Tuesday, July 22, 2014

বালিশ

হাদিমের পেটে ভুটভুট আওয়াজ হয়। গুহায় কোন শব্দ নাই, আলো নাই। অন্ধকারে ভুসভুস করে নাক  ডেকে ঘুমায় একপাল মানুষ। হাদিম ঘুমাতে পারে না। গুহামুখে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে আকাশ দেখে। চিকচিক করে অনেক তারা। আজকে চাঁদের থালিটা নাই। মেঘও নাই।

সারাদিন ধকল গেছে। শিকার ধরতে বেগ পেতে হয়েছে অনেক। একটা গণ্ডারের তাড়া খেয়ে গাছে উঠে বেঁচেছে। শেষে বনের এক পাশে গাছতলায় পড়ে থাকা হাবিজাবি ফলমুল খেয়ে পেট ভর্তি করে আসার পথে একটা খরগোশের বাচ্চা চোখে পড়লো। দেখামাত্র দেরী না করে নিখুঁতভাবে পাথর নিক্ষেপ করলো হাদিম। অব্যর্থ লক্ষ্য। চামড়া ছিলে এতটুকুন মাংস মিললো। কিন্তু এটুকুনে কি পেট ভরে? তবু পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর ঝক্কি ঝামেলায় না গিয়ে কাঁচাকাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেললো নাড়িভুড়ি সহ।

সেই থেকে অশান্তির শুরু। পেটটা ঢোল হয়ে আছে। কতক্ষণ গড়াগড়ি খেল সে মাটিতে। তবু ঢোলটা কমে না। কী মুশকিল। দুহাতে পেট চাপড়ালো, খামচি দিল বড় বড় নখে। কোথাও ফুটা করে দিতে পারতো যদি। পায়খানার বেগও আসছে না যে কিছু জায়গা খালি করবে।

হাদিমের মনে হচ্ছে খরগোশটা জীবিত হয়ে পেটের মধ্যে ঢুশ মারছে। হারামজাদা! এত ছোট্ট জিনিসের এত শক্তি কেমনে হয়? অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে হাদিম ভাবতে থাকে কি করলে ঘুম আসবে। হাই উঠছে কিন্তু ঘুম আসে না। চোখ বুজতেই পেটে ঢুশঢাশ শুরু হয়। ভুটভাট শব্দটা মাঝে মাঝে এত জোরে হয় যে কানে এসেও বাজে।

শুয়ে বসে কিছুতে শান্তি নেই। মাঝরাতে সে উঠে বাইরে যায়। কাজটা সারতে পারলে আরাম হতো। একটু দূরে গর্তের পাশে বসে যায় আবার। কিন্তু অনেক কোৎকাত করেও কাজ সারা যায় না। অসমাপ্ত রেখে উঠে পড়ে।

শুনতে পায় দূরে গর্জন করছে হিংস্র প্রাণী। কিন্তু ভয় লাগছে না আজ, পেটের অশান্তিতে ভয়ডর চলে গেছে। আবার গুহায়ও ফিরতে ইচ্ছে করছে না এই অশান্তি নিয়ে। শরীরে কেমন আলস্য ধরে গেছে। হাদিম শুয়ে পড়ে একটা জঙ্গলের পাশে। কিন্তু মাথাটায় যেন আরাম লাগছে না। ব্যথা ব্যথা অনুভব। হাদিম কিছু ঘাস পাতা জড়ো করে মাথায় দিল। তাও হয় না। আরো কিছু লতাপাতা দিয়ে এক মাথা উচু করে মাথা রাখলো। এখন বেশ আরাম লাগছে। ঘুম চলে আসছে তার। পেটের ভুটভাটগুলো গলার ঢেকুর হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। টেরই পেল না কখনো ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ঘুম ভাঙলো একদম সূর্য ওঠার পর। আজ প্রথম গুহার বাইরে রাত কাটালো। বিপদ হতে পারতো। দলের সবাই তিরস্কার করলো হাদিমকে।

কিন্তু হাদিমের শরীর একদম ঝরঝরে হয়ে গেছে। সে ভাবলো রাতে ঘুমোবার সময় মাথার নীচে দেয়া ঘাস লতাপাতার বোঝাটাই পেটের ভুটভাট দূর করে শান্তির ঘুম এনে দিয়েছে। তখন থেকে সে প্রায়ই ঘুমোবার আগে জঙ্গল থেকে ঘাসলতাপাতা ছিড়ে এনে মাথার নীচে দেয়। বাকীরা দেখে দেখে হাসে। ব্যাটা পাগল নাকি। কিন্তু হাদিম পাত্তা দেয় না ওসব।

কিছুদিন পর গুহার আরো একজনের সেরকম ভুটভাট সমস্যা হলো। হাদিম তাকেও ঘুমাবার সময় ঘাসপাতা দিয়ে শুতে বললো। প্রথমে সে অবিশ্বাস করলেও যখন সে ঘাসপাতা দিয়ে শুলো, তার ঘুম এসে গেল। ভুটভাট কমে গেল। তখন বুঝলো জিনিসটা কামেল আছে। তারপর থেকে আস্তে আস্তে পদ্ধতিটা জনপ্রিয় হতে থাকে।

যখন পাড়ার সর্দারের কাছে ঘাসপাতা মাথায় দিয়ে ঘুমানোর উপকারীতার কথাটা পাড়লো একজন, তখন সর্দার একটু ভেবে হুকুম দিল ঘাস পাতা নয়, তার জন্য ভেড়ার চামড়া আর লোম দিয়ে অমন একটা বোঁচকা তৈরী করে দিতে। ওটা মাথায় দিয়ে সর্দার ঘুমাতে শুরু করলো প্রতিদিন।

সর্দারকে ভেড়ার চামড়া ব্যবহার করতে দেখে কিছুদিন পর বাকীরাও ঘাসপাতা বাদ দিয়ে চামড়া ব্যবহার শুরু করলো এই কাজে। এদ্দিন ধরে কোমরে আর মাথায় এক টুকরো চামড়া পরা হতো বিশেষ উৎসবের দিনে নাচানাচি করার জন্য। এখন চামড়ার চাহিদা অনেক বেড়ে গেল বোঁচকা বানাবার কাজে।

ভুটভাট সমস্যা প্রায় সবারই থাকে। কিন্তু সেই সমস্যার চেয়েও বোঁচকার প্রয়োজনটা বাড়লো ঘুমের আরামের জন্য। মাথার নীচে একটা বোঁচকা দিলে ঘুমটা কেমন স্বর্গীয় আনন্দের ব্যাপার হয়ে যায়। এই জিনিসটা আস্তে আস্তে মানুষের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠতে লাগলো এবং একসময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে গেল।

নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কাহিনীটা কি? হ্যাঁ, সেটাই। সেই থেকে চালু হওয়া বোঁচকটা কয়েক হাজার বছর পর বালিশ নামে পরিচিত হলো। আজ বালিশের নাম সবাই জানে কিন্তু হাদিমের নামটা বেমালুম ভুলে গেছে মানুষ।


[পাদটীকাঃ আদিম মানুষদের কোন নাম ছিল না। তবু  আধুনিক যুগের এক মানুষের কাছে 'হাদিম' নামে একজন ধরা দিল কল্পজালে। হাদিমের যুগ দশ হাজার বছরেরও পুরোনো। আধুনিক মানুষের মতে খ্রিষ্ট্রপূর্ব ৭০০০ সালের দিকে মেসোপটমিয়ার মানুষ প্রথম বালিশ ব্যবহার করে। কিন্তু তারো কয়েক হাজার বছর আগেই কোন এক গুহাবাসী হাদিম বালিশের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে সেটা কোন রেকর্ডে নেই। তাই আজ হাদিমকে চেনে না কেউ। হাদিম আজ কল্পলোকের বাসিন্দা হলেও মাঝে মাঝে সে আপনাদের সামনে আসবে তার আদিম আবিষ্কারের আরো বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে। ]

ফতমে ডং গসসো খেনো?

আকাশে মেঘটেঘ দেখলে মনটা একটু উদাস হয়। বাঙালী মনের ধরণটাই এরকম। একটু দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে মেঘ দেখবে, বৃষ্টির গান শুনবে, স্মৃতিচারণ করবে। এই দুঃখবোধ আসলে সত্যিকারের কোন দুঃখ না। সুখী জীবনের কোন একটা অংশ দুঃখের এই প্রকাশ। জীবনকে যারা উপভোগ করে তারাই এই দুঃখ বিলাস করে। সত্যিকারের যন্ত্রণা নিয়ে যারা দিন কাটায় তাদের এই বিলাসীতার অবকাশ একেবারেই নেই। মাঝে মাঝে ভালো সময়ে আমিও এই দুঃখবিলাসে জড়াই। বৃষ্টির ছাঁটের মধ্যে অচেনা কোন স্মৃতির কান্না খুঁজি, খুঁড়ে খুঁড়ে বেদনা বের করি সুখের অতল থেকে। কারণ আমি নিজেও আদি অকৃত্রিম বাঙালী।

আজ সকালের মেঘলা আকাশ, ঝড়ো হাওয়া, জানালার কাঁচে আছড়ে পড়া বৃষ্টি দেখতে দেখতে উদাস হয়ে ভাবছিলাম আজ দিনটা খারাপ না। এখনো কোন দুঃসংবাদ পীড়িত করেনি। ফেসবুকে বন্ধুদের কয়েকটা টোকা দিয়ে চোখে পড়লো একটা মজার লেখা। এটা ইতিমধ্যে অনেকের পড়া হয়েছে ফেসবুকে। আমি তবু কপি করে রাখার লোভটা সংববরন করতে পারলাম না।

চাটগাইয়া প্রেমালাপ

আশিকঃ Hi, খি গত্তেসো?
তানিয়াঃ বাত কাচ্চি।
আশিকঃ ওবাইজ্জাখোদা! লুজা লাকোনি থুমি?...
তানিয়াঃ নাহ।
আশিকঃ খেনো?
তানিয়াঃ আম্মু মানা গসসে। আমার ফরীক্ষা ছলতেসে তো, ফুরাদিন লুজা তাকলে মন দিয়ে ফত্তে ফারবো না। সেজইন্ন সবগুলা লাকতে অবেনা। শুক্কুরবারে লাকতে বলসে।
আশিকঃ আচ্চা... খি দিয়ে বাত কাচ্চো?
তানিয়াঃ ডাইন আত দিয়ে।
হি হি হি...
আশিকঃ আল্লা! আমি মনে গসসি মুক দিয়ে কাচ্চো। হো হো হো...
তানিয়াঃ থুমি বেসি বান্দর অই গেসো। থুমাকে মাইর দিতে অবে।
আশিকঃ দ না! আমি খি থুমাকে দরে লাকসি?
তানিয়াঃ হুমম... বাত কানা শেষ।
আশিকঃ বালো। খালকে খি ফরীক্কা থুমাদের?
তানিয়াঃ ইংলিশ ফতম ফত্র।
আশিকঃ ঠেনসটা বালো গরে ফড়বা। ফুরো ইংলিশ সাবজেক্ট ঠেনসের উফর।ঠেনস যথ বালো ফারবা ইংলেজিত থথ বেশি লম্বর ফাবা।
তানিয়াঃ ওবুক! থুমি তো বৌত কিসু ঝানো!
আশিকঃ হুমম...আমি ইংলিশে অনাস গত্তেসি তো...
তানিয়াঃ ওমারে! থুমি বেশি ফাখাফাখি গরো।
আশিকঃ ফাখাফাখি না গরলে মাইয়া ফঠাতে ফারবো নাথো।
তানিয়াঃ হইসে আর বেড বেড গত্তে অবে না। লুজা তেকে মানুষ এথ খতা খেমনে বলে! মারেম্মা!
আশিকঃ খে বেড বেড গত্তেসে? আমি না থুমি? ফল হন্ডেয়ার!
তানিয়াঃ থুমি ফল!
আশিকঃ তাপ্পর হাবে একন!
তানিয়াঃ থুমি কাবে!
আশিকঃ আমি কাবো না। লুজা তাকসি।
তানিয়াঃ হা হা হা... বান্দর।
আশিকঃ থানিয়া...থুমাকে একটা খতা বলবো।
তানিয়াঃ বলো।
আশিকঃ থুমার সুকগুলো কুব ঠানা ঠানা । আমার মনে খয়, সারাদিন থাকাই তাকি।
তানিয়াঃ যাহ্! আমার শরম লাগতেসে! থুমি লুজা তেকে এগুলো কি সুরু গসসো?
আশিকঃ চ্যরি...আচ্চা একটা খতা বলি?
তানিয়াঃ একন বলসো না একটা!
আশিকঃ হিটা না, আলেকটা।
তানিয়াঃ ও.খে। বলো।
আশিকঃ আমি থুমাকে অনেক বালোবাশি। থুমার মথামথ কি? থুমি খি আমাখে বালোবাশো?
তানিয়াঃ আমার খাজ আসে। কুদা হাফেজ। ফরে কতা হবে। বাই।
আশিকঃ আমার ফশ্নের উত্তর দি যাও!
তানিয়াঃ খিসের ফশ্ন?আমি খিসু শুনি নাই। ফরে কতা অবে, বাই।
আশিকঃ ফরে আর কথা অবে না। আমি আজখে তেকে আমার পেসবুকের একাউন্ট ডিট্টেবেট গরে দিব।
তানিয়াঃ দাওগা। আমাখে বলতেসো খেনো?
আশিকঃ আচ্চা, বাই। বালো তেকো। কুদাফেজ।
তানিয়াঃ এই শুনো! এথ ফাট দেকাও কেন?
আশিকঃ খে দেকাসসেদে ফাট? আমি না থুমি?
তানিয়াঃ থুমি একটু বেশি মাতো। খতা খম বলবে।
আশিকঃ হুমম... আমি আর খতাই বলবো না। থুমি খি আমার ফশ্নের উত্তরটা দিবে?
তানিয়াঃ হুমম...
আশিকঃ হুমম... খি? হ্যাঁ নাখি না?
তানিয়াঃ হ্যাঁ... আমিও থুমাকে বালুবাশি।
আশিকঃ থুমিও বাজী... এত লং গত্তে জানো যে!
ফতমে ডং গসসো খেনো?

......................................................................................................

হাসির গল্প কি? হাসতে হাসতে তবু চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছি কেন।

Thursday, July 10, 2014

দুটো স্মৃতি এবং একটি সম্পর্কহীন গল্প


লাইব্রেরী ভ্রমণ

বহুদিন ধরে যাবো ভাবছিলাম। শেষবার গিয়েছি দুই দশক আগে। এমরানই নিয়ে গিয়েছিল। প্রাচীন একটা দালান। আবছা অন্ধকার ধোঁয়াশা ঢাকা একটা ঘর। টিমটিমে আলো জ্বলছে সিলিং থেকে। লম্বা টেবিল ঘরের মাঝখানে। সারিবদ্ধ চেয়ার। সারি সারি বইয়ের তাক দেয়াল জুড়ে।

ঘরজুড়ে অতি প্রাচীন একটা গন্ধ। যেন টাইম মেশিনে চড়ে হঠাৎ করে উনিশ শতকে চলে এসেছি। ঐ তো ওদিকে বঙ্কিম, রামমোহন, বিদ্যাসাগর। তার পাশেই তরুণ রবীন্দ্রনাথ কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নজরুল হামাগুড়ি দিচ্ছে ধুলোমাখা উঠোনে। জীবনানন্দ আচড় কাটছে মেঝেতে। এরা সব আমার চেনা।

আমি একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম। মোটা একটা জার্নালে বুঁদ হয়ে গেলাম। এই তো এদের খুঁজছিলাম আমি এতকাল। সেই শেষ। দুই দশক ওমুখো হইনি। সময় পাইনি।

সেদিন আবারো ঝোঁক চেপে গেল। অফিসে ফাঁক বের করে আবারো ছুটলাম। ভেতরে ঢুকলাম। দুপুর একটা বাজে। নীরব নিস্তব্ধ পুরো দালান। একটা দরোজা খোলা। আমি আলগোছে ঢুকলাম। কেউ নেই। দিনের আলো যথেষ্ট ঢোকেনি। ঘুপঘুপ করছে অন্ধকার। চেয়ার টেবিল সব আগের মতন, আরো পুরোনো হয়েছে ২০ বছরে। একটাও মানুষ নেই।

না আছে। পেছন থেকে একজন কথা বলে উঠলো।
-কী চাই?

চমকে উঠে জবাব দিলাম,
-ইয়ে, পুরোনো কিছু বই পত্রিকা চাই।

-বই আছে পত্রিকা নাই।
-পত্রিকা কোথায়
-পত্রিকা সের দরে বিক্রি হয়ে গেছে।
-বইগুলো দেখতে চাই
-আপনি অসময়ে এসেছেন। এই লাইব্রেরী খুলবে দেড়টায়। বন্ধ হবে পাঁচটায়। আপনি এখন বাইরে যান।

আবছা আঁধারে মানুষটার দিকে দেখলাম ভালো করে। অসন্তুষ্ট চেহারা। বইপত্রের চেয়ে নিয়ম মানার দিকে আগ্রহ বেশী। বেরিয়ে এলাম। পুরোনো হতাশা এসে গ্রাস করলো। আমাদের লাইব্রেরীগুলো কেন যেন পড়াবান্ধব না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী নিয়েও একই হতাশা ছিল।

মলিনতম অবহেলিত সেই প্রাচীন লাইব্রেরীটার নাম চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশান লাইব্রেরী।


হারানো বন্ধু

রাঙ্গুনিয়া পেরিয়ে আরো বেশ কিছুদূর যাবার পর আমাদের বাসটা থামালো সরকারী বাহিনী। এক বিডিআর জওয়ান গাড়িতে উঠে কিছু একটা খুঁজছে।

আমরা তিনজন। দুজন জেগে আছি, মাঝখানের জন ঝিমাচ্ছে। বিডিআর আঙুল তুললো তার দিকে।

বললো, ওনাকে নেমে যেতে হবে। ...
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কেন, সমস্যা কি?
বিডিআর জওয়ান বললো, পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন বিদেশী নাগরিক নিষিদ্ধ।

আমরা তাকালাম আমাদের লালগোঁফের বন্ধুটার দিকে।
ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে তুলে বললাম, "ঐ বেডা তোরে ত নামি যন ফড়িবু। তোর বাড়ি হন্ডে, রাশিয়া না?"

সে ধড়মড় করে জেগে উঠে বললো -"ধুর বেডা মশকারি নচুদাইস"।

বিডিআর জওয়ান ওর ভাষা শুনে চোখ কপালে তুলে সুরসুর করে নেমে গেল। গাড়ি আবারো চলতে শুরু করলো।

সেই বন্ধুটির নাম হোসেন শহীদ। সে আজো দুনিয়াতে আছে একই শহরে আছে, কিন্তু আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে অজ্ঞাত কারণে।


মহাচোর

দেশের উজির অনেক উচ্চ বংশীয় লোক। সমাজে সম্মানিত। অর্থে প্রতিষ্ঠিত। ক্ষমতায় দম্ভিত। শুধু একটি অতি গোপনীয় সমস্যা তার। উজির ভদ্রলোক সপ্তাহে একদিন চুরি করেন। চুরি করেন রাজকোষ থেকে। রাজা প্রতি রোববার শিকারে বেরোন, তখন তিনি চুরির কাজ সারেন। চুরির কথা রাজকোষ প্রহরী ছাড়া আর কেউ জানে না। প্রহরীকে বলে দিয়েছেন কাউকে জানালে চাকরী তো যাবেই, সাথে জানও। প্রহরী নিশ্চুপ।

একদিন ভদ্রলোকের নিজের ঘরে চোর ঢুকলো। চোর চুরি করে পালাবার আগেই ধরা পড়ে গেল। প্রকাশ্য রাজ দরবারের বিচারে সাজা হলো শূলে চড়ানো। শূলে চড়ার আগে চোর একবার রাজার সাথে দেখা করতে চাইল। রাজা অনুমতি দিল। চোর তার কোচড় থেকে একটি স্বর্ণমুদ্রা বের করে রাজার সামনে ধরলো।

রাজা বললো, "এ কী!!! এ তো রাজকোষের স্বর্ণ!!!!"
চোর বললো, "মহারাজ একটি স্বর্ণমুদ্রা চুরির সাজায় যদি শূলে চড়তে হয়, পুরো রাজকোষ চুরির সাজা কি?"

[বাংলাদেশেও বড় বাটপার ছোট বাটপারকে শাস্তি দিতে পারদর্শী যদি না তার রাজনৈতিক যোগাযোগ মজবুত থাকে]

=======================================================



Tuesday, July 8, 2014

যে চিঠি রাষ্ট্রনায়ক কখনো পড়বেন না

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

একজন সাধারণ নাগরিকের সমস্যার কথা আপনার কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনা শতকরা ১ শতাংশের কম জেনেই আমি লিখছি। চিঠিটা যদি কোন সুত্র বা শাখা প্রশাখায় ভর করে আপনার কাছে পৌঁছে যায় একদিন!

আপনি বলতে পারেন এই সমস্যার কথা কেন আমি স্থানীয়ভাবে সমাধান করছি না। বাংলাদেশে অনেক সমস্যা স্থানীয়ভাবে অবহেলিত হয় অথবা স্থানীয় প্রশাসনের স্বার্থবিরোধী হবার কারণে সমাধান হয় না।

আমি বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানী প্রক্রিয়া করণ অঞ্চল চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে লিখছি। দশ বছর আগেও এই ইপিজেডের অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। পনের বছর আগে এই ইপিজেড সত্যি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিশ্রুতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই ইপিজেড গত পাঁচ ছয় বছর ধরে জঘন্য অবস্থায় আছে। আমি মাত্র চারটি সমস্যার কথা লিখবো আজ-

১. ইপিজেডের কুরুক্ষেত্র প্রবেশমুখ
একটা সময় ইপিজেডে গাড়ি ঢুকতে এমনকি ব্রেক কষারও দরকার হতো না। এতই মসৃন ছিল রাস্তা ঘাট প্রবেশপথ। ঢোকার পথ, বেরোবার পথ দুটো পথই ছিল মসৃন সুন্দর সুশৃংখল। এখন ইপিজেডে ঢোকা এবং বের হওয়া একটা দুঃস্বপ্ন বিশেষ। ইপিজেডের প্রবেশমুখে বসানো হয়েছে একটি কন্টেইনার ডিপো। সেই ডিপোর শত শত ট্রাক, ট্রেলার আসা যাওয়া করে রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি করে, রাস্তাগুলো গর্ত হয়ে গেছে,  রাস্তার দুই তৃতীয়াংশ জায়গা ট্রাক পার্কিং হয়ে গেছে। ফলে এখানে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ও শত শত গাড়ি ঢুকা ও বের হবার জন্য লড়াই করে। শুনে অবাক হবেন, শুধু গেট অতিক্রম করতে একেকটি গাড়ির কমপক্ষে আধঘন্টা সময় লাগে।

আপনি এসব কিছুই দেখেন না, কেননা আপনি সকাল সাতটায় কোনদিন ইপিজেডে আসেননি। আর আপনার আসার আগেই রাস্তাঘাট পবিত্র করার কর্মসূচি চলে। বাংলাদেশের কোন সরকার দেশের বিশ্রী চেহারা দেখার সুযোগ পান না এই পবিত্র কর্মসূচির বলে।

২. ইপিজেডে ঢোকার অপ্রয়োজনীয় সিংহ দরোজা
আপনি জেনে অবাক হতে পারেন ইপিজেডে দুটো সিংহ দরোজা বানানো হয়েছিল কোন এক উর্বর মস্তিষ্কের পরামর্শে। যদিও আরো চারটি গেট আগে থেকেই আছে। তবু সেই ব্যয়বহুল সিংহ দরোজা বানানো হয়েছিল। সেই দরোজা দুটির একটি দিয়ে ঢোকা অন্যটি দিয়ে বের হবার পথ। গাড়ি ঢুকার জন্য দুটো ফোকড় রাখা হলেও মানুষ হাঁটার জন্য রাখা হয়েছে তিনফুটের একটা ফোকড়। সেই ফোকড় দিয়ে একজনের বেশী ঢুকতে পারে না। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রোত ওখানে আটকা পড়ে এবং বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা গাড়ির রাস্তা দখল করে হাঁটতে থাকে। এতে শতশত গাড়ির জট লেগে যায় মুহুর্তেই। সেই জট বিমানবন্দর সড়ক পর্যন্ত পৌঁছায় এবং সেই সড়কের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে নরক কাণ্ড চলে।

আপনাকে হয়তো বলা হবে গেট দুটো নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে যাতে অবৈধভাবে কেউ মালামাল চুরি করে নিয়ে যেতে না পারে। বলে রাখি, ইপিজেডে যারা চুরি করে তারা পুকুর চুরিই করে। পুরো ট্রাক ভর্তি করে গেটে টাকা দিয়ে মালামাল হাপিস করে দেয়। এই চুরির সাথে গেটের সব রকমের কর্মকর্তা জড়িত।

৩. ইপিজেডের অনাকাংখিত জলাবদ্ধতা
গত বিশ ত্রিশ বছরের ইতিহাসে ইপিজেডে বৃষ্টির পানিতে বন্যা হবার নজির গত চার পাঁচ বছরেই দেখা গেছে। এর আগে কোনদিন চিন্তাই করা যেতো না এখানে বন্যা হতে পারে। ইপিজেডে বন্যা হবার কয়েকটা কারণের অন্যতম হলো, পানির চলাচলের রাস্তাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে ইপিজেড থেকে অনুমোদিত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। গেটের মধ্যে কন্টেনার ডিপো এবং পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ জায়গার একটা ফ্যাক্টরী এই জলাবদ্ধতার জন্য অন্যতম দায়ী। এই হলো ইপিজেডের মূল প্রবেশপথের জলাবদ্ধতা। এছাড়া ইপিজেডের খালে বাধ দিয়ে একটি পানি শোধনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ওরা ইপিজেড থেকে বের হওয়া পানিগুলো আটকে রাখার ফলে বৃষ্টি হওয়ামাত্র খালটি উপচে রাস্তায় পানি উঠে যায়। সেই পানি আমাদের ফ্যাক্টরীর আঙিনাকেও প্লাবিত করে।

আপনাকে এই বন্যা কখনো দেখতে হয়নি কেননা আপনি এসব কুক্ষণে ইপিজেড সফরে বের হন না। আপনাকে এসব সমস্যার কথা কখনো বলা হয় না। সব কিছু ঠিক আছে, সবদিকে মসৃন সৌন্দর্যশুধুই উন্নয়ন আর অগ্রগতি। আপনাকে এই বলে ভুলিয়ে রাখা হয়। অথচ আপনি জানতেও পারেন না আইল্যাণ্ডের যে পাশে আপনি যাবেন শুধু সেই পাশে চুনকাম করা আছে, বাকী পাশটা খালি।


৪. ইপিজেডের প্রধান সড়কের আবর্জনার ভাগাড়
ইপিজেডের সামনে বিমানবন্দর সড়ক। সকল এয়ারপোর্ট যাত্রী এবং ইপিজেডের শ্রমিককর্মী এই পথ দিয়ে যাতায়াত করে। সকালবেলা একটা ভয়াবহ বিশ্রী একটা দৃশ্য দেখতে হয় প্রতিদিন। সড়কের পাশে একটা কাঁচাবাজারের আড়ত। সেই আড়ত ফুটপাতের পুরোটা দখল করে নিয়েছে। ফুটপাতের পাশে রাস্তার অর্ধেক জুড়ে ময়লা আবর্জনার স্তুপ। গলিত পচিত আবর্জনারা সমস্ত রাস্তাময় এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে গাড়ি ছাড়া কোন মানুষ হেঁটে পার হবার উপায় নেই। আপনি যদি এসি গাড়িতে চোখ বন্ধ করে থাকেন তাহলে এই বিভৎসতা আপনাকে স্পর্শ করবে না। নগরকর্তারা হয়তো তাই করে থাকেন তাই এই দৃশ্যগুলো সমাধান হয় না। এই আবর্জনা আর আড়ত একই সুত্রে বাঁধা। এখন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে মানুষ চলাচলের পথে আড়ত আর আবর্জনার পর্বত জেগে থাকবে কিনা। লজ্জিত হয়ে ভাবি এই রোডকে ভিআইপি রোডও বলা হয় মাঝে মাঝে।

আপনি এই দৃশ্য কখনো দেখেন না কেননা আপনি আসার আগে ময়লা আবর্জনা ডাস্টবিন সব সরে যায়। আপনার ভিভিআইপি গাড়িবহর বিনা বাধায় পার হবার জন্য আমাদের দুই ঘন্টা আটকে রাখা হয় ফটকের ভেতরে।

আপাততঃ এই চারটি সমস্যার কথাই থাকুক। বাকীটা অন্য কোন একসময়।

আপনার সার্বিক মঙ্গল কামনায়-


একজন সাধারন কর্মী
চট্টগ্রাম ইপিজেড,দক্ষিণ হালিশহর
চট্টগ্রাম।
৭ জুলাই ২০১৪

Sunday, July 6, 2014

সরকারী চাকরী এবং সততা কাহন

ছাত্রজীবনে আমি সরকারী চাকরীর স্বপ্ন দেখতাম। বিসিএস পাশ করে বড় চাকরী করবো সংসারে সুখ সমৃদ্ধি আনবো এরকম একটা পরিকল্পনা মগজে সুন্দর করে সাজানো ছিল। ছাত্রজীবনের পুরোটাই বাবার হোটেলে খেয়েছি, একখানা টিউশানী করে নিজের খরচ নিজে যোগাড় করার গরজ করিনি। সংসার চালাতে মাসে কিরকম খরচ লাগে স্পষ্ট ধারণাও ছিল না। পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমায় দেখা চাকরী পেয়ে মিষ্টির হাঁড়ি আর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার একসাথে নিয়ে বাড়ি ফেরার দৃশ্যটাই শুধু ভাসতো। ওই দৃশ্যের পর ঘটনা কোনদিকে গড়াবে সেটা নিয়ে ভাবনা ছিল না।
তখন সরকারী চাকরীর সবচেয়ে ভালো স্কেল ছিল ২৮৫০ টাকা। সব মিলিয়ে ৪৫০০ টাকার মতো পেতো একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। একই সময়ে বেসরকারী ব্যাংকের প্রথম শ্রেনীর অফিসারের সূচনা বেতন ছিল ৬০০০ টাকা। আমার টার্গেট ছিল সরকারী চাকরী না পেলে ব্যাংকের চাকরীতে ঢুকে যাবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা দেবার আগেই বিসিএস দিলাম, কিন্তু সবগুলো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ভাইবাতে ফেল। একই সাথে সবচেয়ে ভালো বেসরকারী ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়েও চুড়ান্ত পরীক্ষায় গিয়ে ফেল করলাম।

সফল রোমান্টিক বাংলা সিনেমার দৃশ্যটা বদলে গিয়ে আর্ট ফিল্মের দিকে যেতে শুরু করলে অখ্যাত এক কোম্পানীর চাকরীর সুযোগ পেয়ে ঢুকে পড়লাম। খাটনি বেশী, বেতন কম হলেও চাকরীটা একটা সিঁড়ি বটে। লেগে থাকলাম। বেশ কবছর পর আবিষ্কার করলাম আমার সাথে যারা সরকারী চাকরীতে ঢুকেছে তাদের চেয়ে আমার বেতন বেশী, কিন্তু তাদের জীবন আমার চেয়ে স্বচ্ছল। ঘটনা কি?

ঘটনা হলো তাদের ঘুষ আছে আমার ঘুষ নেই। আমি আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে শুরু করলাম প্রথমবারের মতো। সরকারী চাকরী পাইনি বলে মানুষের কাছে বিবেকের কাছে সৎ থাকতে পারছি। কিন্তু এই সততা কতটুকু খাঁটি? সুযোগ পেলে আমিও কি সরকারী বন্ধুদের মতো ঘুষ খেতাম না? মানুষ কেন ঘুষ খায়, কতটা বাধ্য হয়ে খায় এই ভাবনাটা মাথাচাড়া দিল তখন থেকেই।
আমার আয় রোজগার বাংলাদেশে গড়পড়তা মধ্যবিত্তের চেয়ে ভালো। যে বাড়িতে ভাড়া থাকি সেটা একজন প্রথম শ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তার বেতনের সমান বলা চলে। বাড়ি ভাড়ার তিনগুন সংসারের অন্যন্য খরচপাতি। জমার খাতা প্রায় শূন্য। তবু সরকারী চাকরীর চেয়ে ভালো আছি না?

বিসিএস পাশ করে ওই চাকরীটা পেলে কি করতাম? যদি সৎ জীবনযাপন করতাম, তাহলে  এখন যে বাড়িতে থাকি সেই বাড়ির এক তৃতীয়াংশ ভাড়ায় কোন ঘুপচি গলি বা কলোনীতে থাকতাম। বাচ্চাদের পড়াতাম সরকারী প্রাইমারী কোন স্কুলে। সপ্তাহের ছদিন শাক ভর্তা কচুঘেচু খেতাম, মাসে একদিন মাছ বা মাংস কিনতাম। পরিবারের চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডাক্তারের কাছে যেতাম না। উপহার হাতে কোন আত্মীয় বন্ধুর বিয়ে জন্মদিনে উপস্থিত হতাম না, বছরে একবারো কোথাও বেড়াবার কথা ভাবতাম না।
কিন্তু পৃথিবীতে ওই জীবন কে চায়। হাতের কাছে আলগা কামাইয়ের সুযোগ রেখে কে আর দীনহীন জীবনযাপন করে? আমি নিশ্চয়ই ঘুষ খেতে শুরু করতাম। পরিবার নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে হবে এই চিন্তায় আমি ডানহাত বামহাত সব হাতে টাকার বস্তা কুড়াতাম। ঘুষ খাওয়াকে তখন হালাল মনে হতো আমার। তাহলে সৎ সরকারী কর্মকর্তা কি সোনার পাথরবাটি?
জানি না। 

কিন্তু আমি সৎ সরকারী কর্মকর্তা একদম দেখিনি তা নয়। আমার বড়মামা ছিলেন সেরকম একজন মানুষ। কাস্টমসের কর্তা হিসেবে তিনি আজীবন চাকরী করে একদম নিঃস্ব হয়ে মারা গেছেন। তাঁর জীবনযাত্রা ছিল এরকম। ৬ ছেলেমেয়েসহ ৮ জনের সংসার। সরকারী বাসায় থাকতেন। একটা বসার, একটা শোবার, একটা খাবার ঘর। খাবার ঘরটা আসলে বারান্দামতন একটা জায়গা। আর সামনের দিকে ছিল একটা ব্যালকনি, সেই ব্যালকনিতে কাঠের চৌকি বিছিয়ে একটা ঘরের আদল দেয়া হয়েছিল। এতগুলো মানুষ নিয়ে এই ঘরে তিনি ৩০ বছর কাটিয়েছেন অবসর নেবার আগ পর্যন্ত। অফিস ছিল কাছেই। হেঁটে আসা যাওয়া করতেন। ছেলেমেয়েদের স্কুল ছিল কলোনীর ভেতরেই, ওরাও হেঁটে আসা যাওয়া করতো। দোকান বাজার ছিল কাছেই। সরকারী হাসপাতাল ছিল কলোনীতেই। সবার সব চিকিৎসা ওখানেই। তবু মামার বাসায় গেলে মনে হতো না মামার অভাবের সংসার। সামান্য দিয়ে, সাধারন জীবনযাপন করে মামা খুশী। মামার বাসায় ছিল শুধু বইয়ের ঘ্রান। সবাই পড়ছে। এই বই সেই বই আউট বই। হ্যাঁ পড়াশোনা ছাড়া মামার আর কোন চাহিদা ছিল না। ছেলেমেয়েরা সেই আশা পুরণ করেছে। সবাই উচ্চশিক্ষিত হয়েছে নিজ যোগ্যতায়। সেই আমলে টাকার দাম ছিল। ৫ টাকা দিয়েও বাজার করা যেত। তবু দেড় হাজার টাকায় মামা ওই সংসারটা কিভাবে চালিয়েছিলেন সেটা ভাবলে মামাকে বড় একজন যাদুকর মনে হয়। সেই যাদুতেই বড় মামার সব ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবার চেয়ে ভালো আছে।

আজকাল কি সেরকম যাদুকর কোথাও আছে? আমরা যারা সততার সাথে জীবনযাপন করছি বলে দাবী করছি, তার কতখানি সত্যিকারের সৎ, কতটা সুযোগের অভাবে সৎ। আমার ধারণা আমি নিজে সৎ কেননা আমার যা আয় তাতে আমি স্বচ্ছল। যদি  আয় সম্পদে স্বচ্ছল না হতাম নিশ্চয়ই আমিও অবৈধ আয়ের চিন্তা করতাম। কে জানে! 

Saturday, July 5, 2014

বাঙাল সমস্যা ও বিশ্বকাপ গণনা

১. বাঙাল সমস্যা
এটা একটা জেনেটিক সমস্যা নাকি আঞ্চলিক বায়ুদুষণ? বাঙালীদের জিনে ঠিক কখন থেকে এই সমস্যাটা শুরু? এটা কি বিশেষ কোন খাবারের কারণে, নাকি জলবায়ুর কারণে, নাকি আর্থিক অবস্থার কারণে?

এই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে জনপ্রিয় মানুষেরা বেশীদিন জনপ্রিয় থাকে না, মেধাবী মানুষেরা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যায়, সৎ মানুষেরা শঠতায় ভুগতে শুরু করে। সেটা খেলোয়াড়, বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক যাই হোন না কেন, একটা সময় এসে প্রায় সবার লাইন নড়বড়ে হয়ে যায়, লাইনচ্যুত হয়ে যায়।

এবং নষ্ট হবার পর বলতে থাকে আগে ভুল ছিলাম এখন সঠিক হইছি। আর আমরা তখন সেই প্যাট্রিয়ট কবিতার মতো একসময়ের জনপ্রিয় মানুষকে জুতোপেটা করে নীচে নামাতে শুরু করি।

বিতর্ক এড়াতে আমি কারো নাম উল্লেখ করছি না, কিন্তু গত ১০০ বছরে জন্ম নেয়া কমপক্ষে অর্ধশতক স্বনামধন্য বিশ্বখ্যাত বাঙালী সেই তালিকায় আছেন। একজন বাঙালী হিসেবে আমি খুব দুঃখিত বোধ করি।

নীরদ চৌধুরীর 'আত্মঘাতী বাঙালী' বইটি আমি পড়িনি। তিনি কি এসব বাঙালকে নিয়ে লিখেছিলেন? হুমায়ূন আজাদ 'বাঙালী' শিরোনামে সাপ্তাহিক খবরের কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন অনেক বছর আগে। সেই লেখাটির কথা খুব মনে পড়ে।

এই বিখ্যাত লোকেরা জানেন না তাদের এই পরিবর্তনের কারণে পেছনে ঝুলে থাকা মানুষেরা কতটা দ্বিধাবিভক্ত হয়, পরস্পর বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। জাতিকে বিভক্ত করার জন্য, অনৈক্যের জটাজালে আটকে দেবার জন্য এই মানুষগুলো প্রবলভাবে দায়ী। তারা জানেননা কত সুদূরপ্রসারী ক্ষতির বীজ তারা বপন করে যাচ্ছেন।

এদের নিয়ে আমার সমস্যাটা হলো আমি যখন এই সময়ের কোন বিষয় নিয়ে লিখি তখন কারো নাম উল্লেখ করতে পারি না। ঘটনাগুলো বর্ননা করি কিন্তু নামগুলো এড়িয়ে যাই। বিতর্কিত নাম এড়িয়ে লিখতে গেলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হবার দশা হয়। সুতরাং বর্তমান সময় নিয়ে আমার সবগুলো লেখাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।


২. বিশ্বকাপ গণনা

বাঙালীর কথা থাক, এবার বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বানরের গণনাটাইপ কয়েকটি অপরিণামদর্শী ভবিষ্যতবাণী -

৯৯% সম্ভাবনাঃ ব্রাজিল আর্জেন্টিনার মধ্যে যে কোন একটা কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যাবে
৮৯% সম্ভাবনাঃ জার্মানী ফ্রান্সকে হারাবে কোয়ার্টার ফাইনালে
৭৯% সম্ভাবনাঃ জার্মানী বিশ্বকাপ জিতবে
৬৯% সম্ভাবনাঃ কোস্টারিকা সেমি ফাইনাল খেলবে
৫৯% সম্ভাবনাঃ নেদারল্যাণ্ড ফাইনাল খেলবে
৪৯% সম্ভাবনাঃ ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ান হবে
৩৯% সম্ভাবনাঃ আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলবে
২৯% সম্ভাবনাঃ... ফ্রান্স বিশ্বকাপ জিতবে
১৯% সম্ভাবনাঃ আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতবে

গণনা শেষ! এবার মাইরপিট করা যায়?
জুলাই ৪, ২০১৪

ভবিষ্যতবাণী আপডেট-
১. নেইমার নেই, কঠিন আঘাত পেয়েছে গতকাল, অতএব ব্রাজিল সেমিতে বিদায়। জার্মানী ফাইনালে চলে গেছে ধরে নেয়া যায়, নাকি?
২. আজকে আর্জেন্টিনা যদি জিতে তার কৃতিত্ব মেসির না, বাংলাদেশের রোজাকাতুরে জনতার দোয়ার।

৩. আজকে কোস্টারিকা যদি না জিতে আর্জেন্টিনার ফাইনাল খেলা অসম্ভব। সেমিতে নেদুর বাপের নেদারল্যাণ্ডের সামনে টিকতে পারবে না মেসিবাহিনী।
জুলাই ৫, ২০১৪

Tuesday, July 1, 2014

এলেবেলে দিনপঞ্জি

রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়াতেই বোধহয় বারবার হাই ওঠে। বারবার হাই ওঠা খারাপ লক্ষণ। যখন হাত এবং মগজ কোনটাতেই কাজ থাকে না তখনই হাইগুলো উঠে। হাই উঠার ঘন্টাখানেক পরই কপালের দুপাশ পিনপিন করতে শুরু করবে। পিনপিনটা মৃদু থেকে তীব্রতার দিকে যেতে যেতে সমগ্র মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক জুড়ে ঝিমঝিম করে বাজতে শুরু করবে। চোখের সামনে যত আলো আছে সবকিছু অসহ্য ঠেকবে। মাথাটা কোথাও ঠেকানোর জায়গা খুঁজবে। চোখটা অন্ধকারের আশ্রয় চাইবে। কোনটাই যখন হবে না তখন তীব্র বেগে আঘাত করতে শুরু করবে মাইগ্রেন ঝড়। কমপক্ষে ১২ ঘন্টা ধরে এই ঝড় চলবে। তারপর ব্যথানাশক এক শান্ত্বনা পুরস্কারের স্পর্শে ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসবে। ততক্ষণে শরীরের কোষগুলো সমস্ত শক্তি হারিয়ে আত্মসমর্পন করে বসেছে।

সোমবার দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এই রুটিন অব্যাহত ছিল। মাঝে কিছু স্মৃতির যন্ত্রণা, অবচেতনের বঞ্চনা এসে নির্ধারিত ঘুমের ট্রেনটা লেট করিয়ে দিল। দশটার ট্রেন ছাড়লো রাত দেড়টায়। মাঝপথে কলিংবেল, আড়াইটায়। একবার, দুবার, তিনবার। কে? এত রাত কে ডাকে?

অন্ধকারে উঁকি দেই, কেউ নেই। কারো থাকার কথা না। কিন্তু কেউ বাজিয়েছিল, কেউ একজন। ভুতপ্রেতে বিশ্বাস নেই। কংক্রিটের শহরে ওসব নেই। বিদ্যুত বিভ্রাট মেনে নেই। আমার ঘুম স্পর্শ করার আগেই অ্যালার্ম বাজে। ওর কোন দোষ নেই। ওকে বলা হয়েছিল এই সময়ে বাজতে, বেজেছে। বাজুক।

অ্যালার্ম বন্ধ করে আড়মোড়া ভেঙ্গে আবারো শুয়ে পড়ি। কটা বাজে? ঘড়িটা দেখা যায় না অন্ধকারে। কাছের ঘড়ি খালি চোখে দেখি না। চশমা নেই হাতের কাছে। উঠে গিয়ে পেড়ে নিতে ইচ্ছে করছে না। আগে ভালো ছিলাম, চশমা দেবার পর থেকে ঝাপসা হয়ে আসছে পৃথিবী।

নাহ, শুয়ে থাকার মানে নেই। উঠে পড়ি। পানি খাই। হাতমুখ ধুয়ে টিভিরুমে যাই। বাতি জ্বালাই। রিমোট টিপি। জার্মানীকে হয়রান বানাচ্ছে আলজেরিয়া। আমি কার পক্ষে? ব্রাজিলের খেলা এবার পছন্দ না হওয়াতে প্রতিদিন নতুন প্রিয় দল বানাই। যে ভালো খেলবে তার পক্ষে আজ। কে ভালো খেলে? জার্মানী? না আলজেরিয়া। দুদলকেই চালাক মনে হয়।

নাইজেরিয়াও চালাক ছিল। তবু হেরে গেল। ওস্তাদের মার শেষ রাতে। ফ্রান্স দোনোমোনো খেলেও শেষ অংকে বাজীমাত করলো। নাইজেরিয়া কালকে ফ্লাইটে চড়ে বসবে। আফ্রিকা থেকে দুটো দল অন্ততঃ খেলছে। এবার কাপ নেবে কে? ইউরোপ না ল্যাটিন আমেরিকা? নতুন কোন দেশ যদি হয়। কোস্টারিকা পছন্দ হয়েছে। মাথায় ঝড় থাকলে এসব ভাবা যায় না। ঝড় থেমেছে, ব্যথা নেই। ঘুম দরকার। সকালে অফিস। ঘুম যাই।

[কপিরাইট: মাইগ্রেনাসক্ত বেতাল মস্তিষ্কের]