যবনিকা
ধুপ করে ছোট্ট একটা আওয়াজ করেই গুলিটা আশ্রয় নিল আবু রেজার বাম বুকে। রক্তের একটা কালচে ধারা নামছে শার্টের পকেট বেয়ে। বৃষ্টির জলে সয়লাব পুরো শরীর। চাদরে ঢাকা মাথাটা একপাশে এলিয়ে পড়লেও রেজার চোখে মুখে যন্ত্রনার কোন ছাপ বোঝা গেল না পার্কের অন্ধকারে। গুলিটা কতখানি উপভোগ্য ছিল তাও জানার উপায় নেই। ঘড়িতে দশটা বাজার সংকেত দিল কোথাও। ঘাতক আদু শেখ জীবনে কয়েক ডজন খুন করলেও এই প্রথম একটা খুনের পর চোখ জ্বালা করলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা পকেটে ভরে একবারও পেছনে না ফিরে হেঁটে বেরিয়ে গেল সে পার্ক থেকে। বৃষ্টি তখন আরো জোরে নেমেছে।
আরো জীবন, আরো আগের জীবন
দ্বিতীয় জীবনের শুরুটা ভালো না হলেও ওটাই ছিল ভালোর সূচনা। প্রথম জীবনের শেষ ধাওয়াটা খেয়েছিল রেজার আগের কর্মক্ষেত্র থেকে বহিষ্কারের সন্ধ্যাবেলায়। তিনমাসের বেতন বাকী রেখে কারখানা লে অফ ঘোষনা করার পর আন্দোলনে নেমে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে প্রানটাই খোয়াতে বসেছিল দেয়াল টপকাতে গিয়ে। শার্টের কলারে লোহার রড আটকে ঝুলেছিল দেয়ালের অন্যপাশে। কোনমতে ছাড়িয়ে নর্দমার আবর্জনার বুকে আশ্রয় নিয়েছিল সেই বেলা।
ধকল সামলে রেজা বহু পথ ঘুরে এই পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল আধঘন্টার মতো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে গেছে তখন। সেই অন্ধকার পার্কে এক চিলতে আলোর মতো যে শ্যামলা মেয়েটির আগমন ঘটেছিল তার সাথে চাওয়াপাওয়ার কোন যোগ ছিল না। তবে ওরকম বিবশ সন্ধ্যায় তার মতো জ্যান্ত পুরুষের পাশে এসে নিঃসংকোচে বসতে পারে তেমন নারী চেনার বয়স রেজার বহু আগেই হয়েছিল। সেপথে কখনো গমন না করেও জানা আছে কিভাবে ওসব উৎপাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হয়। মেজাজ এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে, দুপুর থেকে না খাওয়া। পকেটে বিশটাকার আস্ত একটা নোটও নেই। প্রথম মন্তব্যটা খুব রুক্ষই ছিল বলা চলে, “যা ভাগ মাগী, অন্যদিকে যা, চোদার টাইম নাই”।
তিথি জীবনে যা কখনো করেনি, যা তার পেশার সাথে, স্বভাবের সাথে সম্পূর্ন বেমানান, তাই করে বসলো। রেজার কাছে এসে তার গালের মধ্যে কষে একটা থাপ্পড় মারলো।
রেজা পুরোপুরি হতবাক। ভাবতেই পারেনি একটা রাস্তার মেয়ে তাকে এভাবে চড় মারতে পারে। জীবনে সে যে কটি চড় চাপড় খেয়েছে তা মায়ের কাছ থেকেই। এমনকি বাবাও কখনো হাত তোলেনি গায়ে। এই মেয়ের এমন দুঃসাহস!! তেড়ে উঠতে গিয়ে দেখে মেয়েটা আবারো চড় তুলেছে, এবার আরো রুদ্রমুর্তি। রেজা চুপসে যায় একটা কথা ভেবে। এসব মেয়ের দলবল থাকে আশেপাশে। ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হবে না। চড় খাওয়াটা পরিচিত কেউ তো দেখেনি। অপমানটা গায়ে না মেখে পিঠটান দেবার প্রস্তুতি নেয় বরং।
মেয়েটা ততক্ষনে একটু হুঁশে এসেছে। শান্ত কন্ঠে বললো,
-একা মেয়ে দেখলে মাগী মনে হয় কেন, আপনাকে এভাবে ভদ্রতা শেখাতে হবে ভাবিনি।
-কি চাও তুমি.........আপনি? তুই থেকে এক চড়ে তুমি, তুমি বলেও মুশকিল লাগলো তাই আপনিতে ফিরে গেল। এবার কিন্তু কন্ঠটা শুনে মেয়েটাকে মনে হচ্ছেনা রাস্তার মেয়ে।
-কিছু চেয়েছিলাম? মুখটা খারাপ না করে বলা যেত না? মেয়েটা যথেষ্ট মার্জিত স্বরে বললো।
-সরি, আমি ভেবেছিলাম ওরকম কেউ..........এই পার্কে কোন ভদ্রমেয়ে আসে না সন্ধ্যাবেলায়। রেজা আমতা আমতা করে বলে।
-ওরকম কাউকে না চাইলে এখানে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছেন কেন?
-এখানে বসে থাকার উপর নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?
-নিষেধাজ্ঞা নাই, তবে সন্ধ্যেবেলায় মতলববাজ লোক ছাড়া কেউ ঢোকে না এই পার্কে। কি করেন আপনি, পেশা কি?
-আপনি কে, পুলিশের লোক? রেজার মনে ভয় ধরলো এবার।
-হ আমি পুলিশ.......আমি হলাম পুলিশের পোষ্য
-মানে?
-মানে পুলিশের খাই, পড়ি, আর পুলিশের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করি
-অদ্ভুত ব্যাপার!
-অদ্ভুত কোনটা, পুলিশের খাওয়াটা নাকি পুলিশকে গাল পাড়াটা
-না, কোনটাই না। আপনিই অদ্ভুত
-আমি অদ্ভুত, কারন আমি পুলিশের বউ। আমার স্বামী এই থানার ওসি।
এটুকু শুনে রেজার বুকে মারাত্মক উটুরপুটুর শুরু হলো। এবার রক্ষা নাই।
-মুখে জবাব নাই কেন সাহেব। ভয় পেলেন নাকি? কি করেন ঠিক ঠিক বলেন। রাতের আঁধারে পার্কে কোন ভদ্রলোক তো বসে থাকে না। আপনার নিশিকন্যাতেও রুচি নেই। কিসে আপনার রুচি। চুরি ছিনতাই?
-কি যে বলেন? রেজা হাসলো তবে অপমানটা গায়ে মাখলো না। পুলিশের বউয়ের চড়টা এখনো জ্বলছে। পুলিশ বেচারা না জানি দৈনিক কটা চড় হজম করে।
-আপনি কি করেন তাতে আমার কৌতুহল নেই। কিন্তু চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোক। কিছু কথা বলি। এই পার্কে বেশীক্ষন বসে থাকবেন না। আমি একটা বাজি নিয়ে এই পার্কে একঘন্টা বসবো বলে এসেছি। আধঘন্টা পেরিয়ে গেছে। আধঘন্টা পর ও আমাকে নিতে আসবে। ওর ধারনা এই পার্কে রাতে কোন ভদ্রমহিলা ঢুকলে ইজ্জত নিয়ে বেরুতে পারে না। আমি ওকে বলেছিলাম পার্ক কেবল দুষ্ট লোকের আস্তানা নয়। খানিক কাপুরুষও মেলে এখানে। ভদ্রলোক একজন পাওয়া গেল চড় খেয়েও চুপ থাকে যে মানুষ। আমি বোধহয় বাজিটা জিতে গেলাম।
রেজার ভাল্লাগছিল না পুলিশের বউয়ের তামাশা। সে যথাসম্ভব ভদ্রভাবে বললো-
-দেখুন, আপনার অনেক দয়া যে আমাকে কেবল চড় দিয়েছেন, পুলিশের হাতে তুলে দেননি। কিন্তু আমি এখন যেতে চাই। অসুবিধে আছে?
-অসুবিধে নেই, যেতে পারেন, যাবার আগে নামটা শুনতে চাই আপনার
-আবু রেজা
-আমি দুঃখিত রেজা। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ। ওভাবে চড় মারা উচিত হয়নি আপনার। কি করেন আপনি?
-জানা কি জরুরী?
-আপত্তিকর কিছু থাকলে দরকার নাই। কিন্তু সাধারন কৌতুহল।
-আপত্তিকর কিছু নেই। আমি এক জায়গায় কাজ করতাম। আজ দুপুরে কোম্পানী লে অফ করে দিয়েছে তিন মাসের বেতন বাকী রেখে। আমরা আন্দোলন করতে শুরু করলে, পুলিশ ডেকে আমাদের দাবড়ানি দেয়। হয়তো আপনার স্বামীই ছিল দাবড়ানির দায়িত্বে। দাবড়ানি খেয়ে মরতে গিয়েও বেচে আছি। খিদা নিয়ে পার্কে শুয়েছিলাম, আপনার চড় খেয়ে তাও গেছে। এখন কোথাও যাবার নেই আমার। বাড়ী ফিরতে পারবো না কারন বাড়ীওয়ালা জিনিসপত্র জব্দ করবে বলেছে আজকের মধ্যে ভাড়া দিতে না পারলে। পকেটে দশ পনেরো টাকার মতো আছে। যা দিয়ে বাকী জীবন কাটাতে হবে........
রেজা বলতে থাকে তিথি চুপ করে শুনে যায়। সবটুকু শুনে তিথির ফ্যান্টাসী বুদবুদের মতো উবে গেল। রেজার পরবর্তী বাক্যটা আরো তলিয়ে দিল তিথিকে-
-আপনার স্বামীকে বলে আমাকে জেলে পাঠাতে পারবেন কোন মামুলি কেস দিয়ে? ওখানে থাকা খাওয়ার একটা বন্দোবস্ত অন্ততঃ হবে।
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল রেজার দিকে। কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। কি বলবে। সত্য বলা উচিত? নাকি লুকোবে। না সত্য কথাই বলি, ভাবলো সে।
-রেজা......আমার নাম তিথি, আমি......আপনাকে আমি সবটা সত্য বলিনি। কিন্তু আপনার কাহিনী শুনে আমার নিজের আসল কথাগুলো শেয়ার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আপনার বর্তমান অবস্থা আমার চেয়েও করুণ, তাই আমি সত্য বলতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি.........
তিথি এবার তার গল্প বলে আর রেজা শুনে যায়। তিথি যখন থামে রেজা অপলক তাকিয়ে থাকে তিথির দিকে। ভেতরে কিসের যেন একটা আলোড়ন। তিথির চোখে নতুন দৃষ্টি এখন, রেজাও বিচিত্র অনুভুতির রাজ্যে বিচরন করছে। চুপ করে বসে আছে ওরা।
অনেকটা সময় কাটার পর তিথি বলে
-এভাবে বসে থাকলে চলবে? কিছু খেতে হবে না? খিদে পেয়েছে খুব।
সেদিনের ওই ঘটনার পরবর্তী দৃশ্যগুলো বাংলা সিনেমাকেও হার মানিয়েছিল। দুজন দুরকম অসহায় মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব, সহমর্মীতার অপূর্ব এক সম্পর্ক। বাংলা সিনেমার কায়দায় খুব দ্রুত সেটা প্রেমে গড়ায় এবং বিয়েতেও। সুখে সংসার করতে থাকে রেজা-তিথি। নিহা, কেকা নামের দুটি ফুটফুটে মেয়ের বাবা-মা হয় ওরা। নার্সারীতে পড়ে পাঁচ বছরের কেকা, আর তিন বছরের নিহা ঘরে বসে অ আ করে গলা ফাটায়।
জীবনের সব লেনদেন কত ভারসাম্যহীন
সুখের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো যদি একদিন বাজার করে ফেরার পথে রেজার রিকশাটা সামান্য দুর্ঘটনায় উল্টে গিয়ে মাথায় মারাত্মক আঘাত না পেত সে। হাসপাতালে চেক আপের সময় একটা টেষ্টের রিপোর্ট আসে সন্দেহজনক। তিথি দুশ্চিন্তায় পড়ে। আবারো টেষ্ট করিয়ে নিশ্চিত করার কথা বললেও এড়িয়ে যায় রেজা। পরে রেজা নিজে নিজে গিয়ে টেষ্ট করায় এবং নিশ্চিত হয়। দেখা যায় মেয়াদ খুব অল্প না হলেও দুবছর খুব বেশী সময় না। কাউকে কিছু বলে না এই ব্যাপারে।
দুই মাস আগে ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবু রেজা এই বেঞ্চিতে এসেই বসে ছিল রাত দশটা পর্যন্ত। মাথার উপরে ঝিম ধরা অন্ধকার। বুকের ভেতর খাঁ খাঁ শূন্যতা। দশ বছরের চাকরী জীবনের সঞ্চিত পাঁচ লাখ টাকার সাথে আরো পঞ্চাশ লাখ টাকা যোগ করেও দুই বছরের বেশী বাঁচতে পারবে না সে। কোন হিসেবই মেলানো যাচ্ছে না। দুই সন্তানের বয়স দশের নীচে। তাঁর অবর্তমানে তিথিকে বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয় দেবার মতো কেউ নেই। নিজে ভালো চাকরী করতো বলে তিথিকে চাকরী করতে দেয়নি। এখন কি হবে? ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে পথে বসবে? চিকিৎসা করালে জমানো টাকা পয়সা সব তো যাবেই, বাঁচারও কোন সম্ভাবনা নেই। শেষমেষ তিথিকে রাস্তায় বসে ভিক্ষা করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। প্রতিদিন অফিস শেষে এই বেঞ্চিতে এসে বসে থাকে রেজা। আকাশপাতাল ভাবে। দশটার পরে বাসায় ফিরে। তিথি খুব বিরক্ত রেজার প্রতিদিন দেরী দেখে। বকাবকি করে, কখনো বা ঝগড়া। রেজা চুপ করে শুনে যায় কিছু বলে না। তিথি পরে অনুতপ্ত হয় ভেবে যে বেচারা অফিসে খুব ঝামেলায় আছে বোধহয়।
এরকম অনেক রাত পেরোয়। দিন আসে দিন যায়। প্রতিদিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে। তবু নিজের সাথে বোঝাপড়া শেষ হয় না। দেড় মাসের মাথায় একদিন পথ খুঁজে পায় পরিচিত একটা লাইফ ইন্সুরেন্সের এজেন্টের সাথে কথা বলে। অসুখের কথা বেমালুম চেপে মোটা প্রিমিয়ামের একটা ইন্সুরেন্স করে ফেলে চোখ বন্ধ করে। গ্রাহকের মৃত্যূর পর নগদ পঞ্চাশ লাখ টাকা পাবে গ্রাহকের স্ত্রী। দুর্ঘটনায় মারা গেলে দ্বিগুন। তাছাড়া আগামী বিশ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়ের শিক্ষা ও ভরনপোষন বাবদ মাসিক পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। অনেক বিলাসী ইন্সুরেন্স প্রিমিয়ামও খুব বেশী। ছমাসে তিন লাখ টাকা মাত্র! তবে রেজা মোটেও চিন্তিত নয় ওটা নিয়ে। কারন মাত্র একবারই দিতে হবে। এরপরও হাতে থেকে যাবে দুই লাখ। সেই দুই লাখ অন্য কাজে। সেই কাজটার খোঁজ করতে শুরু করলো রেজা।
একদিন পার্কেই খোঁজ পেয়ে গেলো সৌভাগ্যের। বসে বসে সিগারেটে আনমনা টান দিচ্ছিল। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। চারদিক নিকষ কালো অন্ধকার। গলার কাছে ঠান্ডা স্পর্শ পেল রেজা হঠাৎ। ‘মিয়া কি আছে দিয়া ফালান, চিল্লাচিল্লি করলে ফাসায়া দিমু’। লোকটার নাম আদু শেখ। এই আদু শেখই তার দ্বিতীয় কাজটা করে দেবার জন্য রাজী হয়েছিল।
অবশিষ্ট বলে কোন বস্তু নেই এক জীবনের
প্রচন্ড যন্ত্রনা আর রক্তপাতপর্ব শেষ হবার পর শরীরটা যখন অবশ হয়ে আসছিল তখন নিথর চোখে বৃষ্টির ছাঁট পড়তেই নিহার কন্ঠটা ভেসে এলো কোথা থেকে যেন। ছোট্ট নিহা বৃষ্টি দেখলেই আবদার করতো- "বাবা, আমি বৃষ্টি যাবো, আমি বৃষ্টি যাবো। আমি তোমাকে ছাতা খুলে দেবো। তুমি আমাকে ছাতা কিনে দিও, আমি স্কুলে যাবো"..........চোখ বুজে আসার পরও যেন শব্দগুলো পাক খেতে থাকে রেজার সিক্ত জুলফির আশেপাশে।
No comments:
Post a Comment