২৬শে মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া একটা অজানা কাহিনী শেয়ার করার জন্যই লিখছি। একটু ভুমিকা দিতে হচ্ছে।
স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে ত্যানা প্যাচানীর তিন দশক পেরিয়ে গেছে। সর্বশেষ এবং অভিনব ত্যানাটি প্যাচিয়েছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ ২০০৬ সালের প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায়। তাতে তিনি ২৬শে মার্চের বদলে নতুন একটা স্বাধীনতা দিবস আবিষ্কার করেছিলেন। মক্সুদিয় ত্যানাটা ২০১০ সালে ষষ্ঠ পাণ্ডবের মকসুদনামায় আলোচিত হয়েছিল সচলায়তনে। গত বছর লেখাটি আরো সংযোজিত অংশ নিয়ে 'অরণ্য বেতার' নামে প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশনী।
বইটার প্রথম কয়েক পাতা পড়ার পর পাঠকের জানা হয়ে যাবে মকসুদ সাহেবের এই নতুন দর্শনের উৎস কি। বইয়ের শুরুতে তিনি রাও ফরমান আলীর বইয়ের অংশ কোট করে পাঠকদের নিশ্চিত করেন যে শেখ মুজিব যে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিদের হাতে গ্রেফতারের আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন সে কথা রাও ফরমান আলী তাঁর বইয়ে লেখেন নি(পৃষ্ঠা-২০)। তাই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়েছেন এই কথায় তিনি বিশ্বাসী নন। স্বাধীনতার ঘোষনা বিষয়ক একটা ব্যাপারে রাও ফরমান আলীর মতো পাকি নরপশুর বই থেকে সিদ্ধান্ত দেন, তাঁকে বুদ্ধিবেশ্যা ছাড়া আর কি বলা যায়?
আবুল মকসুদ বলেছেন "যারা ২৬-২৭ মার্চে চট্টগ্রাম বেতার থেকে ওই ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা সকলেই অনধিকারচর্চা করেছেন, সীমা লংঘন করেছেন, যা স্রেফ মারাত্মক অপরাধের পর্যায়ে পড়ে"(পৃষ্ঠা-২৩)
আমি ব্যক্তিগতভাবে একাত্তরে সেরকম অপরাধীর সন্ধান করি সুযোগ পেলেই। খুঁজতে গিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারে সেরকম এক অখ্যাত অপরাধীর খোঁজ পেলাম চট্টগ্রামের সাহিত্যিক মাহবুবুল আলমের 'বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত' বইটিতে। 'দৈনিক স্বাধীনতা' পত্রিকার ৯ মার্চ ১৯৭২ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রায় সম্পূর্ন লেখাটাই নীচে দেয়া হলো আগ্রহী পাঠকদের জন্য।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গোড়াপত্তনের কাহিনী
এম এ হালিম
২৫শে মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় খবর এলো মুজিব ইয়াহিয়া ভুট্টো আলোচনা সফল হয়নি। মনে ভয় হলো, এবার দেশের ভাগ্যে কি রয়েছে। তবে মাইকে প্রচারিত হতে শুনেছি গোলমালের কথা। ঘাবড়ে গেলাম। আওয়ামীলীগ নেতাদের খুঁজবার চেষ্টা করলাম। এমপিএ ইছহাক সাহেবকে পেলাম টিএন্ডটি স্টোরের ওখানে। অনেককে তিনি অভয় দিচ্ছেন। হঠাৎ খবর এলো হালিশহর ইপিআর ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আসছে। উনি চলে গেলেন সেসব বুঝে নেবার জন্য। যাবার সময় বলে গেলেন কিছু দরকার হলে ওনার খোঁজ করার জন্য।
তখন ভোর ৫টা ২৬মার্চ ১৯৭১। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে। সবার মুখে একই কথা, একই প্রশ্ন। কি হবে? ঢাকা বেতার কেন্দ্র বন্ধ। চট্টগ্রামসহ অন্যনহ বেতারের সাড়াশব্দ নেই। সার্বিক খবরের জন্য আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রে গেলাম। তখন বেলা প্রায় সাড়ে সাতটা। দেখলাম কজন ইপিআর ও পুলিশ পাহারারত।একজনকে জিজ্ঞেস করলাম বেতারের কাজ চলবে কিনা। বললেন- চালাবে কে? কর্মীরা সব এসেছে, কিন্তু বলার তো কেউ নেই। বেতার ভবনে ঢোকার চেষ্টা না করে সোজাসুজি চলে এলাম আগ্রাবাদস্থিত মোজাফফর সাহেবের দোকান জেকস-এ। টেলিফোন করলাম বেতার কেন্দ্রে, উত্তরে ঢাকার কোন খবর নেই বললো।
চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ। ভোর রাত থেকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করা হয়েছে। শোনা গেল হালিশহর ইপিআর ক্যাম্পে যুদ্ধ চলছে। আমাদের আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীতে গোলাগুলি আসতে লাগলো। ভয়ে সবাই কম্পিত। ইতিমধ্যে ঢাকা বেতার বেজে উঠলো। খবর এলো অপেক্ষা করুন, একটু পরেই খবর বলছি। একটু পরে খবর হলো, সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বুঝতে বাকী রইল না এটা কাদের খবর। এতক্ষণ যারা দু এক কথা বুক ফুলিয়ে বলার চেষ্টা করছিল তাদের বুকে কাপুনি শুরু হয়ে গেলো।
এমন সময় আগ্রাবাদ কলোনী রেশন শপের মালিক গোলাম মাওলা ও মালেক নামের বরিশালের এক বন্ধু শেখ সাহেবের নামে প্রেরিত ইংরেজীতে একটা বার্তা নিয়ে আমাদের ওখানে হাজির হলেন। বেলা তখন আটটা।সবাই জড়ো হয়ে গেল। পরে কলোনী এসোসিয়েশানের সেক্রেটারী শফিউদ্দিন সাহেব বার্তাটি বাংলায় অনুবাদ করে কলোনী মসজিদের মাইক যোগে প্রচার করলেন। ওকে সাহায্য করছেন আমদানী রপ্তানী অফিসের মোজাম্মেল ভাই। বার্তার মর্মকথা হলো, “ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানায় পাকিস্তান বাহিনী অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে হাজার হাজার বাঙালীসহ ইবিআর, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর লোকদের নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করেছে। তোমরা যে যে অবস্থায় পারো রুখে দাড়াও।”
ঢাকা বেতার যখন পাক সেনাদের নিয়ন্ত্রনে চলে গেছে তখন অন্যন্য বেতারগুলো তাদের অনুসরণ করতে পারে। বিশ্বে যে সব আন্দোলন হয়েছে তাতে দেখা যায় বিপ্লবীরা আগেই বেতার কেন্দ্র নিয়ন্ত্রনাধীন রেখেছে। কারণ, কেবল বেতার মারফত বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়া সহজ এবং তা কার্যকরী হয়।মনে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে এবার বাংলা স্বাধীন হবেই।....৭ই মার্চের ভাষনের কথা মনে পড়লো। বঙ্গবন্ধু বলছিলেন প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। আমার মনে প্রেরণা জাগলো। ভাবলাম যে করে হোক বেতার কেন্দ্র চালু রাখা দরকার।
তারপর গেলাম এম এ হান্নান সাহেবের বাসায়। তাঁকে পেলাম বাসার কাছেই। কর্মী পরিবেষ্টিত হয়েএ আলাপ আলোচনা করছিলেন। ওনাকে বিষয়টা সংক্ষেপে বলাতে উনি বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে উপলব্ধি করলেন। আমার প্রস্তাব নিয়ে আলাপ করলাম সবার সাথে। এই অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে যদি বেতার খোলার ব্যাপারে সমর্থ হই। তাহলে জনাব হান্নান সরাসরি বেতারে স্বাধীনতা ঘোষনার ভার নেবেন। হান্নান সাহেব ওয়াদা করলেন এক ঘন্টার মধ্যে আগ্রাবাদ বেতার ভবনে পৌছাবেন।
চিন্তিত মনে পৌছলাম আগ্রাবাদ বেতার ভবনে। হায় কপাল। বেতার ভবন খালি। খোঁজ নিয়ে জানলাম ঢাকা বেতারের ঘোষণার পরপরই বেতার কর্মীরা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বেতার ভবন ছেড়ে নিজ নিজ জায়গায় চলে গেছেন। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসলো। দুএকজনের সাথে পরিচয় থাকলেও অনেকেরই বাসা চিনি না। এই অবস্থায় খোঁজ করে আবার একত্র করা সম্ভব হবে না। হান্নান সাহেব ও অন্যন্য নেতাদের কি জবাব দেবো। এতক্ষণ বড় গলায় বলে আসলাম এ কাজের ভার আমার।
খানিক পর একজনে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। কাছে এসে বললো, হান্নান সাহেব বেতার ভবনে পৌছেছেন কিছু বলার জন্য। অথচ এখন দেখছি বেতার বন্ধ। মাথায় বাজ পড়লো। সঙ্গী শুক্কুর ভাই বললেন, রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ার মির্জা নাসির সাহেবকে বলে দেখতে পারেন। মির্জা নাসির সাহেব আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর ডি-তে থাকেন। মির্জা সাহেবের সাথে দেখা করে সব খুলে বললাম। ইতিমধ্যে তার বাসার সামনে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেল।সবার অনুরোধ আপনি আমাদের সাহায্য করুন। তখন বেলা প্রায় বারোটা। ইতিমধ্যে স্টেট ব্যাংক কলোনী থেকে একখানা কালো রঙের গাড়িতে করে কয়জন আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মীর্জা সাহবের বাসার সামনে ভীড় দেখে একজন গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লেন। আগ্রহ সহকারে ব্যাপার জানতে চাইলেন। ভদ্রলোকের নাম এম এ কাসেম। উনি কোন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। উনি বললেন ওনার গাড়িতে করে বেতার ভবনে পৌছে দেবেন। মীর্জা সাহেব বললেন, “কিছুক্ষণ আগে আমার সব বেতার কর্মীরা এসে বলে গেল জীবনের ঝুকি নিয়ে তারা কোন কাজ করতে পারবে না।” আমি বললাম, “আপনি আমাদের সাথে চলুন, তাদেরকেও আমরা নিয়ে আসবো।”
ইতিমধ্যে ওর বাসার সামনে জনতার হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। উপস্থিত সবাই উত্তেজিত হয়ে বললো যে, “মীর্জা সাহেব যে পর্যন্ত যাবেন না, আমরা ততক্ষণ এ স্থান ত্যাগ করবো না।” অবশেষে মীর্জা সাহেব বাধ্য হয়ে আমাদের সাথে বেরিয়ে পড়লেন।গিয়ে আমরা কাসেম সাহেবের গাড়িতে উঠলাম। একটু যেতেই উনি বললেন, এখানেই থাকেন আমাদের আরেক ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সোবহান সাহেব। গাড়ি থামলো সোবহান সাহেবের বাসার সামনে। মীর্জা সাহেব আমি ও কাসেম সোবহান সাহেবের বাসায় উঠলাম। একটু পরেই সোবহান সাহেবকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।
সোবহান সাহেবকে ইতিপূর্বে চিনতাম না তবে নাম শুনেছি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় উনি আওয়ামীলীগের নির্দেশক্রমে বেতার কেন্দ্র চালনার কাজে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছেন। অনেকেরই মুখে ওর প্রশংসা শুনেছি। পরে জানতে পারলাম যে বেলা দশটার পরে যে সব কর্মী বেতার ভবন ছেড়ে এসেছিলেন তাদেরকে নিয়ে সোবহান সাহেব মির্জা সাহেবের বাসায় সিদ্ধান্ত নেন যে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে কোন লোক উদ্যোগী হয়ে আসলে বেতার কর্মীরা সর্বপ্রকারের সহযোগীতা করবেন। গাড়ি পৌছুলো বেতার ভবনে। ইতিপূর্বে একখানা জীপে করে জনাব এম এ হান্নান কয়জন আওয়ামীলীগ কর্মীসহ আগ্রাবাদ বেতার ভবনে পৌছেছিলেন। মির্জা সাহেব সোবহান সাহেবকে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনে যাওয়ার জন্য বললে সোবহান সাহেব বলেন, কালুরঘাট থেকেই সবকিছু করা যাবে, দুজন দুই খানে থাকার কোন দরকার নাই। পরে দুইজনেই কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবনে যাবার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এই সময় হান্নান সাহেব বেতার ভবনে অবস্থান করছিলেন। ওকে গাড়িতে নিয়ে ছুটলাম কালুরঘাট। দুখানা গাড়ি চললো দ্রুতবেগে। জনাব কাসেম ওর গাড়ি দ্বারা যে উপকার করেছেন তা চিরদিন মনে থাকবে।
আমাদের গাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে ডাঃ খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছালো।। ড্রাইভার বললো, গাড়ির তৈল শেষ হয়ে গেছে। ওখানকার পোট্রোল পাম্প লাফার্জ কর্পোরেশান থেকে তৈল নেয়া হলো।হান্নান সাহেব এর ব্যবস্থা করেছিলেন। একটু দূরে যেতেই সোবহান সাহেব বললেন, দেলোয়ার হোসেন, বেতার ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাসাটা চিনে রাখুন, সময়মতো কাজে দেবে। উনি থাকেন কাপাসগোলায়। দেলোয়ার সাহেব বাসায় ছিলেন। মনে হচ্ছিল তিনি এই কাজের জন্যই তৈরী হচ্ছিলেন। অবশেষে গাড়ি পৌছালো কালুরঘাট ট্রান্সমিটার কেন্দ্রে।
সেখানে তখন একমাত্র আমিনুর রহমান পাহারাদার বাদে আর কোন রেডিও স্টাফ ছিল না। সে তখন কাজ বন্ধ করে দাড়িয়েছিল। সেখানে কয়েকজন পুলিশ আর ইপিআর পাহারারত ছিল। মির্জা সাহেব সোবহান সাহেব আর দেলোয়ার সাহেব একযোগে ট্রান্সমিটার চালানোর কাজে লেগে গেলেন। আর হান্নান সাহেব কয়েক সহকর্মী সহ স্ক্রীপ্ট লেখার কাজে লেগে গেলেন। অল্পক্ষনের মধ্যে বেতার চালু হলো। এক ছাত্রবন্ধু প্রথম ঘোষনা করলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। দেশবাসীকে তিনি অনুরোধ করলেন, আপনারা অপেক্ষা করুন এখুনি আমাদের চট্টলবীর এম এ হান্নান সাহেব আপনাদের উদ্দেশ্যে ভাষন দেবেন। এইভাবে কয়েকবার ঘোষণা করা হলো। বেলা ২-১০মিনিট। হান্নান সাহেব বেতারের সামনে দাড়িয়ে ঘোষণা করলেন এদেশের স্বাধীনতা।
নোটঃ এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল চট্টগ্রামের প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী (যিনি লিখেছিলেন একুশের প্রথম কবিতা, 'কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি') সম্পাদিত দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার ৯ মার্চ ১৯৭২ সংখ্যায়। লেখকঃ এম এ হালিম, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনীর বাসিন্দা, তৎকালীন কাস্টমস প্রিভেন্টিভ অফিসার'
পাঠক, এই হলো এম এ হান্নানের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠে একজন সাধারণ মানুষের ভুমিকা। এম এ হান্নানের ওই ঘোষণাটা ২৬শে মার্চ বেলা ২.১০ মিনিটে প্রচার হয়েছিল ৫/৭ মিনিটের সংক্ষিপ্ত এক অধিবেশনে। এই সময়ে বেতারের নিয়মিত কর্মীদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। মূল ভুমিকায় যারা ছিলেন তাদের সবাই অপরিচিত মুখ। তবে বেলাল মোহাম্মদের উদ্যোগে ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আবারো দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন এম এ হান্নান। এটাই সর্বত্র আলোচিত হয়। কারণ সেই সময় উপস্থিত ছিলেন আলোচিত পরিচিত ১০ বেতার কর্মী। এদের সবাই মকসুদের চোখে অপরাধী হলেও জনাব মকসুদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনাকারী হিসেবে কৃতিত্ব দিতে সম্মত হন চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীণ রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ার মির্জা নাসিরুদ্দিনকে মধ্যে যাকে আক্ষরিক অর্থেই সিজিএস কলোনীর বাসা থেকে জোর করে বের করে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ট্রান্সমিটার চালু করার জন্য। পরবর্তী সময়ে যিনি পাকিস্তান সরকারের অনুগত থেকে কাজ করেছেন।
মকসুদ সাহেব এমনকি ক্যাপ্টেন রফিকের মধ্যেও ততটা দেশপ্রেম পান না যিনি সত্যিকার অর্থে প্রথম বিদ্রোহ করেছিলেন পাকিদের বিরুদ্ধে। ২৫শে মার্চ রাতে যার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন। তিনি দেশপ্রেম খুঁজে পান মেজর জিয়াতে যাকে প্রায় জোর করে মুক্তিযুদ্ধে সামিল করতে হয়েছিল।
জনাব মকসুদ, ৪১ পৃষ্ঠায় আপনার 'উই রিভোল্ট' শিরোনামের জিয়া তোষণ দেখে আমার একচোট হাসি পেয়েছিল। কারণ সব জেনেশুনে সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস করার জন্য যাবার সময় আগ্রাবাদে ক্যাপ্টেন খালেকের কাছে বাধা পেয়ে জিয়া 'উই রিভোল্ট' বললেন। তারপর কোথায় গেলেন তিনি? ২৪ ঘন্টা আগেও রেলওয়ের পাহাড়ে ক্যাপ্টেন রফিকের সাথে সংক্ষিপ্ত মিটিং এ কোন রকম আক্রমন আশংকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানীদের উপর বিশ্বাস রেখে।
যে সময়ে শহরের মধ্যে ক্যাপ্টেন রফিকের ইপিআর সামান্য শক্তি নিয়ে প্রাণপন যুদ্ধ করে যাচ্ছিল আর মেজর জিয়া 'উই রিভোল্ট' বলে সবচেএ শক্তিশালী ৮ম রেজিমেন্ট নিয়ে কর্নফুলী নদী পার হয়ে বোয়ালখালী পটিয়ার নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিলেন। শুধু তাই না, কাপ্তাই থেকে আগত ইপিআর দলকে শহরে যেতে না দিয়ে কালুরঘাট আটকে রাখেন। ইতিহাস বলে ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ২৫শে মার্চ ক্যাপ্টেন রফিকের আহবানে সাড়া দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে পাকিস্তানীরা এত সহজে এতগুলো বাঙালী সৈনিকের প্রাণ নিতে পারতো না। এত দ্রুত শহরের পতন ঘটতো না।
যে মেজর জিয়াকে ইনিয়ে বিনিয়ে মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ সৈনিক বানাবার চেষ্টা করেছেন আপনি সেই মেজর জিয়ার সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সেদিন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে হাজারের উপর বাঙালী সৈনিক এবং তাঁদের অফিসারকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের হাতে। যার মধ্যে ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবচেয়ে সিনিয়র বাঙালী অফিসার লে কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরী। জিয়া নন, এই কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরীরই হবার কথা ছিল চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সৈনিকদের নেতা। তার উদ্যোগেই আরো এক সপ্তাহ আগে এম আর সিদ্দিকীর বাসায় বিদ্রোহের ব্যাপারে বৈঠক হয় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিদের সাথে। আপনার গবেষণা এসবে আলো ফেলতে পারেনি, কারণ আপনার গবেষণার টর্চলাইট রাও ফরমান আলীদের হাতে।
জনাব মকসুদ, আপনার 'অরণ্য বেতার' পাঠ করার পর প্রাথমিক অনুভুতি আপনার ডান গন্ডে বামহাতের একটা অসৌজন্য ক্রিয়া। আপনার ধারণাই নেই আপনার বইয়ের কিছু অংশ মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে কতটা অপমান করেছে, হেয় করেছে।
No comments:
Post a Comment