Wednesday, November 25, 2009

অমূল্য মাষ্টারের বিয়েটা আমাদের কখনোই খাওয়া হয়নি

অমূল্য মাষ্টারকে বহুদিন পর মনে পড়লো।

ব্যাপক সিনেমা পাগল অমূল্যচন্দ্র ম্যানোলা কোম্পানীর চাকরীর পাশাপাশি টিউশানিও করতো কয়টা। তার মধ্যে একটা আমাদের বাসা। তরুন অকৃতদার এই লোক 'অমূল্য মাষ্টার' হিসেবে পরিচিত ছিল এলাকায়। লজিং থাকতো আমাদেরই এক প্রতিবেশীর বাসায়। লোকটা বড়দের কাছে রসিক মানুষ হলেও ছোটদের যম ছিল।

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ুয়া বলে আমি পড়তাম না তার কাছে, ফলে তার বেত আমাকে ছুঁতে পারেনি কখনো। হম্বিতম্বি সব প্রাইমারী লেভেলের ভাইবোনদের উপর দিয়েই যেত। দৈনিক একবেলা এক ঘন্টা এসে পড়িয়ে যেতো আমাদের বাসায়। কিন্তু আড্ডা দিতো আরো দেড় দুইঘন্টা। আমার এক চাচা ছিলেন ওনার সমবয়সী, তাই একটা আড্ডার সম্পর্ক ছিল দুজনের। কিঞ্চিত বড় হবার সুবাদে অমূল্য মাষ্টারের সাথে আমার ঠিক বন্ধুত্ব না হলেও প্রায়ই ওদের গল্পে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা হবার চান্স নিতাম। বয়সটা ইঁচড়ে পাকা হয়ে ওঠার উপযুক্ত বলে ওদের গল্পের মধ্যে রসের আনাগোনা বুঝতেও খুব বেশী কষ্ট হতো না। কিন্তু চেহারায় "কলা ছিলে না দিলে খেতে পারিনা" ভাব নিয়ে পড়ে থাকতাম।

অমূল্য মাষ্টারের তিনটা ঘটনা এখনো ভুলতে পারিনি। সেটাই বলি।

১. তাকে সিনেমাপাগল বা সিনেমা উন্মাদ যাই বলা হোক, হলে গিয়ে একনাগাড়ে সর্বাধিক সময় সিনেমা দেখার রেকর্ড অমূল্য মাষ্টার বাদে আর কারো আছে কিনা জানা নেই। তখনও মানুষের যাতায়াত ছিল সিনেমা হলে, সেই ৮০-৮২ সালের দিকে। আমরাও যেতাম মাঝে মাঝে। কিন্তু অমূল্য মাষ্টারের সিনেমা দেখাটা ছিল বিশাল ব্যাপার। সেই সময় 'লাভ ইন সিঙ্গাপুর' ও 'সওদাগর' নামে দুটো সিনেমা বাংলাদেশে ব্যাপক হিট খায়। সেই সিনেমা দুটো অমূল্য মাষ্টার দেখেছিল প্রতিটা ১২ বার করে। শুধু কি তাই? একদিন এক নাগাড়ে দিনের ১২টা থেকে শুরু করে রাত ১২টা পর্যন্ত সবগুলো শো-র টিকেট কিনে বারোঘন্টা সিনেমা দেখেছিল নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে। ভাবা যায়?

২. ম্যানোলা তখন বাংলাদেশে নামকরা কসমেটিক কোম্পানী। অমূল্য মাষ্টার ম্যানোলা কোম্পানীর কোন পদে চাকরী করতো জানি না। কিন্তু বেশ বড় পদে নিশ্চয়ই। স্নো আর ক্রীম এত সুলভ ছিল তার কাছে যে সে মুখ মাথা এমনকি হাঁটু থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত ক্রীম মেজে আসতো কাজ থেকে ফেরার সময়। একদিন আমাকে বলেই ফেললো, আমাকে একটা ডানোর বড় টিন দাও তোমাদের জন্যও টিন ভর্তি করে ক্রীম নিয়ে আসবো। আমি হাঁটু আর পায়ের তালু পর্যন্ত ক্রীম মাজার উপকারিতা কি ভাবতে ভাবতে মার কাছে ডানোর টিন চাইতে গিয়ে রুটি সেঁকার খুন্তির তাড়া খেয়ে পালালাম।

৩. অমূল্যের সাথে তার গ্রামের একটা মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে ছিল। সেই সামনের বৈশাখে বিয়ে। মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়ে। অমূল্য মেয়েটাকে পড়াতো আগে থেকে। পড়াতে গিয়েই জীবন সঙ্গী নির্বাচন। আমাদের সাথে প্রায়ই গল্প করতো মেয়েটা কিরকম মেধাবী, কত সুন্দর, মেট্রিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পাবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। তার হবু বউয়ের গল্প শুনতে শুনতে অমূল্যের স্বপ্নটা আমাদেরও ছুয়ে যেত। কিন্তু বৈশাখ কাছাকাছি আসতেই অমূল্যের পরিবারে কে যেন একজন মুরব্বী মারা যান। ফলে বিয়ে স্থগিত হয়ে যায় এক বছরের জন্য। এক বছর কেন?

তখন শুনেছিলাম হিন্দুশাস্ত্র মতে পরিবারের বড় ছেলের বিয়ে নাকি বৈশাখেই হতে হয়। সত্যমিথ্যা জানি না। তবে আমরাও মেনে নিয়েছিলাম যেহেতু অমূল্যও মেনে নিয়েছিল। আমরা পরবর্তী বৈশাখের অপেক্ষায় থাকি। আমাদের অপেক্ষা বিয়েতে আমোদ ফূর্তি করা, ব্যাপক খাওয়াদাওয়ার উৎসবের জন্য। আগাম দাওয়াত পেয়ে গিয়েছিলাম। অমূল্য প্ল্যান করতে থাকে কিভাবে কি করবে।

কিন্তু পরবর্তী বছরে পরিবারের আবারো কার যেন দেহত্যাগ ঘটলো। বিয়ে আবারো স্থগিত। অমূল্য এসে বিষন্ন মুখে পড়ায়। আমরাও বিষন্ন থাকি। খাওয়াটা না জানি মার যায়। পরের বছর অমূল্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে হবু বউয়ের মেট্রিক পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার পুরো সময়টা দিনরাত খেটেখুটে পরীক্ষার হলে ডিউটি দিয়ে পার করে। পরীক্ষার তিনমাস পর রেজাল্ট দিল। বউ ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে!!! কি আনন্দ আমাদের! সব কৃতিত্ব অমূল্য মাষ্টারের। খুশীতে ব্যাপক মিষ্টিমুখ করানো হলো আমাদের। আমরা নিশ্চিত হই এবার বিয়েটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। সামনের বৈশাখেই বিয়েটা খাবো আমরা।

কিন্তু বিয়ের দিন ঘনাবার অনেক আগেই একটা দুঃসংবাদ আসলো। না, এবার কেউ মারা যায়নি। এবারের ঘটনা ভিন্ন। মেয়ের ভালো রেজাল্ট দেখে পাত্রীপক্ষ পিঠটান দিয়েছে। হবু শ্বশুর এখুনি মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। আরো উচ্চশিক্ষিত করে তারপর বিয়ে। আসল কথা ভালো রেজাল্টের কল্যানে পাত্রীর বাজার দর অনেক বেড়ে গেছে। ক্লাস নাইনে থাকতে বিয়েটা হয়ে গেলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু মেয়ে ফার্স্ট ডিভিশান পেয়ে যাওয়াতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ অমূল্যচন্দ্রকে এখন নিতান্ত বেমানান লাগছে মেয়েপক্ষের কাছে।

ফলতঃ অমূল্য মাষ্টারের বিয়েটা আমাদের কখনোই খাওয়া হয়নি।

ছয় টাকার চাকরী, চুয়ান্ন টাকার খেসারত

যেনতেন একটা চাকরী পেতেও কত যুদ্ধ, কতরকম নাকানিচুবানি খেতে হয় মানুষের। অথচ আমরা দুইবন্ধুতে মিলে সাড়ে তিনটাকা বাসভাড়া আর আড়াই টাকার কাগজ খামের খরচ দিয়ে চাকরী বাগিয়ে ফেলেছিলাম। শায়েস্তা খানের আমলে নয়, মাত্র সোয়াযুগ আগে নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে। তবে ছয়টাকা ব্যয় করে চাকরী পাওয়াও ব্যাপার ছিল না।

ব্যাপারটা হলো ওই চাকরীটা পেতে আমাদের আরো চুয়ান্ন টাকা খরচ করতে হয়েছিল। সেই বাড়তি চুয়ান্ন টাকা খরচের ঘটনাই বলি।

পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সাদা কাগজে দরখাস্ত লিখে অনেকটা মজা করার উদ্দেশ্যেই ইন্টারভিউ দিতে গেলাম আমি আর বিল্লাহ। জীবনের প্রথম দরখাস্ত একটা প্রায় ওয়াক ইন ইন্টারভিউর জন্য। দরখাস্ত জমা দিতে গিয়ে দেখি প্রচন্ড ভীড় অফিসের গেটে। শুনলাম পোষ্ট খালি আছে বারোটা, দরখাস্ত পড়েছে সাড়ে ছয়শো। ১০% চান্সও নেই। বিল্লাহ নিদারুন হতাশ। আমি বললাম, 'নো চিন্তা বন্ধু জীবনের প্রথম ইন্টারভ্যু, চাকরী না পেলেও ইন্টারভিউ চর্চা হয়ে যাবে প্র্যাকটিক্যালি।'

উপস্থিত প্রার্থীদের মধ্যে পোষাক আশাকে আমাদের দুজনের চেয়ে ক্ষ্যাত আর কেউ ছিল না। আমার কটন প্যান্টের উপর ছেড়ে দেয়া শার্টের সাথে ঘষে যাওয়া বাটা চপ্পল। এই বেশে চাকরী পাবার কোন সম্ভাবনা নাই। এখানে আজ সব টাই পরা বাঙালী। বিদেশী কোম্পানী স্মার্ট লোকই চাইবে। কত যত্ন করে প্লাষ্টিক ফোল্ডারে বায়োডাটা এনেছে একেকজন। আর আমাদের দরখাস্ত চন্দ্রঘোনার আদি বাঁশঝাড়ের মন্ডে তৈরী কেপিএমের লালচে হোয়াইট প্রিন্ট কাগজ। দরখাস্ত জমা দেবার ঘন্টাখানেক পরেই ডাক এল। ইন্টারভিউ বোর্ডে একজন বাঙালী দুজন বিদেশী। আমার ত্যানামার্কা হাতে লেখা দরখাস্তটা দুআঙুলের চিপায় নিয়ে মাঝ বয়সী বিদেশী ভদ্রলোক বললেন, এটাই তোমার? বললাম, জী। এটা তোমার হাতের লেখা? বললাম, জী।

সেই বড়কর্তার মুখে খানিক ব্যাঙ্গের হাসি লক্ষ্য করে আমি শিওর হয়ে গেলাম আমার চাকরী হবে না। না হলে না হোক। প্রথম ইন্টারভ্যুতেই লাগবে এমন সম্ভাবনা নাই। হবেই না যখন ডেসপারেট হয়ে বাকী সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। এক পর্যায়ে কর্তা বললেন, তোমার সাবজেক্ট তো অ্যাকাউন্টিং তোমাকে আমি অ্যাকাউন্টসের জন্য নিলাম, কি বলো? আমি চেয়ার থেকে আলগা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বললাম, ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু দুঃখিত আপনার চাকরী আমি করবো না। আমি গেলাম, গুডবাই (আমি যদিও অ্যাকাউন্টিং এ পড়েছি কিন্তু চাকরীতে ওটা নেবো না বলে কঠিন প্রতিজ্ঞা ছিল)।

ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বললেন, আরে করো কি। বসো বসো, ঠিক আছে, তোমার যা পছন্দ তাই দেয়া হবে তোমাকে। তবে একটা কথা। তোমার নাকের নীচের ওই কালো গোঁফ জোড়া তো বাদ দিতে হবে। শুনে চমকে উঠলেও মুখে বললাম 'প্রবলেম নাই'। বলা হলো লাঞ্চের পর রেজাল্ট দেবে। কিন্তু বেরিয়ে এসে ভাবলাম, ব্যাটারা বলে কি? আমার এত সাধের পাকানো গোঁফ ফেলে দেবো? গুষ্টি মারি তোর চাকরীর। আয় যাই গা। বিল্লাহকে নিয়ে রাস্তায় উঠে একটা বাসে চড়ে বসলাম। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ফোঁটাফোঁটো।

বাসটা আগ্রাবাদের কাছাকাছি আসতেই বৃষ্টিটা কুকুর বিড়াল রূপ নিল। বৃষ্টির ধুন্ধুমার নাচনে রাস্তাঘাট, অফিস, দোকানপাট সব ঝাপসা দেখছি। বাস থেকে নেমে দাঁড়ানোর জায়গাও নাই। হঠাৎ মনে পড়লো নতুন চাকরী পাওয়া বন্ধু ডিউর অফিস তো এখানেই। বাসটাকে থামাতে বলে একদৌড়ে ওর অফিস বিল্ডিং-এ ঢুকে গেলাম। ইস্পাহানীর অফিস। চারতলায় উঠে ওর অফিসে উঁকি দিলাম। আমাদের দেখে বেরিয়ে এল সে। ওর নতুন চাকরীটা পাবার পর একটা খাওয়াদাওয়া হবার কথা ছিল। ধরলাম আজকেই পাওনাটা মিটিয়ে দে। রাজী হলে কাছাকাছি একটা রেষ্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম আধভেজা হয়ে।

খেতে খেতে চাকরীর ইন্টারভিউর কথাটা বললাম। গোঁফ বিসর্জন দিয়ে চাকরী করবো না বলেও জানালাম। কথা শুনে ডিউ ধমকে উঠলো, 'ব্যাটা মাগনা চাকরী পাবি নাকি। একটা কিছু ছাড় দিতেই হয়। এতো সামান্য গোঁফ। গোঁফ গেলে গোঁফ আসবে। আমার তো গোঁফই নাই। যা, খেয়েদেয়ে সোজা ফিরে যা আবার। রেজাল্ট জেনে ফিরবি।' এই জাতের হুকুম আশা করিনি ওর কাছে, কিন্তু আজকে ও খাওয়াচ্ছে। তাই বিশেষ কিছু না বলে গোমড়া মুখে বিল্লাহকে নিয়ে চাকরীর রেজাল্ট আনতে গেলাম। গিয়ে দেখি, দুজনেই পাশ!!! তবে এখন একটা দ্বিতীয় ইন্টারভিউ হবে। সেই বাছাইতে টিকলে তবেই ফাইনাল। অপেক্ষা করতে বলা হলো আবারো। দুশ্শালা! মনে মনে গালি দিলাম।

বেরিয়ে এসে পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে ধরালাম। ফুটপাতের সিমেন্টে পাছা ঠেকিয়ে বসলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ আগে। সিগারেট অর্ধেক শেষ করার পর খেয়াল করলাম সামনের চত্তরে ইন্টারভিউ বোর্ডের সেই বিদেশী ভদ্রলোক পায়চারী করছে আর আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে ধুমসে বিড়ি টানতে লাগলাম। দ্বিতীয় ইন্টারভিউতে ভদ্রলোককে দেখা গেল না বলে একটু স্বস্তি পেলাম। দেখা গেল, দুই নম্বর ইন্টারভিউতেও টিকে গেলাম দুইজনে। ধুত্তোরি। এত করেও ঠেকানো গেল না চাকরীটাকে। গোঁফজোড়া এবার ছাড়তেই হবে!! ঘোড়ার ডিমের চাকরী আমার। কিন্তু বাবার সংসার ভারাক্রান্ত চেহারা মনে হতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, চাকরীটা করবো। তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতেই বাসায় ফিরলাম।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু হলো না।

পাড়ায় কিভাবে যেন গোঁফ ছাটার কথাটা রটে গিয়েছিল। সন্ধ্যার সময় পাড়াতো বন্ধুরা সব দলবেধে হাজির। চাকরীর শুভেচ্ছা জানাতে নয়, এসেছে গোঁফ ছাঁটা অভিযানে সঙ্গ দেবার বাসনায়। আমার শোক ওদের মচ্ছব! ঘোষনা করা হলো এই ঘটনা বিনা উৎসবে ছাড়া যাবে না। পাড়ার নাপিতকে দিয়ে বিশেষ কায়দায় ছাঁটানো হবে আমাদের গোঁফ। পরিষ্কার বুঝে গেলাম বেইজ্জতীর বিশেষ আয়োজন করা হলো। কোন অজুহাতে পালিয়ে দুরে কোন অচেনা নাপিতের সেলুনে গিয়ে কাটতে চাইলাম। কিন্তু আমাদের দুজনকে চোখে চোখে পাহারায় রাখা হলো। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখা গেল ছোটখাট একট মিছিল হয়ে গেছে দশবারো জনের। সবাই প্রথমে মোড়ের টং দোকানে গিয়ে একচোট চা বিস্কুট সিগারেট চালালো আমাদের উপর দিয়ে। চল্লিশ টাকা এক ধাক্কাতেই শেষ। তারপর আমাদের দুজকে সেলুনে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। আর সবাই চারপাশে ঘিরে দাড়ালো যেন চিড়িয়াখানার বাঁদরকে শেভ করানো হচ্ছে। হাসাহাসি চলছে খুব।

পাঁচমিনিটেই সাফা হয়ে গেল দশ বছরের শান দেয়া গোঁফ। আয়নায় নিজেরে চিনতে পারলাম না। যাত্রাপালার সং দেখছি যেন। এই চেহারার নিয়ে রাস্তায় বেরুবো কী করে? ভীষন বিব্রত অবস্থায়ও কাষ্ঠ হাসি দিতে হলো। সেলুনের ভেতর বাইরে থেকে প্রবল করতালি শুরু হলো। কাজ শেষে বিল দেবার সময় এলো নাপিতের আবদার। দুই জনের গোঁফছাটা দশটাকার ব্যাপার। কিন্তু নাপিত ব্যাটা বলে বসলো, 'দাদারা জীবনে প্রথম গোঁফ ছাঁটলেন। আমাদের বকশিশ না দিলে দাবী রেখে দেবো'। পুরোনো নাপিত, নতুন আবদার, কত বেতমিজ। কিন্তু কি আর করা। দুটাকা দুটাকা করে আরো চার টাকা গচ্ছা দিলাম।

সবাইকে বিদায় দিয়ে দুই বন্ধুতে আলাপ হচ্ছিল। অত্যন্ত হিসেবি ও মিতব্যয়ী বিল্লাহ বেজার মুখে বললো, "দোস্ত চাকরী পাইতে খরচ হইছে ছয়টাকা। কিন্তু গোঁফ ছাঁটার খেসারত তো গেল চুয়ান্ন টাকা। দুনিয়াতে বিচার নাই। এই ভাবেই সম্পদের অপচয় হয়!!"

চট্টগ্রামের লেইঙ্গা মাষ্টারঃ যাকে আমরা ভুলে গিয়েছিলাম!

১৯১০ সালের দিকে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর এক মেধাবী ছাত্র যাদববাবুর পাটীগনিতের একটা অংক নিয়ে সমস্যায় পড়লো। স্কুলের কোন শিক্ষকই অংকটির সমাধান করতে পারলেন না। ছেলেটি থাকতো আগ্রাবাদের ছোটপুল এলাকায়। শেষ চেষ্টা হিসেবে সে প্রতিবেশী এক অংক পন্ডিতের কাছে গেল সমস্যাটি নিয়ে, তিনিও বহু চেষ্টা করে সমাধান করতে পারলেন না।

কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত দিলেন। বললেন যে যাদববাবুর ওই অংক প্রশ্নটিতে ভুল আছে। মারাত্মক অভিযোগ! যাদববাবুর অংকের বিরূদ্ধে এত বড় অভিযোগ তোলার সাহস উপমহাদেশে কারো ছিল না তখন। পরদিন মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষকগন কথাটি শুনে একচোট হাসলেন। বললেন, এত বড় পন্ডিত যাদববাবু, আর তার ভুল ধরে কোথাকার এক প্রাইমারী পাশ লেইঙ্গা মাষ্টার।

লেইঙ্গা মাষ্টারের আসল নাম আবদুস সোবহান। পড়াশোনায় প্রাইমারী পাশ হলেও মেধায় ছিলেন অতুলনীয়। ছেলেবেলায় গাছ থেকে পড়ে কোমরে আঘাত পেলে কোমরের নীচ থেকে পা পর্যন্ত অচল হয়ে যায়। চলাফেরা করতেন বিয়ারিং এর চাকায় তৈরী কাঠের পাটাতন দিয়ে বানানো গাড়ীতে বসে। চাটগাঁইয়া ভাষায় পঙ্গু বা চলৎশক্তি বিহীন লোককে বলা হয় লেইঙ্গা। প্রচন্ড শিক্ষানুরাগী এই মানুষটির শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। তিনি আগ্রাবাদের বেপারী পাড়া এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি প্রাইমারী স্কুল। নাম আগ্রাবাদ প্রাইমারী স্কুল। ওই এলাকার প্রথম স্কুল সেই বৃটিশ আমলে। কথিত ছিল লেইঙ্গা মাষ্টারের বেতের দৈর্ঘ্য নাকি তার স্কুলের চেয়েও বড়। এত কড়া শাসনে রাখতেন স্কুল।

তো লেইঙ্গা মাষ্টারের কানে এলো মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষকদের বিরূপ মন্তব্য। তিনি প্রত্যুত্তর না দিয়ে নীরবে ভাবতে লাগলেন। কয়েকদিন ভেবে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে। বিস্তারিত যুক্তি তুলে জানালেন কেন যাদববাবুর পাটিগনিতের ওই অংক প্রশ্নটি ভুল। তিনি ভুলটা শুদ্ধ করে একটা সমাধানও চিঠির সাথে পাঠিয়ে দিলেন।

চিঠি পেয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের প্রধান প্রফেসর বোস সহকর্মী অন্যান্য অধ্যাপকদের নিয়ে একটা বোর্ড বসালেন। নানান আলোচনার পর বোর্ডের সবাই অবাক হয়ে একমত হলেন যে সেই অখ্যাত লেইঙ্গা মাষ্টারের কথাই ঠিক! অংকটি আসলেই ভুল ছিল। ফিরতি জবাবে তাঁরা আবদুস সোবহানকে পন্ডিত উপাধি দিয়ে একটা সার্টিফিকেট ও নগদ পাঁচশো টাকার একটা মানি অর্ডার সম্মানী পাঠালেন।

সেই লেইঙ্গা মাষ্টারের মৃত্যুর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর পর আগ্রাবাদ এলাকায় সরকারী কর্মকর্তাগনের চেষ্টায় স্কুলটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয় আগ্রাবাদ প্রাইমারী স্কুল নামে। যেটি বর্তমানে "আগ্রাবাদ সরকারী কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়" নামে পরিচিত।

সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো আমি লেইঙ্গা মাষ্টারের এলাকায় দীর্ঘ বিশটি বছর বসবাস করেছি। সেই স্কুলে দশটি বছর পড়াশোনা করে মেট্রিক পাশ করেছি। কিন্তু কেউ কখনো ঘুনাক্ষরেও লেইঙ্গা মাষ্টারের কথা বলেনি আমাদের। কত তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের কীর্তিমান পূর্বপুরুষের কথা ভুলে যাই! মাত্র গতকাল রাতে শুনলাম আমি লেইঙ্গা মাষ্টার ইতিকথা।

একটু শান্ত্বনার সংবাদও পেলাম গতকাল। ২০১০ সালের জানুয়ারীতে স্কুলের ৫০ বছর পুর্তি উৎসবে লেইঙ্গা মাষ্টারকে মরনোত্তর সম্মান জানাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের খেদ যদি তাতে একটুও মেটে!

[তথ্যসুত্র কৃতজ্ঞতাঃ সাখাওয়াত হোসেন মজনু ভাই]

ঠিক গল্পও নয়

পরামানিকের কানাচোখে দৃশ্যটা দেখার কথা ছিল না। কিন্তু একটা পাথরে বেমক্কা হোঁচট খেয়ে যেখানে পড়ে গেল তার পাশেই রমিজ মন্ডলের গুদাম ঘরের দেয়ালের ফোকড়টা। ফোকরটা যেখানে ঠিক সেই বরাবর পরামানিকের বামচোখটা পড়লো এবং অনুচিত দৃশ্যটা দেখে ফেললো। দেখেই পালাতে চেয়েছিল।

কিন্তু রমিজ মন্ডলের বর্বর ছেলে মাখন মন্ডল তার আগেই ফোকড় দিয়ে পরামানিককে দেখে ফেললো। দেয়াল টপকে বাইরে এসে "হারামীর পো কাউকে বললে খুন করে ফেলবো" বলে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর।

পাঁচমিনিটের মাথায় পরামানিক দুই চোখেই সমান আঁধার দেখলো। দৃশ্যটা না দেখলেই কি বাঁচতো পরামানিকের বাকী চোখটা? অনুচিত দৃশ্য দেখতে হবে জানলে ফোকড়ে তাকাতোই না। কিন্তু দেখার আগে বুঝবে কি করে ভেতরে কি চলছে?

এ তার কর্মের ফল, নাকি কপালের দোষ? তাকানোটা আকাম হয়েছে, কিন্তু হোঁচটটা খেয়েছে কপাল দোষে।

কর্মের দোষ কপালের ঘাড়ে চাপিয়ে অঝোরে কাঁদতে বসলো পরামানিক।

মানীর মান জুতার বাড়িতেও যায় না, কথাটা ভুল

আমার এক প্রতিবেশী গিয়াস সাহেব। দুর সম্পর্কের আত্মীয়ও হন। সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন রাজস্ব বিভাগে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন মর্মে সার্টিফিকেটও আছে। আমি তাকে যথেষ্ট ভক্তিশ্রদ্ধা করতাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। এলাকায় সন্ধ্যার পর প্রায়ই বিদ্যুত চলে যায়। এটা একটা নিয়মিত চিত্র চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের। মজার ব্যাপার হলো গিয়াস সাহেব এই ঘটনার মধ্যে বিরাট ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতেন। ফিসফিস করে বলতেন, "বুঝলে ভাতিজা। এই সবই হিন্দুদের চক্রান্ত। হিন্দুর ছেলেরা দিনের বেলা পড়াশোনা করে রাখে, রাতে খেলাধুলা করে। তাই রাতে মুসলমানের ছেলেমেয়েরা যাতে পড়তে না পারে সেজন্য কারেন্ট বন্ধ করে দেয়। হিন্দুরা চায়না মুসলমান শিক্ষিত হোক। সব ইন্ডিয়ার চক্রান্ত"। আমি তাজ্জব শুনে।

আর একবার কোরবানীর সময় শেয়ারে গরু কোরবানী দিয়েছিলাম ওনার সাথে। গরু জবাই করার সময় কসাইদের সাথে আমিও ট্যাং ধরলাম একটা। কিন্তু গরুর লাথির চোটে আমি তিন লাফে গরু ছেড়ে পালিয়ে এলাম। এটা দেখে গিয়াস সাহেব রেগে গেলেন। আমার বাবাকে অভিযোগ করে - "কিসের এমএ পড়া ছেলে আপনার, গরুর ট্যাংটাও ঠিকমতো ধরতে পারে না। যতসব অপদার্থ।" এইটা শুনে বাবা লা জওয়াব, আর আমরা আড়ালে গিয়ে হাসি।

এই ভদ্রলোক সবকিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজতে ভালোবাসতেন। সহজ বিষয়কেও জটিল করে দেখতে ভালোবাসতেন। দেখতে সুশ্রী হ্যান্ডসাম এই ভদ্রলোক এত নরম স্বরে কথা বলবেন যেন ফেরেশতার বানী নির্গত হচ্ছে। প্রথম দৃষ্টিতে দেবদুত মনে হবার কথা। কিন্তু যেদিন গিয়াস সাহেবের মধ্যে ওই নোংরা সাম্প্রদায়িক মনোভাব দেখলাম, অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনলাম সেদিন থেকে শ্রদ্ধাটা যেন বাষ্পীভুত হয়ে গেল। গিয়াস সাহেবকে সালাম দিতেও কুন্ঠিত হই এখন।

শ্রদ্ধেয় মানুষদের শ্রদ্ধার আসন ধরে রাখার জন্য সতর্ক থাকা উচিত। মানীর মান জুতার বাড়িতেও যায় না, কথাটা ভুল।

[উৎসর্গ: ব্লগের বেইজ্জতাপন্ন মানীগুনীজন]

তোর বন্ধুতায় আমি যে বিব্রত এখন, হে বন্ধু আমার!

পাকাপাকিভাবে শহরবাসী হই প্রথম স্কুলে ভর্তি হবার সময়। ১৯৭৪ সালে 'পাঠশালা' শব্দের সহজ বানানটা হেডমাষ্টারের ভয়ের চোটে গুলিয়ে ফেলে ক্লাস টুর বদলে ক্লাস ওয়ানে যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম তার নাম আগ্রাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখনকার দিনে সরকারী প্রাইমারী স্কুলগুলোতে সর্বশ্রেনীর মানুষের সন্তানেরা পড়তো। ১৯৭৪ সাল ছিল দুর্ভিক্ষের সময়। কলোনীর সিড়িগুলোতে গ্রাম থেকে আসা শত শত দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সমাগম।

মনে পড়ে স্কুল থেকে আমরা জাতিসংঘ মার্কা নীল রঙের খাতা কলম রাবার পেয়েছিলাম। সেই সাথে সম্ভবতঃ বিস্কুট আর দুধপাউডারও দেয়া হয়েছিল। ক্লাসে প্রথমদিন যে ছেলেটির পাশে বসেছিলাম তার নাম মিলন। আমার প্রথম স্কুল বন্ধু। ওর রোল নাম্বার দশের ভেতরে হলেও আমার রোলনাম্বার ছিল ৬৯। এটি ক্লাসের সর্বশেষ রোলনাম্বার। এই সম্মানটা আমি পাবার কারন হলো আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র ১৬ দিন আগে। সুতরাং শিক্ষা জীবনটা শুরুই হয়েছিল লাষ্ট বয় হিসেবে।

মিলন আমার চেয়ে স্বাস্থ্যবান ও দেখতে বড়সড় ছিল। বাবা সেদিন মিলনকে বলেছিল আমাকে একটু দেখে রাখতে। কারন গ্রাম থেকে সদ্য এসেছি শহরে, শহুরে কেতা তেমন কিছুই বুঝি না। মিলন কথা রেখেছিল। আমাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল যতদিন পেরেছে। অদ্ভুত ভালোবাসা আর মমতায় ঢেকে রেখেছিল আমাকে। মিলনের বাবা ছিল কোন এক সরকারী দফতরের পিয়ন, আবার নিকটস্থ কাঁচাবাজারে তাঁর একটা সবজীর দোকানও ছিল। এখন অনেকে অবাক হবে সবজী বিক্রেতা শ্রেনীর ছেলের সাথে কিভাবে বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু তখনকার সময়ে কার বাবা কি সেটা নিয়ে বন্ধুত্বে কোন হেরফের হতো না। ভেদাভেদ শুরু হয়েছিল আরো অনেক পরে, আরো বড় হতে হতে, সচেতন হতে শুরু হবার পর। মিলন আমার বন্ধু ছিল ততদিন, যতদিন শ্রেনীসচেতন বন্ধুগন আমার চারপাশ ঘিরে ফেলেনি। সম্ভবতঃ ক্লাস থ্রী থেকে আমার নতুন বন্ধু যোগ হতে শুরু করে। মিলনের সাথে দুরত্বের সুত্রপাত তখন থেকে।

ক্লাস ফাইভে উঠতে উঠতে আমার বন্ধুমহলে বহুজাতের বাঁদরের আগমন ঘটে। সহজ সরল মিলন তাদের সাথে এঁটে উঠতে পারলো না। সেইসব উৎপাতে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ বৃদ্ধির কারনে মিলন আমার সাথে তেমন থাকে না। ফলে তার সাথে আমার দুরত্ব বাড়তেই থাকে। সম্ভবতঃ ক্লাস ফাইভের পর মিলন আর পড়াশোনা করেনি। আমাদের বন্ধুতার মৃত্যুঘন্টা বেজে গিয়েছিল তখনই। এরপরেও অবশ্য তাকে মাঝে মাঝে দেখতাম বাজারের তরকারির দোকানে বসতে। আমি ততদিনে মোটামুটি শ্রেনী সচেতন হয়ে উঠেছিলাম বলে মিলনকে বন্ধু স্বীকার করতে আমার ভেতর লজ্জাবোধের সৃষ্টি হয়। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর আমার মিলনপর্ব চুকে যায় স্থায়ীভাবে।

আরো পঁচিশ বছর পরের কথা।

একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তার পাশের দোকান থেকে ফলমূল কিনছিলাম। হঠাৎ কাঁধে একটা হাতের অস্তিত্ব অনুভব করি। ফিরে তাকিয়ে আমার মুখটা হা হয়ে যায়। এ কে? কত যুগ আগের মুখ এটি। এখনো অবিকল সেই মুখ, সেই মায়া, সেই হাসি। এ তো আমার ছেলেবেলার বন্ধু মিলন!! সে যখন আমার নাম ধরে যখন ডাক দিলে আমি অবাক, আমাকে চিনেছে ও? আমার হাতটা ধরে শক্ত একটা চাপ দিলে মনে পড়লো ওর গায়ে আগের মতোই আমার চেয়ে বেশী জোর। ওই চাপেই বুঝে গেলাম মিলন এখনো আগের আন্তরিকতা ধরে রেখেছে। কথায় কথায় জানতে পারলাম মিলন এখন সরকারী চাকরী করে। কোন একটা ডিপার্টমেন্টের মিস্ত্রী পদবীতে কাজ করে। তার পোষাক একটু গরীবি হলেও চেহারায় পুরো আত্মবিশ্বাস। আমাকে যেন এখনো ভরসা দিয়ে যাচ্ছে। আছি বন্ধু তোমার জন্য।

মিলনের কথাবার্তা কুশালাদি জিজ্ঞেসের ভঙ্গীমায় পুরোনো আন্তরিকতা বিদ্যমান থাকলেও, শ্রেনীসচেতন আমি কিন্তু খানিক বিব্রত। ওকে এড়াতে পারলে যেন বাঁচি। মিলন যতটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার পরিবারের খোঁজখবর করছে, আমি ততোধিক আলগা হয়ে জবাব দেবার চেষ্টা করছি। এমনকি মিলনের পরিবারের কে কোথায় আছে আমি তা একবারও জানতে চাই না। পালিয়ে যাবার অজুহাত হিসেবে মিলনকে বলি, আজ আমার খুব কাজ আছে, পরে দেখা হবে। কিন্তু মিলনের হাত ছাড়তে অনিচ্ছুক। সে জোর করে আমাকে তার নিকটবর্তী বাসায় নিয়ে যায়। উচ্চকন্ঠে তার পরিবারের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। এবং সবচেয়ে যেটা অবাক করেছে- আমার বাবা তাকে দুই যুগ আগে একটা বিদেশী বেল্ট উপহার দিয়েছিল সে এখনো রেখে দিয়েছে সেই স্মৃতি। আমি বিব্রত অবস্থায়ও মুগ্ধ হয়ে যাই ওর আন্তরিকতায়। বন্ধুত্ব কত বছর জিইয়ে থাকে? সেরকম কোন সীমারেখা কি আছে?

মিলনকে দেখে বুঝলাম সত্যিকার বন্ধুত্বের কোন শ্রেনীভাগ থাকে না। কিন্তু আমার ভেতরে যে বৈষম্যের বীজ অংকুরিত হয়েছিল শৈশবে এখন তা মহীরূহ। আমি সেটা উপেক্ষা করে মিলনকে কিছুতেই বন্ধুতার কাতারে আনতে পারলাম না আর। তাই বিদায় নেবার সময় মিলনকে মুখে বললাম, দেখা হবে। কিন্তু একবারও বললাম না- 'একদিন সময় করে বাসায় আসবি। একবেলা খাবি আমার সাথে।' এমনকি আমার নতুন বাসার ঠিকানাও বললাম না ওকে।

বাসায় ফেরার পথে একা একা ভাবতে লাগলাম মানুষের স্বার্থপর শ্রেনীসচেতনতার বীজ কত গভীর হয়!! দেশ উদ্ধার করা আড্ডাবাজিতে শ্রেনীবৈষম্যের বিরূদ্ধে এত বড় বড় গীত গাই, সামাজিক অবিচারের বিরূদ্ধে চায়ের কাপে ঝড় তুলি, সেই আমি কী এই আমি? আমার সবগুলো সুশীল আচার কি মুখোশ নয়? বই-খাতা-কলম-কীবোর্ডের বাইরে ব্যক্তিজীবনে আমরা কতটা ভন্ড, হায়!

একচোখা এক বিষন্ন চিল

একচোখা একটি বিষন্ন চিল একা একা উড়ছে বঙ্গোপসাগের অথই নীল জলরাশির ওপর। দুপাশে ছড়ানো পাখায় ভর দিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে নিঃসঙ্গ ধূসর চিলটি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে রানওয়ে হারিয়ে ফেলা একটা বিমানের মতো। বাতাসের লোনা জলের গন্ধে অনাগত শীতে ঝরা পাতার হাহাকার। সেই হাহাকারের মাঝে অবুঝ চিলটি হারানো কিছু খুঁজছে। খুজছে, কিন্তু ভুলে গেছে কি হারিয়েছে? কিছু একটা পড়ে গেছে তার পায়ের নখর গলে, আনন্দে মগ্ন একচোখা চিল দেখতে পায়নি কোথায় পড়েছে। তাই আদিম ভোর থেকে বাতাসের ভেলায় ভাসতে ভাসতে ভেবে চলেছে কি হারিয়েছে। কিছুতেই মনে করতে পারলো না কি হারিয়ে গেল। তবু সেই অজানা বস্তুর সন্ধানে একচোখা চিল আজ সারাদিন.......

তিনবিঘা করিডোরে কয়েকজন বাউন্ডুলে এলোমেলো হেঁটেছিল

সতর্কবানীঃ ঢাউস লেখা, অধৈর্য পাঠক প্রবেশ করিবেন না]

মানুষের জীবনে কত রকম সাধ অপূর্ণ রয়ে যায়! আমার সেরকম অপূর্ণ সাধের একটা বাউন্ডুলে জীবন। একটা বয়সে খুব ইচ্ছে করতো এলোমেলো হাঁটতে। সুযোগ পেলেই পালের হাওয়া যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকে পালিয়ে যাওয়া। নব্বই দশকের প্রথমভাগে ঢাকার বন্ধুদের সাথে আমার একটা আড্ডা ছিল নিয়মিত। কদিন পরপর নানা অজুহাতে ছুটে যেতাম ঢাকায়। সেই বাউন্ডুলে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিনরাত্রি। ১৯৯৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে ছুট লাগালাম ঢাকায়। বেকার জীবনের শেষ আড্ডা দিয়ে ফিরে আসার আগের রাতে সাব্বির বললো ওরা কাল সকালে উত্তরবঙ্গে যাবে একটা কাজে। কাজটা কি সেটা বললে আরেক বিশাল কাহিনী হয়ে যাবে বলে সেটা উল্লেখ করবো না আজ। কেবল ভ্রমনটাই বলি।

বাংলাদেশের ম্যাপের উত্তর কোনায় যে তিনটি সুচালো মাথা বেরিয়েছে তার মাঝখানের টিলার নাম বুড়ীমারী। ভারতে যাবার একটি অন্যতম স্থল বন্দর। হিমালয় পর্বতের খাড়াইগুলো যার কয়েক মাইল উত্তরে এসে থেমে গেছে দিগন্তের সেই শেষ প্রান্তে মেঘমুক্ত আকাশে মাঝে মাঝে কাঞ্চনজংঘার শ্বেতশূভ্র চুড়াটা উঁকি দেয়। সাব্বির বললো, চাইলে ওদের সাথে যেতে পারি আমি। কোথাও যাবার প্রস্তাব পেলে 'না' শব্দটা কখনোই উচ্চারন করতাম না। সুতরাং খপ করে লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। কাঞ্চনজংঘার নাম শুনেই আমার মাথা থেকে বাসা বাড়ী, পরিবার, চট্টগ্রাম সব উবে গেল। মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো কাঞ্চনজংঘার সাদা সাদা বরফে ঢাকা চুড়া। মেঘের ফাঁক দিয়ে ওই উচুতে উঁকি দিচ্ছে। সেই কবে একটা বই পড়েছিলাম কাঞ্চনজংঘার উপর। টয়ট্রেনে চড়ে মেঘের ভেতর দিয়ে হিমালয়ের সেই যাত্রার বর্ননা ভুলতেই পারি না। চাইলে নাকি চুরি করে শিলিগুড়ি দিয়ে পালিয়ে একেবারে দার্জিলিংও চলে যাওয়া যায়। কিন্তু আমার পকেট তখন গড়ের মাঠ। বাড়ী ফেরার গাড়ী ভাড়া একশো বিশ টাকা বাদে আর কিছু নেই। কিন্তু থাকিতে বন্ধু ভয় কি রে তোর। সাব্বির বললো নো চিন্তা আমি আছি। কথা সত্য, সাব্বির থাকা মানে টাকার ভাবনা উসুল। ওর সাথে আমার অলিখিত চুক্তি হলো, আমার পকেট গড়ের মাঠ হলে সেটা পুর্ন করার দায়িত্ব ওর, আর ওরটা গড়ের মাঠ হলে দায়িত্ব আমার।

রাত দশটার মধ্যে টিকেট করে গাবতলী থেকে ফেরার পথে আমার পকেটে একটা পাঁচশত টাকার নোট গুঁজে দিয়ে সাব্বির বললো, এটা পথ খরচ, লাগলে খরচ করিস, না লাগলে ফেরত দিস। আমাকে আর পায় কে। জোশ একটা ভ্রমনের স্বপ্ন নিয়ে ওর বাসায় ফিরে ঘুম একচোট। ওর ব্যাচেলর ঘরে আমাদের সব বন্ধুদের আড্ডা ছিল। আমরা সবাই বেকার, ও একমাত্র চাকরীজীবি। বেডরুমটা পুরো কার্পেটে ঢাকা। ওখানে যে যার খুশী মতো বালিশ রেখে ঘুমোই আমরা। চাঁটগা থেকে যারা ঢাকা যাই সব বন্ধুর আশ্রয় ফকিরাপুলের ওই বাসাটা। এমনকি ঢাকার বন্ধুরাও বাসায় ভালো না লাগলে এখানে এসে ফ্রী থাকা খাওয়া চালিয়ে যায় দিনের পর দিন। সাব্বিরের বেতনের সিংহভাগ অংশ বন্ধুদের পেছনেই যেত। ওর উদারতা আমাদের সম্পদ। কি এক অবাক দিন গেছে তখন।

পরদিন বিকেলে বাস ছাড়লো গাবতলী থেকে। তখনো যমুনা সেতু হয়নি। লালমনিরহাটগামী যে বাসটিতে আমরা উঠলাম সেটি ছিল একটা লোকাল বাস। ঠাসাঠাসি ভিড়। দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। এটার নাকি বারো থেকে আঠারো ঘন্টা পর্যন্ত লাগাতে পারে পৌছাতে। ফেরীতেই লাগতে পারে তিনঘন্টা। দীর্ঘ ক্লান্তিকর একটা যাত্রা। কিন্তু দীর্ঘ যাত্রার কথা শুনে কারো চেহারায় এতটুকু বিরক্তি এলো না। বরং দীর্ঘ আড্ডার লোভে চিকচিক করছে সবকটি মুখ। পথে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে বিদঘুটে অভিজ্ঞতা হলো রংপুর পেরুনোর পর। একটা সেতু পেরুনোর পর পর। ওই সেতুটা (সম্ভবতঃ তিস্তা এতদিন পর সঠিক মনে নেই) পেরুনোর পর বাসটা থেমে গেল। রাত দুটো বাজে তখন। নিঝুম নীরবতা চারিদিকে। বিরান সেই অন্ধকারে আশেপাশে কোন লোকালয় ঠাহর করা গেল না। জানা গেল সামনের রাস্তাটা ভালো না। প্রায় দশ মাইলের মতো রাস্তায় নাকি ডাকাতের রাজত্ব। একা কোন গাড়ী পার হয় না রাতের বেলা। আরো গাড়ী আসলে সবাই লাইন ধরে একসাথে চলবে সাথে থাকবে একটা পুলিশের এসকর্ট ভ্যান। শুনে আমরা তাজ্জব মানলাম। বাংলাদেশে এরকম ভয়ংকর জায়গাও আছে যেখান দিয়ে একটা বাস একা পেরুবার সাহস পায় না। প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষা করার পর আরো কয়েকটা বাস এসে লাইনে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন পর কোত্থেকে একটা পুলিশের গাড়ীও চলে এলো। আমাদের বাসটার সামনে এসে পুলিশের গাড়ীটা দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর সবগুলো ড্রাইভারের সাথে কথা বলে প্রথমে পুলিশের গাড়ী তার পেছন পেছন আমাদের গাড়ীটা, তারপর অন্যগাড়ীগুলো এগোতে লাগলো। এতক্ষন ভয় লাগেনি, কিন্তু পুলিশ দেখে বিপদের গুরুত্বটা বেড়ে গিয়ে ভয়টা জেঁকে বসলো। দুপাশের অন্ধকারে সতর্ক চোখে দেখছি কোন নড়াচড়া আছে কিনা। এই রাস্তার দুপাশে অন্তত পাঁচ-সাত মাইল নাকি কোন জনবসতি নেই। বিশাল প্রান্তর চিরে বেরিয়ে গেছে রাস্তাটা। এলাকাটা একেবারে জনবিরল। আমি সামনে পুলিশের গাড়ীর দিকে তাকিয়ে জুবুথুবু বন্দুক জড়িয়ে থাকা পুলিশদের বসে থাকতে দেখলাম। মনে হলো হাতের বন্দুকগুলো ওদের বোঝা বাড়ানো ছাড়া তেমন উপকারে আসে না। হয়তো গুলিও নেই ভেতরে। সত্যি সত্যি সামনে ডাকাতদল পড়লে ওরাই হয়তো সবার আগে ছুটে পালাবে ওই অন্ধকারে। দীর্ঘসময় লাগিয়ে আমাদের কাফেলা একটা মোড়ে পৌছালো। ওখান থেকে একটা পথ কুড়িগ্রাম, আরেকটা লালমনিরহাটের দিকে চলে গেছে। এখান থেকে নিরাপদ যাত্রা। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লালমনিরহাটের পথ ধরলাম।

আরো বেশ কয়েকঘন্টা যাবার পর পাটগ্রামে এসে পৌছালাম। সকাল হয়ে গিয়েছিল ততক্ষনে। কেমন একটা পরিত্যক্ত শহরের মতো লাগলো দেখতে জায়গাটা। লোকজন তেমন নেই রাস্তায়। ভ্যানগাড়ী দেখা গেল দুয়েকটা। বুড়ীমারী সীমান্তের কাছেই ওদের অফিস। বাসটার শেষ যাত্রী আমরাই। যেই কোম্পানীর বাসে করে গিয়েছি সেই বাসের কন্ডাকটরের সাথে খাতির করে নিয়েছিলাম আমরা যাবার পথেই। একরাত এখানে কাটাবো। রাতে থাকার জন্য বাস কাউন্টারের পেছনে একটা ঘরের ব্যবস্থা হয়ে গেল এই খাতিরের সৌজন্যে। গাড়ী থেকে নেমে বাস কাউন্টারে ঢুকলাম সবাই। টিনশেড একটা বাড়ীর সামনের রুমটা অফিস, পেছনের ঘরে বাসের ষ্টাফদের থাকার জায়গা। ওটাই আমাদের জন্য ছেড়ে দেয়া হলো অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে। আমরা তখন যাহা পাই তাহাতেই আনন্দিত। বাসের লোকদের সহায়তায় সকালের চা নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো। পরোটা ভাজি চা।

চা নাস্তা সেরে বেরুলাম সীমান্ত দেখতে। আমাদের থাকার আস্তানা থেকে সোজা নাক বরাবর একটা রাস্তা চলে গেছে। ওদিকে কয়েকশোগজ পরেই সীমান্তের গেট। এখানে রাস্তাগুলো ভীষন পরিষ্কার, সুন্দর। দুপাশে সারিবদ্ধ গাছ লাগানো। হেঁটে হেঁটে বুড়ীমারী সীমান্তের যেখানে বাংলাদেশের সীমানা চিহ্নটা আঁকা হয়েছে ওখানে দাঁড়ালাম। কে জানি নিষেধ করলো ওখানে দাঁড়াতে। নো ম্যানস ল্যান্ড। মানুষের জীবনে স্বেচ্ছায় নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়ানোর সুযোগ খুব বেশী আসে না। নিষেধ শুনে সরে আসতে হলো। বামপাশে কাষ্টমসের অফিসঘর। ডানদিকে সুন্দর একটা নদী। ওটার এপাশ বাংলাদেশ, অন্যপাশ ভারত। নদীটা এত সুন্দর পরিষ্কার টলমলে জল। স্রোত আছে বেশ। পাহাড়ী নদী, ভারতের হিমালয় থেকে কলকল করে বরফগলা জল বয়ে আনছে এই সমতল ভুমিতে।

ওখানে বেশ কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম আমাদের আবাসে। ওখানকার একজন বললো তিনবিঘা করিডোর নাকি খুব কাছেই। চাইলে যেতে পারি। গেটটা একঘন্টা পর পর আধঘন্টার জন্য খোলে দিনের বেলা। এক দৌড়ে ভ্যানগাড়ীতে বেড়িয়ে আসতে পারি। বাহ, তিনবিঘা করিডোর? কত লেখাজোকা পড়েছি ওটা নিয়ে। এরকম বিরল একটা সুযোগ পাবো এখানে এসে চিন্তাই করিনি। দেরী না করে একটা ভ্যান ভাড়া করে ছুটলাম। যেতে হবে পাটগ্রাম হয়ে। যেতে যেতে বিশাল প্রান্তর পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কাঁটাতার ঘেরা সীমান্তে। গেট বন্ধ এখন। ভ্যানওয়ালা জানালো আরো একঘন্টা পর খুলবে। এখানে একটা কেমন অস্তস্তিকর পরিবেশ। ভীষন কড়াকড়ি যেন। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের পোষ্ট দেখলাম করিডোরের মাঝখানে। ওদের মধ্যে রনসজ্জা, যেন এই মুহুর্তে যুদ্ধ বেধে যাবে। আমাদের বিডিআর পোষ্ট বেশ খানিকটা ভেতরে হওয়াতে অস্তিত্ব টের পাওয়া মুশকিল। ওপাশে বাংলাদেশ এপাশেও বাংলাদেশ। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ঝকঝকে ভারতীয় রাস্তা। ভারতের ওই অংশটার সাথে বাংলাদেশের পার্থক্যটা বেশ পরিষ্কার। বাংলাদেশ অংশটা ভীষন দরিদ্র মনে হলো।

আমরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম তিনবিঘা করিডোর। ওপাশে একটা বাংলাদেশ আছে যেটা আক্ষরিক অর্থে বন্দীশালা। কেউ ইচ্ছে করলেই ওখান থেকে যখন তখন চলে আসতে পারবে না এই অংশে। রাতে যদি কেউ মরেও যায় গেট খুলবে না। হাসপাতালে নেবার দরকার হলেও পরদিন ভোর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নিয়ম ভীষন কড়াকড়ি ভারতীয় তরফ থেকে। আমরা ভ্যানঅলার কাছ থেকে এসব তথ্য পাচ্ছিলাম, আর বিষন্ন হয়ে পড়ছিলাম।

এমন সময় একটা বিকট চিৎকার এলো কোথা থেকে জানি। তাকিয়ে দেখি বিএসএফ পোষ্ট থেকে বন্দুক উঁচিয়ে আমাদের দুরে সরে যেতে বলছে। ভ্যানঅলা বললো এখানে দাঁড়ানো নিষেধ। এই গেট ওদের। গেটের জায়গাটুকুও ওদের। আমরা গেটের একফুটের ভেতর চলে গেছি তাই গেট থেকে তফাত যেতে বলছে ওই সৈনিক। সরে গেলাম। কিন্তু এত রূদ্রমুর্তির কারন বুঝলাম না। গিয়ে পাশের প্রান্তরের ঘাসগুলো মাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম সবাই। ভারতীয় কাঁটাতার থেক দুই ফুট দুরত্ব বজায় রাখতে হলো। আমাদের তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করছে সৈন্যদল। দেখে মেজাজ এমন খারাপ হলো, হঠাৎ এক বন্ধু বললো, আমার পেশাব করতে হবে। দাড়া বাংলাদেশে দাড়িয়ে ইন্ডিয়ার কি করে বৃষ্টি ঝরাই দেখ।

বন্ধুর সাহস দেখে আমরা তাজ্জব। কিন্তু সাহস ব্যাপারটা যেন সংক্রামক। হুমকি আছে জেনেও জিপার খুলে বাকীরাও লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। আইন মেনে কাঁটাতার থেকে দুইফুট দুরে দাঁড়িয়ে ওইপারে জল ঝরাচ্ছে একদল বেপরোয়া তরুন। বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে ভারতে জলত্যাগ। একটা অহিংস প্রতিবাদ, ভারতীয় সহিংস হুংকারের প্রতিবাদে। যে কোন মুহুর্তে একটা হুংকার বা গুলি ছুটে আসতে পারে। কিন্তু আমরা তখন মরিয়া। শালার যা হবে হোক। এই কাজ দেখিয়ে যাবো তোদের। আশ্চর্য এবার কোন হুংকার এলো না। নির্বিঘ্নে কাজ সেরে সবাই বিজয়ী উল্লাস করে উঠলো। যাক ব্যাটাদের একটা শিক্ষা দেয়া হয়েছে আইন মেনেই।

গেট খোলার সময় হলে আমরা লাইন ধরে দাঁড়ালাম। করিডোরটা বোধহয় একশো গজের মতো হবে। করিডোরে প্রবেশ করে আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে পেরোচ্ছি ভারতীয় অংশটা। অদুরে বিএসএফ সৈনিকদের হেলমেট পরা মুখ আংশিক দেখা যাচ্ছে বালির বস্তার পেছনে সাব মেশিনগানের নলের পাশে। আবারো একটা চিৎকার। আরে মুশকিল, এখন সমস্যা কি তোর, চিল্লাস কা? কি বললো বুঝলাম না। কিন্তু চিৎকার চলছেই। একজন বুঝলো, বললো এত আস্তে হাঁটলে চলবে না। দৌঁড়ে জোর কদমে পেরিয়ে যেতে হবে জায়গাটা। হেলে দুলে হাঁটার কোন অবকাশ নেই। আজব! আমার আধঘন্টায় আমি যেমন খুশী তেমন করে পেরুবো। তাতে তোদের কি। কিন্তু না, আধঘন্টা আমাকে দেয়া হয়েছে জরুরী গতিতে পেরুবার জন্য। আয়েশ করে নয়। হেলেদুলে চলা এই জায়গায় নিষিদ্ধ। মেজাজ আবারো টং হলো সবার। এ কোন জাতের কথা? কি রকম চুক্তি হলো এটা? দুজনরে সমান সমান ব্যবহার করার কথা শুনেছি এতদিন। এখন এসব কি? পুরোটাই তো ওদের নিয়ন্ত্রনে। আমাদের কিছু করার নেই।

যাই হোক অবশেষে পা রাখলাম অন্য বাংলাদেশে। এটা একটা ভুমি দ্বীপ। আঙরপোতা দহগ্রাম নামে দুটি গ্রাম এখানে। দোকানপাট দেখে চা খাওয়ার উসিলায় স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলার সুযোগ নিলাম। চা দোকানের টুলে দুটো বাংলাদেশী পুলিশকে লাঠি হাতে বসে থাকতে দেখলাম। বললাম, সারাক্ষন এই হুমকির মধ্যে থাকেন কি করে আপনারা, ভয় করে না? উত্তরে যা বললো শুনে ভিরমি খেলাম রীতিমতো। বললো, ওদের ভয় বেশী তাই এত হুংকার করে। ওদের মেশিনগানের সাথে আমাদের এই লাঠিই যথেষ্ট। লোকটা রসিকতা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম। যাই হোক, দেশপ্রেমের জোর আছে দেখে ভালো লাগলো। ওখানকার বেশীরভাগ মানুষের মধ্যে এটা দেখেছি। আমি ভাবতাম ওরা ভারতীয় বাহিনীর ভয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকবে সারাক্ষন। কিন্তু সীমান্তের লোকজন নাকি একটু বেপরোয়া রকমের সাহসী হয়। হতেই হয় বোধহয়, নইলে টিকতে পারবে না। ওরা দেখলাম থোড়াই কেয়ার করে ওসব হুংকার হুমকি ধমকি। আরেকটা কথা মনে হলো সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের দেশপ্রেমের জোরও বোধহয় অন্যদের চেয়ে একটু বেশী।

গেটটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষনে। আরো একঘন্টা ফেরা যাবে না। আঙরপোতার আরেকজন মানুষের সাথে কথা হলো। তিনি বললেন, বাংলাদেশ অংশে চাষের কাজ করেন তিনি। দুপুরে তার নয় বছরের মেয়েটি ভাত নিয়ে যায় ক্ষেতে। গেট বন্ধ হয় একটায়, মেয়েটা তার আগেই খাবার দিয়ে যায়। মেয়েটা যদি কখনো এক মিনিট দেরী করে, তাহলে তাকে একঘন্টা না খেয়ে বসে থাকতে হবে। বাপ এই পারে, মেয়ে ওই পারে। কতবার ঘটেছে ওরকম! এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে রাতে কোন বিপদ হলে সমস্যা। ভোর না হওয়া পর্যন্ত মরে গেলেও গেট খুলবে না।

হাবিজাবি নানা গল্পের পর গেট খোলার সময় হয়ে গেলে আমরা ফেরার জন্য উঠলাম। ওপাশে ভ্যান অপেক্ষা করছিল তখনো। জোর কদমে পেরিয়ে গেলাম তিনবিঘা করিডোর। ওপারে পৌঁছে ফিরে তাকালাম ভুমিদ্বীপ বাংলাদেশের দিকে। কী অদ্ভুত জীবন এখানকার মানুষের। স্বাধীনতা শব্দটার মানেটা সম্পূর্ন অন্যরকম ওখানে।

পাটগ্রামে এসে খেয়াল হলো দুপুরের খাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে খাবার দোকানপাট তেমন নেই। একটা হোটেল পেয়ে ঢুকে গেলাম। মুরগী অর্ডার দিতে গিয়ে দাম শুনে টাশকি খেলাম। এত সস্তা! সেই তুলনায় ডিমের দাম বরং বেশী। দশটা ডিমের দাম দিয়ে একটা আস্ত মুরগী পাওয়া যাবে। দেশী মুর্গীর ঝোল দিয়ে মোটা চালের ভাত দারুন লাগলো। দিনভর আরো ঘোরাঘুরি হলো অনেক। ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় তাসের আড্ডা চলার সময় একজন বাইরে থেকে খবর আনলো এখানে ভুটানী 'সরবত' পাওয়া যায়। সুখবর পেয়ে রাতের খাবার সেরে দুটো বোতল যোগাড় করা হলো। পনেরো মিনিটের মধ্যে খালাস বোতলের ‘সিরাপ’। তারপর সবাই রাস্তায় বেরুলাম হাঁটতে। বাহ, দারুন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ভারতে যাবার রাস্তাটা একদম নির্জন এখন। দুয়েকটা কুকুর বাদে রাস্তায় আমরাই আছি কেবল। রাত বারোটা বাজে প্রায়। আমরা আধপাগল কয়জন তরুন এলোমেলো হাঁটছি। বেসুরো গলায় গান গাইছি। বিশেষ করে সাব্বিরের গান শুনলে রবীন্দ্রনাথ মাটির নীচ থেকে কঁকিয়ে উঠতো। ব্যাটার সারেগামা এত উচ্চমার্গের।

দুপাশের গাছের সারিগুলো ছায়ার মতো দাড়িয়ে আছে। আমাদের চোখে ঘুম নেই। রাস্তার ধারে কয়েকটা ভারতীয় ট্রাক দেখা গেল আমদানী পন্য নিয়ে এসেছে। ট্রাকের নীচে চুলা জ্বেলে রান্না চড়িয়েছে শিখ ড্রাইভার। আমাদের মধ্যে রুপু ছিল দুষ্টের শিরোমনি। সে এগিয়ে গিয়ে বাতচিত শুরু করলো তাদের একজনের সাথে। আধখেচড়া ভাষার জগাখিচুড়ীতে কিছুই বুঝলাম না। রুপু ফিরে এসে বললো, আরে ওদের সাথে কথা বলা তো সোজা। খালি বলবি "ইধার কা মাল কুধার যাতা হু।" তারপর খাতির হয়ে যাবে দেখবি। আমরা সেই শিখলাম। যতক্ষন ওই জায়গায় ছিলাম, ইধার কুধার বলতে বলতে হেসে খুন একেকজন।

পরদিন দুপুরে খাওয়ার পর পর আমাদের ফেরার পালা। আমার খুব মাথা ধরেছিল, বমি বমি লাগছিল। আমি একটা এভোমিন ট্যাবলেট খেয়ে বাসে উঠে চোখ বুঝে থাকলাম। রুপু সাব্বির সিদ্ধান্ত নিল বাসের মধ্যে একবোতল ভুটানী সিরাপ রাখবে, বাকী আঠারো ঘন্টার যাত্রায় এক চুমুক করে খেতে খেতে ঢাকায় পৌঁছাবে। ওরা ডানকানের একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতলে ভরে নিল সিরাপটা। আসলেই দেখতে লাগছে লাল গোলাপী রূহ আফজা সিরাপের মতো। মাথার উপরে মালামাল রাখা তাকে প্রকাশ্যেই রেখে দিল বোতলটা। বাস ছাড়তেই একটু পরপর গলা শুকিয়ে গেছে বলে, একেকজন একেক চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। আমি এভোমিনের নেশায় টাল হয়ে ঘুমোচ্ছি, ভুটানী সিরাপে আমি নেই। নগরবাড়ী ফেরীর আগ পর্যন্ত আমি প্রায় বেহুঁশ ছিলাম। ফেরীঘাটে পৌছে অন্য যাত্রীরা সবাই নেমে গেল আমরা কজন বাদে। একটুপর ড্রাইভার এলো আমাদের কাছে। চেহারা সুরত পরখ করে হো হো করে হেসে উঠলো সে। বললো, দাদারা যে লাইনের লোক, আগে বলবেন তো। আমিও তো লাইনের মানুষ। আসেন একসাথে খাই, আমারও আছে। নেমে গেল ওরা, আমি বাসে একা। পরে জেনেছি ড্রাইভার বেশী টানেনি গাড়ী চালাতে অসুবিধা হবে বলে। তবু এখন ভাবতে শিউরে উঠি, ওই সময়গুলোতে কিরকম বেপরোয়া ছিলাম আমরা।

আধমাতাল ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে যখন ঢাকায় প্রবেশ করছে আঁধার কেটে তখন ভোরের আলো ফুটছিল ঢাকার আকাশে। আমাদের চোখে, মুখে, শরীরে ক্লান্তিকর অবশ অনুভুতি। সীমান্ত ভ্রমনের স্মৃতি যেন মুছে গিয়ে বিছানার ডাকটা খুব মধুর শোনাচ্ছিল। পরবর্তী আটঘন্টা বেহুশের মতো ঘুমোলাম সবাই সাব্বিরের বাসার কার্পেটে।

আমাদের হারানো গল্পের বাগান

তুমি যাবার পর থেকে আমার গল্পগুলো থেমে গেছে। যদ্দিন তুমি ছিলে আমি ছিলাম এক নিটোল গল্পকার। একেকটা গল্পের একেকটা জীবন্ত চরিত্র নিয়ে তোমার আগ্রহ আমার গল্প বানাবার উৎসাহকে জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত করতো। আমার সকল গল্পের একমাত্র পাঠিকা ছিলে তুমি। আমার কোন গল্প কখনো কোথাও পাঠাইনি। তুমি জানতে আমার গল্পে কখনো বানোয়াট চরিত্র থাকে না। চারপাশের মানুষগুলো নিয়েই আমার যত গল্প। তাই আমার গল্প নিয়ে তোমার বিপুল আগ্রহ। গল্পের মাঝে কখনো কখনো সংলাপ তৈরীতে মেকাপ দিতে হলেও চরিত্র চিত্রনে কোন আলগা প্রয়াস ছিল না। গল্পগুলো লিখতে লিখতে আমি কখন তোমাকেও গল্পের একটা চরিত্র ভাবতে শুরু করেছিলাম নিজেই জানি না। তোমার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তাই তোমাকেও গল্পে সম্পৃক্ত করলাম আজ। তুমি আমার গল্প মানুষ? তোমার আমার গল্পের সুচনা হয়েছিল কিভাবে? আমাদের গল্পের প্রথম সংলাপটি ছিল তোমার। তোমার প্রথম সংলাপটি যখন আমার প্রাঙ্গনে এসে পৌছল তখন আমি ভীষন একা। সেই একাকী সময়ে গল্প করার মতো কাউকে বড় প্রয়োজন ছিল। তোমারও হয়তো। তবে আমার দ্বিতীয় সংলাপ নিক্ষেপে খানিক বিলম্ব হওয়াকে তুমি হতাশার সাথে প্রকাশ না করলে আমাদের দুজনের গল্পকার হওয়া হতো না। তোমার সেই হতাশার মধ্যে একটা সুপ্ত আকুলতা ছিল যাতে আমি সবুজের প্রতিশ্রুতি দেখেছিলাম। তৃতীয় সংলাপের পর সেই সবুজের কুড়িটি পাতা মেলতে শুরু করলো। তারপর একদিন পত্রপল্লব বেড়ে গিয়ে আমাদের বিশাল গল্পের বাগান গড়ে উঠলো। নিয়মিত পরিচর্যায় আমাদের গল্প বাগানে হরেক রকমের ফুল ফুটলো, পাখপাখালীর আগমন ঘটলো, গান হলো, কবিতা হলো। ধীরে ধীরে গল্প যেন উপন্যাসে রূপ নিল। বিস্ময়ের ঘোর কেটে উপন্যাসের যাত্রাপথে একদিন তোমার ডাক এসে গেল আচমকা। নিরুপায় তুমি আমাকে ছেড়ে উড়াল দিলে নতুন গন্তব্যে........ চিরতরে। তোমাকে গল্প বলার, তোমার গল্প শোনার আর কোন সুযোগ রইল না আমার। আজ তোমার আকাশে নতুন ভোর, নতুন সূর্যোদয়, নিত্য নতুন প্রতিশ্রুতি। আমাদের সেই গল্প বাগান এখনো সেই খানেই আছে, তবে নিঝুম নিস্তব্ধতায় নিথর পড়ে আছে। বহুদিন কোন নতুন ফুল ফোটেনি, পাখপাখালি আসে না। সাপখোপ আর ইঁদুরের বসতি আগাছায় ভরা সেই বাগানে আমি আর হাঁটাহাঁটি করি না আজকাল। আমাদের গল্পগুলো কি আর কখনো প্রান ফিরে পাবে না? স্মৃতি কি প্রানহীন নিস্তরঙ্গ জলের আধার? তবু স্মৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে এত সুখ পাই কেন!

বিলম্ব পোষ্টঃ চট্টগ্রামে ইফতারাড্ডা (উৎসর্গ: পদ্মলোচন ও স্বপ্নবাজ)

সেদিন দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনে লাঞ্চটা শেষ করে সিগারেটে আগুন দিতেই যে ফোনটা এলো সেটা এক প্রত্যাশিত সুখবর। আমাদের প্রিয় ব্লগার ও হবু ব্যারিষ্টার জাবীর জানালো ভিসাটা হয়ে গেছে। সুখবরটা সেলিব্রেট করার কোন উপায় নেই চাটগা থেকে। তবু জেনে ভালো লাগছে ঢাকার ব্লগারগন শুক্রবারে একটা অনুষ্ঠান করছেন। খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও থাকতে পারছি না বলে জাবীরের কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

গত কিছুদিন ধরে আক্ষরিক অর্থেই দৌড়ের উপরে ছিলাম, এখনো কিছুটা। তাই ব্লগেও আসা হয় না ঠিকমতো। লেখার সময় নেই, পড়ার সময় নেই, আড্ডা দেবার সময় তো নেই নেই হয়ে গেছেই। আসলে ঈদের বন্ধের পর থেকে আগের সব রুটিন বদলে গেছে যেন। খেই হারিয়ে ঘুরে মরছি এলোপাথাড়ি যেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত কখনো কখনো অফিসে কাটাই।

জাবীরের সাথে মাত্র একবারই আড্ডা দেবার সুযোগ পেয়েছিলাম। গতমাসে জাবীর চট্টগ্রাম এলো কাজে, ফোনে ঠিক করা হলো আমি অফিস শেষে ওকে নিয়ে ইফতার আড্ডায় বসবো। পাওয়া গেল আরেক চাটগাইয়া ব্লগার স্বপ্নবাজকে। আমার সাথে সেই প্রথম দেখা স্বপ্নবাজের সাথেও। যে ঠিকানায় জাবীরকে থাকতে বললাম সেটি ইস্পাহানী মোড়ে পিটস্টপ রেষ্টুরেন্ট। আমার অফিস থেকে ওখানে যেতে বড়জোর আধঘন্টা লাগে। কিন্তু ইফতারপূর্ব জ্যামের কারনে লেগে গেল দুইঘন্টা। যখন রেষ্টুরেন্টে পৌছালাম তখন মসজিদে ফু দেয়া শুরু হয়ে গেছে। আজান দেয় দেয় অবস্থা। আমি পুরো রেষ্টুরেন্টে হেটে বেরিয়ে কোথাও জাবীরকে পেলাম না। আজব।

পাঁচ মিনিট আগেও কথা হলো ওর সাথে গেল কই। বলেছিলাম ইফতারীর টেবিলের দখল নিয়ে বসে যেতে, নইলে পরে জায়গা পাওয়া যাবে না। সবগুলা মানুষের চেহারা দিয়ে ঘুরে এলাম, না জাবীর নয় একটাও। আমি ভুল করছি না তো দেখতে? আগে তো দেখিনি? ছবির সাথে আসল মানুষের মিল থাকে না। কি করি দিলাম ফোন আবার। তারপর নজর রাখলাম কার ফোন বাজে আর কার ঠোট নড়ে, গোয়েন্দা নজরে অনেকের ঠোট নড়তে দেখছি, কানে চোঙা লাগিয়ে অনেকেই কথা বলছে। জাবীরের সাথে আমিও বলছি। জিগাইলাম, কই তুমি। সে কয়, দাদা আমি তো এইখানে। আমি কই, আমিও তো এইখানে। কি মুশকিল। এত মানুষ মোবাইলে কথা বলে, কে কার কথা শোনে। ব্যাটারা ইফতারের আগে ইকটু চুপটি কর, আমি খুজে বের করি পদ্মলোচন জাবীরকে, ইফতারীর সময় যে পেরিয়ে যায়!!!

হঠাৎ নজরে পড়লো এক হুজুরের দিকে। জোব্বাজাব্বা পাগড়ী পড়া এক হুজুর মনে হলো আমার ফোনের তালে মাথা নেড়ে কথা বলছে, কি জানি সন্দেহ করে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। কাছাকাছি গিয়ে শুনি আমার ফোনে সেই শব্দ, এই হুজুরও সেই কথা বলে। খাইছে, এই হুজুরই তো জাবীর........ব্যাটা করছে কি? এই বেশভুষা লাগাইছে ক্যান? আমি দুইবার ওর পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি, ভেবেছি কোন মওলানা ইফতার খেতে এসেছে এখানে। জাবীর ততক্ষনে চিনে ফেলেছে আমাকে। উঠে এলে জড়িয়ে ধরলাম হেসে। ওর সাথে এক বন্ধুও আছে। যাক ইফতার করা যাবে তাহলে। হাপ ছাড়লাম। কিন্তু তখনো স্বপ্নবাজ আসেনি। রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে আজানের সাথে সাথে স্বপ্নবাজও হাজির। এরপর ইফতার, গপসপ, আড্ডা, চায়ের তেষ্টা। চায়ের অনুরোধ করতে দেরী হয়ে গেছে বলে সিরিয়ালে পেছনে পড়ে গেলাম। আমাদের ভাগ্যে চা জুটলো না, বলা হলো আরো বসতে হবে চা খেতে হলে। দুচ্ছাই অতক্ষন চা খেতে কে বসে থাকে, তারচে আমার বাসায় গিয়েই খাই চা। বাসায় গিয়ে চা খাওয়া হলো, আরেক দফা আড্ডা হলো।

তারপর ফেরার পালা এলো। জাবীর শরীর ঠিক রাখতে রাতে খায় না, এটা নিয়ে স্বপ্নবাজের সুন্দর কিছু মন্তব্য ছিল, দিলাম না এখানে। যাইহোক ডিনার বাদে ষ্টেশানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল ওরা। জাবীর কথা দিল লন্ডন যাবার আগে আরেকবার হবে আসা। আরো একটা আড্ডা সময়। কিন্তু হলো না আর। জাবীর তার আগেই চলে যাচ্ছে। এরপর আড্ডাটা হবে পরিপূর্ন ব্যারিষ্টারের সাথে। সেই দিনের প্রতি চোখ মেলে থাকলাম। জাবীরের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

ট্রান্সলেশান করো : ফাকি সব খরে রব রাতি ফোহাইল

ইন্টারে পড়ার সময় আমাদের দুই বন্ধু এক রাতে বাড়ী ফেরার পথে পাড়ার এক পরিচিত পাড় মাতালের মুখোমুখি হলো। পঞ্চাশোর্ধ মাতাল যে ইন্টারভিউ নিয়েছিল সেটা বহুবছর বন্ধুমহলে আনন্দ যুগিয়েছিল।

-এ্যাই খোথায় যাইচ্চ তুম্বরা?
-বাসায় যাইতেছি চাচা
-খোত্তেখে আসতেচ?
-পড়াশুনা করে আসতেছি (ডাহা মিছা কথা, দুজনেই গঞ্জিকার ভক্ত, সেই কাজ সেরে বাড়ী ফিরছিল)
-কিসে ফড়ো?
-কলেজে ফড়ি
-বহুত ফড়াশুনা কইরচ, দেকি দুটা ট্রান্সলেশন করো তো, তাইলে বুইজব তোমরা ফড়াশুনা করি আসতেছ,
-জী বলেন
-ফাকি সব খরে রব রাতি ফোহাইল, খাননে খুসুম খলি সবি ফুরাইল..বল ইংরেজীতে বল এইটা তইলে বুইজব তোমার শিক্কিত পোয়া

বন্ধু দুজন ঘাবড়ে গেল। তাছাড়া ওরাও তখন ঝিমানিতে আছে। বললো চাচা আমরা একটু পেশাব সেরে আসি। পেশাবের নাম করে একটু আঁধারে গিয়ে, সামনের দেয়ালটা টপকে ভোঁ দৌড়। পেছনে শুনতে পাচ্ছিল মাতাল তখনো ট্রান্সলেশানের অপেক্ষায় চেঁচাচ্ছে.....

"...ফাকি সব খরে রব রাতি ফোহাইল, খাননে খুসুম খলি সবি ফুরাইল। না ফারলে তোমাদের বাফেরে লাগাই দিবো। এই খোথায় তোমরা........"

অপ্রত্যাশিত বিদ্যুতের চমক

গল্পটির সুত্রপাত হয়েছিল এইখানে। লেখক চা খেতে গিয়ে ডিনারও সেরে ফেলেছিল। ফিরে এসে গল্পটি সমাপ্ত করতে পাঠকের ব্যাপক অনাগ্রহ লক্ষ্য করে নিজের হাতেই আবার কোদাল চালাতে শুরু করলো। ফলাফল নীচে দেয়া হলো।

*********************************************************
ট্রেনটা ভুজপুর জংশনে এসে থামলো। বগিতে মৃদু আলো। বেশীরভাগ যাত্রী নেমে গেছে। বগির এই অংশে মাত্র দুজন মানুষ। দুজনেই নীরব। মেয়েটি তখনো বিষন্নমুখে বাইরে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি যেদিকে বসেছে সেদিকে লোকালয় নেই, দেখার কিছু নেই, ষ্টেশানের বিপরীত দিক ওটা। তবু মেয়েটি বাইরের দিকে চেয়ে আছে অনির্দিষ্ট দৃষ্টিতে। তরুনটি বই থেকে মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকালো। প্ল্যাটফরমে কতগুলো ফেরীওয়ালা বসা, ভবঘুরে লোকজনও দেখা যাচ্ছে কিছু।

দুজনের মধ্যে দুরত্ব বড়জোর পাঁচফুট। এই দুরত্বে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে কিভাবে কথোপকথন শুরু করে তরুনের কোন ধারনা নেই। সে যে দেশে পড়াশোনা করে সেই দেশে অবশ্য অপরিচিত মানুষকেও হাই হ্যালো করা যায়। এদেশে সেখানে কেমন সংকোচ কাজ করে। নারী হলে তো কথাই নেই। তরুনটি মুগ্ধ হয়ে তরুনীর বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কয়েকসেকেন্ড। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিল। সরাসরি তাকানো অভদ্রতা হয়ে যায়। আবার আড়চোখে তাকানোও ভব্যতার মধ্যে পড়ে না। তবে মেয়েটির মধ্যে এমন কিছু আছে না তাকিয়ে বেশীক্ষন থাকা যাচ্ছে না। ভদ্রতা করে হাই বলাও যাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটার সাথে পরিচিত হবার সুপ্ত একটা বাসনা ধীরে ধীরে দানা বাধছে সেটা রূপম ভালোই টের পাচ্ছে।

ট্রেনটা কতক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। খিদে পেয়ে গেছে রূপমের। কিন্তু খাবার নেই সাথে। খাবার দোকান খুঁজতে ষ্টেশানে নামতে সাহস পাচ্ছে না। গ্রামের ষ্টেশানগুলোর আশেপাশে বিস্কুট চায়ের দোকান থাকে, কিন্তু অচেনা জায়গায় নামার ব্যাপারে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল রূপমের বহুবছর আগে একবার। সেকথা মনে পড়তেই সে চিন্তাটা বাদ দিল। কিচ্ছু করার নেই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ফস করে ধরিয়ে ফেললো রূপম। খিদে পেটে সিগারেট যুত লাগে না, তবু নিঃসঙ্গতা কাটাতে সিগারেটের জুড়ি নেই। সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে ভাবনাগুলো কেমন খেলে যায়।

সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ নাকে যেতেই ভ্রু কুচকে জয়া জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে রূপমের দিকে তাকালো। এই প্রথম তার খেয়াল হলো বগির এই অংশে ওই তরুনটি ছাড়া আর কেউ নেই। সিগারেটের গন্ধ তার খুব বিশ্রী লাগে। গাড়ীতে যারা সিগারেট খায় তাদের প্রচন্ড ঘেন্নার চোখে দেখে সে। তরুনটি বাইরে তাকিয়ে আপনমনে সিগারেট টানছে। সিগারেটটা তরুনের ঠোঁটে কেমন বেমানান লাগলো। এত সুন্দর মানুষ সিগারেটের মত বিশ্রী জিনিস খায় কি করে। ঠোট কালো হয়ে যায় না? আশ্চর্য ব্যাপার যে সিগারেটের গন্ধে নাকে ওড়না দেবার বদলে জয়া ভাবতে বসে গেল অদ্ভুত একটা বিষয়ে- বেমানান ঠোঁটে সিগারেট। যেন এটি একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। ওটা নিয়ে কয়েক মিনিট এপার ওপার ভাবতে ভাবতে কাটালো।

সিগারেট টানার পুরোটা সময় রূপম বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল সচেতনভাবেই। সে নারী ও শিশুদের সামনে সিগারেট ধরায় না কখনো। আজ ব্যতিক্রম ঘটলো। অপরিচিত জায়গা বলেই কি? সিগারেট ধরালেও সংকোচে মেয়েটার দিকে তাকানো থেকে বিরত রাখলো নিজেকে। যেন ওই মেয়ের কোন অস্তিত্বই জানা নেই তার। ফলে তার জানা হলো না মেয়েটা তার দিকে কত মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিল পাক্কা দুমিনিট। সিগারেটের শেষাংশ বাইরে ছুড়ে দিয়ে বইটা খুলে বসলো আবার। এবার আর বইয়ে মন বসলো না। মেয়েটার দিকে ফিরে তাকাবার অবদমিত বাসনাটা জেগে উঠলো আবার। কিন্তু কিছুক্ষন আগের সিগারেট ধরানোর অপরাধবোধ তাকে সংকুচিত করে রাখলো। সংকোচ ধামাচাপা দিয়ে যখন সে চোখ তুললো, মেয়েটা তখন বাইরের অন্ধকারে ডুবে গেছে।

ট্রেনটা চলতে শুরু করলো আবারো। ট্রেন ও লাইনের ঝমঝম শব্দের ছন্দটা উপভোগ করছে রূপম। আরো এক ঘন্টার রাস্তা বাকী আছে হিসেবমতে। মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতে পকেট থেকে বের করে দেখলো আশিকের ফোন। কতক্ষন লাগবে জিজ্ঞেস করলো বন্ধু আশিক। পথের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সাবধান করলো। বলো সে ষ্টেশানে থাকবে গাড়ী নিয়ে।

জয়া না তাকিয়েও কথাগুলো শুনছে মন দিয়ে। বুঝতে পারছে ছেলেটা একটু আনাড়ী আছে। এত বড় মরদকে কত জ্ঞান দিতে হয়, যেন বাংলাদেশে নতুন এসেছে। যত্তসব। এসব জিনিস মাম্মী ড্যাডির ছেলে হয়, এটা নিশ্চিত। আবার সিগ্রেটও খায়। বাপরে বাপ.... ফ্যাশান কত। কাঁধের ব্যাগ দেখলে মনে হয় বিদেশী টুরিষ্ট। মনে মনে ছেলেটার সাথে ঝগড়া শুরু করে কেন যেন। যখন কিছু করার থাকে না এরকম মনে মনে খেলা জয়ার ভীষন প্রিয়। এমনকি মনে মনে প্রেমও করে কখনো কখনো। নির্দিষ্ট কারো সাথে নয়। কল্পনার সৃষ্টি সব। তবে এই ছেলেকে তার কল্পনার মানুষের সাথে মেলানো যাচ্ছে না। বেখাপ্পা টাইপ। তবু সামনে আছে এর সাথে প্রেম না হোক ঝগড়া করা যাক। সময় কাটবে তার।

সময় যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। আরো দুটো ষ্টেশান পেরোবার পর ট্রেনটা গতি ধীর করতে শুরু করলো হঠাৎ। একসময় ঝমঝম শব্দটা থেমেই গেলো। কি হলো? রূপম বই থেকে মুখ তুলে বাইরে তাকালো। জয়া জানালা থেকে একটু সরে আসলো। ট্রেন যখন অচেনা কোথাও থামে তখন বাইরে তাকানো নিরাপদ নয়। সে জানে, কিন্তু হাঁদারাম ছেলেটা জানে না বোধহয়। তাকে ওসব বিষয়ে ট্রেনিং দেয়নি মাম্মীডেডী? রূপম এবার পুরো মাথাটা বের করে দেখছে বাইরের অন্ধকারে।

জয়ার ভীষন রাগ হচ্ছে এবার ছেলেটার উপর। আরে বোকা করছো কি। বাইরে অত দেখার কি আছে। মাথা ঢোকাও ভেতরে। ধুর.......কিচ্ছু শুনছে না ছেলেটা। শুনবে কি করে, জয়াতো মনে মনেই চিৎকার করছে। যদি কেউ দায়ের কোপ মারে? জয়ার গাটা শিরশির করে উঠলো এবার। কিন্তু অপরিচিত মানুষ, তাকে কি করে বলবে। রাজ্যের সংকোচ এসে জড়ো হয় ।

ট্রেনটা চলতে শুরু করে আবার। রূপম মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে বইয়ে মন দেয়। জয়ার বুক থেকে একটা ভার নেমে যায়।

আরো প্রায় আধঘন্টার পথ। তারপর গন্তব্য। রূপমের একটু মন খারাপ হয়। আরো কিছুক্ষন যাওয়া যেতো যদি। মেয়েটার সাথে কথা বলার কোন ছুতো বের করা গেল না। গন্তব্যে পৌছে যাওয়া মানেই তো একটা আকাংখার অপমৃত্যু। সামনে আর কোন ষ্টেশান নেই। রূপম ছটফট করতে থাকে মনে মনে। কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকাতে পারে না সরাসরি। একবারও চোখাচোখি হয়নি ওদের।

জয়া কোথায় যাবে জানে না। মামার বাড়ী আর ফিরবে না বলে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছে। তার বাবা মা নেই। ঘনিষ্ট আত্মীয় বলতে এক খালা আছে, বিদেশে থাকে। দেশে এই মামা ছাড়া আর কেউ নেই। মামাই লালনপালন করেছে পনের বছর আগে দুর্ঘটনায় বাবা মা দুজনে মারা যাবার পর থেকে। ট্রেনটা তাকে যদি আজীবন বহন করে নিত। এই যাত্রা যদি কখনো শেষ না হতো, ট্রেনটাকে ঘরবাড়ী বানিয়ে যদি বিশ্বময় ঘোরা যেত। কত আবজাব ভাবে জয়া। মেয়েদের জন্য দেশটা মোটেও নিরাপদ নয়। তবু জয়া মরে গেলেও ফিরবে না ওই ঘরে। এত বড় অপমান সে সহ্য করবে না। সে এই ট্রেনেই আজকের রাতটা কাটাবে ঠিক করলো।

শেষ ষ্টেশান আসতেই রূপম তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। একবারো তাকালো না জয়ার দিকে। যেন তাকে খেয়ালই করেনি। মেয়েদের সাথে এরকম ভাব ধরা তার পুরোনো অভ্যেস। এতে করে দুর্বলতা এড়ানো যায়। রূপমের নেমে যাওয়া দেখে জয়ার একাকীত্বটা ভীষন চেপে বসলো। এতক্ষন সময়টা ভালোই কাটছিল, এখন কি করবে সে? একা এই বগিতে শুয়ে ঘুমোবে, শেয়াল কুকুরের খাবার হতে হবে না তার? রাতের বেলা একা একটা মেয়েকে পেলে মানুষগুলো কি পশু হয়ে যেতে পারে তা পত্রিকার পাতায় প্রায়ই পড়ে সে। আজ কি তার সেই দিন? হোক, আত্মহত্যাই হোক এভাবে।

কতক্ষন কেটেছে তার জানা নেই। ট্রেনের বাতিগুলো নিবে গেছে। সীটে হেলান দিয়ে তার ঘুমের মতো এসেছে। হটাৎ মোবাইল ফোনের শব্দে ঘোর কাটলো। আরে এ যে সেই ছেলেটার ফোনের রিংটোন। সেকি ফিরে এসেছে? কি করে সম্ভব। নাকি স্বপ্ন দেখছে। ফোন বাজছেই। খুব কাছে। অন্ধকারে দেখলো ছেলেটা যেখানে বসেছিল সেইখানে ফোনটা বাজছে অন্ধকারে নীলাভ আলো ছড়িয়ে। ছেলেটা ফোনটা ফেলে গেছে ভুলে।

ফোন তুলবে কি তুলবে না ভাবতে ভাবতে কেটে গেল লাইনটা। আবারো বাজলো ফোনটা। আবারো। তিনবার বাজার পর সংকোচে ফোনটা তুললো সে। রিসিভ করতেই ভেসে এলো সেই কন্ঠ। বহুল কাংখিত ছিল যেন এই ‘হ্যালো’ শব্দটা। কয়েকবার হ্যালো শোনা গেল ওপার থেকে। জয়া কয়েক সেকেন্ড পরে বললো হ্যালো। এই প্রথম কথা হলো ওদের।

-হ্যালো.....কথা বলছেন না কেন? (ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ বললো)
-হ্যালো...
-কে বলছেন?
-আমি..........
-আপনার হাতে ওটা আমার মোবাইল......
-জী আমি....মানে.....ফোনটা বাজছিল, ধরলাম
-ওটা আমার ফোন.... হারিয়ে গিয়েছিল, আপনি কোথায় পেয়েছেন
-আমি জানি না, আমি ঠিক..... (আমতা আমতা করে নারী কন্ঠ)
-দেখুন ফোনটা আমার দরকার, অনেকগুলো দরকারী নাম্বার ওখানে, আপনি কোথায় আছেন বলুন
-আসলে..... আমি জানি না আমি ঠিক কোন জায়গায়
-কি বলছেন? আপনি জানেন না আপনি কোথায়?
-আসলেই জানি না
-আপনি কি জোক করছেন? দেখুন ফোনটা দিতে না চাইলে না দিন, কিন্তু সিমটা আমার খুব দরকার, ওটা ফেরত চাই আমার।
-না না আপনি বুঝতে পারছেন না, আমি বোঝাতে পারছি না.....ফোনটা আপনি নিয়ে যেতে পারেন
-তাহলে আপনি কোথায় বলছেন না কেন এখনো? কোথায় আছেন বলুন.. টাকা পয়সা চাইলে দিতে পারি, কত লাগবে জানান
-ছি ছি আপনি কিসব বলছেন, আপনার ফোন আপনি নিয়ে যান, আমি আপনার ফোন নেব কেন?
-তাহলে ঠিক ঠিক বলেন আপনি এখন কোথায়
-আমি এখন ট্রেনে
-ট্রেনে মানে? কোন ট্রেনে?
-সেই ট্রেনে, যেই ট্রেনে আমি এসেছি,
-মানে?
-সেই ট্রেন....সেই শেষ ষ্টেশানে, যেখানে ট্রেন থেমেছিল, ষ্টেশানের নাম জানি না
-আশ্চর্য!! কি বলছেন? আপনি কে? আপনি কি ......
-আমি এই ট্রেনে এসেছিলাম
-আপনি সেই.......ট্রেন থেকে নামেননি আপনি এখনো??
-না
-কেন?
-কোথায় নামবো, আমার কোথাও যাবার নেই
-আশ্চর্য......আপনি....তবে কি বলি......ইয়ে আমি আসলে খুব সরি, অনেক আজেবাজে কথা বলেছি না চিনে......আমি ভেবেছি অন্য কেউ
-না ঠিক আছে, আমি তো চেনা কেউ না আপনার
-না না, ঠিক করিনি আমি.......আমি দুঃখিত
-আপনি এসে নিয়ে যান আপনার ফোন
-আসছি আমি এখুনি, আধঘন্টার মধ্যে, আপনি থাকুন
-আচ্ছা

ফোনটা আস্তে নামিয়ে রাখলো জয়া। ওটার নীলচে আলোটা নিভে গেল কয়েকসেকেন্ড পর। চারপাশে এখন নিকষ কালো অন্ধকার। অচেনা জায়গার অচেনা রাতের শব্দ। অন্ধকারে ওটার দিকে তাকিয়ে জয়া ভাবলো যে আলোটা এতক্ষন জ্বলেছিল একটু পর সেরকম একটা আলো আবারো জ্বলবে কয়েক মিনিটের জন্য। ফোনটা নিয়ে ছেলেটা চলে যাবার পর আবারো ফের সেই অন্ধকার। সেই একাকীত্ব। রাত ভোর হতে এখনো অনেক বাকী। সেই অজানা ভোরের প্রতীক্ষায় বসে থাকবে জয়া এই অচেনা ষ্টেশানে। ভোরটা কি দেখা হবে তার?



[পাদটীকাঃ গল্পটি আপাততঃ এখানে শেষ। তবে একটা গল্পের শেষ কখনো কখনো একটা উপন্যাসের সুত্রপাত করতে পারে। সেই সম্ভাবনা এখানে লুকিয়ে আছে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিছুটা নির্ভর করছে রূপমের উপর, কিছুটা জয়ার উপর। জয়ার জীবনটা কোন খাতে প্রবাহিত হবে সেটা কি রূপমের কোন হটকারী সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে? মানুষের জীবনের গতিপথগুলো অদ্ভুত, কখনো কখনো এক সেকেন্ডের একটা সিদ্ধান্ত আমূল পাল্টে দিতে পারে একেকটা জীবনের গতিপথ। কোন মানুষই এর বাইরে নয়। প্রতিটি মানুষের জীবনতো একেকটা ত্রিমাত্রিক উপন্যাস]

একটি গল্পের সুত্রপাত-

একটা গল্প লিখতে ইচ্ছে করছে। কি গল্প হবে এখনো জানি না। তবে গল্পের চটকদার একটা নাম ঠিক করা হয়েছে- "অপ্রত্যাশিত বিদ্যুতের চমক"। গল্পটা হতে হবে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু প্রানবন্ত। গল্পের মধ্যে সর্বোচ্চ দুজন চরিত্র থাকবে যার একজন পুরুষ আরেকজন নারী। অথবা দুজন পুরুষ কিংবা দুজন নারী। না, দুজন নারীকে নিয়ে ছোট গল্প লেখা যাবে না। কারন দুজন নারী একত্রিত হলে গল্প অনেক বড় হয়ে যাবে, সাধারনতঃ নারীগন স্বল্পভাষী হয় না। সুতরাং গল্পের আকার সংক্ষিপ্ত রাখতে দুজন পুরুষ কিংবা এক নারী এক পুরুষকে নিয়ে লেখাই শ্রেয়।

দুজন পুরুষকে নিয়ে গল্প দাঁড় করানো অবশ্য কঠিন। কারন পুরুষেরা পরস্পরের সাথে কথা বলে কম। অপরিচিত হলে তো মুখে রা টি নেই। তারচে বরং অচেনা নারী ও অচেনা পুরুষকে নিয়ে গল্প তৈরী করা যায়। দুই লিঙ্গের মধ্যে বিপরীত ও সহজাত আকর্ষনের কারনে গল্প হয়ে উঠতে পারে রোমান্টিক। কিন্তু না, রোমান্টিক গল্প লিখবো না। নারী ও পুরুষের দেখা হলেই কি রোমান্টিক গল্প হতে হবে? নারী পুরুষের মধ্যে অন্য সম্পর্ক হতে পারে না? আরো বেশী অর্থপূর্ন কোন সম্পর্ক? কি সেটা? প্রেম ছাড়া আর কি আছে? প্রেম কি পদ্যের মতো ছন্দময়? প্রেম ছাড়া অনুরাগের আর কোন প্রকাশ নেই? হয়তো আছে। সেটা পাঠকের মনে মনেও থাকতে পারে।

একটা কাজ করা যাক। গল্পটা না লিখে বরং পাঠককে গল্পের প্লট নিয়ে একটা ধারনা দেয়া যাক। পাঠকই ঠিক করুক প্রেমহীন একটা মধুর অর্থপূর্ন সম্পর্ক।

..........................................................................................................................
ধরা যাক একটি লোকাল ট্রেনের বগি। ধলঘাট ষ্টেশান থেকে ট্রেনে উঠেছে রূপম। কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর একগাদা বই। জানালার পাশে বসে রূপম নিবিষ্ট মনে বইয়ের ভেতরে ডুবে আছে। জানালা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সবুজের অপূর্ব সমারোহ। সূর্য তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তের পানে। বিকেলের সোনালী রোদে গ্রামগুলো যেন ধুয়ে যাচ্ছে। হেমন্তকাল তখন। হালকা কুয়াশার আস্তরন ভেসে আছে ধানক্ষেতের উপর।

মিনিট পনের পর কদলপুর ষ্টেশান থেকে একই বগিতে ট্রেনে উঠলো এক তরুনী। নাম জয়া। রূপম যেখানে বসেছে তার চেয়ে একটু দুরের একটা সীটে বসে পড়লো সে। যদিও লক্করঝক্কর লোকাল ট্রেন, তবে ট্রেনে ভীড় একেবারেই নেই। কারন এই সময়ে শহরমুখী যাত্রী থাকে না বললেই চলে। শহর এখনো অনেক দুর। এভাবে চললে ঘন্টা দুয়েক লাগার কথা। পথে আরো আটটা ষ্টেশান ধরার কথা। আরেকটা বড় জংশনে আধা ঘন্টার মতো থামার কথা একটা এক্সপ্রেস ট্রেনকে পার করে দিতে। ততক্ষনে সন্ধ্যে পেরিয়ে যাবে।

তবে এই তথ্যগুলো তরুন তরুনী দুজনেরই অজানা। কারন তরুন বিদেশ থেকে এসে বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিল। কোন কিছুই চেনে না সে। সে জানে কেবল এই ট্রেন যেখানে থামবে সেখানে তাকে নেমে যেতে হবে। ওখানে তার জন্য দাড়ানো থাকবে একটা গাড়ী। আর তরুনী এই পথে কখনো ট্রেনে চড়েনি। সে মামার বাড়ীতে থেকে পড়াশোনা করে। মামীর সাথে রাগ করে বেরিয়ে পড়েছে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে। ট্রেনটা ছুটে যাচ্ছে ঝমঝম করে, দিগন্ত চিরে।
.............................................................................................................................

পাঠকের মনে ভাবনার সুত্র ধরিয়ে দিয়ে লেখক চা খেতে চলে যান। গল্পটির সাইজ মোটামুটি ১০০০ শব্দের ভেতর রাখার ইচ্ছে লেখকের। তার মধ্যে ২০০টি শব্দ লেখা হয়েছে। লেখকের ধারনা চা খেয়ে আসতে আসতে পাঠক গল্পটি শেষ করে ফেলতে পারে মনে মনে। পাঠকের দেয়া সমাপ্তি দিয়ে গল্পটি শেষ করলে কেমন হয়? কি আছে পাঠকের মনে....? বাকী ৮০০ শব্দে কি ঘটতে পারে?

সুশীল বেয়াদবী

সবাই সুশীল হতে পারে না। একবার না পারিলে শতবার চেষ্টা করেও কেউ কেউ পুরোপুরি সুশীল হয় না। সুশীল হতে হলে জীনের সাহায্য লাগে। মানে জেনেটিক্যালি হয়ে আসতে হয়। ট্রেনিং, শিক্ষাদীক্ষা ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি নিয়ে কেউ সুশীল হতে পারে না। আমি ভদ্রসমাজে সুশীল ভান করে থাকি ঠিকই। কিন্তু রাস্তায় মেজাজ খারাপ হলে মুখ দিয়ে যা বের হয় তার সাথে সুশীলতা মেলানো যায় না। বিপরীত দিকে বখে যাবার জন্যও যোগ্যতা লাগে। আমি বাল্যকালে অতীব বখা ছেলেদের সাথে বেশ কিছুকাল কাটিয়েছি। ভেবেছিলাম বখেই যাবো। কিন্তু সম্ভাবনায় গুড়ে বালি। বখাও হলো না আমার।

ওদিকে সুশীলদের সাথে বসবাস করেও ঠিক খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। মাঝে মাঝেই দড়ি ছেঁড়া হয়ে যেতাম। তারুন্যের শুরুতে আমার কয়েকজন সুশীল বন্ধুবান্ধবকে দেখে সুশীলতার দীক্ষা নিতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুকাল। সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে মেলামেশা হতো নিয়মিত। পাড়ায় কবি বন্ধু ছিল একজন। তার সাথে ঘুরে ঘুরে কবি সমাজে সমঝদারের খাতির পেতে লাগলাম। কবিতার ক-ও বুঝি না, কিন্তু না বুঝেও কা কা করলেও দেখি কবি সমাজ মারহাবা মারহাবা করে খুশী হয়। কোন কোন আড্ডায় কেউ কেউ আনকোড়া কবিতা পড়তে দিয়ে মতামতও চায়। আমি চোখ আধবোঝা করে উচ্চমার্গীয়তার ভান করি। কবি খুশী হয়। ভাগ্যিস 'কি বুঝিয়াছো বৎস' বলেনি, বললে রাম ধরা। আসলে সেই সময়টাতে প্রচুর বই পড়তাম ঠিকই কিন্তু উত্তরাধুনিক বা পরাবাস্তব কবিতা জিনিসটা আমার মাথার উপর দিয়েই যেতো। কিন্তু যাদের সাথে মিশতাম তারা সবাই উত্তরাধুনিক পরাবাস্তব কবিতাই লিখতো। তাই কষ্টের দিন যেতো যেদিন কয়েকজন কবি একসাথে নতুন কবিতা লিখে আনতো।

একদিন আমার এই সুশীল হবার খবর সংবাদ পৌছে গেল পাড়ার এক নবীন দার্শনিক কবির কানে। আমার ধারনাই ছিল না ছোকরা কবিতা লেখে। এক দুপুরে তার মোটা কবিতার খাতাটা আমার হাতে দিয়ে বললো, ভাইয়া আপনি একটু দেখে দেবেন পত্রিকায় পাঠানোর জন্য কোন কোন কবিতা দেয়া যায়। বুঝলাম উৎপাত শুরু হলো মাত্র। কারন ছেলেটা লাসা প্রকৃতির, বাজারে মাছঅলার সাথে কিংবা পথে রিকশাওয়ালার সাথে কি হয়েছে তা নিয়ে আধাঘন্টা বকবক করতে পারে। কী উৎপাতের কথা। এমনিতেই উত্তরাধুনিক কবিদের যন্ত্রনায় সুশীল আড্ডা ছাড়ি ছাড়ি অবস্থা। এদিকে ঘরেই কবিতা দিয়ে যাচ্ছে আরেকজন। সুশীল হবার যন্ত্রনা তো কম না?

তবু আমি কবিতার খাতাটা নিয়ে রেখে দিলাম গম্ভীর হয়ে। কবির নাম তৈয়ব। ভাগিয়ে দেবার কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। কারন তৈয়ব আমার খুব ভক্ত। ভক্তকে নিরাশ করবো তেমন নিষ্ঠুর কি করে হই। তবু উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য কদিনের জন্য তাকে দুরে রাখতে হবে। আমার অন্য কাজে ব্যাঘাত হচ্ছিল। কয়েকজন কট্টর লেখকের দাঁতভাঙা কয়েকটা বই ছিল আমার কাছে। ফরহাদ মজহার, আবুল কাশেম ফজলুল হক ইত্যাদি লেখকের তাত্ত্বিক বই। ওই বইগুলো আমার বদহজম হচ্ছিল তখন। বইগুলো গছানোর একটা উপায় পেয়ে আলোকিত হয়ে উঠলো চেহারা।

একদিন বিকেলে তৈয়ব কবিতার মতামত নিতে আসলে তার হাতে বইগুলো তুলে দিয়ে বললাম- "পড়েছো এ বইগুলো? অসাধারন বই। এগুলো না পড়লে ভালো কবিতা আসবে না। তুমি ওগুলো পড়ে শহীদের কাছে গিয়ে মতামত দিও। আর তোমার কবিতার খাতা ওর কাছে দেয়া আছে, তার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না কবিতা নিয়ে।"

শহীদ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কবি মহলের অন্যতম কবিবর। একদিন কথায় কথায় বলছিল পাড়ায় একটাও শিক্ষিত লোক নেই যে তার কবিতা বোঝে। ভাবলাম নবীন কবি তৈয়বকে আবিষ্কার করে নিশ্চয়ই আনন্দিত হবে সে। পরের সপ্তাহ থেকে কবি তৈয়বের গন্তব্য বদলে গেল শহীদের বাসার দিকে। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম সে যাত্রা।

কয়েকদিন পর শহীদ আমাকে রাস্তায় পাকড়াও করলো। "শালা কী একটা পাগল জুটিয়ে দিয়েছিস, দিনরাত ঘুমাতে পারি না, তার কবিতা নাকি ছাপাতে হবে আমার পত্রিকায়। কিন্তু খাতা খুলে দেখি নামধাম বদলে আস্ত কাজী নজরুল ইসলাম কাট করে মেরে দিয়েছে।"

আমি শিউরে উঠলাম ভেতরে ভেতরে। ভাগ্যিস পড়ি নাই। নইলে বলেই ফেলতাম, কবি আপনি তো মহান। কারন নজরুলের অনেক কবিতা তখনো পড়া হয়নি আমার।

মুখে বললাম, "দোস্ত আমারে মাফ কর। আমি কবিতা পড়া ছেড়ে দিয়েছি, তাই তোর কাছে পাঠিয়েছি। ঝামেলা মনে করলে বিদায় করে দে"

শহীদ ক্ষেপে গিয়ে বলে, "বিদায় করব কি করে, ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিদিন, বেয়াদপের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুকে। আগে আমাকে লুকিয়ে সিগারেট খেতো আর এখন আমাকেই কিনে দিতে চায়। আমি নাকি হারামজাদার কবি বন্ধু এখন। কিসব যন্ত্রনা লেলিয়ে দিয়েছিস তুই!!"

সর্বনাশ! তাই নাকি? আমার তখন মনে পড়লো একদিন নিউমার্কেটের সামনে দেখা হলে তৈয়ব আমাকে বারবার জোর করছিল, ভাইয়া আপনাকে সিগারেট কিনে দেই, একটা খান।

বলেছিলাম, "আমি ভর দুপুরে সিগারেট খাই না।" শুনে খুব বেজার হয়েছিল তৈয়ব।

তাহলে এই মতলব? ভাগ্যিস খাইনি। শালা বেয়াদবীর আর্ট জানে। কোনদিন আমাকে গলায় জড়িয়ে ধরে বলতো, আয় দোস গাঁজা টানি এক সাথে। এ যে সুশীল বেয়াদপ! এর পর থেকে আমি তৈয়বের ছায়াও মাড়াই না। বাসায় বলা আছে তৈয়বকে দেখামাত্র যেন বলা হয় - "বাড়ীতে নেই আমি, চলে গেছি মার্কেটে।"

ইসলামী ব্যাংকের হালাল হারাম ( যদি সুদ না বলে ভুষি বলি!!)

সুদ হারাম... সুদ হারাম.... সুদ হারাম।
লাভ হালাল.... লাভ হালাল... লাভ হালাল।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশী মুসলমানদের বিরাট অংশকে কাবু করে দিয়েছে এই বানীতে। ইসলাম বিষয়ে তরলপ্রান মানুষ তা বিশ্বাসও করেছে। বিশ্বাস করছে, ভালো করছে। ইসলামী ব্যাংকের ব্যাবসা রমরমা হইছে!! দেশে ইসলামী ব্যাংকের বিরাট জোয়ার বইতেছে। বিদেশী ব্যাংকগুলিও ইসলামী ট্যাগ লাগিয়ে ব্যাংকিং করতে আগ্রহী হচ্ছে। কারন বাজার বলে কথা। সুতরাং ইসলামের উপকার হোক বা না হোক। ব্যাংকিং ব্যবসায় প্রতিযোগীতা বাড়ছে।

আমার কিছু আলগা কথা আছে এই প্রসঙ্গে। যৎসামান্য ব্যাংকিং জ্ঞানের প্রভাবে এগুলো বেরিয়ে যায় মাঝে মাঝে।

আচ্ছা সুদ কি? সুদের সংজ্ঞা কি? সুদ শব্দটা কেন আসলো। interest শব্দটার বাংলা সুদ। তো.....এই অনুবাদ কি কোন হুজুর করে দিয়েছে? কোন সে মওলানা?

ইসলাম যখন কায়েম হয়, তখন কি ব্যাংক ছিল? ব্যাংক প্রথা চালু হয়েছে কোথা থেকে, কখন থেকে?

ইসলামী ব্যাংক সুদ আর লাভের মধ্যে হালাল হারামের মাজেজা দেখিয়ে ব্যাবসা চাঙ্গা করেছে বছরে পর বছর, আম জনতা বেহেশতের লোভে আকাম কুকামে টাকা কামিয়েও ইসলামী ব্যাংকে জমিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক হারাম বলে সুদ দেয় না লাভ দেয়, তো যারা ওই ব্যাংকে টাকা জমা রাখে তাদের কামাইগুলা কি হারাম না হালাল তা কি কখনো যাচাই করে রাখা হয়? নাকি হারাম টাকা ইসলামী ব্যাংকে রাখলে ইসলামী ফিল্টারে হালাল হয়ে বেরিয়ে আসে?

ইসলামী ব্যাংক বৈদেশিক বানিজ্যে আছে কি না। বিদেশে যখন কোন লেনদেন করে, তখন সুদ বাদে লেনদেন করে, নাকি ইসলামী ফিল্টার করে? সারা বিশ্বে ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংকিং সুদের হার নির্ধারন করে LIBOR কিংবা SIBOR নামে দুটো পথে। ইসলামী ব্যাংকের কী নিজস্ব কোন চ্যানেল আছে বৈদেশিক লেনদেনে? যদি না থাকে তাহলে দেশী টাকা জমা রাখার বেলায় হালাল শ্লোগান, আর বিদেশী লেনদেনে হারাম কারবার। একই ব্যাংকের এই দুইরকম লেনদেন কি মোনাফেকীর লক্ষন নয়?

যদি তথাকথিত সুদ আর লভ্যাংশ হাদিস মেনে ব্যাংকিং করতে হয়, ইসলামী ব্যাংকের কোন অধিকারই নেই ব্যবসা চালানোর। বান্দারে সাত-পাচ চৌদ্দ বুঝিয়ে পার পাওয়া যাবে, কিন্তু আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবে। তাইলে কি ইসলামী ব্যাংকওয়ালারা আল্লাহ খোদায় বিশ্বাস করে না? নইলে এখনো গলা ফুলিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে কি করে?

এখন একটু গিয়ানী কতা কই। ইসলাম যখন কায়েম হচ্ছিল তখন দুনিয়াতে ব্যাংকিং প্রথা ছিল না। প্রথম ব্যাংকিং ব্যবস্থার উদ্ভব হয় ইউরোপে। নাসারাদের দেশে। নাসারাদের অন্যতম ভাষা ইংরেজী। ভারতবর্ষে ওদের শাসন নাজিল হয় দুশো বছরের জন্য। সেই সুবাদে এই দেশেও আমদানী হয় ব্যাংকিং ব্যবস্থা। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় লেনদেনের হার নির্ধারিত হয় ইন্টারেষ্ট নামক উপাদন দিয়ে। ইংরেজী 'ইন্টারেষ্ট' শব্দটাকে কোন এক বঙ্গসন্তান অনুবাদ করেন 'সুদ' বলে। সেই থেকে চলে আসছে ব্যাংক ও সুদ। সেই আদম সন্তান যদি অনুবাদ করার সময় সুদ না বলে 'ভুষি' করতো তাহলে সেটা হারাম হতো না বলে মনে হয় না।

আপনার বলেন, ভুষি হারাম এই কথা কোন মুসলমান মওলানা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে?? সুতরাং সুদ ব্যাপারটা যতটা হালাল হারাম সমস্যা তার চেয়ে বেশী শব্দানুবাদের সমস্যা।