Monday, November 14, 2011

উষ্ট্র কোরবানি

কোরবানির গরু নিয়ে দবির ছবিরের প্রতিযোগিতা আজকে নতুন কিছু না। আপনারা গত বছর, তার আগের বছর, কিংবা তার আগের যুগেও দেখেছেন। এটাও সেই পুরোনো ঘটনার নতুন চর্বন। এই ঘটনার দুজনও আমার ব্যক্তিগত পরিচিত।

দবির সাহেব পুলিশ কর্মকর্তা, ছবির সাহেব কাস্টমস কর্তা। দুই জনের আলীশান বাড়ি পাশাপাশি। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে দুই বাড়ির মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় কে কত বড় গরু কিনবে। উৎসাহটা দারোয়ানের মধ্যেই বেশী। কোরবানির সময় বাদে দুই বাড়ির দুই দারোয়ানের অম্লমধুর দোস্তালি। কিন্তু কোরবানির সময় হলেই দুজন দুজনকে ঠারে ঠারে চায়।

পুলিশ বাড়ির দারোয়ান রমজান, কাস্টম বাড়ির দারোয়ান জলিলের চেয়ে এক কাঠি সরেস থাকে। কারণ পুলিশ বাড়ি সবসময় বড় গরু কিনে। বড় গরু কেনার গোপন রহস্য হলো শেষ মুহূর্তে গরু কেনা। ধরা যাক ছবির সাহেব দুইদিন আগে ৫০ হাজার টাকার একটা বলদ কিনে গর্বিত, কিন্তু দবির সাহেব ঈদের আগের রাতে গিয়ে ৭০ হাজার দিয়ে ইয়া বড় একটা ষাঁড় কিনে আনলো। ছবির সাহেবের দীর্ঘদেহী বলদটা দেখতে হাড় জিরজিরে মনে হয়।

গত বছর ছবির সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন এবার দবির সাহেবকে জিততে দেবে না। তিনি বিশেষ লোক দিয়ে বাজার থেকে ইয়া বড় একটা উট কিনে আনালেন কোরবানির তিনদিন আগে। উটের দেখাশোনা করার জন্য আলাদা লোকও আনলেন। লোকজন ভিড় করে উট দেখতে থাকে প্রতিদিন। জলিল গম্ভীর মুখে সবাইকে বলে বেড়ায়, 'আরব দেশের উট'।

রমজান এটা দেখে হিংসায় পুড়ে যায়। এত করে দবির সাহেবকে বললো এবার একটা উট কিনতে, কিন্তু তিনি কিনে আনলেন ১ লাখ টাকার একটা ষাঁড়। কিন্তু যত বড়ই হোক ষাঁড় ষাঁড়ই, উট উটই।

দবির সাহেব বললেন, আসলে ছবির সাহেবের জানোয়ারটা রাজস্থানের মালবাহী উট।

মুখ কালো করে ষাঁড়টাকে দানাপানি খাওয়ায় রমজান। গেট থেকে পারতপক্ষে বের করে রোড শো করে না অন্যন্য বারের মতো। একদিনই কেবল বের করছিল, কিন্তু কেউ জিজ্ঞেসই করলো না ষাঁড়টার দাম কতো। সবাই উটের চারদিকে ব্যস্ত। জীবনে এই প্রথম ওরা লাখ টাকার ষাঁড় দিয়ে কোরবানি করছে, ব্যাপারটা পাড়ার লোককে জানা দেয়া গেল না বলে বেশ মর্মাহত রমজান।

ঈদের দিন সকালে হৈ চৈ করে বিশেষ কায়দায় উট জবাই করা হলো। লোকজন সেই জবাই কান্ড দেখার জন্যও অনেকক্ষণ ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল। দুপুরের দিকে ভিড় কমে গেল। রমজান কাটাকুটি রান্না ইত্যাদি কাজে সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। রান্না বিলিবন্ঠন খানাপিনা সারতে সারতে বিকেল নেমে গেল।

পাঁচটার পরে রমজান গেট থেকে বেরুলো ভয়ে ভয়ে। জলিলের টিটকারি ছুটবে যে কোন সময়। এত বছরের টিটকারির জবাব হজম করতে হবে আজ তাকে দবির সাহেবের নির্বুদ্ধিতার জন্য।

বেরিয়ে দেখে কোথাও কেউ নেই। একটা নেভি সিগারেটে আগুন দিয়ে কাস্টম বাড়ির পশ্চিম কোনায় চলে গেল। এখানে সিগারেট টানা নিরাপদ। কিন্তু ওখানে গিয়ে সে অবাক। গালে হাত দিয়ে বিমর্ষ চেহারায় জলিল বসে আছে। সকালের সেই উৎফুল্লতার লেশমাত্র অবশিষ্ট নাই। রমজান ওকে দেখে পালিয়ে আসতে গিয়েও দাঁড়ালো। কারণ জলিল কোন টিটকারি দিচ্ছে না আজ, কিছু বলছেও না। ব্যাপার কী?

-ঐ কি হইছে রে, মুখ কালা ক্যান?
-কিছু না!
-আরে মুশকিল, সাহেব বকা দিছে নাকি?
-না!!
-এত বড় উট সামলাইতে কষ্ট হইছে?
-নাআআআ!!
-তাইলে কি, এরাম পেঁচার লাহান মুখ করে রাখছস ক্যান? ভরা পেটে মুখ অন্ধকার করে কেউ?
-আর ভরা পেট....
-কেন কি হইছে?
-সেই কোন এগারোটায় তাড়াহুড়া করে মাংস কেটে চুলায় দিয়া আসছি, এখনো পর্যন্ত ডেকচি নামে নাই চুলা থেকে...
-ঘটনা কি, নামে নাই কেন?
-এখনো মাংস সিদ্ধ হয় নাই। বেগম সাহেবা খুব ঝগড়া করলো সায়েবের সাথে। মাথামোটা বলে গালি দিল। এই উটের মাংস সেদ্ধ হইতে নাকি চোদ্দ ঘন্টা লাগবে। রাত বারোটার আগে খাওয়া যাবে না। শালার একটা ইটাও যদি এতক্ষণ চুলায় রাখতাম হালুয়া হইয়া যাইতো। দুপুর থেকে উপাসে আছি। ঈদের দিন অন্য কিছু খাইতে মন চায় বল?

রমজানের বুক থেকে সারাদিনের বিশাল একটা পাথর যেন নেমে গেল। চরম উদারতার বহিঃপ্রকাশে জীবনে প্রথমবারের মতো একটা আস্ত নেভি সিগারেট জলিলের হাতে তুলে দিল ।

No comments: