Wednesday, January 26, 2011

[অচেনা পাহাড়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামে-চার] স্বচ্ছ জলের কোলাহল পেরিয়ে পূর্বমুখী যাত্রাপথে

দেরী হয়ে গেছে অনেক। কুঁড়েতে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে আসতে অনেক সময় লেগে গেল। এক মাইল হাঁটতে এক ঘন্টা লাগে এখানে। তাড়াতাড়ি দাঁড় বাইতে শুরু করলো ধনু। বিকেলের হিম শীতল হাওয়া দিতে শুরু করেছে। সূর্যকে পেছনে রেখে নৌকা এগিয়ে চললো সামনে। আমি ছইয়ের নীচে হেলান দিয়ে ফোকর দিয়ে আকাশ দেখছি। আকাশের এই নীলটা শুধু এখানে না, সারা পৃথিবীতেই আছে। কিন্তু শংখ নদী ছাড়া দেশের অন্য কোন নদীতে এই নীলের এতটা স্ফটিকস্বচ্ছ বিচ্ছুরণ দেখিনি। পাহাড় চুড়া থেকে থেকে নদীটা দেখে মনে হয় সবুজ পাহাড়ের মাঝখানে কেউ আঁকাবাঁকা নীল আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে।

ধনু বললো এখানে নৌকা বাইতে আরাম। কিন্তু আরো গভীরে গিয়ে নৌকা বাওয়া কঠিন হবে। নদীর গভীরতা কমে আসছে। বছরের এই সময়ে নদীতে পানির প্রবাহ থাকে না। নদীটা সচল থাকে বর্ষাকালেই। বৃষ্টিজলের উপর এত নির্ভরশীলতা আর কোন নদীর নেই। যেখানে গভীরতা কম সেখানে নৌকা টেনে নিয়ে যেতে হয়। পরিশ্রমের কাজ। পরিশ্রমে আপত্তি নেই আমার। কিন্তু মাইলের পর মাইল বরফশীতল জলে নৌকা টেনে নিয়ে যাবার কথা ভাবতেই শিউরে উঠলাম।

নৌকাটা ধনু কিনেছে এক কারবারীর কাছ থেকে। কারবারী সৌখিন মানুষ ছিল। তাই এই নৌকায় সাধারন ডিঙির চেয়ে সুযোগ সুবিধা একটু বেশী। শোবার জায়গাটা বেশ আরামদায়ক। আবার শোবার জায়গায় তক্তা সরালে এক খন্ড বাক্সমতোন, যেখানে দরকারী জিনিসপত্র খাবার ইত্যাদি রাখা যায়। মাথার উপরে ছইটা বেড়া এবং কাঠের যৌথ নির্মান। নির্মান কৌশলও মুগ্ধ করার মতো। ছাদের দিকে অনেকগুলো হুক। সেখানে ঝুলছে হারিকেন, কাপড়চোপড়, এক কাঁদি কলা এবং একটা কাঠের ঘড়ি।

ঘড়িটা আমাকে কৌতুহলী করে তুললো। এরকম অদ্ভুত কিসিমের ঘড়ি কোথাও দেখিনি। গোলগাল কাঠের ফ্রেমের ভেতরে পেতলের একটা পাত। তার ভেতরে ঘড়ির সেকেন্ড মিনিটের কাঁটা। ঘন্টার কাঁটা সবচেয়ে বড়, তার ছোট মিনিট, তার ছোট সেকেন্ড। সেকেন্ডের কাঁটাটা অদ্ভুত। ওটা যেন একটা পাখির ঠোঁট। এরকম উল্টো চেহারার ঘড়ি দেখিনি কখনো। তাছাড়াও ঘড়িটার বাইরের দিকের কাঠের মধ্যে কারুকাজ যা শতবর্ষী পুরোনো হবে মনে হয়। তবে ঘড়িটা বন্ধ। মনে হয় দম দেয়া ঘড়ি, ধনু ভুলে গেছে দম দিতে। অথবা দম ফুরিয়ে গেছে চিরতরে।

আমার কৌতুহলী দৃষ্টি লক্ষ্য করে ধনু বললো, ঘড়িটার একটা ইতিহাস আছে।

-কি ইতিহাস বল
-শুনবি?
-শুনব
-অবিশ্বাস করবি না তো?
-না
-এটা এক পবিত্র ঘড়ি। কাহিনী যদি অবিশ্বাস করিস, তাইলে তোর সর্বনাশ হয়ে যাবে, তুই আর বাড়ী ফিরতে পারবি না জীবনে।
-আমি বিশ্বাস করবো
-ঠিকাছে, তবে তার আগে আমার পরিবারের গল্প বলি

আমাদের আদিগ্রাম ছিল এখন যেখানে থাকি সেখান থেকে অনেক উত্তরে। সাতদিনের হাঁটা পথ। সেই গ্রামে বিরাট সংসার ছিল আমাদের। বাপ ছিল জুমিয়া। জুম চাষে এত পারদর্শী ছিল যে এই পার্বত্য অঞ্চলের এমন কোন এলাকা নাই বাবা জুমচাষ করেনি। বাবার সুনাম ছিল পাহাড়ময়। কিন্তু সে ছিল উড়নচন্ডী টাইপ। আজ এখানে তো কাল ওখানে।

কোথাও স্থিরতা না থাকলেও মানুষ হিসেবে সফল ছিল। তবু ছোট্ট একটা ভুল তাকে জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করলো। সেই ভুলটা কিভাবে ঘটলো বলি।

বাউন্ডুলে হলেও মাসে অন্তত একবার বাড়ীতে আসতো। কিন্তু একবার এমন উধাও হলো যে দু বছর কোন খবর নেই। সবাই ধরে নিল, তাকে বাঘে খেয়েছে নয়তো মিলিটারীতে। তখন মিলিটারী পাহাড়ে হানা দিতে শুরু করেছিল। লোক ধরে ধরে কাজ করায় ক্যাম্পে নিয়ে। কেউ বিরুদ্ধে গেলেই ঠুশ। এরকম ভীতিকর প্রচারণা খুব জনপ্রিয় পাহাড়ে। তাই কেউ 'না' করতো না।

ঘটনা আংশিক সত্যি। আসলে বাবা ঘুরতে ঘুরতে রাঙামাটিতে স্থিত হয়েছিল কিছুদিনের জন্য। যখন কাপ্তাইয়ে চাকমাদের সাথে চাষের কাজ করতো তখন হঠাৎ খবর এলো তাদের চাষের জমিগুলো ছেড়ে দিতে হবে সরকারের কাছে। সরকার এখানে নদীর মধ্যে বাঁধ দেবে। সেই বাঁধে পানি আটকে থাকবে। সেই আটকানো পানি দিয়ে কি জানি করবে। তাতে নাকি এলাকার চেহারা বদলে যাবে। উপজাতিদের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন ঘটবে।

এই জাতীয় কথাগুলো অনেক উপর থেকে সাধারণ মানুষের কাতারে আসতে আসতে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় নয়তো ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে যায়। তাই গ্রামের মানুষ আসল ঘটনা জানতে পেল না। কিন্তু তারা প্রতিবাদে ফেটে পড়লো। বাপদাদার জমি ফেলে দিয়ে পাহাড়ে উঠে বসে থাকতে হবে। পেটে দানাপানি দেবার কি হবে। জুম চাষ করে কটা ধান হবে। এতে বছর কাটবে কি করে? এটা কিছুতেই মানা যায় না।

বয়ষ্করা বললো, ঝামেলায় গিয়ে কাজ নেই। তারা ঝামেলা চায় না। সমতলের মানুষদের চেনা আছে ওদের। ইতিহাস বলে ওদের চোখ একবার যেদিকে পড়েছে, সেদিক ছারখার করেছে। মোগলরা তাদের তাড়িয়ে পাহাড়ে তুলে দিয়েছে। ইংরেজরা তাদের কোনঠাসা করে রেখেছে। আর এখন পাকিস্তানীরা তাদের পাহাড় থেকেও উচ্ছেদ করে কোন নরকে পাঠাতে চায়। না চাইলেও সেই নরকেই বাস করতে হবে। ওদের জাতির কোন স্বীকৃতি নেই, তাই ওরা 'উপজাতি'।
আপোষকামী বয়স্কদের এই মতে সায় দিল না তরুনেরা। তরুনেরা সংখ্যাগরিষ্ট। তারা মানলো না। ভেতরে ভেতরে ফুসতে থাকে তারা। ভিন্নজাতির লোক হয়েও বাবা তাদের সাথে যোগ দিল।

বাবার এই চাকমা জাতির ভেতর ঢুকে যাওয়ার পেছনে অন্য একটা কাহিনী জড়িত ছিল তখন কেউ জানতো না। যে গ্রামে বাবা চাষবাস করতো, সেই গ্রামের একটা মেয়ের সাথে বাবার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সেই মেয়েটি গর্ভবতী হয়। ঘটনা জানাজানি হলে এলাকায় কেলেংকারী লেগে যায়। তাকে খুন করার জন্য ছুটে আসে কেউ কেউ। অবশেষে ধরে নিয়ে মিলিটারীর হাতে তুলে দেয়। মিলিটারী বাবাকে ধরে নিয়ে যায়।গ্রামে কেবল এই খবর পৌছে যে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে দেশদ্রোহীতার কারণে। কাপ্তাই এলাকায় যে বাঁধ দেয়া হচ্ছে সেই বাঁধ নির্মানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করেছে।

ব্যাপারটাতে রাজনৈতিক প্রলেপ দেয়াতে কেলেংকারীর সংবাদটা চাপা পড়ে যায়। বছর দুয়েক জেলে থাকার পর মুক্তি পেয়ে বাবা প্রথমেই কাপ্তাই গিয়ে দেখে সমস্ত এলাকা তলিয়ে গেছে কর্নফুলীর নীচে। বন্যার পানি থৈ থৈ করছে চারপাশে। এখান ওখানে বিশাল পাহাড়গুলো এখন কেবল কোনমতে মাথাটা উচিয়ে দাঁড়িয়ে। যেখানে ছিল সজীব সবুজ ফসলী জমি সেখানে মাইলের পর মাইল থৈ থৈ করছে অঢেল পানি। এত বাড়ী ঘর মানুষ গরু ছাগল কোথায় গেল?

আর মিতিয়া? তার পেটের সন্তান? পাগলের মতো হয়ে গেল সে। এতগুলো মানুষ স্রেফ ডুবে মারা যেতে পারে না।

ছোটাছুটি করে খোঁজ খবর নিয়ে জানলো কিভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার জুম্ম পরিবার এদেশ ছেড়ে চলে গেছে।

খোঁজ করতে করতে প্রায় চারমাস পর সীমান্তের ওই পাড়ের একটা গ্রামে খোঁজ পেল তার মিতিয়ার। ধোঁয়া ওঠা রান্নাঘরে বসে শাকপাতা সেদ্ধ করছে,পাশে দাঁড়ানো উস্কোখুশকো চুলের এক বালক। গায়ের রং তারই মতো, চিনতে বাকী রইলো না তার। ঘরে পুরুষ কেউ ছিল না তখন। সে মিতিয়াকে নিয়ে পালিয়ে চলে আসে নিজের গ্রামে। কিন্তু গ্রামে ফিরে ঠাই হয়না বাবার নতুন বউয়ের। চাকমা মেয়ে বিয়ে করেছে বলে বাবাকে সবাই মিলে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। সে গ্রাম ছেড়ে মিতিয়াকে নিয়ে চলে যায় দক্ষিনের অজানা উপত্যকার দিকে যেখানে কোন মার্মা পল্লী নেই।

মুরংদের এলাকায় এসে নতুন করে ঘর বাধলো বউ ছেলে নিয়ে এবং সেই ছেলেটি হলো এই ধনু মার্মা।

এটুকু বলে থেমে গেল ধনু। গল্প শেষ? আমার চোখে প্রশ্ন। ধনুর গল্প হলো, কিন্তু ঘড়ির গল্প কই? ধনুর চোখে কেমন যেন একটা হঠাৎ বিরক্তি। সামনের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখে একটা হতাশা দেখা গেল তার চোখে। গল্পের ভেতর এতটা ডুবে গেছিলাম যে কখন অন্ধকার নেমে এসেছে টেরই পাইনি। ধনু নৌকাটাকে তীরের একটা জায়গায় লাগালো।

-এটা কোন জায়গা? জানতে চাইলাম আমি।
-নাম জানি না এই জায়গার, তবে থিন্ডু পাড়া এখনো আসেনি। থিন্ডু পাড়ার আগে একটা কালো পাথর আছে বাম পাড়ে। ওই জায়গা এখনো আসেনি। ভাবছিলাম থিন্ডু পাড়ায় গিয়ে নাপ্পি খেয়ে গা গরম করবো। তোকে নিতে গিয়েই হলো না।

তাকে অসন্তুষ্ট মনে হলো রুটিন প্ল্যানে ব্যাঘাত ঘটাতে। রাতের বেলা এই জিনিস না হলে অনেকেরই চলে না। আমি নিজে ওই পানীয়তে আসক্ত নই বলে ধনুর ক্ষতিটা পরিমাপ করতে পারলাম না। কেবল তার গল্পের বাকী অংশটা শোনার জন্য চুপচাপ অপেক্ষা করছি। কিন্তু সে গম্ভীর। বাকী গল্পটা বলবে কিনা সন্দেহ আছে। তবু জিজ্ঞেস করলাম।

-তারপর? ঘড়িটার কথা বল।

ধনু নিরুত্তর। নৌকাটা একটা গাছের সাথে বেঁধে রেখে লাফ দিয়ে নেমে জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেল। আমি কেডসের ফিতাটা আলগা করে আয়েশ করে বসলাম। জঙ্গলের এই নিকষ কালো অন্ধকার রূপটাকে মোটেই ভীতিকর মনে হচ্ছে না। ভেতরটা নিরেট অন্ধকার হলেও নদীর অংশে আলোর আভা। তীরের জঙ্গলে লক্ষ লক্ষ জোনাকীর আলো উৎসব। মুগ্ধ হয়ে দেখছি।

ধনু গেল কোথায়? ব্যাটার মর্জি বোঝা ভার। তুই নৌকা আস্তে চালাইছস, সেজন্য দেরী হইছে, আমি কি জানি তোর থিন্ডুপাড়া কয় মাইল? আরে একরাত নাপ্পি না খেলে কি মরে যাবি নাকি? মনে মনে ঝগড়া শুরু করে দিলাম ওর সাথে। কিন্তু গেল কই ব্যাটা?

ঠিক সেসময় জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা প্রবল আলোড়ন সাথে একটা অচেনা গর্জন ভেসে এলো। খাইছে, ওখানে কি হচ্ছে? ভয়ে আমার কলিজাটা পিঠের দিকে লাফ দিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেই গর্জনের সাথে ধনুর আর্তনাদ যোগ হয়ে আরো ভয়াবহ আবহ সৃষ্টি করলো। আমি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখি অন্ধকার চিরে তীরের মতো জঙ্গল ফুড়ে বেরিয়ে আসছে ধনু। এক লাফে নৌকায় উঠে টান দিয়ে দড়ি খুলে বৈঠা দিয়ে ঝড় তুললো নদীর পানিতে। তীর থেকে বেশ কয়েক গজ দূরে যাবার পর থামলো। ভোস ভোস করে নিঃশ্বাস ফেলছে সে। আমি তখনো ভয়ে পাথর, নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছি। ব্যাপার কি, কিছুই বুঝতে পারছি না।

খানিক থিতু হয়ে ধনু খিক খিক করে হারামি টাইপের হাসি দিল একটা। বললো সে গেছিল প্রাকৃতিক কর্ম করতে। কিন্তু ঢালুতে যে একটা বদরাগী শুয়োর ঘুমিয়ে ছিল সে দেখেনি অন্ধকারে। শুয়োরের গায়ের উপর সরসর করে পড়া মাত্রই জেগে উঠে এমন ক্ষ্যাপাটে দাবড়ানি দিয়েছে ধনুকে....বলতে বলতে আবারো হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে ধনু। এতক্ষণে আমিও হাসিতে যোগ দিতে পারলাম যদিও ভেতরে কলিজা আর ফুসফুসের মধ্যে তুমুল আন্দোলন চলছে তখনো।

ধনুকে গল্পের বাকী অংশের জন্য তৈরী করার জন্য আমি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে।

ধনু বললো, রাতের বেলা নৌকা তীরে ভিড়ানোর চেয়ে মাঝনদীতে রাখাই নিরাপদ। ব্যবস্থাটা আমারও পছন্দ হলো। নদীতে রাত কাটানোর ব্যাপারটা দারুণ মজার। হালকা চালে দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়া।

কিন্তু এখন ঘুমোলে চলবে না। গল্পের এখনো অনেক বাকী। ধনু বললো, খিদা পেয়েছে, রান্না করা লাগবে। খাওয়াদাওয়া সেরে গল্প হবে। সে রান্না করতে লেগে গেল নৌকাটা যুতসই একটা জায়গায় বেধে।

আমি একপাশে হেলান দিয়ে বসে অনির্দিষ্ট চোখে বাইরে তাকিয়ে আছি। প্রাগৈতিহাসিক আমলের ছোট্ট একটা হারিকেন জ্বলছে ছইয়ের সাথে আটকানো হুকের সাথে ঝুলে। মনে হয় জন্মাবধি চিমনিটায় কেউ হাত দেয়নি। এমন কালো হয়েছে ওটা ছেদ করে আলোর কনাগুলো আমার কাছে আসতেই খাবি খাচ্ছে। আলোর সাথে অন্তত অর্ধেক আসছে আঁধারের কনা।

আচ্ছা এই টিমটিমে হারিকেনের আলোর গতিও কি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল? অলস মস্তিষ্কটা শয়তানের কারখানা হলেই বুঝি এ জাতীয় উর্বর চিন্তা ভাবনার আগমন ঘটে।

[অচেনা পাহাড়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামে-তিন] শংখ নদীর উৎসে, আরো গহীন অরণ্যের সন্ধানে

কতোক্ষণ ঘুমিয়েছি বলতে পারবো না। কিন্তু মোটামুটি পোয়াখানেক রক্ত শরীর থেকে মাইনাস হবার পর হুঁশ হলো। গলা, গাল, হাতের কবজি পর্যন্ত ফুলে ঢোল করে ফেলেছে হুলডোজার বাহিনী। ভুলে গিয়েছিলাম অডোমস মেখে শুতে। মোম জ্বালালাম। তারপর বাঁশের কঞ্চি খুঁজে নিয়ে চুলকানির ঝড় তুললাম একটা। গলা, গাল ঠোট যে পরিমান উঁচু হয়েছে স্বয়ং হালাকু খানও ভয় পাবে আমাকে দেখে।

ফোকড় দিয়ে বাইরে তাকালাম। যথারীতি কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার। দিকপাল বোঝার উপায় নেই। চুলা জ্বেলে গরম পানি বসালাম। ব্যাগ থেকে কাজু বাদামের টিন খুললাম। অল্প কয়েকটা খেয়ে চা বানালাম খুব করে চিনি দিয়ে। যা রক্ত খেয়েছে চিনি দিয়ে হলেও পুরনের চেষ্টা। চা খেয়ে অডোমস ক্রীম মেখে কুঁড়ের বাইরে আসলাম লাঠি হাতে। আজকে কোন উৎপাত নেই। পোকাদের অবিরাম কিটিমিটি শব্দ আর দূরে কোন ফাঁকিবাজ কুকুরের অলস ডাক বাদে কোথাও কোন শব্দ নেই। এরকম সময়ে জ্যোৎস্না থাকলে অপূর্ব সৌন্দর্য দেখা যেত উপত্যকায়। সিগারেট ধরিয়ে আরাম পাচ্ছি না। এ জায়গায় একটা নারকোলের খোল দিয়ে বানানো হুঁকো নিয়ে গুড়গুড় করে ধোঁয়া ছাড়লে মানানসই হতো।

বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না। বাতাসে কান ব্যাথা করছে। কুঁড়েতে চলে এলাম। বাইরে ভয়াবহ ঠান্ডা। ভেতরে খানিকটা কম। শুয়ে পড়লাম মুখের উপর তোয়ালেটা ঢাকা দিয়ে।

কুত্তার বাচ্চা।

না গালি না। সত্যি সত্যি একটা কুকুরছানা কখন এসে কুঁড়ের এককোনে ঘুমিয়ে পড়েছে জানি না। মচমচ শব্দে আমি উঠে দাঁড়াতে সে জেগে উঠলো তড়াক করে, তারপর কুঁই কুঁই শুরু করলো। আমার কুকুরপ্রীতি নেই। কুকুর দেখলেই গদাম দেই। কিন্তু এই বেচারাকে দেখে মায়া লাগলো। এই ঘরের মালিক আমিও না সেও না। দুজনই ইমিগ্রান্ট। তাই ওকে ঠিক অনাহুত মনে হলো না। খিদে পেয়েছে বেদম। ওকে রেখেই আমি রান্না করতে বসলাম।

খিচুড়ী রান্না করে ওরেও খানিক ভাগ দিলাম। খাওয়া সেরে চলে যাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু ব্যাটা দেখি আমার পায়ে পায়ে ঘুরে। এইটা আমার খুব বিরক্ত লাগে। লাথি উঠাতে গিয়েও সংযত হলাম। ঘরের কাজ কি কি আছে হিসেব করলাম। নদীতে যেতে হবে যথারীতি পানির জন্য। পরপর দুইদিন খিচুড়ি খেয়ে অরুচি এসে গেছে। তাছাড়া কাচামরিচ ছাড়া জমছে না। শাকটাক কিছু পাওয়া গেলে সেদ্ধ করে লবন দিয়েও খাওয়া যেত।

ভোরের অন্ধকার কেটে রোদ হেসে উঠলে বেরুলাম কুঁড়ে থেকে। আজকে বাতাস আছে খানিক। পাহাড়ী বাতাসে কেমন একটা শব্দ থাকে। কিন্তু তারচেয়ে যেটা কানের ভেতর কুলকুল করছে সেটা হলে শীতের কামড়। এই বাতাস দেখতে নিরীহ, কিন্তু কামড় কঠিন। মাফলার নাই। কানে গামছাটাই বেধে নিলাম। আজকের ট্রেকিং হবে সবজি সন্ধান। দুপুরের মেনুটায় ব্যতিক্রম আনা চাই।

আজকে গোসল করবো না। এই শীতে নদীতে নামলে হাড্ডিসহ বরফ হয়ে যাবে। কিন্তু এই নদীটায় যাদু আছে, বন জঙ্গলে দুতিন ঘন্টা ঘুরে কখন যে অন্য পথে নদীর কাছে চলে এসেছি। বাংলাদেশে যত নদী আছে সবগুলোর সৌন্দর্য একত্র করেও শংখ নদীর সাথে পারবে না। অথচ এই নদীটাই সবচেয়ে কম আবিষ্কৃত। সবচেয়ে কম মানুষ যাতায়াত করে এই নদীতে। সবচেয়ে কম নৌকা ভাসে এখানে। এদিকের এলাকাটা তো সভ্যতা বিবর্জিত।

এরকম আরো এক দেড়শো কিলোমিটার ভেতরে চলে গেছে এই নদীটা। প্রথম যেদিন এই নদীর সাথে দেখা হয় সেদিনই প্রেমে পড়ে যাই। আকাশের নীল যেন কেউ বিছিয়ে দিয়েছে এই নদীর ভাজে ভাজে। শংখ একদম আদি অকৃত্রিম বাংলাদেশী নদী। সবচেয়ে বেশী বাক নেয়া নদীও এটি। এই নদীর উৎসে যাবার একটা ইচ্ছে চাপা আছে এখনো।

আরে, ওইটা কি দেখা যায় ওদিকে, নৌকা না? ওই পাড় ঘেষে দক্ষিন দিকে যাচ্ছে। কেন যেন আমি চিৎকার করে ডাক দিলাম- বদি আলম!!!

এটা একটা চাটগাঁর ফাইজলামী ডাক। কাহিনী আছে এটার। আমার ডাকটা অতদূরে গেল কিনা নিশ্চিত না, তবে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে একটা ইকোর সৃষ্টি করলো। বোঝা গেল, ওইপাড়েও পৌছে গেছে। কারণ নৌকাটা ঘুরছে। এদিকে আসছে মনে হলো। ওটাকে আসতে দেখে তাৎক্ষনিক একটা নতুন প্ল্যান মাথায় ঢুকলো। দেখি কাজ হয় কি না।

দশ মিনিটেই কাছে এলো নৌকাটা। এটা ঠিক নৌকাও না ছোট্ট ডিঙি বলা যায়। মাথার উপর তালপাতার বেড়া দিয়ে ঢাকা। দাঁড় বাইছে নিরীহ চেহারার উপজাতি এক মানুষ। আমাকে দেখে প্রথমে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। অপ্রসন্ন সুরে পাহাড়ী ভাষায় কি জানি বললো। বুঝলাম না।

বোধহয় কোত্থেকে এখানে মরতে এসেছি জানতে চাইল। ভাষা না বুঝলে তো উদ্দেশ্য বোঝানো মুশকিল। আমার বাংলা ভাষাও তার কাছে অবোধ্য মনে হলো। খানিক পর চাটগাইয়া ভাষায় কথা বলে উঠতেই তার মুখ উজ্জ্বল দেখালো। এই ভাষা সে মোটামুটি বোঝে। আলাপ জমে উঠলো শীগগির।

এটা সেটা বলে খাতির জমিয়ে ফেলতে সময় লাগলো না। পাহাড় নিয়ে আমার মুগ্ধতাকে সে সম্মান জানিয়ে তার নৌকায় দুপুরের আহারের নিমন্ত্রন করলো। এবার আমাকে পায় কে। কথায় কথায় জেনে গেলাম তার নাম ধনু মার্মা। তার বাড়ী থানচিতে। রুমা বাজারে কাজে এসেছিল দুইদিন আগে। আজ ফিরে যাচ্ছে কাজ সেরে। বাঁশকোড়া দিয়ে টুইট্টা মাছের ঝোল রান্না করছে সে। ডেকচিতে আরো কি কি লতাপাতা দিয়েছে। সুগন্ধ মৌ মৌ করছে। কতোকাল পরে যেন অতীব তৃপ্তির সাথে দুপুরের ভাত খেলাম। এত মজার রান্না হয়েছে যে, আমি ডেকচির তলানিও খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে ধনুকে একটা সিগারেট অফার করলাম। লাজুক মুখে ধনু সিগ্রেট ধরালো। বললো, সে হুঁকো খেয়ে অভস্ত। তবে সিগারেটের শখ আছে। ভালো সিগারেট পেলে খায়। আমারটা বেনসন, নিঃসন্দেহে ভালো সিগারেট।

ধোঁয়া টানতে টানতে মোক্ষম সময়ে আবদারটা পাড়লাম।

"তোমাদের বাড়ীতে নেবে আমাকে?" গলায় যথাসম্ভব মধু ঢেলে বললাম।

আমার কথা শুনে ধনু এক সেকেন্ডের জন্য চমকে গেল যেন। এ আবার কেমন প্রস্তাব। তারপরই হেসে দিল। বললো, আমাদের আর বাড়ী কই। থাকি পাহাড়ের কিনারের ছোট একটা খুপড়ি ঘরে। ওসব তোমার ভালো লাগবে না। তাছাড়া বহুদুর। যেতে অনেক সময় লাগবে। দুইদিনের পথ এখান থেকে।

আমি বললাম, কতো আর লাগবে, থানচি আর কতোদূর। লাগুক। কিন্তু আমি যেতে চাই। তুমি নিবা কিনা বলো।

ধনু গাঁইগুই করছে। বললো, থানচির শেষ মাথায় ওর গ্রাম। ওখানে যেতে হাটতে হয় প্রচুর। এরকম আরো নানান অজুহাত। ওর আপত্তির রহস্যটা বুঝলাম না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না, এটা একটা কারণ। কিন্তু আমি একা ওদের কি ক্ষতি করবো। এত ভয় পাবার কি আছে। নাকি বিনা পয়সায় ওর নৌকায় করে যাবো, সেজন্যই আপত্তি। আমিও নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইলাম। এই সুযোগ হারানো যাবে না হেলায়। শংখ নদীর উৎসের পথে যাবার সহজ কোন পথ নেই। বললাম, ধনু কতো টাকা দিলে নেবে তুমি?

কথাটা বোধহয় রুক্ষ হয়ে গেল বেশী। ধনুর আত্মভিমানে লাগলো। গটগট করে যা বললো তার সারমর্ম হলো- আমি নৌকার মাঝি না। ভাড়া নেবো কেন। তুমি কি করে ভাবলে আমি মেহমানের কাছ থেকে ভাড়া নেবো? ইত্যাদি।

আমি সরি জাতীয় কিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু চাটগাইয়া ভাষায় সরি বলে কোন বস্তু নেই। তাই তার হাত দুটো ধরে, সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই এটা খা, মাথা গরম করিস না। দুষ্টামি করছি তোর সাথে। পুরো প্যাকেটটা তার হাতে দিয়ে দিলাম।

চট করে তুই তোকারীতে চলে যাওয়াতে সে আমোদিত হলো মনে হয়। এটা একটা পুরোনো টেকনিক, এক গুরু শিখাইছিল। এবার সে খুশী। আপন মনে বিড়ি টানতে টানতে বললো, আমরা খুব গরীব। তোরে রাখি কই। এক ঘরে থাকি বউছেলেমেয়ে নিয়ে। তুই গেলে তো একদিনে আসতে পারবি না। কদিন থাকতে হবে একটা ফিরতি নৌকা যোগাড় হওয়া পর্যন্ত। তাই তোকে নিতে চাইনি।

আমি বললাম, আমার থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি গাছতলাতেও থাকতে পারবো। তবে তোর আপত্তি না থাকলে এই নৌকা আমার ঘর হবে। আমি নৌকায় ঘুমাবো রাতে। তোর অসুবিধা আছে? নাকি আমাকে অবিশ্বাস লাগে?

এবার সে এসে আমার দুহাত জড়িয়ে এমনভাবে তাকালো মনে হলো আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্বাসী বন্ধু হয়ে গেলাম দুঘন্টার আলাপেই।

[চলবে....]

Monday, January 17, 2011

ওশিনের স্কুল

ওশিনের স্কুল নিয়ে বিরাট টেনশান ওর মায়ের। মেয়ে স্কুলে ভর্তি হবে সেজন্য মায়েরা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো প্রস্তুতি নেয়। খুকীর টেনশান দেখে আমি মুখটিপে হেসেছি। মেট্রিক পরীক্ষা দেবার সময় না জানি কিরকম করবে। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল বাংলা স্কুলে পড়াবো। আমি যেরকম স্কুলে পড়ে এসেছি সেরকম স্কুল। আমি আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর সরকারী প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৭৪ সালে। সাদামাটা স্কুল। যেটাকে ব্যঙ্গ করে কাউয়া স্কুল বলা হতো। সব ভাইবোন সেই স্কুলেই পড়েছি। কিন্তু এখানে ওরকম স্কুল কোথায় পাই। এখন আমরা কাজীর দেউড়ীতে। গলির ভেতর একটা স্কুল আছে অবশ্য। সরকারী প্রাইমারী। কিন্তু ওখানে দরিদ্র ছেলেমেয়েরা পড়ে, তাই ওখানে আমাদের সন্তানদের যেতে দেয়া হবে না। ওখানে কেবল টিকা দেবার জন্যই যাওয়া হয়।

কাছে পিঠে সিজিএস আর সেন্টমেরিস স্কুল আছে। সিজিএস ইংরেজী স্কুল, আর সেন্ট মেরিস যুদ্ধক্ষেত্র। আমি রাজী হলাম না। আমি প্রতিযোগিতার মারামারিতে নেই। সহজ একটা বাংলা স্কুল দরকার। যেখানে বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য বইয়ের বস্তা দেয়া হয় না। আনন্দের সাথে পড়াশোনা করানো হয়। ইংরেজী বাদে সেরকম স্কুল নাকি আর নাই। আমার কঠিন ইচ্ছে ইংরেজী স্কুলে পড়াবো না। কেন ইংরেজী স্কুলের বিপক্ষে সে ব্যাপারে ব্লগে প্রচুর লেখালেখি করেছি। এখানে লিখলাম না আর।

খুঁজতে গিয়ে কাছাকাছিই আরেকটা স্কুলের সন্ধান পেলাম। ফুলকি। এই স্কুলের নাম শুনেছিলাম। কিন্তু কোথায় কিভাবে পড়ায় জানতাম না। খবর নিয়ে জানলাম আমি যেরকম স্কুল চাই এটি সেরকম একটি স্কুল। কেবল খেলার মাঠ নেই। স্কুলের অবস্থানটাও চমৎকার জায়গায়। নন্দনকাননে, ডিসি হিলের উল্টোদিকে।



View Larger Map

খেলার মাঠ নেই এটাকে মেনে নিয়ে তাই ফুলকি থেকেই ভর্তি ফরম নিলাম।

ভর্তি পরীক্ষার দিন ছিল কঠিন একটা দিন। সে কিছুতেই পরীক্ষা দিতে একা ঢুকবে না। বাবা মা সহ ঢুকতে হবে। দুটোর সময় ওর পরীক্ষার শিডিউল ছিল। শেষে ছটার সময় সবার শেষে বাবা-মা সহ ওশিন মাহিয়াত ইতিহাস সৃষ্টি করে ইন্টারভিউ দিতে ঢুকলো। ইন্টারভিউ ভালো দিল। রেজাল্ট বের হলে দেখি, পাশ করেছে। দেরী না করে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করে ফেললাম।

স্কুল পেলাম। পরীক্ষা দিল। পাশ করলো। ভর্তি হলো। ভাবলাম টেনশান গেল। কিন্তু না। এবার নতুন টেনশান। যে মেয়ে পরীক্ষা দিতে ঢোকেনি পাচ মিনিটের জন্য, সে কি করে স্কুলে ক্লাস করবে।

১০ জানুয়ারী থেকে স্কুলে ক্লাস শুরু। ওর মা ওর ফুপু দুজনে মিলে নিয়ে গেল। নাহ। কিছুতেই ক্লাসে ঢুকলো না। কান্নাকাটি করে গেটের বাইরে চলে এল। প্রথমদিন পুরো ব্যর্থ।


স্কুলের প্রথম দিন। বিশেষ একটা দিন। মহাসমারোহে ওশিন বিদায় নিচ্ছে দাদুর কাছ থেকে।

...........................

ফুপুর সাথে বাসা থেকে বেরিয়ে

......................

ওশিনদের স্কুলের গলি। গলিমুখ দিয়ে দেখা যাচ্ছে ডিসি হিল পার্কের আভাস। স্কুলটা ডিসি হিলের উল্টোদিকের ঢালে অবস্থিত।

............................

স্কুলের প্রথমদিন। স্কুলের সিড়িঘরে বসা মা মেয়ে দুজন। ওর মা ওশিনকে বুঝিয়ে ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ওশিনের চেপে রাখা ঠোটদুটো বলে দিচ্ছে। 'কিচ্ছুতেই যাব্বো নাহ'!!!


দ্বিতীয় দিন আবারো চেষ্টা করা হলো। এবার বারান্দা পর্যন্ত গিয়েই ফিরে এল। খুকী হতাশ। আমি আশাবাদী। ৩য় দিন ক্লাসে ঢুকলো অবশেষে। খুশী মনে ফিরে এল। বললো, স্কুলটা খুব ভালো, টিচার খুব আদর করেছে, খেলাধুলা বাদে কোন পড়ালেখা নেই। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কিন্তু ৪র্থ দিন আবারো বিগড়ালো। ফিরে চলে এল কান্নাকাটি করে। অনেক বুঝিয়ে ৫ম দিনে মোটামুটি রাজী করানো হলো। হলো ঢুকতে। ষষ্ঠ দিনেও গেল। ওর মার মুখে একটু হাসি ফুটেছে। কিন্তু আগামীদিন এখনো অনিশ্চিত। কিছুদিন এই টেনশান থাকবে। আগামী দিন ওশিন স্কুলে যাবে তো?

Sunday, January 9, 2011

বিস্ময় ও প্রযুক্তি

মানুষের আনন্দিত হবার ক্ষমতা নাকি নির্ভর করে বিস্মিত হবার ক্ষমতার উপর। যার চোখে যত বেশী বিস্ময় সে তত বেশী সুখী মানুষ। শিশুরা যা দেখে তাতেই বিস্মিত হয়, আগে কখনো দেখেনি বলে। তাই শিশুদের জগত আনন্দময়। সে বস্তি শিশু হোক কিংবা প্রাসাদ শিশু। পার্থক্য এক জায়গাই, বস্তি শিশু কাঁদে ক্ষুধার যন্ত্রনায়, প্রাসাদ শিশু কাঁদে খাবার নিয়ে পীড়াপীড়ি যন্ত্রনায়।

প্রসঙ্গ বদলে যাবার আগে লাইনে ফিরে আসি। বিস্ময় বনাম আনন্দ।
আধুনিক মানুষের সবচেয়ে আনন্দের জগতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি করছে প্রযুক্তি। যে যত বেশী প্রযুক্তিসমৃদ্ধ, সুখী হবার ক্ষমতা তার ততই অবমূল্যায়িত। রেডিওর মতো তুচ্ছ জিনিসের কথা নিউটন কিংবা আর্কিমিডিসের মতো মহাবিজ্ঞানীও কল্পনা করতো না। একটা সাধারন নকিয়া ১২০০ মডেলের মোবাইল দেখেও স্বয়ং আইনস্টাইন লাফ দিয়ে উঠতো, আর আইফোন বা গ্যালাক্সী দেখলে নিশ্চিত ফিট খেতো। আজকাল চারপাশে প্রযুক্তি পকেটে পকেটে। আগামী ৫০ বছরে প্রযুক্তি কোথায় পৌছাবে সেটা কল্পনা করাও মুশকিল। প্রযুক্তির প্রবৃদ্ধি হয় গানিতিক হারে।

প্রযুক্তি সুখ কেড়ে নিচ্ছে কিভাবে? বই পত্রিকা লেখালেখি, অবসরে সাহিত্য রসিক মানুষদের তিনটি প্রিয় বিষয়। আজকাল প্রযুক্তি আমাদের সময় দখল করে নিয়েছে অনেকটাই, দিনে ২৪ ঘন্টা সময়ে কুলোয় না। একদিনে নিদেন পক্ষে ৩৬ ঘন্টা থাকা দরকার।

দিনের মধ্যে কাজ দশ ঘন্টা, ঘুম ছয় ঘন্টা বাদ দিলে, বাকী ৮ ঘন্টার ৪ ঘন্টা রাস্তার জ্যামে, বাকী ৪ ঘন্টা মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, আর টেলিভিশনের দখলে। এই চার জিনিস মিলে আমাদের অবসরগুলো খুবলে খুবলে খেয়ে নেয়। আর বই, খাতা, কলম হাতে নিয়ে বসার ইচ্ছে টুকু প্রতিদিন একটু একটু মরে যায়। যারা ইন্টারনেট ব্লগ ফেসবুকে আটকানো থাকে তাদের কেউ দিনে একবারও বই খাতা কলম এই তিনের একটাও স্পর্শ করে কিনা সন্দেহ আছে। নিজের কথা ধরে বলি, সাইন করা ছাড়া কলম দিয়ে অন্য কোন কাজ করিনা বহুদিন।

প্রযুক্তির সাথে আনন্দ একেবারে নেই সেটা ঠিক না। আনন্দ আছে কিন্তু সেটা খুব সংক্ষিপ্ত। ফাষ্ট ফুডের মতো। আগে মনে হতো পুরোনো দিনের মানুষ কতো দুর্ভাগা ছিল। প্রযুক্তি বিহীন দিন কাটিয়ে মরে গেছে বেচারারা। আর আজকাল মনে হয়, ওরাই ভাগ্যবান ছিল। এখন জীবিত যারা, তাদের মধ্যে বয়স্করা সবচেয়ে কম প্রযুক্তি জীবন কাটিয়েছে, তারাই সবচেয়ে বেশী আনন্দময় সময় পেয়েছে জীবনে। যারা কমপক্ষে চল্লিশোর্ধ তারাও জীবনের ২/৩ অংশ প্রযুক্তিবিহীন সময় পেয়েছে।

কিন্তু যারা সদ্য বিশ পেরিয়েছে? তারাতো প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই প্রযুক্তির জালে আটকে পড়েছে। আর যেসব শিশু এখনো পাঁচ বছর পেরোয়নি, তারাতো প্রযুক্তির উপর পা দিয়ে হাঁটছে। আমার দেড় বছরের সন্তান এখনো কথা শেখেনি, বাবা মাকে স্পষ্ট করে ডাকতে পারে না, কিন্তু মোবাইল দেখামাত্র হাতে নেবার জন্য তীব্র চিৎকার জুড়ে দেয়, এবং মোবাইল হাতে পেলে সাথে সাথে কানে ঠেকিয়ে কা কা, কে কে করে আলাপ জুড়ে দেয় অজ্ঞাত বন্ধুর সাথে।

মোবাইল বস্তুটা আমার কাছে যাদুকরী যন্ত্র মনে হয়, নইলে ছেলে বুড়ো সবাইকে এরকম আবিষ্ট করে রাখে কেন? টিভিতে, পত্রিকায় মোবাইল কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে মনে হবে দেশের মানুষের একমাত্র কাজ হলো কথা বলা। মানুষকে দুটো বেশী কথা বলানোর জন্য মোবাইল কোম্পানীগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে।

এই মোবাইল বস্তুটা আমাদের বিস্ময় নষ্ট করেছে মারাত্মকভাবে। এটা দিয়ে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করা যায়, মুঠোর ভেতর বিশ্ব যেন। আজকাল প্রযুক্তিও অনেকটা মোবাইল কেন্দ্রিক হয়ে গেছে, কোম্পানীগুলো সব প্রযুক্তিকে এই ছোট্ট যন্ত্রটার ভেতরে সেঁদিয়ে দেবার জন্য হেন কাজ নেই করছে না। মোবাইলে কি কি প্রযুক্তি ঢুকে গেছে তা বলতে গেলে বেকুব হয়ে যাবো, তাই কি কি এখনো ঢোকেনি তার কয়েকটা বলি।

১. মোবাইল সেট টিপে এখনো খাবার বের করা যায় না। (মোবাইল টিপে খাবার বাসায় চলে আসে, সেটার কথা বলা হচ্ছে না)
২. মোবাইলে চড়ে এখনো কোথাও যাওয়া যায় না।(মোবাইল টিপে গাড়ী চলে আসে বাসায়, সেটার কথা বলা হচ্ছে না)
৩. মোবাইল টিপে গার্লফ্রেন্ডকে পাশে এনে বসিয়ে দেয়া যায় না (মোবাইল টিপলে বান্ধবী বাসায় চলে আসে, সেটার কথা বলা হচ্ছে না)

এরকম কিছু ব্যাপার বাদে বাকী সবকিছু মোবাইলে ঢুকে গেছে। যোগাযোগ, কাজ, বিনোদন, শিক্ষা সবকিছুই এর ভেতর আছে। ব্ল্যাকবেরী যখন প্রথম বেরুলো, শুনলাম ওটার ভেতর নাকি আস্ত সৌরজগত আছে। গ্রামীনে গেলাম ব্যাপার কি জানার জন্য। কৌতুহল নিবৃত্ত করার চেষ্টার মুখে ঝামা ঘষে দিল গ্রামীনের সেলসম্যান। হামবড়া মুখ নিয়ে যা বললো তার সারমর্ম হলো, ওটা তারা আমাদের মতো আমজনতার কাছে বিক্রি করবে না। পত্রিকায় ছবি দেখেছি এই ঢের। তাছাড়া দামও সাত আসমানের উপর।

মনে কষ্ট পাইনি তেমন। কারণ মোবাইলে আমি ফ্যান্সি নই। প্রযুক্তি বান্ধব মানুষ হয়েও মোবাইলে প্রাচীনতায় অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু কদিন আগে প্রয়োজনে একটা প্রযুক্তি বান্ধব মোবাইল কিনতে হলো। দামে ব্ল্যাকবেরীর ১/৪ অংশ, কিন্তু সুবিধাগুলো দেখি আইফোন ছুঁই ছুঁই, ব্ল্যাকবেরীও এখানে পাত্তা পায় না। কি বিস্ময়, পরতে পরতে, মুগ্ধ হয়ে গেলাম রীতিমতো। হঠাৎ গ্রামীণ সেলসম্যানের সেই কথাগুলো মনে হলো। একচোট হাসলাম। ওই তাচ্ছিল্যটাও এত দিন পর একটা আনন্দ দিল।

এই পর্যন্ত এসে মনে হলো, কি নিয়ে লিখতে বসেছি তা ভুলে অন্য রাস্তায় চলে এসেছি যথারীতি। কথার সারমর্ম হলো দুটো লাইন মাত্র।

প্রযুক্তি আমাদের বিস্মিত হবার ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, তাই মানুষ কোন কিছুতে বিস্মিত হয় না আজকাল। আনন্দের দিনগুলোও হারিয়ে গিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর বিষন্ন দিন দখলে নিয়েছে জীবন। সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের কোন প্রতিফলনে মুগ্ধতা আসে না। ছেলেভুলানো ছড়া দিয়ে কান্না থামাতো আগের দিনের মায়েরা, আজকাল আইফোনে la isla bonita ডান্স দেখিয়েও কান্না থামানো যায় না, প্রতিদিন এক জিনিস কাহাতক সহ্য হয়। একটা খেলনা দিয়ে ১২ ঘন্টাও পোষায় না। নতুন কিছু চাই!

আমরা সুখী হতে বেগ পাচ্ছি, সুখ আমাদের ছুয়ে ছুয়ে চলে যাচ্ছে প্রাচীন কোন রাজ্যে। যায় দিন সবসবয় ভালো হবেই, আসে দিন নয়।
দিনশেষে যাযাবরের সেই কথাগুলো সত্যি মনে হয়, প্রযুক্তি দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাই না?

Saturday, January 8, 2011

ঘর হইতে তিন পা ফেলিয়া

বেড়ানোর সুশীল জায়গাগুলোতে অরুচি ধরে গেছে। কক্সবাজার, রাঙামাটি বান্দরবান, সেন্টমার্টিনের কথা শুনলেই গা গুলায়। এত এত মানুষের ভীড় যেন বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। যুতসই জায়গা খোঁজার জন্য গুগল আর্থের সহায়তা নিলাম। চট্টগ্রামের আশেপাশে হাতের নাগালে মানুষ যেখানে যায় না সেরকম অজনপ্রিয় একটা গন্তব্যের জন্য খোঁজ দ্য সার্চ লাগিয়ে প্রায় ঘরের কাছেই ৫০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে পছন্দ করে ফেললাম দুদুটো জায়গা। তারই একটাতে গিয়ে ২০১০ সালকে বিদায় দিলাম ৩১শে ডিসেম্বর।

সেটির কথাই বলি এখন। জায়গাটা চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ২০ কিমি দূরে পটিয়ার রিজার্ভ ফরেষ্টে।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাবার পথে কর্ণফুলী নদীটা পেরিয়ে ডানদিকে আনোয়ারাকে রেখে বামদিকে আধাঘন্টা চলার পর পটিয়ার যানজটের পাল্লায়। মফস্বলের এই যানজট ঢাকাবাসীর কাছে নস্যি হলেও ভ্রু কুঁচকে উঠবে অজান্তেই। পাড়া গাঁয়ে কিসের এত যানজট! পনেরো মিনিটের সেই জট পেরিয়ে খানিকটা আরো দক্ষিনে গেলেই নির্ঝঞ্জাট পথের শুরু। শ্রীমাই খাল পেরিয়ে যাবার সময় বামদিকে সবুজ অনুচ্চ পাহাড়ের দীর্ঘ সারিগুলি ঠিক হাতছানি দেয় না, কিন্তু রহস্যপ্রিয় মানুষের কৌতুহলের যোগান দেয়। কি আছে ওই পাহাড়ের অরণ্যে?

আরো কিছুদুর গেলে কমল মুন্সির হাট। তারপর দুপাশে মেহগনি গাছের সারির ছায়ার পথ পেরিয়ে মাইলখানেক গেলেই একটা মসৃন সেতু যার তলা দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা পাহাড়ী ছড়া। খরনা খাল বলে জনপ্রিয় সেটি। সেতুটা পেরিয়ে দক্ষিনে আরো দুশো গজ গেলে খরনা রাস্তার মাথা। ডানদিকে আজিমপুর গ্রাম আর বামদিকে একটা ছোট্ট পিচঢালা পথ পূর্ব দিকে চলে গেছে ধানক্ষেত চিরে।

ওইপথ দিয়ে কিছুদূর গিয়ে প্রাচীন একটা বৃটিশ আমলের রেল লাইন, এখনো টেনেটুনে দৈনিক একটা ট্রেন আসে আঁকাবাঁকা লাইন দিয়ে, তার পাশেই খরনা স্টেশানের প্রাচীন জরাজীর্ন লাল কুটির। কিছু দোকানপাট আর রেল লাইন পেরিয়ে পুবে আরো আধমাইল গেলে পথ শেষ। এখানে রিকশা বা গাড়ী থেকে নেমে পায়ে হাঁটা পথ।

ঠিক সোজা নয় তবে পুব দিকে যে পথটা একে বেঁকে চলে গেছে দিগন্তের দিকে সে পথে হেলে দুলে হাঁটতে হবে। কিছুদূর পর পর লোকজন দেখলে জিজ্ঞেস করতে হবে খরনা পাহাড় কতদূর? কোন পথে যেতে হবে? উত্তর আসবে, 'ওখানে কি, কেন যাবেন?' বলতে হবে, 'বেড়াতে যাবো, পাহাড় দেখবো।'

শুনে ওরা অবিশ্বাসের দৃষ্টির সাথে ফিসফিস করে স্থানীয় ভাষায় বলবে, 'বেয়াক মিছা হতা, জাগা কিনতো আইসসেদে'। (সব মিথ্যে কথা, জমি কিনতে আসছে)

আরো কিছুদূর পেরিয়ে গেলে লোকালয় একেবারে শেষ। টুকরো টাকরা টিলা জঙ্গলের শুরু। তার আশেপাশে সবজী ক্ষেতে নিড়ানি দিচ্ছে কৃষক। নতুন লোক দেখে সবার কৌতুহলী দৃষ্টি। জিজ্ঞেস করবে 'ওবা হন্ডে যদ্দে' (কোথায় যাচ্ছো ভাই?)। বলা হবে, 'ওই পাহাড়ে যাচ্ছি, যেখান থেকে খরনা খাল নেমে এসেছে।'

বলবে 'বেশীদূর ন যাইয়ু, আতি আছে এন্ডে' (বেশীদূর যাবেন না, হাতি আছে ওদিকে)।

জুতো স্যান্ডেলে চলার পথও শেষ হবে একসময়। দিগন্তে বিলীন জঙ্গলের রেখাগুলো এখন পাহাড়ের চেহারায় ধরা দেবে। বুনো গাছপালাগুলো অনেকটা স্পষ্ট এখন। রাস্তার শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখা যাবে কলকল শব্দে স্বচ্ছ জলের খরনা খালের ধারা বাঁক ঘুরে চলে গেছে অনেক গভীর অরণ্যে। এখান থেকেই খরনা খালের পাহাড় যাত্রা। এখান থেকেই সত্যিকারের অরণ্য ভ্রমণ শুরু। আনন্দেরও।

সম্মুখে দাঁড়ানো করলডেঙ্গা পাহাড় শ্রেনী। কর্ণফুলী নদী থেকে শংখ নদী পর্যন্ত উত্তর দক্ষিনে আঠারো মাইল বিস্তৃত বিশাল এই বনভূমি। অনুচ্চ সবুজ পাহাড়গুলো মোটামুটি ১৫০ থেকে ৩০০ ফুটের মধ্যে অবস্থিত। যার অতি সামান্য অংশে মানুষের যাতায়াত সম্ভব। পুরো এলাকাই দুর্গম। বন্য হাতির রাজত্ব বলে বাইরের মানুষেরা আসতে সাহস পায় না।


==

==

==

==



লোকালয়ের এত কাছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বিশাল একটা খনি এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে ভাবতেই অবাক লাগে। আট দশ মাইল দুরের পাহাড় চুঁইয়ে নেমে আসা এই ঝরনাটি আমার গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে, অথচ একবারও যাইনি ওই পাহাড়ে। ছেলেবেলায় দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে মেঘের ছায়া পড়তে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। বড় হবার পর পাহাড়টা কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল। আসলে দৃষ্টিসীমার ভেতর গ্রামের গাছপালাগুলো বেড়ে গিয়ে ঢেকে দিয়েছিল আর চাপা পড়ে গিয়েছিল পাহাড়ে যাবার বাসনাও।

অনেক বছর পেরিয়ে যাবার পর এই স্বপ্নটা সত্যি সত্যি পূরন হলো। এবারের যাত্রা ছিল পথের নিশানা চিনে আসার যাত্রা। রাত্রিযাপনের স্বপ্নটা আপাততঃ মূলতবী রইল। পরের বারে যাত্রা হবে আরো গভীরে, আরো রহস্য রোমাঞ্চের প্রতিশ্রতি নিয়ে।

সবশেষে, ফিরে আসার সময় ঝোলানো ক্যামেরায় যেমন খুশী তেমন তোল - অনির্দিষ্ট ফোকাসের তিন মিনিটের ভিডিওচিত্র। আগ্রহীরা ক্লিক করে দেখতে পারেন। এখানে কান পেতে কি অরণ্যের ডাক শোনা যায়?


আরো কিছু ছবি দেখতে এখানে
http://www.flickr.com/photos/hrrh69/sets/72157625609627663/

ঘুম পায়

ইঁচড়ে পাকা বয়সে আমার এক গুরুবন্ধু বলতো,- 'মানুষের জীবনে তিনটা মাত্র মৌলিক বিষয়, বাকী সব ফালতু। তিনটা হলো, আহার, নিদ্রা, ত্যাগ। বুঝলি'?

আমরা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলেছি, 'হুম বুঝেছি'।

বললো, 'কি বুঝলি বল।'

কি মুসিবত! আহার নিদ্রা না বোঝার কি আছে? তবে ত্যাগ নিয়ে আসলেই সন্দেহ ছিল। কারণ বাবা মা পরিবারকে ত্যাগ করাটাও যদি মৌলিকত্বে পড়ে আমি তাতে নেই। মিনমিন করে বললাম, 'ত্যাগ বাদে সব পারবো। পরিবার ত্যাগ করে থাকা সম্ভব না।'

গর্দভ!!! ধমকে উঠলো সে। 'হাঁদারাম এই ত্যাগ সেই ত্যাগ নয়। ভদ্রভাষায় বলেছি। এটা তোর প্রাত্যাহিক ত্যাগের বিষয়, প্রকৃতির ডাক।'
.
এরকম গুরুকে মান্য না করে যাবে কোন গর্দভ?
.
আজকের কথা সেই তিন মৌলিকত্বের একটা নিয়ে। ঘুম।
.
ঘুম একটি অবশ্য করণীয় আচার। আহার বাদ দিয়েও ঘুমকে প্রতিদিন প্রয়োজন। কিন্তু এই মৌলিক বিষয়টিও কি কখনো কখনো অসভ্যতার আওতায় পড়ে? তাহলে আমার সভ্য হওয়া হলো না এই জীবনে।
.
মানুষ কোথায় কোথায় ঘুমায়? বিছানা বালিশ বাদেও বাসে-ট্রেনে-আকাশে-পানিতে-মিলাদে-মসজিদে-সেমিনার-সভাসমিতি-কর্মশালায় কোথায় নয়? দৌড়াতে দৌড়াতেও নাকি কেউ কেউ ঘুমায়।
আমার এক বন্ধু আছে এক বাড়ীভর্তি হৈ হল্লার মধ্যে দিব্যি ঘুমিয়ে যেতে পারে। আরেকজন আছে মাথার উপর/পাশ দিয়ে ট্রাক চলে গেলেও বেঘোরে ঘুমোবে। পরীক্ষিত তথ্য।
.
কিন্তু ঘুমকে প্রচন্ড ভালোবাসলেও তাকে সহজে পেতাম না। আমাকে প্রচুর কায়দা কানুন করতে হতো। সমস্ত বাড়ী সুনসান নীরব এবং নিশ্ছিদ্র অন্ধকার না হলে আমার ঘুম আসতো না। বাড়ীর দূরের কক্ষ থেকে প্রতিফলিত সামান্য আলো কিংবা শব্দও আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতো। বিছানা শোবার অন্ততঃ তিন ঘন্টা পরে ঘুম আসতো কোন কোন রাতে। কোন কোন রাত একদম নির্ঘুম কাটিয়েও সকালে উঠে পড়তাম। বাসায় বন্ধুরা কেউ থাকতে এলে আমার কায়দা কানুনে ত্যক্ত হতো।
.
আমার ঘুমের কষ্ট দূর হয় চাকরী জীবনে এসে। অফিস থেকে ফিরে খেয়ে শুতে না শুতেই ঘুম। সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত অফিস করে এমন মরার ঘুম হতো, মাথার উপরে সিলিং ফ্যানের মিগ২৯ গর্জনও আমার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারতো না। বরং সেই মিগ২৯ গর্জনকে এত ভালোবেসে ফেলি যে অন্য কোথাও গেলে নিঃশব্দে ফ্যান ঘুরতে দেখলে অবাক লাগতো, এরা এরকম অরক্ষিত অনাবৃত ঘুমায় কিভাবে? বাইরে টুং করে রিকশার ঘন্টি বাজলেও তো ঘুম ছুটে যাবে। আমার ফ্যানটা যখন চলতো তখন বাইরের মহাসড়কে ট্রাক চললেও কোন শব্দ হতো না। সব শব্দ গিলে ফেলা সেই ফ্যানটি যেদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো, মরচে ধরা ব্লেডের দিকে তাকিয়ে আমার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। আবার কবে এরকম একটা গর্জন ফ্যান পাবো।
.
কথায় আসি।
ভাইসব, ঘুম নিয়ে আমার কষ্ট দেখে কেউ চিন্তিত হবেন না। আজকাল আমার বেশ ঘুম হয়। তবে নির্দিষ্ট কিছু জায়গা বাদে। ট্রেনের প্রথম শ্রেনী, বাসের প্রথম শ্রেনী আর প্লেনের সীট যেখানে ঘুমানোর সমস্ত সুব্যবস্থা আছে সেসব জায়গায় আমার দুচোখ সারাদিন এক করে রাখলেও ঘুম আসে না।
.
আমার ঘুম আসে আজব কিছু জায়গায়। সবচেয়ে বেশী ঘুম আসে সেমিনার বা ওয়ার্কশপে কিংবা জুম্মার খোতবায়। আজকাল কোন সেমিনার কিংবা ওয়ার্কশপে যোগ দিতে ভয় পাই, ঘুমের ভয়ে। হলভর্তি জ্ঞানীগুনী লোকের মধ্যে একজন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে, খুব অশোভনীয় ব্যাপার।
.
মসজিদে জুমার খোতবায় কতো জরুরী বিষয়ে ফতোয়া দিচ্ছে হুজুর, কিন্তু এক পাপী বান্দা ঢলে পড়ছে পাশের মুসল্লীর ঘাড়ে। কত্তবড় বেত্তমিজ লোক! কথার সামারি হলো, মোটামুটি যেসব জায়গায় জেগে থাকা ফরজ, সেখানে আমার ঘুম জেঁকে আসে।
.
তবে আরো দুটো জায়গার কথা না বললে নয়। এট দুটো জায়গায়ও আমার খুব ভালো ঘুম হয়। ভীড় ঠেলাঠেলি সমৃদ্ধ নড়বড়ে সিটি সার্ভিস বাস আর ভটভট করে চলা সিএনজি টেক্সী।
.
সিএনজি টেক্সীতে চিড়িয়াখানার মতো খাঁচার হুকুমে সবাই অখুশী হলেও আমি হইনি এই কারনে। কারন খোলা টেক্সীতে ঘুমিয়ে পড়লে গড়িয়ে রাস্তায় চলে যাবার সম্ভাবনা।
এরপর আসি নড়বড়ে শহর এলাকার বাস সার্ভিসে। বাসের ভীড়ে পকেট দুটো টাইট করে সামলে সীটের হেলানে ঘাড়টা তিনি মিনিট ফেলে রাখলেই ঘুমটা আলফা লেভেলে চলে যায়।
ভাবছেন পকেটমার হলে কিভাবে ঠেকাই?
বিশ্বাস..., বুঝলেন মশাই? বিশ্বাসের উপর কোন কথা নেই।
.
বিশ্বাস করি মাথার উপরে ছাদের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকা যাত্রীরা আমার পকেটের পাহারাদার। কেউ পকেটে হাত দিলেই পাশের জন অটোমেটিক্যালি খপ করে ধরে ফেলে চিৎকার দেবে, পকেট সামালকে!!
.
অবাক হচ্ছেন, বাঙালীর উপর এত বিশ্বাস দেখে?
অবাক হতে পারেন, কিন্তু কেউ কেউ বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বললেও বাঙালীর এই নৈতিকতার উপর আমার বিশ্বাস এখনো অটুট।
.
আচ্ছা বাঙালীর নৈতিকতা কি?
গুরুগম্ভীর বিষয়। তবু চেষ্টা করে দেখা যাক। উত্তরাধূনিক ভাষায় নৈতিকতা হলো...........এবং........বাঙালী হলো...।... অতঃপর..........অতএব.........
.
নাহ আর পারছি না......হাই উঠছে........এটা নিয়ে আরেক ইনিংসে বলতে হবে। এখন যাই, ঘুম পাচ্ছে।
.
আজকাল ব্লগ লিখতে বসলেও ঘুম পায়।