যেনতেন একটা চাকরী পেতেও কত যুদ্ধ, কতরকম নাকানিচুবানি খেতে হয় মানুষের। অথচ আমরা দুইবন্ধুতে মিলে সাড়ে তিনটাকা বাসভাড়া আর আড়াই টাকার কাগজ খামের খরচ দিয়ে চাকরী বাগিয়ে ফেলেছিলাম। শায়েস্তা খানের আমলে নয়, মাত্র সোয়াযুগ আগে নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে। তবে ছয়টাকা ব্যয় করে চাকরী পাওয়াও ব্যাপার ছিল না।
ব্যাপারটা হলো ওই চাকরীটা পেতে আমাদের আরো চুয়ান্ন টাকা খরচ করতে হয়েছিল। সেই বাড়তি চুয়ান্ন টাকা খরচের ঘটনাই বলি।
পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে সাদা কাগজে দরখাস্ত লিখে অনেকটা মজা করার উদ্দেশ্যেই ইন্টারভিউ দিতে গেলাম আমি আর বিল্লাহ। জীবনের প্রথম দরখাস্ত একটা প্রায় ওয়াক ইন ইন্টারভিউর জন্য। দরখাস্ত জমা দিতে গিয়ে দেখি প্রচন্ড ভীড় অফিসের গেটে। শুনলাম পোষ্ট খালি আছে বারোটা, দরখাস্ত পড়েছে সাড়ে ছয়শো। ১০% চান্সও নেই। বিল্লাহ নিদারুন হতাশ। আমি বললাম, 'নো চিন্তা বন্ধু জীবনের প্রথম ইন্টারভ্যু, চাকরী না পেলেও ইন্টারভিউ চর্চা হয়ে যাবে প্র্যাকটিক্যালি।'
উপস্থিত প্রার্থীদের মধ্যে পোষাক আশাকে আমাদের দুজনের চেয়ে ক্ষ্যাত আর কেউ ছিল না। আমার কটন প্যান্টের উপর ছেড়ে দেয়া শার্টের সাথে ঘষে যাওয়া বাটা চপ্পল। এই বেশে চাকরী পাবার কোন সম্ভাবনা নাই। এখানে আজ সব টাই পরা বাঙালী। বিদেশী কোম্পানী স্মার্ট লোকই চাইবে। কত যত্ন করে প্লাষ্টিক ফোল্ডারে বায়োডাটা এনেছে একেকজন। আর আমাদের দরখাস্ত চন্দ্রঘোনার আদি বাঁশঝাড়ের মন্ডে তৈরী কেপিএমের লালচে হোয়াইট প্রিন্ট কাগজ। দরখাস্ত জমা দেবার ঘন্টাখানেক পরেই ডাক এল। ইন্টারভিউ বোর্ডে একজন বাঙালী দুজন বিদেশী। আমার ত্যানামার্কা হাতে লেখা দরখাস্তটা দুআঙুলের চিপায় নিয়ে মাঝ বয়সী বিদেশী ভদ্রলোক বললেন, এটাই তোমার? বললাম, জী। এটা তোমার হাতের লেখা? বললাম, জী।
সেই বড়কর্তার মুখে খানিক ব্যাঙ্গের হাসি লক্ষ্য করে আমি শিওর হয়ে গেলাম আমার চাকরী হবে না। না হলে না হোক। প্রথম ইন্টারভ্যুতেই লাগবে এমন সম্ভাবনা নাই। হবেই না যখন ডেসপারেট হয়ে বাকী সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। এক পর্যায়ে কর্তা বললেন, তোমার সাবজেক্ট তো অ্যাকাউন্টিং তোমাকে আমি অ্যাকাউন্টসের জন্য নিলাম, কি বলো? আমি চেয়ার থেকে আলগা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বললাম, ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু দুঃখিত আপনার চাকরী আমি করবো না। আমি গেলাম, গুডবাই (আমি যদিও অ্যাকাউন্টিং এ পড়েছি কিন্তু চাকরীতে ওটা নেবো না বলে কঠিন প্রতিজ্ঞা ছিল)।
ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বললেন, আরে করো কি। বসো বসো, ঠিক আছে, তোমার যা পছন্দ তাই দেয়া হবে তোমাকে। তবে একটা কথা। তোমার নাকের নীচের ওই কালো গোঁফ জোড়া তো বাদ দিতে হবে। শুনে চমকে উঠলেও মুখে বললাম 'প্রবলেম নাই'। বলা হলো লাঞ্চের পর রেজাল্ট দেবে। কিন্তু বেরিয়ে এসে ভাবলাম, ব্যাটারা বলে কি? আমার এত সাধের পাকানো গোঁফ ফেলে দেবো? গুষ্টি মারি তোর চাকরীর। আয় যাই গা। বিল্লাহকে নিয়ে রাস্তায় উঠে একটা বাসে চড়ে বসলাম। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ফোঁটাফোঁটো।
বাসটা আগ্রাবাদের কাছাকাছি আসতেই বৃষ্টিটা কুকুর বিড়াল রূপ নিল। বৃষ্টির ধুন্ধুমার নাচনে রাস্তাঘাট, অফিস, দোকানপাট সব ঝাপসা দেখছি। বাস থেকে নেমে দাঁড়ানোর জায়গাও নাই। হঠাৎ মনে পড়লো নতুন চাকরী পাওয়া বন্ধু ডিউর অফিস তো এখানেই। বাসটাকে থামাতে বলে একদৌড়ে ওর অফিস বিল্ডিং-এ ঢুকে গেলাম। ইস্পাহানীর অফিস। চারতলায় উঠে ওর অফিসে উঁকি দিলাম। আমাদের দেখে বেরিয়ে এল সে। ওর নতুন চাকরীটা পাবার পর একটা খাওয়াদাওয়া হবার কথা ছিল। ধরলাম আজকেই পাওনাটা মিটিয়ে দে। রাজী হলে কাছাকাছি একটা রেষ্টুরেন্টে ঢুকে গেলাম আধভেজা হয়ে।
খেতে খেতে চাকরীর ইন্টারভিউর কথাটা বললাম। গোঁফ বিসর্জন দিয়ে চাকরী করবো না বলেও জানালাম। কথা শুনে ডিউ ধমকে উঠলো, 'ব্যাটা মাগনা চাকরী পাবি নাকি। একটা কিছু ছাড় দিতেই হয়। এতো সামান্য গোঁফ। গোঁফ গেলে গোঁফ আসবে। আমার তো গোঁফই নাই। যা, খেয়েদেয়ে সোজা ফিরে যা আবার। রেজাল্ট জেনে ফিরবি।' এই জাতের হুকুম আশা করিনি ওর কাছে, কিন্তু আজকে ও খাওয়াচ্ছে। তাই বিশেষ কিছু না বলে গোমড়া মুখে বিল্লাহকে নিয়ে চাকরীর রেজাল্ট আনতে গেলাম। গিয়ে দেখি, দুজনেই পাশ!!! তবে এখন একটা দ্বিতীয় ইন্টারভিউ হবে। সেই বাছাইতে টিকলে তবেই ফাইনাল। অপেক্ষা করতে বলা হলো আবারো। দুশ্শালা! মনে মনে গালি দিলাম।
বেরিয়ে এসে পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে ধরালাম। ফুটপাতের সিমেন্টে পাছা ঠেকিয়ে বসলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ আগে। সিগারেট অর্ধেক শেষ করার পর খেয়াল করলাম সামনের চত্তরে ইন্টারভিউ বোর্ডের সেই বিদেশী ভদ্রলোক পায়চারী করছে আর আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে ধুমসে বিড়ি টানতে লাগলাম। দ্বিতীয় ইন্টারভিউতে ভদ্রলোককে দেখা গেল না বলে একটু স্বস্তি পেলাম। দেখা গেল, দুই নম্বর ইন্টারভিউতেও টিকে গেলাম দুইজনে। ধুত্তোরি। এত করেও ঠেকানো গেল না চাকরীটাকে। গোঁফজোড়া এবার ছাড়তেই হবে!! ঘোড়ার ডিমের চাকরী আমার। কিন্তু বাবার সংসার ভারাক্রান্ত চেহারা মনে হতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, চাকরীটা করবো। তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতেই বাসায় ফিরলাম।
ঘটনাটা এখানেই শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু হলো না।
পাড়ায় কিভাবে যেন গোঁফ ছাটার কথাটা রটে গিয়েছিল। সন্ধ্যার সময় পাড়াতো বন্ধুরা সব দলবেধে হাজির। চাকরীর শুভেচ্ছা জানাতে নয়, এসেছে গোঁফ ছাঁটা অভিযানে সঙ্গ দেবার বাসনায়। আমার শোক ওদের মচ্ছব! ঘোষনা করা হলো এই ঘটনা বিনা উৎসবে ছাড়া যাবে না। পাড়ার নাপিতকে দিয়ে বিশেষ কায়দায় ছাঁটানো হবে আমাদের গোঁফ। পরিষ্কার বুঝে গেলাম বেইজ্জতীর বিশেষ আয়োজন করা হলো। কোন অজুহাতে পালিয়ে দুরে কোন অচেনা নাপিতের সেলুনে গিয়ে কাটতে চাইলাম। কিন্তু আমাদের দুজনকে চোখে চোখে পাহারায় রাখা হলো। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখা গেল ছোটখাট একট মিছিল হয়ে গেছে দশবারো জনের। সবাই প্রথমে মোড়ের টং দোকানে গিয়ে একচোট চা বিস্কুট সিগারেট চালালো আমাদের উপর দিয়ে। চল্লিশ টাকা এক ধাক্কাতেই শেষ। তারপর আমাদের দুজকে সেলুনে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। আর সবাই চারপাশে ঘিরে দাড়ালো যেন চিড়িয়াখানার বাঁদরকে শেভ করানো হচ্ছে। হাসাহাসি চলছে খুব।
পাঁচমিনিটেই সাফা হয়ে গেল দশ বছরের শান দেয়া গোঁফ। আয়নায় নিজেরে চিনতে পারলাম না। যাত্রাপালার সং দেখছি যেন। এই চেহারার নিয়ে রাস্তায় বেরুবো কী করে? ভীষন বিব্রত অবস্থায়ও কাষ্ঠ হাসি দিতে হলো। সেলুনের ভেতর বাইরে থেকে প্রবল করতালি শুরু হলো। কাজ শেষে বিল দেবার সময় এলো নাপিতের আবদার। দুই জনের গোঁফছাটা দশটাকার ব্যাপার। কিন্তু নাপিত ব্যাটা বলে বসলো, 'দাদারা জীবনে প্রথম গোঁফ ছাঁটলেন। আমাদের বকশিশ না দিলে দাবী রেখে দেবো'। পুরোনো নাপিত, নতুন আবদার, কত বেতমিজ। কিন্তু কি আর করা। দুটাকা দুটাকা করে আরো চার টাকা গচ্ছা দিলাম।
সবাইকে বিদায় দিয়ে দুই বন্ধুতে আলাপ হচ্ছিল। অত্যন্ত হিসেবি ও মিতব্যয়ী বিল্লাহ বেজার মুখে বললো, "দোস্ত চাকরী পাইতে খরচ হইছে ছয়টাকা। কিন্তু গোঁফ ছাঁটার খেসারত তো গেল চুয়ান্ন টাকা। দুনিয়াতে বিচার নাই। এই ভাবেই সম্পদের অপচয় হয়!!"
No comments:
Post a Comment