Saturday, March 3, 2012

অপারেশান লাইভ মার্সঃ ২০৬৩

প্রনেট থেকে দুটো বীপ বীপ শব্দ এলো। রিশাদ বুঝলো সময় মাত্র পনেরো মিনিট। আর দশ মিনিট পর চারটা বিপ আসবে। তখনই প্রনেটের স্লাইডিং ডোর খুলবে। এই প্রথম সে যাচ্ছে মঙ্গলে। বহুকাল আগে তার বাবা একদিন জ্বরের ঘোরে বলেছিল তুমি একদিন মঙ্গলগ্রহে যাবে। রিশাদ তখন ৪ বছরের শিশু। তার স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু বাবা চলে যাবার পর মা বহুদিন কথাটা বলেছে তাকে শুনতে শুনতে তার মনে হয়েছিল সত্যিই সে শুনেছিল বাবার কথাটা।

কষ্ট হচ্ছে তার। অচেনা কষ্ট। পৃথিবী ছেড়ে যাবার মায়ায় নয়। সে হরদম পৃথিবী ছেড়ে উপগ্রহ স্টেশানে যাচ্ছে আসছে কখনো চাদের মাটিতে ঘুরে আসছে। তার কষ্ট হলো বাবাকে নিয়ে। কিছু বাবা কখনোই তাদের ছেলেদের পরিপূর্ন সফল দেখে যেতে পারে না। তার বাবাও সেরকম একজন। তাকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু রিশাদের বয়স দশ বছর হবার সময় বাবা পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যায়। বাবার রেখে যাওয়া অর্থে কিছুকাল চললেও কয়েক বছরের মধ্যে চুড়ান্ত অভাব নেমে আসে। মা পাগলের মতো ঘুরেছে টাকার জন্য। কেউ দেয়নি। শেষে নিজে কি কি কাজ করে সেই টাকায় ওরা দুভাইবোনের পড়াশোনা চালিয়ে যায়। বোনের বিয়ে দেয়, তাকে বিদেশে পাঠায়। বিদেশে পাঠাবার পর মা একা হয়ে যায়। গিযে উঠেছিল বোনের বাড়িতে। বোন তাকে যত্নেই রেখেছিল। একদিন সেই মাও চলে যায় তখন রিশাদ পিএইচডি শেষ করে নাসায় চাকরীর জন্য দরখাস্ত করেছিল। মাও শুনে যেতে পারলো না ছেলের সাফল্য। এখন বোন আছে কানাডা। সে আমেরিকায়। বাবামা দুজনের কবর দেশে। চট্টগ্রামে যাওয়া হয়নি কতোকাল!! গত ২০ বছর কোন সুযোগ আসেনি। এত ব্যস্ত সারা বিশ্বের দায়িত্ব নিয়ে। তার ছেলেরা বিদেশী। সে বিয়ে করেছিল লুসিকে। আমেরিকান তরুণী। তার কলেজ জীবনের বন্ধু। লুসির সাথে বিয়ে হবার পর তার সাথে বাংলাদেশের সমস্ত যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বোনের সাথে দেখা হয় বছর দুবছরে একবার। সেই একমাত্র যোগাযোগটা রাখে দেশের সাথে। সেই খালাটাও মারা গেছে কয়েক বছর আগে। আর কোন পিছুটান নেই তার। ফুপুদের মধ্যে মাত্র একজনের সাথে যোগাযোগ ছিল, সেই ফুপুও তার সংসার নিয়ে নাতি নাতনি নিয়ে ব্যস্ত। কে কার খোঁজ রাখে।

৫৪ বছর বয়সে এসে পেছনে ফিরে তাকায় রিশাদ। দেশ বলতে সে এখন আমেরিকাকেই বোঝে তার ছেলেমেয়েদের মতোই। বাংলা কথা বলতে পারলেও পড়তে পারে না।

এত বছর পরে এই সময়ে এসে কেন তার মনে পড়ে যাচ্ছে সব। বাবা মা কতো ভালোবাসতো তাকে। তাকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখেছে। অথচ সে বাবা মার কবর দেখতে যায়নি গত বিশ বছর। শেষবার গিয়েছিল ২০৪৩ সালে। এখন দেশে যাওয়া কতো সহজ। প্রনেটে মাত্র দশ মিনিট লাগবে পৌঁছাতে। যদিও খরচ অনেক বেশী। কিন্তু সেই বেশীটা তার এক সপ্তাহের স্যালারিও না। বাবা মাকে দেখার জন্য তার এক সপ্তাহের বেতনও খরচ করতে পারেনি রিশাদ। এটা খুব কষ্ট দিল তাকে। ঠিক এই মুহুর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে সব। এটাকে কি অপরাধবোধ বলে?



এতটা সাফল্য আসবে কখনোই ভাবেনি সে কিংবা তার আমেরিকান পরিবার। কিন্তু তার বাবা ৫০ বছর আগে কি করে ভবিষ্যতবানী করলো যে রিশাদ একদিন মঙ্গলগ্রহে যাবে। মা বলতো সবাই ওটা ঠাট্টা হিসেবেই নিয়েছিল। ঠাট্টা হলেও কথাটা কতো ভারী ছিল এত বছর পর এসে বুঝতে পারছে সে। সেই আমলে মানুষ তো দূরে থাক মানুষবিহীন রকেট যেতেও নাকি ছ মাস লাগতো। আর এখন সাড়ে সাত ঘন্টায় সে পৌছে যাবে মঙ্গলগ্রহে। রিশাদই প্রথম না। আগেও কয়েকজন এসে ঘুরে গেছে। কিন্তু রিশাদের এই যাত্রাটা আগের সবগুলো থেকে ভিন্ন। সে যাচ্ছে এই গ্রহ থেকে মানুষকে ওই গ্রহে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে উৎসাহিত করার বিজ্ঞাপনে। লুসি বলেছিল এটা ছিল নির্বাচনের ভুং ভাং প্রতিশ্রুতি। ক্ষমতায় এলে সব ভুলে যাবে। কিন্তু ভোলেনি প্রেসিডেন্ট। রিশাদকে মনোনীত করেছে পাচ জনের টিমে। দলনেতা হিসেবে। বাকীদের বয়স ত্রিশের মধ্যে। কিন্তু রিশাদকে দেখায় তারো কম। তার বাংলাদেশী শারিরীক গঠনের কারণেই।

দুয়েক মিনিট পরেই ফাইনাল বীপ শোনা যাবে। বাকী চারজন তৈরী। বীপ আসামাত্র ঢুকে যাবে। সবাইকে বিদায় দিচ্ছে। আগামী দুমাস ওরা মঙ্গলেই থাকবে। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে। সব সেরে আসতে হবে। ওই পরীক্ষার রেজাল্টের উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যত মানব বসতির বাস্তবতা।

হঠাৎ তার মাথায় একটা দুর্বুদ্ধি খেলে গেল। এখুনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষুণি। দশ সেকেন্ড ভাবলো। তারপর আরো পাঁচ সেকেন্ড। না, এটা তাকে করতেই হবে। বাবাকে না দেখে সে মঙ্গলে পা দেবে না। যত সর্বনাশই হোক। এই কাজটা, জীবনে প্রথমবারের মতো একটা প্রতারণার আশ্রয় তাকে নিতেই হবে।

বাকী চারজন অভিযাত্রী দেখতে পেল দলনেতার শরীরটা বাঁকা হয়ে মুচড়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে মেঝেতে। মহাকাশের সমস্ত জবরজং পোষাক আশাক সহকারে রিশাদ গড়িয়ে পড়লো স্টীল প্ল্যাটফর্মে। দৌড়ে গিয়ে ওরা তুলতে চাইল। কিন্তু রিশাদের শরীর নড়ছে না। টিভি ক্যামেরায় লাইভ দেখাচ্ছিল। এই দৃশ্যে সারা বিশ্বে উত্তেজনার জোয়ার ছুটে গেল। কি হয়েছে কেউ বুঝছে না। ছোটাছুটি শুরু হয়েছে। স্ট্রেচারে করে বাইরে নিয়ে আসা হলো। ফাইনাল বীপ বেজে থেমে গেল। দরোজা খুলে গেল। কিন্তু কেউ ঢুকলো না। কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট টিভি দেখে মুখ ফুটে বললো, হল্ট! ফ্লাইং স্টেশানে খবর পৌছে গেল পরমুহুর্তেই। অপারেশান লাইভ মার্স, থমকে গেল কিছু সময়ের জন্য।

রিশাদের জ্ঞান ফিরেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সবচেয়ে খ্যাতনামা নভোচারী ফিটনেস সেন্টারে রাখা হয়েছে তাকে। প্রেসিডেন্ট তাকে দেখতে এল ঘন্টাখানেক পরেই। সিকিউরিটি বের হয়ে যাবার পর প্রেসিডেন্ট হিকেন্স তার স্বরূপে বেরিয়ে এল। এই হিকেন্স তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধু এবং লুসির ঘনিষ্ঠতম ফার্স্ট কাজিন। আপন বোনের চেয়েও বেশী আদরের লুসি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পরও তাই তাদের ঘনিষ্ঠতা কমেনি। রিশাদের এই প্রজেক্টের হেড বানাবার কৃতিত্বের পেছনে রিশাদের মেধা কিন্তু তার নামটা জোরালো সুপারিশে এসেছে হিকেন্সের কারণে।

-রিশাদ, কি হয়েছে তোমার?
-দেখলে না, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে গেলাম অজ্ঞান হয়ে?
-ননসেন্স, তুমি এক সেকেন্ড আগেও পুরো ফিট ছিলে, এখন কি হলো তোমার, মতলবটা আমাকে খুলে বলো
-তুমি বিশ্বাস করো না আমাকে?
-আমাকে তুমি ডোবাতে চাও? তার চেয়ে প্রাণে মেরে ফেলো।
-কি বলো হিকেন্স?
-নয়তো কি, এরকম একটা প্রজেক্টে তুমি আগুন ধরিয়ে দিলে?
-আগুন ধরাবো কেন? আমি যাচ্ছি তো। আগামীকাল গেলে পৃথিবীর খুব বিলম্ব হয়ে যাবে?
-যাচ্ছো? তাহলে আজকে কেন এমন করলে? সারা বিশ্বের মিডিয়া আমাদের উপর চোখ রেখেছে জানো তুমি?
-আমাদের এই মুহুর্তের কথাবার্তাও শুনছে ওরা?
-না তা শুনবে না। এটাকে আমি সাংবাদিক থেকে কোয়ারাইন্টাইন করে রেখেছি।
-গুড, এখন শোনো
-বলো
-আমার শেষ একটা উপকার করবে?
-চেষ্টা করবো
-চেষ্টায় চলবে না। কথা দাও। এটা তোমার আমার ডীল। আর কেউ যেন না জানে। তোমার বউ না, আমার বউও না।
-কী এমন সিক্রেট বলতো?
-আমাকে তুমি দুই ঘন্টা সময় আর এক সীটের ছোট্ট একটা প্রনেট দেবে। কথা দিচ্ছি কালকে তোমার প্রজেক্ট সাফল্যজনকভাবে মঙ্গলে পৌঁছাবে।
-আশ্চর্য কথা, কি করতে চাও তুমি?
-তুমি আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগাবে না তো?
-না
-প্রমিজ?
-প্রমিজ।
-আমি একটা ঘন্টা বাংলাদেশে বাবার কবরের পাশে কাটিয়ে আসতে চাই।
-কী সর্বনেশে চাওয়া!!!
-কেন?
-তুমি জানো তুমি কি চাইছ? চাইলে আকাশ থেকে চাঁদটা পেড়ে তোমার হাতে বসিয়ে দেবার চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু এটা একদম অসম্ভব। তুমি পাগল!!!
-না হিকেন্স। আমি অসম্ভব কিছু চাইনি। তুমি চাইলেই পারো।
-না!!!! অসম্ভব!!! আমাকে মেরে ফেললেও এটা করবো না।
-হিকেন্স! তুমি কথা দিয়েছো!
-কথার গুষ্টি মারি আমি। তুমি কোথাও যাচ্ছো না। আমার সারাজীবনের স্বপ্ন তুমি নস্যাত করে দিচ্ছো এক খামখেয়ালী শখের জন্য, আর আমি তোমার কথা রাখবো??? আমাকে এত হাদা মনে হয় তোমার??
-প্লীজ হিকেন্স!
-কোন প্লীজ না। তুমি এখন থেকে কঠোর ওয়াচে থাকবে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এবং এই গ্রহ থেকে রওনা না হওয়া পর্যন্ত। আমি টয়লেটেও ক্যামেরা বসাতে বলে দিচ্ছি। তোমার সমস্ত প্রাইভেসি আবদার বাতিল।
-হিকেন্স!
-শাট আপ!!!!! ইউ ইউ........ড্যাম!! আমি গেলাম এখন!!
-শোনো হিকেন্স
-আমি আর কোন কথা শুনবো না তোমার, তুমি একটা বদ্ধ উন্মাদ!!
-তাইলে আমার শেষ কথাটা শুনে যাও। তোমার এই প্রজেক্টে আমি পেচ্ছাব করে দিলাম এই মুহুর্ত থেকে!!
-কী!!!!????
-শুনে রাখো। আমি এই প্রজেক্টের জন্য দিনের পর দিন বছরের পর বছর নিজেকে তৈরী করছিলাম যে কারণে, এত বছর ভুলে গিয়েছিলাম সেটা। ঠিক প্রনেটের দরোজা খোলার আগ মুহুর্তেই মনে পড়েছে। তুমি কি চাও আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আবেগের জায়গাটাকে না ছুয়ে মঙ্গলগ্রহে যাবো?
-কী সেই কারণ
-এখন তা আর না শুনলেও চলবে তোমার! প্রজেক্ট বাতিল বলে ধরে নাও।
-রিশাদ!! তুমি আমাকে বুঝতে চেষ্টা করো, এটা আমার কতোবড় স্বপ্ন, তুমি এভাবে বাতিল বলতে পারো না।
-তাহলে তুমিও আমার মঙ্গল ভ্রমনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নচারী আমার বাবাকে দেখা থেকে বারণ করতে পারো না।
-তোমার বাবা এটার স্বপ্নচারী?
-আমার বাবা ৫০ বছর আগে আমার মঙ্গলযাত্রা নিয়ে একটা অলৌকিক বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন। আর কেউ বিশ্বাস করেনি। কেবল মা করতো। মা আমাকে বলতো। আমিও কখনো বিশ্বাস করিনি। তবু স্বপ্নটাকে আমি লালন করেছিলাম। সেভাবেই আমার পড়াশোনা চালিয়ে আজ এখানে এসেছি। তুমি চাও আমি ওই স্বপ্নে দেখা মানুষটাকে অবজ্ঞা করি???? তোমাদের দেশকে সেবা করতে গিয়ে গত বিশ বছর আমি বাবাকে দেখতে যাইনি। তবু তুমি আমাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে তোমার ইগো, তোমার প্রটোকল ইত্যাদি ঠিক রাখার জন্য?
-না রিশাদ
-তবে?
-আমাকে একটু ভাবতে দাও
-তোমাকে এই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। যাবো কি যাবো না। দ্বিতীয় কারো পরামর্শে তুমি সিদ্ধান্ত নিলে আমার বিপক্ষে যাবে আমি খুব ভালো করেই জানি।
-আমাকে এতটা চাপ দেয়া কি ঠিক তোমার? আমি তোমার বন্ধু হলেও রাষ্ট্রের জন্য দায়িত্ব আছে না আমার?
-আমার কাছে তোমার রাষ্ট্রের চেয়ে আবার বাবার আবেগটা গুরুত্বপূর্ন। ক্লিয়ার?
-মনে হচ্ছে তুমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর আমি তোমার খানসামা!
-যা ইচ্ছে ভাবো তুমি। কিন্তু আমি এক্ষুনি শুনতে চাই। যেতে দেবে কি দেবে না?
-ঠিক আছে। যাবে তুমি। মাত্র দুঘন্টাই এক সেকেন্ডও বেশী নয়।
-আমি একা যাবো। প্রাইভেট প্রনেটে। কেউ যেন ফলো না করে। হাসপাতালের ছাদের ফ্লাইং প্যানেলে তুমি এনে রাখার ব্যবস্থা করবে ওটা। ওখান থেকেই উড়বো।
-নিরাপত্তার কি হবে। তোমাদের একেকজনের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র বিশাল বাজেট রাখে। তুমি এরকম নিরাপত্তাহীন অবস্থায় দূরদেশে গেলে কোন দুর্ঘটনায় কি করবে?
-দুঘন্টার জন্য নিজের দায়িত্ব নিতে পারবো আমি। তুমি কেবল কানে রিপ্লিটা দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে। যে কোন সমস্যায় আমি তোমার কানে জানিয়ে দেবো। রিপ্লিতে আর কারো আইডি যেন না থাকে। আমি কারো ট্রেস সংকেতে পড়তে চাই না।
-তোমার কথামতোই হবে। কিন্তু তুমি ফিরে আসবে ঠিকসময়ে। কথা দাও।
-তুমি আমার কথা রেখেছো, আমিও রাখবো।

সেই রাতেই রিশাদ উড়াল দিল। দশ মিনিটের পথ। রাত থেকে দিনে আসার পর রোদটা খুব কড়া লাগছে। বাংলাদেশের আকাশে মেঘ আছে। রাডার সিকিউরিটি লেভেলের উপর দিয়েই উড়ে এসেছে সে। রেঞ্জের মধ্যে থাকলেও সমস্যা নাই। এই প্রনেটে সব ধরনের ট্রাকিং ডিভাইস জ্যাম করা আছে। উপর থেকে নির্জন একটা জায়গা বের করলো। কবরস্থান এমনিতেই নির্জন জায়গা। তবু সরাসরি বাবার কবরে না নেমে পাশের একটা জঙ্গলে নামলো। ওখানে প্রনেটকে লুকিয়ে রেখে, পোষাক বদলে পায়ে হেঁটে কবরের দিকে রওনা হলো সে। পথে এক বুড়োমতন লোকের সাথে দেখা। রিশাদকে দেখে চিনলো না। কিন্তু গ্রামের মানুষের কৌতুহল বেশী। তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন।

-আবুল হোসেনের কবর ওইখানে ছিল না?
-কোন আবুল হোসেন?
-সিরাজ হোসেনের ছেলে আবুল হোসেন
-ওওওও পুব পাড়ার আবুল হোসেন? তার কবর তো বহুত আগেই হাপিস
-মানে কি
-আরে বাপজি, এত বছর পর কি কবর থাকে? সে মারা গেছে কোন ৫০ বছর আগে। আমি বলে চিনছি তারে, আর কেউ তো চিনবেও না। আপনি তার কে হন
-আমি তার ছেলে
-ওওও আপনি কি শহর থেকে আসছেন?
-জী শহর থেকে
-ওই জঙ্গলে কিল্লাই গেছিলা। ওদিকে তো কবর নাই রাস্তাও নাই
-ওই জঙ্গলে পাখি দেখতে গেছিলাম
-ওওওও বুঝছি। আইসো আবুল হোসেনের কবরের চিহ্ন দেখাই।
-আচ্ছা
-ওই যে একটা বাদিগাছ, ওইটা তার বাপের, মানে আপনার দাদার কবর। তার এপাশে দুইটা বেড়া, তার পারে আরেকটা পিলার। ওই পিলারের আশেপাশে তার কবর আছিল। এতদিন পর বলা মুশকিল।

রিশাদ গুটি গুটি পায়ে ওই কবরের কাছে গেল। দোয়াদরুদ কিছু জানে না সে। ছেলেবেলায় কি শিখেছে মনে নেই। ধর্মের সাথে কোন যোগাযোগ নেই বহুযুগ। তবু সে বিরল এক কান্নায় প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাটু গেড়ে বসে গেল পিলারের গোড়ায়। কাঁদছে সে অঝোর ধারায়। এই তার ভুলে যাওয়া বাবার কবর। যে বাবা তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল বহুযুগ আগে। যে বাবাকে সে ভুলে বিদেশে গিয়ে সংসার পেতেছে। বাবা কি তাকে ক্ষমা করবে? বাবা, বাবা বাবা!! আমি এখন কি করবো, কোথায় যাবো বাবা!! আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা। তুমি আমাকে ক্ষমা করো বাবা। তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে আমি যে তোমাকেই ভুলে গিয়েছিলাম বাবা!

রিশাদের কান্নার শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়। বুড়োটা দূর থেকে দেখতে পায়, লোকটা পিলারের পাশে বসে ঝুঁকে ঝুঁকে কাঁপছে। চৈত্রের বাতাস বইছে উল্টোপাল্টা। আকাশ কালো হয়ে আসছে দ্রুত। ঝড় নামতে পারে যে কোন সময়। রিশাদ ভুলে যায় তার সময় মাত্র দুঘন্টা। আর আধঘন্টা পরই শেষ। কানের রিপ্লিতে ডাক দিতে শুরু করেছে হিকেন্সের গলা। রিশাদ তবু নড়তে চাইলো না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে একটা রাত একটা দিন সে চুপ করে কাটিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এখন বড় অসময়। আবার আসতে হবে তাকে। সে টের পায়, এই মাটিতেই তার নাড়ি পোতা। মায়ের কবর এখানে হয়নি। মাকে খালা তার বাবার পাশেই সমাহিত করেছিল। এখন খালাও নাই। মামাদের কারো সাথে যোগাযোগ নেই। কিভাবে মাকে খুঁজে পাবে।

এত কম সময়ে তার কোথাও যাওয়া হবে না আর। উঠলো সে ক্লান্ত শরীর নিয়ে। বহুকালের ক্লান্তি তার যেন। আবার ফিরে আসবে সে। এই দেশেই ফিরে আসবে। এই মাটিতে। মা বাবা দুজনকে ছেড়ে সে কতোকাল কাটিয়েছে বিদেশ বিভুইতে। মঙ্গল থেকে ফিরে সে চাকরীতে ইস্তফা দেবে। এই বাংলাদেশেই তার জীবনের শেষটুকু কাটাবে।

রিপ্লিতে বীপ শব্দ এলো। হিকেন্স ডাক দিচ্ছে। উঠতে শুরু করলো সে ভূমি থেকে আকাশে। ক্যালিফোর্নিয়া সময় রাত তিনটায় সে হাসপাতালে প্রবেশ করলো আবার। কেউ টের পায়নি সে ছাদে হাওয়া খেতে গিয়ে পৃথিবীর দিবাভাগটা ঘুরে এসেছে।

No comments: