হালাল টাকা দিয়ে হজ্জে যাবার জন্য জব্বার আলী তালুকদার তার বেতনের পুরোটাই জমাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরে। কর্পোরেশনের জুনিয়র কেরানী হলেও ঢাকা শহরে তার দুটো বাড়ি আর তিনটা ট্রাক আছে। সংসার চালাতে বেতনের টাকায় হাত না দিলেও চলে। চারজনের পরিবার নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল তার। জীবনের শেষ বেলায় পুণ্যতীর্থ মক্কা নগরীতে গিয়ে হজ্জ করে আসার চিন্তাটা দীর্ঘকাল মগজে স্টোর করা ছিল। টাকা পয়সারও কোন অভাব নাই। কেবল সময়ের অভাব তার। কিন্তু বছর দেড়েক আগে মসজিদের ইমাম সাহেব খোৎবার সময় কঠিন হুংকার দিয়ে জানান দিয়েছিল,"বয়সকালে হজ্জ করতে হবে এবং হজ্জ করতে ১০০% হালাল টাকা লাগবে, নইলে হজ্জ করেও দোজখের দাউ দাউ আগুনে কাবাব হতে হবে"।
কিন্তু তার বাড়ি ট্রাক সব হারাম কিংবা জনগণের টাকা দিয়ে তৈরী। একমাত্র হালাল উপার্জন চাকরীর বেতন। সেই বেতনের টাকাই জমাতে শুরু করেছিলো সে। কিন্তু হজ্জে যাবার পুরো টাকা হাতে আসার আগে তার চাকরীর মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল বলে চিন্তিত জব্বার আলী কোন একটা হালাল উপায়ের জন্য মাওলার কাছে পাঁচবেলা হাত জোর করে কান্নাকাটি করতে থাকে। অবশেষে একদিন মাওলার দিলে রহম হলো।
সৌদি প্রবাসী এক মামাতো শ্যালক তার দেশ-স্থিত পরিবারকে হজ্জে নিয়ে যেতে চায়। জব্বার আলীর কাছে খবর পাঠালো যদি সে শ্যালকের পরিবারের সফরসঙ্গী হয় তাহলে তার সকল খরচ শ্যালকই বহন করবে। শ্যালকের পরিবারে হজ্জযাত্রী তিনজনই মহিলা, এক মামী, দুটো বাচ্চাসমেত মামাতো শ্যালিকা, একটা পুচকা বাচ্চাসমেত শ্যালকের বউ। এতজনের ঝামেলা বহন করার জন্য তাদের সাথে একজন পুরুষ যাওয়া দরকার। জব্বর আলী শরিয়তমতে ঠিক যোগ্য না হলেও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সফরসঙ্গী বিবেচিত হলো বয়স্ক বলে। আনন্দে তাতা-থৈথৈ করে উঠলো জব্বর আলীর উৎকণ্ঠিত হৃদয়। উপরঅলার কাছে তার প্রার্থনা বৃথা যায়নি।
বৃথা না যাওয়ারই কথা! সে তো কোনদিন কারো ক্ষতি করেনি, অন্যের জমি দখল করেনি, গ্রামে গেলে হাত খুলে দান করেছে, গরীব দুঃখীকে সবসময় সুনজরে দেখেছে। জীবনে কারো একটা টাকা মেরে খেয়েছে বলতে পারবে না। সামান্য কিছু যা খেয়েছে তা সরকারের টাকা। সেটা খাবার অধিকার তার আছে। কারণ সরকারের মালিক জনগণ। আর সে তো জনগণেরই একজন। নিজের টাকা নিজের পকেটে বন্দী করেছে। অন্যায় কি করেছে। সেই টাকায় দুটো
বাড়ি তুলেছে, তিনটা ট্রাক কিনেছে, সেই বাড়ির কর পরিশোধ করে সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নে অংশ নিয়েছে। মাওলা তাঁর দিকে তো রহম দেবেই।
যথাসময়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে নির্ধারিত তারিখে এয়ারপোর্ট রওনা দেবার সময় শ্যালকের বউ নায়লা ফোন করলো। দুলাভাই, এয়ারপোর্ট যাবার সময় আমাদের বাসা হয়ে যাবেন, একসাথে যাওয়া যাবে।
গাড়ি ভাড়ার টাকাও বেঁচে যাবে বলে কঞ্জুস জব্বার আলী বিমলানন্দ অনুভব করলো। শ্যালকের মাইক্রোবাস আছে একটা। আরামে যাওয়া যাবে তাতে। একটা সিএনজি ডেকে শ্যালকের বাসায় চলে এলো।
কিন্তু শ্যালকের বাসায় এসেই আক্কেল গুড়ুম। শুনলো ওদের গাড়িটা নষ্ট। গ্যারেজে পড়ে আছে কদিন। জব্বার আলীর সাথে এয়ারপোর্টে যাবার জন্য ৯টা বিরাট ব্যাগ নিয়ে তৈরী ওরা। জব্বার আলীর নিজের তিনটা লাগেজ। মোট বারোটা লাগেজ নিয়ে সিএনজি করে এয়ারপোর্ট যাওয়া অসম্ভব। বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজন। ওরা উপদেশ দিল একটা মাইক্রোবাস ভাড়া করে নিতে। জব্বার আলী নিজে কোনদিন এসব গাড়ি ভাড়া করেনি, সে জানেও না কিভাবে করতে হয়। চিরকাল অন্যের উপর নির্ভর করে চলেছে এসব ব্যাপারে। নিজের খরচে চড়েনি কখনো। মাত্র চারঘন্টা হাতে আছে। রাস্তার জ্যাম পার হতে দুই ঘন্টা যাবে। এয়ারপোর্টে রিপোর্ট করতে বলেছে ৩ ঘন্টা আগে। মাথায় হিজিবিজি লেগে গেল তার। মেয়েমানুষের বুদ্ধি! আগে বলবি না তোদের গাড়ি গ্যারেজে, জব্বার আলীর কাঁধে চড়ে তোদের এয়ারপোর্টে যেতে হবে। তোদের বাপের টাকা দিয়ে এখন গাড়ি ভাড়া করবো? মনে মনে প্রচন্ড বিরক্তি
সহকারে গজগজ করতে থাকে জব্বার আলী। কিন্তু চেহারায় হাসিটা ঝুলিয়ে রাখতেই হলো, কারণ জব্বার আলীর হজ্জ করার পুরো টাকাটাই তো বেঁচে গেছে।
টাকায় বাঘের দুধও মেলে। কলিজায় আঘাত নিয়েও ৩০০০ টাকায় একটা মাইক্রোবাস ঠিক করে ফেললো।
সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর জব্বার আলীর নতুন যন্ত্রণা শুরু হলো।
শ্যালক মতিয়ার মহাধূর্ত লোক। এই হারামজাদা দেশে থাকতে ছিল লুচ্চা। জব্বার আলী ভেবেছিল এত বছর এই পবিত্র নগরীতে বসবাস করেছে তার উপর মাওলার রহম পড়েছে নিশ্চয়ই। সে নাকি খোদ কাবা শরীফের সবচেয়ে সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল একবার। এত ভাগ্যবান। ওখানে ঢুকার সৌভাগ্য হয় সৌদি রাজপরিবারের সদস্য আর উচ্চপদস্থ কর্তাদেরই। কিন্তু মাওলার খাস কামরা ঘুরে এসেও শয়তান তাকে ছাড়েনি। সৌদি আরবে পৌঁছানোর পরপর টের পেল মতিয়ারের সাথে শয়তানের দোস্তিটা আমরণ। রোজ হাশরে তার কি দশা হবে ভেবে জব্বারালীর একটু সান্ত্বনা হলো।
হজ্জের সময় প্রায় এক সপ্তাহ মতিয়ার তাকে বাধ্য করেছে ওই তিন মহিলার মোট বইতে। জীবনে যে কাজটা সে দেশে করেনি, এই হজ্জে এসে সেই কাজটাই বিরসমুখে করে গেল। ঘামতে ঘামতে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় সে ছুটে বেরিয়েছে মহিলাদের পেছনে পেছনে। বিচ্ছু বাচ্চাগুলোকে সামলাতে হয়েছে তাকেই। মতিয়ার তাকে এনেছে এই তিনজনের ফাইফরমাশ খাটতে। সবকিছু সহ্য করে গেছে দুই লাখ টাকা বেঁচেছে বলে।
হজ্জ শেষে জব্বার আলী দিন গুনছে কবে দেশে ফিরে যাবে। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। যাবার আগে একবার সোনার মার্কেট ঘুরে যেতে হবে। মতিয়ার বলেছে সস্তায় সোনার বিস্কুট কিনে দেবে। সে নিজেও মহিলাদের গলায় কেজি খানেক স্বর্ণ ঝুলিয়ে দেশে ফেরত পাঠাবে। জব্বার আলী সাথে করে ৫০০০ ডলার নিয়ে এসেছিল লুকিয়ে। স্বর্ণ কেনার জন্য মতিয়ারের হাতে সবটুকু তুলে দিল। এই টাকায় তিনটা আস্ত বিস্কুট পাওয়া যাবে।
দেশে ফিরে যাবার দিন বিকেলবেলা। সবকিছু গোছগাছ করে এয়ারপোর্ট রওনা দেবার আগে মতিয়ার যার যার গলার স্বর্ণ বুঝিয়ে দিয়ে মতিয়ারের দিকেও একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল। সোনার বিস্কুটটা জব্বার আলী ব্যাগের ভিতর চালান করে দেবার আগে একটু দ্বিধা করলো। এত হালকা লাগে কেন? প্যাকেট খুলে দেখে একটা মাত্র বিস্কুট।
মতিয়ারের দিকে প্রশ্নবোধক চাউনি দিতেই মতিয়ার জবাব দিল, 'দুলাভাই আপনার টাকায় তিনটা বিস্কুটই কেনা হইছিল। কিন্তু নায়লা জানিয়েছে আপনি নাকি হালাল হারাম বিষয়ে খুব সচেতন। আমার টাকার অনেকটা তো হারাম, তা দিয়ে আপনার হজ্জের পবিত্রতা আর সওয়াব নষ্ট করতে চাই না। তাই আপনাকে একটা বিস্কুট দিয়ে বাকী দুই বিস্কুট আপনার হজ্জের খরচ বাবদ কেটে রাখা হলো। আপনার হালাল টাকায়ই হজ্জটা হয়ে যাক। কি বলেন?'
মতিয়ারের কথা শুনে জব্বার আলীর হাত থেকে একমাত্র বিস্কুটটাও খসে পড়লো।
No comments:
Post a Comment