ছাত্রজীবনে আমি সরকারী চাকরীর স্বপ্ন দেখতাম। বিসিএস পাশ করে বড় চাকরী করবো সংসারে সুখ সমৃদ্ধি আনবো এরকম একটা পরিকল্পনা মগজে সুন্দর করে সাজানো ছিল। ছাত্রজীবনের পুরোটাই বাবার হোটেলে খেয়েছি, একখানা টিউশানী করে নিজের খরচ নিজে যোগাড় করার গরজ করিনি। সংসার চালাতে মাসে কিরকম খরচ লাগে স্পষ্ট ধারণাও ছিল না। পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমায় দেখা চাকরী পেয়ে মিষ্টির হাঁড়ি আর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার একসাথে নিয়ে বাড়ি ফেরার দৃশ্যটাই শুধু ভাসতো। ওই দৃশ্যের পর ঘটনা কোনদিকে গড়াবে সেটা নিয়ে ভাবনা ছিল না।
তখন সরকারী চাকরীর সবচেয়ে ভালো স্কেল ছিল ২৮৫০ টাকা। সব মিলিয়ে ৪৫০০ টাকার মতো পেতো একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। একই সময়ে বেসরকারী ব্যাংকের প্রথম শ্রেনীর অফিসারের সূচনা বেতন ছিল ৬০০০ টাকা। আমার টার্গেট ছিল সরকারী চাকরী না পেলে ব্যাংকের চাকরীতে ঢুকে যাবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা দেবার আগেই বিসিএস দিলাম, কিন্তু সবগুলো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ভাইবাতে ফেল। একই সাথে সবচেয়ে ভালো বেসরকারী ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়েও চুড়ান্ত পরীক্ষায় গিয়ে ফেল করলাম। সফল রোমান্টিক বাংলা সিনেমার দৃশ্যটা বদলে গিয়ে আর্ট ফিল্মের দিকে যেতে শুরু করলে অখ্যাত এক কোম্পানীর চাকরীর সুযোগ পেয়ে ঢুকে পড়লাম। খাটনি বেশী, বেতন কম হলেও চাকরীটা একটা সিঁড়ি বটে। লেগে থাকলাম। বেশ কবছর পর আবিষ্কার করলাম আমার সাথে যারা সরকারী চাকরীতে ঢুকেছে তাদের চেয়ে আমার বেতন বেশী, কিন্তু তাদের জীবন আমার চেয়ে স্বচ্ছল। ঘটনা কি?
ঘটনা হলো তাদের ঘুষ আছে আমার ঘুষ নেই। আমি আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে শুরু করলাম প্রথমবারের মতো। সরকারী চাকরী পাইনি বলে মানুষের কাছে বিবেকের কাছে সৎ থাকতে পারছি। কিন্তু এই সততা কতটুকু খাঁটি? সুযোগ পেলে আমিও কি সরকারী বন্ধুদের মতো ঘুষ খেতাম না? মানুষ কেন ঘুষ খায়, কতটা বাধ্য হয়ে খায় এই ভাবনাটা মাথাচাড়া দিল তখন থেকেই।
আমার আয় রোজগার বাংলাদেশে গড়পড়তা মধ্যবিত্তের চেয়ে ভালো। যে বাড়িতে ভাড়া থাকি সেটা একজন প্রথম শ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তার বেতনের সমান বলা চলে। বাড়ি ভাড়ার তিনগুন সংসারের অন্যন্য খরচপাতি। জমার খাতা প্রায় শূন্য। তবু সরকারী চাকরীর চেয়ে ভালো আছি না?
বিসিএস পাশ করে ওই চাকরীটা পেলে কি করতাম? যদি সৎ জীবনযাপন করতাম, তাহলে এখন যে বাড়িতে থাকি সেই বাড়ির এক তৃতীয়াংশ ভাড়ায় কোন ঘুপচি গলি বা কলোনীতে থাকতাম। বাচ্চাদের পড়াতাম সরকারী প্রাইমারী কোন স্কুলে। সপ্তাহের ছদিন শাক ভর্তা কচুঘেচু খেতাম, মাসে একদিন মাছ বা মাংস কিনতাম। পরিবারের চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডাক্তারের কাছে যেতাম না। উপহার হাতে কোন আত্মীয় বন্ধুর বিয়ে জন্মদিনে উপস্থিত হতাম না, বছরে একবারো কোথাও বেড়াবার কথা ভাবতাম না।
বিসিএস পাশ করে ওই চাকরীটা পেলে কি করতাম? যদি সৎ জীবনযাপন করতাম, তাহলে এখন যে বাড়িতে থাকি সেই বাড়ির এক তৃতীয়াংশ ভাড়ায় কোন ঘুপচি গলি বা কলোনীতে থাকতাম। বাচ্চাদের পড়াতাম সরকারী প্রাইমারী কোন স্কুলে। সপ্তাহের ছদিন শাক ভর্তা কচুঘেচু খেতাম, মাসে একদিন মাছ বা মাংস কিনতাম। পরিবারের চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট ক্লিনিক বা ডাক্তারের কাছে যেতাম না। উপহার হাতে কোন আত্মীয় বন্ধুর বিয়ে জন্মদিনে উপস্থিত হতাম না, বছরে একবারো কোথাও বেড়াবার কথা ভাবতাম না।
কিন্তু পৃথিবীতে ওই জীবন কে চায়। হাতের কাছে আলগা কামাইয়ের সুযোগ রেখে কে আর দীনহীন জীবনযাপন করে? আমি নিশ্চয়ই ঘুষ খেতে শুরু করতাম। পরিবার নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে হবে এই চিন্তায় আমি ডানহাত বামহাত সব হাতে টাকার বস্তা কুড়াতাম। ঘুষ খাওয়াকে তখন হালাল মনে হতো আমার। তাহলে সৎ সরকারী কর্মকর্তা কি সোনার পাথরবাটি?
জানি না।
কিন্তু আমি সৎ সরকারী কর্মকর্তা একদম দেখিনি তা নয়। আমার বড়মামা ছিলেন সেরকম একজন মানুষ। কাস্টমসের কর্তা হিসেবে তিনি আজীবন চাকরী করে একদম নিঃস্ব হয়ে মারা গেছেন। তাঁর জীবনযাত্রা ছিল এরকম। ৬ ছেলেমেয়েসহ ৮ জনের সংসার। সরকারী বাসায় থাকতেন। একটা বসার, একটা শোবার, একটা খাবার ঘর। খাবার ঘরটা আসলে বারান্দামতন একটা জায়গা। আর সামনের দিকে ছিল একটা ব্যালকনি, সেই ব্যালকনিতে কাঠের চৌকি বিছিয়ে একটা ঘরের আদল দেয়া হয়েছিল। এতগুলো মানুষ নিয়ে এই ঘরে তিনি ৩০ বছর কাটিয়েছেন অবসর নেবার আগ পর্যন্ত। অফিস ছিল কাছেই। হেঁটে আসা যাওয়া করতেন। ছেলেমেয়েদের স্কুল ছিল কলোনীর ভেতরেই, ওরাও হেঁটে আসা যাওয়া করতো। দোকান বাজার ছিল কাছেই। সরকারী হাসপাতাল ছিল কলোনীতেই। সবার সব চিকিৎসা ওখানেই। তবু মামার বাসায় গেলে মনে হতো না মামার অভাবের সংসার। সামান্য দিয়ে, সাধারন জীবনযাপন করে মামা খুশী। মামার বাসায় ছিল শুধু বইয়ের ঘ্রান। সবাই পড়ছে। এই বই সেই বই আউট বই। হ্যাঁ পড়াশোনা ছাড়া মামার আর কোন চাহিদা ছিল না। ছেলেমেয়েরা সেই আশা পুরণ করেছে। সবাই উচ্চশিক্ষিত হয়েছে নিজ যোগ্যতায়। সেই আমলে টাকার দাম ছিল। ৫ টাকা দিয়েও বাজার করা যেত। তবু দেড় হাজার টাকায় মামা ওই সংসারটা কিভাবে চালিয়েছিলেন সেটা ভাবলে মামাকে বড় একজন যাদুকর মনে হয়। সেই যাদুতেই বড় মামার সব ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবার চেয়ে ভালো আছে।
আজকাল কি সেরকম যাদুকর কোথাও আছে? আমরা যারা সততার সাথে জীবনযাপন করছি বলে দাবী করছি, তার কতখানি সত্যিকারের সৎ, কতটা সুযোগের অভাবে সৎ। আমার ধারণা আমি নিজে সৎ কেননা আমার যা আয় তাতে আমি স্বচ্ছল। যদি আয় সম্পদে স্বচ্ছল না হতাম নিশ্চয়ই আমিও অবৈধ আয়ের চিন্তা করতাম। কে জানে!
আজকাল কি সেরকম যাদুকর কোথাও আছে? আমরা যারা সততার সাথে জীবনযাপন করছি বলে দাবী করছি, তার কতখানি সত্যিকারের সৎ, কতটা সুযোগের অভাবে সৎ। আমার ধারণা আমি নিজে সৎ কেননা আমার যা আয় তাতে আমি স্বচ্ছল। যদি আয় সম্পদে স্বচ্ছল না হতাম নিশ্চয়ই আমিও অবৈধ আয়ের চিন্তা করতাম। কে জানে!
No comments:
Post a Comment