অমূল্য মাষ্টারকে বহুদিন পর মনে পড়লো।
ব্যাপক সিনেমা পাগল অমূল্যচন্দ্র ম্যানোলা কোম্পানীর চাকরীর পাশাপাশি টিউশানিও করতো কয়টা। তার মধ্যে একটা আমাদের বাসা। তরুন অকৃতদার এই লোক 'অমূল্য মাষ্টার' হিসেবে পরিচিত ছিল এলাকায়। লজিং থাকতো আমাদেরই এক প্রতিবেশীর বাসায়। লোকটা বড়দের কাছে রসিক মানুষ হলেও ছোটদের যম ছিল।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ুয়া বলে আমি পড়তাম না তার কাছে, ফলে তার বেত আমাকে ছুঁতে পারেনি কখনো। হম্বিতম্বি সব প্রাইমারী লেভেলের ভাইবোনদের উপর দিয়েই যেত। দৈনিক একবেলা এক ঘন্টা এসে পড়িয়ে যেতো আমাদের বাসায়। কিন্তু আড্ডা দিতো আরো দেড় দুইঘন্টা। আমার এক চাচা ছিলেন ওনার সমবয়সী, তাই একটা আড্ডার সম্পর্ক ছিল দুজনের। কিঞ্চিত বড় হবার সুবাদে অমূল্য মাষ্টারের সাথে আমার ঠিক বন্ধুত্ব না হলেও প্রায়ই ওদের গল্পে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা হবার চান্স নিতাম। বয়সটা ইঁচড়ে পাকা হয়ে ওঠার উপযুক্ত বলে ওদের গল্পের মধ্যে রসের আনাগোনা বুঝতেও খুব বেশী কষ্ট হতো না। কিন্তু চেহারায় "কলা ছিলে না দিলে খেতে পারিনা" ভাব নিয়ে পড়ে থাকতাম।
অমূল্য মাষ্টারের তিনটা ঘটনা এখনো ভুলতে পারিনি। সেটাই বলি।
১. তাকে সিনেমাপাগল বা সিনেমা উন্মাদ যাই বলা হোক, হলে গিয়ে একনাগাড়ে সর্বাধিক সময় সিনেমা দেখার রেকর্ড অমূল্য মাষ্টার বাদে আর কারো আছে কিনা জানা নেই। তখনও মানুষের যাতায়াত ছিল সিনেমা হলে, সেই ৮০-৮২ সালের দিকে। আমরাও যেতাম মাঝে মাঝে। কিন্তু অমূল্য মাষ্টারের সিনেমা দেখাটা ছিল বিশাল ব্যাপার। সেই সময় 'লাভ ইন সিঙ্গাপুর' ও 'সওদাগর' নামে দুটো সিনেমা বাংলাদেশে ব্যাপক হিট খায়। সেই সিনেমা দুটো অমূল্য মাষ্টার দেখেছিল প্রতিটা ১২ বার করে। শুধু কি তাই? একদিন এক নাগাড়ে দিনের ১২টা থেকে শুরু করে রাত ১২টা পর্যন্ত সবগুলো শো-র টিকেট কিনে বারোঘন্টা সিনেমা দেখেছিল নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে। ভাবা যায়?
২. ম্যানোলা তখন বাংলাদেশে নামকরা কসমেটিক কোম্পানী। অমূল্য মাষ্টার ম্যানোলা কোম্পানীর কোন পদে চাকরী করতো জানি না। কিন্তু বেশ বড় পদে নিশ্চয়ই। স্নো আর ক্রীম এত সুলভ ছিল তার কাছে যে সে মুখ মাথা এমনকি হাঁটু থেকে পায়ের তালু পর্যন্ত ক্রীম মেজে আসতো কাজ থেকে ফেরার সময়। একদিন আমাকে বলেই ফেললো, আমাকে একটা ডানোর বড় টিন দাও তোমাদের জন্যও টিন ভর্তি করে ক্রীম নিয়ে আসবো। আমি হাঁটু আর পায়ের তালু পর্যন্ত ক্রীম মাজার উপকারিতা কি ভাবতে ভাবতে মার কাছে ডানোর টিন চাইতে গিয়ে রুটি সেঁকার খুন্তির তাড়া খেয়ে পালালাম।
৩. অমূল্যের সাথে তার গ্রামের একটা মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে ছিল। সেই সামনের বৈশাখে বিয়ে। মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়ে। অমূল্য মেয়েটাকে পড়াতো আগে থেকে। পড়াতে গিয়েই জীবন সঙ্গী নির্বাচন। আমাদের সাথে প্রায়ই গল্প করতো মেয়েটা কিরকম মেধাবী, কত সুন্দর, মেট্রিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পাবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। তার হবু বউয়ের গল্প শুনতে শুনতে অমূল্যের স্বপ্নটা আমাদেরও ছুয়ে যেত। কিন্তু বৈশাখ কাছাকাছি আসতেই অমূল্যের পরিবারে কে যেন একজন মুরব্বী মারা যান। ফলে বিয়ে স্থগিত হয়ে যায় এক বছরের জন্য। এক বছর কেন?
তখন শুনেছিলাম হিন্দুশাস্ত্র মতে পরিবারের বড় ছেলের বিয়ে নাকি বৈশাখেই হতে হয়। সত্যমিথ্যা জানি না। তবে আমরাও মেনে নিয়েছিলাম যেহেতু অমূল্যও মেনে নিয়েছিল। আমরা পরবর্তী বৈশাখের অপেক্ষায় থাকি। আমাদের অপেক্ষা বিয়েতে আমোদ ফূর্তি করা, ব্যাপক খাওয়াদাওয়ার উৎসবের জন্য। আগাম দাওয়াত পেয়ে গিয়েছিলাম। অমূল্য প্ল্যান করতে থাকে কিভাবে কি করবে।
কিন্তু পরবর্তী বছরে পরিবারের আবারো কার যেন দেহত্যাগ ঘটলো। বিয়ে আবারো স্থগিত। অমূল্য এসে বিষন্ন মুখে পড়ায়। আমরাও বিষন্ন থাকি। খাওয়াটা না জানি মার যায়। পরের বছর অমূল্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে হবু বউয়ের মেট্রিক পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার পুরো সময়টা দিনরাত খেটেখুটে পরীক্ষার হলে ডিউটি দিয়ে পার করে। পরীক্ষার তিনমাস পর রেজাল্ট দিল। বউ ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছে!!! কি আনন্দ আমাদের! সব কৃতিত্ব অমূল্য মাষ্টারের। খুশীতে ব্যাপক মিষ্টিমুখ করানো হলো আমাদের। আমরা নিশ্চিত হই এবার বিয়েটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। সামনের বৈশাখেই বিয়েটা খাবো আমরা।
কিন্তু বিয়ের দিন ঘনাবার অনেক আগেই একটা দুঃসংবাদ আসলো। না, এবার কেউ মারা যায়নি। এবারের ঘটনা ভিন্ন। মেয়ের ভালো রেজাল্ট দেখে পাত্রীপক্ষ পিঠটান দিয়েছে। হবু শ্বশুর এখুনি মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না। আরো উচ্চশিক্ষিত করে তারপর বিয়ে। আসল কথা ভালো রেজাল্টের কল্যানে পাত্রীর বাজার দর অনেক বেড়ে গেছে। ক্লাস নাইনে থাকতে বিয়েটা হয়ে গেলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু মেয়ে ফার্স্ট ডিভিশান পেয়ে যাওয়াতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ অমূল্যচন্দ্রকে এখন নিতান্ত বেমানান লাগছে মেয়েপক্ষের কাছে।
ফলতঃ অমূল্য মাষ্টারের বিয়েটা আমাদের কখনোই খাওয়া হয়নি।
No comments:
Post a Comment