Thursday, July 29, 2010

অপূর্ব এক তিতকুনে রাঙানো আকাশ

গরম পানির মগে ধূসর সাদা ছোট্ট টি ব্যাগটা চুবিয়ে দিলাম। মগের তলানিতে গিয়ে বসে গেল টি-ব্যাগটা চুপচাপ। কয়েক মুহূর্ত পরেই টিব্যাগের তলা থেকে সোনালি রঙের ঢেউ খেলানো লিকার মগের তলদেশ আলোকিত করতে শুরু করে। অপূর্ব এক দৃশ্য। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকি। জলের ভেতর ভেজা ধোঁয়া যেন, কুন্ডলী পাকিয়ে ওঠা রঙিন লিকারগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা মগে।

খানিক বাদেই স্বচ্ছ গরম জলের মগটি হয়ে ওঠে একরাশ তরল সোনার আধার। তারপর সেই সোনালু রং আস্তে আস্তে গাঢ় হয়। সেই গাঢ়তা একসময় খয়েরী মেঘের ঘনত্ব নিয়ে তলা ছাড়িয়ে উর্ধ্বমুখী হতে থাকে। আমি আনমনে চেয়ে থাকতে থাকতে দু’আঙুলের মাঝে টিব্যাগের সুতোটা ধরে আলগোছে নাড়তে থাকি। রঙের খেলা সমাপ্ত হলে সিক্ত টি ব্যাগটি তুলে নিয়ে বাইরে ফেলে দেই। তারপর সেই রাঙানো মগটা মুখের কাছে এনে প্রথম চুমুক দিলাম উষ্ণ তরলে। নিমেষেই কষ-তিক্ত একটা স্বাদ জিবে আশ্রয় নিল।

ঠোঁটের বামপাশটা কুঁচকে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। মনে পড়লো, এই তেতো অপ্রত্যাশিত নয়। স্বেচ্ছায় জেনে শুনেই চিনি খাওয়া বাদ দিয়েছি। হরদম তেতো চায়ের স্বাদ নিচ্ছি। একসময় তেতো চা অসহ্য লাগতো, তেতো কিছুই নিতে পারতাম না। কাউকে তেতো স্বাদ নিতে দেখলে বিস্মিত হতাম। অথচ আজকাল প্রতিদিন অবলীলায় দুকাপ তেতো হজম করি। বহুকাল মিষ্টতায় ডুবে ছিলাম বলেই বোধহয় আজ আমি তেতো ভালোবাসি।

বেলা বাড়তে বাড়তে তেতোটাই সত্য হলো আজ? নাকি রঙের মুগ্ধতায় তেতো হজম করে নিচ্ছি। এত যুগ চা খাবার পরে এই অপূর্ব রঙ চোখে পড়লো আজকেই প্রথম!

ছৈয়দ্দা

ছৈয়দ্দাকে প্রথম যখন দেখি তখন সে তীব্র কন্ঠে কারো মায়ের সাথে সম্পর্কস্থাপন সংক্রান্ত গালিবর্ষন করছিল।

একটা মানুষ এক নাগাড়ে কতক্ষন গালির ঝড় তুলতে পারে সেটা ছৈয়দ্দাকে না দেখলে কখনোই জানা হতো না। এবং তার মুখ নিসৃত শব্দগুলোকে নেহায়েত গালি না বলে গালিঝড় কিংবা গালিটর্নেডো বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রথমে শুনতে কানে তালা দিতে হলেও কিছুদিন পর দেখা গেল ছৈয়দ্দার গালি না শুনলে মনে হতো কোথাও কোন ভজঘট লেগেছে, মানে দিনটা ঠিক নেই।

নতুন এলাকায় নতুন বাড়ীতে উঠেছি। বিশাল প্রান্তরের মাঝে একটুকরো জমিতে ছোট্ট একটা বাড়ী। দুর থেকে বাংলো মনে হলেও ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায় একটা সাদামাঠা মধ্যবিত্ত পরিবারের বসতঘর সেটি। শহরের মধ্যে অবস্থিতি হয়েও বাড়ীর চারপাশে এখনো জলজ্যান্ত গ্রাম। পেছনের ধানক্ষেতটি পশ্চিম দিকে যেতে যেতে প্রায় দিগন্ত ছুঁয়ে গেছে। বাড়ীর পাশ দিয়ে পুবদিকে যে মাটির রাস্তা চলে গেছে সেটা বেয়ে কয়েকশো গজ হাঁটলে নিকটস্থ প্রতিবেশী নুরুল আবসার সাহেবের বাড়ীটা পড়বে।

সেই বাড়ীর সামনে একটা পুকুর। মাটির রাস্তাটা পুকুরের পাড় ঘেসে চলে গেছে। মাটির রাস্তার ডান দিকে একটা গোবরগন্ধী গোয়াল দেখা যাবে। গোয়ালের লাগোয়া বেড়ার তৈরী একটা ঝুপড়ি ঘর। ঝুপড়ির চালে লাউয়ে সবুজ লতা ছেয়ে আছে, পাশে কয়েকটা কলা গাছ।

সেই গোয়াল, কলাগাছ আর ঝুপড়ির অস্থায়ী মালিক ছৈয়দ্দা এবং স্থায়ী মালিক সরকার। এটি রাস্তার জন্য অধিগ্রহন করা জায়গা। যদ্দিন রাস্তা হচ্ছে না তদ্দিন ছৈয়দ্দা দখলসুত্রে বসবাস করবে। পেশায় ছৈয়দ্দা একজন চাষা। এলাকায় জমি বর্গা নিয়ে চাষবাস করার জন্য সুদুর বাঁশখালী থেকে এখানে এসে ঢেরা বেঁধেছে।

গালিগালাজ শুনতে যতই খারাপ লাগুক আমাদের স্বীকার করতেই হয় যে গালিবর্ষনে সে কড়া সাম্যবাদী। গালিগালাজে তার কোন শ্রেনীভেদ নাই। প্রতিবেশী নুরুল আবসার সাহেবকে যে ভাষায় গালি দেবে, তার গোয়ালের অলস বলদকেও সে ভাষায়, আবার নিজের ছেলেকেও একই ভাষায় গালি। তার এই সাম্যবাদ নীতি প্রশংসার দাবীদার হতে পারে কিনা জানি না, কিন্তু আমাদের জন্য ছিল আতংকের।

আমাদের কানে সবচেয়ে বেশী পীড়া দিতো যখন গালিটা আবসার সাহেবের উদ্দেশ্যে বর্ষিত হতো। আবসার সাহেব সমাজে আমাদের শ্রেনীর লোক হওয়াতে ভয় ছিল - না জানি আমরাও কোনদিন ছৈয়দ্দার গালির লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়ি। তার গালির প্রতিবাদ করার মতো দুঃসাহস পাড়ার কারো ছিল না। পুলিশে কেস করারও কোন আইন নাই।

যেই প্রতিবাদ করবে ছৈয়দ্দা তার মায়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে মুহূর্তও দ্বিধা করবে না এবং সেই আওয়াজ অন্তত আধমাইল দুরে গিয়ে পৌঁছাবে। এরকম নিরুপদ্রপ গালিবর্ষনের সুযোগ থাকার ফলে ছৈয়দ্দার গালিঝড় সূর্যোদয়ের মতো প্রতিদিনের অপরিহার্য অংশ হয়ে থাকে।



কিছুদিন পর খেয়াল করলাম ভদ্রলোকদের মধ্যে আবসার সাহেবই সবচেয়ে বেশী গালি খায়। আর কেউ ততটা না। ব্যাপার কি? একদিন কৌতুহলী হয়ে ছৈয়দ্দার সাথে খাতিরা আলাপ জমালাম। আকড়া মাকড়া অনেক আলাপ হলো গরু-গাধা-চাষবাস বিষয়ে। এক সময়ে আবসার সাহেবের সম্পর্কে তার মতামত চাইলাম। ছৈয়দ্দা যা বললো তার ভদ্র ভাষার সারমর্ম হলো-

আবসার সাহেব লোক খারাপ না। ভদ্রলোক একটা নামকরা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। নিজের গাড়ী বাড়ী সামাজিক অবস্থান সবই আছে। তবে মানুষটা "লোয়া-কিপটা"(লৌহ কঠিন কঞ্জুস)। ছৈয়দ্দার সাম্প্রতিক মেজাজ খারাপ করার কারণ ঘটেছে আবসার সাহেবের ভাড়াটে বাড়ীটা।

আবসার সাহেবের দুটো বাড়ী। একটা বাড়ীতে নিজে থাকেন, আরেকটা বাড়ী ভাড়ায় দিয়েছেন। বাড়ী ভাড়া দেন ঠিকই কিন্তু টু-লেট সাইনবোর্ড লাগাতে রাজী না তিনি। এই সাইনবোর্ড বানাতে কয়টাকা খরচ হয়। কিন্তু আবসার সাহেবের কথা হলো, খামাকা পয়সা নষ্ট করে লাভ কি। তিনি বাড়ীর বাইরের দেয়ালে একটা ভাঙা ইট দিয়ে মোটা মোটা করে টেনে টেনে লিখে দিলেন -TO-LET.

ওটা লেখার পর থেকে ছৈয়দ্দার মেজাজ গরম।

জিজ্ঞেস করলাম টু-লেট সাইনবোর্ড না দেয়াতে তোমার সমস্যা কোথায়? বাড়ী হলো আবসার সাহেবের। তার যেরকম খুশী সেরকম পদ্ধতিতে ভাড়াটিয়া যোগাড় করুক।

ছৈয়দ্দা বলে, "আরে বদ্দা, তুঁই কি বুঝিবা, আঁরা বাশখাইল্যা মানুষ, হইলজা বড় দইজ্জার লান। ইতে কনজুইসর বাইচ্চা আঁরার জাতর বেইজ্জতি গইজ্জি। মাইনসে ইডা মার্কা লেখা দেখি আঁরে হয়দে- অডা বাইনচোত, তোরা বাঁশখাইল্লা হাইচ্ছোত ইডা মারি হোচ্চত।"
(মানে তুমি বুঝবা না, আমরা বাশখালীর মানুষ বড় ইজ্জতের মানুষ, কিন্তু এই ইট দিয়ে লেখা টু-লেট দেখে রাস্তার লোক বাঁশখালীর লোকের কিপটামির বদনাম করে যাচ্ছে, যা আমাকে হরদম শুনতে হচ্ছে প্রতিবেশী হওয়ার কারণে। আবসার সাহেব বাঁশখালীর লোক)।

এইটুকু শোনার পর আলাপ আর এগোয় না। ইজ্জত নিয়েই যখন ফ্যাসাদ, তখন ছৈয়দ্দার সাথে তর্ক করে নিজের ইজ্জতকে রিস্কে ফেলে দেবার চেয়ে তাকে ফ্লোর ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে যাওয়াই উত্তম। তাই করলাম।

Monday, July 12, 2010

অনাঘ্রাত দীর্ঘশ্বাস

এইসব প্রেম কি মিথ্যা ঘটনা? রটনার বাইরেও গোপনে গোপনে প্রেম চরে বেড়ায় আকাশে বাতাসে। আমাদের কতদিন কথা হয় না জানো তুমি চাঁদ?। হয়না দেখা কতোটা কাল!

আমি বাতাসের কাছে প্রান খুলে দেই....হাওয়ার শীতল পরশে ভেতরে লুকোনো ব্যাথা বুদবুদ হয়ে উড়ে চলে যায়। ঘুমঘরের চর্চিত মাটি ছুঁয়ে ফিরে আসে তার দীর্ঘশ্বাস।

হে পুত পবিত্র প্রেম হে মমতার ছায়া, হে বিরূপতার কায়া, আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাদের ভুলে গেছি। আমি কখনো নতজানু হইনি পাপের কাছে তবু আমি মাটির গর্ভে হারিয়ে গিয়েছি চিরতরে। আমি কখনো এখানে ছিলাম তার কোন চিহ্ন রাখেনি কেউ, আমার পুত্র প্রপৌত্রেরাও আমাকে মনে রাখেনি। আমি হারিয়ে গিয়েছি চিরতরে।

দেবদারুর চিরল কান্ডটা যেদিন আকাশের দিকে মাথা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল, আমি সেদিন মগ্ন ছিলাম দীঘির জলে কম্পমান পদ্মপাতার অতলে। অতি নিকটে দাড়িয়ে থেকেও আমাকে দেখেনি সে, উপেক্ষা করে চলে গেছে অনায়াসে।

আমাকে কোন কালে চিনতো বলে কোথাও লিখে রাখেনি তবু আমি জানি সে আমারে কতো বেশী জানতো, কতোটা ভীষণ বাসতো আর শ্রদ্ধায় হতো কতো অবনত।

আমি এইসব কিছু কথা মনে রাখি তবু কেউ জানে না আমি কোথায়, আমিও জানি না অকস্মাৎ আমি কোথায় চলে এলাম এই অন্ধকারে। আমি কেবল আলোকিত আকাশ দেখি আর দীর্ঘশ্বাস গুনি জীবিত মানবের।

যারা এখনো জানে না তাদের কেউ কেউ আসছে আমার কাছে। আমি অপেক্ষায় রই, অনন্তকাল, আমার কোন হতাশা নেই, আমার কোন আক্ষেপ নেই, আমার কোন প্রেম অবশিষ্ট নেই। আমি চুড়ান্ত ধ্বংসের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে।

পাগলরে তুই সাঁকো নাড়াইস নারে

চল চল চল/ ওরে তরুন দল/ তোদেরকে বোকা বানিয়ে/ যত্তসব আইবুড়োদের দল

ভয়ের কারন নাই। কবিতা লেখার অপচেষ্টা হচ্ছে না। আরেকটা টেকি গল্প। কম্পিউটারের ভুত স্মৃতি নিয়ে।

চাকরীতে ঢোকার সময় প্রথম মিথ্যাটা বলেছিলাম কম্পিউটার নিয়ে। অফিসে একখানা লেটেষ্ট কম্পিউটার কেনা হয়েছিল। ব্রান্ড Acer মডেল 486 সাথে আরো নানা ধরনের আপডেট জিনিস। নতুন ফিচার উইনডোজ ৩.১ এবং সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা এটি সম্পূর্ণ রঙ্গিন। এত চোখা জিনিস দেখে আমার ২৮৬ পিসিতে করা ৭ দিনের কোর্সের জ্ঞান ভিরমি খেল।

ফলে অফিসে জয়েন করার পর বড় সাহেব যখন জিজ্ঞেস করলো কে কে কম্পিউটার জানে, আমি 'জীবনেও কম্পিউটার দেখি নাই' বলে সবার পেছনে লুকিয়ে থাকলাম। যে কয়েকজন কম্পিউটার জানে বলে হাত তুললো তাদেরকে লম্বা দিস্তা কাগজের শিট ধরিয়ে দেয়া হলো কাজ করার জন্য। আমি মনে মনে বললাম, “মরগে তোরা, আমি বাঁচলাম”।

কম্পুজ্ঞানী কলিগরা ভেবেছিল ‘কম্পু পারি’ বললে বস খাতির করবে, বেতন ভাতা বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু লম্বা কাগজের দিস্তা দেখে ‘জেনারেল’ এসির বাতাসেও ঘামতে থাকলো এবং রাত বারোটায়ও কাজ অসম্পূর্ণ রেখে বাড়ী ফিরতে লাগলো। আমি কম্পুজ্ঞান লুকিয়ে রাখছিলাম ঠিকই কিন্তু মাঝে মধ্যে উকি দিয়ে দেখি কিভাবে কি করে। খেয়াল করে দেখলাম ওই কম্পুজ্ঞানীরা টাইপ কাজে আমার চেয়ে পিছিয়ে এবং লোটাস জ্ঞান খুবই দুর্বল। দুর্বলকে সাহায্য করার নৈতিক মানসে একদিন দুপুরবেলা বললাম আমি একটু ‘ট্রাই করি’।

দেখা গেল আমার ‘ট্রাই’ ওদের চেয়ে দ্রুত হচ্ছে। বসের অগোচরে ওদের কাজে সাহায্য করার অনুরোধ পেলাম। কিন্তু একদিন কাজ শেষে পেছনে ফিরে দেখলাম বস খাড়া আমার পেছনে। ভয়ে আমার শিরদারা টনটন করতে লাগলো। কারণ বসের পরবর্তী সংলাপগুলো হুমকিমূলক।

-কি করো তুমি এখানে, কম্পিউটার জানো না, কিন্তু অন্যের কাজে বিঘ্ন ঘটাও কেন? গেম খেলতে বসেছো নাকি?
-গেম? তাওবা। কাজের জায়গায় গেম খেলবো কেন? কিসের গেম?
-ন্যাকামি করো? ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানো না?
-সত্যি জানি না স্যার
-শাট আপ
-সরি স্যার
-তুমি ভালো করেই জানো লেটেষ্ট কম্পিউটারে সব ধরনের গেম লোড করা থাকে। কিন্তু খবরদার ভুলেও ওসব কখনো খেলবে না। এটা কাজের জায়গা। খেলাধুলার মাঠ নয়।
-কিন্তু কোথায় সেগুলা? আমি নিজেও খেলাধুলা পছন্দ করিনা কাজের সময়। খালি একবার দেখিয়ে দেন। জীবনেও যাবো না ওদিকে।
-আচ্ছা দেখাচ্ছি। বাট বি কেয়ারফুল। ডোন্ট এভার ওপেন দোজ গেমস!

তারপর বস একটা কমান্ড দিলে উইন্ডোজ ৩.১ খুললো। তারপর আরেকটা ক্লিক করলো। তারপর আরেকটা মেনু এলো। তারপর দেখা গেল নানা রকম তাস খেলা, মাইন সুইপার, আরো কি কি। সবাই মনযোগ দিয়ে দেখলাম। নোট করে নিলাম।

বস বললো, মনে থাকবে তো?
আমরা বললাম, ইয়েস স্যার। আলবত থাকবে।

আসলেই মনে থেকেছিল কিভাবে গেম সেকশান খুলতে হয়। সেদিন সন্ধ্যা থেকে নিয়ম করে দুই ঘন্টা কম্পিউটারে পালাক্রমে তাস খেলা চলতে লাগলো। অফিসে এতদিন পর একটা আনন্দের জায়গা পাওয়া গেল। ভার্সিটি ছাড়ার পর তাস খেলার সুযোগ হয় নাই আর।

পাগল তুই সাঁকো নাড়িস না রে।

একটি বোবায়িত কিংবা বিধ্বস্ত স্বপ্ন

অপরূপ এক স্বপ্ন দেখে এইমাত্র জেগে উঠলো সে।

এরকম স্বপ্ন এসময়ে দেখার কথা না তার। তবু দেখেছে এবং বিস্মিত হয়েছে। আবেশটা এখনো ছুঁয়ে আছে। ঘুম ভেঙ্গে গেলেও আধবোজা চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাইরে তখনো মিশমিশে কালো আঁধার। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলো ভোরের সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু ঘন মেঘলা বর্ষন ঢেকে রেখেছে চারদিক। একটানা বাতাসের সাথে তুমুল বৃষ্টি বাইরে।

এত ভোরে কখনো ঘুম ভাঙ্গে না তার। বরাবরই দেরীতে ঘুম ভাঙ্গা মানুষ ছিল। ছেলেবেলায় স্কুলে যেতে কষ্ট হতো ভোরবেলা। স্কুল শেষ হবার পর কলেজে কিছুদিন আরাম করার সাধ ছিল। শুনেছে কলেজে নাকি ক্লাস না করেও পরীক্ষা দেয়া যায়, কেউ কিচ্ছু বলে না। কথাটা শোনার পরপর কলেজে ওঠার জন্য তার ভেতর একটা স্বপ্ন জাগতে থাকে। ক্লাস এইট থেকেই সে নিজেকে কলেজে পড়ুয়া ভাবতে শুরু করে। কিন্তু সত্যি সত্যি যেদিন কলেজে উঠলো, মোহভঙ্গ হলো তার।

কলেজে দেরীতে গেলেও চলে, কিন্তু প্রাইভেট স্যারের বাসায় যাবার জন্য সেই সাতটায় উঠতে হতো। শীতকালে ভীষন কষ্ট। রিকশা নিয়ে চেরাগী পাহাড়ের পাশের গলিতে বিজয় স্যারের বাসা। বিজয় স্যার ফিজিক্স পড়াতেন। খুব নমনীয় একজন স্যার, আস্তে আস্তে বোঝাতেন, তার ভীষণ ভালো লাগতো এই স্যারকে। স্যারের বাসা থেকে বেরিয়ে খিদে পেয়ে যেতো। বন্ধুদের নিয়ে ঢুকে পড়তো গলির মুখে দস্তগীর রেস্তোরায়। সুগন্ধী সেঁকা পরোটা চায়ে ভিজিয়ে খেতে অপূর্ব লাগতো। তারপর আন্দরকিল্লায় গিয়ে মুড়ির টিন বাসে উঠে পড়তো। ২৫ পয়সা ভাড়া দিয়ে নিউ মার্কেট নেমে সিটি কলেজ।

কলেজে ক্লাস শেষে কোন কোন দুপুরবেলা কোন বন্ধুর আহবানে কলেজের লাগোয়া লায়ন সিনেমা হলে ঢুকে ৬ টাকার ব্যালকনি টিকেটে ১২-৩টার শো দিয়ে সেদিনের প্রাকটিক্যাল ক্লাসটা সেরে নেয়া হতো। এভাবে কতোবার যে ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে! কখনোই ভালো ছাত্রের কাতারে ছিল না সে।

খারাপও হতে পারেনি সুযোগের অভাবে। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই সে এক বড় সড় রাজনৈতিক পান্ডা হতে পারতো। একবার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছিল। যখন তাকে বিনা দোষে হাজতবাস করিয়েছিল স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার। বিদ্রোহী হয়ে উঠে রাজনৈতিক অস্ত্র তুলে নিতে চেয়েছিল হাতে। কিন্তু কেন যেন হওয়া হয়নি। আসলে নষ্ট রাজনীতি তখন থেকেই বিষময় হয়ে উঠেছিল তার কাছে।

আজ ভোরে ঘুম ভেঙ্গে কেন যেন সেই দিনগুলি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। অথচ স্বপ্নটার কাছে ওই স্মৃতিগুলো একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। দেশে ফিরেছে তিন মাস হলো। এখনো মনে হয় অচেনা কোন দেশে চলে এসেছি ভুল করে। দীর্ঘ বারো বছর পর চেনা দেশটা অচেনা হয়ে গেল। যেখানে সে বাস করতো সেখানে চেনা কিছুই নেই। মাটির রাস্তাটা হয়ে গেছে চার লেইনের হাইওয়ে। বাড়ীর চারপাশের ধান ক্ষেতগুলো আকাশছোঁয়া দালানে ভরে গেছে। কোথাও এক ফোঁটা দম ফেলার জায়গা নেই। বিকট শব্দে ট্রাক বাস ছুটে যাচ্ছে একের পর এক। সন্ধ্যের পর বিশাল লম্বা জ্যাম লাগে। একটানা হৈ চৈ রাত এগারোটা অবধি। পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়না মাঝরাত পেরিয়ে গেলেও।

আজকের হাইওয়ে এই সেদিনও ছিল নির্জন জলাভূমি। ভাবতে কেমন লাগে। সন্ধ্যা হলেই সুনসান। টেবিলে পড়তে বসে জানালা দিয়ে মনটা উড়ে চলে যেতো কোথাও। আশেপাশে কোন ঘরবাড়ী ছিল না। দখিনের ঘরটাতে থাকতো সে। দখিনের জানালা দিয়ে দখিনো হাওয়া আসতো হু হু করে। ফ্যান লাগতো না তার। ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে একটা চেয়ার একটা টেবিল। একটা চৌকি, দুটো বাশের কঞ্চির বুকশেলফ, আর একটা আলনা। এই নিয়ে ছিল তার নিজস্ব জগত। টেবিলে একটা আকাই স্টেরিও সেট।

সেখানে হারানো দিনের গান বাজতো। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতো। "তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার......." এত প্রিয় ছিল গানটা তখন! গাইতে গিয়ে তার চোখে জল এসে যেত। অথচ সে কাউকে হারায়নি তখনো পর্যন্ত। যখন সত্যি সত্যি হারিয়েছে তখন আর একটা গানও বাজেনি, কোথাও কোন সুর বাজে নি আর।

আজ শেষ রাতের স্বপ্নটিতে কি ছিল? সুন্দর একটা অবাস্তব দৃশ্য। নষ্টালজিক কোন উপাদান ছিল না। তবু বারবার সে ফিরে যাচ্ছে পুরোনো দিনে।

মানুষ বদলে যায়। সময় সবকিছুর বদলের কারিগর। বদলে গেলে কি চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়? বারো বছর পর দেশে ফিরে সবকিছু অচেনা লাগছে। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। অনেক স্মৃতি মুছে গেছে। এরকমই হবার কথা। কিন্তু বদলে যাওয়ার কষ্ট তাকে এমন পোড়ায় কেন। ফিরে এসে প্রথমেই খুঁজেছে যা খোঁজা উচিত নয় তার খোঁজ নিতে গিয়ে কি বিড়ম্বিত হয়েছে তা কাউকে বলাও যায় না।

মানুষ বদলে যায় সময়ের প্রয়োজনে নাকি নিজের প্রয়োজনে? এতখানি বদলে যাওয়া কি করে সম্ভব? বারো বছর কি খুব দীর্ঘ সময়? চেনা মানুষ এত অচেনা হয়ে যায় কেন? অনুভুতি ব্যাপারটা কি চিরকাল আপেক্ষিক? যখন যার তখন তার- আলাদিনের চেরাগের মতো। প্রতিটি মানুষ কি একেকটি আলাদিনের চেরাগ? যার হাতে পড়বে তার ঘষাতেই হুকুম তামিল করবে। কি অদ্ভুত!

মানুষের মনের চেয়ে পরিবর্তনশীল বস্তু এই জগতে সৃষ্টি হয়নি। কত মিথ্যা বিশ্বাসে কত প্রাণ অহেতুক ঝরে যায়। কত জীবন নষ্ট হয়ে যায় ভুল বিশ্বাসে। যে ফুলের আয়ু মাত্র একদিন সেও প্রতিশ্রুতি দেয় আজীবন সুগন্ধ বিলানোর। এত আত্মপ্রতারণা। তবু জেনে শুনে বিশ্বাসে গা ভাসায় মানুষ।

আগে কখনো এত গভীরভাবে চিন্তা করেনি। আজকের স্বপ্নটা সব উলটপালট করে দিল। স্বপ্নটা মিথ্যা। মিথ্যা হলেও সুন্দর। মুগ্ধ করে রেখেছে তাকে। স্মৃতির পরতে পরতে যে আনন্দগুলি বিষাদের আবরনে ঢাকা ছিল, আজ বিষাদের ব্যান্ডেজ খুলে তাকে ডেকে বলেছে, আসো আমি মরিনি, এখনো আছি বেঁচে। তুমি আসো, নতুন করে বাঁচো। আমি ভুলিনি তোমাকে। তুমি যা দেখেছো তা দুঃস্বপ্নমাত্র। এই দেখো আমাকে। আমি আছি, আমিই সত্যি। আমার কাছেই থাকো তুমি।

ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। তারপর থেকেই মনের ওলটপালট চলছে। এমন মিথ্যা কেউ বলে। সে তো কখনো এমন মিথ্যাবাদী ছিল না। স্বপ্নে এমন ডাহা মিথ্যা বলতে পারলো?

এই মিথ্যা স্বপ্নও তার বুকে দ্রিম দ্রিম করে বাজাতে লাগলো অনুভুতির ঢোল। যে অনুভুতি সে কবর দিয়ে রেখেছিল বারোটি বছর। হঠাৎ সে ভাবতে লাগলো। এই যে জেগে উঠেছি, এটাও কোন স্বপ্ন নয়তো? বাইরের বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ। বিজলীর চমক। অন্ধকার। সবকিছুই স্বপ্ন নাতো?

মশারির বাইরে একটা ছায়া এসে দাঁড়ালো। এলোচুলে দাঁড়ানো। কে? এই ঘরে তো আর কেউ নেই। বিদেশ থেকে আসার পর এই হোটেলে তিনমাস ধরে বাস করছে সে। রুমের দরোজা বন্ধ। কিন্তু এই নারীমূর্তি কোথা থেকে এলো? হঠাৎ ভয়ে গা শির শির করে উঠলো তার। একটু আগের জেগে ওঠা প্রেমানুভুতিময় স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটলো নিমেষে।

বহু বছর আগে এক রাতে এরকম একটা অচেনা মূর্তি তার বুকের উপর চেপে বসেছিল। গলার ওপর দুহাতের সাড়াশি চাপ। দম বন্ধ হয়ে উঠছিল তার। মরে যেতে যেতে প্রচন্ড চীৎকারে জেগে উঠতে চাইছিল। কিন্তু কেউ তার ডাক শুনতে পাচ্ছিল না। একেবারে শেষ পর্যায়ে গোঁ গোঁ শব্দ শুনে মা ছুটে এসেছিল পাশের ঘর থেকে। তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল। বলেছিল, খোকা উঠ, তোকে বোবায় ধরেছে খোকা। জেগে উঠ নইলে মারা যাবি। সে জেগে উঠে দেখে সারা শরীর ঘেমে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।

মশারির পাশে দাঁড়ানো আবছা নারী মূর্তিটা দেখলো সে আবারো। আজকে সে একা। এই হোটেলে আশেপাশের ঘরে কেউ নেই। প্রায়ই খালি থাকে হোটেলটি। এই বর্ষা সিজনে গ্রাহক কম। চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। আজ কে তাকে বাঁচাবে? কে জাগাবে তাকে?

প্রেম খেদ দুঃখ কষ্ট সব ছাড়িয়ে তার মধ্যে জেগে থাকে একটাই অনুভুতি- ভয়। স্বপ্নের ভেতরে আরেক স্বপ্নের প্রতারণায় আবদ্ধ সে। প্রথম স্বপ্নটা দেখে ঘুমিয়ে থাকলেই ভালো ছিল। ঘুমের মধ্যে কেউ বুকের উপর চেপে বসলেও টের পেত না। মৃত্যুভয় কি ঘুমেও জেগে থাকে? কে জানে। আসন্ন পরিণতির জন্য তৈরী হলো সে।

সুপ্রিয় ড.ইউনুস, আপনি কি এখনো আছেন বাংলাদেশের কোটি মানুষের হৃদয়ে?

প্রিয় ড.ইউনুস,

এ চিঠি আপনি কখনো পড়বেন না হয়তো। তবু যদি কখনো চোখে পড়ে এরকম ক্ষীণতম আশা নিয়ে আম জনতার একজন হয়ে হঠাৎ আপনাকে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করছে আজ।

সত্যি কথা বলতে কি আপনাকে নিয়ে আমরা একটা বিভ্রান্তিতে আছি। একসময় আপনাকে আমাদের ভীষণ ভালো লাগতো, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আপনি, কাছাকাছি এলাকার মানুষ। ভালো লোক। গরীবের ব্যাংকার। বিশ্বব্যাপী খ্যাতি। ক্লিনটন পরিবারের বন্ধু। সব মিলিয়ে আপনার মধ্যে মুগ্ধ করানোর প্রচুর উপাদান ছিল। গর্ব করার অনেক ব্যাপার ছিল।

গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋনের উচ্চ সুদ কিংবা জবরদস্ত আদায় পদ্ধতি নিয়ে যে সব অভিযোগ শোনা যায় সেগুলোও আমাদের কাছে তেমন পাত্তা পায়নি। প্রবল রাজনীতি প্রবন দেশেও আমাদের ধারনা ছিল আপনি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী গ্রহনযোগ্য ব্যক্তি। শেখ মুজিবের পর বাংলাদেশকে এত উঁচুতে আর কেউ নেয়নি। বাংলাদেশের যে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে আপনার আন্তর্জাতিক খ্যাতি অনেক বেশী। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার বক্তৃতা শোনার জন্য বসে থাকে জ্ঞানীগুনী মানুষজন। আপনার লেখা নিয়ে গবেষণা হয় জাপান আমেরিকার বড় বড় অর্থনৈতিক ফোরামে। দীর্ঘ দেড়যুগ আপনি বাংলাদেশে অবিসংবাদী ব্যক্তিত্ব হয়ে ছিলেন।

কিন্তু ২০০৬ সালে এমন কি ঘটলো? নিজের দেশে আপনাকে হঠাৎ করে বয়কট করা শুরু হলো কেন? বিশেষ করে নোবেল পাওয়ার পর থেকে বেড়ে গেল কেন ওটা? আপনাকে লোকজন হিংসা করা শুরু করেছে নোবেল পাওয়াতে? আপনি কি কখনো আসল কারনটা অনুসন্ধান করে দেখেছেন? ২০০৬ সাল থেকে আপনার অবিসংবাদী অবিতর্কিত অবস্থানটা নড়ে গেল কেন হঠাৎ? এমন কি ঘটলো আপনার? ভেবেছেন কখনো?

প্রিয় ড.ইউনুস, আমাদের মতো অর্ধমূর্খ জনতার কেউ কেউ আপনাকে নোবেলের চেয়েও বড় মনে করতাম। আপনি নোবেল পাওয়াতে আমরা যতটা অবাক হয়েছি তারচে বেশী অবাক হয়েছি নোবেল আপনাকে আত্মহারা করেছে বলে। নোবেল পেয়ে কঠিন রকম আনন্দ হতেই পারে, দোষের কিছু নয়। কিন্তু নোবেল পাওয়ার পর আপনার মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা তৈরী হয়েছিল কখনো কি তা টের পেয়েছিলেন? সেই সময় আপনার সাক্ষাতকার, আপনার বানী, উপদেশ, দেশের চলমান পরিস্থিতি, ওই সব কিছুর মধ্যে আপনার ভুমিকার কেমন অসংলগ্নতা লক্ষ্য করেছি আমরা সবাই, কিন্তু আপনি কি একবারো টের পাননি?

প্রিয় ড.ইউনুস, আমি বলবো - নোবেল নয়, রাজনীতিবিদগনকে মোটাদাগে দুর্নীতিবাজ বলা নয়, ক্ষুদ্রঋনের উচ্চসুদ নয়, আপনার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামিয়েছে অন্য কিছু, অন্য কোন বিষয়।

২০০৬ সালের অক্টোবরে আপনি নোবেল প্রাপ্তির আনন্দে হয়তো খেয়াল করেননি দেশের মানুষ সেই সময়কালে একদল শকুনের থাবার নীচে কিরকম অনিশ্চিত জীবন যাপন করছিল। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র দেশটাকে পাকিস্তান বানাবার সব আয়োজন সেরে ফেলেছিল। সাজানো নির্বাচনে বিজয়ী হবার সব কুটকৌশল তৈরী করা হয়েছিল।

আপনি গরীবের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টি করেছেন। দারিদ্র বিমোচনের স্বপ্নে বিভোর আপনি। দারিদ্রকে যাদুঘরে পাঠাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু কি করে আপনার চোখ এড়িয়ে গেল ইয়াজুদ্দিন আইজুদ্দিনরা দেশটাকে তখন কোন পথে নিয়ে যাচ্ছিল? কিভাবে প্রস্তুত হয়েছিল নিজামী- মুজাহিদদের হাতে দেশটার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিতে আপনি একটুও খেয়াল করেননি? বিশ্বাস হয় না।

প্রিয় ড.ইউনুস, আপনি হয়তো জানেন না সেদিন আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল লক্ষ কোটি মূর্খ জনতা। আপনি নোবেল পাওয়ার পর ভেবেছিল আপনি অন্ততঃ মৃদু তিরস্কার করবেন সেই অশুভ ক্ষমতাসীন চক্রকে। দেশকে ঠিক পথে চালাতে আপনি কিছু কথা বলবেন জনসমক্ষে। আপনাকে চোখ রাঙাবার সাহস ওদের নেই বলে আমাদের ধারনা।

কিন্তু সেদিন যখন মুর্খ জনতার আশাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আপনি ইয়াজুদ্দিনদের পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে নোবেল আনতে চলে গেলেন নোবেল দেশে, আমরা প্রবল হতাশায় বালিশে মুখগুজে ভুল থাকতে চাইলাম আপনি আমাদের খেয়াল না করে নিজের কৃতিত্বের দিকেই চেয়ে ছিলেন আর একপেশে সংবর্ধনা সভায় ফুলের তোড়া গ্রহন করে আপ্লুত হলেন।

হায় দেবতা। আপনি মূর্খ জনতার চোখে দেবতাই তো ছিলেন। আপনার ভুমিকা দেখে সেদিন আমাদের মতো মূর্খ জনতারও মোহভঙ্গ হলো । রাজনীতিবিদদের মতো আমরাও আপনাকে বর্জন করা শিখে গেলাম রাতারাতি।

সুপ্রিয় ড.ইউনুস আপনি ১/১১ এর সুফল ঘরে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু একবারো ভাবেননি আমাদের হতাশার কথা।

জেনে রাখুন- মানুষেরহৃদয় থেকে আপনার চ্যুতির কারন ক্ষুদ্রঋন নয়, রাজনীতি করার আকাংখা নয়, রাজনীতিবিষোদাগার নয়। ন্যায়ের প্রতিআপনার সেদিনকারঅস্পষ্ট ভুমিকার কারনেইআপনি পদচ্যুত হয়েছিলেনমানুষের হৃদয় থেকে। যেখানে আপনি ফিরে যাবার চেষ্টাও করেননি আর।

আপনার জন্মদিনে এমন একটা লেখা লিখতে হলো বলে আমি অত্যন্ত দুঃখিত ড.ইউনুস। তবে বিশ্বাস করুন, মানুষ চাইলেই ভুল শোধরাতে পারে। নিজেকে স্পষ্ট করতে পারে। আপনি বিশ্বের দরবারে যেরকম স্পষ্ট নিজের দেশেও স্পষ্ট থাকুন। মানুষ আপনাকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে। ভাল থাকুন সফল থাকুন আজ, সারা বছর, সারাজীবন।

বিনীত,
একজন অর্ধমূর্খ নাগরিক

আবার যদু কাগু (খোমাবইয়ে আগুন)

পূর্ব কাহিনীঃ আন্ডামারার যদু কাগু

কাগুর বয়স ১৩২ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু একেবারে বুড়ো হয়ে যায়নি। গায়ে তাকদ আছে তখনো। সেই সময় দেড়শো দুশো বছর বাঁচতো মানুষ। কাঠুরে পুত্র মধু আন্ডামারা ছেড়ে পালানোর পর যদু-কাগুর ঘুমটা ভালোই হচ্ছিল। ব্যবসাপাতিও চরমে।

কিন্তু মাঝে মাঝেই কিছু দুঃস্বপ্ন দেখে কাগু। একদিন চরম এক দুঃস্বপ্নের পাল্লায় পড়লো। দেখলো তার যদু-মাচা চুরি করে তার ৪২তম সন্তান ১২ বছরের দুষ্টু বালক একটা চিলের পাখার সাথে বেঁধে দিল। যদু-মাচা হয়ে গেল চিল-মাচা। সেই চিল-মাচা সাঁই সাঁই করে উড়ে ভিন দেশে নিয়ে গেল দুষ্টু বালককে।

বেশ কিছুদিন গেলে বালক ফিরে এলো চিল-মাচায় চড়ে। কিন্তু সাথে করে নিয়ে এলো ভিনদেশী রূপবতী যৌবনবতী ষোড়শী এক বালিকা। বয়সে এবং শরীরে বালকের চেয়েও বড়।

চিল-মাচা আন্ডামারায় ল্যান্ড করার পর বালক এসে যদুর সামনে নামলো। বলল, "বাবা ইহা আমার গার্লফ্রেন্ড জান্টুবানু, আমি ইহাকে বিবাহ করিতে চাই।"

একেতো বয়সে বড় বালিকা। তার উপর মুখে তার ভিনদেশী বুলি। কথাটা শোনামাত্র যদুকাগুর মাথায় দাবানল লেগে গেল। কত্তবড় সাহস!!! এখুনি তাকে শায়েস্তা না করলে শিক্ষা হবে না। রেগে মেগে 'ওরে হতচ্ছাড়া বিয়াদ্দপ বাঁদর তোর এতবড় দুঃসাহস, আমার সাথে বাংলায় কতা কস' বলে গদাম করে পা চালিয়ে দিল বালকের উদ্দেশ্যে।

কিন্তু সেই পা গিয়ে লাগলো পাশে ঘুমিয়ে থাকা কাগুর ৭৭ বছর বয়সী বউ গুন্নীবানুর হাঁটুতে । গুন্নীবানু তার ১১তম এবং সর্বশেষ বউ। বুড়ী এমনিতে বাতের ব্যাথায় কাহিল। সারারাত কোঁকাতে কোঁকাতে দেরীতে ঘুমিয়েছে কাল রাতে। এখন কাগুর বেমক্কা লাথি খেয়ে কাঁচাঘুমটা ভেঙ্গে গেল তার।

তার আগের রাতে তরকারীতে নুন হয়নি বলে যদু বুড়ো একটা লাথি দিয়েছিল খাবারের বাটিতে। গুন্নীবানু পাল্টা জবাব হিসেবে সেই তরকারীর আস্ত বাটি পুরোটাই যদু-কাগুর মাথার উপর ঢেলে দিয়েছিল। কাগু নীরবে হজম করে নিয়েছিল তখন।

গুন্নীবানু ভাবলো এখন সেই ঘটনার প্রতিশোধ নেবার জন্য যদুবুড়া তার ঘুমন্ত হাঁটুতে লাথি মেরেছে। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে মেজাজ একে তো ফরটি নাইন, তার উপর আগের রাতের কথা মনে হতেই "ওরে হতচ্ছাড়া মিনসে ঘুমের মধ্যেও আমারে জ্বালাইতাস হারামী, দেখাইতাছি মজা তোর আইজ" বলে চিৎকার করে উঠলো বুড়ী।

তারপর পাশ থেকে নারকেলের ছোবড়ার পাপোষটা নিয়ে কাগুর নাক বরাবর একটা আছাড় দিল। পাপোষের আঘাত নাকে লেগে কাগুর ঘুম গেল টুটে, স্বপ্ন গেল ছুটে।

চোখ খুলে গুন্নীবানুর রুদ্রমূর্তি দেখে বুঝে ফেললো ঘটনা খারাপ, আরো খারাপ হবার আগেই মাটিতে ঝাপিয়ে পড়ে বুড়ীর পায়ে ধরে ফেললো, "বউ এইবার মাফ কইরা দে, আমি একটা খারাপ স্বপন দেইখা উঠলাম। তাই ঘুমের মিদ্যে পা চটে গেল। তোরে ইচ্ছা কইরা লাথি দেই নাই। জীবনে আর কুনদিন এরূম হইবো না। মাচার কসম"

মাচার কসম শুনে বুড়ী শান্ত হলো। তারপর কাগু স্বপ্নের ঘটনাটা বিস্তারিত খুলে বললো বুড়ীকে।

স্বপ্ন সবসময় সত্যি হয় না। কিন্তু যদি সত্যি হয়? বুড়ীও ভয় পেল ছেলের দুর্মতির আশংকায়। তাই দেরী না করে ভোর হবার আগেই যদু কাগুকে নিয়ে তাদের বানানো সবগুলা যদু-মাচায় আগুন ধরিয়ে দিল। কাগু নিজ ব্যবসার ক্ষতিও তোয়াক্কা করলো না ছেলের অমঙ্গল আশংকায়।

ফলে পরদিন থেকে আন্ডামারার লোকজন বাজারে গিয়ে তরমুজ বিক্রি করতে পারলো না, চাল কিনতে পারলো না, ডাল কিনতে পারলো না, গোসত কিনতে পারলো না। অভাবে অনটনে আরো দুর্বল হয়ে পড়লো। তারা কেবল তরমুজ খায়, আর তরমুজ হাগে। গ্রামের নালা নর্দমা সব তরমুজের লালে লাল হয়ে গেল।


[এটি ১০০% আজাইরা সাময়িক রূপকথা]

আন্ডামারার যদু-কাগু (১০০% কপিরাইটেড রূপকথা)

চোদ্দ হাজার পুরুষ আগেকার কথা।

দক্ষিন এশিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে সবুজ শ্যামল একটা গ্রাম আন্ডামারা। গ্রামের প্রধান ফসল তরমুজ। আর কোন ফসলের চাষবাস শেখেনি ওরা। ফলে তরমুজের বিনিময়েই চাল ডাল সহ অন্যান্য জিনিসপত্র যোগাড় করতো গ্রামবাসী। ওখানে এত হাজারে হাজারে তরমুজ ফলতো যে বেশীরভাগ মাটিতেই গলে পচে যেত। অথচ কয়েক ক্রোশ দূরের বাজারে তরমুজের খুব চাহিদা। সেখানে তরমুজের বিনিময়ে অনেক ভালো জিনিস পাওয়া যেত, সোনা রূপায় সংসার ভরে যেত। গ্রামের লোকদের ভাগ্য বদলে যেত কদিনেই। কিন্তু যাবার পথ দুর্গম জঙ্গলময় হওয়াতে মাথায় করে অত বড় তরমুজ নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। সেই যুগে গাড়ী ঘোড়া দুরে থাক, চাকাও আবিষ্কার হয়নি। ফলে আন্ডামারার সুস্বাদু তরমুজের স্বাদ খুব বেশী দূরে যায়নি।

সেই আন্ডামারায় ছিল যদু কাগু নামে এক বাঁশের কারিগর। বাঁশের তৈরী নানা রকম জিনিস বানাতে ওস্তাদ লোকটা। একদিন সে দারুণ একটা জিনিস আবিষ্কার করে বসে। একটা অভিনব বাঁশের মাচা। সেটাকে দুটো গরুর সাথে বেঁধে দিয়ে তাতে চড়ে বসলো সে। গরু হাঁটলে জিনিসটাও চলতে শুরু করে। তাকে আর কষ্ট করে হাঁটতে হয় না।

জিনিসটা তাকে আরামের সন্ধান দিল। নতুন আবিষ্কারের নাম দিল যদু-মাচা। সেই যদু-মাচায় করে একদিন কিছু তরমুজ নিয়ে গেল কয়েক দূরের বাজারে এবং তরমুজের বিনিময়ে বেশ কিছু চাল ডাল ভর্তি করে গ্রামে ফিরে এলো সন্ধ্যেবেলা। কিছুদিন পর লোকজন খেয়াল করলো কয়েকদিন পরপর সে বাজারে যায় আর ফিরে আসে নানা রকম পণ্য নিয়ে। তা দেখে চমৎকৃত গ্রামবাসী অনুরোধ করলো তাদের জন্যও যদু -মাচা তৈরী করে দিতে।

কিন্তু লোকটি জানায় ওটা বানানো খুব কঠিন, সবার জন্য বানানো সম্ভব নয়। তবে চাইলে তার যদুমাচা ব্যবহার করতে পারে স্বল্পদুরত্বে। বাজারে আর কারো পণ্য নিতে অনাগ্রহী কাগু। তখনকার দিনে টাকা পয়সার চল হয়নি। সবকিছু বিনিময়ের মাধ্যমে চলতো। উপায় না দেখে গ্রামবাসী কমিশনের বিনিময়ে যদুমাচায় করে কেবল কাছাকাছি এলাকায় পন্য আনা নেয়া শুরু করলো এবং অল্পদিনের মধ্যেই যদুমাচা খুব জনপ্রিয় হয়ে গেল।

বাজারে পণ্য বিক্রির সুযোগ না পেয়েও গ্রামবাসীর কাছাকাছি যাতায়াতের সমস্যার সমাধান করলো বলে গ্রামের গর্ব হয়ে গেল লোকটা। সুনাম ছড়িয়ে গেল আশেপাশের গ্রামেও। অতঃপর স্বচ্ছলতার সাথে সুখে শান্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে লাগলো সে।

গল্পটা এখানে শেষ হয়ে যেতে পারতো!

কিন্তু দিন সমান যায় না। একদিন আন্ডামারার এক কাঠুরিয়া পুত্র মধু জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কাটতে গিয়ে দেখলো একটা কাঠের গুড়ির অবশিষ্টাংশ রয়ে গেছে যা লাকড়ি হিসেবে কোন কাজে আসবে না। চাঁদের মতো গোলাকার খন্ডটা সে গড়িয়ে কাছের জলাশয়ের দিকে চালান করে দিল সে। কাঠের গোলাকার খন্ডটি গড়িয়ে যাবার দৃশ্যটা হঠাৎ তার মাথায় একটা দুষ্টবুদ্ধির যোগান দিল। সে একই রকম আরো একটা চাকতি বানিয়ে দুটো একসাথে লাঠি দিয়ে জোড়া দিয়ে গড়াতে গড়াতে বাড়ী ফিরলো। একটা মজার খেলনা পেয়ে আহ্লাদিত কাঠুরিয়া পুত্র।

[মধু কাঠুরের সেই সামান্য খেলনা আবিষ্কার যে সুদূর ভবিষ্যতের মানব সভ্যতার ভিত রচনা করে ফেলেছে তা বোঝার ক্ষমতা তখনকার কোন মানুষের ছিল না। সেটা ছিল সভ্যতারই চাকা, যা কয়েক হাজার বছর পরে গিয়ে চুড়ান্ত উৎকর্ষতায় নিয়ে যাবে মানবজাতিকে।]

কদিন বাদে খেলনাটাকে আরো একটু কায়দা করলো মধু। চাকার উপরিভাগে কায়দা করে কাঠের তক্তা বসিয়ে তার সাথে দড়ি বেঁধে লাকড়ি আনা নেয়ার কাজ করতে লাগলো বন থেকে। তার সেই বাহনের নাম দিল মধু-মাচা। একদিন মধু-মাচার সাথে সে একটা গরু জুড়ে দিয়ে দেখলো গরু লাগানোর পর দারুন গতি পেয়েছে তার বাহন।

একবার সাহস করে সেই বাহনে করে বাজারেও চলে গেল। দেখা গেল দুপুরের আগেই ফিরে এসেছে সে বাজার ঘুরে। গ্রামবাসী চমৎকৃত হলো তার কীর্তিতে। গ্রামের কেউ কেউ তার মধু-মাচায় করে বাজার ঘুরে আসতে লাগলো শখের বশে। কেউবা পন্যও আনা নেয়া শুরু করলো। যদিও বেশীরভাগ লোক যদু-মাচায় অভ্যস্ত তবু কিশোর তরুনদের কাছে মধু-মাচা বেশ জনপ্রিয়তা পেল। তারা যখন তখন বাজারে যায় আসে।

মধু সরল সোজা ছেলে। কারো কাছে কমিশন চায় না তার মধু-মাচায় চড়ার বিনিময়ে। একেবারে বিনামূল্যে আসা যাওয়া করা যায় বলে বড়রাও নজর দিতে শুরু করলো মধু-মাচার দিকে। ভাবলো এটাতে করে যদি নিয়মিত তরমুজ আনা নেয়া করা যায় তাহলে সময় অনেক বেঁচে যায়। বাজারে তরমুজ বিক্রি করা যায়।

মধুমাচার প্রতি গ্রামবাসীর আগ্রহ যদু কাগুকে ভাবনায় ফেললো। একটা ফন্দী বের করলো সে। একদিন গ্রামের মোড়ল মাতব্বর সবাইকে তার বাড়ীতে দাওয়াত দিয়ে খাসী জবাই করে খাওয়ালো। খাওয়াদাওয়া শেষে আসল কথাটা পাড়লো,

"ভাইসব, নিশ্চয় খেয়াল করছেন, দিনকাল কেমন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কলিযুগ এসে গেল বলে। আমাদের যুগে আমরা কখনো গ্রামের বাইরে বাজারে যেতাম না কিশোর বয়সে। এখনকার ছেলেপেলে বেয়াদপ হয়ে গেছে, মুরব্বী মানে না, অনুমতি ছাড়া যখন তখন গ্রাম ছেড়ে সেই দুরের বাজারে গিয়ে আড্ডা দেয়। এসব অনাচার বন্ধ করতে না পারলে গ্রামে ইজ্জত সম্মান নিয়ে থাকা যাবে না।"

মুরব্বীরা তখন কাগুর খাসির গোসত খেয়ে ফুর্তিতে আছে। যদুকাগুর কথায় এক বাক্যে সায় দিল। "ঠিক বলছেন ভাইসাব। এই অনাচার চলতে পারে না দেশে। কি করতে হবে এখুনি ঠিক করেন। আপনি জ্ঞানী মানুষ আপনিই বলেন কি করতে হবে।"

যদু কাগু তখন বললো,
"আমি জানি কি করে অনাচার বন্ধ করা যাবে। যত নষ্টের মূল ওই কাঠুরিয়ার ছাওয়াল মধু, সে কি একটা দুষ্ট জিনিস বানাইছে আমার গরু-মাচা থেকে নকল কইরা। নাম নাকি মধু-মাচা। কত্তবড় বেয়াদব। সেই মধু-মাচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে আন্ডামারা গ্রামে। তাতে কেউ চড়লে তাকে দশটি করে বেত্রদন্ড দেয়া হোক। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এরকম দুঃসাহস দেখাতে না পারে।"

গ্রামের মোড়ল মাতব্বর সবাই হৈ হৈ করে একবাক্যে রাজী হলো। নিষিদ্ধ করা হলো
মধু-মাচা। যত্তোসব অনাচার দুর হোক। এই বলে সভা সমাপ্ত করে বাড়ী ফিরে গেল সবাই।

খবরটা গেল মধুর কানে। সে বুঝলো যদু-মাচা কেন তার বিরূদ্ধে লেগেছে। যদি মধুমাচা নিষিদ্ধ হয় তাহলে সবাই কাগুর বাহনে করে বাজারে পণ্য আনা নেয়া করতে বাধ্য থাকবে। কাগুর একচেটিয়া কামাই অব্যাহত থাকবে। তাই সে তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে গোঁ ধরলো মধু-মাচা বন্ধ করবে না। কিন্তু গ্রামের মুরব্বী সমাজ কঠিন। তাকে এক ঘরে করে দেয়া হলো।

কুলিয়ে উঠতে না পেরে সে একরাতে গ্রাম ছেড়ে পালালো তার মধু-মাচা নিয়ে। পালিয়ে অনেক দুরের সমুদ্রতীরের ঠাডারা গ্রামে গিয়ে আস্তানা গাড়লো। ঠাডারা থেকে ভেলা নিয়ে ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌছালো মরুভুমির এক বিরান নগর মরুগঞ্জে। সেখানে মধুকে এবং মধু-মাচাকে সাদরে বরন করে নিল সবাই।

কয়েক বছরের মধ্যে মধু-মাচার ব্যাপক প্রসার ঘটলো সমগ্র মরু অঞ্চলে। ঘোড়ার সাথে বেধে মরুভুমিতেও ঘুরে আসা যায় আধুনিক এই বাহনে। ঘরে ঘরে মধু-মাচা আছে সেখানে। সবাই ব্যবসা করছে ধুমিয়ে। ফলে মরুগঞ্জের মানুষ স্বচ্ছল হয়ে উঠলো খুব তাড়াতাড়ি। শীঘ্রই মরুগঞ্জ হয়ে গেল আশেপাশের মধ্যে সবচেয়ে ধনী গ্রাম।

অন্যদিকে আন্ডামারার কি হলো? সেখানে এখনো ধীরগতির যদু-মাচায় করে পন্য আনা নেয়া করে মানুষ। বেশীরভাগ লোক হত দরিদ্র। রোগ শোক অভাব অনটনে দিন কাটে।

তবে সমগ্র গ্রামের মধ্যে প্রকট দারিদ্র্য ছড়িয়ে থাকলেও একজন মানুষ খুব স্বচ্ছলতা অর্জন করেছেন ক'বছরে। গ্রামে মাটির ঘর তুলেছেন, পুকুর কাটিয়েছেন, সিন্ধুক বানিয়েছেন। গোলা বানিয়েছেন, সোনাদানার স্তুপ গড়েছেন।

তিনি হলেন মোড়ল সমাজের বুদ্ধিপতি ‘যদু-কাগু’।


[পাদটীকাঃ এই গল্পের কোন হেতু নাই, কেবল কপিরাইট আছে]