Monday, November 14, 2011

ডানপিটেমির ছেলেবেলা

কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার পর গ্রামে বেড়াতে যাবার রেওয়াজটা আজকাল উঠে গেছে কিনা জানি না। আমাদের সময় ওটাই ছিল বছরের সেরা রিক্রিয়েশান। প্রাইমারী পেরিয়ে হাইস্কুলে ওঠার পর গ্রামে গেলে মজা করা হতো খুব। শহরে আমার ভাবগুরু ছিল বড় মামার ছেলে তমাল। ক্লাসে আমার এক বছরের বড় হলেও গ্রামে গেলে আমরা বন্ধু। বড় মামা শহরে থাকতেন, মেঝমামা গ্রামে।

তমাল একজন প্রতিষ্ঠিত পড়ুয়া। আমরা যখন মামাবাড়ি গিয়ে গাছের ডালে ডালে উল্লুকের মতো ঝুলতাম, পুকুরে দাপাদাপি করতাম কিংবা কাদায় গড়াগড়ি খেতাম অথবা ডাংগুলি খেলতে খেলতে দুপুর পার করে দিতাম, তখন সে নানার খাটের পাশের টেবিলে মগ্ন হয়ে আছে কোন গল্পের বইতে। ফলে তার সুনাম ছিল গ্রাম জুড়ে। শহর থেকে বেড়াতে গেলে রীতিমত সেলেব্রিটি মর্যাদা পেত। তার এত ভালোত্ব আমাদের খুব হিংসা হতো। সেই ভালোত্ব ঘোচানোর ইচ্ছেতে একবার আমরা আমাদের দস্যিপনাতে ওকেও কিভাবে যেন সামিল করে ফেললাম। বইটই ফেলে সেও হৈ হৈ করে যোগ দিল আমাদের সাথে।

যোগ দেবারও পড়ুয়া কারণ ছিল। ওর বই পড়ার অভিজ্ঞতায় দেখেছে এই বয়সে ডানপিটে ছেলেরা গাছ থেকে ফলমূল চুরি করে। পাড়া দাপিয়ে বেড়ায়। সুতরাং জীবনে একবার ওরকম অভিযানে নামলে দোষ নেই।

গ্রাম্য অভিজ্ঞতা তার সবচেয়ে কম হলেও বয়সে বড় হওয়ায় আমরা ওর নেতৃত্বে অভিযানে বেরিয়ে গেলাম। বাড়ীর পেছনে সামান্য পথ হেটে একটা নির্জন পুকুরপাড়। ওই পুকুরে কেউ গোসল করে না অজ্ঞাতকারণে। গা ছমছম নির্জন জায়গা। ওদিকে কেউ যেত না খুব দরকার না হলে। পুকুরটায় কেবল মাছের চাষ। ওই জায়গাটা তাই চুরি করার জন্য আদর্শ। কিন্তু সব কটা আনাড়ি চোর। কোন গাছ থেকে কি চুরি করতে হবে না বুঝতে পারছে না। যুতসই কোন গাছ মিলছে না। কোন গাছেই ফল নেই।

কেবল গাবগাছে কটা গাব দেখা যাচ্ছে কিন্তু ওটায় চড়া দুঃসাধ্য। পড়লে হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকবে না। সহজ কোন শিকারে খোঁজে আমরা। অভিযানে বেরুবার আগে আমি আরেকটা হাত সাফাই করেছি, নানার খাটের নীচে গুপ্তধনের মতো একটা ছোট্ট ছুরি পেয়েছি যেটাকে ভাঁজ করা যায়। অভিযানে অস্ত্রশস্ত্র থাকলে সাহস লাগে। পুরো বনজঙ্গল ঘেঁটে কোন গাছ পাওয়া যাচ্ছে না বলে সবাই যখন হতাশ, তখন একজন বললো, ওই তো একটা লেবুগাছ, থোকা থোকা লেবু ধরে আছে। লেবুও তো একটা ফল, আয় লেবুই সাফা করি। যেই বলা সেই কাজ, দামাল কিশোরের দল হৈ হৈ করতে করতে লেবুগাছে হামলে পড়লো। মোটামুটি সবার পকেট/কোঁচড় যখন ভর্তি তখন তমাল বললো, হয়েছে এবার ফেরা যাক।

আমরা ফিরে চললাম। ঘরে ঢুকলে তো মাইর চলবে, ডরে আমরা পাশের একটা দেউড়ী ঘরে ঢুকে গিয়ে খিল আটকে দিলাম। একটা চৌকিতে সব লেবু ঢেলে দিলাম। বাপরে.... লেবুর পাহাড় পড়ে গেছে। এত লেবু নিয়ে কি করা যায়? এতক্ষণে মাথায় চিন্তাটা আসলো। লেবুতো পেয়ারা বা আম না, যে কচকচ করে খেয়ে ফেলবো।

মহা মুশকিলে পড়লাম। লেবুচুরি পরিকল্পনায় ছিল না। কিন্তু কিছু একটা চুরি না করলে অভিযান ব্যর্থ হচ্ছিল বলেই চুরিটা করা। এসব ভাবনা আলোচনা যখন চলছিল, তখন সেই পুকুর পাড় থেকে এক প্রাচীন নানীর চিৎকার শোনা গেল, "কোন গোলামের বাচ্চা আমার লেবুগাছ ন্যাড়া করে দিয়েছে, ওরে বদমাশের দল, আমার হাড় জ্বালাইলি, আমি একবার পাই হাড্ডি গুড়া করবো তোদের....."

অনির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য করে বলা হলেও প্রত্যেকটা উচ্চারিত শব্দ আমাদের হাড়ে এসে লাগলো। কারন গলাটা যার, তিনি হলেন পাড়ার সবচেয়ে দজ্জাল বুড়ি। তার ডরে চিল শকুনও তার কোন ফলের গাছে বসে না। আমাদের সব পুচকের চোখ মুখ শুকনো। বুকে হালকা কাঁপন।

এমন সময় দরজায় দমাদম শব্দ।

ওরে বাপ। কে এলো আবার? লুকা লুকা। সব লেবু লুকা, আইজ রক্ষা নাই। কিন্তু তমাল মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললো, তোরা অত চিন্তা করিস কেন। বলবো, আমরা লেবু শহর থেকে কিনে এনেছি। লেবুর মধ্যে কি নাম লেখা আছে? তার বুদ্ধিতে দরজা খুলে দিলাম।

সর্বনাশ!! এটা তো তৈয়ব। যে বুড়ি গালি দিচ্ছে তার নাতি। যদিও সে আমাদের ডাংগুলি বন্ধু, কিন্তু চুরি ধরতে পারলে বন্ধুত্বের বারোটা বাজবে। একদম বমাল হাতে নাতে ধরা। তৈয়ব চৌকির উপর ছড়ানো লেবুর পাহাড় আর দাদীর চিৎকার গালি দুটো মিলিয়ে যা বোঝার বুঝে নিল।

তমাল আসলেই প্রতিভাবান। সে তখন ছুরি দিয়ে নির্বিকার লেবু কাটছিল। তৈয়বকে দেখে বেড়াছেড়া কন্ঠে বললো, "আরে তৈয়ব কেমন আছো? তুমি আসছো.... ভালো হয়েছে, আসলে আমরা লেবু খেতে খুব পছন্দ করি তো তাই শহর থেকে আসার সময় এত্তগুলা লেবু কিনলাম, এখন খেয়ে শেষ করতে পারছি না। আসো তুমিও খাও একটা।"

তৈয়ব বেজার মুখে লেবুটা নিল। চোরকে হাতে নাতে পেয়েও কিছু করতে পারছে না কারণ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে সে এই গ্রামের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছেলে এবং তার বন্ধুও। তমালের বন্ধুত্ব হারাতে হবে চুরির ঘটনা ফাঁস হলে। সুতরাং দাদীর চিৎকারে গা না করে সে বিরস মুখে লেবু খেতে বসে গেল আমাদের সাথে।

ঘটনাটা তৈয়ব বেমালুম চেপে গেলেও রাতের বেলা আরেক চোরের খোঁজ লাগালো মেজমামা বাড়ীতে ফেরার পর। তার দামী ছুরিটা চুরি গেছে, যে চুরি করছে তাকে পাওয়া গেলে কানের পটকা ফাটিয়ে দেয়া হবে বলে ঘোষণা করা হলো।

চিন্তায় পড়লাম। আসলে ছুরিটা প্রথমে চুরি করেছি আমি, কিন্তু আমার কাছ থেকে নিল তমাল, আবার তার কাছ থেকে হাতিয়েছে খালাতো ভাই আজাদ। চোর হিসেবে কাকে ধরা উচিত, কার কানের পটকা ফাটানো হবে সেটা নিয়ে আলোচনা হলো আমাদের। আলোচনা অসমাপ্ত রেখে শুতে গেলাম।

তবে শোবার আগে আজাদ চুপি চুপি ছুরিটা জায়গা মতো রেখে এলো।

পরদিন মেঝ মামার ছেলে বেলাল ওটা খুঁজে পেয়ে খুশীতে বাবার কাছে ছুটে গিয়ে বললো, "বাবা বাবা..... দেখো ছুরিটা পাওয়া গেছে।"
মামা তখন টেরা চোখে বেলালের দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি তখনই বুঝেছিলাম এটা কার কাজ। আয় তোর কানের পটকা ফাটাই এবার......."

বেলালের ত্রাহি চিৎকারে আমাদের সবার মনে কেমন একটা নিষিদ্ধ পুলক লাগলো।

No comments: