Wednesday, April 3, 2024

বই প্রকাশনার বাস্তবতা: এক প্রকাশকের অভিজ্ঞতা

 সুমেরু মুখোপাধ্যায়:

বছর কুড়ি হল বাংলা প্রকাশনার সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়ই একটি পত্রিকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হই, পরের বছরই সমস্ত দায়িত্ব হুড়মুড় করে ঘাড়ের উপর এসে পড়ে। সেসব ধরলে আরও পাঁচ বছর। ট্রেডল প্রেসে ছাপা হত, গালি প্রুফ ছিঁড়ে পাতা ডামি বানানো শেখাতেন কলেজস্কোরারের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় শ্রীকৃষ্ণগোপাল মল্লিক। প্রতিষ্ঠানিক ক্লাসে সেসব শিখিনি। তিনশো কপি ছাপা হত সে পত্রিকা যার বেশির ভাগ কপি পাঠাতে হত বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে। পাতিরাম, শিয়ালদা, সুবর্ণরেখা শান্তিনিকেতনে কিছু কপি রাখা থাকত, যার টাকা কখনই পেতাম না আর। কপি যেত অধিকাংশই সৌজন্য হিসাবে, বিক্রি করে টাকা ঘরে আসত না। হিসাবপত্তর সেভাবে করাও হয়নি, সেসব মিশে যেত নানা হইচইতে। তবে বান্ডিল বান্ডিল পত্রিকার কপি পড়ে থাকত পত্রিকা অফিসের বাংকারে। সে বাংকারে হাত পড়ত পরবর্তী সংখ্যার প্রস্তূতিতে। ২০০৯-১০ আমার ঢাকা প্রবাসে বাংলাদেশের প্রকাশনার সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়ি, তার আগে এসে গেছে গুচ। লেখার থেকে নাচানাচি কাঁপাকাপি বেশি হচ্ছে। কাজ ভাগাভাগি, দেশে বিদেশে মেল চেনে ঝগড়াঝাঁটি আহ্লাদ, সবই এখন কম্পিউটারে। প্রথম থেকেই ঠিক ছিল দাম রাখা হবে তুমুল সিজিনের বাঁধাপকপির থেকেও কম। সবাই ঘরে ঘরে পড়বে আর ডাকবে, হাম্বা-হাম্বা বলে। তখনও দিদির হরেকরকম্বার আবিষ্কার হয়নি। প্রথম চারটি চটি ছাপা হল ৫০০ কপি করে।
৯ঋকাল বুকস করতে এসে জানতাম তিনশো কপি তো বেচে দিতে পারব। প্রিন্ট অর্ডার ৫৫০ দেখে প্রেসের শান্তনুবাবু কিন্তু কিন্তু করলেন অনেকবার, সরাসরি কিছু বললেন না ছাপলেন একটু কমিয়ে ৩৫০ করে। প্রথম দুটি বই ৫৫০ করেই ছাপা হয়ে গিয়েছিল। যার একটি বই আজও শেষ হয়নি আট বছরে। আরও বলা ভাল তার অর্ধেক শেষ হয়েছে সবে। ঠেকে শিখি। সিটিপিতে ছাপা, কাগজের দাম, কাপড় দিয়ে বোর্ড বাঁধাই সবই বেড়েছে কয়েক বছরে। এসেছে ডিজিটাল বলে এক মারণ রোগ। যাতে ১০/২০ কপিও ছেপে ফেলে হাত ঝেড়ে ফেলা যায়। আমাদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৪০ ছুঁইছুঁই। আপ্রাণ চেষ্টা করছি বইয়ের সংখ্যা কমানোর। অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয় বই বলে মনে হলে এগোই না আর। নতুনদের বই করার জন্য অনেক প্রকাশনা এসেছেন। তাঁরা অনেক শর্টকার্ট জানেন। অধিকাংশ স্বপ্ন দেখেন বয়ই বেচে বড় হবেন, বদলে দেবেন সব। দুরন্ত পি আর। রেগুলার ফিডে থাকার মতো মমতাশংকর বা প্রামাণিক চাই। আসলে টোপ চাই, শাঁসালো লেখক চাই কারণ একমাত্র তেলেই মাছ ভাজা যায়। তার পরে বায়নাক্কা কম থাকে। কেউ কেউ সোসাল মিডিয়ায় খুব পপুলার। পোস্ট দেওয়ার আগেই ভক্তেরা লাইক, লাভ দেওয়ার স্যাডো প্রাকটিশ করেন। বই বার হলে একশো কপি ফুস করে ( হ্যাঁ দুই তিন দিনে) বিক্রিও হয়ে যায়, পরের একশো কপি যদিও পরবর্তী দুই তিন বছরেও বিক্রি হয় না। একশো কপি কী অনেক বেশি? এঁদের বই তখন অনেক প্রকাশকই করতে চান নিজের খরচায়। পরের বই ৮০% ক্ষেত্রে ৫০ কপিও বিক্রি হয় না। এঁদের বেশিরভাগ ওয়ান টাইম ওয়ান্ডার হিসাবে থেকে যাচ্ছেন বাংলা প্রকাশনায়।
প্রচুর ত্যানা পেঁচিয়েছি। আমি কলকাতার সহযোগী প্রকাশক / লেখক বন্ধুদের থেকে জানতে চাই, এখন খুব বেশি বিক্রি বলতে কত বোঝেন? সংস্করণ বলে এখন কিছু বেঁচে নেই। সবাই তুমুল সংস্কার করে ফেলেছি সব। তন্ত্র, মন্ত্র, ভুত, গোয়েন্দা, এগুলি নাকি ভাল বিকোয়। সেসব নিয়ে আমি জানি না, আলোচনায় আনবেন না। কলেজস্ট্রিটে আর একটা শব্দ খুব কার্যকরী 'মরা লেখক'। আমি ব্যাখ্যা করলাম না। বাংলাদেশের রয়্যালটির চেকের ছবি অনেকের মনোবিকারের কারণ হতে পারে, কিন্তু বাস্তব তো কঠিন। নিজেকে আনিসুল হক, নজিম উদ্দিন, সুমন্ত আসলাম ভাববেন না। আপনার বই আপনি নিজে বিপণন না করলে (না কিনে নিলে) সারা বছরে ৫০ কপিও বিক্রি করা শক্ত। তাকে মেনে নিতে হবে।

[সূত্র: লেখকের ফেসবুক পোস্ট, ৩ এপ্রিল ২০২৪]

No comments: