Thursday, February 25, 2010

একটি ভেলা, একটি ঝরনা এবং একটি ভ্রমনের সারসংক্ষেপ

লোকটা কাঠুরে। পাহাড়ী বৃক্ষ থেকে জ্বালানী সংগ্রহ করার জন্য ভেলা বানিয়ে উজানে গিয়েছিল। হিমালয়ের বরফ গলা খরস্রোতা নদী। নদীতীরে বসে ভেলাটা দড়ি দিয়ে ধরে রেখে কাঠুরে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল খানিক। দিবানিদ্রার ঝিমানিতে দড়িটা কখন ফসকে গেল হাত থেকে কাঠুরে টেরই পেল না।

সেইক্ষন থেকে ভেলাটার অনিশ্চিত ভাসন্ত জীবন শুরু। দিন যায়, মাস যায়। ভেলাটি নানান আঁক বাঁক ঘুরতে ঘুরতে কোথাও স্থির হতে পারে না নির্জন পর্বত সংকুল অরন্যে। ভাসতে ভাসতে ছোট্ট একটা উচ্ছল ঝর্নাধারার সাথে মিলিত হলো একদিন। যেখান থেকে হিমালয় প্রবাহের নদীগুলোর জন্ম হয় ঠিক সেইখানে ভেলাটি আটকে ছিল একটা ঝোপের লতায়। ঝরনার আনন্দধারা স্পর্শ করলো ভেলাটিকে। তাই প্রথম সুযোগেই ভেলাটি নিজেকে নিশ্চিন্তে ভাসিয়ে দিল পাহাড়ী ঝরনার একাকীত্বে।

ভাসতে ভাসতে ঝর্নাকে সঙ্গী করে প্রকৃতির বিপুল সাম্রাজ্যকে নতুন চোখে দেখতে পেল সে। ঝর্নাধারা তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল বুনো অর্কিডের সাথে, পাথরে লেগে থাকা প্রায় অদৃশ্য সবুজ শেওলার সাথে, অচেনা ডাকের পাখীদের সাথে, ঘাসের কার্পেট বিছানো উপত্যকার সাথে।

দক্ষিন সাগর থেকে উড়ে আসা মেঘেরা যেখানে বাধা পেয়ে বৃষ্টি ঝরায় একদিন ওরা থামলো সেই খানে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছিল উপত্যকা জুড়ে। ধোঁয়াশা সেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ঝর্নাধারা একটা অচেনা অথচ খুব পরিচিত সুরের গান গেয়ে শোনালো তাকে। বৃষ্টি বিষন্ন ভেলাটিকে সেই গান যেন স্পর্শ করলো কোথাও। সেই সাথে বুঝতে পারলো এই আপাতঃ উচ্ছল ঝরনাটির কোথাও লুকোনো ক্ষত আছে একটা।

বৃষ্টি থামার পর আবারো পথ চলা শুরু হলে দেখলো ঝরনার বিষন্ন সুর কেটে গিয়ে তখন উজ্জল রোদ্দুর চিকমিক করছে। দেখে বোঝার উপায় নেই একটু আগে এই ঝরনাটিই করুন সুরে কি গান গেয়েছিল। দিনের পর দিন কলকল করে ঝরনা বয়ে চলে, ঝরনার গান শুনতে শুনতে বয়ে যায় ভেলাও।

পর্বতের উদ্দাম পথ চলা যখন সমতল সন্নিকটে একটু স্থিরতায় এসেছে তখন ভেলাটি ঝরনার কাছে মুখ খুললো, নিজের বহু পুরোনো লুকোনো এক ক্ষতকে উন্মুক্ত করলো ঝরনার কাছে। বেড়ে ওঠার কালে কোন এক আঘাতে তার প্রান বিলুপ্ত হবার পূর্বে সেও ছিল একটা পত্র পল্লবিত সবুজ বৃক্ষ। সেটাই তার আসল পরিচয়। ভেলাটির বর্তমানের পরিচয়হীনতার বেদনা, স্থানচ্যুত হবার বেদনা ঝরনাকে প্রবলভাবে স্পর্শ করলো।

ঝরনা পরম আদরে আশ্রয় দিল ভেলা এবং তার সকল বেদনাকে। একদিন ঝরনারও মুখ খুললো, জানা গেল তারও আছে অজানা বেদনার ইতিহাস। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ভেলাটি আবিষ্কার করলো ঝরনার বেদনা যেন তার চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশী। ঝরনাটি যেই ফল্গু ধারার সাথে বয়ে যাচ্ছিল, এক আকস্মিক ভুমি ধ্বস এসে রূদ্ধ করে দিয়েছিল তার অগ্রযাত্রা। প্রানবন্ত ধারাটিকে মাঝ পথে হারিয়ে ফেলে দিশেহারা মুমূর্ষু হয়ে পড়ে ছিল ঝরনাটি। ঠিক সেই সময়ে ভেলাটিও এসে আটকে গিয়েছিল ঝরনার কাছাকাছি লতাঝোপে।

নতুন মেঘের বৃষ্টিতে যখন ঝরনার বুকে স্রোতের জন্ম হলো, তখন ঝরনাটি প্রান পেল, প্রান পেয়ে প্রথম চোখ মেলে দেখলো ভেলাটিকে। নিঃসঙ্গতা কাটাতে ভেলাকেই তার সব গান শুনিয়ে যায় ঝরনা। ভেলাটিও এতদিন পর পথ চলার আনন্দ পেল। দুজনের একসাথে পথ চলা সেই থেকে শুরু। গন্তব্য অনিশ্চিত জেনেও পথ চলা থামে না। কারন এ ভ্রমন কেবলই ভ্রমন। এ ভ্রমনের কোন গন্তব্য নেই, আছে কেবল আনন্দ।

No comments: