Sunday, January 14, 2018

: : সাহিত্যসখা : : অপরিচিত পৃথিবীর কথা : : [ক্রমশ:]

এক.
আমার সাহিত্য জীবন বৈচিত্রময়। ছাত্র জীবনে আমার সাথে সাহিত্যের যোগাযোগ এতটা ঘনিষ্ট ছিল না। চাকরীজীবনে এসে সাহিত্য আমাকে খুঁজে পেয়েছে। আগে আমি সাহিত্য খুঁজে বেড়াতাম, চাকরী জীবনে সাহিত্য আমাকে খোঁজে। তখন আমার অসময়, তবু আমার পিছু নিয়েছিল সাহিত্যেরা। নানামুখী সাহিত্য আমাকে আকৃষ্ট করেছে। আমার সবচেয়ে পুরোনো সম্পর্ক কবিতার সাথে। ঠিক কখন থেকে আমি কবিতা ভালোবাসতে শুরু করি মনে নেই। তবে সালটা ১৯৮৭ কিংবা তার আশেপাশেই হবে। বয়স তখন আমার উনিশ বছর। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে। দীর্ঘসময় কবিতার মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকার পর একটা ধাক্কায় কবিতার কাছ থেকে ছিটকে পড়ি ১৯৯৭ সালে। তখন আমার চাকরীজীবন। জীবন সংগ্রামে আমি নিজেকে নিয়ে মগ্ন। তবু এর মধ্যে একদিন আমার নাটকের সাথে যোগাযোগ হয়ে গেল ২০০২ থেকে। কী অসাধারণ নাট্যজগত। আগে কখনো এভাবে নাটকের সাথে যুক্ত ছিলাম না। চাকরীর ব্যস্ততার মধ্যেও নাটক আমাকে আপ্লুত করে রেখেছিল। কবিতার কথা তখন ভুলেই গিয়েছি প্রায়। কিন্তু নাটকের সাথে দুবছর যাবার আগেই উপন্যাস আমাকে টানতে থাকে। ২০০৩ সালে উপন্যাস আমাকে এতখানি আপ্লুত করলো যে নাটকের প্রতি ভালোবাসা আমার কাছে অতীত হয়ে গেল চট করে। উপন্যাসের সাথে দীর্ঘমেয়াদী সময়ের যাত্রা। তবু কখনো কখনো উপন্যাসে একটু বিরক্তি আসতে থাকে। সেরকম সময়ে ২০০৫ সালে ছোটগল্পের সাথে যোগাযোগ ঘটলো। গল্প পড়তে ভালোই লাগে। বেশী সময় না, কিন্তু চট করে একটা পাঠ হয়ে যায়। বেশ লাগছে। নাটক, উপন্যাস, গল্প নিয়ে বেশ চলছিল। একসময় সবকিছুর প্রতি একটু নিরাসক্ত। ক্যারিয়ারে নতুন উন্নতির ঝোঁক। সেই সময় ২০০৯ সালে এসে প্রবন্ধ পড়া এবং লেখার ঝোঁক আসলো। লিখতে লিখতে প্রবন্ধের প্রতি এমন একটা মুগ্ধতা ভর করলো আমি উপন্যাস, গল্প, নাটক সব বাদ দিয়ে কেবল প্রবন্ধ নিয়ে পড়ে থাকলাম। প্রবন্ধের সাথে আমার দার্শনিক যোগাযোগ। আমার আত্মার খোরাক যেন আসতে থাকলো প্রবন্ধ থেকে। মাসের পর মাস দিনরাত আমার কখন কেটে যায় প্রবন্ধের ছায়ায় আমি টেরও পাই না। এমনকি চাকরীর প্রতি আমার মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। প্রবন্ধ আমাকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ করেছে। সাহিত্যে আমি যত সারবস্তুর সন্ধান পেয়েছি তার মধ্যে প্রবন্ধ হলো সবার সেরা। কোন এক অদ্ভুত কারণে প্রবন্ধের সাথে যখন আমার যাত্রা শুরু হলো তখন কোত্থেকে যেন কবিতা এসে ভর করলো আবার। ২০১০ থেকে একটু একটু করে কবিতা পড়া শুরু করি আবার। ২০১১ থেকে কবিতাও প্রবন্ধের সাথে ঘন হয়ে চেপে বসতে থাকে। তবু প্রবন্ধ এগিয়ে থাকে। ২০১৭ সালে এসে আমি আবিষ্কার করি আমার চারপাশ ঘিরে আছে প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প, কবিতা, নাটক। এদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। আমাকে অনেক দিয়েছে এই সাহিত্যসম্ভার। বিনিময়ে আমি কোন সাহিত্য রচনা করতে পারিনি। কিন্তু এর ফাঁকে রচনা করতে শুরু করেছি ইতিহাস। ইতিহাসের পাশাপাশি কিছু গল্প হয়েছে, কিছু প্রবন্ধও। উপন্যাস এখনো মাঝপথে। নাটকে আগ্রহ নেই। কবিতা এখন একটু গভীর। আমি আগের চেয়ে কবিতাকে আরো গভীরভাবে বুঝি। আসলে একেক সময়ে একেক রকমের সাহিত্য ভালো লাগে। আবার সবকিছু একসাথে ভাল লাগে না। ইতিহাসে ঝোঁকটা অনেক বেড়েছে। তার পাশাপাশি যতদিন সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক থাকবে, ততদিন এগুলো আমার চারপাশে থাকবে। আগ্রহ মরে গেলে সব তালাবদ্ধ করে চলে আসবো। কোন একদিন সবকিছুর প্রতি আগ্রহ উঠে যেতে পারে।

দুই.
প্রবন্ধের প্রতি ঝোঁক বাড়ার পর থেকে কবিতার সাথে দূরত্বের সূত্রপাত। অথচ একসময় কবিতার সঙ্গ না পেলে আমার এক দিনও কাটতো না। প্রবন্ধের প্রতি আমার ঝোঁক আছে, কিন্তু আবেগ নেই। কবিতার প্রতি আমার ঝোঁক নেই, কিন্তু কবিতাই আমার আবেগ ধারণ করতো। কবিতা আমাকে বুঝতো, আমার কাছে আসতো। কবিতা আমাকে কখনো ছেড়ে যায়নি, আমিই কবিতাকে দূরে ঠেলেছি। বুকশেলফে সারিসারি বই হয়ে কবিতা নিঃশব্দ অভিমানে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি কবিতার দিকে ফিরেও তাকাই না। কী অদ্ভুত মানুষের জীবন। একসময় কবিতাকে কাছে পাওয়ার জন্য কত দুর্মর আবেগ কাজ করতো, আর এখন সব গল্প হয়ে গেছে। প্রবন্ধের সাথে আমার কোন আবেগের সম্পর্ক নেই। প্রবন্ধ আমার কাজের জায়গা। আমার প্রতিদিন  কয়েক ঘন্টা প্রবন্ধের সাথে কাটাতে হয়। প্রায় নিয়মের মতো হয়ে গেছে। এমন কিছু ছুটির দিনেও প্রবন্ধের কাছ থেকে ছুটি নেই। আমার সাহিত্যজীবন প্রবন্ধময় হয়ে গেছে। 

তিন.
মাঝে মাঝে সকল সাহিত্যসখা আমার অপরিচিত পৃথিবী। সবকিছুর পরিপূর্ণতা নিয়েও আমি একা। নিতান্তই একা। জীবন যেমন। সব সফলতার চুড়ায় উঠে আমি মূলত একজন নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী।

চার.
যাকে খুব ভালোবাসি, তাকেও প্রতিদিন একরকম ভালোবাসা যায় না। মাঝে মাঝে ভালোবাসাও ছুটি চায়, বিরতি চায়। বিরতি পেলে ভালোবাসা নতুন করে ডালপালা মেলার সুযোগ পায়। একনাগাড়ে ভালোবাসতে বাসতে দমবদ্ধ হয়ে পড়ার পর হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। মাঝে মাঝে বিরহকাল ভালো। দূরে গিয়ে ফিরে আসার সুযোগ থাকা ভালোবাসার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখার জন্য মাঝে মাঝে দূরে সরে থাকা ভালো। দূর থেকে চেনা ভালোবাসাকে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়। নতুনত্ব না থাকলে ভালোবাসায় আনন্দ থাকে না। একই মানুষকে অনেকদিন ভালোবাসার একমাত্র উপায় হলো অভিনবত্ব। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভালোবাসার পদ্ধতি, নতুন দৃষ্টিকোন থেকে চেনা মানুষকে আবিষ্কার করার মধ্যে ভালোবাসার পুনরাবৃত্তি ঘটে নতুন নতুন উপায়ে। একই মানুষের সাথে সারাজীবন আনন্দে কাটাতে হলে বৈচিত্র্যের সন্ধান করে যেতে হবে। বৈচিত্র আর ব্যতিক্রমই মানুষের জীবনের আনন্দের উৎস। প্রতিদিন ভালোবাসা ভালো নয়। মাঝে মাঝে ভালোবাসার ছুটি নেয়া উচিত। একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য এই ছুটির কোন বিকল্প নেই।

আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে এই কথাগুলো প্রকাশ্যে বলার অর্থ হলো আত্মহত্যা। আপনি খুন হয়ে যাবেন নয়তো আপনার প্রেম খুন হয়ে যাবে। আপনি কিছু না বলেই নিঃশব্দে নিজ দায়িত্বে দূরে সরে থাকার অজুহাত খুঁজে বের করবেন। দেখবেন সুখ আপনাকে ঘিরে আছে সারা জীবন। দেখবেন, ভালোবাসা আপনাকে ঘিরে আছে সব সময়। মাঝে মাঝে ছুটি দেন। ছুটি নেন। অজুহাত খুঁজে বের করুন। সুখী হবার জন্য আর কোন ভালো বিকল্প নেই।

He looked at her as a man looks at a faded flower he has plucked, in which he can barely recognize the beauty that had made him pluck and destroy it.[Anna Karenina, Leo Tolstoy, p.248]
মেয়েটিকে সে ততক্ষণই ভালোবাসবে যতক্ষণ সে তার কাছে পুরোপুরি ধরা দেবে না। যখনই সে ধরা দেবে তখনই তার প্রেমের মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে। গাছ থেকে ছিড়ে নেয়া ফুলকে মানুষ যতক্ষণ ভালোবাসে, সবটুকু প্রেম বিলিয়ে দেয়া মেয়েটিকেও সে ততক্ষণ ভালোবাসবে। পাওয়া হয়ে যাবার পর তাকে ছুড়ে ফেলে দেবে, যেমন করে গাছ থেকে ছিড়ে নেয়া ফুলকে ছুড়ে দেয় মলিন হয়ে যাবার পর। গাছে ফুটে থাকা ফুলের চেয়ে হাতে ধরা ফুলের মূল্য চিরকালই কম। প্রিয় প্রেম তাই অধরা থাকাই ভালো। হাতে নয়, গাছে থাকুক ফুল।

ভ্রনস্কি ভাবছে - আমি যদি তোমাকে না পেতাম, তাহলে আরো বেশিকাল ভালোবাসতে পারতাম। তুমি যতদিন আমার কাছে ধরা দাওনি, আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবেসেছিলাম।
আমি ভাবছি - তোমাকে আমি এখনো ভালোবাসি, কারণ তুমি আমার কাছে আসোনি। আমিও তোমাকে কাছে পেতে চাইনি। আমরা নিজেরা যে দূরত্ব বজায় রেখেছি সেটাই আমাদের প্রেমকে টিকিয়ে রেখেছে। তুমি যেদিন কাছে আসবে, সেদিন আমাদের সব শেষ। তোমার সাথে আমার দূরত্বই প্রেম। বিরহই ভালোবাসা। তোমাকে না পেয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই। তোমাকে পাইনি বলে আরো বেশি করে ভালোবাসি।

-তাই, তাই এসব কবিতার কথা, সাহিত্যের কথা তোমার এত প্রিয়
-এই সাহিত্য আমাকে জীবনকে বুঝতে শিখিয়েছে, তোমাকে ভালোবাসতে দিয়েছে।