কতোক্ষণ ঘুমিয়েছি বলতে পারবো না। কিন্তু মোটামুটি পোয়াখানেক রক্ত শরীর থেকে মাইনাস হবার পর হুঁশ হলো। গলা, গাল, হাতের কবজি পর্যন্ত ফুলে ঢোল করে ফেলেছে হুলডোজার বাহিনী। ভুলে গিয়েছিলাম অডোমস মেখে শুতে। মোম জ্বালালাম। তারপর বাঁশের কঞ্চি খুঁজে নিয়ে চুলকানির ঝড় তুললাম একটা। গলা, গাল ঠোট যে পরিমান উঁচু হয়েছে স্বয়ং হালাকু খানও ভয় পাবে আমাকে দেখে।
ফোকড় দিয়ে বাইরে তাকালাম। যথারীতি কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার। দিকপাল বোঝার উপায় নেই। চুলা জ্বেলে গরম পানি বসালাম। ব্যাগ থেকে কাজু বাদামের টিন খুললাম। অল্প কয়েকটা খেয়ে চা বানালাম খুব করে চিনি দিয়ে। যা রক্ত খেয়েছে চিনি দিয়ে হলেও পুরনের চেষ্টা। চা খেয়ে অডোমস ক্রীম মেখে কুঁড়ের বাইরে আসলাম লাঠি হাতে। আজকে কোন উৎপাত নেই। পোকাদের অবিরাম কিটিমিটি শব্দ আর দূরে কোন ফাঁকিবাজ কুকুরের অলস ডাক বাদে কোথাও কোন শব্দ নেই। এরকম সময়ে জ্যোৎস্না থাকলে অপূর্ব সৌন্দর্য দেখা যেত উপত্যকায়। সিগারেট ধরিয়ে আরাম পাচ্ছি না। এ জায়গায় একটা নারকোলের খোল দিয়ে বানানো হুঁকো নিয়ে গুড়গুড় করে ধোঁয়া ছাড়লে মানানসই হতো।
বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারলাম না। বাতাসে কান ব্যাথা করছে। কুঁড়েতে চলে এলাম। বাইরে ভয়াবহ ঠান্ডা। ভেতরে খানিকটা কম। শুয়ে পড়লাম মুখের উপর তোয়ালেটা ঢাকা দিয়ে।
কুত্তার বাচ্চা।
না গালি না। সত্যি সত্যি একটা কুকুরছানা কখন এসে কুঁড়ের এককোনে ঘুমিয়ে পড়েছে জানি না। মচমচ শব্দে আমি উঠে দাঁড়াতে সে জেগে উঠলো তড়াক করে, তারপর কুঁই কুঁই শুরু করলো। আমার কুকুরপ্রীতি নেই। কুকুর দেখলেই গদাম দেই। কিন্তু এই বেচারাকে দেখে মায়া লাগলো। এই ঘরের মালিক আমিও না সেও না। দুজনই ইমিগ্রান্ট। তাই ওকে ঠিক অনাহুত মনে হলো না। খিদে পেয়েছে বেদম। ওকে রেখেই আমি রান্না করতে বসলাম।
খিচুড়ী রান্না করে ওরেও খানিক ভাগ দিলাম। খাওয়া সেরে চলে যাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু ব্যাটা দেখি আমার পায়ে পায়ে ঘুরে। এইটা আমার খুব বিরক্ত লাগে। লাথি উঠাতে গিয়েও সংযত হলাম। ঘরের কাজ কি কি আছে হিসেব করলাম। নদীতে যেতে হবে যথারীতি পানির জন্য। পরপর দুইদিন খিচুড়ি খেয়ে অরুচি এসে গেছে। তাছাড়া কাচামরিচ ছাড়া জমছে না। শাকটাক কিছু পাওয়া গেলে সেদ্ধ করে লবন দিয়েও খাওয়া যেত।
ভোরের অন্ধকার কেটে রোদ হেসে উঠলে বেরুলাম কুঁড়ে থেকে। আজকে বাতাস আছে খানিক। পাহাড়ী বাতাসে কেমন একটা শব্দ থাকে। কিন্তু তারচেয়ে যেটা কানের ভেতর কুলকুল করছে সেটা হলে শীতের কামড়। এই বাতাস দেখতে নিরীহ, কিন্তু কামড় কঠিন। মাফলার নাই। কানে গামছাটাই বেধে নিলাম। আজকের ট্রেকিং হবে সবজি সন্ধান। দুপুরের মেনুটায় ব্যতিক্রম আনা চাই।
আজকে গোসল করবো না। এই শীতে নদীতে নামলে হাড্ডিসহ বরফ হয়ে যাবে। কিন্তু এই নদীটায় যাদু আছে, বন জঙ্গলে দুতিন ঘন্টা ঘুরে কখন যে অন্য পথে নদীর কাছে চলে এসেছি। বাংলাদেশে যত নদী আছে সবগুলোর সৌন্দর্য একত্র করেও শংখ নদীর সাথে পারবে না। অথচ এই নদীটাই সবচেয়ে কম আবিষ্কৃত। সবচেয়ে কম মানুষ যাতায়াত করে এই নদীতে। সবচেয়ে কম নৌকা ভাসে এখানে। এদিকের এলাকাটা তো সভ্যতা বিবর্জিত।
এরকম আরো এক দেড়শো কিলোমিটার ভেতরে চলে গেছে এই নদীটা। প্রথম যেদিন এই নদীর সাথে দেখা হয় সেদিনই প্রেমে পড়ে যাই। আকাশের নীল যেন কেউ বিছিয়ে দিয়েছে এই নদীর ভাজে ভাজে। শংখ একদম আদি অকৃত্রিম বাংলাদেশী নদী। সবচেয়ে বেশী বাক নেয়া নদীও এটি। এই নদীর উৎসে যাবার একটা ইচ্ছে চাপা আছে এখনো।
আরে, ওইটা কি দেখা যায় ওদিকে, নৌকা না? ওই পাড় ঘেষে দক্ষিন দিকে যাচ্ছে। কেন যেন আমি চিৎকার করে ডাক দিলাম- বদি আলম!!!
এটা একটা চাটগাঁর ফাইজলামী ডাক। কাহিনী আছে এটার। আমার ডাকটা অতদূরে গেল কিনা নিশ্চিত না, তবে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে একটা ইকোর সৃষ্টি করলো। বোঝা গেল, ওইপাড়েও পৌছে গেছে। কারণ নৌকাটা ঘুরছে। এদিকে আসছে মনে হলো। ওটাকে আসতে দেখে তাৎক্ষনিক একটা নতুন প্ল্যান মাথায় ঢুকলো। দেখি কাজ হয় কি না।
দশ মিনিটেই কাছে এলো নৌকাটা। এটা ঠিক নৌকাও না ছোট্ট ডিঙি বলা যায়। মাথার উপর তালপাতার বেড়া দিয়ে ঢাকা। দাঁড় বাইছে নিরীহ চেহারার উপজাতি এক মানুষ। আমাকে দেখে প্রথমে সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। অপ্রসন্ন সুরে পাহাড়ী ভাষায় কি জানি বললো। বুঝলাম না।
বোধহয় কোত্থেকে এখানে মরতে এসেছি জানতে চাইল। ভাষা না বুঝলে তো উদ্দেশ্য বোঝানো মুশকিল। আমার বাংলা ভাষাও তার কাছে অবোধ্য মনে হলো। খানিক পর চাটগাইয়া ভাষায় কথা বলে উঠতেই তার মুখ উজ্জ্বল দেখালো। এই ভাষা সে মোটামুটি বোঝে। আলাপ জমে উঠলো শীগগির।
এটা সেটা বলে খাতির জমিয়ে ফেলতে সময় লাগলো না। পাহাড় নিয়ে আমার মুগ্ধতাকে সে সম্মান জানিয়ে তার নৌকায় দুপুরের আহারের নিমন্ত্রন করলো। এবার আমাকে পায় কে। কথায় কথায় জেনে গেলাম তার নাম ধনু মার্মা। তার বাড়ী থানচিতে। রুমা বাজারে কাজে এসেছিল দুইদিন আগে। আজ ফিরে যাচ্ছে কাজ সেরে। বাঁশকোড়া দিয়ে টুইট্টা মাছের ঝোল রান্না করছে সে। ডেকচিতে আরো কি কি লতাপাতা দিয়েছে। সুগন্ধ মৌ মৌ করছে। কতোকাল পরে যেন অতীব তৃপ্তির সাথে দুপুরের ভাত খেলাম। এত মজার রান্না হয়েছে যে, আমি ডেকচির তলানিও খেয়ে ফেললাম। খাওয়া শেষে ধনুকে একটা সিগারেট অফার করলাম। লাজুক মুখে ধনু সিগ্রেট ধরালো। বললো, সে হুঁকো খেয়ে অভস্ত। তবে সিগারেটের শখ আছে। ভালো সিগারেট পেলে খায়। আমারটা বেনসন, নিঃসন্দেহে ভালো সিগারেট।
ধোঁয়া টানতে টানতে মোক্ষম সময়ে আবদারটা পাড়লাম।
"তোমাদের বাড়ীতে নেবে আমাকে?" গলায় যথাসম্ভব মধু ঢেলে বললাম।
আমার কথা শুনে ধনু এক সেকেন্ডের জন্য চমকে গেল যেন। এ আবার কেমন প্রস্তাব। তারপরই হেসে দিল। বললো, আমাদের আর বাড়ী কই। থাকি পাহাড়ের কিনারের ছোট একটা খুপড়ি ঘরে। ওসব তোমার ভালো লাগবে না। তাছাড়া বহুদুর। যেতে অনেক সময় লাগবে। দুইদিনের পথ এখান থেকে।
আমি বললাম, কতো আর লাগবে, থানচি আর কতোদূর। লাগুক। কিন্তু আমি যেতে চাই। তুমি নিবা কিনা বলো।
ধনু গাঁইগুই করছে। বললো, থানচির শেষ মাথায় ওর গ্রাম। ওখানে যেতে হাটতে হয় প্রচুর। এরকম আরো নানান অজুহাত। ওর আপত্তির রহস্যটা বুঝলাম না। আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না, এটা একটা কারণ। কিন্তু আমি একা ওদের কি ক্ষতি করবো। এত ভয় পাবার কি আছে। নাকি বিনা পয়সায় ওর নৌকায় করে যাবো, সেজন্যই আপত্তি। আমিও নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইলাম। এই সুযোগ হারানো যাবে না হেলায়। শংখ নদীর উৎসের পথে যাবার সহজ কোন পথ নেই। বললাম, ধনু কতো টাকা দিলে নেবে তুমি?
কথাটা বোধহয় রুক্ষ হয়ে গেল বেশী। ধনুর আত্মভিমানে লাগলো। গটগট করে যা বললো তার সারমর্ম হলো- আমি নৌকার মাঝি না। ভাড়া নেবো কেন। তুমি কি করে ভাবলে আমি মেহমানের কাছ থেকে ভাড়া নেবো? ইত্যাদি।
আমি সরি জাতীয় কিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু চাটগাইয়া ভাষায় সরি বলে কোন বস্তু নেই। তাই তার হাত দুটো ধরে, সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই এটা খা, মাথা গরম করিস না। দুষ্টামি করছি তোর সাথে। পুরো প্যাকেটটা তার হাতে দিয়ে দিলাম।
চট করে তুই তোকারীতে চলে যাওয়াতে সে আমোদিত হলো মনে হয়। এটা একটা পুরোনো টেকনিক, এক গুরু শিখাইছিল। এবার সে খুশী। আপন মনে বিড়ি টানতে টানতে বললো, আমরা খুব গরীব। তোরে রাখি কই। এক ঘরে থাকি বউছেলেমেয়ে নিয়ে। তুই গেলে তো একদিনে আসতে পারবি না। কদিন থাকতে হবে একটা ফিরতি নৌকা যোগাড় হওয়া পর্যন্ত। তাই তোকে নিতে চাইনি।
আমি বললাম, আমার থাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি গাছতলাতেও থাকতে পারবো। তবে তোর আপত্তি না থাকলে এই নৌকা আমার ঘর হবে। আমি নৌকায় ঘুমাবো রাতে। তোর অসুবিধা আছে? নাকি আমাকে অবিশ্বাস লাগে?
এবার সে এসে আমার দুহাত জড়িয়ে এমনভাবে তাকালো মনে হলো আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্বাসী বন্ধু হয়ে গেলাম দুঘন্টার আলাপেই।
[চলবে....]
No comments:
Post a Comment