Saturday, December 31, 2011

বছর শেষের কথকতা

আরেকটি বছর কি গেল আজ? ক্যালেন্ডারের হিসেবে তাই।

আমি আজ থেকে বছরের হিসেব বাদ দিয়ে দশকের খাতা উল্টালাম। আরো এক দশক কি গেল? নাকি দুই? আমি কি সময় খাতার দ্বিতীয় দশকে পৌঁছালাম? দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম আমার দশক কোনটি নয়। আমি তোমাকে কতোকাল ধরে চিনি? আমি সময় ক্যালেন্ডারে তোমাকে চিনি না। আমি তোমাকে চিনি হৃদয় ক্যালেন্ডারে।

আমি তোমাকে জনম জনম ধরে খুঁজে যাই এখানে ওখানে সবখানে। আমি তোমাকে খুঁজে পাই না যুক্তি দিয়ে খুঁজি বলে। হৃদয় দিয়ে খুঁজতে আমি ভুলে গেছি ওটা অকেজো হয়ে গেছে বলে।

আমি কি তোমাকে মুক্তি দিয়েছিলাম? না। তোমার মুক্তি হয়েছে আলোয় আলোয়। তোমার মুক্তি আলোর ভীড়ে হারাতে ভালোবাসে। আমার যুক্তি তখন মিলায় বাতাসে। মুক্তি নিয়ে কোথায় হারালে তুমি? অসীম আকাশে মুক্তির গান বাজে দেশ মানচিত্রের সীমানা ছাড়িয়ে।

আমার কাছে তো দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। তবু আমি তোমাকেই ভালোবাসি - আমার দুঃখিনী বাংলাদেশ।

Wednesday, December 28, 2011

বনলতার অসুখ

স্বার্থপরতার অলিগলি পেরিয়ে শীত কুয়াশার বেড়াজাল এড়িয়ে শেষরাতের স্বপ্নে ভেসে এলো- কাঁপানো জ্বর নিয়ে এলোচুলে বিছানায় শুয়ে বনলতার শরীর।

এত ছোট্ট স্বপ্ন আমি আর কখনোই দেখিনি।

Monday, December 26, 2011

ফেরার

বললো না, থেকে যাও।
যাবার ইচ্ছে না থাকলেও চলে যেতে হলো।

বললো না, ফিরে এসো
ফেরার ইচ্ছে থাকলেও ফেরা হবেনা হয়তো।

বললো না, জেগে থেকো
ঘুমোনোর সময় না হলেও ঘুমিয়ে পড়তে হলো তাই।

আকাশ নেমে গেল ঢেউ ভাঙা নিঃসঙ্গ সৈকতে।
বলো, এখন তো দিন শেষ, তুমি ফেরার হও।

Monday, December 19, 2011

!!!!!

অচিন দেশ ডাকছে।

যেতে হবেই

যাবার আগে বলে যাবার নিয়ম?

 

নাহ!

 

বলে কয়ে যাওয়া বিব্রতকর

অপ্রস্তুত চলে যাওয়াই ঢের ভালো।

 

প্রস্তুত থেকো

মাঝপথে নেমে যেতে হবে ট্রেন থেকে।

Thursday, December 15, 2011

[ব] ন কবিতা

যখন কিছু লিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু মাথার ভেতরে কোন বাক্য কাজ করে না সেরকম দুঃসময়ে যেসব এলোমেলো বাক্য পয়দা হয় তাকে কোবতে বলে ভুল হতে পারে। যেমন-

বেহিসেবি কথা বলার একজন বন্ধু দরকার
বেয়াড়া সময় কাটানোর একটা জীবন
বেসামাল হারিয়ে যাবার একটা অরণ্য আর
বেহুদা লেখালেখি করার একটা খাতা
পাইনি পাইনি করে সব পাওয়া হয়ে গেলে

একদিন- বন্ধু এসে জানালো
এইসব পাগলামিতে কোন প্রেম নেই,
এর সবকিছুই অসুস্থতার লক্ষণ!

তারপর থেকে আমি হাসপাতালে বন্দী,
আর তুমি মুক্ত বিহঙ্গ।

http://www.amrabondhu.com/neer/2518

[ব] ওপেনসোর্স ভালোবাসা

পাসওয়ার্ড ছাড়াই অবাক লগ ইন করলাম তোমার জীবনে-
ঠিক করে বলোতো,
এই উন্মুক্ত দ্বার কি কেবল আমারই জন্য?
নাকি সকল হ্যাকার পুরুষের জন্য!

ভেবেছি তুমি এক ওপেন সোর্স ভালোবাসা-
তাই ডিজিটালি আমি কেবল তোমাকেই চেয়েছি

...............................................................

এরর মেসেজ....ওরা বলছে ৫০ শব্দের কমে কোন অনুভুতি প্রকাশ নিষিদ্ধ।
...............................................................

তবে দীর্ঘসময় লগ ইন করেও তোমার মনের ভেতরে কোন ডাটা খুঁজে পাচ্ছি না।
জানি না কোথায় লুকিয়ে রেখেছো তোমার সোর্স কোড।

জানো কি তুমি, সোর্স কোড ছাড়া কতোকাল আমি তোমার প্রেমে এরকম মুগ্ধ থাকবো

http://www.amrabondhu.com/neer/1485

[০০০০০০]............উড়ো হাওয়া

.........................
................
...........................
....................!!!!

[ব] ন কবিতা

১.
তোমাকে দেখি আর নিজেকে দারুন উচ্ছৃংখল লাগে
তোমাকে দেখি আর নিজেকে বড় অপাংক্তেয় লাগে

আমাকে উচ্ছৃংখল রেখে তুমি
দু'পায়ে আলতা মেখে হাঁটছো ওই সংসারে

ভরাডুবি চাঁদটাকে আজ বিষ জ্যোৎস্নায় চুবিয়ে
খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে
http://www.amrabondhu.com/neer/1043


২.
সেই যে তুমি
মাঝে মাঝেই দেখা পাই তোমার
যতক্ষণ থাকো সমস্ত জুড়েই থাকো
মগজের আনাচে কানাচে তখন কেবলই তোমার অস্তিত্ব
যখনই আসো
আমাকে আষ্ট্রেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখো দিনরাত
কতোরাত নির্ঘুম কেটেছে তোমাকে পেয়ে
কত ভোর হয়েছে দুপুর........

একবার এলেই,
সহজে যেতে চাওনা তুমি আমাকে ছেড়ে

বলতো তুমি কে
তুমি কি সেই স্মৃতিময় ... ... ... ন?

http://www.amrabondhu.com/neer/1796

[ব] ন কবিতা

১.
বন্ধু তুমি কথা দাও
আমাকে আর কখনো খুঁজবে না।

বন্ধু তুমি জানবে না-
এবার যেখানে যাবো
সেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না।

http://www.amrabondhu.com/neer/1083

[ব] সুরঞ্জনা

সুরঞ্জনা,
তোমাকে কখনো বলিনি ওই যুবকের পানে যেও না।
তাই বলে চলে যাবে যার সাথে নেই কোন জানা শোনা?

সুরঞ্জনা,
তোমাকে আজকাল নিয়মিত দেখছি না।
আছি আমি ঘরে-বাইরে রাস্তায় হাটে মাঠে ঘাটে
তোমাকে খুঁজছি সবখানে- কোথাও পাচ্ছি না।

সুরঞ্জনা,
তোমাকে কতবার বলেছি আমাকে ছেড়ে দুরে যেও না।
তবু তুমি দুরে যাও- দুর থেকে দুরে চলে যাও
আবার ফিরবে কিনা সে ভাবনায় রাত্রে আমার ঘুম আসে না।

সুরঞ্জনা,
হঠাৎ করে অচেনা কোন যুবকের হাত ধরো না।
সব পারলেও এটা কখনো সহ্য করতে পারবো না।

সুরঞ্জনা,
যেখানে আমি থাকি না সেখানে আর কখনো যেও না
কোন একদিন হয়তো ফিরতি ট্রেনের টিকেট পাবে না।

(এটা কিন্তু কোন কবিতা না, তবু কি পাইরেসির দোষে শাস্তি হবে জেল অথবা জরিমানা)
http://www.amrabondhu.com/neer/1134

[ব] ন কবিতা

১.
তোমার সকল উপেক্ষা
যেন আমারেই লক্ষ্য করে।

ঠিক যেমন তোমার প্রতীক্ষা
আমাকে লক্ষ্য করে না।
http://www.amrabondhu.com/neer/656

২.
হে অচেনা, আমি তোমাকে একটুও মিস করি না।
তবু অচেনা কোন নম্বর থেকে মিস কল এলে
ব্যাকুল হয়ে দেখি এটা সেই অজানা নাম্বার কিনা।
নেটের কসম আমি তোমাকে কখনোই মিস করি না।
http://www.amrabondhu.com/neer/309

[ব] অতঃপর একদিন

তুমি নির্জন ছিলে না, আবার জনারণ্যেও ছিলে না। চুপকথার এক বিষন্ন নগরীতে ছিল বসবাস। আমি গলি পথে সেই নগরীতে হাঁটতে গিয়ে মুখোমুখি হই তোমার। বিষন্ন নগরীতে বসবাস করলেও আমি কোন বিষন্নতা দেখিনি তোমার চোখে মুখে। তুমি ছিলে উচ্ছল ফুলেল তারুণ্যে ভরপুর অপূর্ব এক সত্তা।

তোমার সংস্পর্শে আমি পবিত্র হলাম, আমি আকাশে চোখ মেললাম, মেঘেদের আনাগোনা দেখলাম, আর ভেসে গেলাম অবাক আনন্দে। আমি ভাসলাম, বাসলাম এবং তোমাকেও ভাসালাম। আমাদের আনন্দমেলায় কোন ছেদ ছিল না।

রাত্রির আকাশ যখন অজস্র নক্ষত্র মাথায় নিয়ে পুব থেকে পশ্চিম ছুটে যায়, আমি সেই আঁধারে মিশে যাই। যখন রাতের শেষ তারাটা নিভে ভোরের আভা ফুটে ওঠে, আমি নতুন দিনের আশ্বাস পাই। তবু সেই বিমুগ্ধ ভোরে বসেও আমি রাতের নক্ষত্রদের কথা ভুলি না। তাই আমার সকল অপ্রকাশিত আনন্দ বেদনার গল্পগুলো স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে চলে যায় তোমার কাছে। তুমি তাদের আগলে রাখো পরম মমতায়।

একদিন আমি তোমার মমতার মধ্যে প্রেমের সন্ধান পাই এবং অবধারিতভাবে সিক্ত হই অনুপম এক ভালোবাসায়।

অতঃপর .....অতঃপর....... একদিন সবকিছুই স্মৃতির অস্পষ্টতায় তলিয়ে যায়।

http://www.amrabondhu.com/neer/166

Wednesday, December 14, 2011

মৃত পদাবলী

১.
মৃত সমাধির উপর দাঁড়িয়ে
মদির কামনায় জেগেছে এক প্রাচীন শরীর
ক্ষয়ে যাওয়া অস্ফূট শব্দাবলী পাখনা মেলেছে দূর দিগন্তের মোহে।

২.
কোন কোন প্রেম শরীরবিহীন,
কোন কোন প্রেম শরীর সর্বস্ব
আবার কোন কোন শরীর প্রগাঢ় প্রেমহীন
প্রেমময় শরীরের চেয়ে সৌকর্যময় বস্তু জগতে আছে কি?

৩.
অবশেষে জানি
দেহ নয়, প্রেম নয়, মোহ নয়
অনাদি কালের এক বিস্ময়কর অনুভুতি কোথাও জেগে রয়
স্মৃতিভস্মের আড়ালে।

Saturday, December 10, 2011

বিমূঢ়

উপস্থিতির বিড়ম্বনা এড়াতে তুমি অনিশ্চিত দূরত্বে। সেই দুরতিক্রম্য দুরত্ব বালির ভেতরে লুকোনো নোনাজলের অগাধ খনি লুকিয়ে রেখে অকারণ উল্লাসে তাতিয়ে তোলো।
গলে যায় বরফ, গলেনা বহুকাল আগে জ্বালানো শিয়রের মোমদানি। বস্তুকান্ড বোতলভুতের আছর হয়ে মিলিয়ে যায় পৃথিবীর তিন ভাগ জলে। তীরে দাঁড়ানো আমি আছড়ানো ঢেউয়ের ভাষা বুঝতে না পেরে মূঢ় হয়ে থাকি।

[০০০০০] অসমাপ্ত.........

অকিঞ্চিত

Tuesday, December 6, 2011

আলোর ছোঁয়া

আলো ছুঁয়ে ফিরে আসো তুমি, আলো দাও দুচোখের পাতায়।

তোমার ছোট্ট প্রাণ, করে আনচান, এই মাটি ছুঁয়ে নাও তুমি পৃথিবীর ঘ্রান।

তোমার চোখে সমুদ্র, আমার পৃথিবী ভাসায়, দিন শেষে ঘরে ফিরে, তোমাকেই খুঁজে পাই।

সুখের মতো ব্যাথা যখন বুকের ভেতর বাজে, আমি জেনে যাই, আছো তুমি আমার সকল অস্তিত্বে।

তুমিই প্রথমা, তুমিই অন্ধকার সরালে।

Thursday, December 1, 2011

চট্টগ্রাম: অতীতস্য অতীত

আমি এখন ঠিক যেখানে বসে কীবোর্ডে আঙুল চালাচ্ছি সেই জায়গাটা ১০০ বছর আগে কেমন ছিল? এই জায়গাটা তখন সমুদ্রের তীরভাগ। বঙ্গোপসাগরের ঢেউ এখানে এসে ভেঙ্গে পড়তো। ভাটার সময় হাঁটুপানি, জোয়ারে জলোচ্ছ্বাস প্রায়। এখান থেকে সোজা পূর্বদিকে তাকালে সবুজের পর সবুজ পেরিয়ে দিগন্তে দৃষ্টিটা যেখানে থেমে যাবে সেখানে পাহাড়ের আভাস। সেই পাহাড়ে শ্বেতাঙ্গ মানুষের বসতি আছে লাল ইটের দালানে। পাহাড়ের পাদদেশে যে সবুজ জঙ্গল দেখা যাচ্ছে তা কোন আদিম জঙ্গল নয়, মানুষের ঘরবসতির ফলমুলের গাছ বন। চট্টগ্রাম তখনো অবিভক্ত ভারতের একটা শহর। সূর্যসেনরা তখনো বালক। বৃটিশদের শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে যাচ্ছে ভারতবাসী। ১০০ বছর আগের চট্টগ্রাম উপনিবেশ ছাড়া আর কিছু নয়।

কিন্তু ১০০০ বছর আগে এই জায়গায় কি ছিল? সেই ইতিহাস কোথাও লিখে যায়নি কেউ। এই জায়গার নাম তখনো চট্টগ্রাম হয়নি। এমনকি সাদকাওয়ানও না। চিৎউতগং তো আরো কয়েকশো বছর পরের ঘটনা। এই জায়গাটা তখন সমুদ্রের অংশ। দেশটা বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়নি তখনো। লক্ষণ সেনের প্রপিতামহের জন্মও হয়নি বঙ্গদেশে। অসভ্য জংলীদের বসবাস ছিল তাও বলা যায় না। চাকমা মার্মা কিংবা অন্য কোন আদিবাসী পার্বত্য অঞ্চলে বসতি গাড়েনি তখনো। কিন্তু আরব বণিকেরা এই দিকে চলে এসেছিল নতুন সম্ভাবনার সন্ধানে। কিছু বণিক সবুজ প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে বসতি গড়ে তুলেছিল স্থায়ীভাবেই। উষর মরুর উত্তাপ থেকে সবুজের স্নিগ্ধতা দান করে গেল তার উত্তরপুরুষকে। বখতিয়ার খিলজি এদেশে আসবে আরো দুশো বছর পরে। এবার প্রকৃতিটা কল্পনা করা যাক। পতেঙ্গা থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত সমতল এলাকা ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ন। নৌকা থেকে কেউ কর্নফুলী তীরে নামলে তাকে জঙ্গল কেটে এগোতে হবে পূর্ব দিকে। ঘটনাক্রমে পতেঙ্গা থেকে ভাটিয়ারী বেল্ট নিয়ে ভেতরের অংশটা আজ শহরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই যে প্রথম নেমেছিল সে এই এলাকাকে বেছে নিয়েছিল। কারণ এখান থেকে সমুদ্র আর নদী দুটোই কাছাকাছি। যদি এখানে বসতি না করে কর্নফুলীর অন্য পাড়ে বসতি করা হতো, তাহলে আজকের সভ্য শহরের সুত্রপাত হতো আনোয়ারা পটিয়ায়। পতেঙ্গা হালিশহর পাচলাইশ নাসিরাবাদ একেকটা গ্রামের নাম হতো। ভুগোল পাল্টাতে হলে ইতিহাস পাল্টাতে হবে। ইতিহাসই ভুগোলের গতিপথ নির্ধারণ করে।

এবার কি ১০০০০ বছর আগের কথা ভেবে দেখা যায়? মানব সভ্যতা তখনো গুটিগুটি পায়ে মধ্য এশিয়ায় হামাগুড়ি দিচ্ছে। সমগ্র দক্ষিন এশিয়া খাঁ খাঁ সবুজের নির্জনতায় ডুবে আছে। আর কিছু কল্পনা করা যায়? কল্পনা থেমে যায়।

Monday, November 28, 2011

অসার কথা

-রাজনীতি নিয়ে কিছু লেখালেখি আবারো শুরু করার ইচ্ছে জাগছে। কিন্তু সময় আর মুডের মধ্যে ঐক্যমত হচ্ছে না।

-উপেক্ষা প্রতিরক্ষার অন্যতম উপায়। রাজনীতিকে উপেক্ষা করে নিজেকে রক্ষা করছি মানসিক চাপ থেকে। কিন্তু পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে কতোদিন টিকে থাকা যায়? নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও অক্ষত থাকে না। ইতিমধ্যে মাসের বাজার খরচে টান পড়তে শুরু করেছে ঠিকই। দ্রব্যমূল্য রাজনীতি টেনে আনে।

-দেশের রাজনীতি অসুস্থ বহুবছর ধরে। সুস্থতার একটু লক্ষণ দেখা দেয় যখন রাজনীতিবিদদের উপর আজাব নেমে আসে কিছুকালের জন্য। ২০০৭ এ একবার সেরকম আজাব এসেছিল। মাঝে মাঝে সেরকম আজাবের দরকার রাজনীতিকে সুস্থ রাখার জন্য।

-শেষবার নির্বাচনে ভোট দেই ১৯৯৬ সালে। তারপর বুঝে গিয়েছি দেশের উন্নতিতে ভোটের কোন ভূমিকা নেই। আর কখনো ভোটকেন্দ্রে যাইনি। আয়ুষ্কালের মধ্যে যদি কখনো সুস্থতা ফিরে আসে, তবে আবারো যাবো ভোট দিতে।

-আমার পরিচিত একজন সরকারী দলের এমপি হয়েছেন কয়েক কোটি টাকা খরচ করে। তিনি এমপি হবার আগে থেকেই শতকোটি টাকার মালিক। আমি খুশী হয়েছিলাম এই ভেবে যে লোকটা খাটি দেশ সেবা করার জন্যই রাজনীতিতে নেমেছে। এতটাকা যার তাঁর দুর্নীতি করা লাগে না। কিছুদিন আগে শুনলাম তিনি দুর্নীতিতে নেই, কিন্তু সরকারী সুবিধা বাগিয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

-যুদ্ধাপরাধীদের জন্য কঠোর অমানবিক শাস্তি কামনা করি। কিন্তু তাদের জন্য মানবিক বিচার প্রক্রিয়া দেখে হতাশ।

-নগরে রেষ্টুরেন্টের চেয়েও ডায়গনষ্টিক সেন্টারের সংখ্যা বেশী। তবু প্রতি সন্ধ্যায় তিল ধারনের জায়গা থাকে না সেখানে। দেশে এত অসুস্থ মানুষ কেন?

-যিনি যত স্বচ্ছল, তাঁর অসুস্থতাও তত জটিল। আয়ের সাথে চিকিৎসা ব্যয়ের কি একটা অনুকুল সম্পর্ক রয়েছে?

-গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় বাইরের খাওয়া পরিহার করুন - ডাক্তারের প্রচলিত পরামর্শ। পুরুষটা বাইরে খেয়েও সুস্থ আর অন্তঃপুরের বাসিন্দারা ঘরের খেয়েও গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত। সমস্যাটা কোথায়?

-স্বচ্ছল আর অস্বচ্ছলের মধ্যে ব্যবধানের আপেক্ষিক গুরুত্বের উপর দেশে অপরাধের সংখ্যা ওঠানামা করে।

-বাংলাদেশে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অসংখ্য। কিন্তু একই সাথে কিছু লোক দৃষ্টিকটু মাত্রায় ধনবান। রাস্তায় নতুন গাড়ির চাকচিক্যে মাঝে মাঝে লজ্জা হয়।

-মানুষ মুখোশধারী প্রাণী। সময়ের সাথে সাথে মানুষের মুখোশ বদলাতে থাকে।

-একটা দেশ যদি একটা রাস্তা হয়, সেই রাস্তার দৈর্ঘ্য যদি ১০০০ মিটার হয়, আর তার প্রতি দশ মিটারে কমপক্ষে একটা করে অনিয়ম পাওয়া যায়, সেই বিশৃংখল ধুলো ধোঁয়া ময়লা আবর্জনাময় পথকে সহ্য করে নেয়ার নামই দেশপ্রেম? বলতে হবে, এমন পথ কি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি?

-জীবনের বিরাট একটা অংশ অজান্তেই আমরা দুমুখো সাপদের সাথে লেনদেন করে কাটাই।

-অধিকাংশ রাজনীতিবিদ কি মানসিক প্রতিবন্ধী? নাকি বাথরুমে বসে একা একা হাসে নিজের অভিনয় পারদর্শীতা নিয়ে।

-স্ববিরোধীতা অন্যতম মানবধর্ম

Saturday, November 26, 2011

কালো সংলাপ

ঝাঁ করে অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশ। চেনা লোডশেডিং। দুটি কন্ঠ জেগে উঠলো সেই অন্ধকারে।

-একদিন আপন শক্তিতে জ্বলে উঠেছিল সত্য।
-সত্য কি?
-যা কিছু মিথ্যার বিপরীত।
-মিথ্যা কি?
-অন্ধকার।
-অন্ধকার কি?
-যখন আলো থাকে না তখন অন্ধকার।
-কখন আলো থাকে না?
-যখন লোড শেডিং হয়।
-কখন লোড শেডিং হয়।
-যখন মিথ্যারা রাজত্ব করে।
-কখন মিথ্যারা রাজত্ব করে?
-যখন অন্ধকার থাকে।
-কখন অন্ধকার থাকে?
-যখন আলো না থাকে।
-কখন আলো থাকে না?
-এক প্রশ্ন বারবার শুনতে ভাল্লাগে না!
-তাহলে এই অন্ধকার ফিরিয়ে নাও না!!

Wednesday, November 23, 2011

তুমি কান্নার রঙ, তুমি জোছনার ছায়া।

আমি তোমাকেই বলে দেব
কী যে একা দীর্ঘ রাত
আমি হেটে গেছি বিরান পথে
আমি তোমাকেই বলে দেব
সেই ভুলে ভরা গল্প
কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায়-
ছুয়ে কান্নার রঙ
ছুয়ে জোছনার ছায়া

আমি কাউকে বলিনি সে নাম
কেউ জানেনা, না জানে আড়াল
জানে কান্নার রঙ
জানে জোছনার ছায়া

তবে এই হোক, তীরে জাগুক প্লাবন
দিন হোক লাবন্য, হ্রদয়ে শ্রাবন
তুমি কান্নার রঙ
তুমি জোছনার ছায়া।

ব্যান্ডসঙ্গীতে এই গানটার মতো চমৎকার লিরিকস আর একটাও না। সঞ্জীব চৌধুরীর নাম আসলেই এই গানটা চলে আসে।
এই গানটা বোধহয় প্রত্যেক মানুষের কোথাও না কোথাও ছুঁয়ে গেছে। কারণ প্রত্যেকের জীবনেই ভুলে ভরা গল্প আছে। না হওয়া গল্প আছে। অসমাপ্ত উপন্যাস আছে। এই গানটা যেদিন প্রথম শুনেছিলাম, সেদিন ভুলে ভরা গল্পের জন্য যে আক্ষেপটা ছিল, সেটি বেমালুম উবে গেছে। ভুলে ভরা গল্পটিও পরিপূর্ণতা পেল।

সময় আর দুঃসময়

সময়কে নিয়ে আমাদের বিশাল বিভ্রান্তি। আমরা সময়কে বুঝি না। দুঃসময়ে প্রায়ই ভাবি সময় আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে, বঞ্চিত করেছে। কিন্তু সময় তো নদীর মতো। উথালপাথাল ঢেউয়ের দোলায় অস্থির করেও নানান আঁক বাঁক পেরিয়ে যখন আমাদের সামনে সেই সবুজ শ্যামল প্রান্তরে হাজির করে, তখন আমাদের সকল উদ্বেগ হারিয়ে যায়। সময়কে ক্ষমা করে দেই অক্লেশে। আমরা তখন বুঝি পাগলা ঢেউ পার হতে গিয়ে যে নদীর চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছি সেটা কতো ভুল। নদী আমাদের সঠিক গন্তব্যেই নিয়ে এসেছে। সময়কে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে দুঃসময়কেও দেই। কারণ দুঃসময় না থাকলে তো সুসময়ের মর্যাদা বোঝা যায় না। আপেক্ষিকতাই জীবনের অন্যতম সত্য।

Thursday, November 17, 2011

এক সন্ধ্যায় মঙ্গল ও পৃথিবী

সন্ধ্যার মুখে মুখে পৃথিবী যখন ঘুমানোর আয়োজন করছিল তখন দূর থেকে হন হন করে বুড়া মঙ্গল মিয়াকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মঙ্গলকে দেখে পৃথিবীর মনে অমঙ্গল আশংকা দানা বেঁধে উঠলো। এরকম বিনা নোটিশে কখনো আসে না সে। লালমুখোকে তার খুব হিংসা। ঝুট ঝামেলা থেকে বহুদূরে ব্যাটা কোটি কোটি বছর ধরে নাকে কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে আয়েশ করে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। যখন ইচ্ছে ঘুমোয়, যখন ইচ্ছে জাগে। বিরক্ত করার কেউ নেই। দুটো বেঢপ চাঁদ আছে, তাদের মুখেও কোন রা নেই। পৃথিবীর বুকেই যত যন্ত্রনা হাউকাউ চিৎকার চেঁচামেচি। যুদ্ধ বোমা সন্ত্রাস অনাহার মহামারী সব এখানেই। ফি বছর একটা না একটা লেগেই আছে। একটা থামালে আরো দশটা লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় জাতিসংঘরে জুতানো দরকার।

পৃথিবীর বুকে এই সব অনাচারের জন্য দায়ী মাত্র একটা প্রাণী। তার পেটে বুকে জীবিত লক্ষ কোটি প্রাণীর মধ্যে মানুষ জাতের একটা মাত্র প্রাণী গোটা দুনিয়ার সব অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অকৃতজ্ঞ এই জাতির অভিযোগ অনুযোগ প্রার্থনা শুনতে শুনতে পৃথিবীর কান ঝালাপালা। এত জ্বালা তোদের তবু লোকসংখ্যা কমাস না। জন্ম নিয়ন্ত্রনের টাল বাহানা করে করেও ৭০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছিস সংখ্যায়। অসম্ভব বিরক্ত লাগে তার। চাইলে সে নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে পুরো মানবজাতিকে। কিন্তু তাতে বাকী প্রাণীকূলেরও ধ্বংস হয়ে যাবার আশংকা আছে বলে সে অক্ষম রাগে কখনো ফোঁস ফোঁস করে, কখনো ঝাঁকুনি দেয়, কাঁপুনি দেয়, যাতে ভয় পায় মানুষের জাত। কিন্তু সব সাময়িক। পরিস্থিতি শান্ত হলে সাংবাদিক ডেকে লেকচার দিয়ে জানাবে এসব হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিজ্ঞান এসব নিয়ন্ত্রন করে ফেলবে। বায়ু নিয়ন্ত্রন করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

গাধার গাধা মানুষের বাচ্চা। মনে মনে গালি দেয় পৃথিবী।

মানুষকে সহজে কাবু করতে না পেরে কিছুদিন যাবত একটা বিকল্প প্ল্যান মাথায় ঘুরছিল তার। মঙ্গল মিয়াকে নিয়েই। মানুষের কানে ফুসকানি দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে তামাশা দেখছে বসে বসে। পুরো প্ল্যানে মঙ্গলের অমঙ্গল লুকিয়ে থাকলেও কাউকে সেটা বলেনি সে। কিন্তু কেউ কি বেফাঁস মুখে মঙ্গলের কানে তুলে দিয়েছে কথাটা ? সেই কারণেই কি মঙ্গল মিয়া এই অসময়ে আসছে? কে ফাঁস করলো? নাহ সে বুধ কিংবা শুক্র কাউকেই বলেনি। শনির সাথে তো তার দেখাই হয় না। আর বৃহস্পতির কাছে যাবার সাহসই নেই তার।

আর ভাবতে পারলো না। বায়ুমন্ডলের দোরে এসে কড়া নাড়তে শুরু করলো মঙ্গল।

-কি হে জেগে আছো না ঘুমিয়ে গেছো (গলায় মধু ঢেলে জিজ্ঞেস করলো মঙ্গল)

-এই তো চোখটা লেগে আসছিল প্রায়। তা এই অসময়ে কি মনে করে, নাকি শুক্রের বাড়ি যাচ্ছিলি টাংকি মারতে? (গলায় ব্যাপক ক্লান্তির ছাপ আনতে চেষ্টা করলো পৃথিবী)

-আরে না, তুমি কি সব বলো না, শুক্রের যে তেজ বাড়ছে আজকাল, কাছে যাওয়াই মুশকিল। সেদিন হুমকি দিয়ে বলেছে আর এক পাও এগোলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে।

-তাইলে এদিকে কিসের মতলবে, আমার কিন্তু সকাল সকাল উঠতে হবে ম্যালা কাজ পড়ে আছে......

-তা জানি। তোমার শরীরটা কেমন যাচ্ছে? খুব খাটাখাটনি হচ্ছে বুঝি আজকাল (দরদ উথলে উঠতে দেখে পৃথিবী আরো সন্দেহপ্রবন)

-হ রে ভাই, শরীর স্বাস্থ্য তেমন ভালো যাচ্ছে না আজকাল। বয়স তো কম হলো না। সাড়ে চারশো কোটি বছর বয়সের মধ্যে শেষ এক কোটি বছর মোটামুটি শান্তিতে কাটিয়েছিলাম। বুকে পেটে গ্যাস্ট্রিকের যন্ত্রনা কমে এসেছিল। নিয়মিত ঘুম হচ্ছিল। গত বিশ হাজার বছর তো একদম নিরুপদ্রপ ঘুমানো গেছে। কিন্তু তাবত প্রাণীকুলের শীর্ষ নিমকহারাম মানবজাতি গত একশো বছর ধরে আমার পেটের মধ্যে এমন গুঁতোগুতি শুরু করেছে আর নাকের উপর দুর্গন্ধ বায়ু ছাড়তে শুরু করেছে যে তাতে হাঁচি কাশি জ্বর পেট ব্যাথা, ডায়রিয়া বমি আবার শুরু হলো বলে। হারামীর বাচ্চারা নিজেদের কুকাজগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘাড়ে চাপিয়ে দায়িত্ব এড়াতে চাইছে। যন্ত্রনায় বাঁচতে ইচ্ছে করছে না আর। আমার কথা বাদ দে, তুই কেমন আছিস বল? তুই তো তো শান্তিতে ঘুমাচ্ছিস বহুকাল। তোকে দেখলেও হিংসা হয়। আহা তোর বয়সে আমারও কতো সুখ গেছে.........।

-আরে না, যার যন্ত্রনা সেই জানে। আমি এই খাঁ খাঁ শীতল মরুভূমি নিয়ে কোটি কোটি বছর কাটিয়ে দিচ্ছি। এতকাল তোমার দিকে তাকিয়ে হা হুতাশ করতাম, বিধাতা আমার বুকে কেন একটা সন্তান দিল না। একটা ফুলের বীজ, একটা পাখির ছানা, কিছু একটা তো দিতে পারতো। আমার কোটি বছরের আক্ষেপে বিধাতার মনে দয়া হলো বুঝি একদিন। সেদিন তোমার বুক থেকে একটা ফড়িং এসে আমার বুকে বসলো, চড়ে বেড়ালো, আমার সেদিন ঈদের আনন্দ। যাক এতদিনে আমার একাকীত্ব বুঝি কাটলো। কিন্তু কিছুদিন পর আরেকটা ফড়িং এসে নামলো, এটা আগের চেয়েও সুন্দর। কিন্তু এই ফড়িংটা বদ কিসিমের। আমার চামড়ায় কেবল খোঁচাখুচি খামচাখামচি করে দিনরাত। আমার এখনো তেমন ব্যাথা লাগছে না, কিন্তু কেমন যেন চুলকানির মতো লাগে। ফোসকা পড়ে যাবে এরকম চলতে থাকলে। অসহ্য হয়ে উঠছে দিনকে দিন। বুঝলাম না আমার গায়ের উপরে এত লক্ষ বর্গমাইলের ধূ ধূ খালি জায়গা পড়ে থাকতে পেটের ভেতর কেন গুঁতোগুঁতি করা শুরু করছে? তাই ভাবলাম তোমারে একবার জিজ্ঞেস করি।

-ভাইরে, আর কইস না। এই হারামীরা আমার পেট ফানাফানা করে সব লুটেপুটে নিছে। এখন তোর দিকে নজর পড়ছে, তোর কাছ থেকে যা পাওয়া যায় তাও লুটে নিবে। কোন কুক্ষণে যে এদেরকে বাঁদর থেকে মানুষ হতে দিলাম, সেই থেকে আমার চোখে ঘুম হারাম হয়ে গেছে।

-এটা কিরকম দুঃসংবাদ দিলা। আমি আমার ঠান্ডা পেট নিয়ে এতদিন গর্ব করতাম। গ্যাস্ট্রিক ডায়রিয়া কিছুই নাই। আগুন পানি কিচ্ছু লাগে না, সব হজম করে শান্তিতে ঘুমাচ্ছি। কেবল কথা বলার জন্য মাঝে মাঝে আনচান করে, একটু সবুজের জন্য, একটা পাখির গানের জন্য একটু হা হুতাশ লাগে। তোমার বুকে এত পাখি এত বন পাহাড়, এত গান দেখে শুনে চোখ জুড়িয়ে যায়। দুয়েকটা পাহাড় জঙ্গল আর পাখপাখালি যদি উড়ে এসে বসতো আমার বুকে। তা না, আসলো তোমার নেমক হারাম মানুষ। ওরা কি চায় আমার কাছে?

-ওরা জানতে চায় তোর বুকে পানি আছে কিনা।

-কেন তোমার বুকে পানির অভাব? চারভাগের তিনভাগ পানি আছে কইলা না সেদিন?

-আরে পানি তো আমার ম্যালাই আছে। কিন্তু তোর পানির ব্যাপার অন্য......

-কি ব্যাপার সেটা?

-তোর বুকে পানি থাকা মানে তোর বুকে অক্সিজেন আছে, অক্সিজেন থাকা মানে প্রাণের সম্ভাবনা, তার মানে তোর বুকটা বাসযোগ্য জায়গা, আর বাসযোগ্য জায়গা পেলেই আদম ব্যবসা....সাথে রিয়েল এস্টেট...বিশাল অট্টালিকা শত শত বুরুজ-আল-মঙ্গল খাড়া করবে তোর বুকে।

-অ্যাঁ??? এই সর্বনেশে বুদ্ধি কে দিল তাদের?

-হে হে, আবার জিগায়। তোর ভালোর জন্যই করলাম। ভাবলাম ছোটভাই অনেক বছর ঠান্ডার মধ্যে একা একা দিন কাটাইতেছে, এইবার একটু ঘর সংসারের স্বাদ নিক, আর আমিও একটু ভারমুক্ত হই। এত মানুষ হজম করা কঠিন হয়ে গেছে আমার। এই মাসে ৭০০ কোটি পার হয়ে গেছে মানুষের বাচ্চা। ১০০০ কোটি হলে তো আমার জান শেষ। তার আগেই.......

-ওরে হারামীর বাচ্চা হারামী, গোলামের বাচ্চা গোলাম...... তাইলে তোর কুবুদ্ধিতেই আজকে আমার সর্বনাশ হতে যাচ্ছে!!!! আমি যদি আর একটারেও আমার পেটের উপর বসতে দেই, উল্কা মেরে তাড়াবো সব....তোর উপর ধুমকেতুর লানত নাজিল হোক...তোর চাঁদ সুরুজ নিপাত যাক!!!!

-আরে অমন চেতে উঠলি কেন? এই ভর সন্ধ্যেবেলা মুখ খারাপ করতে আছে? আমি বুদ্ধি না দিলেও ওরা তোর দিকে যেতোই। এক আম্রিকান হারামী দীর্ঘদিন ধরে তোর দিকে তাকিয়ে ছিল জুল জুল করে। সে আরো বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে মঙ্গল সমাজ গঠন করেছে। তোর বুকে কিভাবে লোকজন নামাবে তার পরিকল্পনা করেছে। মনে হচ্ছে তারা শুধু বসবেই না লেপ্টে গড়িয়ে শুয়ে থাকবে। তয় লোক কিন্তু খারাপ না একেবারে। সবগুলো সভ্য দেশের মানুষ। এইখানে দেখ তোর মেহমানদের সম্ভাব্য তালিকা
http://en.wikipedia.org/wiki/Manned_mission_to_Mars

http://en.wikipedia.org/wiki/Mars_Direct
http://en.wikipedia.org/wiki/Robert_Zubrin
http://en.wikipedia.org/wiki/Mars_Society

তালিকা দেখে মঙ্গল মিয়া মুর্ছা গেল।

[ছবি: উইকিপিডিয়া]

Monday, November 14, 2011

নীল পাহাড়ের চেনা গল্প

১.
সাপটা ছোবল দিতে আধসেকেন্ড দেরী করাতেই সাবুর ভোজালির কোপে মরলো। সবুজ লতা সাপটা ঝুলে ছিল ঝাকড়া শ্যাওড়া গাছ থেকে। ঝুলন্ত অবস্থাতেই ছোবল তুলেছিল। ভয়ংকর বিষধর এই সাপ।

সাবুর মেজাজটা তিনদিন থেকে চোতরা পাতার মতো চুলবুল করছে। তিন বাটি নাপ্পি খেয়েও ভুলতে পারছে না নীলা ম্রুর সেই রুদ্রমূর্তি।

নীলা অমন করতে পারে সে কখনো ভাবেনি। নীলাও হয়তো ভাবেনি সাবু অমন কিছু করবে। পুরুষ মানুষকে চেনা দায় বলে ঘেন্না করছে তাকে নিশ্চয়ই। ভেবে সেও নিজেকে ঘেন্না করতে শুরু করে। নীলার সাথে তার রহস্যময় সম্পর্কটিকে সে নিজের করে নিয়েছিল। ওই পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় যখন উঁচু জামগাছটার দিকে চোখ পড়তো তখন সাবু কল্পনায় নীলাকে দেখতে পেত ওই জামগাছটার মধ্যে। গাছটা নীলাদের উঠোনে দাড়িয়ে। যে উঠোনটা নীলা সকাল বিকেল ঝাট দিয়ে তকতকে রাখে। আর মাঝে মাঝে গাছের নীচে দাড়িয়ে নীলা গুনগুন করে উদাসী গান গায়। একদিন শুনে ফেলেছিল সাবু। দৌড়ে পালিয়েছিল নীলা। নীলাকে সেই প্রথম দৌড়াতে দেখে মনে হয়েছিল সে যেন মেঘলা চুলের এক নিটোল কিশোরী। তার তরুনী শরীর ঢাকা পড়ে যায় কিশোরী অবয়বের পেছনে।

নীলারা যে পাহাড়ে থাকে, তার দুটো পাহাড় পরেই সাবুদের পাড়া। সেই পাড়ার নীচটা ঢালু হতে হতে নেমে গেছে নদীর ধারে। নদীটা পেরিয়ে ওপারে জনমানবহীন পাহাড় জঙ্গল শুরু। দৃষ্টি আরো ছড়িয়ে দিলে দূরে দেখা যাবে আকাশের সাথে মিশে গেছে একটা বিশাল নীলচে পাহাড়। ওটাকে সবাই নীল পাহাড় নামেই ডাকে। কেউ কেউ বলছে ওই পাহাড়টা বাংলাদেশের ওই পাড়ে বার্মার সীমানায়। সাবু ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখছে ওই পাহাড়ে যাবার। কিন্তু ওই পাহাড়ে যাওয়াটা অশুভ, ওখানে গেলে কেউ ফেরে না আর - এরকম গুজবের কারণে কেউ ওদিকে যাবার সাহস পায় না। কেবল সাবু একাই সেই পাহাড়ের স্বপ্নে বাস করতো।

২.
বেশ কয়েকমাস আগের কথা।

পাহাড়ে নীচের বাজারে একটা উৎসব হচ্ছিল। সেই উৎসবে আরো শত শত তরুণীর মধ্যে একটা মেয়ের দিকে নজর গেল সাবুর। মেয়েটা ছিল সবার চেয়ে আলাদা। ওর মুখের আদলে কিশোরীর নিষ্পাপতা। দুধে আলতা মেশানো শুভ্র মসৃন ত্বক। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ছোট করে ছাটা। চোখের মধ্যে কি যেন একটা আছে। ওর চোখ, নাকি চুল, নাকি হাসি, কোনটা বেশী সুন্দর ভাবতে গিয়ে একটু বেশী সময়ই বোধহয় তাকিয়ে ছিল সাবু এবং মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ফেললো তাকে। দেখলো এবং চোখ ফেরালো না। কেমন একটা নেশা জাগানিয়া চাউনি ছিল মেয়েটার চোখে। সলজ্জ মুগ্ধতাও।

সাবু একটু থতমত খেল মেয়েটার চাহনীতে। চুরি করে যেন ধরা পড়েছে সেরকম সংকোচে আস্তে সরে পড়লো ওখান থেকে। কিন্তু চেহারাটা ভুলতে পারছে না। মেলার কিছুতেই মন বসে না আর। ফেরার পথেও ভাবছিল মেয়েটার কথা। কে ওই মেয়ে? কোন পাড়া থেকে এসেছে? দলবল ছেড়ে আলাদা হয়ে হাঁটছিল সাবু। তাকে যেতে হবে হেডম্যানের বাড়ি। ডেকেছে বুড়ো কি একটা কাজে। কিছুদূর এগিয়ে দেখলো সেই মেয়েটি খানিকটা সামনে হেঁটে যাচ্ছে। একা। দ্রুত পা চালালো সে, মেয়েটার কাছে পৌঁছাতে হবে। পাশাপাশি যেতেই পায়ের শব্দে ফিরে তাকালো মেয়েটা। সেই ছেলেটা তার পিছু নিয়েছে? এত বড় সাহস! একদম কাছে চলে এসেছে।

-কি নাম তোর?
-নীলা
-বাড়ি কই।
-ওই খানে
-ওটা তো হেডম্যানের বাড়ি
-ওটাই তো আমার ঘর। তুই কে রে?
-আমি সাবু
-কী চাস?
-তোকে চাই
-মাথা ঠিক আছে তোর? আমি কে জানিস?
-জানি, তুই চাঁদের পরী হলেও আমি তোকে চাই
-মর তুই
-মরতে হলেও আমি তোকে চাই
-আমার কাছে দা আছে, এক কোপে কল্লা ফেলে দিব
-ফেলে দে, তবু আমি তোকে চাই
-যা ভাগ। লোকে দেখবে, নিন্দে হবে, ফিরে যা
-না ভাগবো না, হেডম্যানের কাছে কাজ আছে আমার।

জেদী মুখে বললো সাবু। জেদী হলেও বেশ রসিকও। এই মেয়েটি হেডম্যানের মেয়ে বুঝতে পেরেই সরাসরি বলতে পেরেছে এই কথা। আর কারো সাহস হবে না। বুড়ো তাকে খুব পছন্দ করে। বউ মরেছে তার কবছর আগে। শুনেছে কয়েকটা অবিবাহিতা মেয়ে আছে তার। এই মেয়েকে চাইলে না করবে না বুড়ো।

কিন্তু মেয়েটা কেমন তেজের সাথে বললো আবার।

-হেডের কাছে কাজ থাকলে ওখানে যা, কিন্তু আমার পিছু আসবি না খবরদার!
-যাচ্ছি। কিন্তু তোর বাপের কাছে গিয়েও বলবো আমি তোকে চাই
-সে আমার বাপ না!!
-বাপ না?
-না!!
-তবে সে তোর কে??
-আমার স্বামী!!

অকল্পনীয় একটা ধাক্কা খায় সাবু। তার হাত পিছলে কি যেন পড়ে গেল নীচে। ছেলে বেলায় বড়শি বিহীন খেলো ছিপ দিয়ে একটা বিশাল শোলমাছ ধরে ফেলেছিল। ভুলে কিংবা খিদেয় মাছটা ছিপের আগায় লাগানো সুতোর আঠায় কামড়ে ধরেছিল আর একটা হেচকা টান দিয়ে সাবু দেখে একটা আস্ত শোলমাছ ঝুলছে সুতোর মধ্যে। কিন্তু সেই অবাক হয়ে থাকার মুহুর্তটিতেই মাছটা সচেতন হয়ে গেল। সুতো থেকে কামড় ছেড়ে দিতেই আবার পানিতে ঝপাস। প্রায় হাতের মুঠোয় পেয়েও মাছটা হারিয়ে ফেলেছিল সাবু, অনেকদিন পুড়িয়েছে তাকে এটা। কেউ বিশ্বাস করেনি, এত বাচ্চা একটা ছেলের খেলনা ছিপে অতবড় মাছ ধরতে পারে।

আজকেও ঠিক সেই অনুভুতি হলো তার। সাবু জানতো না ষাট বছর বয়সের হেডম্যান আগের বউ মরার পর আরেকটা তরুণীকে বিয়ে করে ঘরে এনেছে। সাবু কিছুদিন দূরের বান্দরবান শহরে কাজ করতে গিয়েছিল। তখনি এসব ঘটেছে।

সাবুকে নির্বাক দেখে খিলখিল করে হাসতে হাসতে নীলা বলে-
- কি রে কথা নাই এখন?
-না রে......মেলা থেকে কিছু কিনলি?
-মরণ, এখন বলে মেলার কথা
-আর কি বলবো
-একটু আগে যা বলতেছিলি
-ভালো লাগছে তোর?
-হুঁ
-আমার সাথে যাবি?
-কোথায়?
-ওই নীল পাহাড়ে
-ওখানে গেলে কেউ ফেরে না
-আমরাও ফিরবো না
-পালাবি?
-পালাবো
-আমাকে নিয়ে?
-তোকে নিয়ে
-আমাকে রাখবি তুই?
-রাখবো
-সারাজীবন?
-সারাজীবন।

৩.
সেই শুরু সাবুর সাথে নীলার রহস্যময় বন্ধুতা। সাবু হেডম্যানের সাহায্যকারী হিসেবে অনেক কাজ করে। আজকাল একটু বেশীই সাহায্য করছে কাজে কর্মে। সময়ে অসময়ে তার বাড়িতে যাতায়াত। নীলা কিন্তু কখনো সামনে আসে না। সাবুর ফেরার সময় হলে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করে। ঝোপের আড়ালে বসে দুজনে কিছু সময় কাটায়। মাঝে মাঝে নদীর কাছেও চলে যায়। সাবুর নিজের একটা ছোট্ট নৌকা আছে। সেটায় গিয়ে বসে। তেমন কিছু না, কেবল হাবিজাবি গল্প আর উড়ে যাবার স্বপ্ন নিয়ে কিছুটা একলা সময়।

সেদিন উড়ে যাবার স্বপ্নের গল্প বলতে বলতে আবিষ্ট হয়ে হঠাৎ সাবু প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ফেলে নীলাকে।

সেটাই সর্বনাশ ডেকে আনে। নীলা ওকে মুখ দিয়ে প্রায় জুতিয়ে দেয় আর কি। পারলে তখুনি হেডম্যানকে ডেকে এনে ছাতু করে দেয় পিটিয়ে। সাবুর ইচ্ছে করছিল মরে যেতে। নীলা ওকে এত ভালোবাসে, তবু এই সামান্য একটা চুমু ওকে এতটা হিংস্র করে তুলবে কখনোই ভাবেনি সে। এরকম সম্পর্কগুলোর সাথে কতো সহজেই শরীর জড়িয়ে যায় আরো গভীরে, সে তো ওইদিকে যায়নি। সামান্য একটা চুমু, তাতেই এত ভয়ংকর? তাহলে কি নীল পাহাড়ের ওই স্বপ্ন গুলো নেহাতই ছেলে ভুলানো খেলা?

ভীষণ রকম অসহায় বোধ করে সাবু। আগামী পূর্নিমার পরদিন সে নীল পাহাড়ে যাবার জন্য নৌকা ঠিক করে রেখেছিল। নীলাও সানন্দে সম্মতি দিয়েছিল। আর কখনো ফিরবে না ওরা। সেই নৌকায় নদীর উজানে গিয়ে অনেক হাঁটাপথ। তারপর নীল পাহাড়। নতুন জায়গায় বসতি। এখন তো সব ভেস্তে গেল! নীলা তার সাথে যাবে না নিশ্চিত। নীল পাহাড়ের স্বপ্ন এরকম মার খাবে কখনো ভাবেনি!

৪.
সবুজ সাপের মাথাটা তখনো নড়ছে। সে লাথি দিয়ে সাপটাকে ফেলে দিল অনেক নীচে। নাহ্ একটা মেয়ের জন্য তার যাত্রা বাতিল করার কোন মানে হয় না। আজকে পূর্নিমা। কালকেই রওনা দিতেই হবে। নীলাকে ভুলতে হলেও পালানো চাই এই জনপদ থেকে।

তার নৌকাটায় রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে। মাঝে মাঝে নদীতে রাত কাটায় সাবু। নৌকাটা একটা নির্জন জায়গায় বাধা থাকে। কেউ আসে না এই দিকটাতে। পরদিন খুব ভোরে দরকারী জিনিসপত্র বেঁধে নিয়ে সাবু বেরিয়ে পড়ে। চারদিকে তখনো কুয়াশা। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ পাহাড়জুড়ে। শীত লাগছে। কান মাথা মুড়ে হাঁটা শুরু করলো সে। দূরে নীলাদের পাহাড়ের একাংশ ঝাপসা মতন দেখা যায়। জামগাছটা বোঝা যায় না এত দূর থেকে। বুকের ভেতর কেমন একটা অচিন ব্যাথা। নীলা তাকে খাদক ভেবেছে। ভুল ধারণাটা ভাঙ্গার কোন সুযোগই পেল না।

কিন্তু নদীর তীরে গিয়ে আরেকটা ধাক্কা। নৌকাটা যেখানে ছিল ওখানে নেই। যে গাছের সাথে বাধা ছিল, সেখানে শুধু দড়িটা ঝুলছে। কেউ নৌকাটা দড়ি কেটে নিয়ে গেছে। পাহাড়ে কখনো চুরি ডাকাতি ছিল না। কিন্তু শান্তি চুক্তির পর থেকে চোর ডাকাতের সংখ্যা বেড়ে গেছে পাহাড়ে। শান্তিবাহিনী ফেরত ছোকরাগুলো ডাকাতি রাহাজানি করে বেড়ায়। সাবু ভেঙ্গে পড়লো প্রায়। তার এত শখের নৌকা কে চুরি করলো? পাহাড়ি না বাঙালী? এদিকে তো বাঙালীরা আসে না।

নদীতে একটা ছলছল শব্দ হচ্ছে কোথাও। কান খাড়া করলো সাবু। দাড় বাইছে কেউ সতর্কভাবে। চোর নিশ্চয়ই পালাতে পারেনি এখনো। ঠিকই। ওই তো দেখা যাচ্ছে নৌকাটা চলে যাচ্ছে। সে ছুটতে শুরু করে তীর ধরে। চীৎকার করে কটু গালি দিল সে নৌকার উদ্দেশ্যে। চীৎকারটা পাহাড়ে কয়েক ধাক্কা খেয়ে নৌকার কাছে পৌছালো। নৌকাটা থামলো। ঘুরছে। আশ্চর্য হলো সাবু। সাহস আছে চোরের। সে কোমর থেকে ভোজালিটা বের করলো। কুয়াশার মধ্যে বোঝা যাচ্ছে না ভেতরে কজন আছে। একাধিক চোর থাকলে ডাকাতে পরিণত হয় তারা।

সাবধানে ভোজালিটা ধরলো সে। নৌকাটা আস্তে করে এসে তীরে ঠেকলো। বৈঠা রেখে উঠে দাড়ালো চোর। সঙ্গীসাথী কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চাদরে মোড়ানো তার আপাদমস্তক।

চোরটা লাফ দিয়ে তীরে নামতেই দেখা গেল, চাদরের আড়ালে নীল পাহাড়ের স্বপ্ন নিয়ে হাসছে নীলা।

কাছে এসে সাবুর হাত ধরে প্রায় ফিসফিস করে বললো, আমাকে ছাড়া নীল পাহাড়ে কিভাবে আবাদ করবি রে পাগল?

পুরোনো ঠিকানায়.........




ওরা তখন গন্তব্য থেকে অনেকটা দূরে। দুজনের দুটো রাস্তা আলাদা হয়ে গিয়েছিল আরো একযুগ আগে। ওরা বরাবরই কাছের মানুষ ছিল। কেউ জানতো না একটা অদৃশ্য বন্ধন আছে তাদের মধ্যে। দুজনেই চেপে রাখা মানুষ। ছেলেটিও মেয়েটিও। ছেলেটি প্রথম যৌবনে একদিন মুগ্ধতা আবিষ্কার করে বালিকার চোখে। ভীত বালিকাও জানে বালকের মুগ্ধতার কথা। বালকের একটা চিরকুট হস্তগত হলে কেঁপে ওঠে বালিকা। এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তার। সে যা জানে তা কাউকে বলা যায় না। ভীষণ লজ্জার কথা। ধরা পড়তে চায় না বালিকা। প্রশ্ন এড়িয়ে উত্তর যায় বালকের কাছে। অভিমানে বালক ফুঁসে ওঠে নীরবে। বালিকা তা জানে না। তবু বন্ধুতা বহাল থাকে। একদিন সেই বন্ধুতার উপর আঘাত হানে ভিন্ন একটা ঝড়। দুজনের পথ সেদিন থেকে আলাদা। উদাসীন বালক আর খোঁজ নেয় না বালিকার মনের। বালিকাও ভুলে থাকে বালকের গোপন মুগ্ধতা। নতুন জীবনে জড়ায় বালিকা। খবর পেয়েও বালকের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। বালিকা তার নিজের পথ বেছে নিয়েছে মঙ্গলের জন্য। বালকও তার নিজের পথ বেছে নেয়। স্মৃতিময় খচখচানি ছাড়া সবকিছু একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়।

তারপর........তারপর কেটে গেছে অনেক বছর।

বহু ঘুরপথ পেরিয়ে একদিন ওদের দেখা হয়ে গেলো ভিন্ন পথের এক তেমাথায়.......তারপর....জেগে উঠলো স্মৃতির খচখচ। কতো কথা জমে আছে এক যুগের। এত বয়সে এসেও কিছু স্মৃতি যেন এইমাত্র দেখা দৃ্শ্য হয়ে ধরা পড়ে। ওরা স্মৃতির অতলে ডুব দেয় প্রতিদিন, তুলে আনে মনি মুক্তো হীরে জহরত......আর বিপুল বিপুল বেদনার ইতিহাস....

এবং সুখ বা দুঃখের পাঁচালী*

স্মৃতির ঘোলাজলে তোমার ছায়া পড়ে,
হৃদয় উতরোল জলের রলরোলে!
আমি কি সুখ খুঁজি - সুখের রাজধানী
কোথায় কোনখানে সে কথা আমি জানি?

সুখ তো প্রজাপতি: অধীর ঘোরে-ফেরে-
স্থিরতা নেই তার, অযথা ঘোরাঘুরি
আমাকে যেতে হবে (তোমাকে হয়তো বা)
দুঃখ নামের নদী সাঁতরে ওই পারে-
তীক্ষ্ণ কাঁটাবন দু'পায়ে হেঁটে হেঁটে।

দুঃখ এই বুকে বেঁধেছে বাসা তার,
জীবন কেটে যাবে দুঃখ বুকে পুষে-
সুখের দাসদাসী এ যুগে অগণন,
সুখের কৃপা পেয়ে তুমিও থাকো সুখে
তোমার সুখটুকু আঁচলে বেঁধে রাখো।

দিবস-রাত ভ'রে সুখের আশ্রয়ে
দীর্ঘজীবি হও। - দুঃখ এই বুকে
কায়েমী হয়ে থাক! - দুঃখ এই বুকে
কায়েমী হয়ে থাক - আমার দুঃখটি;
পাথর দুর্বহ- একাকী বয়ে যাই!

কিশোরকালে তুমি স্বপ্ন দেখেছিলে
যেমন যুবরাজ এবং গুণীজন
তেমন পেয়েছো তো? - এবার হও সুখী।
দুঃখে যাক চ'লে আমার দিন রাত-
আমার ভালোবাসা আমারি বুকে থাক।



*রফিক আজাদ

হালাল হজ্জ

হালাল টাকা দিয়ে হজ্জে যাবার জন্য জব্বার আলী তালুকদার তার বেতনের পুরোটাই জমাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। কর্পোরেশনের জুনিয়র কেরানী হলেও ঢাকা শহরে তার দুটো বাড়ি আর তিনটা ট্রাক আছে। সংসার চালাতে বেতনের টাকায় হাত না দিলেও চলে। চারজনের পরিবার নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল তার। জীবনের শেষ বেলায় পুণ্যতীর্থ মক্কা নগরীতে গিয়ে হজ্জ করে আসার চিন্তাটা দীর্ঘকাল মগজে স্টোর করা ছিল। টাকা পয়সারও কোন অভাব নাই। কেবল সময়ের অভাব তার। কিন্তু বছর দেড়েক আগে মসজিদের ইমাম সাহেব খোৎবার সময় কঠিন হুংকার দিয়ে জানান দিয়েছিল,"বয়সকালে হজ্জ করতে হবে এবং হজ্জ করতে ১০০% হালাল টাকা লাগবে, নইলে হজ্জ করেও দোজখের দাউ দাউ আগুনে কাবাব হতে হবে"।

কিন্তু তার বাড়ি ট্রাক সব হারাম কিংবা জনগণের টাকা দিয়ে তৈরী। একমাত্র হালাল উপার্জন চাকরীর বেতন। সেই বেতনের টাকাই জমাতে শুরু করেছিলো সে। কিন্তু হজ্জে যাবার পুরো টাকা হাতে আসার আগে তার চাকরীর মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল বলে চিন্তিত জব্বার আলী কোন একটা হালাল উপায়ের জন্য মাওলার কাছে পাঁচবেলা হাত জোর করে কান্নাকাটি করতে থাকে। অবশেষে একদিন মাওলার দিলে রহম হলো।

সৌদি প্রবাসী এক মামাতো শ্যালক তার দেশ-স্থিত পরিবারকে হজ্জে নিয়ে যেতে চায়। জব্বার আলীর কাছে খবর পাঠালো যদি সে শ্যালকের পরিবারের সফরসঙ্গী হয় তাহলে তার সকল খরচ শ্যালকই বহন করবে। শ্যালকের পরিবারে হজ্জযাত্রী তিনজনই মহিলা, এক মামী, দুটো বাচ্চাসমেত মামাতো শ্যালিকা, একটা পুচকা বাচ্চাসমেত শ্যালকের বউ। এতজনের ঝামেলা বহন করার জন্য তাদের সাথে একজন পুরুষ যাওয়া দরকার। জব্বর আলী শরিয়তমতে ঠিক যোগ্য না হলেও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সফরসঙ্গী বিবেচিত হলো বয়স্ক বলে। আনন্দে তাতা-থৈথৈ করে উঠলো জব্বর আলীর উৎকণ্ঠিত হৃদয়। উপরঅলার কাছে তার প্রার্থনা বৃথা যায়নি।

বৃথা না যাওয়ারই কথা! সে তো কোনদিন কারো ক্ষতি করেনি, অন্যের জমি দখল করেনি, গ্রামে গেলে হাত খুলে দান করেছে, গরীব দুঃখীকে সবসময় সুনজরে দেখেছে। জীবনে কারো একটা টাকা মেরে খেয়েছে বলতে পারবে না। সামান্য কিছু যা খেয়েছে তা সরকারের টাকা। সেটা খাবার অধিকার তার আছে। কারণ সরকারের মালিক জনগণ। আর সে তো জনগণেরই একজন। নিজের টাকা নিজের পকেটে বন্দী করেছে। অন্যায় কি করেছে। সেই টাকায় দুটো
বাড়ি তুলেছে, তিনটা ট্রাক কিনেছে, সেই বাড়ির কর পরিশোধ করে সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নে অংশ নিয়েছে। মাওলা তাঁর দিকে তো রহম দেবেই।

যথাসময়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে নির্ধারিত তারিখে এয়ারপোর্ট রওনা দেবার সময় শ্যালকের বউ নায়লা ফোন করলো। দুলাভাই, এয়ারপোর্ট যাবার সময় আমাদের বাসা হয়ে যাবেন, একসাথে যাওয়া যাবে।

গাড়ি ভাড়ার টাকাও বেঁচে যাবে বলে কঞ্জুস জব্বার আলী বিমলানন্দ অনুভব করলো। শ্যালকের মাইক্রোবাস আছে একটা। আরামে যাওয়া যাবে তাতে। একটা সিএনজি ডেকে শ্যালকের বাসায় চলে এলো।

কিন্তু শ্যালকের বাসায় এসেই আক্কেল গুড়ুম। শুনলো ওদের গাড়িটা নষ্ট। গ্যারেজে পড়ে আছে কদিন। জব্বার আলীর সাথে এয়ারপোর্টে যাবার জন্য ৯টা বিরাট ব্যাগ নিয়ে তৈরী ওরা। জব্বার আলীর নিজের তিনটা লাগেজ। মোট বারোটা লাগেজ নিয়ে সিএনজি করে এয়ারপোর্ট যাওয়া অসম্ভব। বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন। ওরা উপদেশ দিল একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে নিতে। জব্বার আলী নিজে কোনদিন এসব গাড়ি ভাড়া করেনি, সে জানেও না কিভাবে করতে হয়। চিরকাল অন্যের উপর নির্ভর করে চলেছে এসব ব্যাপারে। নিজের খরচে চড়েনি কখনো। মাত্র চারঘন্টা হাতে আছে। রাস্তার জ্যাম পার হতে দুই ঘন্টা যাবে। এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে বলেছে ৩ ঘন্টা আগে। মাথায় হিজিবিজি লেগে গেল তার। মেয়েমানুষের বুদ্ধি! আগে বলবি না তোদের গাড়ি গ্যারেজে, জব্বার আলীর কাঁধে চড়ে তোদের এয়ারপোর্টে যেতে হবে। তোদের বাপের টাকা দিয়ে এখন গাড়ি ভাড়া করবো? মনে মনে প্রচন্ড বিরক্তি
সহকারে গজগজ করতে থাকে জব্বার আলী। কিন্তু চেহারায় হাসিটা ঝুলিয়ে রাখতেই হলো, কারণ জব্বার আলীর হজ্জ করার পুরো টাকাটাই তো বেঁচে গেছে।

টাকায় বাঘের দুধও মেলে। কলিজায় আঘাত নিয়েও ৩০০০ টাকায় একটা মাইক্রোবাস ঠিক করে ফেললো।

সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর জব্বার আলীর নতুন যন্ত্রণা শুরু হলো।

শ্যালক মতিয়ার মহাধূর্ত লোক। এই হারামজাদা দেশে থাকতে ছিল লুচ্চা। জব্বার আলী ভেবেছিল এত বছর এই পবিত্র নগরীতে বসবাস করেছে তার উপর মাওলার রহম পড়েছে নিশ্চয়ই। সে নাকি খোদ কাবা শরীফের সবচেয়ে সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল একবার। এত ভাগ্যবান। ওখানে ঢুকার সৌভাগ্য হয় সৌদি রাজপরিবারের সদস্য আর উচ্চপদস্থ কর্তাদেরই। কিন্তু মাওলার খাস কামরা ঘুরে এসেও শয়তান তাকে ছাড়েনি। সৌদি আরবে পৌঁছানোর পরপর টের পেল মতিয়ারের সাথে শয়তানের দোস্তিটা আমরণ। রোজ হাশরে তার কি দশা হবে ভেবে জব্বারালীর একটু সান্ত্বনা হলো।

হজ্জের সময় প্রায় এক সপ্তাহ মতিয়ার তাকে বাধ্য করেছে ওই তিন মহিলার মোট বইতে। জীবনে যে কাজটা সে দেশে করেনি, এই হজ্জে এসে সেই কাজটাই বিরসমুখে করে গেল। ঘামতে ঘামতে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় সে ছুটে বেরিয়েছে মহিলাদের পেছনে পেছনে। বিচ্ছু বাচ্চাগুলোকে সামলাতে হয়েছে তাকেই। মতিয়ার তাকে এনেছে এই তিনজনের ফাইফরমাশ খাটতে। সবকিছু সহ্য করে গেছে দুই লাখ টাকা বেঁচেছে বলে।

হজ্জ শেষে জব্বার আলী দিন গুনছে কবে দেশে ফিরে যাবে। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। যাবার আগে একবার সোনার মার্কেট ঘুরে যেতে হবে। মতিয়ার বলেছে সস্তায় সোনার বিস্কুট কিনে দেবে। সে নিজেও মহিলাদের গলায় কেজি খানেক স্বর্ণ ঝুলিয়ে দেশে ফেরত পাঠাবে। জব্বার আলী সাথে করে ৫০০০ ডলার নিয়ে এসেছিল লুকিয়ে। স্বর্ণ কেনার জন্য মতিয়ারের হাতে সবটুকু তুলে দিল। এই টাকায় তিনটা আস্ত বিস্কুট পাওয়া যাবে।

দেশে ফিরে যাবার দিন বিকেলবেলা। সবকিছু গোছগাছ করে এয়ারপোর্ট রওনা দেবার আগে মতিয়ার যার যার গলার স্বর্ণ বুঝিয়ে দিয়ে মতিয়ারের দিকেও একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল। সোনার বিস্কুটটা জব্বার আলী ব্যাগের ভিতর চালান করে দেবার আগে একটু দ্বিধা করলো। এত হালকা লাগে কেন? প্যাকেট খুলে দেখে একটা মাত্র বিস্কুট।

মতিয়ারের দিকে প্রশ্নবোধক চাউনি দিতেই মতিয়ার জবাব দিল, 'দুলাভাই আপনার টাকায় তিনটা বিস্কুটই কেনা হইছিল। কিন্তু নায়লা জানিয়েছে আপনি নাকি হালাল হারাম বিষয়ে খুব সচেতন। আমার টাকার অনেকটা তো হারাম, তা দিয়ে আপনার হজ্জের পবিত্রতা আর সওয়াব নষ্ট করতে চাই না। তাই আপনাকে একটা বিস্কুট দিয়ে বাকী দুই বিস্কুট আপনার হজ্জের খরচ বাবদ কেটে রাখা হলো। আপনার হালাল টাকায়ই হজ্জটা হয়ে যাক। কি বলেন?'

মতিয়ারের কথা শুনে জব্বার আলীর হাত থেকে একমাত্র বিস্কুটটাও খসে পড়লো।

উষ্ট্র কোরবানি

কোরবানির গরু নিয়ে দবির ছবিরের প্রতিযোগিতা আজকে নতুন কিছু না। আপনারা গত বছর, তার আগের বছর, কিংবা তার আগের যুগেও দেখেছেন। এটাও সেই পুরোনো ঘটনার নতুন চর্বন। এই ঘটনার দুজনও আমার ব্যক্তিগত পরিচিত।

দবির সাহেব পুলিশ কর্মকর্তা, ছবির সাহেব কাস্টমস কর্তা। দুই জনের আলীশান বাড়ি পাশাপাশি। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে দুই বাড়ির মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় কে কত বড় গরু কিনবে। উৎসাহটা দারোয়ানের মধ্যেই বেশী। কোরবানির সময় বাদে দুই বাড়ির দুই দারোয়ানের অম্লমধুর দোস্তালি। কিন্তু কোরবানির সময় হলেই দুজন দুজনকে ঠারে ঠারে চায়।

পুলিশ বাড়ির দারোয়ান রমজান, কাস্টম বাড়ির দারোয়ান জলিলের চেয়ে এক কাঠি সরেস থাকে। কারণ পুলিশ বাড়ি সবসময় বড় গরু কিনে। বড় গরু কেনার গোপন রহস্য হলো শেষ মুহূর্তে গরু কেনা। ধরা যাক ছবির সাহেব দুইদিন আগে ৫০ হাজার টাকার একটা বলদ কিনে গর্বিত, কিন্তু দবির সাহেব ঈদের আগের রাতে গিয়ে ৭০ হাজার দিয়ে ইয়া বড় একটা ষাঁড় কিনে আনলো। ছবির সাহেবের দীর্ঘদেহী বলদটা দেখতে হাড় জিরজিরে মনে হয়।

গত বছর ছবির সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন এবার দবির সাহেবকে জিততে দেবে না। তিনি বিশেষ লোক দিয়ে বাজার থেকে ইয়া বড় একটা উট কিনে আনালেন কোরবানির তিনদিন আগে। উটের দেখাশোনা করার জন্য আলাদা লোকও আনলেন। লোকজন ভিড় করে উট দেখতে থাকে প্রতিদিন। জলিল গম্ভীর মুখে সবাইকে বলে বেড়ায়, 'আরব দেশের উট'।

রমজান এটা দেখে হিংসায় পুড়ে যায়। এত করে দবির সাহেবকে বললো এবার একটা উট কিনতে, কিন্তু তিনি কিনে আনলেন ১ লাখ টাকার একটা ষাঁড়। কিন্তু যত বড়ই হোক ষাঁড় ষাঁড়ই, উট উটই।

দবির সাহেব বললেন, আসলে ছবির সাহেবের জানোয়ারটা রাজস্থানের মালবাহী উট।

মুখ কালো করে ষাঁড়টাকে দানাপানি খাওয়ায় রমজান। গেট থেকে পারতপক্ষে বের করে রোড শো করে না অন্যন্য বারের মতো। একদিনই কেবল বের করছিল, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেসই করলো না ষাঁড়টার দাম কতো। সবাই উটের চারদিকে ব্যস্ত। জীবনে এই প্রথম ওরা লাখ টাকার ষাঁড় দিয়ে কোরবানি করছে, ব্যাপারটা পাড়ার লোককে জানা দেয়া গেল না বলে বেশ মর্মাহত রমজান।

ঈদের দিন সকালে হৈ চৈ করে বিশেষ কায়দায় উট জবাই করা হলো। লোকজন সেই জবাই কান্ড দেখার জন্যও অনেকক্ষণ ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। দুপুরের দিকে ভিড় কমে গেল। রমজান কাটাকুটি রান্না ইত্যাদি কাজে সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রান্না বিলিবন্ঠন খানাপিনা সারতে সারতে বিকেল নেমে গেল।

পাঁচটার পরে রমজান গেট থেকে বেরুলো ভয়ে ভয়ে। জলিলের টিটকারি ছুটবে যে কোন সময়। এত বছরের টিটকারির জবাব হজম করতে হবে আজ তাকে দবির সাহেবের নির্বুদ্ধিতার জন্য।

বেরিয়ে দেখে কোথাও কেউ নেই। একটা নেভি সিগারেটে আগুন দিয়ে কাস্টম বাড়ির পশ্চিম কোনায় চলে গেল। এখানে সিগারেট টানা নিরাপদ। কিন্তু ওখানে গিয়ে সে অবাক। গালে হাত দিয়ে বিমর্ষ চেহারায় জলিল বসে আছে। সকালের সেই উৎফুল্লতার লেশমাত্র অবশিষ্ট নাই। রমজান ওকে দেখে পালিয়ে আসতে গিয়েও দাঁড়ালো। কারণ জলিল কোন টিটকারি দিচ্ছে না আজ, কিছু বলছেও না। ব্যাপার কী?

-ঐ কি হইছে রে, মুখ কালা ক্যান?
-কিছু না!
-আরে মুশকিল, সাহেব বকা দিছে নাকি?
-না!!
-এত বড় উট সামলাইতে কষ্ট হইছে?
-নাআআআ!!
-তাইলে কি, এরাম পেঁচার লাহান মুখ করে রাখছস ক্যান? ভরা পেটে মুখ অন্ধকার করে কেউ?
-আর ভরা পেট....
-কেন কি হইছে?
-সেই কোন এগারোটায় তাড়াহুড়া করে মাংস কেটে চুলায় দিয়া আসছি, এখনো পর্যন্ত ডেকচি নামে নাই চুলা থেকে...
-ঘটনা কি, নামে নাই কেন?
-এখনো মাংস সিদ্ধ হয় নাই। বেগম সাহেবা খুব ঝগড়া করলো সায়েবের সাথে। মাথামোটা বলে গালি দিল। এই উটের মাংস সেদ্ধ হইতে নাকি চোদ্দ ঘন্টা লাগবে। রাত বারোটার আগে খাওয়া যাবে না। শালার একটা ইটাও যদি এতক্ষণ চুলায় রাখতাম হালুয়া হইয়া যাইতো। দুপুর থেকে উপাসে আছি। ঈদের দিন অন্য কিছু খাইতে মন চায় বল?

রমজানের বুক থেকে সারাদিনের বিশাল একটা পাথর যেন নেমে গেল। চরম উদারতার বহিঃপ্রকাশে জীবনে প্রথমবারের মতো একটা আস্ত নেভি সিগারেট জলিলের হাতে তুলে দিল ।

ডানপিটেমির ছেলেবেলা

কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার পর গ্রামে বেড়াতে যাবার রেওয়াজটা আজকাল উঠে গেছে কিনা জানি না। আমাদের সময় ওটাই ছিল বছরের সেরা রিক্রিয়েশান। প্রাইমারী পেরিয়ে হাইস্কুলে ওঠার পর গ্রামে গেলে মজা করা হতো খুব। শহরে আমার ভাবগুরু ছিল বড় মামার ছেলে তমাল। ক্লাসে আমার এক বছরের বড় হলেও গ্রামে গেলে আমরা বন্ধু। বড় মামা শহরে থাকতেন, মেঝমামা গ্রামে।

তমাল একজন প্রতিষ্ঠিত পড়ুয়া। আমরা যখন মামাবাড়ি গিয়ে গাছের ডালে ডালে উল্লুকের মতো ঝুলতাম, পুকুরে দাপাদাপি করতাম কিংবা কাদায় গড়াগড়ি খেতাম অথবা ডাংগুলি খেলতে খেলতে দুপুর পার করে দিতাম, তখন সে নানার খাটের পাশের টেবিলে মগ্ন হয়ে আছে কোন গল্পের বইতে। ফলে তার সুনাম ছিল গ্রাম জুড়ে। শহর থেকে বেড়াতে গেলে রীতিমত সেলেব্রিটি মর্যাদা পেত। তার এত ভালোত্ব আমাদের খুব হিংসা হতো। সেই ভালোত্ব ঘোচানোর ইচ্ছেতে একবার আমরা আমাদের দস্যিপনাতে ওকেও কিভাবে যেন সামিল করে ফেললাম। বইটই ফেলে সেও হৈ হৈ করে যোগ দিল আমাদের সাথে।

যোগ দেবারও পড়ুয়া কারণ ছিল। ওর বই পড়ার অভিজ্ঞতায় দেখেছে এই বয়সে ডানপিটে ছেলেরা গাছ থেকে ফলমূল চুরি করে। পাড়া দাপিয়ে বেড়ায়। সুতরাং জীবনে একবার ওরকম অভিযানে নামলে দোষ নেই।

গ্রাম্য অভিজ্ঞতা তার সবচেয়ে কম হলেও বয়সে বড় হওয়ায় আমরা ওর নেতৃত্বে অভিযানে বেরিয়ে গেলাম। বাড়ীর পেছনে সামান্য পথ হেটে একটা নির্জন পুকুরপাড়। ওই পুকুরে কেউ গোসল করে না অজ্ঞাতকারণে। গা ছমছম নির্জন জায়গা। ওদিকে কেউ যেত না খুব দরকার না হলে। পুকুরটায় কেবল মাছের চাষ। ওই জায়গাটা তাই চুরি করার জন্য আদর্শ। কিন্তু সব কটা আনাড়ি চোর। কোন গাছ থেকে কি চুরি করতে হবে না বুঝতে পারছে না। যুতসই কোন গাছ মিলছে না। কোন গাছেই ফল নেই।

কেবল গাবগাছে কটা গাব দেখা যাচ্ছে কিন্তু ওটায় চড়া দুঃসাধ্য। পড়লে হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকবে না। সহজ কোন শিকারে খোঁজে আমরা। অভিযানে বেরুবার আগে আমি আরেকটা হাত সাফাই করেছি, নানার খাটের নীচে গুপ্তধনের মতো একটা ছোট্ট ছুরি পেয়েছি যেটাকে ভাঁজ করা যায়। অভিযানে অস্ত্রশস্ত্র থাকলে সাহস লাগে। পুরো বনজঙ্গল ঘেঁটে কোন গাছ পাওয়া যাচ্ছে না বলে সবাই যখন হতাশ, তখন একজন বললো, ওই তো একটা লেবুগাছ, থোকা থোকা লেবু ধরে আছে। লেবুও তো একটা ফল, আয় লেবুই সাফা করি। যেই বলা সেই কাজ, দামাল কিশোরের দল হৈ হৈ করতে করতে লেবুগাছে হামলে পড়লো। মোটামুটি সবার পকেট/কোঁচড় যখন ভর্তি তখন তমাল বললো, হয়েছে এবার ফেরা যাক।

আমরা ফিরে চললাম। ঘরে ঢুকলে তো মাইর চলবে, ডরে আমরা পাশের একটা দেউড়ী ঘরে ঢুকে গিয়ে খিল আটকে দিলাম। একটা চৌকিতে সব লেবু ঢেলে দিলাম। বাপরে.... লেবুর পাহাড় পড়ে গেছে। এত লেবু নিয়ে কি করা যায়? এতক্ষণে মাথায় চিন্তাটা আসলো। লেবুতো পেয়ারা বা আম না, যে কচকচ করে খেয়ে ফেলবো।

মহা মুশকিলে পড়লাম। লেবুচুরি পরিকল্পনায় ছিল না। কিন্তু কিছু একটা চুরি না করলে অভিযান ব্যর্থ হচ্ছিল বলেই চুরিটা করা। এসব ভাবনা আলোচনা যখন চলছিল, তখন সেই পুকুর পাড় থেকে এক প্রাচীন নানীর চিৎকার শোনা গেল, "কোন গোলামের বাচ্চা আমার লেবুগাছ ন্যাড়া করে দিয়েছে, ওরে বদমাশের দল, আমার হাড় জ্বালাইলি, আমি একবার পাই হাড্ডি গুড়া করবো তোদের....."

অনির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা হলেও প্রত্যেকটা উচ্চারিত শব্দ আমাদের হাড়ে এসে লাগলো। কারন গলাটা যার, তিনি হলেন পাড়ার সবচেয়ে দজ্জাল বুড়ি। তার ডরে চিল শকুনও তার কোন ফলের গাছে বসে না। আমাদের সব পুচকের চোখ মুখ শুকনো। বুকে হালকা কাঁপন।

এমন সময় দরজায় দমাদম শব্দ।

ওরে বাপ। কে এলো আবার? লুকা লুকা। সব লেবু লুকা, আইজ রক্ষা নাই। কিন্তু তমাল মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললো, তোরা অত চিন্তা করিস কেন। বলবো, আমরা লেবু শহর থেকে কিনে এনেছি। লেবুর মধ্যে কি নাম লেখা আছে? তার বুদ্ধিতে দরজা খুলে দিলাম।

সর্বনাশ!! এটা তো তৈয়ব। যে বুড়ি গালি দিচ্ছে তার নাতি। যদিও সে আমাদের ডাংগুলি বন্ধু, কিন্তু চুরি ধরতে পারলে বন্ধুত্বের বারোটা বাজবে। একদম বমাল হাতে নাতে ধরা। তৈয়ব চৌকির উপর ছড়ানো লেবুর পাহাড় আর দাদীর চিৎকার গালি দুটো মিলিয়ে যা বোঝার বুঝে নিল।

তমাল আসলেই প্রতিভাবান। সে তখন ছুরি দিয়ে নির্বিকার লেবু কাটছিল। তৈয়বকে দেখে বেড়াছেড়া কন্ঠে বললো, "আরে তৈয়ব কেমন আছো? তুমি আসছো.... ভালো হয়েছে, আসলে আমরা লেবু খেতে খুব পছন্দ করি তো তাই শহর থেকে আসার সময় এত্তগুলা লেবু কিনলাম, এখন খেয়ে শেষ করতে পারছি না। আসো তুমিও খাও একটা।"

তৈয়ব বেজার মুখে লেবুটা নিল। চোরকে হাতে নাতে পেয়েও কিছু করতে পারছে না কারণ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে সে এই গ্রামের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছেলে এবং তার বন্ধুও। তমালের বন্ধুত্ব হারাতে হবে চুরির ঘটনা ফাঁস হলে। সুতরাং দাদীর চিৎকারে গা না করে সে বিরস মুখে লেবু খেতে বসে গেল আমাদের সাথে।

ঘটনাটা তৈয়ব বেমালুম চেপে গেলেও রাতের বেলা আরেক চোরের খোঁজ লাগালো মেজমামা বাড়ীতে ফেরার পর। তার দামী ছুরিটা চুরি গেছে, যে চুরি করছে তাকে পাওয়া গেলে কানের পটকা ফাটিয়ে দেয়া হবে বলে ঘোষণা করা হলো।

চিন্তায় পড়লাম। আসলে ছুরিটা প্রথমে চুরি করেছি আমি, কিন্তু আমার কাছ থেকে নিল তমাল, আবার তার কাছ থেকে হাতিয়েছে খালাতো ভাই আজাদ। চোর হিসেবে কাকে ধরা উচিত, কার কানের পটকা ফাটানো হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হলো আমাদের। আলোচনা অসমাপ্ত রেখে শুতে গেলাম।

তবে শোবার আগে আজাদ চুপি চুপি ছুরিটা জায়গা মতো রেখে এলো।

পরদিন মেঝ মামার ছেলে বেলাল ওটা খুঁজে পেয়ে খুশীতে বাবার কাছে ছুটে গিয়ে বললো, "বাবা বাবা..... দেখো ছুরিটা পাওয়া গেছে।"
মামা তখন টেরা চোখে বেলালের দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি তখনই বুঝেছিলাম এটা কার কাজ। আয় তোর কানের পটকা ফাটাই এবার......."

বেলালের ত্রাহি চিৎকারে আমাদের সবার মনে কেমন একটা নিষিদ্ধ পুলক লাগলো।

একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা

একদা এমনই বাদলশেষের রাতে---
মনে হয় যেন শত জনমের আগে---

পৃথিবীটা যে গতিতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তার চেয়েও দ্রুত গতিতে দুটো বাক্য এসে তার চোখের সামনের ল্যাপির পর্দা জুড়ে দাড়ায়। এত রাতে কে মেইল দিল? মেরুণ ফ্রেমের চশমাটা একটু নেড়ে বসালো সে নাকের উপর। প্রেরকের অচেনা নাম দেখেই বুঝলো পথিক পথ হারাইয়াছে। টেলিফোনে ক্রস কানেকশানর মতো ইমেল ক্রসকানেকশান।

নদী ভ্রু কুঁচকে বাক্য দুটোর দিকে তাকিয়ে মেইলটা ডিলিট করার আগে এক সেকেন্ড ভাবলো। এক সেকেন্ডের এক শতাংশের মধ্যে নদী ঘুরে আসে একটা সৌরজগত।

একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ দিল অবারিত করে ||

স্মৃতিকে সম্মান দিতে মাঝরাতে এই বেহুদা চিঠিটা মুছে না দিয়ে পত্রদাতাকে ফিরতি ডাকে অতিশয় ভদ্রস্বরে জানালো যে এই পত্র পথ হারিয়ে ভুলক্রমে তার কাছে চলে এসেছে, তিনি যেন সঠিক রাস্তায় আবার প্রেরণ করেন।

অচেনা পত্রদাতা ধন্যবাদ জানিয়ে যে পত্র লিখেছিল সেখানে একটা বাক্যে মানব মনের একটু হাহাকার মেশানো ছিল। ওই হাহাকারের সাথে নদীর বিদ্যমান বেদনার তানপুরার কোথাও সুর মিলেছিল বলে নদী মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। তবু ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে পত্রপাঠ বিদায় দেবার জন্য বাক্যটা উপেক্ষা করে জানালো, ধন্যবাদের কোন জবাব হয় না।।

চিঠিতে কোন জবাব চাওয়া হয়নি, তবু পরদিনও চিঠি আসলো একটা। বন্ধুত্বের আহবানের ইঙ্গিত ছিল সেই পত্রে। ওর বান্ধবী লুনার মতে, জগতের সকল পুরুষই কমবেশী লুল। একটা মেয়ের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেলে নানান অজুহাতে তার সাথে স্টিকি হবার চেষ্টা করে।

নদী এই তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, জগতের সকল পুরুষ এক নয় হে।

কিন্তু তৃতীয় পত্রটিতে বন্ধুত্বের আহবান লুনার তত্ত্বকে সমর্থন করায় বিরক্ত হলো নদী। পত্রদাতা লিখেছেন তিনি অতিদূর দেশে বাস করেন। একাকী নিঃসঙ্গ জীবন। নারীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা উঠিয়া গিয়াছে, জীবনে বিবাহ করিবেন না ইত্যাদি। এই বাক্যটি পড়ার পর নদী চুড়ান্ত বিরক্ত হয়।

এই জীবনে তার সাথে পরিচত হওয়া কমপক্ষে তিনজন পুরুষ এই কথা বলেছে, দেখা গেছে প্রত্যেকের মধ্যে একটা একাকীত্বের বেদনা লুকোনো, প্রত্যেকেই নারীজাতির প্রতি উদাস, কেবল তাকেই দেখেছে ব্যতিক্রমী নারী হিসেবে। একসময় এসব শুনে চমৎকৃত হতো সত্যি, কিন্তু আজকাল অসহ্য লাগে এসব ঠুডা উদাসীনতা। কিন্তু বন্ধুতার আহবান উপেক্ষা করা সহজ কাজ নয়। অতটা অভদ্র হতে পারবে না সে। চুপ করে থাকলো, জবাব দেবে না আর।

অচেনা পত্রদাতা আরো একখানা পত্রবান নিক্ষেপ করলেন দুদিন বাদে। এবারের পত্রে কোন হাহাকার নেই, উত্তর না পাওয়ার ক্ষোভও নেই। লিখেছেন তিনি বই পড়তে ভালোবাসেন, গান শুনতে ভালোবাসেন, ছবি তুলতে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন ভ্রমণ করতে।

নদী হাসি চাপতে পারলো না এটা দেখে। লুনা বলেছিল জগতের সকল পুরুষ নাকি এই চারটা শখের কথা তাদের বায়োডাটাতে লিখে। নদী এই পত্রের একটা ফাজলেমি উত্তর লিখলো, "আমি সকাল সকাল ঘুমাতে ভালোবাসি, বই পড়ি না, গান শুনি না, বেড়াতে পছন্দ করি না, ছবি তুলিনি জীবনেও"।

এক লাইনে এতগুলো মিথ্যে লিখতে পারলো সে! প্রতি রাতে ঘুম নেই তার চোখে, সারারাতই গান শোনে, বই পড়ে, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে যায় দূরে কোথাও, ক্যামেরায় ক্লিক তার প্রিয় অভ্যেস।

নদীর ওই একলাইনের উত্তরে পত্রদাতা আবারো বিশাল পৃষ্ঠাভর কাহিনী লিখে পাঠালো। এবার শুরু হয়েছে বিস্তারিত জীবন কাহিনী। নদী আলগোছে চোখ বুলিয়ে ডিলিট বাটনে চাপ দেয়। পরদিন আরেকটা আসে, আরেক কাহিনী নিয়ে। নদী যথারীতি ডিলিট বাটনের সাহায্য নেয় হালকা চোখ বুলিয়ে।

প্রায় তিন সপ্তাহ নদী কোন চিঠির জবাব না দিলেও পত্রদাতা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে চিঠি লিখে যায় প্রতিদিন। নদী মনে মনে গাল পাড়ে- 'ব্যাটা রামছাগল'।

একদিন চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ। নদী হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। পরদিন থেকে নেট খুলে চিঠি মোছার ঝামেলা নেই। কিন্তু তবু নেটে গিয়ে একবার ঘুরে আসে প্রতিরাতে। কোন মেইল নেই। প্রতিদিনের অভ্যেস মেইলটা চেক করা। চিঠি থাক বা না থাক।

তিন চারদিন কোন চিঠি মুছতে না পেরে নদী কেমন একটু অস্থির হয়। রাগও হয় একটু অচেনা পত্রদাতার প্রতি। কি হলো লোকটার? কোন খবর না দিয়ে এরকম গায়েব হয়ে যায় কেউ? গায়েবই যদি হবি তাহলে এত কাহিনী করার কি দরকার ছিল। আমি কি তোর কাছে চিঠি চেয়েছিলাম? মেজাজ চড়তে থাকে দিনে দিনে।

একসপ্তাহ পর নিয়ম ভেঙে নদীই চিঠি লিখে বসে এক লাইনের। "কি ব্যাপার? সাড়া শব্দ নেই কেন? কোথায় আছেন? কেমন আছেন?"

ওমা, পরদিনই চিঠির জবাব এসে হাজির। এক লাইনের জবাবে তিন পৃষ্টার বিরাট কাহিনী। এবার কপাল কুঁচকানোর সাথে দাঁতের দুপাটির আংশিকও দেখা যাচ্ছে নদীর। এত বড় চিঠি লিখতে বলছে কে আপনাকে। যত্তসব! চিঠিটা মুছতে গিয়েও রেখে দিল। ভাবতে বসলো, কারণ কি?

লোকটা না হয় লুল বুঝলাম। কিন্তু আমি কেন লোকটার চিঠির জন্য অস্থির হয়ে আছি? চিঠি মোছার জন্য এত আগ্রহের কারণ কি? বেহায়াটা নির্ঘাত জানে না তার চিঠি আমি মুছতেই পছন্দ করি।

মনকে শক্ত করে কঠিন ঝামা ইট ঘষে একটা উত্তর লিখতে বসলো নদী।

"জনাব, আপনি হয়তো জানেন না, আই'ম টেকেন। আপনি শেষ যে পত্রটি লিখেছেন, তাতে আমি ভীষণ লজ্জিত যে আপনি আমাকে নিঃসঙ্গ বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু আমি স্বামী সন্তানকে নিয়ে সুখে দিন যাপন করিতেছি। আপনার পত্রের জন্য অশেষ ধন্যাবাদ। দয়া করে আমাকে চিঠি লিখবেন না। চিঠি মুছতে প্রতিদিন লগইন করতে হয়। ভালো থাকুন।"

এত অপমানজনক উচ্চারণের পর আর কোন চিঠি আশা করা যায় না। নদী তাই চেয়েছিল মিথ্যে দিয়ে সাজানো বাক্যগুলো লিখে লোকটাকে নিবৃত করতে। কারণ লোকটা তাকে ক্রমশ গ্রাস করছিল। অসহ্য এটা।

উত্তরে লোকটা কয়েক ডজন অট্টহাসির ইমো দিল এবং চিঠি দেয়া বন্ধ করলো।

যদি একেবারেই কোন জবাব না আসতো, নদীর কোন সমস্যা হয়তো হতো না। কিন্তু অট্টহাসির ইমোগুলো তাকে দিনরাত জ্বালিয়ে মারতে লাগলো। মুছতে গিয়েও মুছতে পারলো না। প্রত্যেকটা ইমো তাকে কিরকম অপমান করছে, অবিশ্বাস করছে, ভাবা যায় না। সেই ভার্চুয়াল ইমোগুলো তাকে পদে পদে হেনস্থা করতে থাকলো। ক্লাসে মন বসে না, বাসায় মন বসে না, বন্ধুদের আড্ডায় যেতে ইচ্ছে করে না। সবখানেই কে যেন তার কানের কাছে গুনগুন করে অট্টহাসি দিচ্ছে।

লোকটা ফোন নাম্বার দিয়েছিল একবার, কেন যেন নাম্বারটা টুকে রেখেছিল তখন। সেদিন আর সহ্য করতে না পেরে চরম কঠিন মেজাজ নিয়ে লোকটাকে ফোন করে বসলো। কোন সুদূরে বসে লোকটা কি করছে কে জানে, যাই করুক, তাকে একটা গালি দিতে চায় নদী। কখনো গলা শোনেনি তার। কিন্তু নদী 'হ্যালো আমি নদী' বলতেই অন্যদিক থেকে মন কেমন করা একটা গলা বলতে শুরু করলো-

সন্ধিলগ্ন ফিরেছে সগৌরবে ;
অধরা আবার ডাকে সুধাসংকেতে,
মদমুকুলিত তারই দেহসৌরভে
অনামা কুসুম অজানায় ওঠে মেতে |
ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি,
অবাধ সাগরে উধাও অগাধ থেকে ;
অমল আকাশে মুকুলিত তার হৃদি
দিব্য শিশিরে তারই স্বেদ অভিষেকে |

দুদিনের প্রস্তুতিতে, রাগের মাথায় যা বলতে চেয়েছিল নদী সব ভুলে যায়, অবশ হয়ে যায় তার শরীর। নিরুপায় আত্মসমর্পন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলে, আমাকে রেহাই দিন নয়তো আশ্রয়....। কাংখিত সেই অচেনা কন্ঠ বলতেই থাকে-

সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে ;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে |

নদী এবার সত্যি সত্যি পরাজিত হলো নতুন পথের সম্ভাবনার কাছে।

সূর্যসেনকে নিয়ে বোম্বের বুজরুকি ছবি Khelein Hum Jee Jaan Sey

ছবিটার নাম দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই ছবিটা চট্টগ্রামের সেই বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে যার মহানায়ক সূর্যসেন। এত বছরেও বাংলাদেশ পারেনি সূর্যসেনকে নিয়ে একটা যুতসই ছবি তৈরী করতে, বোম্বে অন্ততঃ বাংলাকে সম্মান দেখিয়েছে ছবিটা তৈরী করে। সেই ভেবে মনে মনে পরিচালক Ashutosh Gowariker এর উপর কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে ছবিটা দেখতে শুরু করি। কিন্তু ছবি যতই এগোতে থাকে কৃতজ্ঞতাবোধ কমতে থাকে আর মুখের ভেতর জমতে থাকে বিবমিষা তরল। মাঝপথ পেরোবার আগে পরিচালকের উদ্দেশ্যে একদলা থুতু তৈরী হয়ে যায় মুখের ভেতর। ওটা বাথরুমে ফেলে এসে কোনমতে ছবির বাকী অংশটা শেষ করি নেহাত ১০০ টাকা খরচ করে কিনেছি বলে। ছবিটার নাম Khelein Hum Jee Jaan Sey।

যদি কারো বিস্তারিত পড়াশোনার সময় না থাকে, ঘটনার উপর বিশদ জ্ঞান লাভের সুযোগ না থাকে, তাহলে ইতিহাস নির্ভর ছবি না বানানোই উচিত তার। নয়তো ইতিহাস বিকৃতিকারী হিসেবে নাম উঠে যাবার সম্ভাবনা থাকে দর্শকের খাতায়। বিকৃতিটুকুও সয়ে নেয়া যেত যদি ছবিটাকে কমার্শিয়াল ছবি হিসবে ঘোষণা করা হতো। কিন্তু পরিচালক সচেতন ভাবে ছবি শুরুর আগেই গম্ভীরতার সাথে জানান দেন, ইহা একটি সত্য ঘটনা, বর্ণিত সকল চরিত্র আর ঘটনা বাস্তব। এই ঘোষণাতেই পাঠকের মনে আলাদা চাহিদা তৈরী হয়ে যায় এবং সেটাই সমস্যা করেছে ইতিহাস জানা পাঠকদের।

পরিচালক হয়তো ছবিটা নেহায়েত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই বানিয়েছে। ধরেই নিয়েছে দর্শক ইতিহাসের অত বিস্তারিত জানবে না, বোম্বের আর দশটা ছবির ফরমেটে কিছু গান, কিছু দলনৃত্য আর খুচরা প্রেম জোর করে সেঁধিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছে।

IMBD তে যখন দেখি "Deprived of playing football by oppressive British, children decide to join a group of freedom fighters" এই বাক্যটা তখন বুঝতে বাকী থাকে না পরিচালক ছবিটাকে কতোটা খেলো করে ফেলেছেন। এই লাইন পড়ে কেউ ভাবতে পারে এটা ফুটবল খেলা সংক্রান্ত কোন একটা গণ্ডগোলের ছবি। যার ফলে ভারতবর্ষে বিদ্রোহ করেছে কিছু বাচ্চালোগ। এটা যে পুরো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা বিষয়ক একটি চলচ্চিত্র সেটা কিছুতেই মাথায় আসবে না।

উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রে প্রেম ছাড়া কোন ছবি তৈরী করা যায় না বলে একটা স্থায়ী ধারণা আছে। সেই ধারণাকে পোক্ত করতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মতো ইতিহাসসমৃদ্ধ ঘটনার মধ্যেই সুচারুরূপে প্রেম ঢুকে গেছে সুক্ষ্ণভাবে। এই ছবিতে প্রধান নারী চরিত্র দুজন। পুরুষ চরিত্র অসংখ্য।

পুরুষ প্রেমহীন থাকতে পারলেও নারীকে কারো না কারো প্রেমে পড়তেই হবে এরকম একটা জিনিসও পরিচালকদের মাথার ভেতরে কাজ করে। ফলে দুই নারীকে যুতসই দুজন বিপ্লবীর সাথে জুড়ে দেয়া হয়। কল্পনা দত্তকে সূর্যসেনের সাথে, প্রীতিলতাকে নির্মল সেনের সাথে।

সূর্যসেনের সাথে প্রীতিলতার সাক্ষাত হয় অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ঘটনার দুবছর পরে ১৯৩২ সালে। কিন্তু ছবিতে দেখা যায় প্রীতিলতা বেণী দুলাতে দুলাতে সখীর হাত ধরে সূর্যসেনের সাথে সাক্ষাত করতে আসে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ঘটনার অনেক আগে। এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সূর্যসেনের সাথে দৈনিক যুক্ত হয়ে যায়। হাসতে হাসতে বিপ্লবীর নাম তালিকাভুক্ত করে প্রীতিলতা সূর্যসেন ওরফে অভিষেক তৃপ্তির চোখে তা দেখতে থাকে, তার বিপ্লব তৈরী হতে থাকে পরিচালকের খেলা ঘরে।

ছবিতে দেখায় রামকৃষ্ণ গহীন জঙ্গলে ট্রেনিং নিতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়(সম্ভবত: নিহত হয়) যেখানে উপস্থিত প্রীতিলতা ও সূর্যসেন সহ অন্য সবাই। কিন্তু ইতিহাস বলে রামকৃষ্ণ বলে এক বিপ্লবী বোমা তৈরী করতে গিয়ে আহত হয় বিস্ফোরণে নগরীর একটা বাসায়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে, পরে ফাঁসি দেয় ১৯৩১ সালে। প্রীতিলতা তখনো বিপ্লবের সাথে যুক্ত হননি, তবু আগ্রহ ছিল প্রবল। রামকৃষ্ণের সাথে জেলখানায় বহুবার দেখা করে। সেই ঘটনা সূর্যসেনের সাথে প্রীতিলতার সাক্ষাতের বছরখানেক আগে।

ছবিতে দেখায় কল্পনা ও প্রীতিলতাকে তার পরিবার কোলকাতায় পাঠিয়ে দেয় বিপ্লবীদের সাথে মাখামাখির কারণে। ওখানে বসে পত্রিকায় পড়ে সূর্যসেন ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট করেছে। অথচ ইতিহাস বলে যখন অস্ত্রাগার লুট হয় তখন প্রীতিলতা মাত্র ইন্টার পাশ করেছে, ঘটনার পরদিন ১৯শে আগস্ট সে সে চট্টগ্রাম আসে। বেথুনে পড়তে যায় আরো কিছুদিন পর।

ছবিতে দেখি প্রীতিলতা কল্পনা দত্তকে নিয়ে কোলকাতা থেকে বিপ্লবীদের জন্য বোমা আর লিফলেট নিয়ে একসাথে ফিরছে। স্টেশনে কল্পনা ধরা পড়ে, প্রীতিলতা নির্বিঘ্নে সরে পড়ে। এরকম কোন ঘটনার কথা ইতিহাস আমাদের বলে না। বরং ইতিহাস বলে কল্পনা দত্ত বেথুন থেকে প্রীতিলতার এক বছর আগেই চট্টগ্রাম কলেজে চলে আসে বদলি হয়ে। প্রীতিলতা বেথুন থেকে বিএ পাশ করে চট্টগ্রাম ফিরে আসে ১৯৩২ সালে। ওই বছর মে মাসের শেষভাগে সূর্যসেনের সাথে দেখা হয় প্রীতিলতার। তার কয়েকমাস পরেই ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পর আত্মাহুতি দেয় প্রীতিলতা।

প্রীতিলতার আত্মাহুতি ঘটনায়ও পরিচালক ধূম্র উড়িয়েছেন। প্রীতিলতা দেশের উদ্দেশ্যে প্রাণ উৎসর্গ করেছে বলে ইতিহাস আমাদের জানালেও এখানে দেখা যাচ্ছে প্রীতিলতা তার জানটা শেষ করে দিচ্ছে জানেমান নির্মল সেনের উদ্দেশ্যে। নির্মল সেন তার কিছুদিন আগে ধলঘাটের সংঘর্ষে নিহত হন। ইতিহাস প্রীতিলতার সাথে নির্মল সেনের কোন রকম প্রেমময় সম্পর্কের ইঙ্গিতও দেয় না। কিন্তু পরিচালক গাঁজা খেয়ে ছবিতে প্রেম আবিষ্কার করে বসেছেন।

এরকম প্রচুর ছোটবড় অসংগতি আর ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে তৈরী হয়েছে 'খেলে হাম জি জান সে'। পরিচালক ইতিহাস নিয়ে ভালোই খেলেছেন। খেলাটা মোটেও ভালো লাগেনি। ইতিহাসের সত্যঘটনা অবলম্বনে তৈরী বলে ঘোষিত যে কোন চলচ্চিত্রের কাছে প্রত্যাশা থাকে স্বাভাবিক ঘটনা নির্ভর ছবি। বাণিজ্যিক বুজরুকি নয়।

তাহাদের অমৃত 'বাণী'

পোষ্ট পড়ে মেজাজ খারাপ হতে পারে। তাই শুরুতে দুটো গান শুনে নিন। প্রথমে শুনুন শোনাও তোমার অমৃতবাণী। একটা শুনে মন ভরেনি? এবার আরেকটা। শুধু তোমার বাণী।। সৌজন্য ছাড়া আজকাল টিভিতে ছাগলও গান গায় না। খবরের পরতে পরতেও সৌজন্য। বিরতি বিজ্ঞাপন তো আছেই। এমনকি হেডলাইনের মাঝখানেও বিজ্ঞাপন চলে। এই গানগুলো পোষ্টের অপ্রাসঙ্গিক জাতের বিজ্ঞাপন। মূল বিষয়ে আসি। বিষয় হলো 'বাণী'।

বিশেষ দিনে দৈনিক পত্রিকার এক্সট্রা পাতা যোগ করতে হয় বাণী প্রচার করতে। এর জন্য পত্রিকার বড় অংকের বিজ্ঞাপন আয় হয়। এর বাইরে বাণীর আর কোন সুবিধাভোগী আছে?

দিবস ভেদে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় বা দপ্তরের প্রধান পর্যন্ত বাণীদাতা হন। বাণীর কতোগুলো নিয়ম আছে ফরমেট আছে সরকারী প্রেসনোটের মতো। আসুন দেখা যাক একটা বাণীতে কি কি থাকে কি কি থাকে না?

১. বাণী পাতায় বাণীদাতার একটা পাসপোর্ট সাইজ ফটো ডান/বাম কোনায় থাকবে। ছবির নীচ বা ডান/বাম পাশ থেকে বাণী লেখা শুরু হবে। নির্দিষ্ট সময় পরে বাণী শেষ হবে। নীচে বাণীদাতার স্বাক্ষর পদবী শিক্ষা ইত্যাদি থাকবে। (স্বাক্ষর কি বিশ্বাসযোগ্যতা বা ওজন বাড়ায়?)

২. বাণী চিরন্তন। তাই বাণী কখনো বদলায় না। যুগযুগ ধর একরকম থাকে। (ধরুন সশস্ত্র বাহিনী দিবস। এই দিবসের গত ত্রিশ বছরের বাণী পাশাপাশি সাজালে দেখা যাবে বাণীর বাক্যমালা একই আছে, শুধু ছবি বদলেছে। বাণীদাতা চিরন্তন না, বাণীই চিরন্তন।

৩. বাণীতে কখনো সমালোচনা থাকে না, শুধুই তৈল মর্দন আর পৃষ্ঠ চুলকানি। মানপত্রের মতো। একসময় বিয়েতেও বর কনের উদ্দেশ্যে মানপত্র ছাপানো হতো। বাণীও সেরকম।

৪. বাণীতে প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করা হয় মরণশীল প্রতিষ্ঠান হলেও।

৫. কোন কোন বাণী যে কোন দিবসেই একরকম থাকে। এর কারণ বাণী ক্লার্ক কুঁড়ে সম্রাট, জীবনে কপিপেষ্ট বাদে আর কিছু শেখেনি।

৬. তবে বাণীর সবচেয়ে ভালো দিক হলো বাণীতে কখনো কাদা ছোড়াছুড়ি থাকে না। বাণী সর্বদা সুশীল। ইস্তিরি করা জামার মতো।

এবার আন্দাজ করা যাক বাণী কে কে পাঠ করে। যার বাণী তিনি যে পড়েন না, তা মোটামুটি নিশ্চিত। তার অত সময় নেই। বাণীদাতা বিদেশে থাকলেও বাণী ছাপা হয়ে যায়। বাণী লেখার লোক আছে। তবে তারাও বোধহয় বাণী পড়ে না। তারা গত বছরের সেভ করা ফাইলটা ওপেন করে বছরটা বদলে দিয়ে প্রিন্ট করে কিংবা পত্রিকা অফিসে ফরোয়ার্ড করে দেয়। পত্রিকা অফিসে বাণী পড়ার কেউ আছে? প্রুফরিডার? না বোধহয়। আজকাল প্রুফরিডিংএর ভাত নেই। পিসিতে স্পেল চেকার দিয়ে কাজ হয়ে যায়। এরপর বাণী পেষ্টিং রুমে চলে যায়। ওখানে পাঠ করার সুযোগ নেই। পেষ্টিং হলে ছাপার ঘরে ঢুকে যায়। ছাপাখানার রোলার দমাদম পেটাতে পেটাতে বাণীকে চিড়ে চ্যাপটা করে ছাপা কাগজে বের করে দেয়।

ছাপা হবার পর থেকে হকারের সাইকেলে চড়ে পাঠকের হাতে পৌঁছাবার আগ পর্যন্তও বাণী পঠিত হবার কোন সম্ভাবনা নেই। অবশেষে পত্রিকার কোলে করে বাণী পাঠকের হাতে আসলো।

ধরা যাক সেই পাঠক আমার মতো কেউ। পত্রিকা হাতে নিয়েই ক্রোড়পত্র চোখে পড়লে ওটা কিসের তা দেখার প্রয়োজন না করেই পাশের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে সযত্নে ড্রপ করবে। ৫ বছর বয়সী কন্যাটা খেলতে এসে ওটা দেখে বলবে, "বাবা এটা তুমি ফেলে দিয়েছো, আমি নিয়ে খেলি?" আমি বলবো, ঠিকাছে তুমি ওটা নিয়ে খেলতে পারো।

কন্যা 'বাণী' নিয়ে খেলতে যাবার খানিক পর একটা চিৎকার আসবে। "বাবা!!! শিহান পেপারটা পড়ার জন্য টানাটানি করছে!!!" শিহান আমার দুবছর বয়সী কনিষ্ঠ সন্তান। বড়বোন যা নেয়, ওরও তা চাই। আমি জবাবে বলবো, "ওকেও পড়তে দাও!"।

কিছুক্ষণ পর আবারো চিৎকার, সাথে কান্না, "বাবা!!!!!!!!! শিহান ওটার উপর হাগু করে দিয়েছে!!!! আমি এখন কেমনে খেলবো????????"

আমি আনমনে জবাব দিতে গিয়ে প্রায় বলে বসবো, ওকে হাগতে দাও.......। কিন্তু কি মনে হতেই দৌড়ে ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখবো কম্ম সাবাড়!! মানী লোকের মান মেরে দিয়েছে আমার ফাজিল ছেলেটা!!

.....................................................................................................................

আজকে কোন লেখা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু খানিক আগে বাংলাদেশ বিমানের ওয়েবসাইটে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম ওয়েবসাইটেও বাণীর আছর। দুই কর্তার দুটো বাণী পড়ে এ বিষয়ে সাড়ে তিনখানা কথা না লিখে পারলাম না।

বিমানের বাণী সেই দুটো পড়তে চান?
বাণী এক। বাণী দুই।

এই বাণীতেও যথারীতি খারাপ কিছু নেই। তবে কথা হলো, সুযোগ পেলেই আমরা বাণী দিতে ভালোবাসি। বাণীসমৃদ্ধ জাতি আমরা।

চিংড়ি ভাজা, খেতে মজা!!!

(এটি একটি খানাপিনা বিষয়ক হালকা পোষ্ট। জ্ঞানীগুনীরা নিজ দায়িত্বে পড়বেন).......আমি পড়তে ভালোবাসি। শুধু তাই না, পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়তে আরো বেশী ভালোবাসি। তবে আজকাল সাহিত্য পড়া বাদ দিয়ে নতুন কিছু পড়ছি। পড়ছি না ঠিক, বলা যায় গবেষণা করছি। .........যেসব খাবার খেতে ডাক্তার বারন করেন, যেসব খাবার জিবে সয় কিন্তু রক্তে সয় না, যেসব খাবার ছেলেপিলেরা কচ কচ করে খায়, আর আধবুড়োরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, সেইসব খাওয়া কি উপায়ে খাওয়া যায় সেই বিষয়ে গবেষণা করা এবয নিষিদ্ধ খাবারগুলোকে নির্ভয়ে টেবিলে পরিবেশনে গৃহিনীদের উৎসাহিত করাও একটা উদ্দেশ্যে। আজকের বিষয় চিংড়ি।

চল্লিশে সবাই চালশে হয় না। তবু চল্লিশ পেরুনো মানুষদের স্বাস্থ্যচিন্তা করতেই হয়। কারণ এই বয়স থেকেই যাত্রা শুরু হয় সেইসব রোগের যা এতদিন যাবত বয়স্কদের রোগ বলেই শুনতে অভ্যস্ত ছিল। যেমন হার্টের ব্যামো, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার ইত্যাদি। এই সময়ে লিপিড প্রোফাইল, কোলেষ্টেরল, এইচডিএল, এলডিএল, ট্রাইগ্লিসারাইড ইত্যাদি শব্দের সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটতে থাকে ধীরে ধীরে। ডাক্তারের চেম্বারে, ডায়গনসিস সেন্টারে, ওষুধের দোকানে বারবার হানা দিতে হয়।

প্রথমবার লিপিড প্রোফাইল করাই তিন বছর আগে। তখন মোট কোলেষ্টেরল LDL, HDL সবকিছু নিরাপদ মাত্রার মধ্যে ছিল, কেবল ট্রাইগ্লিসারাইড ছিল ২৮০ (সর্বোচ্চ নিরাপদ সীমা ২০০)। ডাক্তার সাহেব TG বা triglycerides নিয়ন্ত্রনের জন্য কিছু নিয়মনীতি বেধে দিলেও বাঙালীর স্বাধীন গণতান্ত্রিক চেতনায় মাসখানেক পরই নিয়মের বেড়া ভেঙ্গে বেরিয়ে আসি। আবার পুরোনো সিস্টেমে চলতে থাকি। দাওয়াতে গেলে নিজের প্লেটে বিরিয়ানী রেজালা সব নিয়ে বসি আর বাণিজ্যমন্ত্রীর মতো লোকজনকে বলতে থাকি, কম খান।

তেমন কোন সমস্যা হচ্ছিল না। তবে জাপানের সুনামীর কিছুদিন পর আমি চোখে প্রায়ই ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্প দেখতে থাকি বাংলাদেশে বসেও। চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম কয়েকবার। আশপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ওরকম ভূমিকম্পের কোন নজির তারা দেখে না। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি দেখেশুনে জানালো ভূমিকম্প আসলে আমার মাথায়। আবারো চেকাপ। লিপিড প্রোফাইলসহ নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষার প্রেসক্রিপশান।

দেখা গেল তিন বছর আগের তুলনায় শরীরের ওজন তেমন না বাড়লেও রক্ত কনিকায় সব ধরনের কোলেস্টেরলের প্রবৃদ্ধি কেওক্রাডং ছেড়ে কাঞ্চনজংঘার দিকে রওনা দিয়েছে এবং সবচেয়ে বাম্পার ফলন হয়েছে টিজি বা ট্রাইগ্লিসারাইডের। আমার ট্রাইগ্লিসারাইড ৭৪৭ ছুয়েছে! ভয়াবহ অবস্থা। টিজি'র বিপদ সীমার সর্বোচ্চ রেটিং ৫০০, আমার রেটিং তাদেরকে ছেড়ে বোয়িং ৭৪৭ এর মতো অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। অথচ আমি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করি, সীমিত আহার করি, পানদোষ নেই, ধুমদোষ নগণ্য। দোষের মধ্যে হাঁটাহাটি কম করি আর সুযোগ পেলে কাবাব তন্দুরী খাই।

ডাক্তার সাহেব সব উর্বর খানাপিনা, সামাজিক দাওয়াত, ফাষ্টফুড, তন্দুরী ইত্যাদির উপর কারফিউ জারি করলেন। রুটি/ভাত, সবজি, সমুদ্রের মাছ, ফলমূল ইত্যাদি বাদে আর সব খাবার নিষিদ্ধ। আয়ুবৃদ্ধির স্বার্থে আমি সব মেনে নিলাম, কিন্তু চিংড়ি মাছের প্রতি আজীবন দুর্বলতা হেতু, ডাক্তারের কাছে মিনমিন করে আপীল করলাম,
-সত্যিই চিংড়ি খাওয়া যাবে না? এটা কি খুব ক্ষতিকর?
-অসম্ভব। এটা কোলেষ্টেরলে ভর্তি, এটা একদম খাওয়া নিষেধ
-কিন্তু আমি যেন শুনলাম এটায় LDL কম HDL বেশী এবং এই চিংড়িতে OMEGA-3 আছে
-ওসব হলো খাওয়ার ফন্দী। আমি যখন বলছি ওসব কিছুতেই খাবেন না।

বেজার মুখ করে চলে আসলাম। কিন্তু একদিন স্বপ্নে আওয়াজ পেলাম, আরো কিছু অজুহাত খুঁজে বের করো যাতে চিংড়িটা সুখপাঠ্য যুক্তি দিয়ে টেবিলে সাজানো যায়। নেটে বসে আবারো গুঁতোগুতি শুরু করলাম। চিংড়ি মাছের মতো মজাদার একটা আইটেম খানাপিনার লিষ্ট থেকে বাদ যাবে, এটা হতে পারে না। খুঁজি আর খুঁজি কিন্তু কোথাও সায় পাই না।

অবশেষে ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশান একটু আশার আলো দেখালো। ওরা মৃদুস্বরে বলছে, যেসব খাবারকে আমরা কোলেষ্টেরোলের জন্য দায়ী করি, আসলে তার চেয়েও ভয়ংকর ক্ষতিকর জিনিস হলো saturated fat এবং trans fat. কোলেষ্টেরোলের উৎপাত কমাতে এই দুটোর ভোজন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। এবং চিংড়িতে এই জিনিসের তেমন প্রাদুর্ভাব নেই। এটা শোনার পর নড়ে চড়ে বসলাম আবার। তবে এই লিংকের ডকুটা ডাক্তারের কাছে দেখালে ডাক্তার মানবে কিনা সন্দেহ। যদিও এখানে পরিষ্কার বলেছে-

A common cause of high blood cholesterol levels is eating too much saturated fat.

However, some people have high blood cholesterol even though they eat a healthy diet. For example, they may have inherited a condition called familial hyperlipidaemia (FH).
The cholesterol which is found in some foods such as eggs, liver, kidneys and some types of seafood eg. prawns, does not usually make a great contribution to the level of cholesterol in your blood. It's much more important that you eat foods that are low in saturated fat.

আবার বলছে-
"In the past a restriction on eggs was recommended because we thought that foods high in cholesterol (including liver, kidneys and shellfish, as well as eggs) could have an impact on cholesterol levels in the body.

ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশানের মতো প্রতিষ্ঠান যখন একথা বলে, তখন আমার ডাক্তারের উপদেশ একটু সন্দেহের মধ্যে পড়ে যায় না?

আমি আজকাল ডাক্তার বৈদ্যকে নির্ভেজাল বিশ্বাস করা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ ওদের কথাবার্তা কদিন পরপর বদলায়। একসময় বলতো চা খাওয়া খারাপ। এখন শুনি দিনে পাঁচ কাপ চা খেলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা কম থাকে, আরো অনেক অসুখ বিসুখের জন্য চা বিশেষ উপকারী। জয়তু চা! তবে চিনি ছাড়া।

যাইহোক চিংড়ি কথায় ফিরে আসি।

ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশানের পরে উইকিতে গিয়ে চিংড়ি বিষয়ে দারুণ একটা প্যারা খুঁজে পেয়ে আরো উৎসাহিত হলাম।
As with other seafood, shrimp is high in calcium, iodine and protein but low in food energy. A shrimp-based meal is also a significant source of cholesterol, from 122 mg to 251 mg per 100 g of shrimp, depending on the method of preparation.[7] Shrimp consumption, however, is considered healthy for the circulatory system because the lack of significant levels of saturated fat in shrimp means that the high cholesterol content in shrimp actually improves the ratio of LDL to HDL cholesterol and lowers triglycerides.[8]

এবং আরেকটু এগিয়ে গিয়ে চিংড়ি নিয়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ লেখা পেয়ে গেলাম American Journal of Clinical Nutrition এর একটা প্রবন্ধে। এটা পাঠ করার পর আমার চিংড়ি প্রেম তুঙ্গে উঠে গেল। এখানে পরিষ্কার বলছে চিংড়ি খাওয়া মোটেও মন্দ কাজ নয়। বরং এটি স্বাস্থ্যপক্ষে খুব উপকারী।

ভূনা চিংড়ির প্লেটটা টেবিলে সাজিয়ে কি এখন দেশী ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখানো যায়?

ঠেঙ্গামারা কথন

প্রায় আদিম যুগের কথা। ঠেঙ্গামারা গ্রামের লোকজন তখন মাত্র মোটা ধুতির উপর পিরান পরতে শিখেছে। তার আগে পুরুষকুলের সবাই উদলা গায়ে থাকতো। শীতকালে সেটা কষ্টকর হলেও গরমে আরাম ছিল। শীতকালে বয়স্কদের শিয়রে একটা করে 'আইল্লা' দেয়া হতো। 'আইল্লা' হলো জ্বলন্ত কয়লাপূর্ন পোড়ামাটির ভান্ড, যাকে মোবাইল ফায়ারপ্লেসও বলা যায়। এর সুবিধা হলো যেখানে খুশী সেখানে নিয়ে যাওয়া যায়। এমনকি সাবধানে কাঁথার ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া যায় শীতকালে। অবশ্য কাঁথা পুড়ে যাবার আশংকাও থাকে সেক্ষেত্রে।

বয়স্করা প্রায়ই বলে ঠেঙ্গামারা গ্রাম এক সময় জগতের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী গ্রাম ছিল। কালের বিবর্তনে সমৃদ্ধি ক্ষয়ে গেছে, লোকজন দরিদ্র হয়ে পড়েছে।

ঠেঙ্গামারা গ্রামের মাঝ দিয়ে একটা খাল বয়ে গেছে। সেই খালের উপর গ্রামবাসীর ব্যাপক নির্ভরতা। ওই খালের ব্যবহারের দক্ষতার উপর নির্ভর করে জনগণের সুখ সমৃদ্ধি।

সেই খালের পরে গ্রামবাসীর নির্ভরতা গ্রামের দুই মৌলানার উপর। ঠেঙ্গামারা গ্রামে একটা মসজিদ থাকলেও মৌলানা আছে দুইজন। মৌলানা বাদে বাকী গ্রামবাসী নিরেট মূর্খ। দুই মোল্লাকে নিয়ে গ্রামবাসী একটু বিপদে পড়েছিল প্রথমদিকে। কারণ দুই মোল্লাই চায় মসজিদের ইমাম হতে। কিন্তু এক মসজিদে দুই ইমাম কেমনে হয়? তাই গ্রামবাসী বসে ঠিক করলো একজন ইমাম আরেকজন মুয়াজ্জিন হবে। তবে যেহেতু দুজনই দাবিদার পরের বছর ইমাম চলে যাবে মুয়াজ্জিনের জায়গায় মুয়াজ্জিন এসে বসবে ইমামের জায়গায়।

ব্যবস্থাটা প্রথম প্রথম ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে কিন্তু মুয়াজ্জিনের দেখা নাই। বাধ্য হয়ে ইমাম রাগে গজগজ করতে করতে নিজেই আজান দেয়। আবার কোন কোন সময় মুয়াজ্জিন এত আস্তে আজান দেয় যে কেউ শুনতেই পায় না। ইমাম নামাজ পড়ানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু লোকজন কেউ আসছে না। ইমামকে এরকম ত্যক্ত করতে থাকলো মুয়াজ্জিন।

পরের বছর পালাবদল হলো। মুয়াজ্জিন ইমামের জায়গায় দাঁড়ালো, ইমাম হুজুর মুয়াজ্জিনের জায়গায় আসলো। কিন্তু বদলাবদলির একদিন পরই দেখা গেল মাগরিবের সময় নতুন মুয়াজ্জিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে নতুন ইমাম নিজেই আজান দিয়ে নামাজ পড়াতে লাগলো। দিনের পর দিন এরকম প্রতিশোধ নেয়ানেয়ির খেলায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে দুজনকে গ্রাম থেকে বের করে দেবার চিন্তা করতে লাগলো।

এই খবর কানে আসার পর পর ইমাম মুয়াজ্জিন সেই রাতের মধ্যেই মিলিত হলো গোপন বৈঠকে। বৈঠক শেষে দুজনে মিলে গভীর রাতে খালের উজানে গিয়ে দুটো ছাগল মেরে রক্ত ছড়িয়ে দিয়ে আসলো জলে আর খালের পাড়ে।

পরদিন সকালে গ্রামবাসী খালে হাতমুখ ধুতে গিয়ে আবিষ্কার করলো খালের পানি লালচে হয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। ভয় পেয়ে গ্রামের লোকজন ছুটলো মসজিদে। ইমাম মুয়াজ্জিন দুজনে গম্ভীর হয়ে ঘটনা শুনলো। তারপর ফতোয়া দিল, গ্রামের অমঙ্গল ঘনিয়ে আসার লক্ষণ। মহামারী এগিয়ে আসছে। ওই বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য জনপ্রতি একটা করে মুরগী জবাই করতে হবে এবং কোন দ্বীনি মানুষকে খাওয়াতে হবে।

গ্রামে দ্বীনি মানুষতো দুইজন। ব্যবস্থা হলো প্রতিবেলায় একটা করে মুরগী জবাই করে একবেলা মুয়াজ্জিন আরেকবেলা ইমামকে খাওয়ানো হবে।

উপস্থিত বুদ্ধিতে টিকে গেল দুজনের চাকরী। কিন্তু মুরগী খাওয়াতে গিয়ে গ্রামের মানুষ আধাআধি ভাগ হয়ে গেল। ইমামকে যারা খাইয়েছে তারা ইমামের ভক্ত হয়ে গেল। মুয়াজ্জিনকে যারা খাইয়েছে তারা মুয়াজ্জিন হুজুরকে মান্য করতে লাগলো। এই দুই দলের মধ্যে একবার হাতাহাতিও হলো খালের পানির ব্যবহার নিয়ে।

নিয়ম ছিল যখন কেউ খাবার পানি সংগ্রহ করবে কিংবা হাতমুখ ধোয়ার জন্য নামবে অন্য কেউ মাছ ধরতে নামবে না তখন। কিন্তু ইমাম মুয়াজ্জিনের দুই দলের দ্বন্দ্বে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটতে থাকলো বারবার। ইমাম সমর্থক যখন খাবার পানি আনতে যায়, মুয়াজ্জিনের লোক তখন জাল মেরে খালের পানি নোংরা করে দেয়। ফলে লাগলো বিরাট ক্যাচাল। গ্রামের মানুষ নিজেরা নিজেরা মারামারি হানাহানিতে জড়িয়ে পড়লো। পুরো গ্রামটা অনাচারে ভরে গেল।

গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক অভিজ্ঞ মানুষ তিতা মিয়া। চোখে দেখেন না। কিন্তু কানে ভালো শোনেন। গ্রামবাসী তাঁর কাছে গেল। তিনি সব শুনে পরামর্শ দিলেন এই আজাব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় খালের দুই পাশে দুইটা মসজিদ নির্মাণ করা। এবং দুই মসজিদে দুই ইমামকে নিয়োজিত করা।

তিতা মিয়ার কথা শতে শত সঠিক। গ্রামবাসী ওই পাড়ে আরেকটা মসজিদ বানিয়ে দুই মৌলানাকে দুই মসজিদের ইমাম করে দেবার পর ঠেঙ্গামারা গ্রামে শান্তির নহর বইয়ে গেল সাতদিন।

অতঃপর.............? তাহারা জনম জনম ধরে সুখে কাটাতে লাগল?

না!

কিছুদিন বাদেই ইমাম মুয়াজ্জিন সমর্থকগন পরস্পরের খাওয়ার পানি সংগ্রহস্থলের উল্টোদিকে পায়খানার নালা খুঁড়ে দিল এবং বছরের পর বছর ধরে তাদের ডায়রিয়া মহামারী চলতে থাকবে।
.........................................................................................................................................

এবং আরো বহু যুগ পার হয়ে ঠেঙ্গামারা জনপদের উত্তরপুরুষেরা বাংলাদেশ নামে একটা স্বাধীন দেশ গঠন করবে।

অবশেষে একদিন মানুষ খেলুম

শতবর্ষ পুরোনো অব্যবহৃত দীঘি। ঘন আঁশটে গন্ধী জলজ আগাছার ফাঁকে ফাঁকে শত শত শাপলা ফুটে থাকে এখনো। পরিত্যক্ত দীঘিতে কেউ আসে না জল নিতে বা গা ধুতে। দীঘির পাড় জুড়ে কবরস্থান। হাজার হাজার মৃত মানুষের হাড় ফসফরাস সরবরাহ করছে মাটিতে। শাপলা তুলতে প্রতিদিন দীঘিতে নামে দ্বাদশবর্ষীয় মুকুল।

একেকটা ফুল তুলে সবুজ সাদা পাপড়িগুলো ফেলে এক কামড়ে ফুলের মাথিটা খেয়ে লতাটা গলায় ঝুলিয়ে নেয়। এই ফুল তার খিদে মেটায়। ফুলের নলিগুলো তার মায়ের রান্নায় তরকারির যোগান দেয়। প্রতিদিন শাপলার তরকারী খেয়ে দুবেলা কাটে মা ছেলের।

আজকে দীঘিতে নেমে গভীরে যেতে হলো একটু। যদিও গভীর অগভীর এক সমান এখানে। জলের নীচে লতার ঝাড়ে পা দিয়ে দিয়ে অনেক দূর চলে যেতে পারে সে। কিন্তু আজকে অল্পদূর গিয়েই হঠাৎ পা ফসকে শেকড় লতার গভীরে নেমে গেল মুকুল। পায়ের নীচে কিসের যেন টান। সে দুপায়ে ঝটকা মেরে উঠতে চাইলে আরো জোরে গিট্টু লেগে গেল। টানাটানিতে তার মাথাটা ডুবে গেল জলের নীচে। সে কোনমতেই ঠাঁই পাচ্ছে না অগভীর জলেও। দম আটকে আসছে তার। শাপলার শেকড় লতাগুলোকে হিংস্র মনে হলো। অল্প কিছুক্ষণ টানাটানির পর জলের নীচেই দমটা থেমে গেল তার।

এই দীঘির পাড়ে কেউ আসে না বিবশ দুপুরে। তাই কেউ দেখলো না এই ঘটনার লেশমাত্র। কেবল গত সপ্তাহে কবর হওয়া জমিরের দাদার বুড়ো শরীরটা কবরের বাঁশের বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পায় দীঘির ধোপ সাদা ফুলগুলো একটা কালো চুলের মাথা ঘিরে বেদম হাসছে ফিসফিসিয়ে। সম্মিলিত সুরে মাথা নেড়ে জাতীয় ফুলগুলো যেন বলছে, 'অবশেষে একদিন মানুষ খেলুম'।

তৎবচন

রোজার শুরুতে গরমের ভয়ে অস্থির ছিলাম। কিন্তু আগস্ট মাসে শ্রাবণের যে অংশটুকু ছিল সেটা তুমুল বারিপাতে কানায় কানায় পুষিয়ে দিল জুলাইয়ের তালু-পোড়া গরমের যন্ত্রণা। চট্টগ্রামে স্বস্তির বাতাস। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে উপভোগ্য বৃষ্টির সাথে বাড়তে থাকে রাস্তার ফুটোর সাইজ। এক সপ্তাহ যাবার পর দেখা গেল দানবীয় কন্টেইনার ট্রেলারের বিশ চাকার ধাক্কায় বিশ্বকাপ উপলক্ষে শহরজুড়ে যেনতেন লেপটানো পিচ-মেকআপ উঠে গিয়ে নগ্ন গর্তগুলো ছোট গাড়ীর চাকার জন্য হা করে আছে। মানুষের রোজা হালকা হতে থাকে গালির তুবড়িতে। যদিও সে গালি গিয়ে পৌঁছে না যথাস্থানে।

মেজাজ মর্জি খারাপ করলে হৃদযন্ত্রে নাকি গড়বড় হয়। ডাক্তার বলে দিয়েছে এমন কিছু না করতে যাতে হৃদযন্ত্রে গণ্ডগোল লাগে। মেজাজ খারাপ করার চেয়ে চোখ বুঝে ধ্যান করতে কিংবা দার্শনিক ভাবনা ভাবতে উপদেশ দিল।

কিন্তু রাস্তার গর্ত আর বৃষ্টির নোংরা জল দেখে কতটুকু দার্শনিক হওয়া যায়। তাই চোখ বন্ধ করে হাবিজাবি যা মাথায় আসলো একটার পর একটা লিস্টি ধরে লিখে গেলাম। এর মধ্যে যদি কোনটা আগে কেউ লিখে থাকে সেটা নেহায়েতই আমার মগজের অজ্ঞতা। কপিরাইট লংঘনের দায় নিতে চাই না। দেখা যাক কয়টা টিকে-

১.
ঝড় জলের সাথে যার দৈনিক বৈরিতা, মেঘের সাথে তার প্রণয় হতে পারে না।

২.
জীবিকা অক্ষত থাকলেই রাজনীতির বিতর্ক চলতে পারে। যাদের জীবিকা অনিশ্চিত তাদের কাছে রাজনীতি বা তন্ত্রের গুরুত্ব কচুরিপানার চেয়েও কম।

৩.
দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাবার পরই আদিম মানুষ অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছে। আর আধুনিক মানুষ অন্যের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দেয়ার জন্য অস্ত্র ব্যবহার করে। বিবর্তনের কি নিদারুণ উন্নতি।

৪.
প্রায়শ্চিত্ত থেকেই কি প্রার্থনার সূত্রপাত? সব প্রার্থনায় অপরাধবোধের চিহ্ন কেন?

৫.
ভূগোলের উপর ইতিহাসের নির্ভরতা নেই, কিন্তু ইতিহাসই ভূগোল নির্মাণ করে। মানচিত্র বদলানোর অসভ্য যুদ্ধের ইতিহাসই সভ্য মানুষের ইতিহাস বিবেচিত হয়।

৬.
বনের পাখিকে ভালোবাসার জন্যই খাঁচা-বন্দী করে মানুষ, কিন্তু সেই ভালোবাসা কেবল পরাধীনতাই প্রসব করে।

৭.
স্বাধীনতাই উড়ন্ত পাখিদের সৌন্দর্য, উচ্ছল বন্ধুরাই তার প্রাণ। পাখিদের উড়তে দেয়া মহানুভবতা নয়, ঔদার্য নয়, প্রকৃতির স্বাভাবিক আচার।

৮.
প্রেরণা ছাড়া কোন যাত্রাই সফল হয় না। কিন্তু প্রেরণারও খুঁটির জোর লাগে।

৯.
আনন্দ-ভ্রমণ দ্রুত ফুরিয়ে যায়, আনন্দহীন ভ্রমণ যেন অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে।

১০.
ইতিহাসের ভুল-পাঠ অমার্জনীয় অপরাধ।

আক্কেল সেলামীঃ হীরক রাজার দেশে

১.
একজন অসুস্থ রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। চট্টগ্রামের মেডিক্যাল সেন্টার। রোগীর জ্বর বেশী, গলায় কফ জমে গেছে, গায়ে লাল র‍্যাশ উঠে গেছে। ক্লিনিকে নেবার পর তাকে সরাসরি HDU নামক অতি যত্নশীল একটা চেম্বারে ঢুকিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিল। ওখানে কারো ঢোকা নিষেধ। একদিন পর রোগ আরো বেড়ে যায়। এরপর একের পর এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসে, বোর্ড বসে, নতুন ওষুধ দেয়, তিনদিন এই অবস্থা চলার পর রোগীর শেষ নিঃশ্বাসটা যখন বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে তখন রোগীকে একটা আইসিইউ এম্বুলেন্সে করে সোজা ঢাকার একটা বড় হাসপাতালে নেয়া হয় রাতের মধ্যে। প্রায় শেষ অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া রোগী জীবন ফিরে পায় আবার।

এবং অতপরঃ কোন উপকারে না এসেও মেডিক্যাল সেন্টার তিন দিনে ষাট হাজার টাকা বিল করেছিল রোগীকে সফলতার সাথে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেবার মূল্যস্বরূপ।

২.
প্রতিবেশী বাড়ির নির্মাণ কাজ করছেন। ভদ্রমহিলার স্বামী মারা গেছে বছর দুয়েক আগে। এখন তার শেষ সঞ্চয়টুকু দিয়ে বাড়ীর কাজে হাত দিয়েছেন। কাজ শুরু করার কদিন পর স্থানীয় কিছু মাস্তান এসে চাঁদা দাবী করলো। এত টাকা দিতে পারবে না বলায় বাড়ীর কাজ বন্ধ করে দিল মাস্তানরা। ভদ্রমহিলা পুলিশে খরব দিলেন। থানা থেকে এস আই এসে এদিক সেদিক ঘুরে মাস্তানদের সাথে কথা বলে বিকেলে এসে জানালো তাকে দশ হাজার টাকা দিলে ব্যাপারটা রফা করে দিতে পারে। ভদ্রমহিলা রাজী হলেন না। এটাও তো চাঁদা। এই চাঁদা বরং মাস্তানদের দিলে ওরা উৎপাত করবে না ভবিষ্যতে। পুলিশকে 'না' বলার ফলস্বরূপ পরদিন পুলিশ আসলো ওনাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যেতে। কারণ তিনি মাস্তান-চক্রকে ধরার জন্য পুলিশকে সহযোগিতা করেননি, উল্টো অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছেন। বহুকষ্টে তিনি পুলিশ মাস্তান দুপক্ষকে চাঁদা দিয়ে রক্ষা পেলেন হয়রানি থেকে।

এবং অতপরঃ সন্ত্রাসীরা চাঁদা চেয়েছিল ২০ হাজার। পুলিশে খবর দেয়ার বেয়াদবির মাসুলসহ দিতে হলো ৪০ হাজার, আর ব্যাপারটা সুন্দর করে মিটমাটের জন্য পুলিশকে দিতে হলো ১০ হাজার।

৩.
সরকার পরিবর্তনের পরদিন নতুন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সদলবলে অফিসে ঢুকে অভিবাদন জানিয়ে বললো 'সাপ্লাই নিয়ে ভাবনা, আর না আর না'। এখন থেকে সব রকম সাপ্লাই ওরাই দেবে দেবে। আগের সাপ্লায়ার বাদ। অনেকদিন খাইছে ওরা। 'কোটেশন দেন আগামী বছর নতুন টেন্ডার হবে' জানানো হলে, বলা হলো কোটেশন লাগবে না, আমাদের চেহারাই কোটেশন। প্রতিকারের জন্য স্থানীয় সরকার দলীয় সাংসদের বাসায় ধর্না দিতেই, আড়মোড়া ভেঙ্গে তিনি বললেন, 'দলের ছেলেরা গত পাঁচ বছর অনেক নির্যাতন সহ্য করেছে এবার ওদের কিছু করে খেতে দেন। নইলে কখন কি করে বসে, বুভুক্ষু লোকের জন্য আইন নাই। বোঝেনই তো।'

এবং অতপরঃ ঘাড়ে দুটো মাথা নেই বলে আগের দলকে বাদ দিয়ে নতুন দলকে কাজ দেয়া হলো। আগের দলকে বিদায় করার ফলস্বরূপ বিদায়-বাণী আসে, "বাসায় বউ বাচ্চার খবর নিছেন তো?"

৪.
ব্যবসায়ী বন্ধুর ১১ লাখ টাকা মেরে দিয়েছে প্রভাবশালী পার্টনার সাবেক কাস্টমস ডেপুটি কর্তা। বন্ধু আদালতে গেল। ক্ষতিপূরণ মামলা করলো। উকিল নিয়োগ করলো। মামলা শুরু হলো। আদালত পুলিশকে হুকুম করলো তদন্তের। বন্ধু থানায় গিয়ে দেখলো ভাগ্যের বৃহস্পতি তুঙ্গে। থানার পুলিশের কর্তা ক্লাসমেট। বললো, দোস্ত চিন্তা নাই। আমি এই সপ্তাহেই সার্চ করতে যাবো, তুই কদিন পরে খোঁজ নিয়ে যাস। পরের সপ্তাহে থানায় গিয়ে দেখে আসামী ওসির পাশের চেয়ারে বসে খোশগল্প করছে, চা খাচ্ছে। দোস্তকে দেখে বন্ধু পুলিশ এগিয়ে এসে আড়ালে নিয়ে গেল ওকে। কানে কানে ফিসফিস করে বললো, এরা অনেক প্রভাবশালী, এদের সাথে ভেজাল করে কাজ নেই। তাছাড়া তোর মামলার ভিত্তি নাই। তুই কিছু টাকা নিয়ে আপোষ করে ফেল। নইলে কখন তোকে রাস্তাঘাটে কিছু করে ফেলবে, এর এক ছেলে আবার খুনের মামলার আসামী। বন্ধু পুলিশ দোস্তের চোখে চোখ রেখে তাজ্জব বনে যায়। এই চোখ সেদিনের চোখ নয়।

এবং অতপরঃ কদিন পর জানা গেছে, থানাকে এক লাখ টাকা দিয়ে রিপোর্ট উল্টিয়ে দিয়েছে সাবেক সরকারী কর্তা।

৫.
আমার বন্ধুটা নাছোড়। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে সে আরো উপরের দিকে গেল সূত্র ধরে ধরে, র‍্যাব, আর্মি যেখানে যা পরিচয় আছে সব কাজে লাগিয়ে রিপোর্টের একটা গতি করলো। কিন্তু মামলার নির্ধারিত তারিখে আদালতে হাজির হলে উকিল তাকে এক পাশে নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ঝামেলা না করে আপোষ করে ফেলেন। এই মামলা টিকবে না। ওরা অনেক শক্তিশালী। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে একটা বুদ্ধি দিলাম। উকিলের চোখে সেদিনকার পুলিশ দোস্তের ছায়া দেখতে পেয়ে চমকে গেল বন্ধু। পুলিশ আর উকিল একই সুরে কথা বলছে কেন?

এবং অতপরঃ বিশ হাজার টাকা দিয়ে উকিলকে কিনে নিয়েছিল বিপক্ষ দল। পরের তারিখ থেকে বাদীর উকিল আসামী পক্ষে কোর্টে দাঁড়ানো শুরু করলো।

Saturday, November 5, 2011

ফেরার পথ

ফেরার পথেই সব মনে পড়লো। যাবার সময় আমি স্মৃতিভ্রষ্ট। ফেরার সময় তাই বড় কষ্ট।

Thursday, November 3, 2011

হিমালয় দর্শন - ৪র্থ দিন

"ঘোড়া একটা অতিশয় ভদ্র প্রাণী, অসম্ভব কষ্টসহিষ্ণু একটা প্রাণী, জগতের সকল প্রাণীর তুলনায় দয়ালু" ইত্যাদি বিশেষণ যার উদ্দেশ্যে মনে মনে বিড়বিড় করছিলাম তার চেহারায় বিন্দুমাত্র সন্তুষ্টির চিহ্ন দেখা গেল না।

এই নিজস্ব মন্ত্র উচ্চারণের কারণ ঘোড়াটা যেন পাহাড়ে ওঠার সময় বিগড়ে না যায়।

কিন্তু তার বিমর্ষ চেহারা আমাকে খানিক চিন্তায় ফেলে দিল। বিমর্ষতার কারণ বুঝলাম যখন গাইড ছেলেটা বললো দিনে তিনবার ঘোড়াটা ওই দুরূহ পর্বতের মাথায় চড়ে টুরিষ্ট নিয়ে। ইউরোপীয়ান টুরিষ্টই বেশী। ওদের সাইজ আমার তিনগুন। হয়তো খানিক আগে আড়াইশো পাউন্ডের কোন হোৎকাকে নিয়ে পাহাড়ে চড়ে এসেছে। ইচ্ছে ছিল একটু খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নেমে। কিন্তু সেই সময়ই আমি ওর পিঠে চড়ে বসলাম দেড় মন+ ওজন নিয়ে। বেজার হবার এরকম নানাবিধ কল্পনা মাথায় ঘুরতে থাকলো আর দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকলো। ঘোড়াটা দপ দপ করে পাথুরে পথ পেরিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল আমার আসনটা ধরে শক্ত করে বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না। চারপাশের প্রকৃতি অতীব মনোরম। পাইনের জঙ্গল ভেদ করে ট্রেইলটা পর্বতের উপর উঠে গেছে। আশেপাশে বেশ কটা ছোট ছোট ঝরনাধারা নেমে আসছে পর্বত থেকে কলকল শব্দ নিয়ে। এত গহীন জঙ্গল কিন্তু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে না।

এই ঘোড়ার কোন লাগাম নেই, থাকলেও লাভ হতো না, আমি অশ্বচালনা দূরে থাক জীবনে এই প্রথম একটা ঘোড়ার পিঠে চড়েছি। ঘোড়ার মালিক/পরিচালক বলে দিয়েছিল, শক্ত করে আসনটা ধরে বসতে। সাদা রঙের ঘোড়াটি তার মালিকের মুখের বিচিত্র শিসের ইশারায় চলে।

আমি বাল্যকালে দস্যুবনহুরকে অসংখ্যবার ঘোড়ায় চড়ে দুর্গম পাহাড় বাইতে পড়েছি। আজকে যে পাহাড়টায় উঠতে যাচ্ছি সেটি অতীব দুর্গম চেহারার। দূর থেকে তার কালচে পাথুরে খাড়া চেহারা দেখেই মেরুদন্ড বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করেছিল। যেন আমি ওই পাথুরে পাহাড়ে টিকটিকির মতো বেয়ে উঠবো। আমার সঙ্গীকে কোনমতেই রাজী করাতে পারলাম না ওই পর্বতে উঠতে।

পনেরো মিনিট যাবার পর জঙ্গল শেষ হয়ে গেল। এখানে পাহাড় উন্মুক্ত অনেকটা। পথও বিশেষ সরু। হাতের বায়ে ভয়ানক খাড়াই। দূরে তাকিয়ে অপূর্ব সবুজের সমারোহ দেখে মুগ্ধ হলাম। পারো উপত্যকাটা থিমফুর চেয়েও সুন্দর কোন সন্দেহ নেই। যেদিক উঠছি কলকল করে পাহাড় থেকে ঝরনা নেমে আসছে। ঝরনার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই চারপাশে। সুনসান প্রকৃতি।

রোদ বাড়ছে, গরমে মাথাটা তেতে উঠছে। চলার পথ রুক্ষ হচ্ছে। আধঘন্টা পরই ঘোড়াটা হাঁপাচ্ছে রীতিমতো। আরো দেড়ঘন্টার পথ। এখানেই হাঁপিয়ে গেলে বাকী পথ কেমনে উঠবে? খানিক পর একটা সিমেন্ট বাধানো পানির হাউস দেখা গেল পথের ধারে। ঘোড়াদের পানি খাবার সরকারী ব্যবস্থা। ঘোড়াটা ওখানে দাঁড়িয়ে পানি খাওয়া শুরু করলো। পানি খেয়েও নড়ছে না, দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে আসছিল ঘোড়ার শিস পরিচালক। শিস দিয়ে সে ঘোড়াকে চলতে হুকুম দিল। ঘোড়া মাটিতে পা ঠুকে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলো। তারপর চলতে শুরু করলো।

কিছুদুর ওঠার পর আবারো হাঁপাচ্ছে ঘোড়াটা। এখানে আর গাছপালা নেই। ট্রেইলটা একদম সরু, রুক্ষ পাথুরে, ডানপাশে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে, বামদিকে নেমে গেছে কমসে হাজার ফুট। দূরের পাহাড়গুলো অনেক নীচে। আমার গলা শুকিয়ে গেল এই জায়গায় এসে। সম্ভবতঃ ঘোড়াটিও ক্লান্ত হলো এই জায়গায় এসে। থম করে দাড়িয়ে পড়লো। এই ঘোড়ার একটা বদ স্বভাব হলো সে চলে একদম কিনার ঘেষে। যেখানে এক ইঞ্চি ভুল পা দিলেও পতন অনিবার্য।

আর এখন সে গ্যাট ধরে যেখানে দাড়ালো সেটা চরম বিপজ্জনক একটা জায়গা। এটা একটা ভি আকৃতির বাঁক। আমরা দাঁড়িয়ে সেই ভি এর কোনাটাতে, যেখানে সামনে পেছনে বায়ে সবদিকেই খাড়াই। পাখা থাকলে উড়াল দিতাম সেই মুহূর্তে। কিন্তু তখন নড়তেও ভয় করছে, ঘোড়ার পিঠ থেকে নামা তো অসম্ভব ওই সরু জায়গায়। মাথার উপরে কড়কড়ে সূর্য। ঘামতে ঘামতে আমি ঘোড়ার মেজাজ বোঝার চেষ্টা করছি। কি ব্যাপার নড়ে না কেন ব্যাটা?

অবলা প্রাণীটার মর্জির সুতোয় ঝুলছে আমার জীবন তখন। সে যদি চায় পিঠে হালকা ঝাকুনি দিয়ে আমাকে নীচে ফেলে দিয়ে ঝামেলা দুর করতে পারে। মতলব কি রে তোর? বাংলা ইংরেজী কোন ভাষা বোঝে না ব্যাটা। পেছনে তাকিয়ে দেখি ঘোড়া চালকও কোথায় উধাও। আমি একা। ধ্বক করে উঠলো বুকটা। এই প্রথম আক্ষেপ হলো কেন পায়ে হেঁটে পাহাড়ে চড়লাম না। নবাবী করতে গিয়ে ধরা। লাঠি নিয়ে পাঁয়ে হেটে ওঠা অনেক নিরাপদ ছিল এর চেয়ে। ঘোড়াকে ধমক দিতেও সাহস পাচ্ছি না। ব্যাটা বিগড়ে গেলে আরো মুশকিল। এখন এমন জায়গায় সে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে নীচে নামতে হলে প্যারাস্যুট লাগবে।

মাত্র দুই মিনিট। দুই মিনিটকে মনে হলো দুই ঘন্টা। অবশেষে পেছন থেকে শিস শোনা গেল। তখন ঘোড়া নড়তে শুরু করলো আবার। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

কিছুদূর যাবার পর দেখি তিনচারজন বুড়োবুড়ির একটা দল। ষাট সত্তরের কম হবে না একেকজনের বয়স। ওরা পায়ে হেটে লাঠিতে ভর দিয়ে পর্বত আরোহন করছে। এই বেলা চরম লজ্জা এসে গ্রাস করলো আমাকে। এরা পায়ে হেটে উঠছে আর আমি দামড়া জোয়ান ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ে উঠছি। মনে মনে ধিক্কার দিলাম ঘোড়ায় চড়ার আয়েশী বুদ্ধিটাকে। কাছাকাছি যেতেই বুড়োবুড়ির দল আমাকে দেখে হেসে উঠলো। মুখে বললো 'হাই, হ্যালো'। আমিও হ্যালো বললাম কাষ্ঠহাসিতে। মনে মনে নিশ্চয় বলছে "ব্যাটা রামছাগল ঘোড়ার পৃষ্টে চড়িয়া পাহাড়ে উঠতাছে।"

তাড়াতাড়ি বুড়োবুড়ির দলকে পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম। পথটা যত উপরে যাচ্ছে কঠিনতর হচ্ছে। ঘোড়ার পিঠটা খুব নড়ছে এখন। সোজা বসে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাটা ঝপাত করে বসে পড়লে তো সোজা নীচে। রাস্তা ফুরায় না। আর কতোদুর? গলায় ক্যামেরা ঝুলানো আছে ঠিকই কিন্তু ফটো তুলতে গেলে হাত ছেড়ে দিতে হবে। তাই ছবি তোলা বাদ। এই বদ ঘোড়াটার কোন বিশ্বাস নাই। ঝাঁকুনি দিতে পারে যে কোন মুহুর্তেই। আমার ভ্রমন সঙ্গী রিজওয়ান ভাই আর গাইড উগেন তো নীচে রয়ে গেছে। চারঘন্টার মধ্যে না ফিরলে ওরা আমাকে রেখে হোটেলে চলে যাবে। পরে ড্রাইভার এসে আমাকে নিয়ে যাবে। দ্রুত উঠতে চেষ্টা করছি। মানে ঘোড়াকে মনে মনে বলছি দ্রুত চলতে। কিন্তু সে তার গতিতেই যাচ্ছে।

খানিক পর একটা সমতল চত্ত্বরের মতো একটা জায়গায় এসে ঘোড়া থেমে গেল। পেছনে আসা ঘোড়াচালক জানালো ঘোড়ার দৌড় শেষ। বাকী পথ তোমাকে হেঁটে উঠতে হবে। আশপাশের প্রকৃতি খুবই সুন্দর, কিন্তু ওই ভর দুপুরের গরমে আর পথে ঘোড়ার ধকলের জন্য সৌন্দর্যটা আমাকে তেমন আকৃষ্ট করলো না। তবু ক্যামেরা তাক করে চতুর্দিকের দিগন্তের পর্বতগুলো ক্যামেরার ফ্রেমে আনতে চাইলাম। পছন্দ হচ্ছে না ছবিগুলো। অভিজ্ঞতা থেকে জানি এরকম রোদে ছবি ভালো আসে না। আর এই দিগন্তজোড়া সৌন্দর্য গতকালকের দোচুলার সৌন্দর্যের সাথে তুলনাও করা যায় না। দোচুলা অসাধারণ। উচ্চতায় থাকসানের চেয়ে দোচুলা এগিয়ে। ওটি আগে দেখে আসার ফলে থাকসান এলাকার পর্বত আমাকে তেমন মুগ্ধ করছে না।

বাকী পথ আরো দেড় ঘন্টার। এই জায়গায় একটা রেস্তোঁরা আছে। রেস্তোঁরার পাশে দাড়িয়ে সামনেই দেখা গেল কাংখিত সেই থাকসান মনেষ্ট্রি যা দেখার জন্য হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসে। রেস্তোঁরার ভেতরটা গমগম করছে নানান দেশী টুরিষ্ট। এই নির্জন পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে এসে এখানকার এই কোলাহলটা কেমন বেমানান লাগলো। আমি ঘড়ি দেখলাম বারোটা বাজে। উপরে উঠতে গেলে দেড়টা। ওখান থেকে নীচে নামতে তিন ঘন্টা। মাথার উপর চান্দিপোড়া সূর্য। পুরো পাথুরে এলাকা এটা। সারা ভুটানে এত ঠান্ডা দেখলাম, কিন্তু এখানে সূর্যটা যেন বেশী রকমের তেতে আছে। মোবাইল বেজে উঠলো। নীচ থেকে গাইড ফোন করেছে। বললো, তুমি কোথায়, কতক্ষণ লাগবে নামতে।

বললাম, আমি তো এখনো পুরোটা উঠতেই পারিনি। মাত্র অর্ধেক এলাম।
সে বললো, তোমার সঙ্গী তো ফিরে যেতে চায়। তুমি থাকো নাকি?

আমি উপরে ওঠানামার সময়টা হিসেব করে সিদ্ধান্ত নিলাম, যথেষ্ট হয়েছে, ফেরা যাক এখান থেকেই। মাথার উপরে এরকম হিটার নিয়ে বাকী পথ উঠে দিনটা এখানে কাবার করার কোন মানে হয় না।

উগেনকে তাড়াতাড়ি বললাম, 'আরে না গরমে আমার মাথা ঘুরাচ্ছে এই পর্যন্ত এসে। বাকীপথ উঠতে পারবো না বোধহয়। থাকো তোমরা। এখুনি নেমে আসছি আমি'। ওখানে হাঁটাহাটি করে বেশ কিছু ছবি তুললাম থাকসান মনেষ্ট্রির। তারপর নামতে শুরু করলাম। নামার সময় ঘোড়া নাই। আমি মরে গেলেও ঘোড়ায় চড়ছি না আর এই পথে। একটা হারামী ঘোড়া।

নামতে আর কতক্ষণ লাগবে। ভাবলাম আমি। কিন্তু এখুনি নামছি বললেও নামছি তো নামছি, নামছি তো নামছিই, পথ ফুরায় না যেন। প্রায় এক ঘন্টা নামার পর ঝরনার জায়গাতে আসলাম। ততক্ষণে পায়ের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ। অনেকদিন এরকম হাঁটাহাঁটি করিনি। পা সোজা রাখা দায় হয়ে গেল। হাটু ভেঙ্গে আসছে। বিশ্রাম নিলাম দুয়েকটা জায়গায়। প্রায় ঘন্টা দেড়েক হাঁটার পর গাড়ির কাছে পৌছাতে পারলাম প্রায় বিধ্বস্ত। নামতে নামতেই পায়ের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে, উঠতে হলে না জানি কী দশা হতো।

উগেনকে বললাম, এবার হোটেলে নিয়ে চলো। একটা কঠিন ঠান্ডা শাওয়ার দরকার। নইলে সামনের বরফগলা নদীতে নেমে যাবো। গলা শুকিয়ে শিরিষ কাগজ। পানি খেলাম ঢকঢক করে আধবোতল। গাড়িতে রাখা শীতল জলের পানিও দেখি গরম হয়ে গেছে।

কিন্তু গাড়ী চলতে শুরু করলো আরেক গন্তব্যে। উগেন বললো, পারো জং দেখে যাই চলো। প্রাচীন একটা দুর্গ। আমি বেজার মুখে রাজী হলাম। দু্র্গের কাছে গিয়ে দেখি গেট বন্ধ। দুর্গ দেখা যাবে না। গত ভূমিকম্পে যে ক্ষতি হয়েছে তা মেরামতের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। খুশী হলাম মনে মনে।

ফেরার সময় খিদে পেয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখি হাতের ডানদিকে একটা সাদা কি যেন দেখা যায় আকাশের গায়। দুটো পর্বতের মাঝখানে আরেকটা সাদা পর্বত যেন। উগেনকে বললাম, গাড়ি রুখখো!!!!

অদ্ভুত সুন্দর আরেকটা পর্বত। এটা আমাদের প্ল্যানে ছিল না। যেন অলৌকিক ভাবে হাজির হয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর ছবিটবি তুলে হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। ওই চুড়াটার নাম মনে নেই। তবে ওটাকে কাঞ্চনজংঘার প্রেয়সী বলা হয়। সিকিম তিব্বত আর ভুটান সীমান্তে অবস্থিত সেটি।

হোটেলে পৌছে শাওয়ার নিলাম। তারপর কাপড় বদলে নীচে ডাইনিং টেবিলে গেলাম। হোটেল জিগম্যালিনের রেষ্টুরেন্টটা বেশ গোছানো। কারুকার্যময়। খাবার মেনু বুফে। সাত আটটার মতো আইটেম। ওখান থেকেই খেতে হবে। খাওয়া শেষ করে বেরুলাম আবার। উগেন এবার নিয়ে গেল ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। ওখানে ক্যামেরা গেটে জমা রেখে ঢুকতে হয়। টিকেট কাটতে হলো ৫০ গুলট্রাম করে। ওটাও একটা পাহাড়েরর মাথায়। পারো ভ্যালীটা খুব সুন্দর দেখা যাচ্ছে ওখান থেকে। কিছু সময় পার করে নেমে এলাম। তারপর গেলাম একটা পুরোনো সেতুর কাছে। সেতুটা সুন্দর। নির্জন পাহাড়ের পাশে। এই শহরটা একদম নিরিবিলি। রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই। মোড়ে একটা মজার দৃশ্য দেখলাম। এই মোড়টা এত নির্জন যে এখানে কটা গরু আড্ডা জমিয়েছে রাস্তার উপর। এই প্রথম গরু দেখলাম শহরের কেন্দ্রে। আরেকটু এগিয়ে দুটো ঘোড়াকে দেখলাম রাস্তার পাশে প্রেম করছে। কালো ঘোড়াদুটি দেখে পছন্দ হয়ে গেল, ছবি তুলে ফেললাম। তারপর ব্রীজের উপর উঠে গেলাম। এই ব্রীজের সামান্য দূরে একটা বাড়ি। বিরাট দেয়াল ঘেরা। এটা ভুটানের রাজার পারো শহরের আবাসভবন। আগামী পরশুদিন রাজা এখানে আসবেন বিয়ের দ্বিতীয় অনুষ্ঠান করতে।

ব্রীজ দেখা শেষ করে বললাম, আজকের মতো আর না, পা ব্যাথা হয়ে গেছে আমার। আমার সঙ্গী বললো যাবার সময় মার্কেটে ঘুরে যাই। পারোতে প্রধান সড়ক একটাই। ওটার দুপাশে যা আছে সেগুলোই মার্কেট।

মার্কেটে ঘুরতে ইচ্ছে হলো না। একটা ছোট্ট মুদী দোকানে গিয়ে জুতোর ব্রাশ কিনলাম ৩৫ টাকা দিয়ে। কেডসের চেহারা থাকসানের ধুলোর আড়ালে হারিয়ে গেছে। এটা নিয়ে ভদ্রসমাজে মেলামেশা করা অসম্ভব। গাড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে ধুলো ঝেড়ে ভদ্র হলাম। আমার সঙ্গী কেনাকাটা করছে ঘুরে ঘুরে। আমি একটা দোকানে ঢুকে কয়েকটা সাবান আর এয়ারফ্রেশনার কিনলাম। ভুটানের নিজস্ব প্রোডাক্ট খুব কম, এটি তার একটা। তারপর হোটেলে ফিরে গেলাম। উগেন আমাদের রেখে চলে গেল। বাকী সময় আমাদের নিজস্ব। গাইড ছাড়া আশেপাশে ঘুরবো। সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। রুমে ঢুকে গেলাম যার যার।

হাতমুখ ধুয়ে টিভি ছাড়লাম। ডায়েরী লিখলাম। দিনের কর্মসূচি লিপিবদ্ধ করলাম। কেমন ক্লান্তি সমস্ত শরীরজুড়ে। দুটো বিছানা পাতা আছে। মানুষ আমি একজন। খানিক ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। ডানদিকের বিছানায় ঢুকে গেলাম। উষ্ণ লেপের নীচে। টিভিতে রাজার বিয়ে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। এদের যত জিনিস দেখেছি সবচেয়ে বোরিং বিষয় হলো টিভি। ভুটানের নিজস্ব চ্যানেলগুলো স্রেফ অখাদ্য। এইচবিও খুজে বের করলাম। জেমসবন্ডের একটা মুভি দেখাচ্ছে। আগেই দেখা। দেখতে দেখতে ঘুম এসে গেল। ঘন্টাখানেক ঘুমানোর পর জেগে উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। রাস্তায় কোন লোকজন নেই। মনে হচ্ছে মাঝরাত পেরিয়েছে। আশ্চর্য একটা শহর এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে? কেডস পরে পকেটে পাসপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় হাটবো। একা একা বেরুলাম নির্জন রাস্তাটায়। এরকম সুনসান কোন শহর আমি দেখিনি। মাথার উপর চাদটা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে। শীতটা বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে এখন। দোকানপাট সব বন্ধ। কেবল বারগুলো খোলা আছে। লোকজন পান করতে ব্যস্ত। এই সময় কারো কিছু করার নেই। কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ফিরে এলাম।

হোটেলে ফিরে শুনলাম খাবার তৈরী। বসে গেলাম। রাতের খাবার সারলাম রুটি ভাজি মুরগী ডালভুনা ইত্যাদি দিয়ে। খেয়ে আবার বেরুলাম সঙ্গীসহ। দুজনে এবার গেলাম একেবারে নদীর ধারে। নদীটাও কাছাকাছি দুই ব্লক পরে। নদীর ধারে পুলিশফাড়ি বা থানা। রেলিং ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে পাহাড়ের খাজে খাজে মানুষের ঘরবাড়ি গুলো দেখতে লাগলাম। অন্যরকম একটা শহর। আস্ত একটা গ্রাম কেউ এই শহরে ঢুকিয়ে দিয়েছে যেন। এত সুন্দর গ্রাম আর যেন দেখিনি। নদীর কলকল শব্দ ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। ঝরনাময় নদীর এই শব্দটা এত চমৎকার করে বাজে সারারাত শুনলেও বিরক্তি আসবে না বোধহয়। কুকুরে আনাগোনা মানুষের চেয়ে বেশী মনে হলো। নদীর ধার থেকে এবার শহরের নির্জন রাস্তগুলো দিয়ে হাটা শুরু করি। কালকে রাজার বিয়ে, সবাই দোকান বন্ধ করে বাইরে সাজাচ্ছে। মজাই লাগলো দেখে। রাজা যে পথে যাবে সেই পথগুলো বিশেষ কায়দায় সজ্জিত হচ্ছে।

দশটার আগেই হোটেলে ঢুকে গেলাম। ঘুমোতে হবে আজকে বেশ করে। ভুটানে আমাদের শেষরাত।