Thursday, May 9, 2019

কাগজীয় সাহিত্যযুগ বনাম অনলাইন সাহিত্যচর্চা

১.
প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে অনলাইনে সাহিত্যচর্চার পরিমান বেড়ে গেছে তুমুলভাবে। অনলাইন পোর্টাল ছাড়াও সাহিত্য পত্রিকার সংখ্যাও অগণিত। দৈনিক, মাসিক, সাপ্তাহিক বাদেও ক্ষণে ক্ষণে গল্প কবিতা প্রকাশিত হয় তেমন পত্রিকাও কম নয়। ই-ম্যাগাজিন বা ওয়েবজিন বাদেও ফেসবুক সাহিত্য পত্রিকা নামের একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করলাম কিছুদিন আগে। ওখানেও হাজার সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে আবার প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হচ্ছে অগণিত। বাংলা সাহিত্যের বাইরে এমন চর্চা আর কোন ভাষায় হয় কিনা জানি না। কোন কোন সাহিত্যগ্রুপে এত বেশী লেখালেখি প্রকাশ হয় যে কেউ কারো লেখা পড়ে উঠতে পারে কিনা জানা নেই। কিন্তু এই বিপুল সৃষ্টিকর্মের সাহিত্যমান কেমন? এক সাহিত্যিক বন্ধুর মতামত নিতে গেলে সে বললো, ৯৯% নিতান্তই আবর্জনা। তবু ভাগ্য ভালো যে শতভাগ আবর্জনা নয়। ১% যদি ভালো হয় সেও কম কথা নয়। একটা স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনে ১০০ জনের লেখা ছাপা হলেও সেখান থেকে ভবিষ্যত সাহিত্যিক উঠে আসার সম্ভাবনা থাকে ১ জন বা ২ জন। সেই হিসেবে অংকটা খুব খারাপ বলা যাবে না।

সাহিত্য চর্চার এই ধুম অনেকে ভালো চোখে দেখেন না। বিরক্তি প্রকাশ করেন যেনতেনভাবে সাহিত্যের নামে এসব আবর্জনা সৃষ্টি। আমার মনে হয় এর একটা ভালো দিক আছে। যারা এমন ধরণের লেখালেখি চর্চা করেন, তাদের সবাই তরুণ প্রজন্মের। তরুন প্রজন্মের এই অবক্ষয়ের যুগে যে কয়জন নিজেদের রক্ষা করতে পারছে তাদেরকে কোন না কোন মননশীল সৃজনশীল কর্মে নিয়োজিত থাকতে হয়। ওটাই তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। সুতরাং তারা যত নিন্মমানের সাহিত্যই রচনা করুক না কেন, তারা অন্তত একটি সৃষ্টিশীল জগতে বাস করে। এই সৃষ্টিশীল সমাজ আমাদের খুব দরকার।

২.
কাগজের পত্রিকা এখনো আছে। কিন্তু সংখ্যার বিচারে অনলাইন পত্রিকার সংখ্যা শতগুন বেশী। অনলাইনে যেসব সাহিত্যচর্চা হচ্ছে, তা যেনতেন হলেও পরিবেশের কথা চিন্তা করলে কাগজের পত্রিকার চেয়ে অনলাইন পত্রিকাই উপকারী। কাগজের পত্রিকা প্রকাশ করতে গেলে পরিবেশের কোন না কোন ক্ষতি করেই করতে হয়। অনলাইন পত্রিকা সেই দায় থেকে মুক্ত। দৈনিক পত্রিকার অনলাইন পাঠকের সংখ্যা কাগজের চেয়ে কয়েকগুন বেশী। যদি সব পাঠককে কাগজের পত্রিকা পড়তে হতো, তাহলে কয়েকগুন বেশী পত্রিকা ছাপাতে হতো। একটি দৈনিকের এক লাখ সংখ্যা ছাপানোর জন্য যদি দশটি বৃক্ষকে প্রাণ দিতে হয়, পাঁচ লাখ হলে পঞ্চাশটি বৃক্ষের প্রাণ যেতো। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে ৪০টি বৃক্ষ বেঁচে যাচ্ছে একটি দৈনিক পত্রিকার হাত থেকে। সবগুলো অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা যদি কাগজে প্রকাশ হতো, তাহলে এতদিনে পৃথিবীতে একটি বৃক্ষও বেঁচে থাকতো না। তাই যেনতেন হলেও অনলাইনেই হোক সাহিত্যচর্চার হাতে খড়ি।

৩.
আমরা এই আসরের অনেকেই কম বেশী লেখালেখি করি। যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বলে দেখতে পাই। কিন্তু কিছু কী পড়ি? কে কী পড়ছি জানি না। এই পড়ার বিষয়টা কোথাও দেখি না। কারণ কী পড়ছি, কী ভাবছি এই বিষয়টা নিয়ে আমরা লিখতে আগ্রহ বোধ করি না। কেন করি না এটা একটা বিস্ময়। সৃষ্টিশীল মানুষদের এমন হবার কথা নয়। ব্যতিক্রম দুয়েকজন আছেন, তাদের সংখ্যা এত কম যে খুঁজে বের করা মুশকিল। কেউ কিছু পড়ছে জানলে অন্যরা তা পাঠে আগ্রহী হয়। চুপচাপ পড়ে গেলে কিছু বোঝার উপায় নেই। একটি ভাল গল্প উপন্যাস পড়লে, একটা ভালো সিনেমা দেখলে সেটা নিয়ে অবশ্যই দুয়েক কলম লেখার চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু আমিও লিখছি না, আপনিও লিখছেন না। আমরা সবাই চুপকথার ডালে বসে থাকি।

[বিস্তার সাহিত্য চক্রের জন্য লিখিত]

জাগো হুয়া সাবেরা অথবা পদ্মা নদীর মাঝি

প্রথম দৃশ্যে চোখের সামনে ভেসে উঠলো দিগন্ত ছোঁয়া বিশাল এক নদী। কূল নাই কিনার নাই যার। সেই নদীতে রাজহাঁসের মতো গ্রীবা উঁচিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা পাল তোলা অসংখ্য নৌকা। স্রোতে ভেসে বেড়াচ্ছে কচুরিপানার দল। দূর থেকে কোন মাঝির ভাটিয়ালী সঙ্গীত ভেসে আসে। নিস্তরঙ্গ প্রকৃতির বেলা ফুরিয়ে ঝুপ করে রাত নামলো। কোথাও কোন শব্দ নেই। জলের ছপছপ শব্দ ছাড়া বাকী পৃথিবী নীরব। গহীন অন্ধকারে দূরে দূরে ছড়ানো টিমটিমে হারিকেন জ্বলা কিছু জেলে নৌকা ভেসে আছে দূর দূরান্তে। বুড়ো মাঝি দাঁড় টানছে বসে। নৌকার ছই থেকে একটা হারিকেনের আলো আর আধাঁরির খেলা মাঝির চেহারার অভিব্যক্তিকে দিচ্ছে এক মোহনীয় রূপ। নৌকার দুই জেলে মাছ ধরা জালটাকে টানতে টানতে নৌকার কাছে নিয়ে এলো। জালে আটকানো বড় বড় জ্যান্ত মাছ লাফালাফি করছে। মাছগুলো নৌকার খোলে জমা হচ্ছে। সব মাছ তোলা হলে সামনে বসা দুই জেলে মাছগুলোর নড়াচড়া দেখছে অপার মুগ্ধতা নিয়ে।

অসাধারণ একটি দৃশ্যায়ন দিয়ে 'জাগো হুয়া সাভেরা'র পর্দা উন্মোচিত হয় দর্শকের সামনে। এ যেন ঠিক সিনেমা নয়। একটা প্রামান্যচিত্র। যেখানে পঞ্চাশ দশকের পূর্ববঙ্গকে তুলে আনা হয়েছে অতি চমৎকার দক্ষতায়। বাংলার নদী, বাংলার মানুষের জীবনযাত্রার এত ঘনিষ্ট এত স্বচ্ছ চেহারা আর কোন চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে বলে মনে হয় না। গ্রাম বাংলার দৃশ্য এত চমৎকার করে ধরা হয়েছে তেমন সিনেমা উপমহাদেশে বিরল।

জাগো হুয়া সাভেরা নির্মিত হয় ১৯৫৮ সালে। পথের পাঁচালীর বছর দুই পর। মুক্তি পাওয়ার পর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের প্রথম ধাক্কায় ছবিটার প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবির কাহিনীতে আপত্তি করার মতো কোন বিষয় না থাকলেও অদ্ভুত কোন কারণে ছবিটা নিষিদ্ধ করা হয়। ছবিতে ভারতীয় শিল্পীর অংশগ্রহনের অপরাধে কিংবা ছবির চিত্রনাট্যকার ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ বামপন্থী ছিলেন বলেও হতে পারে। এর কিছুদিন পর ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

১৯৫৮ সালের সিনেমায় চেনামুখ পাওয়া প্রায় অসম্ভব বলা যায়। আনিস নামের অভিনেতাটি খান আতা ছিলেন সেটা সিনেমা দেখেই বোঝা গেল। অন্যতম মূখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন খান আতা। ভারতীয় নাট্য অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র ছিলেন প্রধান নারী চরিত্রে।  জহির রায়হান ছিলেন এই সিনেমার সহকারী পরিচালক। জহির রায়হানের চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই সিনেমার মাধ্যমেই। ছবির সংগীত পরিচালনায় ভারতের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ তিমির বরণ। ক্যামেরায় ছিলেন অস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ চিত্রগ্রাহক ওয়াল্টার লাসালি।

ওয়াল্টার লাসালির ক্যামেরার কাজ এতই চমৎকার ছিল যে প্রায় প্রতিটি দৃশ্যই ক্লাসিক হবার যোগ্যতা রাখে। বাংলাদেশের মানুষ নদীর দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গেছে। কিন্তু এই ছবিতে আমাদের চেনা জানা সেই নদীর দৃশ্য এমন মধুর এক ব্যঞ্জনা তৈরী করে যা নিখাদ শিল্পী সত্তা ছাড়া কারো পক্ষে ধারণ করা সম্ভব নয়। ছবি দেখা শেষ হবার অনেক পরও চোখের সামনে ভাসতে থাকে এক ঝাঁক পাল তোলা নৌকার সেই দৃশ্যটা। পাল তোলা নৌকার সমাহার যে একটা নদীর রূপকে এমন মহিমান্বিত করতে পারে এই সিনেমা দেখার আগে টের পাইনি। শুধু নদীর দৃশ্য নয়, প্রতিটি গ্রামীন দৃশ্যকে এমন নিপুনভাবে ধারণ করা হয়েছে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল সিনেমা নয়, চোখের সামনেই ঘটতে দেখছি ব্যাপারগুলো।

ছবির আপাদমস্তক পূর্ববঙ্গের গ্রামীন চিত্র দিয়ে মোড়ানো। গ্রামের দৃশ্য আমরা আরো শত শত ছবিতে দেখেছি। কিন্তু এই ছবির দৃশ্যগুলো একেবারেই আলাদা। আর দশটা ছবিতে গ্রামীণ দৃশ্য বলতে যা দেখা যায় এই ছবি তেমন নয়। অধিকাংশ ছবিতেই গ্রাম জীবন, ঘরবাড়ি, পুকুর, নদীতীর, বাজার, যাই দেখানো হোক না কেন, কোন না কোনভাবে বোঝা যায় এগুলা সিনেমার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানে 'জাগো হুয়া সাভেরা' অন্য সব সিনেমা থেকে এগিয়ে। এই সিনেমার গ্রামীণ দৃশ্যের চিত্রায়ন ছিল অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয়। এখানে যে গ্রাম্য মেলাটি দেখা যায়, সেটি সত্যিকারে মেলা, এখানে যে বাজার দেখানো হয় সেটি সত্যি একটি বাজার। এই সিনেমায় সব স্বাভাবিক দৃশ্যের প্রদর্শনী। অধিকাংশ দৃশ্যকে সিনেমা মনে হয়নি। হাসমুরগী কুকুর বিড়াল জন্তু জানোয়ার সব কিছু প্রামান্য চিত্রের মতো দৃশ্যের পর দৃশ্যে হেঁটে গেছে।

এই সিনেমার অনেক কিছু ভালো লাগলেও দুটো সমস্যা চোখে পড়ার মতো। প্রথম সমস্যা হলো ভাষা। ছবির চিত্রায়ন করা হয়েছে ষাটনল নামের একটা গ্রামে। ফ্রেমের মধ্যে যারাই আছে সব যেন সেই ষাটনল গ্রামের অঙ্গীভূত বাসিন্দা। ষাটনল গ্রামের সুখ দুঃখ দেখতে দেখতে ছবি শেষ দৃশ্যে পৌঁছে যাবার পর শুধু একটি আক্ষেপ জাঁকিয়ে বসবে, কেন উর্দু ভাষায়  নির্মিত হলো সিনেমাটি। পরিচালক-প্রযোজক উর্দুভাষী বলেই? মাঝে মাঝে কিছু বিক্ষিপ্ত বাংলা সংলাপ ছিল, সেগুলো কেন বাংলায় করা গেলেও, বাকীগুলো কেন উর্দুতে করতে হলো, তার কোন জবাব পাওয়া যায় না। সত্যি বলতে কী বাংলার চিরচেনা দৃশ্যপটে অবাঙালী সংলাপগুলো ছিল সবচেয়ে দৃষ্টিকটু। ভাষার ব্যাপারটা ঠিক থাকলে সিনেমাটি বাংলাদেশের দর্শকের কাছে আরো বেশী সমাদৃত হতো।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো ছবিটার কাহিনী তৈরী হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে। কিন্তু ছবির টাইটেলে কোথাও তাঁর নাম নিশানা নেই। এই ব্যাপারটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। ভারতীয় শিল্পী বা কলাকুশলী সিনেমায় কাজ করতে পারলে ভারতীয় লেখকের নাম কেন থাকতে পারলো না।

ছবিটা পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হলেও ১৯৫৯ সালের মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে চুড়ান্ত পর্বে মনোনয়ন পেয়েছিল। একাডেমি এওয়ার্ডের আসরে সেরা  বিদেশী ছবির তালিকায় স্থান পেয়েছিল। কিন্তু আইয়ুব সরকারের হাতে নিষিদ্ধ হবার পর ছবিটার সকল কপি হারিয়ে যায় কিংবা নষ্ট করে ফেলা হয়। দীর্ঘকাল দর্শকের সুযোগ হয়নি ছবিটা দেখার। জানা গেছে,  প্রায় পঞ্চাশ বছর পর ফ্রান্সের এক চলচ্চিত্র উৎসবের আর্কাইভ থেকে এটি উদ্ধার করেন ছবির প্রযোজক নোমান তাসিরের ছেলে আনজুম তাসির। ২০১৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র পর্বে দেখানো হয় এ ছবি।

সবশেষে জাগো হুয়া সাভেরা সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যায়- এ হল সেই জাতের আরেকটি চলচ্চিত্র, যা দেখা মানে শুধু মাত্র একটি সিনেমা দেখা নয়, একটি অনন্য অভিজ্ঞতাময় সময়ে অবগাহন করে আসা। এই অভিজ্ঞতা বারবার নিতে ইচ্ছে করবে। বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্য সংস্কৃতি, গ্রামীণ পারিবারিক দৃশ্য, গ্রামীন সমাজের চিত্র নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে এই ছবি নিশ্চিতভাবে তাদেরকে নস্টালজিক করে দেবে। এমনকি পঞ্চাশ দশকের ঢাকা শহর দেখতে কেমন ছিল সেই বিরল অভিজ্ঞতাও এই সিনেমার সেলুলয়েড স্বচ্ছতায় পাওয়া যায়। এই সিনেমার চিত্রায়নের মাধ্যমে নদীমাতৃক বাংলাদেশের অতীত সৌন্দর্যের একটি অ্যালবাম সংগ্রাহকের সম্পদ হয়ে থাকবে।