গল্পটির সুত্রপাত হয়েছিল এইখানে। লেখক চা খেতে গিয়ে ডিনারও সেরে ফেলেছিল। ফিরে এসে গল্পটি সমাপ্ত করতে পাঠকের ব্যাপক অনাগ্রহ লক্ষ্য করে নিজের হাতেই আবার কোদাল চালাতে শুরু করলো। ফলাফল নীচে দেয়া হলো।
*********************************************************
ট্রেনটা ভুজপুর জংশনে এসে থামলো। বগিতে মৃদু আলো। বেশীরভাগ যাত্রী নেমে গেছে। বগির এই অংশে মাত্র দুজন মানুষ। দুজনেই নীরব। মেয়েটি তখনো বিষন্নমুখে বাইরে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি যেদিকে বসেছে সেদিকে লোকালয় নেই, দেখার কিছু নেই, ষ্টেশানের বিপরীত দিক ওটা। তবু মেয়েটি বাইরের দিকে চেয়ে আছে অনির্দিষ্ট দৃষ্টিতে। তরুনটি বই থেকে মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকালো। প্ল্যাটফরমে কতগুলো ফেরীওয়ালা বসা, ভবঘুরে লোকজনও দেখা যাচ্ছে কিছু।
দুজনের মধ্যে দুরত্ব বড়জোর পাঁচফুট। এই দুরত্বে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে কিভাবে কথোপকথন শুরু করে তরুনের কোন ধারনা নেই। সে যে দেশে পড়াশোনা করে সেই দেশে অবশ্য অপরিচিত মানুষকেও হাই হ্যালো করা যায়। এদেশে সেখানে কেমন সংকোচ কাজ করে। নারী হলে তো কথাই নেই। তরুনটি মুগ্ধ হয়ে তরুনীর বিষন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কয়েকসেকেন্ড। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিল। সরাসরি তাকানো অভদ্রতা হয়ে যায়। আবার আড়চোখে তাকানোও ভব্যতার মধ্যে পড়ে না। তবে মেয়েটির মধ্যে এমন কিছু আছে না তাকিয়ে বেশীক্ষন থাকা যাচ্ছে না। ভদ্রতা করে হাই বলাও যাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটার সাথে পরিচিত হবার সুপ্ত একটা বাসনা ধীরে ধীরে দানা বাধছে সেটা রূপম ভালোই টের পাচ্ছে।
ট্রেনটা কতক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। খিদে পেয়ে গেছে রূপমের। কিন্তু খাবার নেই সাথে। খাবার দোকান খুঁজতে ষ্টেশানে নামতে সাহস পাচ্ছে না। গ্রামের ষ্টেশানগুলোর আশেপাশে বিস্কুট চায়ের দোকান থাকে, কিন্তু অচেনা জায়গায় নামার ব্যাপারে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল রূপমের বহুবছর আগে একবার। সেকথা মনে পড়তেই সে চিন্তাটা বাদ দিল। কিচ্ছু করার নেই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ফস করে ধরিয়ে ফেললো রূপম। খিদে পেটে সিগারেট যুত লাগে না, তবু নিঃসঙ্গতা কাটাতে সিগারেটের জুড়ি নেই। সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে ভাবনাগুলো কেমন খেলে যায়।
সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ নাকে যেতেই ভ্রু কুচকে জয়া জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে রূপমের দিকে তাকালো। এই প্রথম তার খেয়াল হলো বগির এই অংশে ওই তরুনটি ছাড়া আর কেউ নেই। সিগারেটের গন্ধ তার খুব বিশ্রী লাগে। গাড়ীতে যারা সিগারেট খায় তাদের প্রচন্ড ঘেন্নার চোখে দেখে সে। তরুনটি বাইরে তাকিয়ে আপনমনে সিগারেট টানছে। সিগারেটটা তরুনের ঠোঁটে কেমন বেমানান লাগলো। এত সুন্দর মানুষ সিগারেটের মত বিশ্রী জিনিস খায় কি করে। ঠোট কালো হয়ে যায় না? আশ্চর্য ব্যাপার যে সিগারেটের গন্ধে নাকে ওড়না দেবার বদলে জয়া ভাবতে বসে গেল অদ্ভুত একটা বিষয়ে- বেমানান ঠোঁটে সিগারেট। যেন এটি একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। ওটা নিয়ে কয়েক মিনিট এপার ওপার ভাবতে ভাবতে কাটালো।
সিগারেট টানার পুরোটা সময় রূপম বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল সচেতনভাবেই। সে নারী ও শিশুদের সামনে সিগারেট ধরায় না কখনো। আজ ব্যতিক্রম ঘটলো। অপরিচিত জায়গা বলেই কি? সিগারেট ধরালেও সংকোচে মেয়েটার দিকে তাকানো থেকে বিরত রাখলো নিজেকে। যেন ওই মেয়ের কোন অস্তিত্বই জানা নেই তার। ফলে তার জানা হলো না মেয়েটা তার দিকে কত মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিল পাক্কা দুমিনিট। সিগারেটের শেষাংশ বাইরে ছুড়ে দিয়ে বইটা খুলে বসলো আবার। এবার আর বইয়ে মন বসলো না। মেয়েটার দিকে ফিরে তাকাবার অবদমিত বাসনাটা জেগে উঠলো আবার। কিন্তু কিছুক্ষন আগের সিগারেট ধরানোর অপরাধবোধ তাকে সংকুচিত করে রাখলো। সংকোচ ধামাচাপা দিয়ে যখন সে চোখ তুললো, মেয়েটা তখন বাইরের অন্ধকারে ডুবে গেছে।
ট্রেনটা চলতে শুরু করলো আবারো। ট্রেন ও লাইনের ঝমঝম শব্দের ছন্দটা উপভোগ করছে রূপম। আরো এক ঘন্টার রাস্তা বাকী আছে হিসেবমতে। মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতে পকেট থেকে বের করে দেখলো আশিকের ফোন। কতক্ষন লাগবে জিজ্ঞেস করলো বন্ধু আশিক। পথের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সাবধান করলো। বলো সে ষ্টেশানে থাকবে গাড়ী নিয়ে।
জয়া না তাকিয়েও কথাগুলো শুনছে মন দিয়ে। বুঝতে পারছে ছেলেটা একটু আনাড়ী আছে। এত বড় মরদকে কত জ্ঞান দিতে হয়, যেন বাংলাদেশে নতুন এসেছে। যত্তসব। এসব জিনিস মাম্মী ড্যাডির ছেলে হয়, এটা নিশ্চিত। আবার সিগ্রেটও খায়। বাপরে বাপ.... ফ্যাশান কত। কাঁধের ব্যাগ দেখলে মনে হয় বিদেশী টুরিষ্ট। মনে মনে ছেলেটার সাথে ঝগড়া শুরু করে কেন যেন। যখন কিছু করার থাকে না এরকম মনে মনে খেলা জয়ার ভীষন প্রিয়। এমনকি মনে মনে প্রেমও করে কখনো কখনো। নির্দিষ্ট কারো সাথে নয়। কল্পনার সৃষ্টি সব। তবে এই ছেলেকে তার কল্পনার মানুষের সাথে মেলানো যাচ্ছে না। বেখাপ্পা টাইপ। তবু সামনে আছে এর সাথে প্রেম না হোক ঝগড়া করা যাক। সময় কাটবে তার।
সময় যাচ্ছে। রাত বাড়ছে। আরো দুটো ষ্টেশান পেরোবার পর ট্রেনটা গতি ধীর করতে শুরু করলো হঠাৎ। একসময় ঝমঝম শব্দটা থেমেই গেলো। কি হলো? রূপম বই থেকে মুখ তুলে বাইরে তাকালো। জয়া জানালা থেকে একটু সরে আসলো। ট্রেন যখন অচেনা কোথাও থামে তখন বাইরে তাকানো নিরাপদ নয়। সে জানে, কিন্তু হাঁদারাম ছেলেটা জানে না বোধহয়। তাকে ওসব বিষয়ে ট্রেনিং দেয়নি মাম্মীডেডী? রূপম এবার পুরো মাথাটা বের করে দেখছে বাইরের অন্ধকারে।
জয়ার ভীষন রাগ হচ্ছে এবার ছেলেটার উপর। আরে বোকা করছো কি। বাইরে অত দেখার কি আছে। মাথা ঢোকাও ভেতরে। ধুর.......কিচ্ছু শুনছে না ছেলেটা। শুনবে কি করে, জয়াতো মনে মনেই চিৎকার করছে। যদি কেউ দায়ের কোপ মারে? জয়ার গাটা শিরশির করে উঠলো এবার। কিন্তু অপরিচিত মানুষ, তাকে কি করে বলবে। রাজ্যের সংকোচ এসে জড়ো হয় ।
ট্রেনটা চলতে শুরু করে আবার। রূপম মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে বইয়ে মন দেয়। জয়ার বুক থেকে একটা ভার নেমে যায়।
আরো প্রায় আধঘন্টার পথ। তারপর গন্তব্য। রূপমের একটু মন খারাপ হয়। আরো কিছুক্ষন যাওয়া যেতো যদি। মেয়েটার সাথে কথা বলার কোন ছুতো বের করা গেল না। গন্তব্যে পৌছে যাওয়া মানেই তো একটা আকাংখার অপমৃত্যু। সামনে আর কোন ষ্টেশান নেই। রূপম ছটফট করতে থাকে মনে মনে। কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকাতে পারে না সরাসরি। একবারও চোখাচোখি হয়নি ওদের।
জয়া কোথায় যাবে জানে না। মামার বাড়ী আর ফিরবে না বলে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছে। তার বাবা মা নেই। ঘনিষ্ট আত্মীয় বলতে এক খালা আছে, বিদেশে থাকে। দেশে এই মামা ছাড়া আর কেউ নেই। মামাই লালনপালন করেছে পনের বছর আগে দুর্ঘটনায় বাবা মা দুজনে মারা যাবার পর থেকে। ট্রেনটা তাকে যদি আজীবন বহন করে নিত। এই যাত্রা যদি কখনো শেষ না হতো, ট্রেনটাকে ঘরবাড়ী বানিয়ে যদি বিশ্বময় ঘোরা যেত। কত আবজাব ভাবে জয়া। মেয়েদের জন্য দেশটা মোটেও নিরাপদ নয়। তবু জয়া মরে গেলেও ফিরবে না ওই ঘরে। এত বড় অপমান সে সহ্য করবে না। সে এই ট্রেনেই আজকের রাতটা কাটাবে ঠিক করলো।
শেষ ষ্টেশান আসতেই রূপম তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। একবারো তাকালো না জয়ার দিকে। যেন তাকে খেয়ালই করেনি। মেয়েদের সাথে এরকম ভাব ধরা তার পুরোনো অভ্যেস। এতে করে দুর্বলতা এড়ানো যায়। রূপমের নেমে যাওয়া দেখে জয়ার একাকীত্বটা ভীষন চেপে বসলো। এতক্ষন সময়টা ভালোই কাটছিল, এখন কি করবে সে? একা এই বগিতে শুয়ে ঘুমোবে, শেয়াল কুকুরের খাবার হতে হবে না তার? রাতের বেলা একা একটা মেয়েকে পেলে মানুষগুলো কি পশু হয়ে যেতে পারে তা পত্রিকার পাতায় প্রায়ই পড়ে সে। আজ কি তার সেই দিন? হোক, আত্মহত্যাই হোক এভাবে।
কতক্ষন কেটেছে তার জানা নেই। ট্রেনের বাতিগুলো নিবে গেছে। সীটে হেলান দিয়ে তার ঘুমের মতো এসেছে। হটাৎ মোবাইল ফোনের শব্দে ঘোর কাটলো। আরে এ যে সেই ছেলেটার ফোনের রিংটোন। সেকি ফিরে এসেছে? কি করে সম্ভব। নাকি স্বপ্ন দেখছে। ফোন বাজছেই। খুব কাছে। অন্ধকারে দেখলো ছেলেটা যেখানে বসেছিল সেইখানে ফোনটা বাজছে অন্ধকারে নীলাভ আলো ছড়িয়ে। ছেলেটা ফোনটা ফেলে গেছে ভুলে।
ফোন তুলবে কি তুলবে না ভাবতে ভাবতে কেটে গেল লাইনটা। আবারো বাজলো ফোনটা। আবারো। তিনবার বাজার পর সংকোচে ফোনটা তুললো সে। রিসিভ করতেই ভেসে এলো সেই কন্ঠ। বহুল কাংখিত ছিল যেন এই ‘হ্যালো’ শব্দটা। কয়েকবার হ্যালো শোনা গেল ওপার থেকে। জয়া কয়েক সেকেন্ড পরে বললো হ্যালো। এই প্রথম কথা হলো ওদের।
-হ্যালো.....কথা বলছেন না কেন? (ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ বললো)
-হ্যালো...
-কে বলছেন?
-আমি..........
-আপনার হাতে ওটা আমার মোবাইল......
-জী আমি....মানে.....ফোনটা বাজছিল, ধরলাম
-ওটা আমার ফোন.... হারিয়ে গিয়েছিল, আপনি কোথায় পেয়েছেন
-আমি জানি না, আমি ঠিক..... (আমতা আমতা করে নারী কন্ঠ)
-দেখুন ফোনটা আমার দরকার, অনেকগুলো দরকারী নাম্বার ওখানে, আপনি কোথায় আছেন বলুন
-আসলে..... আমি জানি না আমি ঠিক কোন জায়গায়
-কি বলছেন? আপনি জানেন না আপনি কোথায়?
-আসলেই জানি না
-আপনি কি জোক করছেন? দেখুন ফোনটা দিতে না চাইলে না দিন, কিন্তু সিমটা আমার খুব দরকার, ওটা ফেরত চাই আমার।
-না না আপনি বুঝতে পারছেন না, আমি বোঝাতে পারছি না.....ফোনটা আপনি নিয়ে যেতে পারেন
-তাহলে আপনি কোথায় বলছেন না কেন এখনো? কোথায় আছেন বলুন.. টাকা পয়সা চাইলে দিতে পারি, কত লাগবে জানান
-ছি ছি আপনি কিসব বলছেন, আপনার ফোন আপনি নিয়ে যান, আমি আপনার ফোন নেব কেন?
-তাহলে ঠিক ঠিক বলেন আপনি এখন কোথায়
-আমি এখন ট্রেনে
-ট্রেনে মানে? কোন ট্রেনে?
-সেই ট্রেনে, যেই ট্রেনে আমি এসেছি,
-মানে?
-সেই ট্রেন....সেই শেষ ষ্টেশানে, যেখানে ট্রেন থেমেছিল, ষ্টেশানের নাম জানি না
-আশ্চর্য!! কি বলছেন? আপনি কে? আপনি কি ......
-আমি এই ট্রেনে এসেছিলাম
-আপনি সেই.......ট্রেন থেকে নামেননি আপনি এখনো??
-না
-কেন?
-কোথায় নামবো, আমার কোথাও যাবার নেই
-আশ্চর্য......আপনি....তবে কি বলি......ইয়ে আমি আসলে খুব সরি, অনেক আজেবাজে কথা বলেছি না চিনে......আমি ভেবেছি অন্য কেউ
-না ঠিক আছে, আমি তো চেনা কেউ না আপনার
-না না, ঠিক করিনি আমি.......আমি দুঃখিত
-আপনি এসে নিয়ে যান আপনার ফোন
-আসছি আমি এখুনি, আধঘন্টার মধ্যে, আপনি থাকুন
-আচ্ছা
ফোনটা আস্তে নামিয়ে রাখলো জয়া। ওটার নীলচে আলোটা নিভে গেল কয়েকসেকেন্ড পর। চারপাশে এখন নিকষ কালো অন্ধকার। অচেনা জায়গার অচেনা রাতের শব্দ। অন্ধকারে ওটার দিকে তাকিয়ে জয়া ভাবলো যে আলোটা এতক্ষন জ্বলেছিল একটু পর সেরকম একটা আলো আবারো জ্বলবে কয়েক মিনিটের জন্য। ফোনটা নিয়ে ছেলেটা চলে যাবার পর আবারো ফের সেই অন্ধকার। সেই একাকীত্ব। রাত ভোর হতে এখনো অনেক বাকী। সেই অজানা ভোরের প্রতীক্ষায় বসে থাকবে জয়া এই অচেনা ষ্টেশানে। ভোরটা কি দেখা হবে তার?
[পাদটীকাঃ গল্পটি আপাততঃ এখানে শেষ। তবে একটা গল্পের শেষ কখনো কখনো একটা উপন্যাসের সুত্রপাত করতে পারে। সেই সম্ভাবনা এখানে লুকিয়ে আছে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিছুটা নির্ভর করছে রূপমের উপর, কিছুটা জয়ার উপর। জয়ার জীবনটা কোন খাতে প্রবাহিত হবে সেটা কি রূপমের কোন হটকারী সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে? মানুষের জীবনের গতিপথগুলো অদ্ভুত, কখনো কখনো এক সেকেন্ডের একটা সিদ্ধান্ত আমূল পাল্টে দিতে পারে একেকটা জীবনের গতিপথ। কোন মানুষই এর বাইরে নয়। প্রতিটি মানুষের জীবনতো একেকটা ত্রিমাত্রিক উপন্যাস]
No comments:
Post a Comment