লিখেছেন- হারুন আহমেদ
৪ এপ্রিল ২০২৪
ব্রিটিশ কর্মকর্তা থমাস হারবার্ট লুইন ১৮৬৫ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। বইয়ের বিজ্ঞাপনে যদিও লুইনের অভিযানকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, বাস্তবে তার প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও কম জরুরি নয়। লুইন পাহাড়িদের সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করলেও বাঙালিদের একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। এর কারণ তিনি মোক্তার বা মোড়ল জাতীয় বাঙালিদের সাথে পেশাগত সূত্রে মিশেছেন এবং
দেখেছেন এদের সীমাহীন দুর্নীতি।
মনে রাখতে হবে, "থাংলিয়ানা " একজন ব্রিটিশের লেখা। তিনি সরাসরি সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নিয়েছেন এবং দায়িত্বরত অবস্থায় পাহাড়ের তথাকথিত অসভ্য বর্বর নৃ-গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধ করেছেন। এদিকে প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, চা বাগানের জন্য পাহাড় দখলের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পাহাড়ের বাসিন্দারা ক্রমশ গৃহহারা হয়ে যায় এবং এর ফলস্বরূপ ঘনঘন বাঙালি বা ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ করে। তারপরও নিজের কাজে লুইনের সততা স্পষ্ট বোঝা যায়। নতুন ও ভালো যে কোনো কিছু তিনি উদারচিত্তে গ্রহণ করতেন। একটা ঘটনা আছে এমন-
"রতন পুইয়ার গ্রামের একটা ঘটনার কথা মনে আছে। একবার আমি তাদের গ্রামে রতন পুইয়ার সাথে কথা বলছিলাম, তখন কোথা থেকে এক হদ্দ মাতাল এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। কিন্তু রতন পুইয়া তাকে তিরস্কার করা দূরে থাকুক, একটা কথাও বলল না। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে পাগড়িটা মাটি থেকে কুড়িয়ে ধুলো ঝেড়ে মাথায় বসিয়ে দিল।
আমি বললাম, 'এটা কেমন ব্যাপার হলো? তুমি তোমার অনুসারীদের বেয়াদবির জন্য শাস্তি দাও না?'
সে রীতিমতো আঁতকে উঠে বলল, 'বেয়াদবি? কী বলছেন সাহেব? সে একটা বদ্ধ মাতাল। তার কোনো হুঁশ নাই। সে কী করেছে নিজেই জানে না। ওটার কথা বাদ দিলে গ্রামে আমরা সবাই সমান। কিন্তু যখন যুদ্ধে যাই তখন সে যদি আমার কথা অমান্য করে সেটার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আছে। এখানে সে নিজের বাড়িতে আছে। ওসবের কোনো বালাই নাই। যে কোনো লোক চিফের বাড়িতে ঢুকে যে কোনো জিনিস নিয়ে আসতে পারে। তাদের কথা হলো-তিনি হলেন আমাদের চিফ। তিনি আরো অনেক উপহার পাবেন। আমাদের কাছে যা আছে সেগুলোও তাঁরই। অতএব তাঁর যা আছে সেগুলোও আমাদের। চিফ যদি আমাদের না দেয় তা হলে আর কে দেবে?' অকাট্য যুক্তি-কোনো সন্দেহ নেই।"
তিনি নিসর্গ পছন্দ করতেন এবং প্রায়ই দুঃসাহসিক বিভিন্ন অভিযানে জড়িয়ে পড়তেন। মাসের পর মাস ঘুরেফিরে একই পোশাক পরে, চড়াই উৎরাই পার হয়ে, খাদ্য স্বল্পতায় ভুগে, দৃঢ় মনোবল নিয়ে লুইন লুসাইসহ বিভিন্ন উপজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কিন্তু একবার সন্ধি স্থাপিত হওয়ার পর তাদের সাথে লুইনের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারাই তার নাম রাখে "থাংলিয়ানা।" লুইন বিভিন্ন বিরূপ পরিস্থিতি তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দ্বারা সমাধান করতেন। বৃটিশদের মধ্যেও কতো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও পেশাগত ঈর্ষা কাজ করতো তার বর্ণনা পড়ে অবাক হতে হয়।
সব মিলিয়ে, "থাংলিয়ানা " দারুণ একটি কাজ। হারুন রশীদের অনুবাদ ও ভূমিকা দুটোই প্রথম শ্রেণির।
লিখেছেন - মুহিবুল ইসলাম
২ এপ্রিল ২০২৪
প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। ভয় আর রহস্যে ভরা গভীর অরণ্যের পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান চালাতে চান বৃটিশ পুলিশের চৌকস কর্মকর্তা থমাস লুইন। সেজন্য তার দরকার ছিল এখানকার আদিবাসীদের সহায়তা। বান্দরবান এলাকার অরণ্যবাসী মুরং সম্প্রদায়ের এক দুর্দর্শ মোড়লকে বাগে এনে কাজে লাাগাতে চান। যার নাম ছিল তোয়েকাম তংলুইন। তাকে কাছে এনে পরিচয়পর্বে মোড়লের নাম শুনেই নিজের নামটা বিকৃত করে পাহাড়িদের মতো উচ্চারণ করে থমাস লুইন বলে ওঠলেন, “আপনি তো আমার পূর্বপুরুষের দিক থেকে আত্মীয় হন। আমার
নাম আরবাট তংলুইন।” এই কৌশলে দারুণ কাজ হয়েছিল। এবং এর জের ধরেই বহু ঘটনা প্রবাহের পর শেষপর্যন্ত তংলুইন নামটা পাহাড়ি সংস্কৃতিতে কিছুটা বিকৃত হয়ে তংলুইন্যা এবং সবশেষে থাংলিয়ানা‘য় রূপান্তর হয়। এভাবেই থমাস হার্বার্ট লুইন হয়ে যান পাহাড়িদের থাংলিয়ানা।
...
১৭৬১ সালে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন জারি হলেও দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। সময়টা ছিল অবিশ্বাস্য অতিলৌকিক গুজবে ঠাসা। জনশ্রুতি ছিল ভারত বার্মার সীমান্তঘেরা বিস্তীর্ণ পার্বত্যভূমিতে বসবাসরত নানান উপজাতির বাসিন্দারা অসভ্য ও হিংস্র এবং ওরা সাপ ব্যাঙ শেয়াল কুকুর আর পতঙ্গই শুধু নয় মানুষকে পেলেও খেয়ে সাবাড় করতে কসুর করে না! ভয়-আতংকে সমতলের কেউ ভুলেও ওই অঞ্চলে পা রাখার দুঃসাহস দেখাতো না। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করেছিলেন এক ব্রিটিশ তরুণ। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬৫ সালে হারবার্ট লুইন নামের এক তরুণ বৃটিশ অফিসার চট্টগ্রামের পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। নিলাভ সবুজের হাতছানি আর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তার কারণে অনেক ঝুকি আর ঝঞ্জার ভেতরে স্বেচ্ছায় প্রবিষ্ট হয়েছিলেন এই তরুণ আফিসার। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ, অভিযান ইত্যাদি কোন কিছুই বাদ যায়নি তার কর্মজীবনে। সেই সুবাদে গুজব এবং ভয়ের এ রাজ্যের সত্যচিত্র সভ্যদুনিয়ার সামনে উন্মোচিত হয়। দিনশেষে শত্রুর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ইংরেজি নাম থমাস হার্টবার্ট লুইন রূপান্তরিত হয় পাহাড়ি নাম থাংলিয়ানায়!
…
বইটিতে রহস্যঘেরা বিশৃংখল অরণ্যবাসী মানুষের জীবন পরিক্রমার নানান স্তরের বা নানান বাকেঁর কথা উপকথাসহ নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রসুত বর্ণনা স্থান পেয়েছে, অরণ্য ও অরণ্যবাসীকে বুঝতে যার সুগভীর তাৎপর্য অনস্বীকার্য। লেখক ব্রিটিশ উপনিবেশ স্বার্থের রক্ষক হলেও তার বর্ণনায় অরণ্যবাসীদের হিংস্রতার তেমন কোন লোমহর্ষক বর্ণনা বইটিতে মূল ফোকাস বা উপজীব্য হয়ে ওঠেনি। দস্যুতা এবং অসভ্যতাই পাহাড়ীদের শুধুমাত্র বৈশিষ্ট্য এমনটা লেখক বলতে চাননি। তার অনেক কথায় পাহাড়িদের সততা এবং সরলতার কথাও উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন ‘ওরা ওদের নিজস্ব আলয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করে। তারা এ চেনা সভ্য জগতের বাইরে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের মানুষ হলেও নিজেদের জীবন নিয়ে তারা সন্তুষ্ট।’
...
চাকরিকালীন (১৮৬৫-১৮৭২) সময়ে নিজের ঝুলিতে সঞ্চিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরল সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিজের কুশলী কলমে লিপিবদ্ধ করেছিলেন থমাস হার্বার্ট লুইন। লন্ডন থেকে ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার স্মৃতিকথা ’A fly on the wheel' নামক বইটি। সেই বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত অধ্যায়গুলোর বাংলা অনুবাদ নিয়েই থাংলিয়ানা। অনুবাদক জনাব হারুন রশিদ অনুবাদের ক্ষেত্রে যান্ত্রিকতা এড়িয়ে দারুণ মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। সাবলীল অনুবাদের কারণে আমার কাছে বইটি সুখপাঠ্য মনে হয়েছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত দুশো পৃষ্ঠার বইটির প্রচ্ছদ, ছাপা সবই সুন্দর। প্রচ্ছদ একেছেন সব্যসাচী হাজরা, বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার কথাপ্রকাশ।
লিখেছেন - রাশেদ স্বপ্ন
২৯ মার্চ ২০২৪
একটু খাঁড়ান, ফর্মালিটি কইরা লই:
আঠারোশ পঁচাশি সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল A Fly On The Wheel নামের একটি স্মৃতিকথা। লেখকের নাম লেফটেন্যান্ট কর্নেল থমাস হারবার্ট লুইন। এডভেঞ্চারপ্রিয় এই ব্রিটিশ ভদ্রলোক তার স্মৃতিকথাটি প্রকাশের কুড়ি বছর আগে চট্টগ্রাম শহরের পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। আজ থেকে দেড়শো বছরেরও কিছু অধিক সময় আগেকার সেই দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল বেশ কিছু দারুণ এডভেঞ্চারের। সেই সকল রোমাঞ্চকর অভিযানের এক লিখিত উপাখ্যান এই ‘থাংলিয়ানা’। ‘এ ফ্লাই অন দি হুইল’ মূলত একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে লুইন সাহেবের সমস্ত কর্মজীবনের স্মৃতিকথা। ‘থাংলিয়ানা’ সেই বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে উল্লিখিত অংশগুলোর বাংলা অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন হারুন রশীদ।
ফর্মালিটি শ্যাষ। এখন আসেন বইয়ের আলাপ করি।
থাংলিয়ানা কী:
‘থাংলিয়ানা’ মূলত লুইন সাহেবের পাহাড়ি ডাকনাম। এই নামকরণের পেছনে একটি চমৎকার ইতিহাস আছে। সেটি লিখে ফেলে বইয়ের আনন্দ নষ্ট না করাই ভালো। তবে থাংলিয়ানার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই যেহেতু এই বই, অতএব নামকরণ অতি অবশ্যই নজরকাড়া এবং প্রাসঙ্গিক।
বই কেমন:
এগারো বছর বয়সে আমি জীবনে প্রথমবারের মতো রবিনসন ক্রুশোকে চিনেছিলাম। ড্যানিয়েল ডিফো আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন এক উপকূল থেকে অন্য উপকূল, এক অন্তরীপ থেকে অন্য অন্তরীপ। তারপর গৃহত্যাগী রবিনসন ক্রুশোর সাথে বন্দী করে ফেলেছিলেন জনমানবহীন এক দ্বীপে। অবশ্য রবিনসন ক্রুশোকে নিয়ে আলোচনা এই অব্দিই হতে দেখেছি আমি। কোন এক অদ্ভুত কারণে সেই জনমানবহীন দ্বীপ ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপের মানুষখেকোদের থেকে মুক্তি লাভের পর ক্রুশোর জীবনে ঘটে যাওয়া বাকি এডভেঞ্চারগুলো নিয়ে কেন জানি খুব বেশি একটা কথা হয় না। সে কথা না হলে না হোক। মূল কথা ড্যানিয়েল ডিফো সদ্য কৈশরে পা দেওয়া আমিকে মুগ্ধ করে রেখেছিলেন তাঁর চমৎকার বর্ণনারমূলক লেখা দিয়ে।
আরেকটু বড়ো হলে এলেন বিভূতিভূষণ। আমাকে ধরিয়ে দিলেন ‘আরণ্যক’। তারপর আবারো সেই অদ্ভুত লেখা। সত্যচরণের সাথে নাঢ়া-লবটুলিয়ার সেই ঘন জঙ্গলের মায়ায় আমি বুঁদ হয়ে রইলাম পুরোটা সময়। সেই ঘোর আজও কেটেছে কি না সন্দেহ।
এবার পেলাম ‘থাংলিয়ানা’। সাহিত্যিক মান বিচারে থাংলিয়ানা আরণ্যক কিংবা রবিনসন ক্রুশোর ধারেকাছে যেতে পারে কি না, সেটা বিতর্কের বিষয়। তবে হারবার্ট লুইনের লেখা হোক বা হারুন রশীদের অনুবাদের মুন্সিয়ানা, থাংলিয়ানা আমাকে সেই রবিনসন ক্রুশো আর সত্যচরণের মতো করেই ঘুরিয়ে দেখালো দেড়শ বছর আগেকার পার্বত্য চট্টগ্রাম। যখন রাঙামাটি-বান্দরবানও বিবেচিত হতো অত্যন্ত দুর্গম এলাকা হিসেবে। জ্ঞানবুদ্ধি হবার পর থেকেই এদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের প্রতি একটা প্রবল টান অনুভব করেছি সবসময়। কিন্তু সময়-সুযোগ-অর্থ ও ইচ্ছাশক্তির অভাবের সম্মিলিত আক্রমণে ঘুরে দেখা হয়েছে খুব কম। তবুও যতটুকু দেখেছি, যতটুকু জেনেছি, তা আমার অন্তরে তৃপ্তি আনেনি। আমার বারবার মনে হয়েছে, নিরুদ্দেশ হয়ে মাসখানিক বান্দরবানের গহীনে গিয়ে থেকে আসতে পারলে ভালো হতো। এই দু-পাঁচদিনের অবসরে ওই মায়াবী ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের কতটা কাছে যাওয়া যায়?
সাধ আছে, সাধ্যি নেই, সাধ্যি আছে, সাধ নেই–এর চক্করে পড়ে জীবনে কোনোদিন পাহাড়ের অতটা কাছে যাওয়া হবে কি না, আমি তা জানি না। এমনিতেও অস্থিতিশীল পাহাড়কে তো আমরা স্থিতিশীল রাখতে পারিনি। তাই পাহাড়ে গিয়ে কোনোদিন নিজের দেশে ঘুরতে এলাম বলে মনেও হয়নি। ওখানে বাঙালি আগ্রাসন দেখে নিজেই নিজের বিবেকের কাছে লজ্জিত হয়েছি বারবার।
থাংলিয়ানা আমাকে এই পাহাড়ের গল্প শোনার একটা ছোট্ট সুযোগ করে দিল বলেই তার প্রতি মুগ্ধতার রেশ কাটছে না। লুইন সাহেবের সাথে আমিও ঘুরে বেড়িয়েছি চট্টগ্রামের পার্বত্য পথের উত্তর হতে দক্ষিণে, পথ হেঁটেছি পূর্বে। পাহাড়ি ঘন জঙ্গল পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছি কালাদান নদীর তীরে। আক্রমণাত্মক সেন্দু উপজাতির তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি সেই পার্বত্য বনে গভীর থেকে গভীরে। দেখেছি পাহাড় আর সমতলের কূটনৈতিক সমঝোতা রক্ষার জন্য লুইন সাহেবের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। দেখেছি লুসাই গ্রামে ব্রিটিশ আক্রমণ, শান্তি স্থাপন, লুসাইদের হাতে অপহৃত এক ব্রিটিশ বালিকা উদ্ধার হতে। সমগ্র বইটি পড়ার অভিজ্ঞতাটিই ভীষণ চমৎকার। বিশেষত দূরবর্তী নীলচে পাহাড়গুলোতে ছুটে যাওয়ার ইচ্ছা যখনই লুইনের কলমে প্রকাশ পেয়েছে, ততবার আমার চোখে সেই নীল পাহাড়সারি আর তাদের ওপরে ভেসে থাকা সাদা মেঘের দৃশ্য ভেসে বেড়িয়েছে। একবিংশ শতকের দেখার চোখ আর ঊনবিংশ শতকের দেখার চোখ এক হবে না জানি। তবুও চেনা দৃশ্যেই পুরোনোকে ধরতে চেষ্টা করে গিয়েছি যতক্ষণ বইটি পড়েছি তার পুরোটা সময়।
‘ন’ তে নগদে নেগেটিভ কিছু:
এত সব ভালোর মাঝেও নেহাত বাঙালি বলেই কিছু খারাপ লাগা কাজ করেছে। যতই লুইন সাহেব পাহাড়ে জনপ্রিয় হন না কেন, তার লেখাতে প্রায়শ ঔপনিবেশিক শাসকের মনোভাব অজান্তেই প্রকাশ পেয়েছে। আমার মনে হয়েছে লুইন সাহেব এডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ বলেই তিনি পাহাড়ে গিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে কাজ করতে পেরেছিলেন। তার বর্ণনায় প্রায়ই একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার প্রবলেম সল্ভিং প্রসেসের কিছু না কিছু বিষয় উঠে এসেছে। তার প্রজাবাৎসল্যতার প্রকাশ তখনই দেখেছি। তবুও কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে এমন স্পষ্টবাদী, জনদরদি একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা কখনই ঔপনিবেশিক শাসন নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। বোধ করি এই-ই জাতীয়তাবাদের স্বরূপ। সবকিছুর আগে নিজের দেশ।
বাঙালিদের নিয়ে পর্যাপ্ত বিষোদগার করে গিয়েছেন জনাব লুইন। তা অবশ্য কিছুটা তিক্ত সত্যই বচন করেছেন তিনি। তবে প্রশংসায় ভিজিয়েছেন পাহাড়িদের। সংঘাতের পরেও তাদের প্রতি লুইনের কলমে ঝরেছে শ্রদ্ধা ও সম্মান। একই শাসকের চোখে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে জাতি হিসেবে আমরা কতখানি মেকি আত্মগরিমায় ভুগি।
অনুবাদ নিয়ে দুটি কথা:
অনুবাদের মান নির্ণয়ের ধৃষ্টতা আমার নেই। সাধারণ পাঠক হিসেবে পড়তে গিয়েছি। পড়েছি। আনন্দ পেয়েছি। কল্পনার চোখে ঘুরে বেরিয়েছি বিস্তীর্ণ পর্বতাঞ্চল। আমার কাছে অনুবাদের সার্থকতা এই-ই। হারুন রশীদের প্রতি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা এবং শুভকামনা।
****** **** ****
লিখেছেন - সুচ চাকমা
২৮ মার্চ ২০২৪
থমাস হারবার্ট লুইন ছিলেন ভারতে ইংরেজ সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন লুইন নামে বিশেষভাবে পরিচিত। আমার বাল্যকালেই আমি আমার দাদুর মুখে শুনেছিলাম ক্যাপ্টেন লুইনের নাম। অবশ্য আমাদের গ্রামাঞ্চলে চাকমা উচ্চারণে বলা হতো "লুইন সাপ্যা"। সাধারণত সাদা চামড়ার বিদেশী লোকদেরকে চাকমারা বলে "ফারাঙি সাহ্ব"। আমার ধারণা ইউরোপিয়ানদের অনেকটা শ্বেতকুষ্ঠরোগীর মতো দেখায় বিধায় তাদেরকে ফারাঙি সাহ্ব বলা হয়ে থাকে। কারণ চাকমা ভাষায় কুষ্ঠ রোগকে বলা হয় ফারাঙি। যাহোক, চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, চাকমা সার্কেলের তৎকালীন শাসক কালিন্দী রানির সাথে নাকি বিভিন্ন বিষয়ে ক্যাপ্টেন লুইনের ঝামেলা হয়েছিল। তাই রানি কালিন্দী ক্যাপ্টেন লুইনকে পছন্দ করতেন না। একবার ক্যাপ্টেন লুইন কালিন্দী রানির সাথে দেখা করতে চাইলে রানি নাকি বলেছিলেন—আমি বানরের মুখ দেখতে চাই না। এই কারণে ক্যাপ্টেন লুইন নাকি কালিন্দী রানির ওপর খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। এগুলি লোকমুখে প্রচলিত শোনা কথা।
ক্যাপ্টেন লুইন ১৮৫৭ সালে একজন সামরিক বাহিনীর শিক্ষানবীশ কর্মকর্তা হিসেবে ভারতে যোগ দেন। এরপর ১৮৬৫ সালে তিনি বদলী হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। এবং ১৮৬৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান। সেই সময় লুসাই, কুকি ও সেন্দু উপজাতীরা প্রায়ই পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ব্রিটিশ শাসিত বিভিন্ন অঞ্চলে এসে লুটতরাজ করত। তারা সাধারন লোকজনদের হত্যা করত এবং শিশু ও নারীদের অপহরণ করে নিয়ে যেত। ১৮৭১ সালে লুসাইরা কাছাড়ের চা-বাগানের ম্যানেজার জেমস উইনস্টোনকে হত্যা করে তাঁর ১২ বছর বয়সী শিশুকন্যা মেরি উইনস্টোনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরফলে ১৮৭২ সালে চট্টগ্রাম থেকে জেনারেল ব্রাউনলো এবং কাছাড় থেকে জেনারেল বাউচারের নেতৃত্বে একটা দ্বিমুখী অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই অভিযানে ক্যাপ্টেন লুইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন লুইন লে.কর্ণেল পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করেন।
"A Fly on the Wheel" নামে ক্যাপ্টেন লুইনের একটি বই প্রকাশিত হয়। সেই বইয়ের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক নির্বাচিত অংশগুলি নিয়ে বাংলায় 'থাংলিয়ানা" নামে অনুবাদ করেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক হারুন রশিদ। বইটি প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালে। অবশ্য একই বিষয়ে রাঙ্গামাটির বিশিষ্ট আইনজীবি অ্যাডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমাও "পার্বত্য চট্টগ্রাম ও লুসাই পাহাড়" নামে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৬ সালে।
বই দুটিই পাঠকদের ভালো লাগবে আশা করি।
******** ******* ********
লিখেছেন - জালাল আহমেদ
২১ মার্চ ২০২৪
১৯৮৩ সালে যখন খাগড়াছড়ি মহকুমায় আমার পদায়ন হয় তখন অন্তত দু'জন ডেপুটি কমিশনার এর নাম জেনেই যোগদান করতে যাই। তাদের একজন টমাস হারবার্ট লিউইন। টি এইচ লিউইন কে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবদন্তি জেলা প্রশাসক হিসাবেই জানি যিনি ১৮৬৬ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মিজোরামে লুসাই পাহাড় এলাকায় কাজ করে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন।
কিন্তু তিনি এর আগে নোয়াখালী জেলায় পুলিশ সুপার হিসাবে কাজ করেছেন তা’ আমরা অনেকেই জানি না। তা'রো আগে তিনি পুলিশ সুপার ছিলেন বিহারের হাজারিবাগ জেলায়। লিউইন এর পিতা ১৮২৩ সালে প্রথম ব্রহ্ম যুদ্ধে অংশ নেন আর লিউইনও অত্যন্ত কম বয়সে প্রথমে সেনাবাহিনীতে এবং পরে একাধিক জেলায় পুলিশ সুপার পদে কাজ করেছেন। ১৮৬৪ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি বিহার এর হাজারীবাগ থেকে কলকাতা-চট্টগ্রাম হয়ে নোয়াখালী আসেন। নোয়াখালীতে কিছুদিন পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনের পর তার পদায়ন হয় পুলিশ সুপার চট্টগ্রাম পদে। তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা হয়েছে(১৮৬০) কিন্তু ডেপুটি কমিশনার পদের উপযুক্ত কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। কথিত মতে এ জন্য আগ্রহী কর্মকর্তা খোজা হলে লিউইন এ জন্য আগ্রহ দেখান ও ক্যাপ্টেন লিউইন কে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডেপুটি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
লিউইন এই আগ্রহ মন থেকেই দেখিয়েছিলেন কারন এতদঞ্চলের উপর তার জানাশোনা ছিলো যে কারো চেয়ে বেশী। পাহাড়ি জনগনকে তিনি মন থেকেই ভালোবেসেছিলেন এবং তারাও তাকে। এর অন্যতম প্রমান আইজল এর সেই লিউইন স্মৃতি স্তম্ভ। “At Tlabung village right next to the Bangladesh border, 98 km to the west of Lunglei, there is a memorial stone erected to the memory of Captain T.H. Lewin, a courageous and adventurous British pioneer whom the Mizos fondly called Thangliana, or “Man of Great Fame”. Lewin was the Deputy Commissioner of Chittagong Hill Tracts when he entered Mizoram from Tlabung in 1865. He signed a peace treaty with one powerful Mizo chief of that time, Rothangpuia of Thangluah clan, following which he shifted his headquarters from Rangamati to Tlabung. He had many interactions with the Mizo chiefs and is remembered as the first white friend of the Mizos. He even wrote some books about the Mizo people. While he was in Tlabung he married a Mizo girl named Darpuii and they had a son who unfortunately died only a year later. Darpuii refused to go to England with Lewin when he retired from service. Lewin died at the age of 77 in 1916 as Honorary Lieutenant Colonel without any decoration for his great pioneering services. The memorial stone was erected in 1920 by arrangement with his English wife, Margaret Lewin.”
লিউইন চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা ও লুসাই এলাকা মিজোরাম নিয়ে অনেকগুলো বই লিখেছিলেন। আমি বহুদিন অনুসন্ধান করে তাঁর আত্মজীবনী "এ ফ্লাই অন দ্য হুইল অর হাও আই হেল্প গভর্ন ইন্ডিয়া" খুঁজে পাই। সেই বই এ লিউইন এর এতদঞ্চলে অবস্থানের সময়কালের অংশটুকু অনুবাদ করেছেন গবেষক-অনুবাদক Haroon Rashid। তাঁর অনুবাদ অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। এখনকার গুগল ট্রান্সলেটর এর যুগে এই সুলিখিত অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ একটি মহৎ কাজ। এ জন্য লেখক হারুন রশীদ কে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। বইটি ইতোমধ্যে পাঠক আনুকূল্য পেয়েছে। সময়ের সংগে সংগে এই আনুকূল্য বৃদ্ধি পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
******* ****** *********
লিখেছেন- অঞ্জন কুমার দাশ
১৪ মার্চ ২০২৪
চট্টগ্রামের দক্ষিণ পূর্বদিকের দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়, পাহাড়ের মানুষ আর ইতিহাস নিয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে তাঁরা এই বইটি পড়ে দেখতে পারেন। বইটির লেখক পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন।
থমাস হারবার্ট লুইন ভারতবর্ষে আসেন ১৮৫৭ সালে ১৮ বছর বয়সে। নানা ঘাট ঘুরে ১৮৬৫ সালে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রধান হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। চট্টগ্রাম এসেই পূর্বদিকে দিগন্ত বিস্তৃত নীল পাহাড়ের প্রেমে পড়ে যান। পাহাড়ের ডাক তাঁকে অস্থির করে তুলে।সমতলের বাঙালিদের কাছে খোঁজখবর করতে থাকেন দুর পাহাড়ে কারা থাকে? তারা কেমন মানুষ?
কিন্তু স্থানীয় লোকজন তাঁকে নিরুৎসাহিত করেন। তাঁদের ধারণা ওসব এলাকা সভ্য মানুষের জন্য নয়। ওখানে যাঁরা থাকেন তাঁরা হিংস্র, বর্বর, অসভ্য। মানব জাতির কলঙ্ক। সাপ- ব্যাঙ-কীটপতঙ্গ হতে শুরু করে শেয়াল-কুকুর-হাতি-অজগর হেন কিছু নাই যা ওরা খায় না। কেউ কেউ জ্যান্ত মানুষও কাঁচা খেয়ে ফেলে। তাঁদের কারো কারো এমনকি লেজও নাকি আছে। আবার কারো কারো বাসা বাড়ি বলতে কিছুই নাই বানরের মতো গাছের উপর বসবাস করেন।
নিঃসন্দেহে ভয়াবহ বর্ণনা। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ যেন অন্য ধাতুতে গড়া। লুইন সে রকমই একজন। এতকিছুর পরও তাঁর মনে হয়—❝আমি চাই একটা অজানা পার্বত্য অঞ্চলে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া, তারপর যা হয় হবে।❞
একদিন ঠিক ঠিক পাহাড়ে ঢুকে পড়লেন ৭ জন পুলিশ, দুজন ভৃত্য ও দুটি হাতি নিয়ে। খাবার দাবার তেমন কিছু নেননি। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন—
❝জীবন কিংবা ভ্রমণে সুখী হওয়ার গোপন রহস্য হলো কোনোটাতেই অনর্থক বোঝা না বাড়ানো।❞
অতএব পথে যা পাবেন তাই খাবেন। কিছু উপহার অবশ্য নিলেন পার্বত্যবাসীদের জন্য।
পরবর্তী কাহিনি রীতিমতো শ্বাসরুদ্ধকর। আপনারা গল্পের রবিনসন ক্রুসোর কথা জানেন। লুইন যেন পাহাড়ের রবিনসন ক্রুসো। পার্থক্য হলো ক্রুসো নিয়তির ফেরে অজানা ভূখন্ড আর অচেনা মানুষের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। লুইনের জড়িয়ে পড়েছিলেন নিয়তির ফেরে নয় বরং বলা যায় তাঁর ক্ষেত্রে এই জড়িয়ে পড়া ছিলো— বাই চয়েজ।
বলাবাহুল্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যে গল্প তিনি শুনেছিলেন এবং এই বর্ণনা যে ভাবমূর্তি তৈরি করে তার সাথে বাস্তবের ফারাক অনেক। অবশ্য খাবারের ব্যাপারে বৈচিত্র্য ছিলো ব্যাপক। কিয়োদের গ্রামে গয়ালের কলিজা কাঁচা খেতে হয়েছে। হুক্কার তলায় জমা হওয়া পানি মুখে নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। ব্যাঙ, গিরগিটি, সুয়োঁ পোকা ভাজি হাসি মুখে গিলতে হয়েছে। এসবই লুইন করেছেন এই জনপদের মানুষের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করতে। শুধু কুকুরের পেটের ভাত আর কুকুরের মাংসটা খািয়া এড়িয়ে গেছেন। তাঁর মনে হয়েছে সবকিছুরই একটি সীমা থাকে যা অতিক্রম করা যায় না। এই খাবারটি তাঁর সেরকম একটি সীমা।
লুইন পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে পারলেও কোথাও কোথাও প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছেন। সেন্দুদের হাতে তো প্রায় মরতে বসেছিলেন। কিভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও জীবন নিয়ে ফিরে এসেছেন সেই রোমাঞ্চকর কাহিনি আগ্রহীরা বই হতে পড়ে নিবেন। ক্ষুদ্র পরিসরে সে বর্ণনা তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব।
আবার একজন ইউরোপীয়ান চা বাগান ম্যানেজারকে হত্যা করে তার ৬ বছরের কন্যাকে যখন লুসাইরা অপহরণ করে তখন আরেকটি সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। মেয়েটিকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা যায় দারুণ উত্তেজনাপূর্ন একটি অভিযানের ভিতর দিয়ে। সে বর্ণনাও দারুণ উপভোগ্য। এই অভিযানের একটি চরম উত্তেজনাপূর্ন মুহুর্তে দুঃসাহসি লুইন একা গিয়ে যখন লুসাই নেতাদের সাথে আলোচনায় বসে যখন তাঁদের মন জয় করে নেন তখন তারা তাঁর নামটি নিজেদের মতো করে উচ্চারণ করে শ্লোগানের মতো বলে ওঠেনঃ— থাংলিয়ানা....থাংলিয়ানা!!
এখানে উল্লেখ করা যায় রাঙামাটি শহরটি এই লুইনের হাত দিয়ে গড়ে ওঠে। শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক সদর দপ্তর ছিলো চন্দ্রঘোনা।
নিঃসন্দেহে লুইন শাসক উপনিবেশিক শ্রেণির একজন প্রতিনিধি। তাঁর কাজ কর্মের পেছনে অবশ্যই উপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থ থাকবে। কিন্তু তার বাইরে গিয়ে বইটিতে এ এলাকার মানুষদের প্রতি তাঁর যে মায়া মমতা ফুটে উঠেছে সেটাও অসাধারণ। প্রায় ১৫০ বছর আগে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা এই বইটি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখা প্রথম দিকের একটি মৌলিক বই।
মূল বইটির নাম A fly on the wheel, ❝থাংলিয়ানা❞ নামের এই অনুবাদটি মূল বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট অংশগুলোর অনুবাদ। অনুবাদক হারুণ রশিদের অনুবাদ হয়েছে অসাধারণ। এরকম অনুবাদ সচরাচর পাওয়া যায় না।
চট্টগ্রামের পূর্ব অংশে কিভাবে রাষ্ট্র প্রবেশ করল এই ইতিহাস যাঁরা জানতেন চান তাঁদের জন্য এই বই অবশ্য পাঠ্য।