Monday, November 14, 2011

নীল পাহাড়ের চেনা গল্প

১.
সাপটা ছোবল দিতে আধসেকেন্ড দেরী করাতেই সাবুর ভোজালির কোপে মরলো। সবুজ লতা সাপটা ঝুলে ছিল ঝাকড়া শ্যাওড়া গাছ থেকে। ঝুলন্ত অবস্থাতেই ছোবল তুলেছিল। ভয়ংকর বিষধর এই সাপ।

সাবুর মেজাজটা তিনদিন থেকে চোতরা পাতার মতো চুলবুল করছে। তিন বাটি নাপ্পি খেয়েও ভুলতে পারছে না নীলা ম্রুর সেই রুদ্রমূর্তি।

নীলা অমন করতে পারে সে কখনো ভাবেনি। নীলাও হয়তো ভাবেনি সাবু অমন কিছু করবে। পুরুষ মানুষকে চেনা দায় বলে ঘেন্না করছে তাকে নিশ্চয়ই। ভেবে সেও নিজেকে ঘেন্না করতে শুরু করে। নীলার সাথে তার রহস্যময় সম্পর্কটিকে সে নিজের করে নিয়েছিল। ওই পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় যখন উঁচু জামগাছটার দিকে চোখ পড়তো তখন সাবু কল্পনায় নীলাকে দেখতে পেত ওই জামগাছটার মধ্যে। গাছটা নীলাদের উঠোনে দাড়িয়ে। যে উঠোনটা নীলা সকাল বিকেল ঝাট দিয়ে তকতকে রাখে। আর মাঝে মাঝে গাছের নীচে দাড়িয়ে নীলা গুনগুন করে উদাসী গান গায়। একদিন শুনে ফেলেছিল সাবু। দৌড়ে পালিয়েছিল নীলা। নীলাকে সেই প্রথম দৌড়াতে দেখে মনে হয়েছিল সে যেন মেঘলা চুলের এক নিটোল কিশোরী। তার তরুনী শরীর ঢাকা পড়ে যায় কিশোরী অবয়বের পেছনে।

নীলারা যে পাহাড়ে থাকে, তার দুটো পাহাড় পরেই সাবুদের পাড়া। সেই পাড়ার নীচটা ঢালু হতে হতে নেমে গেছে নদীর ধারে। নদীটা পেরিয়ে ওপারে জনমানবহীন পাহাড় জঙ্গল শুরু। দৃষ্টি আরো ছড়িয়ে দিলে দূরে দেখা যাবে আকাশের সাথে মিশে গেছে একটা বিশাল নীলচে পাহাড়। ওটাকে সবাই নীল পাহাড় নামেই ডাকে। কেউ কেউ বলছে ওই পাহাড়টা বাংলাদেশের ওই পাড়ে বার্মার সীমানায়। সাবু ছেলেবেলা থেকে স্বপ্ন দেখছে ওই পাহাড়ে যাবার। কিন্তু ওই পাহাড়ে যাওয়াটা অশুভ, ওখানে গেলে কেউ ফেরে না আর - এরকম গুজবের কারণে কেউ ওদিকে যাবার সাহস পায় না। কেবল সাবু একাই সেই পাহাড়ের স্বপ্নে বাস করতো।

২.
বেশ কয়েকমাস আগের কথা।

পাহাড়ে নীচের বাজারে একটা উৎসব হচ্ছিল। সেই উৎসবে আরো শত শত তরুণীর মধ্যে একটা মেয়ের দিকে নজর গেল সাবুর। মেয়েটা ছিল সবার চেয়ে আলাদা। ওর মুখের আদলে কিশোরীর নিষ্পাপতা। দুধে আলতা মেশানো শুভ্র মসৃন ত্বক। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ছোট করে ছাটা। চোখের মধ্যে কি যেন একটা আছে। ওর চোখ, নাকি চুল, নাকি হাসি, কোনটা বেশী সুন্দর ভাবতে গিয়ে একটু বেশী সময়ই বোধহয় তাকিয়ে ছিল সাবু এবং মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ফেললো তাকে। দেখলো এবং চোখ ফেরালো না। কেমন একটা নেশা জাগানিয়া চাউনি ছিল মেয়েটার চোখে। সলজ্জ মুগ্ধতাও।

সাবু একটু থতমত খেল মেয়েটার চাহনীতে। চুরি করে যেন ধরা পড়েছে সেরকম সংকোচে আস্তে সরে পড়লো ওখান থেকে। কিন্তু চেহারাটা ভুলতে পারছে না। মেলার কিছুতেই মন বসে না আর। ফেরার পথেও ভাবছিল মেয়েটার কথা। কে ওই মেয়ে? কোন পাড়া থেকে এসেছে? দলবল ছেড়ে আলাদা হয়ে হাঁটছিল সাবু। তাকে যেতে হবে হেডম্যানের বাড়ি। ডেকেছে বুড়ো কি একটা কাজে। কিছুদূর এগিয়ে দেখলো সেই মেয়েটি খানিকটা সামনে হেঁটে যাচ্ছে। একা। দ্রুত পা চালালো সে, মেয়েটার কাছে পৌঁছাতে হবে। পাশাপাশি যেতেই পায়ের শব্দে ফিরে তাকালো মেয়েটা। সেই ছেলেটা তার পিছু নিয়েছে? এত বড় সাহস! একদম কাছে চলে এসেছে।

-কি নাম তোর?
-নীলা
-বাড়ি কই।
-ওই খানে
-ওটা তো হেডম্যানের বাড়ি
-ওটাই তো আমার ঘর। তুই কে রে?
-আমি সাবু
-কী চাস?
-তোকে চাই
-মাথা ঠিক আছে তোর? আমি কে জানিস?
-জানি, তুই চাঁদের পরী হলেও আমি তোকে চাই
-মর তুই
-মরতে হলেও আমি তোকে চাই
-আমার কাছে দা আছে, এক কোপে কল্লা ফেলে দিব
-ফেলে দে, তবু আমি তোকে চাই
-যা ভাগ। লোকে দেখবে, নিন্দে হবে, ফিরে যা
-না ভাগবো না, হেডম্যানের কাছে কাজ আছে আমার।

জেদী মুখে বললো সাবু। জেদী হলেও বেশ রসিকও। এই মেয়েটি হেডম্যানের মেয়ে বুঝতে পেরেই সরাসরি বলতে পেরেছে এই কথা। আর কারো সাহস হবে না। বুড়ো তাকে খুব পছন্দ করে। বউ মরেছে তার কবছর আগে। শুনেছে কয়েকটা অবিবাহিতা মেয়ে আছে তার। এই মেয়েকে চাইলে না করবে না বুড়ো।

কিন্তু মেয়েটা কেমন তেজের সাথে বললো আবার।

-হেডের কাছে কাজ থাকলে ওখানে যা, কিন্তু আমার পিছু আসবি না খবরদার!
-যাচ্ছি। কিন্তু তোর বাপের কাছে গিয়েও বলবো আমি তোকে চাই
-সে আমার বাপ না!!
-বাপ না?
-না!!
-তবে সে তোর কে??
-আমার স্বামী!!

অকল্পনীয় একটা ধাক্কা খায় সাবু। তার হাত পিছলে কি যেন পড়ে গেল নীচে। ছেলে বেলায় বড়শি বিহীন খেলো ছিপ দিয়ে একটা বিশাল শোলমাছ ধরে ফেলেছিল। ভুলে কিংবা খিদেয় মাছটা ছিপের আগায় লাগানো সুতোর আঠায় কামড়ে ধরেছিল আর একটা হেচকা টান দিয়ে সাবু দেখে একটা আস্ত শোলমাছ ঝুলছে সুতোর মধ্যে। কিন্তু সেই অবাক হয়ে থাকার মুহুর্তটিতেই মাছটা সচেতন হয়ে গেল। সুতো থেকে কামড় ছেড়ে দিতেই আবার পানিতে ঝপাস। প্রায় হাতের মুঠোয় পেয়েও মাছটা হারিয়ে ফেলেছিল সাবু, অনেকদিন পুড়িয়েছে তাকে এটা। কেউ বিশ্বাস করেনি, এত বাচ্চা একটা ছেলের খেলনা ছিপে অতবড় মাছ ধরতে পারে।

আজকেও ঠিক সেই অনুভুতি হলো তার। সাবু জানতো না ষাট বছর বয়সের হেডম্যান আগের বউ মরার পর আরেকটা তরুণীকে বিয়ে করে ঘরে এনেছে। সাবু কিছুদিন দূরের বান্দরবান শহরে কাজ করতে গিয়েছিল। তখনি এসব ঘটেছে।

সাবুকে নির্বাক দেখে খিলখিল করে হাসতে হাসতে নীলা বলে-
- কি রে কথা নাই এখন?
-না রে......মেলা থেকে কিছু কিনলি?
-মরণ, এখন বলে মেলার কথা
-আর কি বলবো
-একটু আগে যা বলতেছিলি
-ভালো লাগছে তোর?
-হুঁ
-আমার সাথে যাবি?
-কোথায়?
-ওই নীল পাহাড়ে
-ওখানে গেলে কেউ ফেরে না
-আমরাও ফিরবো না
-পালাবি?
-পালাবো
-আমাকে নিয়ে?
-তোকে নিয়ে
-আমাকে রাখবি তুই?
-রাখবো
-সারাজীবন?
-সারাজীবন।

৩.
সেই শুরু সাবুর সাথে নীলার রহস্যময় বন্ধুতা। সাবু হেডম্যানের সাহায্যকারী হিসেবে অনেক কাজ করে। আজকাল একটু বেশীই সাহায্য করছে কাজে কর্মে। সময়ে অসময়ে তার বাড়িতে যাতায়াত। নীলা কিন্তু কখনো সামনে আসে না। সাবুর ফেরার সময় হলে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করে। ঝোপের আড়ালে বসে দুজনে কিছু সময় কাটায়। মাঝে মাঝে নদীর কাছেও চলে যায়। সাবুর নিজের একটা ছোট্ট নৌকা আছে। সেটায় গিয়ে বসে। তেমন কিছু না, কেবল হাবিজাবি গল্প আর উড়ে যাবার স্বপ্ন নিয়ে কিছুটা একলা সময়।

সেদিন উড়ে যাবার স্বপ্নের গল্প বলতে বলতে আবিষ্ট হয়ে হঠাৎ সাবু প্রবল আবেগে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ফেলে নীলাকে।

সেটাই সর্বনাশ ডেকে আনে। নীলা ওকে মুখ দিয়ে প্রায় জুতিয়ে দেয় আর কি। পারলে তখুনি হেডম্যানকে ডেকে এনে ছাতু করে দেয় পিটিয়ে। সাবুর ইচ্ছে করছিল মরে যেতে। নীলা ওকে এত ভালোবাসে, তবু এই সামান্য একটা চুমু ওকে এতটা হিংস্র করে তুলবে কখনোই ভাবেনি সে। এরকম সম্পর্কগুলোর সাথে কতো সহজেই শরীর জড়িয়ে যায় আরো গভীরে, সে তো ওইদিকে যায়নি। সামান্য একটা চুমু, তাতেই এত ভয়ংকর? তাহলে কি নীল পাহাড়ের ওই স্বপ্ন গুলো নেহাতই ছেলে ভুলানো খেলা?

ভীষণ রকম অসহায় বোধ করে সাবু। আগামী পূর্নিমার পরদিন সে নীল পাহাড়ে যাবার জন্য নৌকা ঠিক করে রেখেছিল। নীলাও সানন্দে সম্মতি দিয়েছিল। আর কখনো ফিরবে না ওরা। সেই নৌকায় নদীর উজানে গিয়ে অনেক হাঁটাপথ। তারপর নীল পাহাড়। নতুন জায়গায় বসতি। এখন তো সব ভেস্তে গেল! নীলা তার সাথে যাবে না নিশ্চিত। নীল পাহাড়ের স্বপ্ন এরকম মার খাবে কখনো ভাবেনি!

৪.
সবুজ সাপের মাথাটা তখনো নড়ছে। সে লাথি দিয়ে সাপটাকে ফেলে দিল অনেক নীচে। নাহ্ একটা মেয়ের জন্য তার যাত্রা বাতিল করার কোন মানে হয় না। আজকে পূর্নিমা। কালকেই রওনা দিতেই হবে। নীলাকে ভুলতে হলেও পালানো চাই এই জনপদ থেকে।

তার নৌকাটায় রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে। মাঝে মাঝে নদীতে রাত কাটায় সাবু। নৌকাটা একটা নির্জন জায়গায় বাধা থাকে। কেউ আসে না এই দিকটাতে। পরদিন খুব ভোরে দরকারী জিনিসপত্র বেঁধে নিয়ে সাবু বেরিয়ে পড়ে। চারদিকে তখনো কুয়াশা। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ পাহাড়জুড়ে। শীত লাগছে। কান মাথা মুড়ে হাঁটা শুরু করলো সে। দূরে নীলাদের পাহাড়ের একাংশ ঝাপসা মতন দেখা যায়। জামগাছটা বোঝা যায় না এত দূর থেকে। বুকের ভেতর কেমন একটা অচিন ব্যাথা। নীলা তাকে খাদক ভেবেছে। ভুল ধারণাটা ভাঙ্গার কোন সুযোগই পেল না।

কিন্তু নদীর তীরে গিয়ে আরেকটা ধাক্কা। নৌকাটা যেখানে ছিল ওখানে নেই। যে গাছের সাথে বাধা ছিল, সেখানে শুধু দড়িটা ঝুলছে। কেউ নৌকাটা দড়ি কেটে নিয়ে গেছে। পাহাড়ে কখনো চুরি ডাকাতি ছিল না। কিন্তু শান্তি চুক্তির পর থেকে চোর ডাকাতের সংখ্যা বেড়ে গেছে পাহাড়ে। শান্তিবাহিনী ফেরত ছোকরাগুলো ডাকাতি রাহাজানি করে বেড়ায়। সাবু ভেঙ্গে পড়লো প্রায়। তার এত শখের নৌকা কে চুরি করলো? পাহাড়ি না বাঙালী? এদিকে তো বাঙালীরা আসে না।

নদীতে একটা ছলছল শব্দ হচ্ছে কোথাও। কান খাড়া করলো সাবু। দাড় বাইছে কেউ সতর্কভাবে। চোর নিশ্চয়ই পালাতে পারেনি এখনো। ঠিকই। ওই তো দেখা যাচ্ছে নৌকাটা চলে যাচ্ছে। সে ছুটতে শুরু করে তীর ধরে। চীৎকার করে কটু গালি দিল সে নৌকার উদ্দেশ্যে। চীৎকারটা পাহাড়ে কয়েক ধাক্কা খেয়ে নৌকার কাছে পৌছালো। নৌকাটা থামলো। ঘুরছে। আশ্চর্য হলো সাবু। সাহস আছে চোরের। সে কোমর থেকে ভোজালিটা বের করলো। কুয়াশার মধ্যে বোঝা যাচ্ছে না ভেতরে কজন আছে। একাধিক চোর থাকলে ডাকাতে পরিণত হয় তারা।

সাবধানে ভোজালিটা ধরলো সে। নৌকাটা আস্তে করে এসে তীরে ঠেকলো। বৈঠা রেখে উঠে দাড়ালো চোর। সঙ্গীসাথী কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চাদরে মোড়ানো তার আপাদমস্তক।

চোরটা লাফ দিয়ে তীরে নামতেই দেখা গেল, চাদরের আড়ালে নীল পাহাড়ের স্বপ্ন নিয়ে হাসছে নীলা।

কাছে এসে সাবুর হাত ধরে প্রায় ফিসফিস করে বললো, আমাকে ছাড়া নীল পাহাড়ে কিভাবে আবাদ করবি রে পাগল?

No comments: