প্রায় আদিম যুগের কথা। ঠেঙ্গামারা গ্রামের লোকজন তখন মাত্র মোটা ধুতির উপর পিরান পরতে শিখেছে। তার আগে পুরুষকুলের সবাই উদলা গায়ে থাকতো। শীতকালে সেটা কষ্টকর হলেও গরমে আরাম ছিল। শীতকালে বয়স্কদের শিয়রে একটা করে 'আইল্লা' দেয়া হতো। 'আইল্লা' হলো জ্বলন্ত কয়লাপূর্ন পোড়ামাটির ভান্ড, যাকে মোবাইল ফায়ারপ্লেসও বলা যায়। এর সুবিধা হলো যেখানে খুশী সেখানে নিয়ে যাওয়া যায়। এমনকি সাবধানে কাঁথার ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া যায় শীতকালে। অবশ্য কাঁথা পুড়ে যাবার আশংকাও থাকে সেক্ষেত্রে।
বয়স্করা প্রায়ই বলে ঠেঙ্গামারা গ্রাম এক সময় জগতের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী গ্রাম ছিল। কালের বিবর্তনে সমৃদ্ধি ক্ষয়ে গেছে, লোকজন দরিদ্র হয়ে পড়েছে।
ঠেঙ্গামারা গ্রামের মাঝ দিয়ে একটা খাল বয়ে গেছে। সেই খালের উপর গ্রামবাসীর ব্যাপক নির্ভরতা। ওই খালের ব্যবহারের দক্ষতার উপর নির্ভর করে জনগণের সুখ সমৃদ্ধি।
সেই খালের পরে গ্রামবাসীর নির্ভরতা গ্রামের দুই মৌলানার উপর। ঠেঙ্গামারা গ্রামে একটা মসজিদ থাকলেও মৌলানা আছে দুইজন। মৌলানা বাদে বাকী গ্রামবাসী নিরেট মূর্খ। দুই মোল্লাকে নিয়ে গ্রামবাসী একটু বিপদে পড়েছিল প্রথমদিকে। কারণ দুই মোল্লাই চায় মসজিদের ইমাম হতে। কিন্তু এক মসজিদে দুই ইমাম কেমনে হয়? তাই গ্রামবাসী বসে ঠিক করলো একজন ইমাম আরেকজন মুয়াজ্জিন হবে। তবে যেহেতু দুজনই দাবিদার পরের বছর ইমাম চলে যাবে মুয়াজ্জিনের জায়গায় মুয়াজ্জিন এসে বসবে ইমামের জায়গায়।
ব্যবস্থাটা প্রথম প্রথম ভালোই যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে কিন্তু মুয়াজ্জিনের দেখা নাই। বাধ্য হয়ে ইমাম রাগে গজগজ করতে করতে নিজেই আজান দেয়। আবার কোন কোন সময় মুয়াজ্জিন এত আস্তে আজান দেয় যে কেউ শুনতেই পায় না। ইমাম নামাজ পড়ানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু লোকজন কেউ আসছে না। ইমামকে এরকম ত্যক্ত করতে থাকলো মুয়াজ্জিন।
পরের বছর পালাবদল হলো। মুয়াজ্জিন ইমামের জায়গায় দাঁড়ালো, ইমাম হুজুর মুয়াজ্জিনের জায়গায় আসলো। কিন্তু বদলাবদলির একদিন পরই দেখা গেল মাগরিবের সময় নতুন মুয়াজ্জিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে নতুন ইমাম নিজেই আজান দিয়ে নামাজ পড়াতে লাগলো। দিনের পর দিন এরকম প্রতিশোধ নেয়ানেয়ির খেলায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে দুজনকে গ্রাম থেকে বের করে দেবার চিন্তা করতে লাগলো।
এই খবর কানে আসার পর পর ইমাম মুয়াজ্জিন সেই রাতের মধ্যেই মিলিত হলো গোপন বৈঠকে। বৈঠক শেষে দুজনে মিলে গভীর রাতে খালের উজানে গিয়ে দুটো ছাগল মেরে রক্ত ছড়িয়ে দিয়ে আসলো জলে আর খালের পাড়ে।
পরদিন সকালে গ্রামবাসী খালে হাতমুখ ধুতে গিয়ে আবিষ্কার করলো খালের পানি লালচে হয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। ভয় পেয়ে গ্রামের লোকজন ছুটলো মসজিদে। ইমাম মুয়াজ্জিন দুজনে গম্ভীর হয়ে ঘটনা শুনলো। তারপর ফতোয়া দিল, গ্রামের অমঙ্গল ঘনিয়ে আসার লক্ষণ। মহামারী এগিয়ে আসছে। ওই বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য জনপ্রতি একটা করে মুরগী জবাই করতে হবে এবং কোন দ্বীনি মানুষকে খাওয়াতে হবে।
গ্রামে দ্বীনি মানুষতো দুইজন। ব্যবস্থা হলো প্রতিবেলায় একটা করে মুরগী জবাই করে একবেলা মুয়াজ্জিন আরেকবেলা ইমামকে খাওয়ানো হবে।
উপস্থিত বুদ্ধিতে টিকে গেল দুজনের চাকরী। কিন্তু মুরগী খাওয়াতে গিয়ে গ্রামের মানুষ আধাআধি ভাগ হয়ে গেল। ইমামকে যারা খাইয়েছে তারা ইমামের ভক্ত হয়ে গেল। মুয়াজ্জিনকে যারা খাইয়েছে তারা মুয়াজ্জিন হুজুরকে মান্য করতে লাগলো। এই দুই দলের মধ্যে একবার হাতাহাতিও হলো খালের পানির ব্যবহার নিয়ে।
নিয়ম ছিল যখন কেউ খাবার পানি সংগ্রহ করবে কিংবা হাতমুখ ধোয়ার জন্য নামবে অন্য কেউ মাছ ধরতে নামবে না তখন। কিন্তু ইমাম মুয়াজ্জিনের দুই দলের দ্বন্দ্বে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটতে থাকলো বারবার। ইমাম সমর্থক যখন খাবার পানি আনতে যায়, মুয়াজ্জিনের লোক তখন জাল মেরে খালের পানি নোংরা করে দেয়। ফলে লাগলো বিরাট ক্যাচাল। গ্রামের মানুষ নিজেরা নিজেরা মারামারি হানাহানিতে জড়িয়ে পড়লো। পুরো গ্রামটা অনাচারে ভরে গেল।
গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক অভিজ্ঞ মানুষ তিতা মিয়া। চোখে দেখেন না। কিন্তু কানে ভালো শোনেন। গ্রামবাসী তাঁর কাছে গেল। তিনি সব শুনে পরামর্শ দিলেন এই আজাব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় খালের দুই পাশে দুইটা মসজিদ নির্মাণ করা। এবং দুই মসজিদে দুই ইমামকে নিয়োজিত করা।
তিতা মিয়ার কথা শতে শত সঠিক। গ্রামবাসী ওই পাড়ে আরেকটা মসজিদ বানিয়ে দুই মৌলানাকে দুই মসজিদের ইমাম করে দেবার পর ঠেঙ্গামারা গ্রামে শান্তির নহর বইয়ে গেল সাতদিন।
অতঃপর.............? তাহারা জনম জনম ধরে সুখে কাটাতে লাগল?
না!
কিছুদিন বাদেই ইমাম মুয়াজ্জিন সমর্থকগন পরস্পরের খাওয়ার পানি সংগ্রহস্থলের উল্টোদিকে পায়খানার নালা খুঁড়ে দিল এবং বছরের পর বছর ধরে তাদের ডায়রিয়া মহামারী চলতে থাকবে।
.........................................................................................................................................
এবং আরো বহু যুগ পার হয়ে ঠেঙ্গামারা জনপদের উত্তরপুরুষেরা বাংলাদেশ নামে একটা স্বাধীন দেশ গঠন করবে।
No comments:
Post a Comment