ছবিটার নাম দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই ছবিটা চট্টগ্রামের সেই বিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে যার মহানায়ক সূর্যসেন। এত বছরেও বাংলাদেশ পারেনি সূর্যসেনকে নিয়ে একটা যুতসই ছবি তৈরী করতে, বোম্বে অন্ততঃ বাংলাকে সম্মান দেখিয়েছে ছবিটা তৈরী করে। সেই ভেবে মনে মনে পরিচালক Ashutosh Gowariker এর উপর কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে ছবিটা দেখতে শুরু করি। কিন্তু ছবি যতই এগোতে থাকে কৃতজ্ঞতাবোধ কমতে থাকে আর মুখের ভেতর জমতে থাকে বিবমিষা তরল। মাঝপথ পেরোবার আগে পরিচালকের উদ্দেশ্যে একদলা থুতু তৈরী হয়ে যায় মুখের ভেতর। ওটা বাথরুমে ফেলে এসে কোনমতে ছবির বাকী অংশটা শেষ করি নেহাত ১০০ টাকা খরচ করে কিনেছি বলে। ছবিটার নাম Khelein Hum Jee Jaan Sey।
যদি কারো বিস্তারিত পড়াশোনার সময় না থাকে, ঘটনার উপর বিশদ জ্ঞান লাভের সুযোগ না থাকে, তাহলে ইতিহাস নির্ভর ছবি না বানানোই উচিত তার। নয়তো ইতিহাস বিকৃতিকারী হিসেবে নাম উঠে যাবার সম্ভাবনা থাকে দর্শকের খাতায়। বিকৃতিটুকুও সয়ে নেয়া যেত যদি ছবিটাকে কমার্শিয়াল ছবি হিসবে ঘোষণা করা হতো। কিন্তু পরিচালক সচেতন ভাবে ছবি শুরুর আগেই গম্ভীরতার সাথে জানান দেন, ইহা একটি সত্য ঘটনা, বর্ণিত সকল চরিত্র আর ঘটনা বাস্তব। এই ঘোষণাতেই পাঠকের মনে আলাদা চাহিদা তৈরী হয়ে যায় এবং সেটাই সমস্যা করেছে ইতিহাস জানা পাঠকদের।
পরিচালক হয়তো ছবিটা নেহায়েত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই বানিয়েছে। ধরেই নিয়েছে দর্শক ইতিহাসের অত বিস্তারিত জানবে না, বোম্বের আর দশটা ছবির ফরমেটে কিছু গান, কিছু দলনৃত্য আর খুচরা প্রেম জোর করে সেঁধিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছে।
IMBD তে যখন দেখি "Deprived of playing football by oppressive British, children decide to join a group of freedom fighters" এই বাক্যটা তখন বুঝতে বাকী থাকে না পরিচালক ছবিটাকে কতোটা খেলো করে ফেলেছেন। এই লাইন পড়ে কেউ ভাবতে পারে এটা ফুটবল খেলা সংক্রান্ত কোন একটা গণ্ডগোলের ছবি। যার ফলে ভারতবর্ষে বিদ্রোহ করেছে কিছু বাচ্চালোগ। এটা যে পুরো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা বিষয়ক একটি চলচ্চিত্র সেটা কিছুতেই মাথায় আসবে না।
উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রে প্রেম ছাড়া কোন ছবি তৈরী করা যায় না বলে একটা স্থায়ী ধারণা আছে। সেই ধারণাকে পোক্ত করতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মতো ইতিহাসসমৃদ্ধ ঘটনার মধ্যেই সুচারুরূপে প্রেম ঢুকে গেছে সুক্ষ্ণভাবে। এই ছবিতে প্রধান নারী চরিত্র দুজন। পুরুষ চরিত্র অসংখ্য।
পুরুষ প্রেমহীন থাকতে পারলেও নারীকে কারো না কারো প্রেমে পড়তেই হবে এরকম একটা জিনিসও পরিচালকদের মাথার ভেতরে কাজ করে। ফলে দুই নারীকে যুতসই দুজন বিপ্লবীর সাথে জুড়ে দেয়া হয়। কল্পনা দত্তকে সূর্যসেনের সাথে, প্রীতিলতাকে নির্মল সেনের সাথে।
সূর্যসেনের সাথে প্রীতিলতার সাক্ষাত হয় অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ঘটনার দুবছর পরে ১৯৩২ সালে। কিন্তু ছবিতে দেখা যায় প্রীতিলতা বেণী দুলাতে দুলাতে সখীর হাত ধরে সূর্যসেনের সাথে সাক্ষাত করতে আসে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ঘটনার অনেক আগে। এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সূর্যসেনের সাথে দৈনিক যুক্ত হয়ে যায়। হাসতে হাসতে বিপ্লবীর নাম তালিকাভুক্ত করে প্রীতিলতা সূর্যসেন ওরফে অভিষেক তৃপ্তির চোখে তা দেখতে থাকে, তার বিপ্লব তৈরী হতে থাকে পরিচালকের খেলা ঘরে।
ছবিতে দেখায় রামকৃষ্ণ গহীন জঙ্গলে ট্রেনিং নিতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়(সম্ভবত: নিহত হয়) যেখানে উপস্থিত প্রীতিলতা ও সূর্যসেন সহ অন্য সবাই। কিন্তু ইতিহাস বলে রামকৃষ্ণ বলে এক বিপ্লবী বোমা তৈরী করতে গিয়ে আহত হয় বিস্ফোরণে নগরীর একটা বাসায়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে, পরে ফাঁসি দেয় ১৯৩১ সালে। প্রীতিলতা তখনো বিপ্লবের সাথে যুক্ত হননি, তবু আগ্রহ ছিল প্রবল। রামকৃষ্ণের সাথে জেলখানায় বহুবার দেখা করে। সেই ঘটনা সূর্যসেনের সাথে প্রীতিলতার সাক্ষাতের বছরখানেক আগে।
ছবিতে দেখায় কল্পনা ও প্রীতিলতাকে তার পরিবার কোলকাতায় পাঠিয়ে দেয় বিপ্লবীদের সাথে মাখামাখির কারণে। ওখানে বসে পত্রিকায় পড়ে সূর্যসেন ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট করেছে। অথচ ইতিহাস বলে যখন অস্ত্রাগার লুট হয় তখন প্রীতিলতা মাত্র ইন্টার পাশ করেছে, ঘটনার পরদিন ১৯শে আগস্ট সে সে চট্টগ্রাম আসে। বেথুনে পড়তে যায় আরো কিছুদিন পর।
ছবিতে দেখি প্রীতিলতা কল্পনা দত্তকে নিয়ে কোলকাতা থেকে বিপ্লবীদের জন্য বোমা আর লিফলেট নিয়ে একসাথে ফিরছে। স্টেশনে কল্পনা ধরা পড়ে, প্রীতিলতা নির্বিঘ্নে সরে পড়ে। এরকম কোন ঘটনার কথা ইতিহাস আমাদের বলে না। বরং ইতিহাস বলে কল্পনা দত্ত বেথুন থেকে প্রীতিলতার এক বছর আগেই চট্টগ্রাম কলেজে চলে আসে বদলি হয়ে। প্রীতিলতা বেথুন থেকে বিএ পাশ করে চট্টগ্রাম ফিরে আসে ১৯৩২ সালে। ওই বছর মে মাসের শেষভাগে সূর্যসেনের সাথে দেখা হয় প্রীতিলতার। তার কয়েকমাস পরেই ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করার পর আত্মাহুতি দেয় প্রীতিলতা।
প্রীতিলতার আত্মাহুতি ঘটনায়ও পরিচালক ধূম্র উড়িয়েছেন। প্রীতিলতা দেশের উদ্দেশ্যে প্রাণ উৎসর্গ করেছে বলে ইতিহাস আমাদের জানালেও এখানে দেখা যাচ্ছে প্রীতিলতা তার জানটা শেষ করে দিচ্ছে জানেমান নির্মল সেনের উদ্দেশ্যে। নির্মল সেন তার কিছুদিন আগে ধলঘাটের সংঘর্ষে নিহত হন। ইতিহাস প্রীতিলতার সাথে নির্মল সেনের কোন রকম প্রেমময় সম্পর্কের ইঙ্গিতও দেয় না। কিন্তু পরিচালক গাঁজা খেয়ে ছবিতে প্রেম আবিষ্কার করে বসেছেন।
এরকম প্রচুর ছোটবড় অসংগতি আর ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে তৈরী হয়েছে 'খেলে হাম জি জান সে'। পরিচালক ইতিহাস নিয়ে ভালোই খেলেছেন। খেলাটা মোটেও ভালো লাগেনি। ইতিহাসের সত্যঘটনা অবলম্বনে তৈরী বলে ঘোষিত যে কোন চলচ্চিত্রের কাছে প্রত্যাশা থাকে স্বাভাবিক ঘটনা নির্ভর ছবি। বাণিজ্যিক বুজরুকি নয়।
No comments:
Post a Comment