Monday, November 14, 2011

একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা

একদা এমনই বাদলশেষের রাতে---
মনে হয় যেন শত জনমের আগে---

পৃথিবীটা যে গতিতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তার চেয়েও দ্রুত গতিতে দুটো বাক্য এসে তার চোখের সামনের ল্যাপির পর্দা জুড়ে দাড়ায়। এত রাতে কে মেইল দিল? মেরুণ ফ্রেমের চশমাটা একটু নেড়ে বসালো সে নাকের উপর। প্রেরকের অচেনা নাম দেখেই বুঝলো পথিক পথ হারাইয়াছে। টেলিফোনে ক্রস কানেকশানর মতো ইমেল ক্রসকানেকশান।

নদী ভ্রু কুঁচকে বাক্য দুটোর দিকে তাকিয়ে মেইলটা ডিলিট করার আগে এক সেকেন্ড ভাবলো। এক সেকেন্ডের এক শতাংশের মধ্যে নদী ঘুরে আসে একটা সৌরজগত।

একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ দিল অবারিত করে ||

স্মৃতিকে সম্মান দিতে মাঝরাতে এই বেহুদা চিঠিটা মুছে না দিয়ে পত্রদাতাকে ফিরতি ডাকে অতিশয় ভদ্রস্বরে জানালো যে এই পত্র পথ হারিয়ে ভুলক্রমে তার কাছে চলে এসেছে, তিনি যেন সঠিক রাস্তায় আবার প্রেরণ করেন।

অচেনা পত্রদাতা ধন্যবাদ জানিয়ে যে পত্র লিখেছিল সেখানে একটা বাক্যে মানব মনের একটু হাহাকার মেশানো ছিল। ওই হাহাকারের সাথে নদীর বিদ্যমান বেদনার তানপুরার কোথাও সুর মিলেছিল বলে নদী মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল। তবু ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে পত্রপাঠ বিদায় দেবার জন্য বাক্যটা উপেক্ষা করে জানালো, ধন্যবাদের কোন জবাব হয় না।।

চিঠিতে কোন জবাব চাওয়া হয়নি, তবু পরদিনও চিঠি আসলো একটা। বন্ধুত্বের আহবানের ইঙ্গিত ছিল সেই পত্রে। ওর বান্ধবী লুনার মতে, জগতের সকল পুরুষই কমবেশী লুল। একটা মেয়ের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেলে নানান অজুহাতে তার সাথে স্টিকি হবার চেষ্টা করে।

নদী এই তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, জগতের সকল পুরুষ এক নয় হে।

কিন্তু তৃতীয় পত্রটিতে বন্ধুত্বের আহবান লুনার তত্ত্বকে সমর্থন করায় বিরক্ত হলো নদী। পত্রদাতা লিখেছেন তিনি অতিদূর দেশে বাস করেন। একাকী নিঃসঙ্গ জীবন। নারীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা উঠিয়া গিয়াছে, জীবনে বিবাহ করিবেন না ইত্যাদি। এই বাক্যটি পড়ার পর নদী চুড়ান্ত বিরক্ত হয়।

এই জীবনে তার সাথে পরিচত হওয়া কমপক্ষে তিনজন পুরুষ এই কথা বলেছে, দেখা গেছে প্রত্যেকের মধ্যে একটা একাকীত্বের বেদনা লুকোনো, প্রত্যেকেই নারীজাতির প্রতি উদাস, কেবল তাকেই দেখেছে ব্যতিক্রমী নারী হিসেবে। একসময় এসব শুনে চমৎকৃত হতো সত্যি, কিন্তু আজকাল অসহ্য লাগে এসব ঠুডা উদাসীনতা। কিন্তু বন্ধুতার আহবান উপেক্ষা করা সহজ কাজ নয়। অতটা অভদ্র হতে পারবে না সে। চুপ করে থাকলো, জবাব দেবে না আর।

অচেনা পত্রদাতা আরো একখানা পত্রবান নিক্ষেপ করলেন দুদিন বাদে। এবারের পত্রে কোন হাহাকার নেই, উত্তর না পাওয়ার ক্ষোভও নেই। লিখেছেন তিনি বই পড়তে ভালোবাসেন, গান শুনতে ভালোবাসেন, ছবি তুলতে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন ভ্রমণ করতে।

নদী হাসি চাপতে পারলো না এটা দেখে। লুনা বলেছিল জগতের সকল পুরুষ নাকি এই চারটা শখের কথা তাদের বায়োডাটাতে লিখে। নদী এই পত্রের একটা ফাজলেমি উত্তর লিখলো, "আমি সকাল সকাল ঘুমাতে ভালোবাসি, বই পড়ি না, গান শুনি না, বেড়াতে পছন্দ করি না, ছবি তুলিনি জীবনেও"।

এক লাইনে এতগুলো মিথ্যে লিখতে পারলো সে! প্রতি রাতে ঘুম নেই তার চোখে, সারারাতই গান শোনে, বই পড়ে, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে যায় দূরে কোথাও, ক্যামেরায় ক্লিক তার প্রিয় অভ্যেস।

নদীর ওই একলাইনের উত্তরে পত্রদাতা আবারো বিশাল পৃষ্ঠাভর কাহিনী লিখে পাঠালো। এবার শুরু হয়েছে বিস্তারিত জীবন কাহিনী। নদী আলগোছে চোখ বুলিয়ে ডিলিট বাটনে চাপ দেয়। পরদিন আরেকটা আসে, আরেক কাহিনী নিয়ে। নদী যথারীতি ডিলিট বাটনের সাহায্য নেয় হালকা চোখ বুলিয়ে।

প্রায় তিন সপ্তাহ নদী কোন চিঠির জবাব না দিলেও পত্রদাতা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে চিঠি লিখে যায় প্রতিদিন। নদী মনে মনে গাল পাড়ে- 'ব্যাটা রামছাগল'।

একদিন চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ। নদী হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। পরদিন থেকে নেট খুলে চিঠি মোছার ঝামেলা নেই। কিন্তু তবু নেটে গিয়ে একবার ঘুরে আসে প্রতিরাতে। কোন মেইল নেই। প্রতিদিনের অভ্যেস মেইলটা চেক করা। চিঠি থাক বা না থাক।

তিন চারদিন কোন চিঠি মুছতে না পেরে নদী কেমন একটু অস্থির হয়। রাগও হয় একটু অচেনা পত্রদাতার প্রতি। কি হলো লোকটার? কোন খবর না দিয়ে এরকম গায়েব হয়ে যায় কেউ? গায়েবই যদি হবি তাহলে এত কাহিনী করার কি দরকার ছিল। আমি কি তোর কাছে চিঠি চেয়েছিলাম? মেজাজ চড়তে থাকে দিনে দিনে।

একসপ্তাহ পর নিয়ম ভেঙে নদীই চিঠি লিখে বসে এক লাইনের। "কি ব্যাপার? সাড়া শব্দ নেই কেন? কোথায় আছেন? কেমন আছেন?"

ওমা, পরদিনই চিঠির জবাব এসে হাজির। এক লাইনের জবাবে তিন পৃষ্টার বিরাট কাহিনী। এবার কপাল কুঁচকানোর সাথে দাঁতের দুপাটির আংশিকও দেখা যাচ্ছে নদীর। এত বড় চিঠি লিখতে বলছে কে আপনাকে। যত্তসব! চিঠিটা মুছতে গিয়েও রেখে দিল। ভাবতে বসলো, কারণ কি?

লোকটা না হয় লুল বুঝলাম। কিন্তু আমি কেন লোকটার চিঠির জন্য অস্থির হয়ে আছি? চিঠি মোছার জন্য এত আগ্রহের কারণ কি? বেহায়াটা নির্ঘাত জানে না তার চিঠি আমি মুছতেই পছন্দ করি।

মনকে শক্ত করে কঠিন ঝামা ইট ঘষে একটা উত্তর লিখতে বসলো নদী।

"জনাব, আপনি হয়তো জানেন না, আই'ম টেকেন। আপনি শেষ যে পত্রটি লিখেছেন, তাতে আমি ভীষণ লজ্জিত যে আপনি আমাকে নিঃসঙ্গ বলে ধরে নিয়েছেন। কিন্তু আমি স্বামী সন্তানকে নিয়ে সুখে দিন যাপন করিতেছি। আপনার পত্রের জন্য অশেষ ধন্যাবাদ। দয়া করে আমাকে চিঠি লিখবেন না। চিঠি মুছতে প্রতিদিন লগইন করতে হয়। ভালো থাকুন।"

এত অপমানজনক উচ্চারণের পর আর কোন চিঠি আশা করা যায় না। নদী তাই চেয়েছিল মিথ্যে দিয়ে সাজানো বাক্যগুলো লিখে লোকটাকে নিবৃত করতে। কারণ লোকটা তাকে ক্রমশ গ্রাস করছিল। অসহ্য এটা।

উত্তরে লোকটা কয়েক ডজন অট্টহাসির ইমো দিল এবং চিঠি দেয়া বন্ধ করলো।

যদি একেবারেই কোন জবাব না আসতো, নদীর কোন সমস্যা হয়তো হতো না। কিন্তু অট্টহাসির ইমোগুলো তাকে দিনরাত জ্বালিয়ে মারতে লাগলো। মুছতে গিয়েও মুছতে পারলো না। প্রত্যেকটা ইমো তাকে কিরকম অপমান করছে, অবিশ্বাস করছে, ভাবা যায় না। সেই ভার্চুয়াল ইমোগুলো তাকে পদে পদে হেনস্থা করতে থাকলো। ক্লাসে মন বসে না, বাসায় মন বসে না, বন্ধুদের আড্ডায় যেতে ইচ্ছে করে না। সবখানেই কে যেন তার কানের কাছে গুনগুন করে অট্টহাসি দিচ্ছে।

লোকটা ফোন নাম্বার দিয়েছিল একবার, কেন যেন নাম্বারটা টুকে রেখেছিল তখন। সেদিন আর সহ্য করতে না পেরে চরম কঠিন মেজাজ নিয়ে লোকটাকে ফোন করে বসলো। কোন সুদূরে বসে লোকটা কি করছে কে জানে, যাই করুক, তাকে একটা গালি দিতে চায় নদী। কখনো গলা শোনেনি তার। কিন্তু নদী 'হ্যালো আমি নদী' বলতেই অন্যদিক থেকে মন কেমন করা একটা গলা বলতে শুরু করলো-

সন্ধিলগ্ন ফিরেছে সগৌরবে ;
অধরা আবার ডাকে সুধাসংকেতে,
মদমুকুলিত তারই দেহসৌরভে
অনামা কুসুম অজানায় ওঠে মেতে |
ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি,
অবাধ সাগরে উধাও অগাধ থেকে ;
অমল আকাশে মুকুলিত তার হৃদি
দিব্য শিশিরে তারই স্বেদ অভিষেকে |

দুদিনের প্রস্তুতিতে, রাগের মাথায় যা বলতে চেয়েছিল নদী সব ভুলে যায়, অবশ হয়ে যায় তার শরীর। নিরুপায় আত্মসমর্পন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলে, আমাকে রেহাই দিন নয়তো আশ্রয়....। কাংখিত সেই অচেনা কন্ঠ বলতেই থাকে-

সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে ;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে |

নদী এবার সত্যি সত্যি পরাজিত হলো নতুন পথের সম্ভাবনার কাছে।

No comments: