১৯১০ সালের দিকে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলের অষ্টম শ্রেনীর এক মেধাবী ছাত্র যাদববাবুর পাটীগনিতের একটা অংক নিয়ে সমস্যায় পড়লো। স্কুলের কোন শিক্ষকই অংকটির সমাধান করতে পারলেন না। ছেলেটি থাকতো আগ্রাবাদের ছোটপুল এলাকায়। শেষ চেষ্টা হিসেবে সে প্রতিবেশী এক অংক পন্ডিতের কাছে গেল সমস্যাটি নিয়ে, তিনিও বহু চেষ্টা করে সমাধান করতে পারলেন না।
কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত দিলেন। বললেন যে যাদববাবুর ওই অংক প্রশ্নটিতে ভুল আছে। মারাত্মক অভিযোগ! যাদববাবুর অংকের বিরূদ্ধে এত বড় অভিযোগ তোলার সাহস উপমহাদেশে কারো ছিল না তখন। পরদিন মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষকগন কথাটি শুনে একচোট হাসলেন। বললেন, এত বড় পন্ডিত যাদববাবু, আর তার ভুল ধরে কোথাকার এক প্রাইমারী পাশ লেইঙ্গা মাষ্টার।
লেইঙ্গা মাষ্টারের আসল নাম আবদুস সোবহান। পড়াশোনায় প্রাইমারী পাশ হলেও মেধায় ছিলেন অতুলনীয়। ছেলেবেলায় গাছ থেকে পড়ে কোমরে আঘাত পেলে কোমরের নীচ থেকে পা পর্যন্ত অচল হয়ে যায়। চলাফেরা করতেন বিয়ারিং এর চাকায় তৈরী কাঠের পাটাতন দিয়ে বানানো গাড়ীতে বসে। চাটগাঁইয়া ভাষায় পঙ্গু বা চলৎশক্তি বিহীন লোককে বলা হয় লেইঙ্গা। প্রচন্ড শিক্ষানুরাগী এই মানুষটির শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। তিনি আগ্রাবাদের বেপারী পাড়া এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি প্রাইমারী স্কুল। নাম আগ্রাবাদ প্রাইমারী স্কুল। ওই এলাকার প্রথম স্কুল সেই বৃটিশ আমলে। কথিত ছিল লেইঙ্গা মাষ্টারের বেতের দৈর্ঘ্য নাকি তার স্কুলের চেয়েও বড়। এত কড়া শাসনে রাখতেন স্কুল।
তো লেইঙ্গা মাষ্টারের কানে এলো মিউনিসিপ্যাল স্কুলের শিক্ষকদের বিরূপ মন্তব্য। তিনি প্রত্যুত্তর না দিয়ে নীরবে ভাবতে লাগলেন। কয়েকদিন ভেবে একটা দীর্ঘ চিঠি লিখলেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে। বিস্তারিত যুক্তি তুলে জানালেন কেন যাদববাবুর পাটিগনিতের ওই অংক প্রশ্নটি ভুল। তিনি ভুলটা শুদ্ধ করে একটা সমাধানও চিঠির সাথে পাঠিয়ে দিলেন।
চিঠি পেয়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংক বিভাগের প্রধান প্রফেসর বোস সহকর্মী অন্যান্য অধ্যাপকদের নিয়ে একটা বোর্ড বসালেন। নানান আলোচনার পর বোর্ডের সবাই অবাক হয়ে একমত হলেন যে সেই অখ্যাত লেইঙ্গা মাষ্টারের কথাই ঠিক! অংকটি আসলেই ভুল ছিল। ফিরতি জবাবে তাঁরা আবদুস সোবহানকে পন্ডিত উপাধি দিয়ে একটা সার্টিফিকেট ও নগদ পাঁচশো টাকার একটা মানি অর্ডার সম্মানী পাঠালেন।
সেই লেইঙ্গা মাষ্টারের মৃত্যুর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর পর আগ্রাবাদ এলাকায় সরকারী কর্মকর্তাগনের চেষ্টায় স্কুলটিকে পুনরুজ্জীবিত করা হয় আগ্রাবাদ প্রাইমারী স্কুল নামে। যেটি বর্তমানে "আগ্রাবাদ সরকারী কলোনী উচ্চ বিদ্যালয়" নামে পরিচিত।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো আমি লেইঙ্গা মাষ্টারের এলাকায় দীর্ঘ বিশটি বছর বসবাস করেছি। সেই স্কুলে দশটি বছর পড়াশোনা করে মেট্রিক পাশ করেছি। কিন্তু কেউ কখনো ঘুনাক্ষরেও লেইঙ্গা মাষ্টারের কথা বলেনি আমাদের। কত তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের কীর্তিমান পূর্বপুরুষের কথা ভুলে যাই! মাত্র গতকাল রাতে শুনলাম আমি লেইঙ্গা মাষ্টার ইতিকথা।
একটু শান্ত্বনার সংবাদও পেলাম গতকাল। ২০১০ সালের জানুয়ারীতে স্কুলের ৫০ বছর পুর্তি উৎসবে লেইঙ্গা মাষ্টারকে মরনোত্তর সম্মান জানাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের খেদ যদি তাতে একটুও মেটে!
[তথ্যসুত্র কৃতজ্ঞতাঃ সাখাওয়াত হোসেন মজনু ভাই]
No comments:
Post a Comment