১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা ছয় তরুণের একটা দল গল্প করতে করতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পূর্ব দিকের সৈকত ধরে হাঁটছিল। এডভেঞ্চারপ্রিয় দলটা সেদিন দুপুরে এসেছে একটা জেলে নৌকায় চড়ে। উত্তাল সমুদ্র পেরিয়ে নৌকাটা যখন খাবি খেতে খেতে সৈকতে এসে পৌঁছালো তখন চরের মধ্যে ঘুরতে থাকা দু চারজন বাদে আর কেউ ছিল না। ওই দ্বীপে তখন কোন ঘাট ছিল না। নৌকা সরাসরি এসে সৈকতে লাগতো। সৈকতে সারি সারি জেলে নৌকা বাদে আর কিছু নেই। ধূ ধূ বালিয়াড়ি, নারিকেল গাছ আর কেয়া ঝাড় শুধু। সাগর গরম থাকায় সেদিন সেন্টমার্টিনের কোন জেলে নৌকা সমুদ্রে নামেনি। টেকনাফ থেকেও এই একটি নৌকা বাদে কোনও নৌকা আসেনি। সেন্টমার্টনে তখনো পর্যটন ব্যাপারটা চালু হয়নি। মাঝে মাঝে দলছুট দুয়েকজন বাদে সেই দ্বীপে কেউ যেতো না। হুমায়ূন আহমদের সমুদ্র বিলাস তখনো তৈরি হয়নি।
ছয়জনের দলটি যখন আগের রাতে টেকনাফে ঘুরে ঘুরে সেন্টমার্টিনে যাবার উপায় খুঁজছিল তখন বাজারের লোকজন তাদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছিল। দুয়েকজন তো এমন ভয় দেখালো ওই দ্বীপে গেলে জলদস্যুদের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু সেসব ভয়কে জয় করে দলটা যে কোন উপায়ে যেতে মরিয়া ছিল। তাদের কারো বাসায় জানে না এই অভিযানের কথা। সবাই বলে এসেছে কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি চারদিনের জন্য।
দিকনির্দেশনাহীন সেই ভ্রমণে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেগুলো অন্য সময়ে বলা যাবে। আপাতত সেই রাতের ঘটনাটা বলা যাক।
একটা ঝুপড়ি দোকানে রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুটঘুটে অন্ধকার দ্বীপে গ্রাম্য পথ ধরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাত দশটার পর ঘুমানোর জন্য নির্ধারিত আস্তানায় রওনা হলো দলটা। আস্তানাটা হলো পূর্বদিকের সৈকতের ওপর দাঁড়ানো গণস্বাস্থ্যের রেস্টহাউস। ভাগ্যক্রমে নৌকায় আসার পথে ওই রেস্টহাউসের কেয়ারটেকারের সাথে পরিচয় হয়েছিল দলের একজনের সাথে। তাঁর সাথে রফা করে ১০০ টাকার বিনিময়ে একটা রুমে ছজনের থাকার বন্দোবস্ত। সৈকতের বালিতে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া দলটার জন্য একটা ডাবল খাট সমৃদ্ধ এক রুমের এই আস্তানা পাঁচ তারকা হোটেলের চেয়ে বেশি ছিল।
নিঝুম সৈকতে বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালো দলটা। বাম দিকে তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র থেকে নীল রঙের ঢেউ এসে লুটিয়ে পড়ছে দূরের সৈকতে। প্রথম দেখায় সবাই ভাবলো কোথাও থেকে আলো এসে পড়েছে বলে ঢেউয়ের নীলাভ ফেনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুতবিহীন দ্বীপে আলো আসবে কোথা থেকে? হারিকেন আর কুপিবাতি ছাড়া ওই গ্রামে আর কোন আলোর উৎস নেই।
দলের মধ্যে সেন্টমার্টিন নিয়ে খানিক পড়াশোনা করা একমাত্র সদস্য আমি। তাই সবাই আমার দিকে তাকালো কোন উত্তর আছে কিনা। কিন্তু আমার পড়াশোনা সেন্টমার্টিনের সমুদ্রের তলদেশে প্রবালের রঙিন বাগান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। সেটাও পশ্চিম সৈকতে। পূর্বদিকে এই ঘটনা ভারী অদ্ভুত।
রহস্যময় আলোর ছটা দেখে কৌতূহলী হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম যেখানে ঢেউগুলো সৈকতে আছড়ে পড়ছে সেই জায়গাতে। কাছে যাবার পর আমাদের মাথা ঘুরে যাবার দশা। ঢেউগুলো যখন সৈকতে ভেঙ্গে পড়ছে তখন লক্ষ কোটি তারকা যেন ছড়িয়ে পড়ছে বালির ওপর। দূর থেকে ঢেউটা দেখতে নীল মনে হচ্ছিল। কিন্তু ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার পর দেখলাম লাল নীল সবুজ হলুদ কমলা নানান রঙের তারকা সৈকতে ছড়ানো। আকাশে তাকিয়ে যত তারা দেখছি নীচের সৈকতেও তার চেয়ে কম নয়। ভয় আর আনন্দের যুগপৎ শিহরণে আমরা নেচে উঠলাম সবাই।
কাছে গিয়ে ভেজা বালিতে হাত দিয়ে জিনিসটা তুলে নিলাম। হাতে নেবার পর হাতও নীলাভ রঙে আলোকিত হয়ে গেছে। ওই আলোতে ঘড়ির সময় দেখেছিলাম মনে আছে। কিন্তু জিনিসটা কী বুঝতে পারছিলাম না। টর্চ জ্বালিয়ে দেখলাম স্বচ্ছ দানাদার কোন পদার্থ মনে হলো। চিনির দানা যতটুকু, ততটুকু আকার। হাতে নিলে একটু উষ্ণবোধ হয়। আমাদের জীবনে দেখা সবচেয়ে আশ্চর্য একটা দৃশ্য।
তখন ভেবেছিলাম এই দৃশ্য সেন্টমার্টিনে সবসময় দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তী ত্রিশ বছরে আরো কয়েকবার সেন্টমার্টিন গেছি, ওই দৃশ্যের দেখা আর কখনো পাইনি। সেই অপরূপ দৃশ্যের ছবি তোলার সুযোগ হয়নি। আমাদের কাছে যে সাধারণ ক্যামেরা ছিল তাতে ওই দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব ছিল না। এতদিন পর মনে হচ্ছে সেই দৃশ্যের উৎস ছিল ‘বায়োলুমিনিসেন্স’ জাতীয় কিছু। যেটা প্লাঙ্কটন বা কোন ধরণের সামুদ্রিক অনুজীব থেকে ছড়ায়। বিশেষ কোন দিনে কিংবা বিশেষ কোন পরিবেশ পরিস্থিতিতে সেগুলো আবির্ভূত হয়।
এখন কত হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন সেন্টমার্টিন যায়। কিন্তু কারো কাছ থেকে ওরকম অপরূপ দৃশ্যের কোন অভিজ্ঞতার সন্ধান পাইনি। কয়েকদিন আগে সেন্টমার্টিনের এক বাসিন্দা ওই দৃশ্যের একটা ছবি পোস্ট করলেন ফেসবুকে। ছবিটা দেখে আমি চমকে গেলাম। এই তো সেই ঢেউ ৩০ বছর আগে যেটা আমরা দেখেছিলাম সৈকতে দাঁড়িয়ে। তাঁর কাছ থেকে ছবিটা ধার নিলাম এই লেখার জন্য। কিন্তু সৈকতে ঢেউ ভেঙ্গে পড়ার পর যে লক্ষ কোটি তারার মেলা বসে সে দৃশ্যের ছবি নেই।
আমি জানি না আমার বন্ধু তালিকায় সেই দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আছে তেমন কেউ আছে কিনা। যদি কেউ থাকেন, তাহলে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন। সম্ভব হলে ছবিও।
পৃথিবীর খুব বেশি জায়গায় এরকম দৃশ্য নেই। গুগল করে অল্প যে কয়টি ছবি দেখলাম সবগুলোতেই নীল রঙ। ৩০ বছর আগে আমরা যে বহু রঙের তারার মেলা দেখেছিলাম কোথাও সেই দৃশ্য নেই। কেন নেই? তার মানে যে জীবগুলো ওই রঙের সৃষ্টি করতো সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে পরিবেশ দুষণের কারণে? আমি জানি না।
আজ নাকি Earth Day, এই দিবসটা পৃথিবীর জন্য মন খারাপ করে দেয়। আমরা প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন এই গ্রহটাকে একটু একটু করে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি।
......................................................
[** পোস্টে ব্যবহৃত তিনটি ছবির দুটি নিয়েছি সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা তৈয়ব উল্লাহ ভাইয়ের কাছ থেকে। আরেকটি ছবি নেয়া হয়েছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপের একটা সাইট থেকে ]
No comments:
Post a Comment