Friday, April 19, 2024

লেখালেখির বয়স

শেখার কোনও বয়স নেই, শেখার কোনও শেষ নেই, শিখতে কোনও লজ্জা নেই। আমি সব জেনে বসে আছি এই ধারণা যার ভেতরে ঢুকবে তার শেখার সম্ভাবনা শেষ। আমার প্রতিদিনই নতুন কিছু শেখার আগ্রহ জাগে। অনেক ক্ষেত্রে আমি শেখার সূত্র পাই তরুণদের কাছ থেকে। আমার বন্ধুতালিকায় যত পড়ুয়া আছে, তাদের অধিকাংশই আমার চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ, কিন্তু জ্ঞানে আমার চেয়ে অনেক ভারী। আমি প্রতিনিয়ত তাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখার সুযোগ পাই। নাম বলছি না, কিন্তু এখানে এমন কয়েকজন আছে তারা জীবনে যত বই পড়েছে, আমি তত বই চোখেও দেখিনি।
 
মাঝে মাঝে দেখি প্রবীন লেখকদের কেউ কেউ বলেন আজকালকার তরুণরা যা লিখছে তা কিছুই হচ্ছে না,তাদের দেবার কিছুই নেই। দুর্ভাগ্য তাঁদের তাঁরা নিশ্চয়ই শুধু খারাপ লেখকদেরই দেখেছেন। আমার সৌভাগ্য আমার চোখে পড়া অধিকাংশ তরুণ দারুণ প্রতিভাবান। আমার বন্ধু তালিকায়ও এমন কয়েকজন আছেন তারা দেশের যে কোন প্রতিষ্ঠিত লেখকের চেয়ে অনেক ভালো লেখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকাংশই প্রচারের আলোয় থাকে না। অন্তত মূলধারার সাহিত্য বলে যেটা আছে সেখানে তাদের লেখাপত্রের প্রচার দেখি না।

এটা গেল সাহিত্যের কথা। এবার ইতিহাসের কথা বলি। যেহেতু ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করি, আমার ধারণা ছিল আমি পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি অনেকদূর জেনে গেছি। সেদিন এক কিশোরকে দেখে আমার সেই ধারণা বড় ধরণের ধাক্কা খেলো। মাত্র আধঘন্টার আলাপে সে আমাকে পৃথিবীর ইতিহাসের এমন গুরুতর কিছু তথ্য শেখালো, যেগুলো আমার জানা ছিল না। যেটা শিখতে গেলে আমার দশটা ভলিউম উল্টাতে হতো। যে যুগে তরুণরা বই পড়ে না বলে দুর্নাম আছে সে যুগে এই তরুণেরা আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা হতে পারে।
 
অতএব, এই আকালের দিনে বাংলা সাহিত্যে যেসব তরুণ ভালো কাজ করছে তাদের উৎসাহ দেয়া উচিত। যেসব প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক এখন আর ভালো লিখছেন না, শুধু নাম হয়েছে বলে মূলধারার সাহিত্যের আসরগুলো দখল করে আছেন, তাদের উচিত অবসরে যাওয়া। তাঁদের কারণে অনেক প্রতিভাবান তরুণ পত্রিকার পাতায় জায়গা পাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চমৎকার একটা সরস লেখা লিখেছিলেন। লেখাটি আমার বিশেষ প্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক বলে এখানে যুক্ত করলাম। শ্যামল যদিও পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতায় লিখেছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতাও একই বলা চলে।

++বৃক্ষ যদি বৃদ্ধ হয়++

“পাহাড়ের ক্ষয় আছে। নদী একদিন শীর্ণ হয়ে আসে। বৃক্ষ বৃদ্ধ হয়। এই অবস্থায় লেখক কত দিন লেখক থাকতে পারেন? তাঁরও তো ক্ষয় আছে। শারীরিক ক্ষয়ের প্রশ্ন তো আছেই। লেখক সত্তারও তো ক্ষয় আছে।

সে কথা কতটা মনে থাকে। লিখে লিখে পাঠক তৈরি হয়ে গেলে লেখক লেখক হয়ে যান। তার পর তৈরি পাঠককে লেখক লেখা দিতে থাকেন। একটা সময় আসে— যখন দেখা যায়— পাঠক আর সে লেখা চাইছেন না। পাঠক আর আগের মতো স্বাদ পাচ্ছেন না। উপরন্তু নতুন নতুন পাঠক এসে গেছেন। তাঁরা নতুন খাবার চান। এই পালটে যাওয়া অবস্থা অনেক লেখক মেনে নিতে পারেন না। কিম্বা নিজেও নিজেকে বদলাতে পারেন না। ভাবেন— পাঠক যেমন নিচ্ছিলেন—তেমনই নিতে থাকবেন। এই দুঃখজনক অবস্থা সৃষ্টি হয় প্রধানত লেখকের জন্যে। আর সৃষ্টি হয় সম্পাদকের কল্যাণে। কোনও এক সময় লেখকের লেখা ছেপে সম্পাদক সাড়া পেয়েছিলেন। কয়েক বার সাড়া পেয়ে মনে হয় নিরন্তর সাড়া পেয়ে যাব।

পত্রিকার রথ নিজের গতিতে সর্বদাই কিছুটা গড়গড় করে গড়ায়। সেই গড়গড়ানো লেখকের লেখার সাড়া ভ্রমে সম্পাদক নিরন্তর যদি পাঠকের ওপর লেখককে চাপিয়ে দেন—তখনই দুঃখের ঘটনা ঘটে।

পাহাড়, নদী, গাছের কর্মকাণ্ড বা ক্ষয় হঠাৎ বোঝা যায় না। এদের জয় বা ক্ষয়- দুটোই খুব বড়। কিন্তু ধীরে ধীরে। তাই দেখা যায় না। সে তুলনায় লেখক একজন মানুষ মাত্র। জেমা, অভিমান, অহম্ ইত্যাদির পুঁটুলি এই লোকটির ক্ষয় ও জয় বেশ চোখে পড়ার। তাই বোধ হয় তাঁর অবসর নেওয়ারও একটা সময় আছে।
কিন্তু ঘটনা দেখা যায় অন্য রকম।

আমরা লেখক। অন্য গ্রহ থেকে এসে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছি। নিত্য প্রসবিনী। নিত্য প্রকাশমান। অশক্ত না হওয়া অবধি লিখে যাব।

নিষ্ঠুর সময় বালির ঝাপটায় অপ্রয়োজনীয় জিনিস চাপা দিয়ে ঢেকে ফেলছে। পাহাড়ের গা বর্ষার জলে ক্ষয় হয়ে ধসে পড়ছে। মোহনা থেকে পালটা ধাক্কায় পলি ফিরে এসে নদীর বুকে চর তুলে দিচ্ছে। চার হাজার বছরের প্রাচীন রেড উড গাছ সভ্যতার পর সভ্যতার জন্ম ও মৃত্যুর ফেনা গায়ে মেখে নিয়ে নিজের উচ্ছেদের দিনটি শুনতে থাকে। আর একজন লেখক — সামান্য মানুষ— তিনি কী করে প্রকৃতির নিয়ম অতিক্রম করবেন?

বাবুর প্রথম গল্প ১৯৪৬ সনে সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৫৬ সনে তিনি যুগের প্রথম মশালচি হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকেই তিনি একটি নাম। এবং এই নাম হবার পর থেকেই তিনি অহম্, যা-লিখি-তাই-ই-লেখার মনোভাবে তিনি আচ্ছন্ন হয়ে যান। তখন আর তিনি শিল্প নন। তিনি পত্রিকার অলংকার।

সংঘর্ষ, আবিষ্কার, নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ব্যাপারটা লেখকের ভেতর থেকে যেদিন উবে যায়— প্রাকৃতিক কারণেই উবে যেতে বাধ্য— তখন লেখককে প্রধানত মাথার ভেতরে বীজ বুনতে হয় গল্পের। লিখতে লিখতে সেই গল্পগাছের বৃত্তে ফুল আসে। তা দেখতে হয়তো ভালো। কিন্তু তা ফুল নয়।

বিষ্ণুপুর থেকে বাঁকুড়া যাবার পথে জ’পুরের জঙ্গলে দেখেছি— পুরনো গাছের জায়গায় তরুণ শাল চারা বসানো হচ্ছে।
লামডিং থেকে বিশ মাইলের ভেতর চা বাগানে দেখেছি ৬০ বছর বয়সের চায়ের ঝাড়কে লোহার চেনে বেঁধে ট্রাক্টর শেকড়-শুদ্ধ টেনে তুলছে। জানলাম, চায়ের ঝাড়ের আয়ু মানুষের মতোই। পীচে বালক, বিশে জওয়ান, চল্লিশে প্রবীণ, ষাটে বিদায়ী।
তাই— ভাবছিলাম, বৃক্ষ যদি বৃদ্ধ হয়— তাহলে....”

No comments: