Saturday, March 31, 2012

জনসেবা ফরমুলা

আমি বরাবরই জনহিতৈষী মানুষ। সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছি কিভাবে মানুষের জন্য কাজ করবো। ছাত্রজীবন থেকে স্বপ্ন দেখতে দেখতে কর্মজীবনের মধ্যাহ্নে প্রবেশ করেছি তবু জনহিতকর কর্মে নিয়োজিত হবার সুযোগ পাইনি। গ্রামে গেলে গরীব মানুষের ক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা হু হু করে ওঠে। কিন্তু শেখ মুজিবের মতো গায়ের চাদরটা খুলে শীতার্ত মানুষটার গায়ে পরিয়ে দিতে পারি না। আসলে আমার চাদরই নেই। গ্রামে গেলে লেদার জ্যাকেট পরি শীত বেশী বলে। ওটা খুলে দেয়া যায় না। ভাবি, আগামী শীতে ওর জন্য একটা চাদর কিনে দেবো। অথবা জাকাতের সময় কিছু টাকা বাড়িয়ে দেবো। অতঃপর শহরে ফিরে যাবার পর এসব ভাবনা ভুলে যেতে অসুবিধা হয় না।

বছরে ছমাসে যখনই গ্রামে যাই ঘুরে ঘুরে দেখি জরাজীর্ন স্কুল, মসজিদ, এতিমখানা, ভবঘুরে মানুষ। এত দীনহীন চেহারা দেখে বুকটা ফেটে যায় করুণায়। আমার একবার গ্রামে আসার খরচ দিয়ে এদের পাঁচজনের সাতদিনের খাবার হয়ে যায়। আমি গাড়িতে উঠে বসে ভাবি, 'হেথায় তুরে এক্কেবারে মানাইছে না গো, এই গরীব দেশে দামী গাড়ি চড়িস কেন তুই'। এই গরীব দেশে এত দামী গাড়িতে চড়া উচিত না আমার। তবু শান্ত্বনা দেই নিজেকে, এই গাড়ির মালিক তো আমি না। রুটি রুজির জন্য খোদা যে জীবিকা দিয়েছেন সেই জীবিকার মালিকের গাড়ি। অপরাধবোধ খানিকটা লোপ পায়। ফিরে আসার আগে মুঠো মুঠো ভাঙতি টাকা ছড়িয়ে আসি দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য। একবেলা কিছু কিনে খাক ওরা।

ব্যাপারটা প্রায়ই ভাবায় আমাকে। এত দরিদ্র মানুষ। এদের জন্য কিছু করা যায় না? অন্তত নিজের গ্রামে? ভাবতে ভাবতে কয়েক বছর কেটে যায়। অনেক জায়গায় লেখালেখি করেছি। কেউ কেউ আশ্বাস দেয়। ক্ষীন আশ্বাস। মন ভরে না। বিদেশী অনেক দাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে লেখা হলো। সম্ভবতঃ বাংলাদেশ থেকে এরকম আরো হাজারো আবেদন গেছে। মেইলগুলোর কোন জবাব আসে না, স্প্যামবট হয়তো দেখামাত্র বাক্সের বাইরে ফেলে দেয়।

অবশেষে একদিন ক্রোড়পতি ক্লাবের বন্ধুস্থানীয় মেম্বারদের কাছে তোলা হলো বিষয়টি। ওখানে আমার মতো জনহিতৈষী লোক আরো আছে। কিন্তু পকেট ঝাড়ার চেয়ে কলম ঝেড়ে জনহিত করার ব্যাপারে ওদের আগ্রহ বেশী। তবু ছেঁকে এমন তিনজনকে পাওয়া গেল উদার, অলস, হালকা ধার্মিক এবং অগাধ বিত্তের মানুষ। ওদের টাকা আছে সময় নেই, মন আছে শ্রম দেবার ইচ্ছে নেই। প্রতি রাতে এক বোতল রেড বা ব্ল্যাক লেবেল লাগে কিন্তু শুক্রবারে জুমার নামাজে হাজির থাকে। ঠিক এরকম লোককে খুঁজছিলাম। ব্ল্যাক লেবেলের বোতলটা খালি হতেই বাইরে চলে এলাম তিনজনকে নিয়ে। তিনজনই বেসামাল অবস্থা। তরল সময়ে কথা বলে আরাম আছে।

-কি বুঝলা সালেক?
-বুঝলাম সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু আমরা মত্ত আছি জাগতিক কাজে
-টাকাপয়সা কি কবরে নিবা?
-তা কেন নেবো, ছেলে মেয়ে ভোগ করবে?
-ছেলেমেয়ে তোমাকে বেহেশতে নেবে?
-তা নেবে কেন, তার জন্য খোদাতালা আছে
-খোদাতালার জন্য কি করছো?
-সব........অ্যাঁ, এটা কি বললা, খোদাতালা কতো বড় মানুষ, তার জন্য কি করবো
-খোদাতালা মানুষ না বেকুব, তিনি সৃষ্টিকর্তা
-ও সরি খোদাতালা, মাই মিসটেক
-তোমার জন্য তো কঠিন আজাব অপেক্ষা করতেছে
-তুমি কেমনে জানো?
-তোমার বাড়ির সামনে সেদিন একটা অনাথ শিশু সাহায্যের জন্য সারাদিন দাঁড়িয়েছিল, তুমি একবার জানলা খুলে তাকাওনি
-তুমি দেখলা কিভাবে?
-আমি বাড়ি ফেরার সময় দেখলাম, দাঁড়ালাম, জিগালাম। ছেলেটা বললো তোমাদের বাড়িতে নাকি খানাপিনার আসর ছিল। দারোয়ান বলছিল বিকালে আসিস। সে বিকাল পর্যন্ত দাঁড়ানো, কিন্তু শেষমেষ খানা নয় খেদানিই জুটছে। সেই দুঃখে কাঁদছিল, আমি তারে বাড়ি এনে খাওয়ায়ে দাওয়ায়ে রেখে দিছি, সে আমার বাগানের মালির সাথে কাজ করে।
-কী বলছো আবুল, আমি তো এর কিছুই জানতাম না। দাঁড়াও আজকেই দারোয়ান ব্যাটাকে শায়েস্তা করবো।
-বেকুবের মতো কথা বলো না। শোনো মিয়া জগতে এরকম অবিচার আছে বলে খোদাতালা পাপপূন্য বেহেশত দোজখ দিয়া দিছে। দুনিয়ার সবাই তো আর ফেরেশতা না। পাপও হবে পূন্যও হবে। পাপকাজ যখন বেশী করবা তখন পূণ্যকাজে ব্যয় করে হিসেবটা ঠিক রাখবা।
-কি সব আজগুবি কও। জীবনে কোন মাওলানার মুখে এরকম কথা শুনি নাই।
-শুনবা কেমনে, জুম্মার নামাজে যাও সোয়া একটায় খুতবা শুরুর পর। বয়ান শুনবা কই থেকে
-কথা ঠিক, আগে গেলে ঝিমানি আসে, লজ্জার ব্যাপার মসজিদে ঘুমিয়ে পড়া।
-শোনো, তুমি তো মনে হয় জাকাতও ঠিকমতো দাও না।
-কে বলে দেই না, গেল ঈদেও তো এক লাখটাকার শাড়ি লুঙ্গি টাকা দিয়া আসছি গ্রামে গিয়ে। কোন গরীব বাদ যায় নাই।
-তোমার ব্যাংকে জমার পরিমান কতো?
-তা দিয়া তোমার কাম কি
-সেইটা ধরেই তো জাকাতের হিসাব। সেই হিসাবে তোমার জাকাত যদি এক লাখ হয় তাইলে ঠিক আছে, যদি তার চেয়ে বেশী থাকে, তার মানে তুমি জাকাত কম দাও। তখন হিসাব হবে কেয়ামতের ময়দানে তোমার আর তোমার খোদাতালার মধ্যে।
-হায় খোদা, আমি তো অত হিসাব করি নাই
-করো নাই, এখন করো। তোমাদের মতো অর্থপিশাচদের জন্য খোদাতালা কিছু নিয়ম দিয়ে গেছে। সেই নিয়ম পালন করলে আকাম করেও বেহেশতে হুরপরীদের বাতাস খাইতারবা। আর নইলে সেই টাকা সাপ হয়ে তোমারে কামড়াইতে থাকবে কেয়ামতের আগপর্যন্ত। কেয়ামত তো পরশুদিন না, আরো কয়েক লাখ বছর আছে। হিসাব কইরা লও মনে মনে।

সেদিনের আলাপের জের নেশা কেটে যাবার পরও মাথায় ঘুরছে ওদের তিনজনের মধ্যে। দোজখের ভয় এখনো আছে লোকজনের মধ্যে। এটা খুব ভালো লাগছে।

সিদ্ধান্ত হলো সখিপুরে একটা বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলা হবে জনহিতৈষী সংস্থা হিসেবে। প্রস্তাবের খসড়া বানিয়ে একদিন ছুটির দিনে চারজনে বসে হিতৈষী সংঘের নাম সদস্য ইত্যাদি ঠিক করলাম। ওরা তিনজনে বছরে বারো লাখ টাকা দিতে পারবে বললো। এই ফান্ডের বড় উৎস হলো জাকাত। তিনজনেরই প্রতিবছর বিশাল অংকের জাকাত দিতে হয়। হিসেব মতো জাকাত আসে জনপ্রতি পাঁচ লাখের উপর কিন্তু এত টাকার শাড়ি লুঙ্গি বিতরণের ঝামেলার কারণে কখনোই জাকাতের টাকা পুরো দিতে পারে না। ফলে গত এক যুগে ওদের বকেয়া জাকাত হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। এই টাকা কবরের সাপ হয়ে ছোবল দেবে শোনার পর শিউরে উঠলো তিনজনে।

আসলে আমি ছাড়া আর কেউ গ্রামে গিয়ে জাকাত বিলি করে না। আমি প্রতিবার গিয়ে কিছু খুচরা শাড়ি লুঙ্গি আর দশ টাকার বান্ডিল ওড়াই। তাতেই প্রভূত সুনাম। আমরা চারজনই একমত হলাম জাকাতের বকেয়া টাকাটা জনহিতকর প্রকল্পে ব্যয় করলে কবর আর কেয়ামতের ময়দান দুটোই নিরাপদ।

রাতে বাসায় এসে ঘুম হলো না আমার। জীবনে প্রথম এত বড় একটা কাজে হাত দিয়েছি। আল্লাহর কাছে হাজার শোকর দেশে এখনো মহৎ লোকেরা বাস করে। আমি নিজের বকেয়া জাকাতের হিসেব করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার জাকাত কত আসে আমি নিজেও জানি না। চাকরীজিবি মানুষ, চাকরীর টাকায় সংসার চালাই। লাখ টাকা মাইনের চাকুরী করেও মাস শেষে দেখা যায় হিসেবের খাতায় আমি আরো জাকাত পাওনা হই। স্ত্রীর কল্যানে আমার কোন জমা টাকা নাই। মনে মনে কৃতজ্ঞতাবোধ করি রোশনারার প্রতি। সে না থাকলে আমার আজ কতো লাখ টাকার জাকাত বকেয়া থেকে যেতো!

পরের সপ্তায় গ্রামে গিয়ে জমি বায়না করে এলাম। দুই বিঘা জমি পাওয়া গেছে রাস্তার কাছাকাছি। এই জমিতে গড়ে উঠবে বৃদ্ধনিবাস। দরিদ্র মানুষদের আবাস আর বিনোদন। পাশাপাশি থাকবে হাঁসমুরগীর খামার, পুকুরে মাছ চাষ হবে, সবজি উৎপাদন হবে। প্রজেক্ট সফল হলে আশেপাশে আরো জমি কেনা যাবে। নিজের ব্যাংক থেকে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে বায়না কর্ম সম্পন্ন হলো। আরো লাগবে প্রায় সত্তর লাখ। তিন বন্ধুকে প্রকল্পের আজীবন দাতা ও পরিচালক ঘোষনা করলাম। উদ্যোক্তা হিসেবে অবশ্য জমিজমা ব্যাংক হিসেব ইত্যাদি আমার নামেই রইল। ওদেরকে সাধলাম কিছু দায়িত্ব নিতে। কিন্তু চালাক মানুষ ওরা। কেউ ঝামেলা নিতে রাজি না। সব আমার উপর দিয়ে চাপাতে চায়। আমি অর্থ শ্রম দুটোই দিচ্ছি, তবে অর্থের চেয়ে শ্রম বেশী ব্যয় করছি। জমি বায়না করার পুরো খরচই আমি দিয়েছি। আশি লাখ টাকা ব্যাংকে রেখে সত্তর লাখ দিয়ে জমিটা রেজিষ্ট্রি করে নেয়া হলো। বাকী আশি লাখ টাকা প্রকল্প ব্যয়ের জন্য। এটা কোন কোন খাতে ব্যয় হবে তা জানার জন্য তাদের মোটেও আগ্রহী না দেখে আমি আশি লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করে ফেললাম।

এক বছর অপেক্ষা করতে হলো হেনতেন করে। কারণ বছর শেষে আশি লাখ টাকার বাচ্চা দেবে। সেই টাকায় কাজ শুরু হবে। এটা আর কাউকে বলা হলো না। আশি লাখের প্রথম বছর বাচ্চা দিলে সেই টাকায় প্রকল্পের ঘরবাড়ি তোলা হলো টিন কাঠ ইটের মিশাল দিয়ে। হাঁসমুরগী মাছ সবজি ইত্যাদি দেখাশোনা করার জন্য তিন জন লোক রাখা হলো। আশ্রমে এখনো কোন বৃদ্ধ আসেনি। অসুবিধে নেই। আস্তে আস্তে জানাজানি হোক তারপর আসবে। আগে আয়ের উৎস গড়ে উঠুক। তাদের খাওয়া পরানোর জন্য নিয়মিত আয়ের দরকার আছে।

কিছুদিন বাদে আরো বিশজন দাতা যোগাড় হয়ে গেল যারা বছরে সম্মিলিতভাবে চার লাখ টাকা দান করবে। আয়ের উৎস বাড়তেই থাকে। এর মধ্যে কাস্টমার মানে বৃদ্ধ বলতে চারজনকে পাওয়া গেল যাদের দুজনকে বাড়ি থেকে জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে ভালো খাবারদাবারের লোভ দেখিয়ে। ঘরে খাবার অভাব নেই তাদের। তবে এখানে চাকরী হিসেবে থাকতে চায়। কয়েকদিন গরু খাসী মুরগী দিয়ে খাওয়ানোর পর তাস খেলতে দেয়া হলো, বাড়িতে তাস খেলার উপায় নাই। এছাড়া টেলিভিশন গান বাজনা ধুমপানের ব্যবস্থা রাখা হলো। মন বসে গেল ওদের খুব তাড়াতাড়ি। ঘরে থাকলে বুড়ির ঘ্যানঘ্যানানিতে জান যায়। সুনাম ছড়াতে থাকলে দূরের গ্রাম থেকে এলো আরো জনা বিশেক লোক। এদের বেশীরভাগেরই ফ্রী হোটেলে আড্ডার লোভেই আসা।

দুবছর যাবার পর আমিও ভাবছি, চাকরীটা এবার ছাড়তে হবে। জনকল্যানে পুরোদস্তুর মনোযোগ দিতে হবে। প্রকল্পের রমরমা অবস্থা। অস্ট্রেলিয়ার এক দুস্ত কল্যান ট্রাস্টকে প্রকল্পের ছবি ইত্যাদি পাঠালে ওরা আগামী বছর তিন লাখ ডলার দান করবে বলে জানালো। এত কিছু দেখাশোনা করতে গেলে চাকরীতে মনযোগ বসবে না। চাকরী ছেড়ে একটা গাড়ি কিনলাম প্রকল্পের নামে। ফতুয়া পরে প্রাডো গাড়িতে চড়তে শুরু করলাম। গ্রামের রাস্তা খারাপ, ফোর হুইল না হলে চলে না।

শুরুতেই ঘোষণা দিলাম, এই প্রকল্প কোন বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা হয়নি। এখানে সবাইকে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে হবে। আমি নিজে কোন বেতন নিবো না। কিন্তু কর্মীদের সামান্য বেতন দেবো, আর ওদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে প্রকল্পে। পরপর দুবছর সফলতার সাথে পার করার পর পত্রিকায় ইন্টারভিউ ছাপানো হলো একজন সফল জনহিতৈষী কলামে। টিভি ক্যামেরা এনে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরী করা হলো। সরকারের কাছ থেকে পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করা হলো। বিদেশ থেকে আমন্ত্রন এলো কয়েকটা। বিদেশী সেমিনারে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে মাত করে দিলাম। সম্মানসূচক ডক্টরেট দেয়া হলো কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সাথে ডোনেশানের চেক।

ডোনেশানের চেকগুলো ব্যাংকে জমা দিতে দিতে হিসেব করে ফেললাম প্রকল্পের ফান্ডে ইতিমধ্যে জমা হলো সাড়ে চার কোটি টাকা। আর ব্যক্তিগত একাউন্টে জমা আশি লাখ + ডোনেশানের চেক= পৌনে আট কোটি টাকা। অডিট শুরু হবার আগেই নিজের হিসেব আর প্রকল্পের হিসেব একদম আলাদা ব্যাংকে নিয়ে পাকা করে রেখে দিলাম। আট কোটি টাকা নিরুপদ্রপ হবার পর প্রকল্পে অধিক মনোযোগ দিতে পারছি।

এভাবেই জনসেবার স্বপ্নপুরণের যাত্রা শুরু হলো। নিঃসন্তান ছিলাম বলে ভয় ছিল বুড়ো বয়সে কে দেখবে। একটা দিক নিশ্চিন্ত হলো। বুড়ো বয়সে আর বৃদ্ধাশ্রমের সন্ধান করতে হবে না। নিজের আশ্রমে বুড়ো চড়িয়েই খাওয়া যাবে। আমার সাথে রোশনারার জৌলুসও বৃদ্ধি বেল বিনাশ্রম সমাজ সেবিকার খাতায় উঠে যাবার পর।

আসলে জনসেবার চেয়ে মহৎ কর্ম আর হয় না। জীবন এমনই হওয়া উচিত। জনগণের ভবিষ্যত আর নিজের ভবিষ্যতের যৌথ উন্নয়ন। সব মিলিয়েই তো জাতীয় উন্নয়ন। শুরুটা তেমন কঠিন নয়, শুধু খেয়াল রাখতে হবে আশেপাশে আছে কোন উদারমনা বিত্তবান অলস মানুষ, ধর্মে যাদের অল্প মতি আছে।

Saturday, March 24, 2012

দুই অসুখ

ভার্সিটি থেকে ফিরে ঘুমিয়েছিল রাকিব। ট্রেন জার্নিটা এত ক্লান্তিকর যে শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শরীরটা ভেঙ্গে পড়ে। সোয়া দুটোয় বটতলীতে পৌঁছায় ট্রেন। বাসায় ফিরে রিকশা কিংবা বাসে। গোসল সেরে খেতে বসতে বসতে তিনটা পার হয়ে যায়। খেয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লেই চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসে। দুপুরের এই ঘুমটা রাতের চেয়েও গভীর। মড়ার মতো ঘুমায় সে।

এই গাঢ় গভীর ঘুমটাও ভেঙে যায় আমিনউদ্দিনের কন্ঠ শুনে। আমিনউদ্দিন সাহেব রূপার চাচা। রুপার বাবা রাকিবের বাবার বন্ধু। চরম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুই পরিবারের মধ্যে যাতায়াতের ঘনিষ্ঠতা আত্মীয়ের চেয়েও বেশী ছিল। রূপাদের সব ঘনিষ্ট আত্মীয়ের যাতায়াত ছিল রাকিবদের বাসায়, তেমননি রাকিবদের সব ঘনিষ্টজনের যাতায়াত রূপাদের বাসায়। রূপা এবার ইন্টার দেবে। রাকিব ভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে। তিন বছর ধরে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে রাকীব সেশান জটের কারণে। শিবির একটা খুন করলে ভার্সিটি দেড় বছর বন্ধ থাকে নব্বই সালে। তাই নব্বই সালে সেকেন্ড ইয়ারে পড়লেও বিরান্নব্বই সালে এসেও সে সেকেন্ড ইয়ারে। এটা নিয়ে রূপা প্রায়ই ঠাট্টা করে রাকিবের সাথে।

এরকম কাছাকাছি বয়সের দুটো তরুন তরুনীর মধ্যে দুমাসের মধ্যেই প্রেম ঘটে যায়। কিন্তু রূপার সাথে সেরকম কিছু দেখেনি পাড়াপড়শিরা। ওদের সন্দেহও করেনি কেউ কখনো। করার কথাও না। ওরা কখনো লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করেনি। যা আড্ডা হয় সবার সাথেই। রাকিব নিজেও কখনো ভাবেনি সেরকম কোন ব্যাপার। তবে রূপার সাথে কথা বলতে ওর ভালো লাগে। ওদের বাসায় গেলে রূপার সাথেই ওর বেশী আড্ডা হয়। রুপারা পাঁচ ভাইবোন। কিন্তু রাকিবের নিকটবর্তী বয়সের আছে তিন বছরের জুনিয়র রূপা। সেই কারণেই বন্ধুত্বটা এই দুজনের মধ্যেই গড়ে উঠেছে।

ওরা কেমন বন্ধু একটা উদাহরণ দেই।

রাকিব ওদের বাসায় গেলে প্রথমে খালাম্মার সাথে কথা বলবে। কুশলাদি আলাপের কিছু সময় পর রূপার ছোট ভাইবোনগুলো আসবে, অনুযোগ করবে - 'রাকিব ভাই এবার অনেকদিন পর এলেন। আজকে অনেকক্ষণ থাকতে হবে'। তারও অনেক পর নিজের ঘর থেকে উষ্কো চুলের পরীর মতো বেরিয়ে আসবে রূপা। এসে খানিকটা হতাশ ভঙ্গিতে বলবে, ও আপনি? কখন এলেন? পাকা অভিনেত্রী! যেন অন্য কারো আসার কথা। রাকিব মৃদু হেসে বলবে, এই তো এখন। ঘুমোচ্ছিলে নাকি? রূপা সংক্ষিপ্ত জবাব দেবে, হু। আর কোন কথা নাই। মুখ ধুতে চলে যাবে সে।

এরপর নাস্তা আসবে। খালাম্মা জোর করে খাওয়াবে। সে না না করেও অনেকখানি খেয়ে ফেলবে। রূপাদের টেবিলে অনেক মজাদার খাবার সজ্জিত থাকে সবসময়। রাকিবের কখনোই আপত্তি থাকে না এই বাসায় খাওয়াদাওয়ায়। নিজের ঘর মনে করেই খায় সে। নাস্তা খেয়ে রাকিব বারান্দার দিকে চলে যাবে।

বারান্দায় ছোট্ট একটা বাগান আছে। বসার একটা আরাম চেয়ার আছে ওখানে। রাকিব ওখানে বসবে। চায়ের কাপ নিয়ে খানিক পর রূপা এসে বলবে, 'আপনার চা রয়ে গেছে তো'। কাপ নিয়ে রাকিব চুমুক দেবে। দীর্ঘসময় নিয়ে চা খাবে রাকিব। আর রুপা একপাশে দাঁড়িয়ে বাগানের সাম্প্রতিক অগ্রগতির বিবরন দেবে। কোন গাছে কতটা ফুল ধরলো, কাচামরিচের ঝাল কোনটা বেশী, পুঁই লতাটা কেমন করে বাড়ছে ইত্যাদি নানান বাগান বিষয়ক ধারা বিবরন। প্রত্যেকবার এই রূটিন। রাকিবের চা শেষ হয়ে গেলেও বাগান বর্ননা চলতেই থাকে। রাকিব প্রবল উৎসাহ নিয়ে এই সব বর্ননা শুনবে।

উদ্ভিদ নিয়ে দুজনের এই মাতামাতিকে ঘরের সবাই নির্দোষ বলে জানে তাই সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে ওদের দিকে তেমন মনযোগ দেয় না। আলাপের ঘন্টা গড়িয়ে সন্ধ্যা পার হয়ে গেলেও রাকিবের ক্লান্তি আসে না শুনতে। রূপারও আসে না বলাতে। তবু একসময় উঠতে হয়। রূপা তখন জোর করবে খেয়ে যেতে। রাকিব রাজী হবে না। তারপর বিদায় নিয়ে চলে আসবে। বিদায় নেবার সময় রূপা দরোজা ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। সিড়ি দিয়ে রাকিবের অদৃশ্য হওয়া অবধি চেয়ে থাকবে।

মনে হতে পারে এখানে কোন একটা সম্পর্কের উৎপত্তি হয়েছে দুজনের মধ্যে। আসলে তা নয়। বছরের পর বছর ওরা এরকমই। এটাকে কেউ অন্য চোখে দেখেনি। ওরা নিজেরাও এটাকে নির্দোষ হিসেবে দেখে। তাই নির্ভয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়।

রূপার চাচাটা বেদম বকবক করে। তাই আজকে রূপার চাচা আমিনউদ্দিনের কন্ঠে যখন রাকিবের ঘুম ভাঙলো তখন সে বিরক্তই হয়েছিল। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকলো সে। যেন আমিনউদ্দিন তাকে ডেকে না পাঠায়। কিন্তু ঘাপটি মারা অবস্থায়ও কান খাড়া হয়ে গেল যখন তার মুখে শুনতে পেল রুপার নাম। রাকিবের মাকে আমিনউদ্দিন অভিযোগ করছে, "দেখেন কান্ড, রূপাটাকে একা ফেলে সবাই দাওয়াতে গেছে সাতকানিয়া। ফিরতে রাত হবে। বাসায় মেয়েটা একা জ্বরে ভুগছে। আমাকে ফোন করে কান্না করছে একটু আগে। আমি নিজে অসুস্থ, যেতে পারলাম না, দেখি মান্নানকে পাঠাবো একটা ডাক্তার নিয়ে............" রাকিব আর শুয়ে থাকতে পারলো না। তড়াক করে উঠলো।

অন্যন্যদিন আমিনউদ্দিনকে তার বিরক্ত লাগলেও আজকে তাকে কেমন আপন লাগলো। ড্রইং রুমে গিয়ে আমিনউদ্দিনকে সালাম দিয়ে সোফায় বসলো। ভাবলো রূপার আরো কোন সংবাদ বের করা যায় কিনা। গত দুমাস ওদিকে যাওয়া হয়নি। রুপার বাবার সাথে কি একটা ঝামেলা হয়েছে রাকিবের বাবার। দুমাস ধরে কথাবার্তা বন্ধ ওদের সাথে। আসা যাওয়াও। দুই বন্ধুর মধ্যে কোন ঝামেলা হলে যাতায়াত বন্ধ থাকে কিছুদিন। এখনো চলছে সেই বিরতিকাল। এরকম বিরতিকাল কখনো এক বছরও হয়ে যায়।

তবে এক বছরের বেশী বিরতিকাল চলে না। কারণ ঈদ আসলে আবারো আসা যাওয়া শুরু হয় ঈদের দিন থেকে। ঈদের দিন দুপুরবেলা রূপা অবশ্যই রাকিবদের বাসায় এসে ঘুরে যাবে, সে সময় রাকিব বাসায় থাকবে না। সন্ধ্যের পর রাকিব অবশ্যই রূপার বাসায় যাবে। সে সময় রূপা বাসায় থাকবে এবং ওরা দুজন ঘন্টা ধরে আড্ডা দেবে। এরপর বরফ গলে যাবে দুই পরিবারের। বলা যায় ওরা দুজন দুই পরিবারের সেতুবন্ধন।

টেলিফোনে সংবাদ নেয়া যায়? রূপাদের বাসার টেলিফোন নাম্বারটা ওর ঠোঁটস্থ। কিন্তু কখনো করেনা টেলিফোন। ওর বাবা ধরে যদি? রূপার বাবা গম্ভীর মানুষ। তাকে একটু ভয়ই পায় রাকিব। কিন্তু আজকে রূপা একা, আজকে করবে? সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। আমিনউদ্দিনের কথা অন্য বিষয়ে ঘুরে গেলে ওর আগ্রহ হারিয়ে যায়।

রুমে ফিরে নিজে নিজে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। আজকে সব সংকোচ ঝেড়ে রূপাকে দেখতে যাবেই সে। কাউকে বলবে না। চুপচাপ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

রূপাদের বাসা শহরের অন্যপ্রান্তে। একটা বাসে চড়ে পৌঁছে যায় ওদের বাসার কাছে। গলিপথ পায়ে হেঁটে যখন চার তলার সিড়ি ভেঙ্গে যখন ওদের বাসার দরোজায় পৌঁছে, তখন ওর হঠাৎ দ্বিধায় পেয়ে বসে। রূপা কি দরোজা খুলবে? এই বয়সের একজন তরুণকে সে যতই আপন লোক হয়, একজন একাকী তরুনী একা ঘরে বিশ্বাস করে ঢোকাতে সংকোচ করে। একটা নির্জন ঘরে একা কখনো ছিল না ওরা। কি করবে এখন? কলিং বেলে চাপ দেবে? সিড়িতে বাতি নেই বলে কলিং বেলের অবস্থানটা আন্দাজে ধরলো। দ্বিধা ঝেড়ে কলিং বেলে চাপ দিল।

একবার, দুবার। কোন সাড়া নেই, পাঁচ মিনিট কেটে যায়। কি হলো ফিট হয়ে পড়ে যায়নি তো? ভয়ে ছ্যাঁত করে উঠলো বুক। কাউকে বলে আসেনি এদিকে। রূপা দরোজা খুলছে না- এই খবরটা যদি ফোন করে দেয় কাউকে, ওরা কি ভাববে? কেন চুপি চুপি চোরের মতো রূপাকে দেখতে এসেছিল সে। ভাবতে ভাবতে ভেতরে একটা পদশব্দ পাওয়া গেল, একটা নারীকন্ঠ জানতে চাইছে, কে?
-আমি
-আমি কে?
-আমি রাকিব
-আপনি? কী ব্যাপার?
"কী ব্যাপার" কথাটা বুকে খুব আঘাত হানলো। রূপা ওকে চিনেও দরোজা খোলার বদলে বলছে, 'কী ব্যাপার'? এমন বদলে গেল সে? মাত্র দুমাসের দুরত্বেই?
-তোমার অসুখের খবর পেয়ে আসলাম। কেমন আছো তুমি?
-আমার অসুখ কে বললো আপনাকে?
-আমিনউদ্দিন চাচা গিয়েছিল বাসায়
খুব অপমান লাগছে রাকিবের দরোজার এপার-ওপার করে কথা বলতে। রূপা তাকে এতটা অপমান করবে কখনো ভাবেনি। যে মেয়ে ওর জন্য দরোজা বন্ধই করতে পারতো না, আজ সে দরোজাই খুলছে না, বাইরে দাড় করিয়ে রেখেছে অন্ধকারে অবাঞ্চিত অতিথির মতো। হায় পৃথিবী। বুকের ভেতরটা কেমন ভারী লাগলো ওর।

-খোঁজ নেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি এখন ভালো আছি, আপনি বাসায় যান

এটা শুনে সে প্রতিজ্ঞা করলো জীবনে আর কখনো এই বাসায় আসবে না। ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল রূপা??? সে বলতে পারলো না, ভেতরে আসি? কি করে বলবে? ও তো অনাহুত এ বাসায়। আর কখনো দেখা করবে না ওর সাথে। কিছুতেই না। ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাড়ালো সে। রুপা আবারো বললো,
-রাকিব ভাই
-হু
-আপনি কী বোকা?
-কেন
-বাইরে এত বড় একটা তালা দেখছেন না?
-তালা? তালা কেন? অন্ধকারে কিছু দেখছি না।
-ওরা তালা মেরে গেছে যাতে কেউ বিরক্ত না করে। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। ডাক্তার বলছে বেশী করে ঘুমাতে। আপনাকে তাই ভেতরে ঢোকাতে পারছি না। কিছু মনে করবেন না।

রাকিব হাত দিয়ে দেখলো সত্যি তালা মারা। ওর বুক থেকে দুই মনী একটা পাথর নেমে গেল যেন। একটু আগের করা প্রতিজ্ঞাগুলো বাদ দিল। রূপা এত বদলাতে পারে না, অবিশ্বাস করা পাপ ওকে।
-আমি কিছু মনে করিনি। ঠিক আছে তুমি ঘুমাও আমি যাই।

নীচে নেমে এল রাকিব। ওদের বাসার পাশেই বিশাল একটা প্রান্তর। সেই প্রান্তরের শেষে একটা রেল লাইন। রাকিব হাটতে হাটতে সেই রেল লাইনে গিয়ে বসে। এখান থেকে রূপাদের বারান্দা দেখা যায়। রূপাকে এক পলক দেখার জন্য রাকিবের মধ্যে কেমন একটা তৃষ্ণা জেগে ওঠে। রূপা যদি বারান্দায় বা জানালায় এসে দাড়ায়। যদি বলে আসতো আমি এদিকে থাকবো তুমি বারান্দায় এসো, তাহলে কি আসতো সে? এ ধরনের কথা মরে গেলেও বলতে পারবে না রাকিব। ওর সাথে সেরকম কোন সম্পর্ক নেই ওর। তবু সে কেন যে রেললাইনের ধারে বসে রূপার জন্য অপেক্ষা করে নিজেই জানে না। কিন্তু রূপা একবারো এলো না বারান্দায়। দেখলো না কেউ ওর অপেক্ষায় আছে ওখানে। সাড়ে আটটার দিকে রূপার বাবা মা ফিরে আসার পর সে উঠলো।

আরো মাস খানেক পর অসুখে পড়ে মোটা কম্বল গায়ে ঘুমোচ্ছিল রাকিব। হঠাৎ জেগে দেখে খাটের পায়ের দিকে দাড়িয়ে আছে রূপা। মুখে জেগে আছে অপরূপা সেই হাসি। বললো,

-আমি উঠলাম, আর আপনি পড়লেন? কাজটা কি ঠিক হলো? সেদিন আমাকে দেখতে গিয়ে অমন পালিয়ে আসলেন কেন? আরেকটু অপেক্ষা করলে কি পায়ে শেকড় গজিয়ে যেতো? অসুস্থ একটা মানুষকে ফেলে পাষাণের মতো চলে আসতে পারলেন আপনি?
-শশশশশ......চুপ
-চুপ কেন?
-চুপপপ করো প্লীজ। কেউ জানে না সেদিন তোমাকে দেখতে গেছি আমি।
-অ

তারপর দুজনেই চুপ। নীরবতা রাজত্ব করতে থাকে ঘরে। রাকিব কিছুতেই বলতে পারলো না, আমি পালিয়ে আসিনি আমি আরো দুঘন্টা বসেছিলাম তোমার জানালায় চোখ রেখে। বেকুবের মতো রেললাইনের ধারে বসে মশার কামড় খেয়েছি ঝাড়া দুঘন্টা। কারো জন্য এতটা আকুল হওয়া লজ্জার কথা। যেন তুমি কতোটা ব্যাকুল না জেনে আমি কতটা আকুল তা বলতে পারছি না।

এবং
এবং
এবং আরো বোকামীর ইতিহাস যুক্ত হলো ক্রমে।

তারপর........এরকম না বলা কথার তালিকা দীর্ঘতর হতে হতে একদিন আমিনউদ্দিন চাচা খবর নিয়ে আসে রূপার বিয়ে ঠিক হয়েছে কলাতলির রফিক সওদাগরের মেজ পুত্রের সাথে।

সংবাদটা শুনে রাকিব কোন ভাবান্তর দেখায় না। দেখাবার কথাও না। রূপার সাথে ওর কিছু ছিল না। যা ছিল ওই বাগানের সাথে। বাগানের ফুল সবজীর গাছগুলোর সাথে আগের মতো আর আড্ডা হবে না। সুযোগ পেলেই ওদের কাছে ছুটে যাওয়া হবে না। ওদের সুখ দুঃখ নিয়ে আর কেউ ভাববে না। রূপার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এটা নিয়ে বিষন্ন হবার বদলে তাই বাগানের গাছগুলোর সঙ্গী হারাবার বেদনায় কাতর হয়ে গেল রাকিব। রূপার বিয়ের দিন বাগানের জন্য সেই কাতরতার প্রকাশ ঘটলো প্রবল কাপুনি সহকারে একটা জ্বরের মধ্য দিয়ে।

রূপার ফুলশয্যার রাত কখন পার হয়ে গেছে সে টেরই পেল না দীর্ঘ জ্বরযাত্রায়। ডাক্তার বলেছে বেশী করে শাকসবজি খেতে। শরীর থেকে প্রচুর ভিটামিন মিনারেল বেরিয়ে গেছে পূর্ন করতে হবে। রাকিব স্বপ্নে দেখলো সারিবদ্ধ টবে শুকিয়ে আছে সজীব বাগান। তবু রূপাদের গলিটা পেরুতে গিয়ে এখনো তার বুকে ছলাৎ করে ঢেউ ওঠে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অজানা কাহিনী এবং একটি মকসুদীয় ত্যানার উপর চপোটাঘাত

২৬শে মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া একটা অজানা কাহিনী শেয়ার করার জন্যই লিখছি। একটু ভুমিকা দিতে হচ্ছে।

স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে ত্যানা প্যাচানীর তিন দশক পেরিয়ে গেছে। সর্বশেষ এবং অভিনব ত্যানাটি প্যাচিয়েছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ ২০০৬ সালের প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায়। তাতে তিনি ২৬শে মার্চের বদলে নতুন একটা স্বাধীনতা দিবস আবিষ্কার করেছিলেন। মক্সুদিয় ত্যানাটা ২০১০ সালে ষষ্ঠ পাণ্ডবের মকসুদনামায় আলোচিত হয়েছিল সচলায়তনে। গত বছর লেখাটি আরো সংযোজিত অংশ নিয়ে 'অরণ্য বেতার' নামে প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশনী।

বইটার প্রথম কয়েক পাতা পড়ার পর পাঠকের জানা হয়ে যাবে মকসুদ সাহেবের এই নতুন দর্শনের উৎস কি। বইয়ের শুরুতে তিনি রাও ফরমান আলীর বইয়ের অংশ কোট করে পাঠকদের নিশ্চিত করেন যে শেখ মুজিব যে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিদের হাতে গ্রেফতারের আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন সে কথা রাও ফরমান আলী তাঁর বইয়ে লেখেন নি(পৃষ্ঠা-২০)। তাই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছেন এই কথায় তিনি বিশ্বাসী নন। স্বাধীনতার ঘোষনা বিষয়ক একটা ব্যাপারে রাও ফরমান আলীর মতো পাকি নরপশুর বই থেকে সিদ্ধান্ত দেন, তাঁকে বুদ্ধিবেশ্যা ছাড়া আর কি বলা যায়?

আবুল মকসুদ বলেছেন "যারা ২৬-২৭ মার্চে চট্টগ্রাম বেতার থেকে ওই ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা সকলেই অনধিকারচর্চা করেছেন, সীমা লংঘন করেছেন, যা স্রেফ মারাত্মক অপরাধের পর্যায়ে পড়ে"(পৃষ্ঠা-২৩)

আমি ব্যক্তিগতভাবে একাত্তরে সেরকম অপরাধীর সন্ধান করি সুযোগ পেলেই। খুঁজতে গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারে সেরকম এক অখ্যাত অপরাধীর খোঁজ পেলাম চট্টগ্রামের সাহিত্যিক মাহবুবুল আলমের 'বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত' বইটিতে। 'দৈনিক স্বাধীনতা' পত্রিকার ৯ মার্চ ১৯৭২ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রায় সম্পূর্ন লেখাটাই নীচে দেয়া হলো আগ্রহী পাঠকদের জন্য।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গোড়াপত্তনের কাহিনী

এম এ হালিম

২৫শে মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় খবর এলো মুজিব ইয়াহিয়া ভুট্টো আলোচনা সফল হয়নি। মনে ভয় হলো, এবার দেশের ভাগ্যে কি রয়েছে। তবে মাইকে প্রচারিত হতে শুনেছি গোলমালের কথা। ঘাবড়ে গেলাম। আওয়ামীলীগ নেতাদের খুঁজবার চেষ্টা করলাম। এমপিএ ইছহাক সাহেবকে পেলাম টিএন্ডটি স্টোরের ওখানে। অনেককে তিনি অভয় দিচ্ছেন। হঠাৎ খবর এলো হালিশহর ইপিআর ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আসছে। উনি চলে গেলেন সেসব বুঝে নেবার জন্য। যাবার সময় বলে গেলেন কিছু দরকার হলে ওনার খোঁজ করার জন্য।

তখন ভোর ৫টা ২৬মার্চ ১৯৭১। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে। সবার মুখে একই কথা, একই প্রশ্ন। কি হবে? ঢাকা বেতার কেন্দ্র বন্ধ। চট্টগ্রামসহ অন্যনহ বেতারের সাড়াশব্দ নেই। সার্বিক খবরের জন্য আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রে গেলাম। তখন বেলা প্রায় সাড়ে সাতটা। দেখলাম কজন ইপিআর ও পুলিশ পাহারারত।একজনকে জিজ্ঞেস করলাম বেতারের কাজ চলবে কিনা। বললেন- চালাবে কে? কর্মীরা সব এসেছে, কিন্তু বলার তো কেউ নেই। বেতার ভবনে ঢোকার চেষ্টা না করে সোজাসুজি চলে এলাম আগ্রাবাদস্থিত মোজাফফর সাহেবের দোকান জেকস-এ। টেলিফোন করলাম বেতার কেন্দ্রে, উত্তরে ঢাকার কোন খবর নেই বললো।

চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ। ভোর রাত থেকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করা হয়েছে। শোনা গেল হালিশহর ইপিআর ক্যাম্পে যুদ্ধ চলছে। আমাদের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীতে গোলাগুলি আসতে লাগলো। ভয়ে সবাই কম্পিত। ইতিমধ্যে ঢাকা বেতার বেজে উঠলো। খবর এলো অপেক্ষা করুন, একটু পরেই খবর বলছি। একটু পরে খবর হলো, সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুঝতে বাকী রইল না এটা কাদের খবর। এতক্ষণ যারা দু এক কথা বুক ফুলিয়ে বলার চেষ্টা করছিল তাদের বুকে কাপুনি শুরু হয়ে গেলো।

এমন সময় আগ্রাবাদ কলোনী রেশন শপের মালিক গোলাম মাওলা ও মালেক নামের বরিশালের এক বন্ধু শেখ সাহেবের নামে প্রেরিত ইংরেজীতে একটা বার্তা নিয়ে আমাদের ওখানে হাজির হলেন। বেলা তখন আটটা।সবাই জড়ো হয়ে গেল। পরে কলোনী এসোসিয়েশানের সেক্রেটারী শফিউদ্দিন সাহেব বার্তাটি বাংলায় অনুবাদ করে কলোনী মসজিদের মাইক যোগে প্রচার করলেন। ওকে সাহায্য করছেন আমদানী রপ্তানী অফিসের মোজাম্মেল ভাই। বার্তার মর্মকথা হলো, “ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানায় পাকিস্তান বাহিনী অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে হাজার হাজার বাঙালীসহ ইবিআর, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর লোকদের নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করেছে। তোমরা যে যে অবস্থায় পারো রুখে দাড়াও।”

ঢাকা বেতার যখন পাক সেনাদের নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে তখন অন্যন্য বেতারগুলো তাদের অনুসরণ করতে পারে। বিশ্বে যে সব আন্দোলন হয়েছে তাতে দেখা যায় বিপ্লবীরা আগেই বেতার কেন্দ্র নিয়ন্ত্রনাধীন রেখেছে। কারণ, কেবল বেতার মারফত বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়া সহজ এবং তা কার্যকরী হয়।মনে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে এবার বাংলা স্বাধীন হবেই।....৭ই মার্চের ভাষনের কথা মনে পড়লো। বঙ্গবন্ধু বলছিলেন প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। আমার মনে প্রেরণা জাগলো। ভাবলাম যে করে হোক বেতার কেন্দ্র চালু রাখা দরকার।

তারপর গেলাম এম এ হান্নান সাহেবের বাসায়। তাঁকে পেলাম বাসার কাছেই। কর্মী পরিবেষ্টিত হয়েএ আলাপ আলোচনা করছিলেন। ওনাকে বিষয়টা সংক্ষেপে বলাতে উনি বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে উপলব্ধি করলেন। আমার প্রস্তাব নিয়ে আলাপ করলাম সবার সাথে। এই অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে যদি বেতার খোলার ব্যাপারে সমর্থ হই। তাহলে জনাব হান্নান সরাসরি বেতারে স্বাধীনতা ঘোষনার ভার নেবেন। হান্নান সাহেব ওয়াদা করলেন এক ঘন্টার মধ্যে আগ্রাবাদ বেতার ভবনে পৌছাবেন।

চিন্তিত মনে পৌছলাম আগ্রাবাদ বেতার ভবনে। হায় কপাল। বেতার ভবন খালি। খোঁজ নিয়ে জানলাম ঢাকা বেতারের ঘোষণার পরপরই বেতার কর্মীরা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বেতার ভবন ছেড়ে নিজ নিজ জায়গায় চলে গেছেন। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসলো। দুএকজনের সাথে পরিচয় থাকলেও অনেকেরই বাসা চিনি না। এই অবস্থায় খোঁজ করে আবার একত্র করা সম্ভব হবে না। হান্নান সাহেব ও অন্যন্য নেতাদের কি জবাব দেবো। এতক্ষণ বড় গলায় বলে আসলাম এ কাজের ভার আমার।

খানিক পর একজনে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছে এসে বললো, হান্নান সাহেব বেতার ভবনে পৌছেছেন কিছু বলার জন্য। অথচ এখন দেখছি বেতার বন্ধ। মাথায় বাজ পড়লো। সঙ্গী শুক্কুর ভাই বললেন, রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ার মির্জা নাসির সাহেবকে বলে দেখতে পারেন। মির্জা নাসির সাহেব আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর ডি-তে থাকেন। মির্জা সাহেবের সাথে দেখা করে সব খুলে বললাম। ইতিমধ্যে তার বাসার সামনে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেল।সবার অনুরোধ আপনি আমাদের সাহায্য করুন। তখন বেলা প্রায় বারোটা। ইতিমধ্যে স্টেট ব্যাংক কলোনী থেকে একখানা কালো রঙের গাড়িতে করে কয়জন আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মীর্জা সাহবের বাসার সামনে ভীড় দেখে একজন গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লেন। আগ্রহ সহকারে ব্যাপার জানতে চাইলেন। ভদ্রলোকের নাম এম এ কাসেম। উনি কোন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। উনি বললেন ওনার গাড়িতে করে বেতার ভবনে পৌছে দেবেন। মীর্জা সাহেব বললেন, “কিছুক্ষণ আগে আমার সব বেতার কর্মীরা এসে বলে গেল জীবনের ঝুকি নিয়ে তারা কোন কাজ করতে পারবে না।” আমি বললাম, “আপনি আমাদের সাথে চলুন, তাদেরকেও আমরা নিয়ে আসবো।”

ইতিমধ্যে ওর বাসার সামনে জনতার হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। উপস্থিত সবাই উত্তেজিত হয়ে বললো যে, “মীর্জা সাহেব যে পর্যন্ত যাবেন না, আমরা ততক্ষণ এ স্থান ত্যাগ করবো না।” অবশেষে মীর্জা সাহেব বাধ্য হয়ে আমাদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন।গিয়ে আমরা কাসেম সাহেবের গাড়িতে উঠলাম। একটু যেতেই উনি বললেন, এখানেই থাকেন আমাদের আরেক ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবহান সাহেব। গাড়ি থামলো সোবহান সাহেবের বাসার সামনে। মীর্জা সাহেব আমি ও কাসেম সোবহান সাহেবের বাসায় উঠলাম। একটু পরেই সোবহান সাহেবকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।

সোবহান সাহেবকে ইতিপূর্বে চিনতাম না তবে নাম শুনেছি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় উনি আওয়ামীলীগের নির্দেশক্রমে বেতার কেন্দ্র চালনার কাজে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছেন। অনেকেরই মুখে ওর প্রশংসা শুনেছি। পরে জানতে পারলাম যে বেলা দশটার পরে যে সব কর্মী বেতার ভবন ছেড়ে এসেছিলেন তাদেরকে নিয়ে সোবহান সাহেব মির্জা সাহেবের বাসায় সিদ্ধান্ত নেন যে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে কোন লোক উদ্যোগী হয়ে আসলে বেতার কর্মীরা সর্বপ্রকারের সহযোগীতা করবেন। গাড়ি পৌছুলো বেতার ভবনে। ইতিপূর্বে একখানা জীপে করে জনাব এম এ হান্নান কয়জন আওয়ামীলীগ কর্মীসহ আগ্রাবাদ বেতার ভবনে পৌছেছিলেন। মির্জা সাহেব সোবহান সাহেবকে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনে যাওয়ার জন্য বললে সোবহান সাহেব বলেন, কালুরঘাট থেকেই সবকিছু করা যাবে, দুজন দুই খানে থাকার কোন দরকার নাই। পরে দুইজনেই কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনে যাবার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এই সময় হান্নান সাহেব বেতার ভবনে অবস্থান করছিলেন। ওকে গাড়িতে নিয়ে ছুটলাম কালুরঘাট। দুখানা গাড়ি চললো দ্রুতবেগে। জনাব কাসেম ওর গাড়ি দ্বারা যে উপকার করেছেন তা চিরদিন মনে থাকবে।

আমাদের গাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে ডাঃ খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছালো।। ড্রাইভার বললো, গাড়ির তৈল শেষ হয়ে গেছে। ওখানকার পোট্রোল পাম্প লাফার্জ কর্পোরেশান থেকে তৈল নেয়া হলো।হান্নান সাহেব এর ব্যবস্থা করেছিলেন। একটু দূরে যেতেই সোবহান সাহেব বললেন, দেলোয়ার হোসেন, বেতার ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাসাটা চিনে রাখুন, সময়মতো কাজে দেবে। উনি থাকেন কাপাসগোলায়। দেলোয়ার সাহেব বাসায় ছিলেন। মনে হচ্ছিল তিনি এই কাজের জন্যই তৈরী হচ্ছিলেন। অবশেষে গাড়ি পৌছালো কালুরঘাট ট্রান্সমিটার কেন্দ্রে।

সেখানে তখন একমাত্র আমিনুর রহমান পাহারাদার বাদে আর কোন রেডিও স্টাফ ছিল না। সে তখন কাজ বন্ধ করে দাড়িয়েছিল। সেখানে কয়েকজন পুলিশ আর ইপিআর পাহারারত ছিল। মির্জা সাহেব সোবহান সাহেব আর দেলোয়ার সাহেব একযোগে ট্রান্সমিটার চালানোর কাজে লেগে গেলেন। আর হান্নান সাহেব কয়েক সহকর্মী সহ স্ক্রীপ্ট লেখার কাজে লেগে গেলেন। অল্পক্ষনের মধ্যে বেতার চালু হলো। এক ছাত্রবন্ধু প্রথম ঘোষনা করলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। দেশবাসীকে তিনি অনুরোধ করলেন, আপনারা অপেক্ষা করুন এখুনি আমাদের চট্টলবীর এম এ হান্নান সাহেব আপনাদের উদ্দেশ্যে ভাষন দেবেন। এইভাবে কয়েকবার ঘোষণা করা হলো। বেলা ২-১০মিনিট। হান্নান সাহেব বেতারের সামনে দাড়িয়ে ঘোষণা করলেন এদেশের স্বাধীনতা।

নোটঃ এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল চট্টগ্রামের প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী (যিনি লিখেছিলেন একুশের প্রথম কবিতা, 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি') সম্পাদিত দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার ৯ মার্চ ১৯৭২ সংখ্যায়। লেখকঃ এম এ হালিম, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর বাসিন্দা, তৎকালীন কাস্টমস প্রিভেন্টিভ অফিসার'

পাঠক, এই হলো এম এ হান্নানের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠে একজন সাধারণ মানুষের ভুমিকা। এম এ হান্নানের ওই ঘোষণাটা ২৬শে মার্চ বেলা ২.১০ মিনিটে প্রচার হয়েছিল ৫/৭ মিনিটের সংক্ষিপ্ত এক অধিবেশনে। এই সময়ে বেতারের নিয়মিত কর্মীদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। মূল ভুমিকায় যারা ছিলেন তাদের সবাই অপরিচিত মুখ। তবে বেলাল মোহাম্মদের উদ্যোগে ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আবারো দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন এম এ হান্নান। এটাই সর্বত্র আলোচিত হয়। কারণ সেই সময় উপস্থিত ছিলেন আলোচিত পরিচিত ১০ বেতার কর্মী। এদের সবাই মকসুদের চোখে অপরাধী হলেও জনাব মকসুদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনাকারী হিসেবে কৃতিত্ব দিতে সম্মত হন চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীণ রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ার মির্জা নাসিরুদ্দিনকে মধ্যে যাকে আক্ষরিক অর্থেই সিজিএস কলোনীর বাসা থেকে জোর করে বের করে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ট্রান্সমিটার চালু করার জন্য। পরবর্তী সময়ে যিনি পাকিস্তান সরকারের অনুগত থেকে কাজ করেছেন।

মকসুদ সাহেব এমনকি ক্যাপ্টেন রফিকের মধ্যেও ততটা দেশপ্রেম পান না যিনি সত্যিকার অর্থে প্রথম বিদ্রোহ করেছিলেন পাকিদের বিরুদ্ধে। ২৫শে মার্চ রাতে যার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। তিনি দেশপ্রেম খুঁজে পান মেজর জিয়াতে যাকে প্রায় জোর করে মুক্তিযুদ্ধে সামিল করতে হয়েছিল।

জনাব মকসুদ, ৪১ পৃষ্ঠায় আপনার 'উই রিভোল্ট' শিরোনামের জিয়া তোষণ দেখে আমার একচোট হাসি পেয়েছিল। কারণ সব জেনেশুনে সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস করার জন্য যাবার সময় আগ্রাবাদে ক্যাপ্টেন খালেকের কাছে বাধা পেয়ে জিয়া 'উই রিভোল্ট' বললেন। তারপর কোথায় গেলেন তিনি? ২৪ ঘন্টা আগেও রেলওয়ের পাহাড়ে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে সংক্ষিপ্ত মিটিং এ কোন রকম আক্রমন আশংকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানীদের উপর বিশ্বাস রেখে।

যে সময়ে শহরের মধ্যে ক্যাপ্টেন রফিকের ইপিআর সামান্য শক্তি নিয়ে প্রাণপন যুদ্ধ করে যাচ্ছিল আর মেজর জিয়া 'উই রিভোল্ট' বলে সবচেএ শক্তিশালী ৮ম রেজিমেন্ট নিয়ে কর্নফুলী নদী পার হয়ে বোয়ালখালী পটিয়ার নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিলেন। শুধু তাই না, কাপ্তাই থেকে আগত ইপিআর দলকে শহরে যেতে না দিয়ে কালুরঘাট আটকে রাখেন। ইতিহাস বলে ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ২৫শে মার্চ ক্যাপ্টেন রফিকের আহবানে সাড়া দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পাকিস্তানীরা এত সহজে এতগুলো বাঙালী সৈনিকের প্রাণ নিতে পারতো না। এত দ্রুত শহরের পতন ঘটতো না।

যে মেজর জিয়াকে ইনিয়ে বিনিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ সৈনিক বানাবার চেষ্টা করেছেন আপনি সেই মেজর জিয়ার সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সেদিন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে হাজারের উপর বাঙালী সৈনিক এবং তাঁদের অফিসারকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের হাতে। যার মধ্যে ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবচেয়ে সিনিয়র বাঙালী অফিসার লে কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরী। জিয়া নন, এই কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরীরই হবার কথা ছিল চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সৈনিকদের নেতা। তার উদ্যোগেই আরো এক সপ্তাহ আগে এম আর সিদ্দিকীর বাসায় বিদ্রোহের ব্যাপারে বৈঠক হয় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিদের সাথে। আপনার গবেষণা এসবে আলো ফেলতে পারেনি, কারণ আপনার গবেষণার টর্চলাইট রাও ফরমান আলীদের হাতে।

জনাব মকসুদ, আপনার 'অরণ্য বেতার' পাঠ করার পর প্রাথমিক অনুভুতি আপনার ডান গন্ডে বামহাতের একটা অসৌজন্য ক্রিয়া। আপনার ধারণাই নেই আপনার বইয়ের কিছু অংশ মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে কতটা অপমান করেছে, হেয় করেছে।

Saturday, March 17, 2012

অদেয়

যেবার সমুদ্র ডেকেছিল, আমি পাহাড়ে গেলাম। যেদিন পাহাড় ডেকেছিল, সেদিন আমি সমুদ্র স্নানে। নদী আমাকে একবারো ডাকেনি, আমি নদীর কাছেই ছিলাম। তবু পাহাড় নয়, সমুদ্র নয়, নদীই তুললো অভিযোগের আঙুল।

আমি নদীকে বোঝালাম, আমি যখন পাহাড়ে তখনো আমি তোমার দিকে তাকিয়ে। আমি নদীকে বোঝালাম আমি যখন সমুদ্রে তখনো আমি তোমার বয়ে আনা জলে সিক্ত। নদী আমাকে বিশ্বাস করলো না, একা চলে গেল।

নদী জানে অপ্রাপ্তির বেদনা, আমি জানি অদেয় হয়ে থাকার অতৃপ্ত দহন।

Saturday, March 3, 2012

অপারেশান লাইভ মার্সঃ ২০৬৩

প্রনেট থেকে দুটো বীপ বীপ শব্দ এলো। রিশাদ বুঝলো সময় মাত্র পনেরো মিনিট। আর দশ মিনিট পর চারটা বিপ আসবে। তখনই প্রনেটের স্লাইডিং ডোর খুলবে। এই প্রথম সে যাচ্ছে মঙ্গলে। বহুকাল আগে তার বাবা একদিন জ্বরের ঘোরে বলেছিল তুমি একদিন মঙ্গলগ্রহে যাবে। রিশাদ তখন ৪ বছরের শিশু। তার স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু বাবা চলে যাবার পর মা বহুদিন কথাটা বলেছে তাকে শুনতে শুনতে তার মনে হয়েছিল সত্যিই সে শুনেছিল বাবার কথাটা।

কষ্ট হচ্ছে তার। অচেনা কষ্ট। পৃথিবী ছেড়ে যাবার মায়ায় নয়। সে হরদম পৃথিবী ছেড়ে উপগ্রহ স্টেশানে যাচ্ছে আসছে কখনো চাদের মাটিতে ঘুরে আসছে। তার কষ্ট হলো বাবাকে নিয়ে। কিছু বাবা কখনোই তাদের ছেলেদের পরিপূর্ন সফল দেখে যেতে পারে না। তার বাবাও সেরকম একজন। তাকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু রিশাদের বয়স দশ বছর হবার সময় বাবা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যায়। বাবার রেখে যাওয়া অর্থে কিছুকাল চললেও কয়েক বছরের মধ্যে চুড়ান্ত অভাব নেমে আসে। মা পাগলের মতো ঘুরেছে টাকার জন্য। কেউ দেয়নি। শেষে নিজে কি কি কাজ করে সেই টাকায় ওরা দুভাইবোনের পড়াশোনা চালিয়ে যায়। বোনের বিয়ে দেয়, তাকে বিদেশে পাঠায়। বিদেশে পাঠাবার পর মা একা হয়ে যায়। গিযে উঠেছিল বোনের বাড়িতে। বোন তাকে যত্নেই রেখেছিল। একদিন সেই মাও চলে যায় তখন রিশাদ পিএইচডি শেষ করে নাসায় চাকরীর জন্য দরখাস্ত করেছিল। মাও শুনে যেতে পারলো না ছেলের সাফল্য। এখন বোন আছে কানাডা। সে আমেরিকায়। বাবামা দুজনের কবর দেশে। চট্টগ্রামে যাওয়া হয়নি কতোকাল!! গত ২০ বছর কোন সুযোগ আসেনি। এত ব্যস্ত সারা বিশ্বের দায়িত্ব নিয়ে। তার ছেলেরা বিদেশী। সে বিয়ে করেছিল লুসিকে। আমেরিকান তরুণী। তার কলেজ জীবনের বন্ধু। লুসির সাথে বিয়ে হবার পর তার সাথে বাংলাদেশের সমস্ত যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বোনের সাথে দেখা হয় বছর দুবছরে একবার। সেই একমাত্র যোগাযোগটা রাখে দেশের সাথে। সেই খালাটাও মারা গেছে কয়েক বছর আগে। আর কোন পিছুটান নেই তার। ফুপুদের মধ্যে মাত্র একজনের সাথে যোগাযোগ ছিল, সেই ফুপুও তার সংসার নিয়ে নাতি নাতনি নিয়ে ব্যস্ত। কে কার খোঁজ রাখে।

৫৪ বছর বয়সে এসে পেছনে ফিরে তাকায় রিশাদ। দেশ বলতে সে এখন আমেরিকাকেই বোঝে তার ছেলেমেয়েদের মতোই। বাংলা কথা বলতে পারলেও পড়তে পারে না।

এত বছর পরে এই সময়ে এসে কেন তার মনে পড়ে যাচ্ছে সব। বাবা মা কতো ভালোবাসতো তাকে। তাকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখেছে। অথচ সে বাবা মার কবর দেখতে যায়নি গত বিশ বছর। শেষবার গিয়েছিল ২০৪৩ সালে। এখন দেশে যাওয়া কতো সহজ। প্রনেটে মাত্র দশ মিনিট লাগবে পৌঁছাতে। যদিও খরচ অনেক বেশী। কিন্তু সেই বেশীটা তার এক সপ্তাহের স্যালারিও না। বাবা মাকে দেখার জন্য তার এক সপ্তাহের বেতনও খরচ করতে পারেনি রিশাদ। এটা খুব কষ্ট দিল তাকে। ঠিক এই মুহুর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে সব। এটাকে কি অপরাধবোধ বলে?



এতটা সাফল্য আসবে কখনোই ভাবেনি সে কিংবা তার আমেরিকান পরিবার। কিন্তু তার বাবা ৫০ বছর আগে কি করে ভবিষ্যতবানী করলো যে রিশাদ একদিন মঙ্গলগ্রহে যাবে। মা বলতো সবাই ওটা ঠাট্টা হিসেবেই নিয়েছিল। ঠাট্টা হলেও কথাটা কতো ভারী ছিল এত বছর পর এসে বুঝতে পারছে সে। সেই আমলে মানুষ তো দূরে থাক মানুষবিহীন রকেট যেতেও নাকি ছ মাস লাগতো। আর এখন সাড়ে সাত ঘন্টায় সে পৌছে যাবে মঙ্গলগ্রহে। রিশাদই প্রথম না। আগেও কয়েকজন এসে ঘুরে গেছে। কিন্তু রিশাদের এই যাত্রাটা আগের সবগুলো থেকে ভিন্ন। সে যাচ্ছে এই গ্রহ থেকে মানুষকে ওই গ্রহে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে উৎসাহিত করার বিজ্ঞাপনে। লুসি বলেছিল এটা ছিল নির্বাচনের ভুং ভাং প্রতিশ্রুতি। ক্ষমতায় এলে সব ভুলে যাবে। কিন্তু ভোলেনি প্রেসিডেন্ট। রিশাদকে মনোনীত করেছে পাচ জনের টিমে। দলনেতা হিসেবে। বাকীদের বয়স ত্রিশের মধ্যে। কিন্তু রিশাদকে দেখায় তারো কম। তার বাংলাদেশী শারিরীক গঠনের কারণেই।

দুয়েক মিনিট পরেই ফাইনাল বীপ শোনা যাবে। বাকী চারজন তৈরী। বীপ আসামাত্র ঢুকে যাবে। সবাইকে বিদায় দিচ্ছে। আগামী দুমাস ওরা মঙ্গলেই থাকবে। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে। সব সেরে আসতে হবে। ওই পরীক্ষার রেজাল্টের উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যত মানব বসতির বাস্তবতা।

হঠাৎ তার মাথায় একটা দুর্বুদ্ধি খেলে গেল। এখুনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষুণি। দশ সেকেন্ড ভাবলো। তারপর আরো পাঁচ সেকেন্ড। না, এটা তাকে করতেই হবে। বাবাকে না দেখে সে মঙ্গলে পা দেবে না। যত সর্বনাশই হোক। এই কাজটা, জীবনে প্রথমবারের মতো একটা প্রতারণার আশ্রয় তাকে নিতেই হবে।

বাকী চারজন অভিযাত্রী দেখতে পেল দলনেতার শরীরটা বাঁকা হয়ে মুচড়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে মেঝেতে। মহাকাশের সমস্ত জবরজং পোষাক আশাক সহকারে রিশাদ গড়িয়ে পড়লো স্টীল প্ল্যাটফর্মে। দৌড়ে গিয়ে ওরা তুলতে চাইল। কিন্তু রিশাদের শরীর নড়ছে না। টিভি ক্যামেরায় লাইভ দেখাচ্ছিল। এই দৃশ্যে সারা বিশ্বে উত্তেজনার জোয়ার ছুটে গেল। কি হয়েছে কেউ বুঝছে না। ছোটাছুটি শুরু হয়েছে। স্ট্রেচারে করে বাইরে নিয়ে আসা হলো। ফাইনাল বীপ বেজে থেমে গেল। দরোজা খুলে গেল। কিন্তু কেউ ঢুকলো না। কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট টিভি দেখে মুখ ফুটে বললো, হল্ট! ফ্লাইং স্টেশানে খবর পৌছে গেল পরমুহুর্তেই। অপারেশান লাইভ মার্স, থমকে গেল কিছু সময়ের জন্য।

রিশাদের জ্ঞান ফিরেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে খ্যাতনামা নভোচারী ফিটনেস সেন্টারে রাখা হয়েছে তাকে। প্রেসিডেন্ট তাকে দেখতে এল ঘন্টাখানেক পরেই। সিকিউরিটি বের হয়ে যাবার পর প্রেসিডেন্ট হিকেন্স তার স্বরূপে বেরিয়ে এল। এই হিকেন্স তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধু এবং লুসির ঘনিষ্ঠতম ফার্স্ট কাজিন। আপন বোনের চেয়েও বেশী আদরের লুসি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পরও তাই তাদের ঘনিষ্ঠতা কমেনি। রিশাদের এই প্রজেক্টের হেড বানাবার কৃতিত্বের পেছনে রিশাদের মেধা কিন্তু তার নামটা জোরালো সুপারিশে এসেছে হিকেন্সের কারণে।

-রিশাদ, কি হয়েছে তোমার?
-দেখলে না, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে গেলাম অজ্ঞান হয়ে?
-ননসেন্স, তুমি এক সেকেন্ড আগেও পুরো ফিট ছিলে, এখন কি হলো তোমার, মতলবটা আমাকে খুলে বলো
-তুমি বিশ্বাস করো না আমাকে?
-আমাকে তুমি ডোবাতে চাও? তার চেয়ে প্রাণে মেরে ফেলো।
-কি বলো হিকেন্স?
-নয়তো কি, এরকম একটা প্রজেক্টে তুমি আগুন ধরিয়ে দিলে?
-আগুন ধরাবো কেন? আমি যাচ্ছি তো। আগামীকাল গেলে পৃথিবীর খুব বিলম্ব হয়ে যাবে?
-যাচ্ছো? তাহলে আজকে কেন এমন করলে? সারা বিশ্বের মিডিয়া আমাদের উপর চোখ রেখেছে জানো তুমি?
-আমাদের এই মুহুর্তের কথাবার্তাও শুনছে ওরা?
-না তা শুনবে না। এটাকে আমি সাংবাদিক থেকে কোয়ারাইন্টাইন করে রেখেছি।
-গুড, এখন শোনো
-বলো
-আমার শেষ একটা উপকার করবে?
-চেষ্টা করবো
-চেষ্টায় চলবে না। কথা দাও। এটা তোমার আমার ডীল। আর কেউ যেন না জানে। তোমার বউ না, আমার বউও না।
-কী এমন সিক্রেট বলতো?
-আমাকে তুমি দুই ঘন্টা সময় আর এক সীটের ছোট্ট একটা প্রনেট দেবে। কথা দিচ্ছি কালকে তোমার প্রজেক্ট সাফল্যজনকভাবে মঙ্গলে পৌঁছাবে।
-আশ্চর্য কথা, কি করতে চাও তুমি?
-তুমি আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগাবে না তো?
-না
-প্রমিজ?
-প্রমিজ।
-আমি একটা ঘন্টা বাংলাদেশে বাবার কবরের পাশে কাটিয়ে আসতে চাই।
-কী সর্বনেশে চাওয়া!!!
-কেন?
-তুমি জানো তুমি কি চাইছ? চাইলে আকাশ থেকে চাঁদটা পেড়ে তোমার হাতে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু এটা একদম অসম্ভব। তুমি পাগল!!!
-না হিকেন্স। আমি অসম্ভব কিছু চাইনি। তুমি চাইলেই পারো।
-না!!!! অসম্ভব!!! আমাকে মেরে ফেললেও এটা করবো না।
-হিকেন্স! তুমি কথা দিয়েছো!
-কথার গুষ্টি মারি আমি। তুমি কোথাও যাচ্ছো না। আমার সারাজীবনের স্বপ্ন তুমি নস্যাত করে দিচ্ছো এক খামখেয়ালী শখের জন্য, আর আমি তোমার কথা রাখবো??? আমাকে এত হাদা মনে হয় তোমার??
-প্লীজ হিকেন্স!
-কোন প্লীজ না। তুমি এখন থেকে কঠোর ওয়াচে থাকবে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এবং এই গ্রহ থেকে রওনা না হওয়া পর্যন্ত। আমি টয়লেটেও ক্যামেরা বসাতে বলে দিচ্ছি। তোমার সমস্ত প্রাইভেসি আবদার বাতিল।
-হিকেন্স!
-শাট আপ!!!!! ইউ ইউ........ড্যাম!! আমি গেলাম এখন!!
-শোনো হিকেন্স
-আমি আর কোন কথা শুনবো না তোমার, তুমি একটা বদ্ধ উন্মাদ!!
-তাইলে আমার শেষ কথাটা শুনে যাও। তোমার এই প্রজেক্টে আমি পেচ্ছাব করে দিলাম এই মুহুর্ত থেকে!!
-কী!!!!????
-শুনে রাখো। আমি এই প্রজেক্টের জন্য দিনের পর দিন বছরের পর বছর নিজেকে তৈরী করছিলাম যে কারণে, এত বছর ভুলে গিয়েছিলাম সেটা। ঠিক প্রনেটের দরোজা খোলার আগ মুহুর্তেই মনে পড়েছে। তুমি কি চাও আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গাটাকে না ছুয়ে মঙ্গলগ্রহে যাবো?
-কী সেই কারণ
-এখন তা আর না শুনলেও চলবে তোমার! প্রজেক্ট বাতিল বলে ধরে নাও।
-রিশাদ!! তুমি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো, এটা আমার কতোবড় স্বপ্ন, তুমি এভাবে বাতিল বলতে পারো না।
-তাহলে তুমিও আমার মঙ্গল ভ্রমনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নচারী আমার বাবাকে দেখা থেকে বারণ করতে পারো না।
-তোমার বাবা এটার স্বপ্নচারী?
-আমার বাবা ৫০ বছর আগে আমার মঙ্গলযাত্রা নিয়ে একটা অলৌকিক বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন। আর কেউ বিশ্বাস করেনি। কেবল মা করতো। মা আমাকে বলতো। আমিও কখনো বিশ্বাস করিনি। তবু স্বপ্নটাকে আমি লালন করেছিলাম। সেভাবেই আমার পড়াশোনা চালিয়ে আজ এখানে এসেছি। তুমি চাও আমি ওই স্বপ্নে দেখা মানুষটাকে অবজ্ঞা করি???? তোমাদের দেশকে সেবা করতে গিয়ে গত বিশ বছর আমি বাবাকে দেখতে যাইনি। তবু তুমি আমাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে তোমার ইগো, তোমার প্রটোকল ইত্যাদি ঠিক রাখার জন্য?
-না রিশাদ
-তবে?
-আমাকে একটু ভাবতে দাও
-তোমাকে এই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। যাবো কি যাবো না। দ্বিতীয় কারো পরামর্শে তুমি সিদ্ধান্ত নিলে আমার বিপক্ষে যাবে আমি খুব ভালো করেই জানি।
-আমাকে এতটা চাপ দেয়া কি ঠিক তোমার? আমি তোমার বন্ধু হলেও রাষ্ট্রের জন্য দায়িত্ব আছে না আমার?
-আমার কাছে তোমার রাষ্ট্রের চেয়ে আবার বাবার আবেগটা গুরুত্বপূর্ন। ক্লিয়ার?
-মনে হচ্ছে তুমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর আমি তোমার খানসামা!
-যা ইচ্ছে ভাবো তুমি। কিন্তু আমি এক্ষুনি শুনতে চাই। যেতে দেবে কি দেবে না?
-ঠিক আছে। যাবে তুমি। মাত্র দুঘন্টাই এক সেকেন্ডও বেশী নয়।
-আমি একা যাবো। প্রাইভেট প্রনেটে। কেউ যেন ফলো না করে। হাসপাতালের ছাদের ফ্লাইং প্যানেলে তুমি এনে রাখার ব্যবস্থা করবে ওটা। ওখান থেকেই উড়বো।
-নিরাপত্তার কি হবে। তোমাদের একেকজনের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র বিশাল বাজেট রাখে। তুমি এরকম নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দূরদেশে গেলে কোন দুর্ঘটনায় কি করবে?
-দুঘন্টার জন্য নিজের দায়িত্ব নিতে পারবো আমি। তুমি কেবল কানে রিপ্লিটা দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে। যে কোন সমস্যায় আমি তোমার কানে জানিয়ে দেবো। রিপ্লিতে আর কারো আইডি যেন না থাকে। আমি কারো ট্রেস সংকেতে পড়তে চাই না।
-তোমার কথামতোই হবে। কিন্তু তুমি ফিরে আসবে ঠিকসময়ে। কথা দাও।
-তুমি আমার কথা রেখেছো, আমিও রাখবো।

সেই রাতেই রিশাদ উড়াল দিল। দশ মিনিটের পথ। রাত থেকে দিনে আসার পর রোদটা খুব কড়া লাগছে। বাংলাদেশের আকাশে মেঘ আছে। রাডার সিকিউরিটি লেভেলের উপর দিয়েই উড়ে এসেছে সে। রেঞ্জের মধ্যে থাকলেও সমস্যা নাই। এই প্রনেটে সব ধরনের ট্রাকিং ডিভাইস জ্যাম করা আছে। উপর থেকে নির্জন একটা জায়গা বের করলো। কবরস্থান এমনিতেই নির্জন জায়গা। তবু সরাসরি বাবার কবরে না নেমে পাশের একটা জঙ্গলে নামলো। ওখানে প্রনেটকে লুকিয়ে রেখে, পোষাক বদলে পায়ে হেঁটে কবরের দিকে রওনা হলো সে। পথে এক বুড়োমতন লোকের সাথে দেখা। রিশাদকে দেখে চিনলো না। কিন্তু গ্রামের মানুষের কৌতুহল বেশী। তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন।

-আবুল হোসেনের কবর ওইখানে ছিল না?
-কোন আবুল হোসেন?
-সিরাজ হোসেনের ছেলে আবুল হোসেন
-ওওওও পুব পাড়ার আবুল হোসেন? তার কবর তো বহুত আগেই হাপিস
-মানে কি
-আরে বাপজি, এত বছর পর কি কবর থাকে? সে মারা গেছে কোন ৫০ বছর আগে। আমি বলে চিনছি তারে, আর কেউ তো চিনবেও না। আপনি তার কে হন
-আমি তার ছেলে
-ওওও আপনি কি শহর থেকে আসছেন?
-জী শহর থেকে
-ওই জঙ্গলে কিল্লাই গেছিলা। ওদিকে তো কবর নাই রাস্তাও নাই
-ওই জঙ্গলে পাখি দেখতে গেছিলাম
-ওওওও বুঝছি। আইসো আবুল হোসেনের কবরের চিহ্ন দেখাই।
-আচ্ছা
-ওই যে একটা বাদিগাছ, ওইটা তার বাপের, মানে আপনার দাদার কবর। তার এপাশে দুইটা বেড়া, তার পারে আরেকটা পিলার। ওই পিলারের আশেপাশে তার কবর আছিল। এতদিন পর বলা মুশকিল।

রিশাদ গুটি গুটি পায়ে ওই কবরের কাছে গেল। দোয়াদরুদ কিছু জানে না সে। ছেলেবেলায় কি শিখেছে মনে নেই। ধর্মের সাথে কোন যোগাযোগ নেই বহুযুগ। তবু সে বিরল এক কান্নায় প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাটু গেড়ে বসে গেল পিলারের গোড়ায়। কাঁদছে সে অঝোর ধারায়। এই তার ভুলে যাওয়া বাবার কবর। যে বাবা তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল বহুযুগ আগে। যে বাবাকে সে ভুলে বিদেশে গিয়ে সংসার পেতেছে। বাবা কি তাকে ক্ষমা করবে? বাবা, বাবা বাবা!! আমি এখন কি করবো, কোথায় যাবো বাবা!! আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা। তুমি আমাকে ক্ষমা করো বাবা। তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে আমি যে তোমাকেই ভুলে গিয়েছিলাম বাবা!

রিশাদের কান্নার শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়। বুড়োটা দূর থেকে দেখতে পায়, লোকটা পিলারের পাশে বসে ঝুঁকে ঝুঁকে কাঁপছে। চৈত্রের বাতাস বইছে উল্টোপাল্টা। আকাশ কালো হয়ে আসছে দ্রুত। ঝড় নামতে পারে যে কোন সময়। রিশাদ ভুলে যায় তার সময় মাত্র দুঘন্টা। আর আধঘন্টা পরই শেষ। কানের রিপ্লিতে ডাক দিতে শুরু করেছে হিকেন্সের গলা। রিশাদ তবু নড়তে চাইলো না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে একটা রাত একটা দিন সে চুপ করে কাটিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এখন বড় অসময়। আবার আসতে হবে তাকে। সে টের পায়, এই মাটিতেই তার নাড়ি পোতা। মায়ের কবর এখানে হয়নি। মাকে খালা তার বাবার পাশেই সমাহিত করেছিল। এখন খালাও নাই। মামাদের কারো সাথে যোগাযোগ নেই। কিভাবে মাকে খুঁজে পাবে।

এত কম সময়ে তার কোথাও যাওয়া হবে না আর। উঠলো সে ক্লান্ত শরীর নিয়ে। বহুকালের ক্লান্তি তার যেন। আবার ফিরে আসবে সে। এই দেশেই ফিরে আসবে। এই মাটিতে। মা বাবা দুজনকে ছেড়ে সে কতোকাল কাটিয়েছে বিদেশ বিভুইতে। মঙ্গল থেকে ফিরে সে চাকরীতে ইস্তফা দেবে। এই বাংলাদেশেই তার জীবনের শেষটুকু কাটাবে।

রিপ্লিতে বীপ শব্দ এলো। হিকেন্স ডাক দিচ্ছে। উঠতে শুরু করলো সে ভূমি থেকে আকাশে। ক্যালিফোর্নিয়া সময় রাত তিনটায় সে হাসপাতালে প্রবেশ করলো আবার। কেউ টের পায়নি সে ছাদে হাওয়া খেতে গিয়ে পৃথিবীর দিবাভাগটা ঘুরে এসেছে।