Thursday, February 25, 2010

বারো ঘন্টা বাসভ্রমনের বিনিময়ে তিন ঘন্টার বইমেলা দর্শন

শনিবার সকালে ঘুম ভাঙলো অনির্ধারিত বিলম্বে। বেশী রাত করে না ঘুমানোর ফসল। ‘দেরীতে ঘুমোলে আগে ওঠা হয় আর আগে ঘুমোলে দেরীতে ওঠা হয়’, তেমন একটা বিদঘুটে ব্যাপার হয় আমার। অফিসের গাড়ীটা মিস করে আর কতটা দেরীতে গেলে চাকরী টিকে থাকবে হিসেব করতে করতে একটা ফাঁকিবাজি ভাবনা মাথায় খেললো। আজ অফিসে না গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়? গত তিনমাস ছুটিছাটা বাদে একনাগাড়ে চলছে। আজকে যাবোই না। তারচে অন্য কোথাও যাওয়া যাক। গতপরশু থেকে ঢাকার বইমেলায় যাবার প্ল্যানটা বারবার বাতিল হচ্ছিল সুপরিকল্পনার অভাবে। নাহ, জীবনে সুপরিকল্পিত কাজ কয়টা করা যায়। তারচে বরং একটা অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তই নেই। হলে হবে নাহলে নাই। ঢাকাগামী যে কোন একটা বাসে একটামাত্র সীটও যদি খালি থাকে এই মুহুর্তে, তাহলে আমি ঢাকা যাবো। এক্ষুনি।

গোসল সেরে রেডী হয়ে সোহাগ পরিবহনে ফোন দিলাম পৌনে দশটায়। বললাম, “ভাই এখুনি ছাড়বে ঢাকার তেমন কোন গাড়ীতে একটা আসন হবে কিনা?”

বলা হলো -“হবে, দশটায় একটা গাড়ী যাচ্ছে, পনের মিনিট পর ছাড়বে”। শোনামাত্র একছুটে বেরিয়ে রিকশায় উঠলাম। তারপর বাস। বাসা থেকে বেরুবার আগমূহুর্তে ফেসবুকে ‘বইমেলা যাচ্ছি’ জাতীয় একটা ষ্ট্যাটাস লিখে এসেছি, ঢাকার কারো চোখে পড়লে যোগাযোগ করা যাবে। বাসে বসে মেলায় গিয়ে কাকে পাবো কাকে পাবো না হঠাৎ গিয়ে, ভাবতে ভাবতে ফোন দিলাম রুবেলকে। ও ছাড়া আর কারো ফোন নম্বর নেই। রুবেলকে জানাতে বেশ কাজ হলো। ওর কাছ থেকে দাদুভাই, সুবর্না, সুমনার নাম্বার পাওয়া গেল। ঢাকা পৌঁছার আগেই ফোনে যোগাযোগ হয়ে গেল বিহঙ্গ, সুমনা আর সুবর্নার সাথে। যাক একদম একা থাকতে হবে না গিয়ে। কেউ না কেউ আসবে।

মেলায় পৌঁছে আমারব্লগের ষ্টল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চরকির মতো কয়েকপাক ঘুরে অনুসন্ধান কেন্দ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম- ‘আমি হারিয়ে গেছি,আমাকে খুঁজে নাও’ ষ্টাইলে। তারপর রুবেল এসে উদ্ধার করলো অনুসন্ধান কেন্দ্র থেকে। গিয়ে পরিচিত হলাম ‘নিক চেনা, মুখ অচেনা’ ব্লগারদের সাথে। অমি পিয়ালরে ভাবতাম পোলাটা বয়সে আমার ছোটই হবে, কথা বলে জানলাম আমার এক বছর আগে ইন্টার পাশ দিছে। এবং দেশী লোক। আমার মামাবাড়ীর প্রতিবেশী। ডটু রাসেলকে ভাবতাম কঠিন এক পোলা, কথা বলে দেখি ভীষন অমায়িক এক ভদ্রলোক।

সুমনাকে ভাবতাম আপু আপু লাগবে, দেখি নিতান্ত বালিকা এখনো। বিহঙ্গরে ভাবতাম বড়সড় ঢ্যাঙা সাইজ কেউ হবে, ওমা এতো পিচ্চি পোলা। কেবল আমার সাথে দেখা করার জন্য সুমনা আর বিহঙ্গ মেলায় এসেছে, এই কথা শুনে কী অসাধারন অনুভুতি হলো! হালিমভাইকে যা ভেবেছি, বরাবরই পেয়েছি অবশ্য। আরো কয়েকজনের সাথে আলাপ হলো নাম ভুলে গেছি বলে ক্ষমাপ্রার্থী। তারপর পরিচিত হলাম এবারে মেলার দুজন সেলেব্রিটি সাবরিনা আর সালমা মাহবুব। সালমা মাহবুব যিনি আমাকে একবার ফোনে একটা ব্যাপারে খুব সাহায্যে করেছেন নিজে সমস্যাক্রান্ত হবার পরও। সাবরিনাকে অন্যসুত্রে পূর্ব চেনাজানা থাকলেও মুখোমুখি হলাম, এই প্রথম। কথা বলে ওনার স্নিগ্ধ আন্তরিকতায় সিক্ত হলাম আবারো। সম্পর্কে আমার ভাবী হলেও, তিনি ভাবীর চেয়ে বোন হতে আগ্রহী। আমি চট্টগ্রামে ওনার বাসায় সবপরিবারে দাওয়াত কবুল করে নিস্তার পেলাম।

এরপর মোড়ক উন্মোচন নজরুল মঞ্চে। দলবেধে উঠলাম সবাই। মোড়ক উন্মোচন হলো ছয়টা বইয়ের। পাপড়ি আপার সাথেও এই প্রথম মুখোমুখি। আমার ছোটবোন সুমীমা ইয়াসমিনের সাথে ওনার দীর্ঘদিনের সখ্যতা। যদিও আমার সাথে কালই প্রথম মুখোমুখি দেখা। কিন্তু দেখামাত্র গ্রেফতার করে নিলেন আন্তরিকতায়। হাত ধরে টেনে নিয়ে বড়বোন সুলভ চোখ রাঙানিতে বললেন, ‘এই তোমার আসল নাম বলো, আসল নামে চিনতে চাই তোমাকে’। আমি কাঁচুমাচু। তারপর চড় চাপড়ের ভয়ে বলে দিলাম আসল নাম। উনি হাফিজ ভাইকে(ওনার বর হাফিজুর রহমান) ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে। ভাইয়াকে বললেন ছবি তুলে দিতে। তারপর লুৎফর রহমান রিটনকে এমন জোরে ডেকে আমার সাথে পরিচয় করালেন দেখে যে কেউ ভুল বুঝবে আমি পাপড়ি আপার আপন মায়ের পেটের ভাই। রিটন ভাইও সেই ভয়ে মুখস্ত বলে বসলেন, আরে ব্লগার ‘নীড় সন্ধানী’ তো মারাত্মক লেখে (তবে আমি জানি আর উপরঅলা জানে রিটন ভাই জীবনেও আমার কোন লেখা পড়ে নাই)

এইসব করতে করতে আড্ডা শেষের দিকে গেল। সুমনা বিহঙ্গ বিদায় নিল। আমি ষ্টলে গিয়ে কয়েকটা বই নিলাম। ব্লগারদের বই এখনো আসেনি, ওটার জন্য অগ্রিম পেমেন্ট দিয়ে আসলাম। রাতের বাসেই ফিরতে হবে, সাথে আমার দুই বন্ধু ছিল ওদের নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে কিছুক্ষন স্মৃতিচারন করলাম। পনের বিশ বছর আগে কোন কোন জায়গায় আমাদের আড্ডা হতো সেগুলো নিয়ে হা হুতাশ করলাম। হা হুতাশ করে লাভ নাই। পুরোনো দিন ফিরবে না, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই বর্তমানকে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার কথা বলে সোহাগের মালিবাগ অফিসের দিকে রওনা দিলাম। প্রিয় বন্ধু আমাকে যত্ন করে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল বাসের গোড়ায়।

বাস যখন মাঝ রাতে চৌদ্দগ্রামের হাইওয়ে ইনে এসে পৌঁছাতে ফোন পেলাম প্রিয় বন্ধুর। সে জানালো মেলার আড্ডার ছবি নাকি ব্লগে চলে এসেছে ইতিমধ্যে। বন্ধু বললো, আনস্মার্ট আমাকে নাকি রীতিমত হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে নীল টিশার্টে। ওর বাকবাকুম খুশী আমাকে সেই মাঘ নিশীথের প্রচন্ড শীতকাঁপুনিতেও উষ্ণতার স্পর্শ দিল যেন।

No comments: