Tuesday, July 8, 2014

যে চিঠি রাষ্ট্রনায়ক কখনো পড়বেন না

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

একজন সাধারণ নাগরিকের সমস্যার কথা আপনার কাছে পৌঁছানোর সম্ভাবনা শতকরা ১ শতাংশের কম জেনেই আমি লিখছি। চিঠিটা যদি কোন সুত্র বা শাখা প্রশাখায় ভর করে আপনার কাছে পৌঁছে যায় একদিন!

আপনি বলতে পারেন এই সমস্যার কথা কেন আমি স্থানীয়ভাবে সমাধান করছি না। বাংলাদেশে অনেক সমস্যা স্থানীয়ভাবে অবহেলিত হয় অথবা স্থানীয় প্রশাসনের স্বার্থবিরোধী হবার কারণে সমাধান হয় না।

আমি বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানী প্রক্রিয়া করণ অঞ্চল চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে লিখছি। দশ বছর আগেও এই ইপিজেডের অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। পনের বছর আগে এই ইপিজেড সত্যি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিশ্রুতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই ইপিজেড গত পাঁচ ছয় বছর ধরে জঘন্য অবস্থায় আছে। আমি মাত্র চারটি সমস্যার কথা লিখবো আজ-

১. ইপিজেডের কুরুক্ষেত্র প্রবেশমুখ
একটা সময় ইপিজেডে গাড়ি ঢুকতে এমনকি ব্রেক কষারও দরকার হতো না। এতই মসৃন ছিল রাস্তা ঘাট প্রবেশপথ। ঢোকার পথ, বেরোবার পথ দুটো পথই ছিল মসৃন সুন্দর সুশৃংখল। এখন ইপিজেডে ঢোকা এবং বের হওয়া একটা দুঃস্বপ্ন বিশেষ। ইপিজেডের প্রবেশমুখে বসানো হয়েছে একটি কন্টেইনার ডিপো। সেই ডিপোর শত শত ট্রাক, ট্রেলার আসা যাওয়া করে রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি করে, রাস্তাগুলো গর্ত হয়ে গেছে,  রাস্তার দুই তৃতীয়াংশ জায়গা ট্রাক পার্কিং হয়ে গেছে। ফলে এখানে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ও শত শত গাড়ি ঢুকা ও বের হবার জন্য লড়াই করে। শুনে অবাক হবেন, শুধু গেট অতিক্রম করতে একেকটি গাড়ির কমপক্ষে আধঘন্টা সময় লাগে।

আপনি এসব কিছুই দেখেন না, কেননা আপনি সকাল সাতটায় কোনদিন ইপিজেডে আসেননি। আর আপনার আসার আগেই রাস্তাঘাট পবিত্র করার কর্মসূচি চলে। বাংলাদেশের কোন সরকার দেশের বিশ্রী চেহারা দেখার সুযোগ পান না এই পবিত্র কর্মসূচির বলে।

২. ইপিজেডে ঢোকার অপ্রয়োজনীয় সিংহ দরোজা
আপনি জেনে অবাক হতে পারেন ইপিজেডে দুটো সিংহ দরোজা বানানো হয়েছিল কোন এক উর্বর মস্তিষ্কের পরামর্শে। যদিও আরো চারটি গেট আগে থেকেই আছে। তবু সেই ব্যয়বহুল সিংহ দরোজা বানানো হয়েছিল। সেই দরোজা দুটির একটি দিয়ে ঢোকা অন্যটি দিয়ে বের হবার পথ। গাড়ি ঢুকার জন্য দুটো ফোকড় রাখা হলেও মানুষ হাঁটার জন্য রাখা হয়েছে তিনফুটের একটা ফোকড়। সেই ফোকড় দিয়ে একজনের বেশী ঢুকতে পারে না। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রোত ওখানে আটকা পড়ে এবং বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা গাড়ির রাস্তা দখল করে হাঁটতে থাকে। এতে শতশত গাড়ির জট লেগে যায় মুহুর্তেই। সেই জট বিমানবন্দর সড়ক পর্যন্ত পৌঁছায় এবং সেই সড়কের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে নরক কাণ্ড চলে।

আপনাকে হয়তো বলা হবে গেট দুটো নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে যাতে অবৈধভাবে কেউ মালামাল চুরি করে নিয়ে যেতে না পারে। বলে রাখি, ইপিজেডে যারা চুরি করে তারা পুকুর চুরিই করে। পুরো ট্রাক ভর্তি করে গেটে টাকা দিয়ে মালামাল হাপিস করে দেয়। এই চুরির সাথে গেটের সব রকমের কর্মকর্তা জড়িত।

৩. ইপিজেডের অনাকাংখিত জলাবদ্ধতা
গত বিশ ত্রিশ বছরের ইতিহাসে ইপিজেডে বৃষ্টির পানিতে বন্যা হবার নজির গত চার পাঁচ বছরেই দেখা গেছে। এর আগে কোনদিন চিন্তাই করা যেতো না এখানে বন্যা হতে পারে। ইপিজেডে বন্যা হবার কয়েকটা কারণের অন্যতম হলো, পানির চলাচলের রাস্তাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে ইপিজেড থেকে অনুমোদিত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। গেটের মধ্যে কন্টেনার ডিপো এবং পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ জায়গার একটা ফ্যাক্টরী এই জলাবদ্ধতার জন্য অন্যতম দায়ী। এই হলো ইপিজেডের মূল প্রবেশপথের জলাবদ্ধতা। এছাড়া ইপিজেডের খালে বাধ দিয়ে একটি পানি শোধনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ওরা ইপিজেড থেকে বের হওয়া পানিগুলো আটকে রাখার ফলে বৃষ্টি হওয়ামাত্র খালটি উপচে রাস্তায় পানি উঠে যায়। সেই পানি আমাদের ফ্যাক্টরীর আঙিনাকেও প্লাবিত করে।

আপনাকে এই বন্যা কখনো দেখতে হয়নি কেননা আপনি এসব কুক্ষণে ইপিজেড সফরে বের হন না। আপনাকে এসব সমস্যার কথা কখনো বলা হয় না। সব কিছু ঠিক আছে, সবদিকে মসৃন সৌন্দর্যশুধুই উন্নয়ন আর অগ্রগতি। আপনাকে এই বলে ভুলিয়ে রাখা হয়। অথচ আপনি জানতেও পারেন না আইল্যাণ্ডের যে পাশে আপনি যাবেন শুধু সেই পাশে চুনকাম করা আছে, বাকী পাশটা খালি।


৪. ইপিজেডের প্রধান সড়কের আবর্জনার ভাগাড়
ইপিজেডের সামনে বিমানবন্দর সড়ক। সকল এয়ারপোর্ট যাত্রী এবং ইপিজেডের শ্রমিককর্মী এই পথ দিয়ে যাতায়াত করে। সকালবেলা একটা ভয়াবহ বিশ্রী একটা দৃশ্য দেখতে হয় প্রতিদিন। সড়কের পাশে একটা কাঁচাবাজারের আড়ত। সেই আড়ত ফুটপাতের পুরোটা দখল করে নিয়েছে। ফুটপাতের পাশে রাস্তার অর্ধেক জুড়ে ময়লা আবর্জনার স্তুপ। গলিত পচিত আবর্জনারা সমস্ত রাস্তাময় এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে গাড়ি ছাড়া কোন মানুষ হেঁটে পার হবার উপায় নেই। আপনি যদি এসি গাড়িতে চোখ বন্ধ করে থাকেন তাহলে এই বিভৎসতা আপনাকে স্পর্শ করবে না। নগরকর্তারা হয়তো তাই করে থাকেন তাই এই দৃশ্যগুলো সমাধান হয় না। এই আবর্জনা আর আড়ত একই সুত্রে বাঁধা। এখন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে মানুষ চলাচলের পথে আড়ত আর আবর্জনার পর্বত জেগে থাকবে কিনা। লজ্জিত হয়ে ভাবি এই রোডকে ভিআইপি রোডও বলা হয় মাঝে মাঝে।

আপনি এই দৃশ্য কখনো দেখেন না কেননা আপনি আসার আগে ময়লা আবর্জনা ডাস্টবিন সব সরে যায়। আপনার ভিভিআইপি গাড়িবহর বিনা বাধায় পার হবার জন্য আমাদের দুই ঘন্টা আটকে রাখা হয় ফটকের ভেতরে।

আপাততঃ এই চারটি সমস্যার কথাই থাকুক। বাকীটা অন্য কোন একসময়।

আপনার সার্বিক মঙ্গল কামনায়-


একজন সাধারন কর্মী
চট্টগ্রাম ইপিজেড,দক্ষিণ হালিশহর
চট্টগ্রাম।
৭ জুলাই ২০১৪

No comments: