Tuesday, May 7, 2024

R and R

1.
You may own billions or trillions, but you can consume only what is allocated for you as of your final day. The only benefit of your ownership is a bunch of numbers and your imagination as an owner.

2.
The world should seriously consider whether so-called economic or industrial development should be continued. If development means destroying the environment on this planet, they should stop now. Right NOW!

হাতের কাছে কলম



কলম দিয়ে লেখালেখি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন ধরে। টুকটাক নোট নেয়া, খসড়া পরিকল্পনার ঘষামাজা কিংবা দুচার পাতা ডায়েরি বাদে আর কিছুতে কলমের ব্যবহার নেই আজকাল। অধিকাংশ মানুষেরই এই অবস্থা। তবু আমার কাছে কলমের মতো প্রিয় জিনিস খুব কমই আছে। লেখালেখি না হলেও আমি কলমের একটা ছোট বাক্স হাতের কাছেই রাখি। আমার গত চল্লিশ বছরের কয়েকটা প্রিয় কলম-পেন্সিল সেখানে মজুদ আছে। সবগুলোই জীবনের নানান পর্বে প্রিয়জনদের কাছ থেকে উপহার পাওয়া। যে কলমগুলো এখনো সচল আছে সেগুলোই এখানে রাখা। যার মধ্যে মেকানিক্যাল পেন্সিলটা সবচেয়ে পুরোনো। পেন্সিল বলেই সচল আছে এখনো।


লেখার কাজ না থাকলেও যে কোন একটি কলম হাতে রাখার পুরোনো অভ্যেস আমার। কী বোর্ডে কাজ করার সময়ও যে কোন একটা কলম আমার পাশে থাকা চাই। কলমের নিঃশব্দ একটা ভাষা আছে। যেটা হাতে নিলেই বলতে থাকে, সময় কম, লিখতে থাকো।


এছাড়া না লিখতে না লিখতে আমার অনেক দামী কলমের কালি শুকিয়ে গেছে, সেগুলো ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় তুলে রেখেছি। সেই কলমগুলো নিয়ে একটা আক্ষেপ থেকে গেছে। শেফার, পার্কার, ওয়াটারম্যান জাতীয় দামী দামী যে কলমগুলো স্কুল বয়সে উপহার পেয়েছিলাম বাবার কাছ থেকে, সেগুলো দিয়ে ঠিকমত একটা পাতাও লিখিনি, ফুরিয়ে যাবার ভয়ে। তখন বুঝিনি, না লিখে রেখে দিলেও যে কোন কলম এমনিতেই ফুরিয়ে যায়।


প্রতিটি কলমের আলাদা গল্প আছে। প্রতিটি কলমের একটা করে ইতিহাস আছে।

Saturday, May 4, 2024

বিশ শতকের সৌভাগ্যবান লাজার সিলবারিস

 


কোনটা যে সৌভাগ্য আর কোনটা দুর্ভাগ্য সেটা মাঝে মাঝে গোলমাল পাকিয়ে যায়। আজকে যে লোকটা ভাবছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা, আগামীকাল হয়তো সেই লোকটাই নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবান হিসেবে দেখতে পারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্তিনিক দ্বীপের বাসিন্দা লাজার সিলবারিস ছিল সেরকম বিরল ভাগ্যবান এক মানুষ। বিশ শতকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান লোক বলা হয় তাকে।
১৯০২ সালের ৭ মে তারিখেও ওই দ্বীপের সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষ ছিল ২৬ বছর বয়সের সিলবারিস। ভয়ংকর সব অপরাধের কারণে তাকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল দ্বীপের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য কারাগারের নির্জন এক গুহায়। পাহাড়ের গায়ে পাথরে নির্মিত ওই কারাগারে নিঃশ্বাস নেবার জন্য শুধু সামনের অংশে ছোট্ট ফোকর বাদে আর কোন দরোজা জানালা ছিল না। ওই কারাগার থেকে জীবনেও পালানো সম্ভব নয়।
কিন্তু তার ভাগ্যে লেখা ছিল অন্য কিছু। ১৯০২ সালের ৮ মে তারিখ সকালে ভয়ানক এক অগ্ন্যুৎপাতে মাত্র এক মিনিটের মধ্যে ওই দ্বীপের ৩০ হাজার বাসিন্দার সমাধি হয়েছিল উত্তপ্ত লাভার নীচে। চারদিন পর ধ্বংসস্তুপ থেকে আধপোড়া অবস্থায় শুধু একজনকে জীবিত উদ্ধার করা গিয়েছিল। তার নাম লাজার সিলবারিস। দুর্ভেদ্য পাথরের কারাগারই তাঁকে রক্ষা করেছিল।
লাজার সিলবারিস পরবর্তী জীবনে আমেরিকার বিখ্যাত সার্কাস দল বার্নাম এণ্ড বেইলির সাথে যুক্ত হয়ে ছোটখাট সেলেব্রিটি হিসেবে জীবন পার করেছে। তার বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো the man who lived through doomsday.

বাঁশ থেকে চাল

 




দিনাজপুরের সাঞ্জু রায় বাঁশ থেকে চাল সংগ্রহ করে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। তাঁর দেখাদেখি গ্রামের আরো অনেকে বাঁশঝাড় থেকে ধান সংগ্রহ করে ভাত রান্না করে খাচ্ছেন। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন ধান বাছতে বাঁশ উজাড় হতে পারে।
খবরটা পত্রিকার পাতায় দেখে ঘরের বোটানিস্টের কাছ থেকে মতামত চাইলাম। তিনি ছোটখাট একটা লেকচার দিয়ে বললেন:
"আসলে ভয়ের কিছু নেই। বাঁশের বংশের যখন আয়ু ফুরিয়ে যায় সে ফুলের মধ্যে ধানের জন্ম দিয়ে মৃত্যুবরণ করে।
ধান আর বাঁশ দুজনই একই বংশের ঘাস। মানে দুজনই ঘাস বংশের সন্তান। সেই বংশের নাম পোয়াসি। পোয়াসি বংশের দুই সন্তানের একজন বাম্বুসোইডি(বাঁশ) আরেকজন ওরাইজোইডি(ধান) পরিবারের সন্তান। অর্থাৎ ধান হলো ছোট বাঁশ, বাঁশ হলো বড় ঘাস। ধান-বাঁশ-ঘাসের মধ্যেকার এই সম্পর্ক লক্ষ কোটি বছর পুরোনো।
বাঁশ গাছে ধান পাওয়ার ঘটনা ৬০ থেকে ১২০ বছরের মধ্যে একবার হতে পারে। শতবর্ষে একবারই ফুল ফোটে বাঁশ গাছে। সে কারণে মানুষের চোখে এই ঘটনা খুব কম পড়ে। এতদিন ধরে একটা বাঁশঝাড় টিকিয়ে রাখা তো সভ্য মানুষের কাজ নয়। তবে ঘটনাটা সব বাঁশের ক্ষেত্রে ঘটে কিনা নিশ্চিত নই। দিনাজপুরে ঘটেছে বেরুয়া নামের এক জাতের বাঁশে। যাতে মনে হচ্ছে বিশেষ কোন কারণে বিশেষ কোন প্রজাতির ক্ষেত্রে ঘটনাটি ঘটে।"

অনেক গ্রামে কুসংস্কার আছে বাঁশ গাছে ফুল ফুটলে অমঙ্গল হয়। দুর্যোগ নেমে আসে। দিনাজপুরের মানুষ অবশ্য এটাকে দুর্যোগ হিসেবে দেখেনি। তারা মনের সুখে বাঁশ থেকে চাল সংগ্রহ করে ভাতের পাশাপাশি পিঠা-পুলি খেয়ে যাচ্ছে। শুধু সাঞ্জু রায়ই কয়েক মন ধান বিক্রি করেছেন ৪০ টাকা কেজি দরে। এটা জেনে ভালো লেগেছে।
বাঙালিদের কাছে এটা নতুন মনে হলেও উত্তরবঙ্গের কোন কোন আদিবাসী গোষ্ঠির কাছে এই বিষয়টা অনেক আগ থেকেই জানা। তারা বহুবছর ধরে বাঁশফুল থেকে ধান সংগ্রহ করার রীতির সাথে পরিচিত।
মানুষ গবাদি পশুর চেয়ে উন্নত জাতি হলেও সারা দুনিয়ার মানবজাতি আসলে ঘাস খেয়েই বেঁচে আছে। ধান, গম, যব, ভুট্টাসহ যত ধরণের শস্যদানা আছে সবই কোন না কোন জাতের ঘাস। সবগুলোই পোয়াসি গোত্রের সন্তান। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে একজন ভাতের দেবী আছেন। তাঁর নাম শ্রীদেবী। ভালো ফসলের জন্য তাঁর পুজা করা হয়। সেই দেবির আদি নামও পোহাসি।
দেখা যাচ্ছে পুরো মানবসভ্যতাই ঘাস খেয়ে টিকে আছে।

রাজু ও মীনার গল্প বনাম বাংলাদেশের আইসিটি শিক্ষার ভুল প্রয়োগ


এটা একটা বাচ্চা ছেলের কাজ। ইন্টারনেট স্পীড চেক করার একটা টুল। বানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অষ্টম শ্রেণী পড়ুয়া এক কিশোর। ধরা যাক ছেলেটার নাম রাজু। একটা অ্যামেচার প্রোগ্রামার সাইটে টপ-১০ হতে পেরেছে বলে খুশি হয়ে আমাকে জানিয়েছে। কিন্তু বাইরের কাউকে জানানো বারণ। আমি তবু ওকে আড়াল করে পোস্ট করছি। কারণটা পরের অংশে আসবে। আমি জানি এগুলো তার স্কুলের পড়াশোনার অংশ নয়। শখের কাজ। নিজের আনন্দের জন্য করা। কিন্তু বড় হয়ে ওসব নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে।
রাজুর এসবে খুব আগ্রহ থাকলেও তার বোন মীনা একদম বিপরীত। সে এসব কাজে মোটেও আগ্রহী না। মীনা পড়ে একাদশ শ্রেণীতে। বাণিজ্য বিভাগে। তার আগ্রহ শিল্প সংস্কৃতি। সে ছবি আঁকে, গান গায়। তবে মুশকিল হলো অন্যান্য বিষয়ের সাথে তাকে আইসিটি নামক একটা বিষয় পড়তে হয়। তার শিক্ষা কিংবা ভবিষ্যত ক্যারিয়ার কোনটার সাথে এই বিষয়ের সম্পর্ক নেই। তবু তাকে ওই ঢেকি গিলতে হচ্ছে দিনের পর দিন। কারণ সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বিষয়টি। ওটার জন্য কোচিং লাগে, টিচার লাগে, অনেক সময়ও লাগে। ছোটাছুটি করে সে মোটামুটি গলদঘর্ম। কিন্তু উপায় নেই। নইলে নইলে পরীক্ষা খারাপ হবে। জিপিএ ফাইভের যুগ এটা।
আমি আইসিটির লোক না হলেও একজন প্রযুক্তিবান্ধব মানুষ। পেশাগত কারণে গত পঁচিশ বছর ধরে আইসিটি সেক্টরের সাথে নানাভাবে কাজ করছি। ফলে আমি মীনাদের আইসিটি সিলেবাসটা দেখে খুব অবাক হয়েছি। আমি ভাল করে জানি এই বিষয়টা সাধারণ ক্যারিয়ারের ছাত্রছাত্রীদের কোন কাজে আসবে না। যারা কম্পিউটার বিজ্ঞান কিংবা ওই সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবে তাদের জন্যই দরকার।
তবু বাংলাদেশে আইসিটি বিষয়ে এমন সব অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে যেগুলো কেবলমাত্র কম্পিউটার বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। এই বিষয়টা এত কড়াকড়িভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কেন? এদেশের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে আইসিটিতে বিশেষজ্ঞ হতে হবে? প্রোগ্রামিং জানতে হবে?
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শতাধিক বিষয় থাকে পড়ার। একটা দেশে হাজারো পেশার মানুষ থাকে। এত পেশার মধ্যে কয়টা পেশায় ওই বিদ্যা কাজে লাগবে? কম্পিউটার সায়েন্স বাদে আর কোন বিষয়ের ছাত্রছাত্রীর কী এই বিদ্যা কাজে লাগবে?
তবু কেন দেশের কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীর অনিচ্ছুক মাথার ভেতরে জোর করে আইসিটির নামে অপ্রয়োজনীয় কিছু সিলেবাস গিলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে? সাধারণ কম্পিউটার চালানোর জন্য বেসিক কিছু প্রোগ্রাম বাদে আর কিছুই দরকার নেই। যারা কম্পিউটার নিয়ে বিশেষ কিছু শিখতে চায় তারা নিজের আগ্রহে শিখবে। যেমন রাজু শিখেছে, আরো হাজার হাজার রাজু আছে বাংলাদেশে। কেউ প্রোগ্রামিং, কেউ গ্রাফিক্সে, কেউ ডেটাবেস, কেউ নেটওয়ার্কিং, যার যেটা পছন্দ সেটা বেছে নিবে। এ জন্য বিজ্ঞানের ছাত্র ছাড়াও বাণিজ্য, মানবিক সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীকে এক যোগে জাভা, এইচটিএমল,সিএসএস, সি প্লাস প্লাস, এলগরিদম, নেটওয়ার্কিং শিখতে হবে? সবগুলার কাজ কী একই? অদ্ভুত এই নীতি। যারা শিক্ষানীতি তৈরি করেন, তাদের মাথায় কী এসব জিনিস আসে না?
আমি গত বছর নতুন কারিকুলাম নিয়ে অনেক সমালোচনা দেখেছি। স্কুলের ক্লাসে ডিমভাজি আর আলুভর্তা শিক্ষা নিয়ে প্রচুর হাসাহাসি হয়েছে। আমার মনে হয় সব মানুষের জীবনে কোন না কোন সময়ে ডিমভাজির শিক্ষাটা কাজে লাগবে। কিন্তু ৯৯% মানুষের জীবনে একবারও এসব প্রোগ্রামিং শিক্ষা কোন কাজে আসবে না। অথচ ডিমভাজি নিয়ে অভিভাবকদের যেরকম সরব হতে দেখেছি আইসিটি নিয়ে কোন কথা বলতে শুনি না। আমার মতে আইসিটি ডিমভাজির চেয়েও অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয়।
আইসিটির মতো বিষয় থাকবে ঐচ্ছিক। ওটা এক্সট্রা কারিকুলামের অংশ। যার ভালো লাগবে সে শিখবে, পড়বে, ক্যারিয়ার গড়বে। কিন্তু আপনারা সারা দেশের সব মানুষকে রাজু বানিয়ে ফেলতে চাইছেন জোর করে। অথচ দেশে রাজু বানাবার মতো কয়টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেটা ভেবেছেন? তাছাড়া দেশে কী শুধু রাজু তৈরি হবে? মীনাদের কোন দরকার নেই? যে ছাত্র/ছাত্রী ওই বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়, তাকে কেন অপ্রয়োজনীয় একটা শিক্ষা জোর করে গিলিয়ে খাওয়াতে হবে?


 

Monday, April 22, 2024

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বিচিত্র আলোকমালা: বায়োলুমিনিসেন্স




আমি জানি না সেন্টমার্টিন দ্বীপে রাতের বেলা এই দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আর কারো হয়েছে কিনা। সেটা জানার জন্য ত্রিশ বছর আগের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।

১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা ছয় তরুণের একটা দল গল্প করতে করতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পূর্ব দিকের সৈকত ধরে হাঁটছিল। এডভেঞ্চারপ্রিয় দলটা সেদিন দুপুরে এসেছে একটা জেলে নৌকায় চড়ে। উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে নৌকাটা যখন খাবি খেতে খেতে সৈকতে এসে পৌঁছালো তখন চরের মধ্যে ঘুরতে থাকা দু চারজন বাদে আর কেউ ছিল না। ওই দ্বীপে তখন কোন ঘাট ছিল না। নৌকা সরাসরি এসে সৈকতে লাগতো। সৈকতে সারি সারি জেলে নৌকা বাদে আর কিছু নেই। ধূ ধূ বালিয়াড়ি, নারিকেল গাছ আর কেয়া ঝাড় শুধু। সাগর গরম থাকায় সেদিন সেন্টমার্টিনের কোন জেলে নৌকা সমুদ্রে নামেনি। টেকনাফ থেকেও এই একটি নৌকা বাদে কোনও নৌকা আসেনি। সেন্টমার্টনে তখনো পর্যটন ব্যাপারটা চালু হয়নি। মাঝে মাঝে দলছুট দুয়েকজন বাদে সেই দ্বীপে কেউ যেতো না। হুমায়ূন আহমদের সমুদ্র বিলাস তখনো তৈরি হয়নি।
ছয়জনের দলটি যখন আগের রাতে টেকনাফে ঘুরে ঘুরে সেন্টমার্টিনে যাবার উপায় খুঁজছিল তখন বাজারের লোকজন তাদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছিল। দুয়েকজন তো এমন ভয় দেখালো ওই দ্বীপে গেলে জলদস্যুদের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু সেসব ভয়কে জয় করে দলটা যে কোন উপায়ে যেতে মরিয়া ছিল। তাদের কারো বাসায় জানে না এই অভিযানের কথা। সবাই বলে এসেছে কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি চারদিনের জন্য।
দিকনির্দেশনাহীন সেই ভ্রমণে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেগুলো অন্য সময়ে বলা যাবে। আপাতত সেই রাতের ঘটনাটা বলা যাক।
একটা ঝুপড়ি দোকানে রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুটঘুটে অন্ধকার দ্বীপে গ্রাম্য পথ ধরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাত দশটার পর ঘুমানোর জন্য নির্ধারিত আস্তানায় রওনা হলো দলটা। আস্তানাটা হলো পূর্বদিকের সৈকতের ওপর দাঁড়ানো গণস্বাস্থ্যের রেস্টহাউস। ভাগ্যক্রমে নৌকায় আসার পথে ওই রেস্টহাউসের কেয়ারটেকারের সাথে পরিচয় হয়েছিল দলের একজনের সাথে। তাঁর সাথে রফা করে ১০০ টাকার বিনিময়ে একটা রুমে ছজনের থাকার বন্দোবস্ত। সৈকতের বালিতে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া দলটার জন্য একটা ডাবল খাট সমৃদ্ধ এক রুমের এই আস্তানা পাঁচ তারকা হোটেলের চেয়ে বেশি ছিল।
নিঝুম সৈকতে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো দলটা। বাম দিকে তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র থেকে নীল রঙের ঢেউ এসে লুটিয়ে পড়ছে দূরের সৈকতে। প্রথম দেখায় সবাই ভাবলো কোথাও থেকে আলো এসে পড়েছে বলে ঢেউয়ের নীলাভ ফেনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুতবিহীন দ্বীপে আলো আসবে কোথা থেকে? হারিকেন আর কুপিবাতি ছাড়া ওই গ্রামে আর কোন আলোর উৎস নেই।
দলের মধ্যে সেন্টমার্টিন নিয়ে খানিক পড়াশোনা করা একমাত্র সদস্য আমি। তাই সবাই আমার দিকে তাকালো কোন উত্তর আছে কিনা। কিন্তু আমার পড়াশোনা সেন্টমার্টিনের সমুদ্রের তলদেশে প্রবালের রঙিন বাগান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। সেটাও পশ্চিম সৈকতে। পূর্বদিকে এই ঘটনা ভারী অদ্ভুত।
রহস্যময় আলোর ছটা দেখে কৌতূহলী হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম যেখানে ঢেউগুলো সৈকতে আছড়ে পড়ছে সেই জায়গাতে। কাছে যাবার পর আমাদের মাথা ঘুরে যাবার দশা। ঢেউগুলো যখন সৈকতে ভেঙ্গে পড়ছে তখন লক্ষ কোটি তারকা যেন ছড়িয়ে পড়ছে বালির ওপর। দূর থেকে ঢেউটা দেখতে নীল মনে হচ্ছিল। কিন্তু ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার পর দেখলাম লাল নীল সবুজ হলুদ কমলা নানান রঙের তারকা সৈকতে ছড়ানো। আকাশে তাকিয়ে যত তারা দেখছি নীচের সৈকতেও তার চেয়ে কম নয়। ভয় আর আনন্দের যুগপৎ শিহরণে আমরা নেচে উঠলাম সবাই।
কাছে গিয়ে ভেজা বালিতে হাত দিয়ে জিনিসটা তুলে নিলাম। হাতে নেবার পর হাতও নীলাভ রঙে আলোকিত হয়ে গেছে। ওই আলোতে ঘড়ির সময় দেখেছিলাম মনে আছে। কিন্তু জিনিসটা কী বুঝতে পারছিলাম না। টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম স্বচ্ছ দানাদার কোন পদার্থ মনে হলো। চিনির দানা যতটুকু, ততটুকু আকার। হাতে নিলে একটু উষ্ণবোধ হয়। আমাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে আশ্চর্য একটা দৃশ্য।
তখন ভেবেছিলাম এই দৃশ্য সেন্টমার্টিনে সবসময় দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী ত্রিশ বছরে আরো কয়েকবার সেন্টমার্টিন গেছি, ওই দৃশ্যের দেখা আর কখনো পাইনি। সেই অপরূপ দৃশ্যের ছবি তোলার সুযোগ হয়নি। আমাদের কাছে যে সাধারণ ক্যামেরা ছিল তাতে ওই দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব ছিল না। এতদিন পর মনে হচ্ছে সেই দৃশ্যের উৎস ছিল ‘বায়োলুমিনিসেন্স’ জাতীয় কিছু। যেটা প্লাঙ্কটন বা কোন ধরণের সামুদ্রিক অনুজীব থেকে ছড়ায়। বিশেষ কোন দিনে কিংবা বিশেষ কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে সেগুলো আবির্ভূত হয়।
এখন কত হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সেন্টমার্টিন যায়। কিন্তু কারো কাছ থেকে ওরকম অপরূপ দৃশ্যের কোন অভিজ্ঞতার সন্ধান পাইনি। কয়েকদিন আগে সেন্টমার্টিনের এক বাসিন্দা ওই দৃশ্যের একটা ছবি পোস্ট করলেন ফেসবুকে। ছবিটা দেখে আমি চমকে গেলাম। এই তো সেই ঢেউ ৩০ বছর আগে যেটা আমরা দেখেছিলাম সৈকতে দাঁড়িয়ে। তাঁর কাছ থেকে ছবিটা ধার নিলাম এই লেখার জন্য। কিন্তু সৈকতে ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার পর যে লক্ষ কোটি তারার মেলা বসে সে দৃশ্যের ছবি নেই।
আমি জানি না আমার বন্ধু তালিকায় সেই দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আছে তেমন কেউ আছে কিনা। যদি কেউ থাকেন, তাহলে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন। সম্ভব হলে ছবিও।
পৃথিবীর খুব বেশি জায়গায় এরকম দৃশ্য নেই। গুগল করে অল্প যে কয়টি ছবি দেখলাম সবগুলোতেই নীল রঙ। ৩০ বছর আগে আমরা যে বহু রঙের তারার মেলা দেখেছিলাম কোথাও সেই দৃশ্য নেই। কেন নেই? তার মানে যে জীবগুলো ওই রঙের সৃষ্টি করতো সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে পরিবেশ দুষণের কারণে? আমি জানি না।
আজ নাকি Earth Day, এই দিবসটা পৃথিবীর জন্য মন খারাপ করে দেয়। আমরা প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন এই গ্রহটাকে একটু একটু করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।
......................................................
[** পোস্টে ব্যবহৃত তিনটি ছবির দুটি নিয়েছি সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা তৈয়ব উল্লাহ ভাইয়ের কাছ থেকে। আরেকটি ছবি নেয়া হয়েছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপের একটা সাইট থেকে ]

Friday, April 19, 2024

চোখের আলোয় দেখেছিলাম

লেখালেখির কাজে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চোখ। দিনের অর্ধেকের বেশি সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে হয়। চশমার পাওয়ার বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বী। কিছুদিন পর স্বাভাবিক দৃষ্টিতে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। এত কিছু পড়তে হয়, সবকিছুতে চোখের ব্যবহার। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অথচ রাতের বেলা দুই চোখে ঘুম থাকে না। দিনের অভ্যেসে জেগে থাকে কোন কাজ না থাকলেও। মাথার ওপর ছাদ না থাকলে আকাশের তারা গুনতাম। আমি যে বাসায় থাকি তার ওপরে আরো পাঁচটা বাসা আছে। তার ওপর ছাদ। সেই ছাদে কখনো শোবার সুযোগ পাইনি। ছাদে শুয়ে ঘুমোতে কেমন লাগে একবার দেখতে হবে। বারো তলার ছাদের ওপর মাদুর পেতে বালিশ নিয়ে শুয়ে থাকতে হবে। নক্ষত্রের কাছ থেকে আলো ধার নিয়ে আরো কিছুদিন পৃথিবীর রূপরস উপভোগ করতে চাই। জ্ঞানচর্চার জন্য দৃষ্টি শক্তিকে বিসর্জন দেয়ার উপযোগিতা কতখানি? এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি। মাঝে মাঝে ভাবা উচিত।

বাবার নোটবুক ১৯৫৫

 






হঠাৎ করে আমার বাবার পুরোনো একটা পকেট ডায়েরি আবিষ্কার করলো আমার পুত্র। যে জিনিস আমি নিজেও কোনদিন দেখার সুযোগ পাইনি। দাদীর সাথে খাতির করে তাঁর পুরোনো রত্নভাণ্ডার থেকে এটা উদ্ধার করেছে সে। ব্যক্তিগত জিনিস হলেও শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না কারণ সেখানে বাবার তারুণ্যের দুটো কাব্য প্রতিভার নিদর্শন রয়েছে। যার একটা বাংলা আরেকটা ইংরেজি। যদিও নিশ্চিত নই এগুলো মৌলিক কবিতা নাকি অন্য কারো বই থেকে টুকে নেয়া। কিন্তু বিষয়টা চমকপ্রদ এবং ১৯৫৫ সালের এত চমৎকার একটা ডায়েরি খুঁজে পাওয়াটাই আমার জন্য দারুণ ব্যাপার। ২৭ বছর আগে প্রয়াত বাবার এই স্মৃতিটা এখন আমার কাছে অমূল্য সম্পদ।

লেখালেখির বয়স

শেখার কোনও বয়স নেই, শেখার কোনও শেষ নেই, শিখতে কোনও লজ্জা নেই। আমি সব জেনে বসে আছি এই ধারণা যার ভেতরে ঢুকবে তার শেখার সম্ভাবনা শেষ। আমার প্রতিদিনই নতুন কিছু শেখার আগ্রহ জাগে। অনেক ক্ষেত্রে আমি শেখার সূত্র পাই তরুণদের কাছ থেকে। আমার বন্ধুতালিকায় যত পড়ুয়া আছে, তাদের অধিকাংশই আমার চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ, কিন্তু জ্ঞানে আমার চেয়ে অনেক ভারী। আমি প্রতিনিয়ত তাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার সুযোগ পাই। নাম বলছি না, কিন্তু এখানে এমন কয়েকজন আছে তারা জীবনে যত বই পড়েছে, আমি তত বই চোখেও দেখিনি।
 
মাঝে মাঝে দেখি প্রবীন লেখকদের কেউ কেউ বলেন আজকালকার তরুণরা যা লিখছে তা কিছুই হচ্ছে না,তাদের দেবার কিছুই নেই। দুর্ভাগ্য তাঁদের তাঁরা নিশ্চয়ই শুধু খারাপ লেখকদেরই দেখেছেন। আমার সৌভাগ্য আমার চোখে পড়া অধিকাংশ তরুণ দারুণ প্রতিভাবান। আমার বন্ধু তালিকায়ও এমন কয়েকজন আছেন তারা দেশের যে কোন প্রতিষ্ঠিত লেখকের চেয়ে অনেক ভালো লেখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকাংশই প্রচারের আলোয় থাকে না। অন্তত মূলধারার সাহিত্য বলে যেটা আছে সেখানে তাদের লেখাপত্রের প্রচার দেখি না।

এটা গেল সাহিত্যের কথা। এবার ইতিহাসের কথা বলি। যেহেতু ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করি, আমার ধারণা ছিল আমি পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি অনেকদূর জেনে গেছি। সেদিন এক কিশোরকে দেখে আমার সেই ধারণা বড় ধরণের ধাক্কা খেলো। মাত্র আধঘন্টার আলাপে সে আমাকে পৃথিবীর ইতিহাসের এমন গুরুতর কিছু তথ্য শেখালো, যেগুলো আমার জানা ছিল না। যেটা শিখতে গেলে আমার দশটা ভলিউম উল্টাতে হতো। যে যুগে তরুণরা বই পড়ে না বলে দুর্নাম আছে সে যুগে এই তরুণেরা আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা হতে পারে।
 
অতএব, এই আকালের দিনে বাংলা সাহিত্যে যেসব তরুণ ভালো কাজ করছে তাদের উৎসাহ দেয়া উচিত। যেসব প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক এখন আর ভালো লিখছেন না, শুধু নাম হয়েছে বলে মূলধারার সাহিত্যের আসরগুলো দখল করে আছেন, তাদের উচিত অবসরে যাওয়া। তাঁদের কারণে অনেক প্রতিভাবান তরুণ পত্রিকার পাতায় জায়গা পাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চমৎকার একটা সরস লেখা লিখেছিলেন। লেখাটি আমার বিশেষ প্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক বলে এখানে যুক্ত করলাম। শ্যামল যদিও পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতায় লিখেছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতাও একই বলা চলে।

++বৃক্ষ যদি বৃদ্ধ হয়++

“পাহাড়ের ক্ষয় আছে। নদী একদিন শীর্ণ হয়ে আসে। বৃক্ষ বৃদ্ধ হয়। এই অবস্থায় লেখক কত দিন লেখক থাকতে পারেন? তাঁরও তো ক্ষয় আছে। শারীরিক ক্ষয়ের প্রশ্ন তো আছেই। লেখক সত্তারও তো ক্ষয় আছে।

সে কথা কতটা মনে থাকে। লিখে লিখে পাঠক তৈরি হয়ে গেলে লেখক লেখক হয়ে যান। তার পর তৈরি পাঠককে লেখক লেখা দিতে থাকেন। একটা সময় আসে— যখন দেখা যায়— পাঠক আর সে লেখা চাইছেন না। পাঠক আর আগের মতো স্বাদ পাচ্ছেন না। উপরন্তু নতুন নতুন পাঠক এসে গেছেন। তাঁরা নতুন খাবার চান। এই পালটে যাওয়া অবস্থা অনেক লেখক মেনে নিতে পারেন না। কিম্বা নিজেও নিজেকে বদলাতে পারেন না। ভাবেন— পাঠক যেমন নিচ্ছিলেন—তেমনই নিতে থাকবেন। এই দুঃখজনক অবস্থা সৃষ্টি হয় প্রধানত লেখকের জন্যে। আর সৃষ্টি হয় সম্পাদকের কল্যাণে। কোনও এক সময় লেখকের লেখা ছেপে সম্পাদক সাড়া পেয়েছিলেন। কয়েক বার সাড়া পেয়ে মনে হয় নিরন্তর সাড়া পেয়ে যাব।

পত্রিকার রথ নিজের গতিতে সর্বদাই কিছুটা গড়গড় করে গড়ায়। সেই গড়গড়ানো লেখকের লেখার সাড়া ভ্রমে সম্পাদক নিরন্তর যদি পাঠকের ওপর লেখককে চাপিয়ে দেন—তখনই দুঃখের ঘটনা ঘটে।

পাহাড়, নদী, গাছের কর্মকাণ্ড বা ক্ষয় হঠাৎ বোঝা যায় না। এদের জয় বা ক্ষয়- দুটোই খুব বড়। কিন্তু ধীরে ধীরে। তাই দেখা যায় না। সে তুলনায় লেখক একজন মানুষ মাত্র। জেমা, অভিমান, অহম্ ইত্যাদির পুঁটুলি এই লোকটির ক্ষয় ও জয় বেশ চোখে পড়ার। তাই বোধ হয় তাঁর অবসর নেওয়ারও একটা সময় আছে।
কিন্তু ঘটনা দেখা যায় অন্য রকম।

আমরা লেখক। অন্য গ্রহ থেকে এসে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছি। নিত্য প্রসবিনী। নিত্য প্রকাশমান। অশক্ত না হওয়া অবধি লিখে যাব।

নিষ্ঠুর সময় বালির ঝাপটায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস চাপা দিয়ে ঢেকে ফেলছে। পাহাড়ের গা বর্ষার জলে ক্ষয় হয়ে ধসে পড়ছে। মোহনা থেকে পালটা ধাক্কায় পলি ফিরে এসে নদীর বুকে চর তুলে দিচ্ছে। চার হাজার বছরের প্রাচীন রেড উড গাছ সভ্যতার পর সভ্যতার জন্ম ও মৃত্যুর ফেনা গায়ে মেখে নিয়ে নিজের উচ্ছেদের দিনটি শুনতে থাকে। আর একজন লেখক — সামান্য মানুষ— তিনি কী করে প্রকৃতির নিয়ম অতিক্রম করবেন?

বাবুর প্রথম গল্প ১৯৪৬ সনে সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৫৬ সনে তিনি যুগের প্রথম মশালচি হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকেই তিনি একটি নাম। এবং এই নাম হবার পর থেকেই তিনি অহম্, যা-লিখি-তাই-ই-লেখার মনোভাবে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে যান। তখন আর তিনি শিল্প নন। তিনি পত্রিকার অলংকার।

সংঘর্ষ, আবিষ্কার, নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ব্যাপারটা লেখকের ভেতর থেকে যেদিন উবে যায়— প্রাকৃতিক কারণেই উবে যেতে বাধ্য— তখন লেখককে প্রধানত মাথার ভেতরে বীজ বুনতে হয় গল্পের। লিখতে লিখতে সেই গল্পগাছের বৃত্তে ফুল আসে। তা দেখতে হয়তো ভালো। কিন্তু তা ফুল নয়।

বিষ্ণুপুর থেকে বাঁকুড়া যাবার পথে জ’পুরের জঙ্গলে দেখেছি— পুরনো গাছের জায়গায় তরুণ শাল চারা বসানো হচ্ছে।
লামডিং থেকে বিশ মাইলের ভেতর চা বাগানে দেখেছি ৬০ বছর বয়সের চায়ের ঝাড়কে লোহার চেনে বেঁধে ট্রাক্টর শেকড়-শুদ্ধ টেনে তুলছে। জানলাম, চায়ের ঝাড়ের আয়ু মানুষের মতোই। পীচে বালক, বিশে জওয়ান, চল্লিশে প্রবীণ, ষাটে বিদায়ী।
তাই— ভাবছিলাম, বৃক্ষ যদি বৃদ্ধ হয়— তাহলে....”

Wednesday, April 10, 2024

ঈদসংখ্যার পাঠক প্রতিক্রিয়া

 ১.

প্রথম আলো : ''রাজকীয় জলদস্যুর দল : সম্রাট আকবর, রানী এলিজাবেথ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম''

এবারের ঈদসংখ্যাগুলোর লেখার মধ্যে সর্বশেষ পড়লাম 'দৈনিক প্রথম আলো'য় প্রকাশিত হারুন রশীদের ''রাজকীয় জলদস্যুর দল : সম্রাট আকবর, রানী এলিজাবেথ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্ম'' লেখাটি। এক কথায় প্রতিক্রিয়া হলো - লেখাটি অসাধারণ। বিষয় নির্বাচন, তথ্যসন্নিবেশ, বিশ্লেষণ আর শাণিত গদ্যে উপস্থাপন - সবমিলিয়ে অনন্য এ লেখাটি পড়ে আমি মুগ্ধ। কীভাবে রানী এলিজাবেথের উত্থান হলো, তাঁর শৈশব-কৈশোর জীবনের ট্র্যাজেডি, দুঃখ-কষ্ট, সিংহাসনে আরোহণ, সাম্রাজ্যবিস্তার পরিকল্পনা,দস্যুতা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন, সম্রাট আকবরের কাছে পত্রপ্রেরণ ও ভারতসহ দুনিয়ার নানাস্থানে ব্রিটিশদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ; এসবের এমন চমকপূর্ণ ও তথ্যনিষ্ঠ বয়ান এর আগে কোথাও পড়িনি। লেখা পড়ে মুগ্ধতার বার্তা জানান দিতে রাতেই লেখকের সন্ধান করে তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম।

ড. এম.আবদুল আলীম
ইতিহাসবিদ, গবেষক
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা।

২.
সিল্করুট ঈদসংখ্যা: আমার 'শেখ দীন মোহামেদ' আবিষ্কার

ইতিহাসে আমার আগ্রহ সমকালীন সময়ে যারা উস্কে দিয়েছেন তাদের মধ্যে Haroon Rashid ভাইয়ের নাম অগ্রগণ্য। প্রতি ইদে নানান ইদসংখ্যা কেনা হয় --- সিল্করুট গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত কিনি। এবারে সিল্করুটের বাড়তি আকর্ষণ হারুন ভাই আর Shuhan Rizwan এর লেখা।
আজ পড়লাম হারুন ভাইয়ের ' আমার 'শেখ দীন মোহামেদ' আবিষ্কার' প্রবন্ধটি। প্রায় আড়াইশ বছর আগের কাহিনি। পলাশীর যুদ্ধের দুই বছর পরে জন্ম নেওয়া এক বাঙালি কিভাবে তার উচ্চাকাঙ্খা আর দুরন্ত সাহসে ভর করে এক সাহেবের সঙ্গে করে বিলেতে পাড়ি জমায়, সেখানে সংসার পাতে, ব্যবসায় উন্নতি করে --- সর্বোপরি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংরেজিতে তার আত্মকাহিনী প্রকাশ করে তার রোমাঞ্চকর বর্ণনা আছে এই লেখাতে। পাটনা থেকে আয়ারল্যান্ড, তারপর সেখান থেকে ব্রাইটন --- পৃথিবীর এ প্রান্তে জন্ম নিয়ে অন্য প্রান্তে যখন এই বাঙালি তার জীবনের অধ্যায় সমাপ্ত করেছেন ততদিনে তিনি হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টা এবং সঙ্গত কারণেই, বিখ্যাত জন।
হারুন ভাইয়ের লেখা নির্মেদ, নির্ভার। তার লেখায় ইতিহাস স্পর্শ করে সাহিত্যের মর্যাদা।
তার আরও অনেক লেখা পড়ার আশায় রইলাম।
আনন্দম!

ড. তারেক আজিজ 
বিজ্ঞানী ও গবেষক

Wednesday, April 3, 2024

বই প্রকাশনার বাস্তবতা: এক প্রকাশকের অভিজ্ঞতা

 সুমেরু মুখোপাধ্যায়:

বছর কুড়ি হল বাংলা প্রকাশনার সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়ই একটি পত্রিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হই, পরের বছরই সমস্ত দায়িত্ব হুড়মুড় করে ঘাড়ের উপর এসে পড়ে। সেসব ধরলে আরও পাঁচ বছর। ট্রেডল প্রেসে ছাপা হত, গালি প্রুফ ছিঁড়ে পাতা ডামি বানানো শেখাতেন কলেজস্কোরারের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় শ্রীকৃষ্ণগোপাল মল্লিক। প্রতিষ্ঠানিক ক্লাসে সেসব শিখিনি। তিনশো কপি ছাপা হত সে পত্রিকা যার বেশির ভাগ কপি পাঠাতে হত বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে। পাতিরাম, শিয়ালদা, সুবর্ণরেখা শান্তিনিকেতনে কিছু কপি রাখা থাকত, যার টাকা কখনই পেতাম না আর। কপি যেত অধিকাংশই সৌজন্য হিসাবে, বিক্রি করে টাকা ঘরে আসত না। হিসাবপত্তর সেভাবে করাও হয়নি, সেসব মিশে যেত নানা হইচইতে। তবে বান্ডিল বান্ডিল পত্রিকার কপি পড়ে থাকত পত্রিকা অফিসের বাংকারে। সে বাংকারে হাত পড়ত পরবর্তী সংখ্যার প্রস্তূতিতে। ২০০৯-১০ আমার ঢাকা প্রবাসে বাংলাদেশের প্রকাশনার সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়ি, তার আগে এসে গেছে গুচ। লেখার থেকে নাচানাচি কাঁপাকাপি বেশি হচ্ছে। কাজ ভাগাভাগি, দেশে বিদেশে মেল চেনে ঝগড়াঝাঁটি আহ্লাদ, সবই এখন কম্পিউটারে। প্রথম থেকেই ঠিক ছিল দাম রাখা হবে তুমুল সিজিনের বাঁধাপকপির থেকেও কম। সবাই ঘরে ঘরে পড়বে আর ডাকবে, হাম্বা-হাম্বা বলে। তখনও দিদির হরেকরকম্বার আবিষ্কার হয়নি। প্রথম চারটি চটি ছাপা হল ৫০০ কপি করে।
৯ঋকাল বুকস করতে এসে জানতাম তিনশো কপি তো বেচে দিতে পারব। প্রিন্ট অর্ডার ৫৫০ দেখে প্রেসের শান্তনুবাবু কিন্তু কিন্তু করলেন অনেকবার, সরাসরি কিছু বললেন না ছাপলেন একটু কমিয়ে ৩৫০ করে। প্রথম দুটি বই ৫৫০ করেই ছাপা হয়ে গিয়েছিল। যার একটি বই আজও শেষ হয়নি আট বছরে। আরও বলা ভাল তার অর্ধেক শেষ হয়েছে সবে। ঠেকে শিখি। সিটিপিতে ছাপা, কাগজের দাম, কাপড় দিয়ে বোর্ড বাঁধাই সবই বেড়েছে কয়েক বছরে। এসেছে ডিজিটাল বলে এক মারণ রোগ। যাতে ১০/২০ কপিও ছেপে ফেলে হাত ঝেড়ে ফেলা যায়। আমাদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৪০ ছুঁইছুঁই। আপ্রাণ চেষ্টা করছি বইয়ের সংখ্যা কমানোর। অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয় বই বলে মনে হলে এগোই না আর। নতুনদের বই করার জন্য অনেক প্রকাশনা এসেছেন। তাঁরা অনেক শর্টকার্ট জানেন। অধিকাংশ স্বপ্ন দেখেন বয়ই বেচে বড় হবেন, বদলে দেবেন সব। দুরন্ত পি আর। রেগুলার ফিডে থাকার মতো মমতাশংকর বা প্রামাণিক চাই। আসলে টোপ চাই, শাঁসালো লেখক চাই কারণ একমাত্র তেলেই মাছ ভাজা যায়। তার পরে বায়নাক্কা কম থাকে। কেউ কেউ সোসাল মিডিয়ায় খুব পপুলার। পোস্ট দেওয়ার আগেই ভক্তেরা লাইক, লাভ দেওয়ার স্যাডো প্রাকটিশ করেন। বই বার হলে একশো কপি ফুস করে ( হ্যাঁ দুই তিন দিনে) বিক্রিও হয়ে যায়, পরের একশো কপি যদিও পরবর্তী দুই তিন বছরেও বিক্রি হয় না। একশো কপি কী অনেক বেশি? এঁদের বই তখন অনেক প্রকাশকই করতে চান নিজের খরচায়। পরের বই ৮০% ক্ষেত্রে ৫০ কপিও বিক্রি হয় না। এঁদের বেশিরভাগ ওয়ান টাইম ওয়ান্ডার হিসাবে থেকে যাচ্ছেন বাংলা প্রকাশনায়।
প্রচুর ত্যানা পেঁচিয়েছি। আমি কলকাতার সহযোগী প্রকাশক / লেখক বন্ধুদের থেকে জানতে চাই, এখন খুব বেশি বিক্রি বলতে কত বোঝেন? সংস্করণ বলে এখন কিছু বেঁচে নেই। সবাই তুমুল সংস্কার করে ফেলেছি সব। তন্ত্র, মন্ত্র, ভুত, গোয়েন্দা, এগুলি নাকি ভাল বিকোয়। সেসব নিয়ে আমি জানি না, আলোচনায় আনবেন না। কলেজস্ট্রিটে আর একটা শব্দ খুব কার্যকরী 'মরা লেখক'। আমি ব্যাখ্যা করলাম না। বাংলাদেশের রয়্যালটির চেকের ছবি অনেকের মনোবিকারের কারণ হতে পারে, কিন্তু বাস্তব তো কঠিন। নিজেকে আনিসুল হক, নজিম উদ্দিন, সুমন্ত আসলাম ভাববেন না। আপনার বই আপনি নিজে বিপণন না করলে (না কিনে নিলে) সারা বছরে ৫০ কপিও বিক্রি করা শক্ত। তাকে মেনে নিতে হবে।

[সূত্র: লেখকের ফেসবুক পোস্ট, ৩ এপ্রিল ২০২৪]

Saturday, March 30, 2024

পাঠ প্রতিক্রিয়া- নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি

 



লিখেছেন - জালাল আহমেদ
২৯ মার্চ ২০২৪

সাধারন জ্ঞানের মুখস্ত বিদ্যায় একটি প্রশ্ন ছিল অবশ্যম্ভাবী, নিষিদ্ধ নগরী কোনটি? কখনো নিষিদ্ধ দেশ কোনটি? উত্তর প্রায় সবারই জানা ছিল, লাসা, তিব্বতের রাজধানী আর দেশ ছিল তিব্বত। তিব্বত চীনের অংশ আবার চীনের অংশ নয় এই নিয়ে বিতর্কও দীর্ঘদিনের। তবে স্মরণাতীত কাল থেকেই তিব্বত ছিল স্বতন্ত্র এক দেশ। আর চতুর্দশ শতক থেকে তিব্বত শাসন করতো তাঁদের ধর্মগুরু দালাই লামা। পঞ্চম দালাই লামা, দ্য গ্রেট ফিফথ লবসাং গিয়াতসো সপ্তদশ শতকের শুরুতে এক ভবিষ্যৎবানী করেন যে বিদেশীদের হাতে তিব্বত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মূলতঃ তারপর থেকেই তিব্বত বিদেশীদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা হয়ে যায়।

ঔপনিবেশিক যুগের শুরুতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চেষ্টা ছিল ভারতবর্ষ, বিশেষ করে বাংলার বিভিন্ন জেলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। ১৭৭২ সালে জেলাসমূহে প্রথম দফা কালেক্টর নিয়োগের সময় তাদের দায়িত্ব ছিল তাদের অধীনস্থ এলাকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ও কলকাতায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করা। বাংলার সংগে তিব্বতের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্ম যেমন প্রবর্তন করেছেন পদ্মসম্ভব বা রিনপোচে তেমনই তার সমন্বিত রূপ দিয়েছেন বাংগালী পন্ডিত অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান। তিব্বতীয় সাধুদের গুরু ছিলেন ভারতীয় সিদ্ধাচার্যগন। একইসংগে ছিল গিরিপথ বেয়ে বানিজ্যক সম্পর্ক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী চাইলো এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে তাই গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৪ সালে তিব্বতে প্রথম দূত প্রেরন করেন জর্জ বোগলেকে। এরপরেও একাধিক বানিজ্যিক বা তথ্যানুসন্ধানী মিশন তিব্বতে যায়। এমন কি ১৮১৫ সালের দিকে রংপুরে কালেক্টরেটে দেওয়ান পদে কাজ করার সময় রাজা রামমোহন রায়ও একটি মিশনের অংশ হিসেবে তিব্বতে গিয়েছিলেন।

কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে অবস্থা পালটে যায়। মধ্য এশিয়া জুড়ে শুরু হয় গ্রেট বৃটেন-রাশিয়ার মধ্যে দ্য গ্রেট গেম। ফলে তিব্বতের উপর দিয়ে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ বৃটিশ সরকারের অগ্রাধিকারে পরিনত হয়। লাদাখ দিয়ে যেমন একের পর এক অভিযান পরিচালিত হয় তেমনই বাংলা থেকেও তথ্য সংগ্রহ অভিযান চলতে থাকে। দার্জিলিং এর এক দরজি কিন্টুপকে পাঠানো হয় এলাকা জরিপ ও ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ অনুসন্ধানে। একইসংগে আমাদের চট্টগ্রামের সন্তান, দার্জিলিং এর ভুটিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরৎচন্দ্র দাসকেও পাঠানো হয় তিব্বতে। ১৮৭৯ সালে ছয়মাসের জন্য ও ১৮৮১ সালে চৌদ্দমাসের জন্য শরৎচন্দ্র দাসের তিব্বতবাসের মাধ্যমে ইংরেজ সরকার প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে এবং কলকাতার সরকারি প্রেস থেকে ‘গোপনীয়’ লেবেল দিয়ে এই বিবরনীর নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করে। ১৮৭৯ সালের ভ্রমনের বিবরণ পঁচিশ কপি “ন্যারেটিভ অফ এ জার্নি টু তাশিলহুনপো ইন ১৮৭৯” নামে ১৮৮১ সালে ছাপা হয়। ১৮৮১ সালের দ্বিতীয় ভ্রমনের বিবরণ ১৮৮৫ সালে “ন্যারেটিভ অফ এ জার্নি টু লাসা ইন ১৮৮১-৮২” ছাপা হয় ১৮৮৫ সালে ১০০ কপি। তবে আমার ধারনা তাঁর এই দুই অভিযানের বিস্তারিত মূল বিবরন এখনো ভারতীয় জাতীয় আর্কাইভ বা ব্রিটিশ লাইব্রেরীর কোন বাকসে পরে আছে। প্রকাশিত এই দুটি ভ্রমন বিবরনী র অনুবাদ ইতোপূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আমি পড়েছিও কিন্তু যখন মূল ইংরেজির সংগে মিলিয়ে পড়তে গিয়েছি তখনই হোঁচট খেয়েছি। মূল থেকে বিচ্যুতি ও সংক্ষেপিত করার কারনে মূল লেখার রস অনুবাদে পাইনি। আমার অন্যতম প্রিয় লেখক Parimal Bhattacharya তাঁর “শাংগ্রিলার খোঁজে” বইতে শরৎচন্দ্র দাসের ভ্রমনের যে সরস বর্ণনা দিয়েছেন তাতেও সাধ মিটছিলো না।

এইক্ষেত্রে চমকে দিলেন "উপনিবেশ চট্টগ্রাম: ৫০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস" এর লেখক, শক্তিশালী অনুবাদক Haroon Rashid । মূল লেখার স্বাদ অক্ষুন্ন রেখে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ অনুবাদ করেছেন শরৎচন্দ্র দাসের এই দুই ভ্রমন বিবরনী। অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এই বিবরণ যেন প্রান পেয়েছে হারুন রশীদ এর দক্ষ অনুবাদে। শরৎচন্দ্র দাস এক বিশাল স্থায়ী অবদান রেখে গিয়েছিলেন টিবেটান-ইংলিশ ডিকশনারীর প্রনেতা হিসেবে। আর অন্যদিকে তাঁর দুই ভ্রমনে প্রাপ্ত তথ্য ইংরেজ সরকার ব্যবহার করেছিলো ১৯০৪ সালে কর্নেল ইয়ংহাজব্যান্ড এর সশস্ত্র তিব্বত অভিযানে। লেখক হারুন রশীদকে ধন্যবাদ এই মূল্যবান বই দুটো দুই মলাটের ভেতর স্বাদু গদ্যে মূলানুগ অনুবাদে আমাদের সামনে হাজির করার জন্য। টি এইচ লিউইন এর “এ ফ্লাই অন দ্য হুইল” এর অনুবাদের পর বাংলাদেশের অনুবাদ সাহিত্যে এটি আরেকটি মূল্যবান সংযোজন। তিনি যে বিষয়ে আগ্রহী সে বিষয়ে আরও অনেক মূল্যবান রচনা অনুবাদের অপেক্ষায়। আমরাও অপেক্ষায় থাকবো পরবর্তী চমকের জন্য।

***** ****** ******

লিখেছেন - মনিরুল ইসলাম
১০ মার্চ ২০২৪
শরৎচন্দ্র দাস তবে ঠিক কী? পণ্ডিত? রোমাঞ্চকর দুর্গম পথের অভিযাত্রী? না কি ব্রিটিশের বেতনভুক গুপ্তচর? প্রশ্ন গুলো তুলেছেন আনন্দবাজার পত্রিকার পর্জন্য সেন। এগুলো হয়তো গভীর গবেষণার বিষয়।কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে সে আমার কাছে দুর্গম পথের অভিযাত্রী। শরৎ চন্দ্র দাসের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে পরিমল ভট্রাচার্যের ‘শাংগ্রিলার খোঁজে’ বইয়ের মাধ্যমে। বিস্ময়ের শুরু তখন থেকেই !এরপর যখন জানতে পাড়ি এই পণ্ডিত অভিযাত্রী আসলে চট্টগ্রামের আলমপুর গ্রামের লোক। তখন আগ্রহের জোয়ার এসে চিন্তার দুকূল ভাসিয়ে দিলো।শরৎচন্দ্র দাশ দুবার তিব্বত অভিযান করেছিলেন। প্রথমবার ১৮৭৯ সালে ছ'মাসের জন্য এবং দ্বিতীয়বার ১৮৮১ সালে। কেবল অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান অর্জন নয়, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে শরৎচন্দ্রের দুই দফা তিব্বত অভিযান বিশেষ গুরুত্ববাহী। ১৮৭৯ সালের ১৭ জুন উগ্যেন গিয়াৎসুর সঙ্গে শুরু হয় তিব্বতের দুর্গম পথে অভিযান। সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন একজন গাইড ও একজন কুলি। সঙ্গে নিয়েছিলেন জরিপকাজ চালানোর জন্য সেক্সট্যান্ট ক্যামেরা, প্রিজম্যাটিক কম্পাস, হিপসোমিটার, থার্মোমিটার ও ফিল্ড গ্লাস। দিনলিপির আকারে লেখা সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা পড়তে পড়তে মনের অজান্তে নিজেও সেই অভিযাত্রায় সামিল হয়ে যাই।
‘ আ জার্নি টু লাসা এন্ড সেন্ট্রাল টিবেট’ থেকে অনুবাদ করে দেবাংশু দাশগুপ্ত লিখেন ‘তিব্বতে দু’বার’।যদিও নাম ‘তিব্বতে দু’বার’ হলেও বইটি মূলত ১৮৮১ অভিযাত্রার উপরে রচিত।সে হিসেবে হারুন রশিদ রচিত ‘ শরচ্চন্দ্র দাস-নিষিদ্ধ তিব্বতে প্রথম বাঙালি’ দুটি অভিযান নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা বই’।যদিও বইটি শুধু শরৎ চন্দ্র দাসের দুইটি বিবরণই নয়, আলোচনা করা হয়েছে তার জীবনের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নিয়েও।শরৎ চন্দ্র ও তার অভিযান এবং তিব্বত ও তার ইতিহাস জানার জন্য এর চেয়ে ভালো বই আর হতে পারে না।

পাঠ প্রতিক্রিয়া - থাংলিয়ানা

 



লিখেছেন- হারুন আহমেদ
৪ এপ্রিল ২০২৪

ব্রিটিশ কর্মকর্তা থমাস হারবার্ট লুইন ১৮৬৫ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। বইয়ের বিজ্ঞাপনে যদিও লুইনের অভিযানকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, বাস্তবে তার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও কম জরুরি নয়। লুইন পাহাড়িদের সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করলেও বাঙালিদের একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। এর কারণ তিনি মোক্তার বা মোড়ল জাতীয় বাঙালিদের সাথে পেশাগত সূত্রে মিশেছেন এবং দেখেছেন এদের সীমাহীন দুর্নীতি।
মনে রাখতে হবে, "থাংলিয়ানা " একজন ব্রিটিশের লেখা। তিনি সরাসরি সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নিয়েছেন এবং দায়িত্বরত অবস্থায় পাহাড়ের তথাকথিত অসভ্য বর্বর নৃ-গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধ করেছেন। এদিকে প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, চা বাগানের জন্য পাহাড় দখলের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পাহাড়ের বাসিন্দারা ক্রমশ গৃহহারা হয়ে যায় এবং এর ফলস্বরূপ ঘনঘন বাঙালি বা ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ করে। তারপরও নিজের কাজে লুইনের সততা স্পষ্ট বোঝা যায়। নতুন ও ভালো যে কোনো কিছু তিনি উদারচিত্তে গ্রহণ করতেন। একটা ঘটনা আছে এমন-
"রতন পুইয়ার গ্রামের একটা ঘটনার কথা মনে আছে। একবার আমি তাদের গ্রামে রতন পুইয়ার সাথে কথা বলছিলাম, তখন কোথা থেকে এক হদ্দ মাতাল এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। কিন্তু রতন পুইয়া তাকে তিরস্কার করা দূরে থাকুক, একটা কথাও বলল না। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে পাগড়িটা মাটি থেকে কুড়িয়ে ধুলো ঝেড়ে মাথায় বসিয়ে দিল।
আমি বললাম, 'এটা কেমন ব্যাপার হলো? তুমি তোমার অনুসারীদের বেয়াদবির জন্য শাস্তি দাও না?'
সে রীতিমতো আঁতকে উঠে বলল, 'বেয়াদবি? কী বলছেন সাহেব? সে একটা বদ্ধ মাতাল। তার কোনো হুঁশ নাই। সে কী করেছে নিজেই জানে না। ওটার কথা বাদ দিলে গ্রামে আমরা সবাই সমান। কিন্তু যখন যুদ্ধে যাই তখন সে যদি আমার কথা অমান্য করে সেটার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আছে। এখানে সে নিজের বাড়িতে আছে। ওসবের কোনো বালাই নাই। যে কোনো লোক চিফের বাড়িতে ঢুকে যে কোনো জিনিস নিয়ে আসতে পারে। তাদের কথা হলো-তিনি হলেন আমাদের চিফ। তিনি আরো অনেক উপহার পাবেন। আমাদের কাছে যা আছে সেগুলোও তাঁরই। অতএব তাঁর যা আছে সেগুলোও আমাদের। চিফ যদি আমাদের না দেয় তা হলে আর কে দেবে?' অকাট্য যুক্তি-কোনো সন্দেহ নেই।"
তিনি নিসর্গ পছন্দ করতেন এবং প্রায়ই দুঃসাহসিক বিভিন্ন অভিযানে জড়িয়ে পড়তেন। মাসের পর মাস ঘুরেফিরে একই পোশাক পরে, চড়াই উৎরাই পার হয়ে, খাদ্য স্বল্পতায় ভুগে, দৃঢ় মনোবল নিয়ে লুইন লুসাইসহ বিভিন্ন উপজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কিন্তু একবার সন্ধি স্থাপিত হওয়ার পর তাদের সাথে লুইনের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারাই তার নাম রাখে "থাংলিয়ানা।" লুইন বিভিন্ন বিরূপ পরিস্থিতি তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দ্বারা সমাধান করতেন। বৃটিশদের মধ্যেও কতো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও পেশাগত ঈর্ষা কাজ করতো তার বর্ণনা পড়ে অবাক হতে হয়।
সব মিলিয়ে, "থাংলিয়ানা " দারুণ একটি কাজ। হারুন রশীদের অনুবাদ ও ভূমিকা দুটোই প্রথম শ্রেণির।



লিখেছেন - মুহিবুল ইসলাম
২ এপ্রিল ২০২৪
প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। ভয় আর রহস্যে ভরা গভীর অরণ্যের পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান চালাতে চান বৃটিশ পুলিশের চৌকস কর্মকর্তা থমাস লুইন। সেজন্য তার দরকার ছিল এখানকার আদিবাসীদের সহায়তা। বান্দরবান এলাকার অরণ্যবাসী মুরং সম্প্রদায়ের এক দুর্দর্শ মোড়লকে বাগে এনে কাজে লাাগাতে চান। যার নাম ছিল তোয়েকাম তংলুইন। তাকে কাছে এনে পরিচয়পর্বে মোড়লের নাম শুনেই নিজের নামটা বিকৃত করে পাহাড়িদের মতো উচ্চারণ করে থমাস লুইন বলে ওঠলেন, “আপনি তো আমার পূর্বপুরুষের দিক থেকে আত্মীয় হন। আমার নাম আরবাট তংলুইন।” এই কৌশলে দারুণ কাজ হয়েছিল। এবং এর জের ধরেই বহু ঘটনা প্রবাহের পর শেষপর্যন্ত তংলুইন নামটা পাহাড়ি সংস্কৃতিতে কিছুটা বিকৃত হয়ে তংলুইন্যা এবং সবশেষে থাংলিয়ানা‘য় রূপান্তর হয়। এভাবেই থমাস হার্বার্ট লুইন হয়ে যান পাহাড়িদের থাংলিয়ানা।
...
১৭৬১ সালে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন জারি হলেও দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। সময়টা ছিল অবিশ্বাস্য অতিলৌকিক গুজবে ঠাসা। জনশ্রুতি ছিল ভারত বার্মার সীমান্তঘেরা বিস্তীর্ণ পার্বত্যভূমিতে বসবাসরত নানান উপজাতির বাসিন্দারা অসভ্য ও হিংস্র এবং ওরা সাপ ব্যাঙ শেয়াল কুকুর আর পতঙ্গই শুধু নয় মানুষকে পেলেও খেয়ে সাবাড় করতে কসুর করে না! ভয়-আতংকে সমতলের কেউ ভুলেও ওই অঞ্চলে পা রাখার দুঃসাহস দেখাতো না। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করেছিলেন এক ব্রিটিশ তরুণ। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬৫ সালে হারবার্ট লুইন নামের এক তরুণ বৃটিশ অফিসার চট্টগ্রামের পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। নিলাভ সবুজের হাতছানি আর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তার কারণে অনেক ঝুকি আর ঝঞ্জার ভেতরে স্বেচ্ছায় প্রবিষ্ট হয়েছিলেন এই তরুণ আফিসার। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ, অভিযান ইত্যাদি কোন কিছুই বাদ যায়নি তার কর্মজীবনে। সেই সুবাদে গুজব এবং ভয়ের এ রাজ্যের সত্যচিত্র সভ্যদুনিয়ার সামনে উন্মোচিত হয়। দিনশেষে শত্রুর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ইংরেজি নাম থমাস হার্টবার্ট লুইন রূপান্তরিত হয় পাহাড়ি নাম থাংলিয়ানায়!
বইটিতে রহস্যঘেরা বিশৃংখল অরণ্যবাসী মানুষের জীবন পরিক্রমার নানান স্তরের বা নানান বাকেঁর কথা উপকথাসহ নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রসুত বর্ণনা স্থান পেয়েছে, অরণ্য ও অরণ্যবাসীকে বুঝতে যার সুগভীর তাৎপর্য অনস্বীকার্য। লেখক ব্রিটিশ উপনিবেশ স্বার্থের রক্ষক হলেও তার বর্ণনায় অরণ্যবাসীদের হিংস্রতার তেমন কোন লোমহর্ষক বর্ণনা বইটিতে মূল ফোকাস বা উপজীব্য হয়ে ওঠেনি। দস্যুতা এবং অসভ্যতাই পাহাড়ীদের শুধুমাত্র বৈশিষ্ট্য এমনটা লেখক বলতে চাননি। তার অনেক কথায় পাহাড়িদের সততা এবং সরলতার কথাও উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন ‘ওরা ওদের নিজস্ব আলয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করে। তারা এ চেনা সভ্য জগতের বাইরে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের মানুষ হলেও নিজেদের জীবন নিয়ে তারা সন্তুষ্ট।’
...
চাকরিকালীন (১৮৬৫-১৮৭২) সময়ে নিজের ঝুলিতে সঞ্চিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরল সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিজের কুশলী কলমে লিপিবদ্ধ করেছিলেন থমাস হার্বার্ট লুইন। লন্ডন থেকে ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার স্মৃতিকথা ’A fly on the wheel' নামক বইটি। সেই বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত অধ্যায়গুলোর বাংলা অনুবাদ নিয়েই থাংলিয়ানা। অনুবাদক জনাব হারুন রশিদ অনুবাদের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকতা এড়িয়ে দারুণ মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সাবলীল অনুবাদের কারণে আমার কাছে বইটি সুখপাঠ্য মনে হয়েছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত দুশো পৃষ্ঠার বইটির প্রচ্ছদ, ছাপা সবই সুন্দর। প্রচ্ছদ একেছেন সব্যসাচী হাজরা, বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার কথাপ্রকাশ।

লিখেছেন - রাশেদ স্বপ্ন
২৯ মার্চ ২০২৪


একটু খাঁড়ান, ফর্মালিটি কইরা লই:

আঠারোশ পঁচাশি সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল A Fly On The Wheel নামের একটি স্মৃতিকথা। লেখকের নাম লেফটেন্যান্ট কর্নেল থমাস হারবার্ট লুইন। এডভেঞ্চারপ্রিয় এই ব্রিটিশ ভদ্রলোক তার স্মৃতিকথাটি প্রকাশের কুড়ি বছর আগে চট্টগ্রাম শহরের পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। আজ থেকে দেড়শো বছরেরও কিছু অধিক সময় আগেকার সেই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল বেশ কিছু দারুণ এডভেঞ্চারের। সেই সকল রোমাঞ্চকর অভিযানের এক লিখিত উপাখ্যান এই ‘থাংলিয়ানা’। ‘এ ফ্লাই অন দি হুইল’ মূলত একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে লুইন সাহেবের সমস্ত কর্মজীবনের স্মৃতিকথা। ‘থাংলিয়ানা’ সেই বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে উল্লিখিত অংশগুলোর বাংলা অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন হারুন রশীদ।

ফর্মালিটি শ্যাষ। এখন আসেন বইয়ের আলাপ করি।

থাংলিয়ানা কী:

‘থাংলিয়ানা’ মূলত লুইন সাহেবের পাহাড়ি ডাকনাম। এই নামকরণের পেছনে একটি চমৎকার ইতিহাস আছে। সেটি লিখে ফেলে বইয়ের আনন্দ নষ্ট না করাই ভালো। তবে থাংলিয়ানার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই যেহেতু এই বই, অতএব নামকরণ অতি অবশ্যই নজরকাড়া এবং প্রাসঙ্গিক।

বই কেমন:

এগারো বছর বয়সে আমি জীবনে প্রথমবারের মতো রবিনসন ক্রুশোকে চিনেছিলাম। ড্যানিয়েল ডিফো আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন এক উপকূল থেকে অন্য উপকূল, এক অন্তরীপ থেকে অন্য অন্তরীপ। তারপর গৃহত্যাগী রবিনসন ক্রুশোর সাথে বন্দী করে ফেলেছিলেন জনমানবহীন এক দ্বীপে। অবশ্য রবিনসন ক্রুশোকে নিয়ে আলোচনা এই অব্দিই হতে দেখেছি আমি। কোন এক অদ্ভুত কারণে সেই জনমানবহীন দ্বীপ ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপের মানুষখেকোদের থেকে মুক্তি লাভের পর ক্রুশোর জীবনে ঘটে যাওয়া বাকি এডভেঞ্চারগুলো নিয়ে কেন জানি খুব বেশি একটা কথা হয় না। সে কথা না হলে না হোক। মূল কথা ড্যানিয়েল ডিফো সদ্য কৈশরে পা দেওয়া আমিকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন তাঁর চমৎকার বর্ণনারমূলক লেখা দিয়ে।

আরেকটু বড়ো হলে এলেন বিভূতিভূষণ। আমাকে ধরিয়ে দিলেন ‘আরণ্যক’। তারপর আবারো সেই অদ্ভুত লেখা। সত্যচরণের সাথে নাঢ়া-লবটুলিয়ার সেই ঘন জঙ্গলের মায়ায় আমি বুঁদ হয়ে রইলাম পুরোটা সময়। সেই ঘোর আজও কেটেছে কি না সন্দেহ।

এবার পেলাম ‘থাংলিয়ানা’। সাহিত্যিক মান বিচারে থাংলিয়ানা আরণ্যক কিংবা রবিনসন ক্রুশোর ধারেকাছে যেতে পারে কি না, সেটা বিতর্কের বিষয়। তবে হারবার্ট লুইনের লেখা হোক বা হারুন রশীদের অনুবাদের মুন্সিয়ানা, থাংলিয়ানা আমাকে সেই রবিনসন ক্রুশো আর সত্যচরণের মতো করেই ঘুরিয়ে দেখালো দেড়শ বছর আগেকার পার্বত্য চট্টগ্রাম। যখন রাঙামাটি-বান্দরবানও বিবেচিত হতো অত্যন্ত দুর্গম এলাকা হিসেবে। জ্ঞানবুদ্ধি হবার পর থেকেই এদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের প্রতি একটা প্রবল টান অনুভব করেছি সবসময়। কিন্তু সময়-সুযোগ-অর্থ ও ইচ্ছাশক্তির অভাবের সম্মিলিত আক্রমণে ঘুরে দেখা হয়েছে খুব কম। তবুও যতটুকু দেখেছি, যতটুকু জেনেছি, তা আমার অন্তরে তৃপ্তি আনেনি। আমার বারবার মনে হয়েছে, নিরুদ্দেশ হয়ে মাসখানিক বান্দরবানের গহীনে গিয়ে থেকে আসতে পারলে ভালো হতো। এই দু-পাঁচদিনের অবসরে ওই মায়াবী ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের কতটা কাছে যাওয়া যায়?

সাধ আছে, সাধ্যি নেই, সাধ্যি আছে, সাধ নেই–এর চক্করে পড়ে জীবনে কোনোদিন পাহাড়ের অতটা কাছে যাওয়া হবে কি না, আমি তা জানি না। এমনিতেও অস্থিতিশীল পাহাড়কে তো আমরা স্থিতিশীল রাখতে পারিনি। তাই পাহাড়ে গিয়ে কোনোদিন নিজের দেশে ঘুরতে এলাম বলে মনেও হয়নি। ওখানে বাঙালি আগ্রাসন দেখে নিজেই নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত হয়েছি বারবার।

থাংলিয়ানা আমাকে এই পাহাড়ের গল্প শোনার একটা ছোট্ট সুযোগ করে দিল বলেই তার প্রতি মুগ্ধতার রেশ কাটছে না। লুইন সাহেবের সাথে আমিও ঘুরে বেড়িয়েছি চট্টগ্রামের পার্বত্য পথের উত্তর হতে দক্ষিণে, পথ হেঁটেছি পূর্বে। পাহাড়ি ঘন জঙ্গল পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছি কালাদান নদীর তীরে। আক্রমণাত্মক সেন্দু উপজাতির তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি সেই পার্বত্য বনে গভীর থেকে গভীরে। দেখেছি পাহাড় আর সমতলের কূটনৈতিক সমঝোতা রক্ষার জন্য লুইন সাহেবের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। দেখেছি লুসাই গ্রামে ব্রিটিশ আক্রমণ, শান্তি স্থাপন, লুসাইদের হাতে অপহৃত এক ব্রিটিশ বালিকা উদ্ধার হতে। সমগ্র বইটি পড়ার অভিজ্ঞতাটিই ভীষণ চমৎকার। বিশেষত দূরবর্তী নীলচে পাহাড়গুলোতে ছুটে যাওয়ার ইচ্ছা যখনই লুইনের কলমে প্রকাশ পেয়েছে, ততবার আমার চোখে সেই নীল পাহাড়সারি আর তাদের ওপরে ভেসে থাকা সাদা মেঘের দৃশ্য ভেসে বেড়িয়েছে। একবিংশ শতকের দেখার চোখ আর ঊনবিংশ শতকের দেখার চোখ এক হবে না জানি। তবুও চেনা দৃশ্যেই পুরোনোকে ধরতে চেষ্টা করে গিয়েছি যতক্ষণ বইটি পড়েছি তার পুরোটা সময়।

‘ন’ তে নগদে নেগেটিভ কিছু:

এত সব ভালোর মাঝেও নেহাত বাঙালি বলেই কিছু খারাপ লাগা কাজ করেছে। যতই লুইন সাহেব পাহাড়ে জনপ্রিয় হন না কেন, তার লেখাতে প্রায়শ ঔপনিবেশিক শাসকের মনোভাব অজান্তেই প্রকাশ পেয়েছে। আমার মনে হয়েছে লুইন সাহেব এডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ বলেই তিনি পাহাড়ে গিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করতে পেরেছিলেন। তার বর্ণনায় প্রায়ই একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার প্রবলেম সল্ভিং প্রসেসের কিছু না কিছু বিষয় উঠে এসেছে। তার প্রজাবাৎসল্যতার প্রকাশ তখনই দেখেছি। তবুও কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে এমন স্পষ্টবাদী, জনদরদি একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা কখনই ঔপনিবেশিক শাসন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। বোধ করি এই-ই জাতীয়তাবাদের স্বরূপ। সবকিছুর আগে নিজের দেশ।

বাঙালিদের নিয়ে পর্যাপ্ত বিষোদগার করে গিয়েছেন জনাব লুইন। তা অবশ্য কিছুটা তিক্ত সত্যই বচন করেছেন তিনি। তবে প্রশংসায় ভিজিয়েছেন পাহাড়িদের। সংঘাতের পরেও তাদের প্রতি লুইনের কলমে ঝরেছে শ্রদ্ধা ও সম্মান। একই শাসকের চোখে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে জাতি হিসেবে আমরা কতখানি মেকি আত্মগরিমায় ভুগি।

অনুবাদ নিয়ে দুটি কথা:

অনুবাদের মান নির্ণয়ের ধৃষ্টতা আমার নেই। সাধারণ পাঠক হিসেবে পড়তে গিয়েছি। পড়েছি। আনন্দ পেয়েছি। কল্পনার চোখে ঘুরে বেরিয়েছি বিস্তীর্ণ পর্বতাঞ্চল। আমার কাছে অনুবাদের সার্থকতা এই-ই। হারুন রশীদের প্রতি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা এবং শুভকামনা।


****** **** ****



লিখেছেন - সুচ চাকমা
২৮ মার্চ ২০২৪


থমাস হারবার্ট লুইন ছিলেন ভারতে ইংরেজ সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন লুইন নামে বিশেষভাবে পরিচিত। আমার বাল্যকালেই আমি আমার দাদুর মুখে শুনেছিলাম ক্যাপ্টেন লুইনের নাম। অবশ্য আমাদের গ্রামাঞ্চলে চাকমা উচ্চারণে বলা হতো "লুইন সাপ্যা"। সাধারণত সাদা চামড়ার বিদেশী লোকদেরকে চাকমারা বলে "ফারাঙি সাহ্‌ব"। আমার ধারণা ইউরোপিয়ানদের অনেকটা শ্বেতকুষ্ঠরোগীর মতো দেখায় বিধায় তাদেরকে ফারাঙি সাহ্‌ব বলা হয়ে থাকে। কারণ চাকমা ভাষায় কুষ্ঠ রোগকে বলা হয় ফারাঙি। যাহোক, চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, চাকমা সার্কেলের তৎকালীন শাসক কালিন্দী রানির সাথে নাকি বিভিন্ন বিষয়ে ক্যাপ্টেন লুইনের ঝামেলা হয়েছিল। তাই রানি কালিন্দী ক্যাপ্টেন লুইনকে পছন্দ করতেন না। একবার ক্যাপ্টেন লুইন কালিন্দী রানির সাথে দেখা করতে চাইলে রানি নাকি বলেছিলেন—আমি বানরের মুখ দেখতে চাই না। এই কারণে ক্যাপ্টেন লুইন নাকি কালিন্দী রানির ওপর খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। এগুলি লোকমুখে প্রচলিত শোনা কথা।

ক্যাপ্টেন লুইন ১৮৫৭ সালে একজন সামরিক বাহিনীর শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা হিসেবে ভারতে যোগ দেন। এরপর ১৮৬৫ সালে তিনি বদলী হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। এবং ১৮৬৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান। সেই সময় লুসাই, কুকি ও সেন্দু উপজাতীরা প্রায়ই পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ব্রিটিশ শাসিত বিভিন্ন অঞ্চলে এসে লুটতরাজ করত। তারা সাধারন লোকজনদের হত্যা করত এবং শিশু ও নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যেত। ১৮৭১ সালে লুসাইরা কাছাড়ের চা-বাগানের ম্যানেজার জেমস উইনস্টোনকে হত্যা করে তাঁর ১২ বছর বয়সী শিশুকন্যা মেরি উইনস্টোনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরফলে ১৮৭২ সালে চট্টগ্রাম থেকে জেনারেল ব্রাউনলো এবং কাছাড় থেকে জেনারেল বাউচারের নেতৃত্বে একটা দ্বিমুখী অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই অভিযানে ক্যাপ্টেন লুইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন লুইন লে.কর্ণেল পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন।

"A Fly on the Wheel" নামে ক্যাপ্টেন লুইনের একটি বই প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক নির্বাচিত অংশগুলি নিয়ে বাংলায় 'থাংলিয়ানা" নামে অনুবাদ করেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক হারুন রশিদ। বইটি প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালে। অবশ্য একই বিষয়ে রাঙ্গামাটির বিশিষ্ট আইনজীবি অ্যাডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমাও "পার্বত্য চট্টগ্রাম ও লুসাই পাহাড়" নামে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে।
বই দুটিই পাঠকদের ভালো লাগবে আশা করি।

******** ******* ********

লিখেছেন - জালাল আহমেদ
২১ মার্চ ২০২৪



১৯৮৩ সালে যখন খাগড়াছড়ি মহকুমায় আমার পদায়ন হয় তখন অন্তত দু'জন ডেপুটি কমিশনার এর নাম জেনেই যোগদান করতে যাই। তাদের একজন টমাস হারবার্ট লিউইন। টি এইচ লিউইন কে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবদন্তি জেলা প্রশাসক হিসাবেই জানি যিনি ১৮৬৬ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মিজোরামে লুসাই পাহাড় এলাকায় কাজ করে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন।
কিন্তু তিনি এর আগে নোয়াখালী জেলায় পুলিশ সুপার হিসাবে কাজ করেছেন তা’ আমরা অনেকেই জানি না। তা'রো আগে তিনি পুলিশ সুপার ছিলেন বিহারের হাজারিবাগ জেলায়। লিউইন এর পিতা ১৮২৩ সালে প্রথম ব্রহ্ম যুদ্ধে অংশ নেন আর লিউইনও অত্যন্ত কম বয়সে প্রথমে সেনাবাহিনীতে এবং পরে একাধিক জেলায় পুলিশ সুপার পদে কাজ করেছেন। ১৮৬৪ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি বিহার এর হাজারীবাগ থেকে কলকাতা-চট্টগ্রাম হয়ে নোয়াখালী আসেন। নোয়াখালীতে কিছুদিন পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনের পর তার পদায়ন হয় পুলিশ সুপার চট্টগ্রাম পদে। তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা হয়েছে(১৮৬০) কিন্তু ডেপুটি কমিশনার পদের উপযুক্ত কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। কথিত মতে এ জন্য আগ্রহী কর্মকর্তা খোজা হলে লিউইন এ জন্য আগ্রহ দেখান ও ক্যাপ্টেন লিউইন কে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডেপুটি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
 
লিউইন এই আগ্রহ মন থেকেই দেখিয়েছিলেন কারন এতদঞ্চলের উপর তার জানাশোনা ছিলো যে কারো চেয়ে বেশী। পাহাড়ি জনগনকে তিনি মন থেকেই ভালোবেসেছিলেন এবং তারাও তাকে। এর অন্যতম প্রমান আইজল এর সেই লিউইন স্মৃতি স্তম্ভ। “At Tlabung village right next to the Bangladesh border, 98 km to the west of Lunglei, there is a memorial stone erected to the memory of Captain T.H. Lewin, a courageous and adventurous British pioneer whom the Mizos fondly called Thangliana, or “Man of Great Fame”. Lewin was the Deputy Commissioner of Chittagong Hill Tracts when he entered Mizoram from Tlabung in 1865. He signed a peace treaty with one powerful Mizo chief of that time, Rothangpuia of Thangluah clan, following which he shifted his headquarters from Rangamati to Tlabung. He had many interactions with the Mizo chiefs and is remembered as the first white friend of the Mizos. He even wrote some books about the Mizo people. While he was in Tlabung he married a Mizo girl named Darpuii and they had a son who unfortunately died only a year later. Darpuii refused to go to England with Lewin when he retired from service. Lewin died at the age of 77 in 1916 as Honorary Lieutenant Colonel without any decoration for his great pioneering services. The memorial stone was erected in 1920 by arrangement with his English wife, Margaret Lewin.”

লিউইন চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা ও লুসাই এলাকা মিজোরাম নিয়ে অনেকগুলো বই লিখেছিলেন। আমি বহুদিন অনুসন্ধান করে তাঁর আত্মজীবনী "এ ফ্লাই অন দ্য হুইল অর হাও আই হেল্প গভর্ন ইন্ডিয়া" খুঁজে পাই। সেই বই এ লিউইন এর এতদঞ্চলে অবস্থানের সময়কালের অংশটুকু অনুবাদ করেছেন গবেষক-অনুবাদক Haroon Rashid। তাঁর অনুবাদ অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। এখনকার গুগল ট্রান্সলেটর এর যুগে এই সুলিখিত অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ একটি মহৎ কাজ। এ জন্য লেখক হারুন রশীদ কে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। বইটি ইতোমধ্যে পাঠক আনুকূল্য পেয়েছে। সময়ের সংগে সংগে এই আনুকূল্য বৃদ্ধি পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।

******* ****** *********


লিখেছেন- অঞ্জন কুমার দাশ
১৪ মার্চ ২০২৪

চট্টগ্রামের দক্ষিণ পূর্বদিকের দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, পাহাড়ের মানুষ আর ইতিহাস নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে তাঁরা এই বইটি পড়ে দেখতে পারেন। বইটির লেখক পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন।
 
থমাস হারবার্ট লুইন ভারতবর্ষে আসেন ১৮৫৭ সালে ১৮ বছর বয়সে। নানা ঘাট ঘুরে ১৮৬৫ সালে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। চট্টগ্রাম এসেই পূর্বদিকে দিগন্ত বিস্তৃত নীল পাহাড়ের প্রেমে পড়ে যান। পাহাড়ের ডাক তাঁকে অস্থির করে তুলে।সমতলের বাঙালিদের কাছে খোঁজখবর করতে থাকেন দুর পাহাড়ে কারা থাকে? তারা কেমন মানুষ?
কিন্তু স্থানীয় লোকজন তাঁকে নিরুৎসাহিত করেন। তাঁদের ধারণা ওসব এলাকা সভ্য মানুষের জন্য নয়। ওখানে যাঁরা থাকেন তাঁরা হিংস্র, বর্বর, অসভ্য। মানব জাতির কলঙ্ক। সাপ- ব্যাঙ-কীটপতঙ্গ হতে শুরু করে শেয়াল-কুকুর-হাতি-অজগর হেন কিছু নাই যা ওরা খায় না। কেউ কেউ জ্যান্ত মানুষও কাঁচা খেয়ে ফেলে। তাঁদের কারো কারো এমনকি লেজও নাকি আছে। আবার কারো কারো বাসা বাড়ি বলতে কিছুই নাই বানরের মতো গাছের উপর বসবাস করেন। 

নিঃসন্দেহে ভয়াবহ বর্ণনা। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ যেন অন্য ধাতুতে গড়া। লুইন সে রকমই একজন। এতকিছুর পরও তাঁর মনে হয়—❝আমি চাই একটা অজানা পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া, তারপর যা হয় হবে।❞

একদিন ঠিক ঠিক পাহাড়ে ঢুকে পড়লেন ৭ জন পুলিশ, দুজন ভৃত্য ও দুটি হাতি নিয়ে। খাবার দাবার তেমন কিছু নেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন—
❝জীবন কিংবা ভ্রমণে সুখী হওয়ার গোপন রহস্য হলো কোনোটাতেই অনর্থক বোঝা না বাড়ানো।❞

অতএব পথে যা পাবেন তাই খাবেন। কিছু উপহার অবশ্য নিলেন পার্বত্যবাসীদের জন্য।

পরবর্তী কাহিনি রীতিমতো শ্বাসরুদ্ধকর। আপনারা গল্পের রবিনসন ক্রুসোর কথা জানেন। লুইন যেন পাহাড়ের রবিনসন ক্রুসো। পার্থক্য হলো ক্রুসো নিয়তির ফেরে অজানা ভূখন্ড আর অচেনা মানুষের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। লুইনের জড়িয়ে পড়েছিলেন নিয়তির ফেরে নয় বরং বলা যায় তাঁর ক্ষেত্রে এই জড়িয়ে পড়া ছিলো— বাই চয়েজ।

বলাবাহুল্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যে গল্প তিনি শুনেছিলেন এবং এই বর্ণনা যে ভাবমূর্তি তৈরি করে তার সাথে বাস্তবের ফারাক অনেক। অবশ্য খাবারের ব্যাপারে বৈচিত্র্য ছিলো ব্যাপক। কিয়োদের গ্রামে গয়ালের কলিজা কাঁচা খেতে হয়েছে। হুক্কার তলায় জমা হওয়া পানি মুখে নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। ব্যাঙ, গিরগিটি, সুয়োঁ পোকা ভাজি হাসি মুখে গিলতে হয়েছে। এসবই লুইন করেছেন এই জনপদের মানুষের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করতে। শুধু কুকুরের পেটের ভাত আর কুকুরের মাংসটা খািয়া এড়িয়ে গেছেন। তাঁর মনে হয়েছে সবকিছুরই একটি সীমা থাকে যা অতিক্রম করা যায় না। এই খাবারটি তাঁর সেরকম একটি সীমা।

লুইন পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে পারলেও কোথাও কোথাও প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। সেন্দুদের হাতে তো প্রায় মরতে বসেছিলেন। কিভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি আগ্রহীরা বই হতে পড়ে নিবেন। ক্ষুদ্র পরিসরে সে বর্ণনা তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব।
আবার একজন ইউরোপীয়ান চা বাগান ম্যানেজারকে হত্যা করে তার ৬ বছরের কন্যাকে যখন লুসাইরা অপহরণ করে তখন আরেকটি সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। মেয়েটিকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা যায় দারুণ উত্তেজনাপূর্ন একটি অভিযানের ভিতর দিয়ে। সে বর্ণনাও দারুণ উপভোগ্য। এই অভিযানের একটি চরম উত্তেজনাপূর্ন মুহুর্তে দুঃসাহসি লুইন একা গিয়ে যখন লুসাই নেতাদের সাথে আলোচনায় বসে যখন তাঁদের মন জয় করে নেন তখন তারা তাঁর নামটি নিজেদের মতো করে উচ্চারণ করে শ্লোগানের মতো বলে ওঠেনঃ— থাংলিয়ানা....থাংলিয়ানা!!

এখানে উল্লেখ করা যায় রাঙামাটি শহরটি এই লুইনের হাত দিয়ে গড়ে ওঠে। শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক সদর দপ্তর ছিলো চন্দ্রঘোনা।

নিঃসন্দেহে লুইন শাসক উপনিবেশিক শ্রেণির একজন প্রতিনিধি। তাঁর কাজ কর্মের পেছনে অবশ্যই উপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থ থাকবে। কিন্তু তার বাইরে গিয়ে বইটিতে এ এলাকার মানুষদের প্রতি তাঁর যে মায়া মমতা ফুটে উঠেছে সেটাও অসাধারণ। প্রায় ১৫০ বছর আগে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা এই বইটি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখা প্রথম দিকের একটি মৌলিক বই।

মূল বইটির নাম A fly on the wheel, ❝থাংলিয়ানা❞ নামের এই অনুবাদটি মূল বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট অংশগুলোর অনুবাদ। অনুবাদক হারুণ রশিদের অনুবাদ হয়েছে অসাধারণ। এরকম অনুবাদ সচরাচর পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রামের পূর্ব অংশে কিভাবে রাষ্ট্র প্রবেশ করল এই ইতিহাস যাঁরা জানতেন চান তাঁদের জন্য এই বই অবশ্য পাঠ্য।

Wednesday, March 27, 2024

মল্লিকা সেন গুপ্তের কবিতা

 কী অসাধারণ একটা কবিতা! মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখছিলেন:

ভালবাসা ভালবাসা বাঁচাও আমাকে

আমাকে সারিয়ে দাও ঝলমলে জীবনের স্বাদে
মাথাভর্তি চুল দাও, চোখে দাও কটাক্ষ বিদ্যুৎ
আমার আকাশে দাও মেঘ বৃষ্টি আলো।
...
আমি না থাকলে ছেলে থাকবে কী করে?
বরকে কে খুঁজে দেবে এল আই সি পলিসি
ভাইটা নেশার ঘোরে কোথায় গড়াবে
ভীমরতি পোকাগুলো বুড়ো মার মাথায় চড়বে।
...
চল্লিশ চাঁদের আয়ু, না বুঝে লিখেছি
এখনও অনেক কাজ বাকি আছে,যাবই না আমি
দু'-দশ বছর আরও তোমাদের জ্বালাব পোড়াব
না রে মৃত্যু আজ আর তোর জন্য সময় হবে না।
...
প্রতিদিন ভোর হয়, জীবন স্রোতের মত চলে
কারও কারও ভোরে আর একদিন সূর্য ওঠে না
সূর্যকে আমি তাই ভয়ংকর দিব্যি দিয়ে বলি
আমি না জাগলে তুমি উঠবে না ভোরের আকাশে।
...
শিশির তোমার কেন কোনওদিন অসুখ করে না?
রোদ্দুর কখনও বুঝি মনখারাপ হয় না তোমার?
সারস তোমাকে কেউ প্রতারণা করেনি কখনও?
আমিও শিশির হয়ে, রোদ্দুর, সারস হয়ে
থেকে যেতে চাই পৃথিবীতে।