Wednesday, November 25, 2009

তিনবিঘা করিডোরে কয়েকজন বাউন্ডুলে এলোমেলো হেঁটেছিল

সতর্কবানীঃ ঢাউস লেখা, অধৈর্য পাঠক প্রবেশ করিবেন না]

মানুষের জীবনে কত রকম সাধ অপূর্ণ রয়ে যায়! আমার সেরকম অপূর্ণ সাধের একটা বাউন্ডুলে জীবন। একটা বয়সে খুব ইচ্ছে করতো এলোমেলো হাঁটতে। সুযোগ পেলেই পালের হাওয়া যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকে পালিয়ে যাওয়া। নব্বই দশকের প্রথমভাগে ঢাকার বন্ধুদের সাথে আমার একটা আড্ডা ছিল নিয়মিত। কদিন পরপর নানা অজুহাতে ছুটে যেতাম ঢাকায়। সেই বাউন্ডুলে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিনরাত্রি। ১৯৯৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে ছুট লাগালাম ঢাকায়। বেকার জীবনের শেষ আড্ডা দিয়ে ফিরে আসার আগের রাতে সাব্বির বললো ওরা কাল সকালে উত্তরবঙ্গে যাবে একটা কাজে। কাজটা কি সেটা বললে আরেক বিশাল কাহিনী হয়ে যাবে বলে সেটা উল্লেখ করবো না আজ। কেবল ভ্রমনটাই বলি।

বাংলাদেশের ম্যাপের উত্তর কোনায় যে তিনটি সুচালো মাথা বেরিয়েছে তার মাঝখানের টিলার নাম বুড়ীমারী। ভারতে যাবার একটি অন্যতম স্থল বন্দর। হিমালয় পর্বতের খাড়াইগুলো যার কয়েক মাইল উত্তরে এসে থেমে গেছে দিগন্তের সেই শেষ প্রান্তে মেঘমুক্ত আকাশে মাঝে মাঝে কাঞ্চনজংঘার শ্বেতশূভ্র চুড়াটা উঁকি দেয়। সাব্বির বললো, চাইলে ওদের সাথে যেতে পারি আমি। কোথাও যাবার প্রস্তাব পেলে 'না' শব্দটা কখনোই উচ্চারন করতাম না। সুতরাং খপ করে লুফে নিলাম প্রস্তাবটা। কাঞ্চনজংঘার নাম শুনেই আমার মাথা থেকে বাসা বাড়ী, পরিবার, চট্টগ্রাম সব উবে গেল। মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো কাঞ্চনজংঘার সাদা সাদা বরফে ঢাকা চুড়া। মেঘের ফাঁক দিয়ে ওই উচুতে উঁকি দিচ্ছে। সেই কবে একটা বই পড়েছিলাম কাঞ্চনজংঘার উপর। টয়ট্রেনে চড়ে মেঘের ভেতর দিয়ে হিমালয়ের সেই যাত্রার বর্ননা ভুলতেই পারি না। চাইলে নাকি চুরি করে শিলিগুড়ি দিয়ে পালিয়ে একেবারে দার্জিলিংও চলে যাওয়া যায়। কিন্তু আমার পকেট তখন গড়ের মাঠ। বাড়ী ফেরার গাড়ী ভাড়া একশো বিশ টাকা বাদে আর কিছু নেই। কিন্তু থাকিতে বন্ধু ভয় কি রে তোর। সাব্বির বললো নো চিন্তা আমি আছি। কথা সত্য, সাব্বির থাকা মানে টাকার ভাবনা উসুল। ওর সাথে আমার অলিখিত চুক্তি হলো, আমার পকেট গড়ের মাঠ হলে সেটা পুর্ন করার দায়িত্ব ওর, আর ওরটা গড়ের মাঠ হলে দায়িত্ব আমার।

রাত দশটার মধ্যে টিকেট করে গাবতলী থেকে ফেরার পথে আমার পকেটে একটা পাঁচশত টাকার নোট গুঁজে দিয়ে সাব্বির বললো, এটা পথ খরচ, লাগলে খরচ করিস, না লাগলে ফেরত দিস। আমাকে আর পায় কে। জোশ একটা ভ্রমনের স্বপ্ন নিয়ে ওর বাসায় ফিরে ঘুম একচোট। ওর ব্যাচেলর ঘরে আমাদের সব বন্ধুদের আড্ডা ছিল। আমরা সবাই বেকার, ও একমাত্র চাকরীজীবি। বেডরুমটা পুরো কার্পেটে ঢাকা। ওখানে যে যার খুশী মতো বালিশ রেখে ঘুমোই আমরা। চাঁটগা থেকে যারা ঢাকা যাই সব বন্ধুর আশ্রয় ফকিরাপুলের ওই বাসাটা। এমনকি ঢাকার বন্ধুরাও বাসায় ভালো না লাগলে এখানে এসে ফ্রী থাকা খাওয়া চালিয়ে যায় দিনের পর দিন। সাব্বিরের বেতনের সিংহভাগ অংশ বন্ধুদের পেছনেই যেত। ওর উদারতা আমাদের সম্পদ। কি এক অবাক দিন গেছে তখন।

পরদিন বিকেলে বাস ছাড়লো গাবতলী থেকে। তখনো যমুনা সেতু হয়নি। লালমনিরহাটগামী যে বাসটিতে আমরা উঠলাম সেটি ছিল একটা লোকাল বাস। ঠাসাঠাসি ভিড়। দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। এটার নাকি বারো থেকে আঠারো ঘন্টা পর্যন্ত লাগাতে পারে পৌছাতে। ফেরীতেই লাগতে পারে তিনঘন্টা। দীর্ঘ ক্লান্তিকর একটা যাত্রা। কিন্তু দীর্ঘ যাত্রার কথা শুনে কারো চেহারায় এতটুকু বিরক্তি এলো না। বরং দীর্ঘ আড্ডার লোভে চিকচিক করছে সবকটি মুখ। পথে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে বিদঘুটে অভিজ্ঞতা হলো রংপুর পেরুনোর পর। একটা সেতু পেরুনোর পর পর। ওই সেতুটা (সম্ভবতঃ তিস্তা এতদিন পর সঠিক মনে নেই) পেরুনোর পর বাসটা থেমে গেল। রাত দুটো বাজে তখন। নিঝুম নীরবতা চারিদিকে। বিরান সেই অন্ধকারে আশেপাশে কোন লোকালয় ঠাহর করা গেল না। জানা গেল সামনের রাস্তাটা ভালো না। প্রায় দশ মাইলের মতো রাস্তায় নাকি ডাকাতের রাজত্ব। একা কোন গাড়ী পার হয় না রাতের বেলা। আরো গাড়ী আসলে সবাই লাইন ধরে একসাথে চলবে সাথে থাকবে একটা পুলিশের এসকর্ট ভ্যান। শুনে আমরা তাজ্জব মানলাম। বাংলাদেশে এরকম ভয়ংকর জায়গাও আছে যেখান দিয়ে একটা বাস একা পেরুবার সাহস পায় না। প্রায় আধাঘন্টা অপেক্ষা করার পর আরো কয়েকটা বাস এসে লাইনে দাঁড়ালো। কিছুক্ষন পর কোত্থেকে একটা পুলিশের গাড়ীও চলে এলো। আমাদের বাসটার সামনে এসে পুলিশের গাড়ীটা দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর সবগুলো ড্রাইভারের সাথে কথা বলে প্রথমে পুলিশের গাড়ী তার পেছন পেছন আমাদের গাড়ীটা, তারপর অন্যগাড়ীগুলো এগোতে লাগলো। এতক্ষন ভয় লাগেনি, কিন্তু পুলিশ দেখে বিপদের গুরুত্বটা বেড়ে গিয়ে ভয়টা জেঁকে বসলো। দুপাশের অন্ধকারে সতর্ক চোখে দেখছি কোন নড়াচড়া আছে কিনা। এই রাস্তার দুপাশে অন্তত পাঁচ-সাত মাইল নাকি কোন জনবসতি নেই। বিশাল প্রান্তর চিরে বেরিয়ে গেছে রাস্তাটা। এলাকাটা একেবারে জনবিরল। আমি সামনে পুলিশের গাড়ীর দিকে তাকিয়ে জুবুথুবু বন্দুক জড়িয়ে থাকা পুলিশদের বসে থাকতে দেখলাম। মনে হলো হাতের বন্দুকগুলো ওদের বোঝা বাড়ানো ছাড়া তেমন উপকারে আসে না। হয়তো গুলিও নেই ভেতরে। সত্যি সত্যি সামনে ডাকাতদল পড়লে ওরাই হয়তো সবার আগে ছুটে পালাবে ওই অন্ধকারে। দীর্ঘসময় লাগিয়ে আমাদের কাফেলা একটা মোড়ে পৌছালো। ওখান থেকে একটা পথ কুড়িগ্রাম, আরেকটা লালমনিরহাটের দিকে চলে গেছে। এখান থেকে নিরাপদ যাত্রা। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লালমনিরহাটের পথ ধরলাম।

আরো বেশ কয়েকঘন্টা যাবার পর পাটগ্রামে এসে পৌছালাম। সকাল হয়ে গিয়েছিল ততক্ষনে। কেমন একটা পরিত্যক্ত শহরের মতো লাগলো দেখতে জায়গাটা। লোকজন তেমন নেই রাস্তায়। ভ্যানগাড়ী দেখা গেল দুয়েকটা। বুড়ীমারী সীমান্তের কাছেই ওদের অফিস। বাসটার শেষ যাত্রী আমরাই। যেই কোম্পানীর বাসে করে গিয়েছি সেই বাসের কন্ডাকটরের সাথে খাতির করে নিয়েছিলাম আমরা যাবার পথেই। একরাত এখানে কাটাবো। রাতে থাকার জন্য বাস কাউন্টারের পেছনে একটা ঘরের ব্যবস্থা হয়ে গেল এই খাতিরের সৌজন্যে। গাড়ী থেকে নেমে বাস কাউন্টারে ঢুকলাম সবাই। টিনশেড একটা বাড়ীর সামনের রুমটা অফিস, পেছনের ঘরে বাসের ষ্টাফদের থাকার জায়গা। ওটাই আমাদের জন্য ছেড়ে দেয়া হলো অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে। আমরা তখন যাহা পাই তাহাতেই আনন্দিত। বাসের লোকদের সহায়তায় সকালের চা নাস্তার ব্যবস্থা করা হলো। পরোটা ভাজি চা।

চা নাস্তা সেরে বেরুলাম সীমান্ত দেখতে। আমাদের থাকার আস্তানা থেকে সোজা নাক বরাবর একটা রাস্তা চলে গেছে। ওদিকে কয়েকশোগজ পরেই সীমান্তের গেট। এখানে রাস্তাগুলো ভীষন পরিষ্কার, সুন্দর। দুপাশে সারিবদ্ধ গাছ লাগানো। হেঁটে হেঁটে বুড়ীমারী সীমান্তের যেখানে বাংলাদেশের সীমানা চিহ্নটা আঁকা হয়েছে ওখানে দাঁড়ালাম। কে জানি নিষেধ করলো ওখানে দাঁড়াতে। নো ম্যানস ল্যান্ড। মানুষের জীবনে স্বেচ্ছায় নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়ানোর সুযোগ খুব বেশী আসে না। নিষেধ শুনে সরে আসতে হলো। বামপাশে কাষ্টমসের অফিসঘর। ডানদিকে সুন্দর একটা নদী। ওটার এপাশ বাংলাদেশ, অন্যপাশ ভারত। নদীটা এত সুন্দর পরিষ্কার টলমলে জল। স্রোত আছে বেশ। পাহাড়ী নদী, ভারতের হিমালয় থেকে কলকল করে বরফগলা জল বয়ে আনছে এই সমতল ভুমিতে।

ওখানে বেশ কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম আমাদের আবাসে। ওখানকার একজন বললো তিনবিঘা করিডোর নাকি খুব কাছেই। চাইলে যেতে পারি। গেটটা একঘন্টা পর পর আধঘন্টার জন্য খোলে দিনের বেলা। এক দৌড়ে ভ্যানগাড়ীতে বেড়িয়ে আসতে পারি। বাহ, তিনবিঘা করিডোর? কত লেখাজোকা পড়েছি ওটা নিয়ে। এরকম বিরল একটা সুযোগ পাবো এখানে এসে চিন্তাই করিনি। দেরী না করে একটা ভ্যান ভাড়া করে ছুটলাম। যেতে হবে পাটগ্রাম হয়ে। যেতে যেতে বিশাল প্রান্তর পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কাঁটাতার ঘেরা সীমান্তে। গেট বন্ধ এখন। ভ্যানওয়ালা জানালো আরো একঘন্টা পর খুলবে। এখানে একটা কেমন অস্তস্তিকর পরিবেশ। ভীষন কড়াকড়ি যেন। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের পোষ্ট দেখলাম করিডোরের মাঝখানে। ওদের মধ্যে রনসজ্জা, যেন এই মুহুর্তে যুদ্ধ বেধে যাবে। আমাদের বিডিআর পোষ্ট বেশ খানিকটা ভেতরে হওয়াতে অস্তিত্ব টের পাওয়া মুশকিল। ওপাশে বাংলাদেশ এপাশেও বাংলাদেশ। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ঝকঝকে ভারতীয় রাস্তা। ভারতের ওই অংশটার সাথে বাংলাদেশের পার্থক্যটা বেশ পরিষ্কার। বাংলাদেশ অংশটা ভীষন দরিদ্র মনে হলো।

আমরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম তিনবিঘা করিডোর। ওপাশে একটা বাংলাদেশ আছে যেটা আক্ষরিক অর্থে বন্দীশালা। কেউ ইচ্ছে করলেই ওখান থেকে যখন তখন চলে আসতে পারবে না এই অংশে। রাতে যদি কেউ মরেও যায় গেট খুলবে না। হাসপাতালে নেবার দরকার হলেও পরদিন ভোর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নিয়ম ভীষন কড়াকড়ি ভারতীয় তরফ থেকে। আমরা ভ্যানঅলার কাছ থেকে এসব তথ্য পাচ্ছিলাম, আর বিষন্ন হয়ে পড়ছিলাম।

এমন সময় একটা বিকট চিৎকার এলো কোথা থেকে জানি। তাকিয়ে দেখি বিএসএফ পোষ্ট থেকে বন্দুক উঁচিয়ে আমাদের দুরে সরে যেতে বলছে। ভ্যানঅলা বললো এখানে দাঁড়ানো নিষেধ। এই গেট ওদের। গেটের জায়গাটুকুও ওদের। আমরা গেটের একফুটের ভেতর চলে গেছি তাই গেট থেকে তফাত যেতে বলছে ওই সৈনিক। সরে গেলাম। কিন্তু এত রূদ্রমুর্তির কারন বুঝলাম না। গিয়ে পাশের প্রান্তরের ঘাসগুলো মাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম সবাই। ভারতীয় কাঁটাতার থেক দুই ফুট দুরত্ব বজায় রাখতে হলো। আমাদের তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করছে সৈন্যদল। দেখে মেজাজ এমন খারাপ হলো, হঠাৎ এক বন্ধু বললো, আমার পেশাব করতে হবে। দাড়া বাংলাদেশে দাড়িয়ে ইন্ডিয়ার কি করে বৃষ্টি ঝরাই দেখ।

বন্ধুর সাহস দেখে আমরা তাজ্জব। কিন্তু সাহস ব্যাপারটা যেন সংক্রামক। হুমকি আছে জেনেও জিপার খুলে বাকীরাও লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। আইন মেনে কাঁটাতার থেকে দুইফুট দুরে দাঁড়িয়ে ওইপারে জল ঝরাচ্ছে একদল বেপরোয়া তরুন। বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে ভারতে জলত্যাগ। একটা অহিংস প্রতিবাদ, ভারতীয় সহিংস হুংকারের প্রতিবাদে। যে কোন মুহুর্তে একটা হুংকার বা গুলি ছুটে আসতে পারে। কিন্তু আমরা তখন মরিয়া। শালার যা হবে হোক। এই কাজ দেখিয়ে যাবো তোদের। আশ্চর্য এবার কোন হুংকার এলো না। নির্বিঘ্নে কাজ সেরে সবাই বিজয়ী উল্লাস করে উঠলো। যাক ব্যাটাদের একটা শিক্ষা দেয়া হয়েছে আইন মেনেই।

গেট খোলার সময় হলে আমরা লাইন ধরে দাঁড়ালাম। করিডোরটা বোধহয় একশো গজের মতো হবে। করিডোরে প্রবেশ করে আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে পেরোচ্ছি ভারতীয় অংশটা। অদুরে বিএসএফ সৈনিকদের হেলমেট পরা মুখ আংশিক দেখা যাচ্ছে বালির বস্তার পেছনে সাব মেশিনগানের নলের পাশে। আবারো একটা চিৎকার। আরে মুশকিল, এখন সমস্যা কি তোর, চিল্লাস কা? কি বললো বুঝলাম না। কিন্তু চিৎকার চলছেই। একজন বুঝলো, বললো এত আস্তে হাঁটলে চলবে না। দৌঁড়ে জোর কদমে পেরিয়ে যেতে হবে জায়গাটা। হেলে দুলে হাঁটার কোন অবকাশ নেই। আজব! আমার আধঘন্টায় আমি যেমন খুশী তেমন করে পেরুবো। তাতে তোদের কি। কিন্তু না, আধঘন্টা আমাকে দেয়া হয়েছে জরুরী গতিতে পেরুবার জন্য। আয়েশ করে নয়। হেলেদুলে চলা এই জায়গায় নিষিদ্ধ। মেজাজ আবারো টং হলো সবার। এ কোন জাতের কথা? কি রকম চুক্তি হলো এটা? দুজনরে সমান সমান ব্যবহার করার কথা শুনেছি এতদিন। এখন এসব কি? পুরোটাই তো ওদের নিয়ন্ত্রনে। আমাদের কিছু করার নেই।

যাই হোক অবশেষে পা রাখলাম অন্য বাংলাদেশে। এটা একটা ভুমি দ্বীপ। আঙরপোতা দহগ্রাম নামে দুটি গ্রাম এখানে। দোকানপাট দেখে চা খাওয়ার উসিলায় স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলার সুযোগ নিলাম। চা দোকানের টুলে দুটো বাংলাদেশী পুলিশকে লাঠি হাতে বসে থাকতে দেখলাম। বললাম, সারাক্ষন এই হুমকির মধ্যে থাকেন কি করে আপনারা, ভয় করে না? উত্তরে যা বললো শুনে ভিরমি খেলাম রীতিমতো। বললো, ওদের ভয় বেশী তাই এত হুংকার করে। ওদের মেশিনগানের সাথে আমাদের এই লাঠিই যথেষ্ট। লোকটা রসিকতা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম। যাই হোক, দেশপ্রেমের জোর আছে দেখে ভালো লাগলো। ওখানকার বেশীরভাগ মানুষের মধ্যে এটা দেখেছি। আমি ভাবতাম ওরা ভারতীয় বাহিনীর ভয়ে জুবুথুবু হয়ে থাকবে সারাক্ষন। কিন্তু সীমান্তের লোকজন নাকি একটু বেপরোয়া রকমের সাহসী হয়। হতেই হয় বোধহয়, নইলে টিকতে পারবে না। ওরা দেখলাম থোড়াই কেয়ার করে ওসব হুংকার হুমকি ধমকি। আরেকটা কথা মনে হলো সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের দেশপ্রেমের জোরও বোধহয় অন্যদের চেয়ে একটু বেশী।

গেটটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ততক্ষনে। আরো একঘন্টা ফেরা যাবে না। আঙরপোতার আরেকজন মানুষের সাথে কথা হলো। তিনি বললেন, বাংলাদেশ অংশে চাষের কাজ করেন তিনি। দুপুরে তার নয় বছরের মেয়েটি ভাত নিয়ে যায় ক্ষেতে। গেট বন্ধ হয় একটায়, মেয়েটা তার আগেই খাবার দিয়ে যায়। মেয়েটা যদি কখনো এক মিনিট দেরী করে, তাহলে তাকে একঘন্টা না খেয়ে বসে থাকতে হবে। বাপ এই পারে, মেয়ে ওই পারে। কতবার ঘটেছে ওরকম! এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে রাতে কোন বিপদ হলে সমস্যা। ভোর না হওয়া পর্যন্ত মরে গেলেও গেট খুলবে না।

হাবিজাবি নানা গল্পের পর গেট খোলার সময় হয়ে গেলে আমরা ফেরার জন্য উঠলাম। ওপাশে ভ্যান অপেক্ষা করছিল তখনো। জোর কদমে পেরিয়ে গেলাম তিনবিঘা করিডোর। ওপারে পৌঁছে ফিরে তাকালাম ভুমিদ্বীপ বাংলাদেশের দিকে। কী অদ্ভুত জীবন এখানকার মানুষের। স্বাধীনতা শব্দটার মানেটা সম্পূর্ন অন্যরকম ওখানে।

পাটগ্রামে এসে খেয়াল হলো দুপুরের খাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে খাবার দোকানপাট তেমন নেই। একটা হোটেল পেয়ে ঢুকে গেলাম। মুরগী অর্ডার দিতে গিয়ে দাম শুনে টাশকি খেলাম। এত সস্তা! সেই তুলনায় ডিমের দাম বরং বেশী। দশটা ডিমের দাম দিয়ে একটা আস্ত মুরগী পাওয়া যাবে। দেশী মুর্গীর ঝোল দিয়ে মোটা চালের ভাত দারুন লাগলো। দিনভর আরো ঘোরাঘুরি হলো অনেক। ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় তাসের আড্ডা চলার সময় একজন বাইরে থেকে খবর আনলো এখানে ভুটানী 'সরবত' পাওয়া যায়। সুখবর পেয়ে রাতের খাবার সেরে দুটো বোতল যোগাড় করা হলো। পনেরো মিনিটের মধ্যে খালাস বোতলের ‘সিরাপ’। তারপর সবাই রাস্তায় বেরুলাম হাঁটতে। বাহ, দারুন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ভারতে যাবার রাস্তাটা একদম নির্জন এখন। দুয়েকটা কুকুর বাদে রাস্তায় আমরাই আছি কেবল। রাত বারোটা বাজে প্রায়। আমরা আধপাগল কয়জন তরুন এলোমেলো হাঁটছি। বেসুরো গলায় গান গাইছি। বিশেষ করে সাব্বিরের গান শুনলে রবীন্দ্রনাথ মাটির নীচ থেকে কঁকিয়ে উঠতো। ব্যাটার সারেগামা এত উচ্চমার্গের।

দুপাশের গাছের সারিগুলো ছায়ার মতো দাড়িয়ে আছে। আমাদের চোখে ঘুম নেই। রাস্তার ধারে কয়েকটা ভারতীয় ট্রাক দেখা গেল আমদানী পন্য নিয়ে এসেছে। ট্রাকের নীচে চুলা জ্বেলে রান্না চড়িয়েছে শিখ ড্রাইভার। আমাদের মধ্যে রুপু ছিল দুষ্টের শিরোমনি। সে এগিয়ে গিয়ে বাতচিত শুরু করলো তাদের একজনের সাথে। আধখেচড়া ভাষার জগাখিচুড়ীতে কিছুই বুঝলাম না। রুপু ফিরে এসে বললো, আরে ওদের সাথে কথা বলা তো সোজা। খালি বলবি "ইধার কা মাল কুধার যাতা হু।" তারপর খাতির হয়ে যাবে দেখবি। আমরা সেই শিখলাম। যতক্ষন ওই জায়গায় ছিলাম, ইধার কুধার বলতে বলতে হেসে খুন একেকজন।

পরদিন দুপুরে খাওয়ার পর পর আমাদের ফেরার পালা। আমার খুব মাথা ধরেছিল, বমি বমি লাগছিল। আমি একটা এভোমিন ট্যাবলেট খেয়ে বাসে উঠে চোখ বুঝে থাকলাম। রুপু সাব্বির সিদ্ধান্ত নিল বাসের মধ্যে একবোতল ভুটানী সিরাপ রাখবে, বাকী আঠারো ঘন্টার যাত্রায় এক চুমুক করে খেতে খেতে ঢাকায় পৌঁছাবে। ওরা ডানকানের একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতলে ভরে নিল সিরাপটা। আসলেই দেখতে লাগছে লাল গোলাপী রূহ আফজা সিরাপের মতো। মাথার উপরে মালামাল রাখা তাকে প্রকাশ্যেই রেখে দিল বোতলটা। বাস ছাড়তেই একটু পরপর গলা শুকিয়ে গেছে বলে, একেকজন একেক চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। আমি এভোমিনের নেশায় টাল হয়ে ঘুমোচ্ছি, ভুটানী সিরাপে আমি নেই। নগরবাড়ী ফেরীর আগ পর্যন্ত আমি প্রায় বেহুঁশ ছিলাম। ফেরীঘাটে পৌছে অন্য যাত্রীরা সবাই নেমে গেল আমরা কজন বাদে। একটুপর ড্রাইভার এলো আমাদের কাছে। চেহারা সুরত পরখ করে হো হো করে হেসে উঠলো সে। বললো, দাদারা যে লাইনের লোক, আগে বলবেন তো। আমিও তো লাইনের মানুষ। আসেন একসাথে খাই, আমারও আছে। নেমে গেল ওরা, আমি বাসে একা। পরে জেনেছি ড্রাইভার বেশী টানেনি গাড়ী চালাতে অসুবিধা হবে বলে। তবু এখন ভাবতে শিউরে উঠি, ওই সময়গুলোতে কিরকম বেপরোয়া ছিলাম আমরা।

আধমাতাল ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে যখন ঢাকায় প্রবেশ করছে আঁধার কেটে তখন ভোরের আলো ফুটছিল ঢাকার আকাশে। আমাদের চোখে, মুখে, শরীরে ক্লান্তিকর অবশ অনুভুতি। সীমান্ত ভ্রমনের স্মৃতি যেন মুছে গিয়ে বিছানার ডাকটা খুব মধুর শোনাচ্ছিল। পরবর্তী আটঘন্টা বেহুশের মতো ঘুমোলাম সবাই সাব্বিরের বাসার কার্পেটে।

No comments: