পাকাপাকিভাবে শহরবাসী হই প্রথম স্কুলে ভর্তি হবার সময়। ১৯৭৪ সালে 'পাঠশালা' শব্দের সহজ বানানটা হেডমাষ্টারের ভয়ের চোটে গুলিয়ে ফেলে ক্লাস টুর বদলে ক্লাস ওয়ানে যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম তার নাম আগ্রাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখনকার দিনে সরকারী প্রাইমারী স্কুলগুলোতে সর্বশ্রেনীর মানুষের সন্তানেরা পড়তো। ১৯৭৪ সাল ছিল দুর্ভিক্ষের সময়। কলোনীর সিড়িগুলোতে গ্রাম থেকে আসা শত শত দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সমাগম।
মনে পড়ে স্কুল থেকে আমরা জাতিসংঘ মার্কা নীল রঙের খাতা কলম রাবার পেয়েছিলাম। সেই সাথে সম্ভবতঃ বিস্কুট আর দুধপাউডারও দেয়া হয়েছিল। ক্লাসে প্রথমদিন যে ছেলেটির পাশে বসেছিলাম তার নাম মিলন। আমার প্রথম স্কুল বন্ধু। ওর রোল নাম্বার দশের ভেতরে হলেও আমার রোলনাম্বার ছিল ৬৯। এটি ক্লাসের সর্বশেষ রোলনাম্বার। এই সম্মানটা আমি পাবার কারন হলো আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র ১৬ দিন আগে। সুতরাং শিক্ষা জীবনটা শুরুই হয়েছিল লাষ্ট বয় হিসেবে।
মিলন আমার চেয়ে স্বাস্থ্যবান ও দেখতে বড়সড় ছিল। বাবা সেদিন মিলনকে বলেছিল আমাকে একটু দেখে রাখতে। কারন গ্রাম থেকে সদ্য এসেছি শহরে, শহুরে কেতা তেমন কিছুই বুঝি না। মিলন কথা রেখেছিল। আমাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল যতদিন পেরেছে। অদ্ভুত ভালোবাসা আর মমতায় ঢেকে রেখেছিল আমাকে। মিলনের বাবা ছিল কোন এক সরকারী দফতরের পিয়ন, আবার নিকটস্থ কাঁচাবাজারে তাঁর একটা সবজীর দোকানও ছিল। এখন অনেকে অবাক হবে সবজী বিক্রেতা শ্রেনীর ছেলের সাথে কিভাবে বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু তখনকার সময়ে কার বাবা কি সেটা নিয়ে বন্ধুত্বে কোন হেরফের হতো না। ভেদাভেদ শুরু হয়েছিল আরো অনেক পরে, আরো বড় হতে হতে, সচেতন হতে শুরু হবার পর। মিলন আমার বন্ধু ছিল ততদিন, যতদিন শ্রেনীসচেতন বন্ধুগন আমার চারপাশ ঘিরে ফেলেনি। সম্ভবতঃ ক্লাস থ্রী থেকে আমার নতুন বন্ধু যোগ হতে শুরু করে। মিলনের সাথে দুরত্বের সুত্রপাত তখন থেকে।
ক্লাস ফাইভে উঠতে উঠতে আমার বন্ধুমহলে বহুজাতের বাঁদরের আগমন ঘটে। সহজ সরল মিলন তাদের সাথে এঁটে উঠতে পারলো না। সেইসব উৎপাতে এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ বৃদ্ধির কারনে মিলন আমার সাথে তেমন থাকে না। ফলে তার সাথে আমার দুরত্ব বাড়তেই থাকে। সম্ভবতঃ ক্লাস ফাইভের পর মিলন আর পড়াশোনা করেনি। আমাদের বন্ধুতার মৃত্যুঘন্টা বেজে গিয়েছিল তখনই। এরপরেও অবশ্য তাকে মাঝে মাঝে দেখতাম বাজারের তরকারির দোকানে বসতে। আমি ততদিনে মোটামুটি শ্রেনী সচেতন হয়ে উঠেছিলাম বলে মিলনকে বন্ধু স্বীকার করতে আমার ভেতর লজ্জাবোধের সৃষ্টি হয়। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর আমার মিলনপর্ব চুকে যায় স্থায়ীভাবে।
আরো পঁচিশ বছর পরের কথা।
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তার পাশের দোকান থেকে ফলমূল কিনছিলাম। হঠাৎ কাঁধে একটা হাতের অস্তিত্ব অনুভব করি। ফিরে তাকিয়ে আমার মুখটা হা হয়ে যায়। এ কে? কত যুগ আগের মুখ এটি। এখনো অবিকল সেই মুখ, সেই মায়া, সেই হাসি। এ তো আমার ছেলেবেলার বন্ধু মিলন!! সে যখন আমার নাম ধরে যখন ডাক দিলে আমি অবাক, আমাকে চিনেছে ও? আমার হাতটা ধরে শক্ত একটা চাপ দিলে মনে পড়লো ওর গায়ে আগের মতোই আমার চেয়ে বেশী জোর। ওই চাপেই বুঝে গেলাম মিলন এখনো আগের আন্তরিকতা ধরে রেখেছে। কথায় কথায় জানতে পারলাম মিলন এখন সরকারী চাকরী করে। কোন একটা ডিপার্টমেন্টের মিস্ত্রী পদবীতে কাজ করে। তার পোষাক একটু গরীবি হলেও চেহারায় পুরো আত্মবিশ্বাস। আমাকে যেন এখনো ভরসা দিয়ে যাচ্ছে। আছি বন্ধু তোমার জন্য।
মিলনের কথাবার্তা কুশালাদি জিজ্ঞেসের ভঙ্গীমায় পুরোনো আন্তরিকতা বিদ্যমান থাকলেও, শ্রেনীসচেতন আমি কিন্তু খানিক বিব্রত। ওকে এড়াতে পারলে যেন বাঁচি। মিলন যতটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার পরিবারের খোঁজখবর করছে, আমি ততোধিক আলগা হয়ে জবাব দেবার চেষ্টা করছি। এমনকি মিলনের পরিবারের কে কোথায় আছে আমি তা একবারও জানতে চাই না। পালিয়ে যাবার অজুহাত হিসেবে মিলনকে বলি, আজ আমার খুব কাজ আছে, পরে দেখা হবে। কিন্তু মিলনের হাত ছাড়তে অনিচ্ছুক। সে জোর করে আমাকে তার নিকটবর্তী বাসায় নিয়ে যায়। উচ্চকন্ঠে তার পরিবারের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। এবং সবচেয়ে যেটা অবাক করেছে- আমার বাবা তাকে দুই যুগ আগে একটা বিদেশী বেল্ট উপহার দিয়েছিল সে এখনো রেখে দিয়েছে সেই স্মৃতি। আমি বিব্রত অবস্থায়ও মুগ্ধ হয়ে যাই ওর আন্তরিকতায়। বন্ধুত্ব কত বছর জিইয়ে থাকে? সেরকম কোন সীমারেখা কি আছে?
মিলনকে দেখে বুঝলাম সত্যিকার বন্ধুত্বের কোন শ্রেনীভাগ থাকে না। কিন্তু আমার ভেতরে যে বৈষম্যের বীজ অংকুরিত হয়েছিল শৈশবে এখন তা মহীরূহ। আমি সেটা উপেক্ষা করে মিলনকে কিছুতেই বন্ধুতার কাতারে আনতে পারলাম না আর। তাই বিদায় নেবার সময় মিলনকে মুখে বললাম, দেখা হবে। কিন্তু একবারও বললাম না- 'একদিন সময় করে বাসায় আসবি। একবেলা খাবি আমার সাথে।' এমনকি আমার নতুন বাসার ঠিকানাও বললাম না ওকে।
বাসায় ফেরার পথে একা একা ভাবতে লাগলাম মানুষের স্বার্থপর শ্রেনীসচেতনতার বীজ কত গভীর হয়!! দেশ উদ্ধার করা আড্ডাবাজিতে শ্রেনীবৈষম্যের বিরূদ্ধে এত বড় বড় গীত গাই, সামাজিক অবিচারের বিরূদ্ধে চায়ের কাপে ঝড় তুলি, সেই আমি কী এই আমি? আমার সবগুলো সুশীল আচার কি মুখোশ নয়? বই-খাতা-কলম-কীবোর্ডের বাইরে ব্যক্তিজীবনে আমরা কতটা ভন্ড, হায়!
No comments:
Post a Comment