Tuesday, December 28, 2010

[অচেনা পাহাড়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামে-দুই]শ্বাপদ সংকুল রাতের শিহরন পেরিয়ে বৈচিত্রময় দিবসে

১.
রাত কতো জানি না। ঘড়ি নেই। সময়ের কোন হিসেব রাখবো না বলে ঘড়ি আনিনি।
ঘরটা ভেঙ্গে পড়বে মনে হলেও ছুটে বেরিয়ে যেতে সাহস হচ্ছে না ঘুটঘুটে অন্ধকারে।
.
কুঁড়ে ঘরের চালের উপর থেকে এবার গরররররররর গররররর জাতীয় অদ্ভুত কিছু বিজাতীয় শব্দ ভেসে আসছে। ভীতু মানুষ না হলেও, এই সময়ের জন্য সাহসটা দমে গেল। এডভেঞ্চারের শুরুতে বেঘোরে মারা পড়াটা কোন কাজের কাজ হবে না। তবে ভয়ের চেয়েও একটা বিচিত্র অভিজ্ঞাতর লোভ অনেক বেশী আবিষ্ট করে রেখেছে বলে ভয়টা দাঁত ফোটাতে পারছে না।
.
অতীত থেকে শিক্ষা পেয়েছি যে দুর্যোগ থেকে বেঁচে গেলে সেই দুর্যোগই পরে মধুর স্মৃতিচারণ হয়ে ওঠে। সেরকম বেশ কয়েকটা অভিজ্ঞতা ঝুলিতে জমা আছে। সেন্টমার্টিনে প্রথমবার যাবার সময় মাঝ দরিয়ায় ছোট্ট নৌকাসহ ডুবে যাচ্ছিলাম দেখেও ভয় পাইনি ঢেউয়ের সেই অপরূপ রুদ্র মূর্তি শ্রীকান্তের চোখে দেখেছিলাম বলে।
.
আন্দাজ করার চেষ্টা করছি কিরকম জন্তু হবে পারে। এই অঞ্চলে কি কি হিংস্র জন্তু আছে তার তালিকা বাংলাপিডিয়ায় পড়েছিলাম অনেক আগে। এখন মনে আসছে না।
.
বাংলাপিডিয়ার কথা মনে পড়লে আমার এখনো লজ্জা হয়। প্রথম যখন ওটা প্রকাশিত হয়, সহজে কিনতে পাওয়া যেত না। হেলায় সুযোগ না হারানোর জন্য কারেন্ট বুক সেন্টারে গিয়ে আগাম অর্ডার দিয়ে রাখলাম। তারপর যখন ঢাকা থেকে জিনিস এলো, ষ্টক ফুরিয়ে যাবার ভয়ে দ্রুততম পথে দশ হাজার টাকায় পুরো সেট কিনে আনি বাসায়। কিন্তু বিজয়ীর হাসিটা ফুরোবার আগে কদিন বাদেই শুনি পুরো বাংলা পিডিয়ার ডিজিটাল ভার্সন মাত্র আশি টাকায়। ওটা ছিল বই কিনে আমার জীবনে অন্যতম ধরা।
.
যাককে, ধান ভানতে শিবের গীত চলে আসছে আবারো। জঙ্গলে ফিরি এখন।
.
২.
উপরে যে জন্তু হানাহানি করছে তা জানার চেয়ে এখানে চুপচাপ বসে থাকি। জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞানতা কখনো কখনো শ্রেয়তর। বাইরে বেরিয়ে টর্চ মেরে দেখতে গেলে ওদের ডিনারের খাদ্য হয়ে যেতে পারি। এখনো নিশ্চিত না ওদের লড়াইটা কি নিয়ে। অসম্ভব কিছু না, হতে পারে আমাকে দখল করা নিয়েই যুদ্ধ। আমার শরীরে যে মাংস আছে তাতে দুটো বাঘের কুলোবে না। তাই হয়তো ফয়সালা চলছে, মানুষ বেটা কার?
.
এটা মাথায় আসার পর গা শির শির করলো। মানুষ খেকো বাঘ নাকি ভয়ংকর জিনিস। আমার কাছে একটা মাল্টিপারপাস পকেট নাইফ বাদে আর কোন অস্ত্র নাই। খালি হাতে আত্মরক্ষা বিদ্যায় কালোফিতার পদক থাকলেও সেটা বাঘভালুকের বিরুদ্ধে কোন কাজে আসছে না। সুযোগ থাকলে ঝেড়ে দৌড় দিতাম, কিন্তু জঙ্গলের যে অবস্থা, দিনের বেলা পায়ে হেঁটেই চলা মুশকিল। রাতে তো পুরা আন্ধা। ঠিক এই সময়ে বিধাতার উপর একটু ক্ষোভ জন্মালো মানুষের প্রতি আনফেয়ার ট্রিটমেন্ট করার জন্য। সকল হিংস্র জীব জন্তুরই বিল্টইন নাইটগ্লাস আছে। কোন যন্ত্র ছাড়াই ওরা রাতের বেলাও ফকফকা দেখে। মানুষের নখ দাঁত কিছুই মজবুত না, তার উপর নাইটগ্লাসও নাই। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একেবারে অচল। এটাকে ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট হিসেবে মেনে নিয়ে কান খাড়া করে শুয়ে থাকলাম।
.
এই ঘরে কোন দরোজা নেই। যে ফোকর দিয়ে আমি ঢুকেছি এত অন্ধকারে সেটার অবস্থানও বুঝতে পারছি না। অন্ধকার এত ঘন হতে পারে এরকম জায়গায় না এলে কেউ বুঝবে না। কোন কোন সাপ(নাকি সব সাপ) নাকি চোখে দেখে না, জিহ্বা দিয়ে শুনে শুনে শিকারকে টার্গেট করে। আমিও কানকে চোখের বিকল্প অবস্থানে দিয়ে তৈরী থাকলাম আক্রান্ত হওয়ার জন্য।
.
এমন সময় দূরে কোথাও তীক্ষ্ণ একটা চীৎকার শোনা গেল। হায়েনা নাকি? তারপর একটা শেয়ালের ডাক। শেয়ালের ডাক থামতে না থামতেই আরো কয়েকটা শেয়াল ডাক ছাড়া শুরু করলো। আবারো সেই হায়েনার মতো তীক্ষ্ণ চিৎকার। আমি হায়েনার ডাক চিনি না। কিন্তু আন্দাজে মনে হলো। ডাকটা কাছে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ মাথার উপর থেকেও সেরকম ডাক শুনতে পেলাম। কান ঝালাপালা করে ফেললো সেই চিক্কন ডাক। ধাপাধাপি থামিয়ে চিৎকার শুরু করলো এবার। আমার কানের পর্দা না ফাটিয়ে ছাড়বে না। আরো কয়েকটাকে আমন্ত্রন করছে নাকি ডিনারে?
.
এই ঘরে আছে এক এক মানুষের ছাও
তোমরা সকলে মিলে তাড়াতাড়ি আও
.
কাহিনী যদি এই হয়, তাহলে আজকেই আমার দিন শেষ। কেউ জানবেও না পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন জঙ্গলে বেঘোরে বন্য জন্তুর পেটে চলে গেছে একটা আস্ত মানুষ। পত্রিকার পাতায় কদিন নিখোঁজ সংবাদ আসবে। তিন মাস পর পরিচিত সাংবাদিক ফলো আপ নিউজ করবে স্থানীয় পত্রিকায়, "আজ তিন মাস হয়ে গেল আবুল হোসেন আমাদের মাঝে নেই। আজ থেকে তিনমাস আগে ২১ ডিসেম্বর শনিবার সকালে কাউকে না বলে উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাকে সর্বশেষ মুরাদপুর বাস স্টেশানে দেখেছে বলে জানিয়েছে তার সহপাঠি জহিরুল। প্রাথমিকভাবে অপহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও তাহার মুক্তিপন ঘোষনা করে কেউ যোগাযোগ করেনি। আবুল হোসেন একজন সৎ নির্বিবাধী সাহসী ও মানবতাবাদী সমাজদরদী মানুষ ছিলেন। তিনি গতবছর তার ছেঁড়া পাঞ্জাবীটা রিকশাচালক নুরুল ইসলামকে দান করেছিলেন।"
.
৩.
হঠাৎ চিক্কুর পাক্কুর সব চুপ। কোথাও কোন শব্দ নেই। পোকা মাকড়গুলো অবিরত চিৎকার করে যাচ্ছে। এই ব্যাটাদের গলা ব্যাথাও হয় না। ঝিঁঝিঁ পোকার গলা কি দিয়ে বানানো খোদা মালুম। সিনথেটিক কোন বস্তু না থাকলে ওটা এত চিৎকারে ফেটে চোঙ্গা হয়ে যেত। মশামাছি বরং খুব ভদ্রজাতের প্রাণী। চিৎকারে অভব্যতা নেই। আমার সাহস ফিরে আসছে। উঠে বসলাম সাবধানে। তবু মচ মচ করে কঁকিয়ে উঠলো। এটা শুনে জন্তু জানোয়ার বিরক্ত হলে সেটা প্রাণঘাতি হবে। কোথাও নড়াচড়া দেখলাম না আর। বুঝলাম চলে গেছে যুদ্ধবাজ জন্তুগুলো। যাবার পর মনে মনে কাহিনীটা সাজিয়ে নিলাম।
.
শহরে ফিরতে পারলে এটা একটা দারুণ গল্প হবে। বীরত্বের রস দিতে হবে কিছুটা। রস ছাড়া বীরত্বের কাহিনী জমে না। ঘটনা সব ঠিক থাকবে, কেবল যোগ করা হবে একটা বর্শা। ওটা এই কটেজেই পাওয়া যাবে। সেই বর্শা হাতে নিয়ে আমি জন্তুটার উপর অন্ধকারেই হুংকার ঝাপিয়ে পড়েছি। বর্শার গুতোয় জঙ্গল ছেড়ে পালিয়েছে সেই কাল্পনিক বাঘটা। বাঘের রং অবশ্যই কালো হবে। যদিও অন্ধকার ছিল। পকেটে টর্চ ছিল ওটা জ্বেলে দেখে নিয়েছি। এরকম চাপাবাজিগুলো খুব কাজের, কেউ যাচাই করতে আসবে না।
.
এসব আউল ফাউল চিন্তা করতে করতে ঘুম জড়িয়ে এল। ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারলাম না বেলা কত হয়েছে। সূর্যের দেখা নেই কোনদিকে। সকাল আটটাও হতে পারে, দুপুর একটাও হতে পারে। যাই হোক, ঘড়ি এখন একটা সেটা পেটের ভেতর। ওটা বলছে খিদা পাইছে, খানা দাও। রাতের কিছু খিচুড়ী ছিল প্যানে। জমে বরফ হয়ে আছে। এই একটাই পাত্র আছে আমার, ওটাতেই রান্না, ওটাতেই খাওয়া। ভাত চা কফি সব একটাতেই। স্টোভটা জাললাম। খিচুড়ী গরম করতে দিলাম। এই স্টোভ যন্ত্রটা




পূর্ব ঘটনা:
http://neersondhani.blogspot.com/2010/12/blog-post_1944.html

[অচেনা পাহাড়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামে-এক] কুয়াশা, মেঘ, পাহাড় ছুঁয়ে আসার ধোঁয়াশা গল্প

১.
চাঁদের গাড়ীটা যেখানে নামিয়ে দিয়ে গেছে পথ ওখানেই শেষ। এর পরে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটাপথ মাইল খানেক। মাইল খানেকই হবার কথা। ম্যাপ তাই বলছে। শীতের বিকেলে রোদ বেশীক্ষণ থাকে না। রোদ থাকতে পৌঁছে যেতে হবে। নইলে পথ হারাবার সম্ভাবনা।
.
বাতাসে বুনো একটা মিষ্টি গন্ধ। অসংখ্য পাখির বিচিত্র কিচিরমিচির শব্দে কান ঝালাপালা হবার যোগাড়। খিদে তেষ্টা দুটোই আকড়ে ধরেছিল দীর্ঘ লক্কর ধক্কর যাত্রায়। কিন্তু এই পাহাড়ী বুনো পথে নামার পর কোথাও উধাও হয়ে গেল সব খিদে ক্লান্তি। এই জায়গাটা কত উঁচু এতক্ষন খেয়াল করা হয়নি। নীচের পাহাড়ের উপর ভেসে থাকা ধোঁয়াগুলো যে আসলে মেঘ তা বুঝতে পেরে চমকে উঠি। ওরা ঠিকই বলেছিল। এখান থেকে মেঘ ছোঁয়া যায়। কিন্তু শীতকালে মেঘ অত নীচে নামে?
.
পথটা ঢালু বলে দৌড়ে দৌড়ে নামছি প্রায়। কিন্তু দৌড়াতে গিয়ে ম্যাপে চোখ রাখা হচ্ছে না। পথ হারিয়ে ফেললে রাতে কি হবে? এই অঞ্চলে কোন লোক বসতি নেই। অন্তত কয়েক বর্গমাইল নিথর পাহাড় সারি। সেই কুটিরটা খুঁজে না পেলে জঙ্গলের জীব জন্তুদের সাথেই রাতটা কাটাতে হবে। শহরের ফুটপাতে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা থাকলেও এখানে তা কাজে আসবে না। চেনা শহরের ফুটপাত আর অচেনা পাহাড়ের জঙ্গল এক নয়। এখানে বুনো জন্তুর চেয়েও ভয়ংকর হলো মশা। যদিও এই মশাগুলোর ব্যবস্থা করার জন্য অডোমস ক্রীম আছে সাথে। শহুরে মশা ধারে কাছেও ঘেঁষেনা এটা গায়ে মাখলে। বুনো মশার জন্য কতোখানি কাবিল তা প্রমান করতে অপেক্ষা করতে হবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সবকিছু ঠিক থাকলে আধাঘন্টার মধ্যে খুঁজে পাবার কথা কুড়ে ঘরটা।
.
এটা একটা নিয়মিত হাঁটা পথ ছিল এককালে। ঝোপঝাড়গুলো দেখে বোঝা যায়। ঘাসের চাপড়াগুলোর সাইজ দেখে মনে হয় খুব বেশীদিন না, হয়তো বছরখানেক আগেও নিয়মিত যাতায়াত ছিল এই পথে। উপজাতি গ্রামগুলো এখান থেকে আরো গভীরে। এদিকে রাস্তাটা ঢাল বেয়ে নেমে গিয়ে কিছুদুরে খাড়া পর্বত উঠে গেছে। ওটার উল্টো দিকেই শংখ নদী বয়ে গেছে।
.
২.
অভীকদের দলটা ছিল ট্রেকার, আমার মতো অবকাশবিলাসী কেউ না। ট্রেকিং শেষে ফেরত আসার পথেই সেই নির্জন কুটিরের দেখা পায়। একটা গা ছমছমে রহস্যময় রাত কাটায় ওরা দলবেধে। রহস্যময় মানে ভয়ের কিছু ছিল না বরং সেই রাতটার বর্ণনায় কেমন একটা রহস্যময়তার গন্ধ ছিল। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যদি সুযোগ পাই অন্ততঃ একটা সপ্তাহ ওই কুটিরের নির্জনতায় কাটাতে হবে। ওদের কাছ থেকে পথের একটা ম্যাপ যোগাড় করে রেখেছিলাম তখন। আজকে সুযোগ পেয়েই বেরিয়ে পড়েছি। কেউ জানে না আমি এখানে আসবো। যোগাযোগ করার সমস্ত যন্ত্রপাতি রেখে এসেছি বাসায়। ক্যানভাসের ব্যাগে কটা কাপড়চোপড়, শুকনো কিছু খাবার, টুকটাক জঙ্গলে দরকার কিছু জিনিসপত্র আর একটা ডায়েরী ছাড়া আর কিছু নেই।
.
পাখির ডাকগুলো আস্তে আস্তে কেমন ঝিমিয়ে পড়ছে। যতই এগোচ্ছি জঙ্গল যেন ঘন হচ্ছে। ব্যাগের পকেট থেকে ছোট চাকুটা বের করতে হলো। ঝোপ ছেটে ছেটে এগোতে হচ্ছে এবার। ঠিক পথেই তো এগোচ্ছি মনে হয়। সূর্যের বিপরীতে হাঁটলে ডানদিকে নীলচে পাহাড়টা আর বামদিকে নদীর বাঁকটা দেখা যাবে। সব ঠিকই আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু সোজা এগোনো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে জঙ্গল এতটা ঘন যে চাকুটা কাজে আসছে না। ঘুরে পথ পেরোতে হচ্ছে। শিমুল গাছ নাকি এটা? সারা গায়ে কাটা কাটা? ওটার নীচে এসে দম নিতে থামলাম।
.
তখনই মনে হলো কি চরম বোকামী করতে যাচ্ছিলাম। ওরা যে পথে এসেছিল সেই পথে তো ঝোপঝাড় কাটা থাকার কথা। কিন্তু এই পথে সব আদিম জঙ্গল। ভুল হয়ে গেছে। ওরা এই পথে যায় নি। এত্ত বড় একটা গাছের বর্ণনা এড়িয়ে যাবার কথা নয়। এই সহজ কথাটা প্রথমেই মাথায় এলো না কেন? আবার উল্টো পথ ধরলাম। এটা কঠিন হয়ে গেল। ঢাল বেয়ে নামা যত সহজ ছিল, ওঠা তারচেয়ে দশগুন কঠিন। নামতে আধাঘন্টা লেগেছিল, উঠতে এক ঘন্টার কম না।
.
সূর্য দ্রুত নেমে যাচ্ছে। যেখানে একটু আগেও রোদ, এখন সেখানে ধোঁয়াটে ছায়া। দূরে নদীর ওপাশের উপত্যকায় কোথাও চুলোয় আগুন দিয়েছে কোন পাহাড়ী গিন্নী। তারই ধোঁয়াগুলো ভাসছে মেঘের মতো। কুয়াশা এসে ঘিরে ধরছে চারপাশ। এসব কি কুয়াশা? নাকি মেঘ? আমি কি মেঘ ছুঁয়ে উঠছি? দ্রুত উপরে ওঠার চেষ্টা করলাম। খিদেটা আবার মোচড় দিল। কিন্তু বসে খেয়ে নেবো উপায় নেই। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।
.
৩.
হাচড়ে পাচড়ে অবশেষে যেখান দিয়ে নেমেছিলাম সেই জায়গায় পৌঁছালাম, তারপর ধপাস করে ঘাসের উপর বসে পড়লাম। গলা শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি খেলাম। সূর্যটা নেমে গেছে। পুরো উপত্যকা জুড়ে ছায়ার মেলা। এই পাহাড়ের ছায়া ওই পাহাড়ে, ওই পাহাড়ের ছায়া তারো পরে। মাঝে মাঝে ছোপ ছোপ মেঘ বা কুয়াশা মাকড়সার জালের মতো ঝুলে আছে এখানে সেখানে। প্রচন্ড শীতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে হাতের তালুতে কিন্তু শরীরের ভেতরটা জ্বলছে বলে চামড়ায় হুল ফুটিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারছে না শীত।
.
বিস্কুট আর পানি দিয়ে খিদেটাকে একটু চাপা দিলাম। চিড়ে আর গুড় আছে ব্যাগে। ওগুলো রাতে খাওয়া যাবে। এখন বরং কুটিরে পৌঁছার সূচনা পথটা খুঁজে বের করি। কিন্তু এই সময়ে পথ খুঁজতে বেরুনো কি ঠিক হবে? আলো নিভে আসছে। অন্ধকার জঙ্গলে বাঘভালুক না থাক, সাপখোপ থাকতে পারে। নাহ, তার চেয়ে এখানেই রাতটা পার করি। কয়েক হাত সামনে মোটা গুড়ির একটা গাছ। ওটার সামনে আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। গাছটার দুটো শেকড় দুপাশে ছড়িয়ে মাঝে একটা খোপের মতো আসন সৃষ্টি করেছে। ওখানে লতাপাতা বিছিয়ে বসে পড়তে পারলেই সাক্ষাত বমজন হয়ে যেতে পারি একরাতের জন্য। বোধি বৃক্ষ হিসেবে অশ্বত্থের খ্যাতি প্রাচীনকাল থেকেই। এটা আসলে অশ্বত্থ তো? গাছটায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসলাম। এই আশ্রয়টা পেয়ে নিশ্চিন্ত লাগছে একটু।
.
৪.
আশ্রয়। অদ্ভুত একটা শব্দ। মানুষের জীবনটা অন্য প্রাণী থেকে একটা কারণে আলাদা। সেটা হলো আশ্রয়। মানুষের সব থাকলেও আশ্রয় না হলে চলে না। প্রত্যেক সুস্থ মানুষের দুটো করে আশ্রয় লাগে। একটা শারীরিক আশ্রয়, আরেকটা মানসিক। বেশীরভাগ মানুষ শরীরের জন্য আশ্রয় খুজে পায়, মনের আশ্রয়ের সন্ধানে সারাজীবন হন্যে হয়ে ঘুরে। তখন সে নিজেই জানে না সে কি খুজছে। ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে লাইটারে আগুন দিলাম। আয়েশে চোখ বুজে এল প্রায়। আহ পর্বতের নির্জনে অবশেষে।
.
কোথা থেকে যেন একটা আলো আসছে। মৃদু আঁচের আলোটা নেচে নেচে হাঁটছে। কে ওখানে? কেউ হাতে করে এক টুকরো আলো নিয়ে জঙ্গলের ঘন অন্ধকারে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেমন একটা নেশা জাগালো আলোর ছন্দটা। আলোটার উৎস খুঁজতে খুঁজতে আরো গভীরে চলে গেলাম। কিন্তু আলোটা যেন লুকোচুরি শুরু করেছে। আমি যতই কাছে যাচ্ছি আলোটা ততই দুরে চলে যাচ্ছে। আলোটাকে আমার ছুঁতেই হবে এরকম একটা অনিবার্য নেশায় পেয়ে বসেছে।
.
জঙ্গলের লতাপাতা এড়িয়ে ছুটছি এলোপাথাড়ি। ঢালুতে পা পিছলে পড়ে যেতে গিয়ে একটা গাছের ডাল ধরে কোনমতে সামলে নিলাম। আলোটাও এখন স্থির। ডিমের কুসুমের মতো মসৃন আভার একটা আলো। কেবল নিজেকে আলোকিত করে রেখেছে। সাপের মনি টনি নয়তো? ভয় লাগলেও নেশা ছুটলো না। আবারো ছুটতে গেলে কোথা থেকে চিকন তারের একটা পিন এসে তীরের মতো গলায় আমুল ঢুকে গেল। বিষাক্ত তীর। ব্যথায় এবং মৃত্যুযন্ত্রনায় চীৎকার করে উঠি।
.
৫.
নাহ মরিনি। লেখাটা ব্লগে দেবার জন্য বেঁচে আছি। জেগে উঠে টের পেলাম ওটা ছিল সেরিব্রাল ম্যালেরিয়াবাহী হুলডোজার মসকুইটো।
.
রাতে আর কোন বিপদ হয়নি। আশেপাশে প্রচন্ড ভনভন করলেও অডোমাসের কল্যানে হুলডোজার তীর বর্শা ছোড়েনি। বোতলের পানি দিয়ে চিড়ে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে রাতের ডিনার সেরে নিয়েছি। চায়ের বদলে কফিক্যান্ডি দিয়ে মুখের তিয়াস মিটিয়েছি। প্রচন্ড কুয়াশায় ভিজে যাবার দশা। ভাগ্যিস টাফেটা কাপড়ের একটা আউটওয়্যার ছিল, তা দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে নিয়েছিলাম। মাথায় চওড়া কার্নিশের ক্যাপটা খুব কাজে দিয়েছিল। তবে শীতের তীব্রতা টের পেয়েছে নাক আর চোখদুটো। ওগুলো ঢাকতে পারিনি কিছু দিয়ে।
.
রাতের পরিবেশটা আমার মতো লোকের জন্য বর্ণনাতীত। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস্য মনে হবে না। বিচিত্র শব্দগুলো ৩ ডি সাউন্ডের মতো মাথার চারপাশে বনবন করতে থাকে। খানিকক্ষণ শোনার পর ছন্দটা বোঝা যায়। হাজার লক্ষ পোকামাকড়ের আজব শব্দের তানে এমন একটা উল্লাস সৃষ্টি হয় যা পৃথিবীর মধুরতম সঙ্গীতকেও হার মানাবে। মুগ্ধ হয়ে সেই শব্দের মাঝে হারিয়ে যাই। ভয়, বিস্ময়, রহস্য এই ব্যাপারগুলোর একটা অদ্ভুত সমাহার ওই শব্দের গুঞ্জরনের মধ্যে খুজে পাওয়া যায়। প্রতিটি শব্দ আলাদা করে বোঝা যায়। ওরা নিজেদের মধ্যে কেমন একটা ঐক্যতান সৃষ্টি করে নিয়েছে।
.
৬.
ভোরে ঘুম ভাঙলে নিজেকে মেঘের রাজ্যে আবিষ্কার করি। আমি আর আমার আশ্রয়দাতা গাছ বাদে বাকী জগত অন্ধকার। না ঠিক অন্ধকার নয়। আলোর আভা আছে। এই আলোটা কেবল পাচ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। তার বাইরে কোন জগতের অস্তিত্ব নেই। তবে এই জগতে আমি ছাড়াও আরো কিছু প্রাণি আছে। রাতের পোকামাকড়ের শব্দগুলো বদলে গিয়ে নানা জাতের হাজারো পাখপাখালীর শব্দ ভেসে আসছে অদৃশ্য কোন স্থান থেকে। ওরা আমকে দেখছে না, আমি ওদের দেখছি না। চারদিক কেবল সাদা সাদা সাদাময় জগত। নেই কেবল ছায়া। আমার ছায়া নেই আশ্রয়দাতা গাছের ছায়া নেই, ভুতরাজ্যের বাসিন্দা হয়ে হঠাৎ এক বিজাতীয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠি। যে নির্জন একাকীত্বের বাসনায় এই পর্বতে আসা যেন সেটার সন্ধান পেয়ে গেছি।
.
পেছনে সরসর শব্দ শুনে গাছটির উল্টোপিঠে তাকাতেই দেখি গলায় লালের আভা নিয়ে একটা সবুজ গিরিগিটি আমার কাছ থেকে একফুট দুরে নিষ্পলক চেয়ে আছে। ছেলেবেলায় এই নিস্পলক চাউনিকে এত ভয় পেতাম যে গিরিগিটি দেখামাত্র গুলতির আদেশ ছিল। গলার ওই লাল রং নাকি মানুষের রক্ত থেকে আসে। গিরিগিটি চোখ নিয়ে মানুষের রক্ত গিলে খায় দুর থেকে এরকম একটা কঠিন বিশ্বাসে বহুকাল আবদ্ধ ছিলাম। আজ সেই রক্তচোষা গিরিগিটিকে এই অরণ্যে একমাত্র বন্ধুর মতো মনে হলো। পৃথিবীতে আমি আর গিরিগিটি বাদে আর কেউ নেই। সে তো এই অরন্যের নাগরিক আমি নিতান্তই ইমিগ্রান্ট।
.
বললাম, বন্ধু নেবে আমাকে তোমার সাথে? আমার কথা শুনেই যেন লজ্জিত গিরিগিটি সুরুত করে লাফ দিয়ে নেমে গেল গাছ থেকে। জগতে আবারো আমি একা। তখনই গাছের কান্ডে ছুরি দিয়ে কাটা দাগগুলো দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে দেখি ওগুলো দাগ নয়। ওটায় লেখা আছে AVIK.
.
৭.
তার মানে অভীকদের দলটা এদিকেই গিয়েছিল। গন্তব্যের খুব বেশী দুরে নেই ভেবে আনন্দে আরেকটা লাফ দিলাম। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে মেঘগুলো সরে গিয়ে সমস্ত উপত্যকাটা উন্মুক্ত হলো। সূর্যের দেখা নেই এখনো। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে ভীষণ। ওই কুটিরে একটা স্টোভ কিংবা চুলো থাকার কথা। সাথে টিব্যাগ আর কফিপ্যাক আছে। চা কফি বানিয়ে আয়েশ করে খাওয়া যাবে।
.
পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে যাত্রা শুরু হলো। এবারে খুব বেশী খুঁজতে হলো না। ঠিক রাস্তায় এগিয়েছি। আধঘন্টা হেঁটেই পৌঁছে গেলাম সেই কুটিরে। ছোটখাট একটা বেড়ার ঘর। বাঁশের মাচার উপর বানানো। যেখানে পাহাড়টা ঝুপ করে নেমে গেছে অনেক গভীর খানে তার কিনারায় দুটো গাছের গুড়ির সাথে দড়ি দিয়ে আটকানো একটা ঝুলন্ত বারান্দার মতো ঘর। উপরেও বেড়ার ছাউনি। দরোজা বলে কোন বস্তু নেই। যে ফোকর দিয়ে কুটিরে প্রবেশ করতে হয় ওটা কেবলই একটা বাঁশের ফোকর। ঘরের এককোনে দুটো চাটাই। আরেক কোনায় সত্যি সত্যি একটা কেরোসিন স্টোভ।
.
কেউ কি থাকে এখানে? এই স্টোভ রাখলো কে? চাটাই আর স্টোভ ছাড়া আর কোন আসবাব নেই। যেদিকে শংখ নদী বয়ে গেছে অনেক নীচ দিয়ে সেই দিকটাতে আগাগোড়া বেড়ার চৌকোনো ফোকড়। চাইলে শুয়ে শুয়েও উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কেবল একটা জিনিস অস্বস্তি লাগে, পায়ের নীচের বেড়ার মচমচ শব্দ। পর্বতের এই নির্জনতার গাম্ভীর্যকে একটু ক্ষুন্ন করছে এই শব্দ। নিথর নির্জন এলাকা বলেই ছোট্ট শব্দকেও বহুদুর বয়ে নিয়ে যায় বাতাস।
.
আপাততঃ নিরুপদ্রপ কয়েকটা দিন। খাবারদাবারে সমস্যা হবে বলে ইনস্ট্যান্ট খিচুড়ীর কয়েকটা প্যাকেটের সাথে, আচার, সস, বাদাম, টোষ্ট, পনির ইত্যাদি খিদে নষ্টকারক শুকনো খাবার এনেছি ব্যাগে করে। কেবল পানিটা সমস্যা হতে পারে। কিন্তু মাইলখানেকের মধ্যেই শংখ নদীটা। দুই লিটারের বোতলে করে দৈনিক একবার আনলেই হবে। আসার পথে বুনো জাম্বুরা আর পেপে গাছে ঝুলন্ত ভক্ষনযোগ্য ফল দেখা গেছে। কলাগাছের সন্ধান করেছিলাম, এখনো চোখে পড়েনি।
.
সারাদিন এখানে সেখানে আনাড়ী ট্রেকিং করে মতো কাটালাম। সন্ধ্যার পরপর কুটিরে ঢুকে গেলাম। খিচুড়ি রান্না করলাম। খেয়েদেয়ে আর সময় কাটে না। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না। যদিও মোম আছে। তারচেয়ে এই ঘরে জোনাকিটা ঢুকে আলো করে দিক। ‘গ্রেভ অব ফায়ারফ্লাইস’ ছবিটাতে ছো্ট্ট মেয়েটি লুকোনো বাংকারে মশারির ভেতর জোনাকীর আলো মেখে ঘুমিয়েছিল। দৃশ্যটা আমি ভুলতে পারি না। কিন্তু এখানে জোনাকীরা ঘরে আসছে না। অদুরে অন্ধকার জঙ্গলে লক্ষকোটি তারকার মতো জ্বলছে।
.
ক্লান্তিতে ঘুম এসে গিয়েছিল কখন। মাঝরাতে মচমচ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভুমিকম্প হচ্ছে পাহাড়ে? এত নড়ছে কেন কুঁড়েটা? ভেঙ্গে পড়ে যাবে নাতো? কুঁড়ের চালের উপর যেন গজব নেমেছে।
.

স্বাধীন সংবাদপত্র

সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসবো, আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভোরের তরতাজা দৈনিকের পাতায় চোখ বুলাবো এই সামান্য শখটা দিবাস্বপ্নই থেকে গেল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সকাল সোয়া সাতটার ট্রেন ধরার দৌড়, আর এখন সাড়ে সাতটার চাকরীর দৌড়ে ভোরের পত্রিকা পড়ার সাধটা শিকেয় তোলাই থেকেছে।

শুক্রবারে আনন্দটা পাওয়া হতো কখনো সখনো। ছুটির একটা দিন। কিন্তু যে শুক্রবারগুলো পত্রিকার পাতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ দিত, সেই শুক্রবারগুলোও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকা পড়ার সেই তীব্র সাধটা আলগা হতে হতে কখন যেন মরে গেছে। আজকাল পত্রিকা হাতে নিয়ে শিরোনামটা দেখেই রেখে দেই। পত্রিকার প্রতি আগ্রহ হারানোর কারণ ভাবতে গিয়ে লেখাটা শুরু করলাম। সমস্যাটা কি পত্রিকার না পাঠকের?

একসময় পত্রিকার চরিত্র বিশ্লেষণ করা হতো কেবলমাত্র রাজনৈতিক মেরু দিয়ে। ডান, বাম কিংবা সুবিধাবাদী মধ্যম ইত্যাদি। ডান বা জামাতী লোক পড়বে সংগ্রাম/ইনকিলাব, বামধারার লোক সংবাদ, মোটামুটি মধ্যমধারা পড়বে ইত্তেফাক, আবার কট্টর আওয়ামী লীগ হলে বাংলার বাণী ধরনের পত্রিকা।

সংবাদপত্রের আসল বিপ্লব শুরু হয় এরশাদ পতনের পর। আজকের কাগজ নামে নতুন চেহারার একটা পত্রিকা আসে বাজারে এবং সম্পূর্ণ নতুন ধারার প্রচলন করে পত্রিকায়। প্রচলিত ফরমেটের পত্রিকা বদলে গিয়ে সৃষ্টি হয় কলামিষ্ট ধারার। মাঝখানের বিশাল দুটি পাতা বরাদ্দ কয়েক রকমের কলামিষ্টের জন্য। নিউজের চেয়ে ভিউজ প্রাধান্য পেতে থাকে পত্রিকায়। মানুষ নতুন আগ্রহ নিয়ে পত্রিকা পড়তে শুরু করে।

কিন্তু মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হঠাৎ একদিন মালিক সাংবাদিক বিরোধে আজকের কাগজ ভেঙ্গে গেল। পত্রিকা থেকে মূলধারার অংশটি বেরিয়ে ভোরের কাগজের জন্ম দিল। পাঠক কিছুদিন হতবাক হলেও অল্প সময়ে ভোরের কাগজও দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। আমরা জানতে পারি ব্যবসায়ী কাম রাজনীতিবিদ সাবের হোসেন চৌধুরী এই পত্রিকার মালিক। এই প্রথম সংবাদপত্র একটা কর্পোরেট শক্তির ছোঁয়ায় আসে। সেই সময় আরেক কর্পোরেট পত্রিকা জনকন্ঠও ব্যাপক জনপ্রিয় পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

আজকের কাগজের ভাঙ্গনের মহামারী কিছুকাল পর ভোরের কাগজেও ফাটল ধরায়। এবারো মালিক সাংবাদিক দ্বন্দ্ব। কর্পোরেট ছোঁয়া থেকে দূরে থাকার জন্য বিদ্রোহী সাংবাদিকগন নতুন একটা স্বাধীন নিরপেক্ষ পত্রিকা গড়ার ঘোষনা দেয়। আসে প্রথম আলো।

ভোরের কাগজের সাদাকালোর গাম্ভীর্য ছাড়িয়ে সম্পূর্ন রঙিন প্রথম আলো। শোনা গেল এবার দেখা যাবে সত্যিকারের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা। পূর্বে যাদের চারখানা পত্রিকা পড়ে সত্য জানতে হতো, তাদের এখন একটি পত্রিকা পড়লেই চলবে। এমনকি কিছু জামাতী লোকজনকেও দেখা গেল প্রথম আলোর ভালত্বে আগ্রহ প্রকাশ করতে। কেউ ভাবলো, বাহ বাকশাল আমলে এরকম একটা পত্রিকা থাকলেই তো ল্যাটা চুকে যেত।

কিন্তু প্রথম আলোর ওই রঙিন যাত্রা যে সাংবাদিকতার কর্পোরেট যাত্রা তা আমজনতার জানা ছিল না। আরো কয়েক বছর যাবার পর বাজারে আরো নতুন নতুন পত্রিকা বের হবার সংবাদ এলো। প্রত্যেকে সত্যের প্রতি নির্ভীক ও নিরপেক্ষতার অঙ্গীকার করে যাত্রা শুরু করলো। দরিদ্র পেশা থেকে সাংবাদিকতার উত্তরন ঘটলো এক্সিকিউটিভ পেশায়। নতুন পত্রিকা এলেই পুরোনো দৈনিক থেকে লোকক্ষয় হবে, বেশী বেতনে যোগ দেবে সদ্যপ্রকাশিত পত্রিকায়, এটাই হয়ে গেল নিয়ম। একসময় এসে দেখা গেল শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার তালিকায় যে নামগুলো দেখা যায় তার সবগুলোর পেছনে কোন না কোন ধনবান শিল্প প্রতিষ্ঠানের সরাসরি সাইনবোর্ড বসানো আছে। কোন পত্রিকাই আর এতিম নয়। শুধুমাত্র সংবাদ প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলো হারিয়ে যেতে থাকলো। শীর্ষ পত্রিকাগুলো হয়ে উঠলো গোত্রপতিদের মুখপত্র।

অদৃশ্য অভ্যুত্থানে পত্রিকার নিয়ন্ত্রন সাংবাদিকদের হাত থেকে চলে যায় বসুন্ধরা ট্রান্সকম কিংবা যমুনার হাতে। তাই কোন সংবাদ বিক্রিত হয় আর কোন সংবাদ বিকৃত হয় আমাদের জানা হয় না। কোন পত্রিকার সাংবাদিক কতটা স্বাধীন সেটাও আমাদের জানা নেই। কিন্তু আমরা এটা স্পষ্ট বুঝি যে সংবাদপত্র ব্যাপারটা আর সাংবাদিকদের হাতে নেই। ফলে প্রথম আলো কখনো ট্রান্সকম গ্রুপের বিপক্ষে লিখবে বা, কালের কন্ঠ কখনো লিখবে না বসুন্ধরার দুর্নীতি, কিংবা যুগান্তর লিখবে না যমুনার কোন অনিয়ম। ওরা কেবল অন্যের দুর্নীতি অনিয়ম খুঁড়ে বের করবে, আর নিজেদের রাখবে নিষ্পাপ নিরপেক্ষ।

আর তাই, যদিও এখনো শুক্রবার আসে, আধোঘুমে শুনি দরোজার নীচ দিয়ে আলগোছে পত্রিকা ঠেলে দিচ্ছে নবীন হকার। কিন্তু দৌড়ে গিয়ে পত্রিকা তুলে নিয়ে পড়ার গোগ্রাস আগ্রহ খুঁজে পাই না আর। পুরোনো অভ্যেসে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে তাজা ঘ্রানটা শুঁকে আলগোছে ভাঁজ করে রেখে দেই পাশের টেবিলে।

স্বাধীন সংবাদপত্র বিষয়টা সম্ভবতঃ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।

ইউনিপেটু্ইউ (UNIPAY2U), মানি মেকিং মেশিন নাকি ফাঁদ?

১.
দ্রুত বড়লোক হতে কে না চায়?

সবচেয়ে বেশী চায় স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত যারা প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশী আয় করে। ধরা যাক, আমি সেরকম একজন আবুল হোসেন। আমার মাসিক আয় ২৫০০০ টাকা। মাসিক খরচ ২০০০০ টাকা গিয়ে সঞ্চয় থাকে ৫০০০ টাকা। বছরে আমার জমে প্রায় ৬০০০০ টাকা। দশ বছরে জমবে ৬০০০০০ টাকা। তবু দেখা যায় এই টাকা দশ বছর জমিয়েও একটা গাড়ী কিনতে পারবো না, ততদিনে গাড়ীর দাম আরো বেড়ে যাবে এবং একশো বছর চাকরী করেও একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারবো না।

এখন আমার সামনে কেউ যদি একটা মুলো ঝুলিয়ে বলে ১ বছরে টাকা দ্বিগুন হবে তেমন একটা যাদুকরী মেশিন এসেছে, আমি মরিয়া হয়ে সেই মেশিনে টাকা ঢালার জন্য ছুটবো।

কারণ আমার ব্যাংকে আছে ৩ লাখ টাকা। তার অন্তত ২ লাখ টাকা এখানে খাটালে ২০১১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই অন্তত ১৯৯৭ মডেলের একটা টয়োটা কিনতে পারবো। আরেকটু দূর স্বপ্নে পাঁচ বছর চললে এই টাকা (২..৪..৮..১৬..৩২..৬৪) =১২৬ লাখ হয়ে যাবে এবং মাত্র পাঁচ বছরে আমি কোটি পতি!! টাকা বাড়ে গুনিতক হারে, কে না জানে।

সুতরাং বুদ্ধিমানের মতো ২ লাখ টাকা ইউনিপেটুইউর হাতে তুলে দিলাম।

২.
পুরোনো বাংলা সিনেমার একটা গান ছিল রুনা লায়লার কন্ঠে -"প্রেমেরই ফাঁদ পাতা ভূবনে, কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে......."। আজকাল প্রেমের ফাঁদ নেই আর, ভোগবাদী মানুষের জন্য এখানে সেখানে মোহনীয় টাকার ফাঁদ।

বেশ কিছুদিন ধরে ইউনিপেটু্ইউ (UNIPAY2U) নামে নতুন একটা ফাঁদের গল্প শুনে যাচ্ছিলাম নানা জনের কাছ থেকে। দ্রততম উপায়ে বড়লোক হবার প্রকল্পে যোগ দেবার জোর নিমন্ত্রন পাচ্ছিলাম। কিন্তু সহজ উপায়ে বড়লোক হবার ব্যাপারে গুরুর নিষেধাজ্ঞা থাকাতে পাত্তা দেইনি। কিন্তু গতকাল এমন একজনের কাছ থেকে এর গুনগান শুনলাম যার কথাকে আমি গুরুত্ব দেই। তিনিও বললেন এটা 'ওয়ার্ল্ডওয়াইড' কোম্পানী। শুনে একটু নড়ে চড়ে বসলাম। ভাবলাম অন্ততঃ একটু সাইবার ভ্রমন হোক।

ক্লিক করি unipay2u.com ওয়েব সাইটে। ঢুকে দেখলাম ওয়েবসাইটটিতে মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ভারত, বাংলাদেশ, দুবাই, নেপাল, চীন এইদেশগুলোর আলাদা ট্যাবে মিরর ওয়েবসাইটের মতো তৈরী করা আছে। সবার শেষে আছে ইউনিগোল্ড টু ইউ ট্যাব। এটি ব্লিংকিং করে চোখ মারছে সোনালীর রঙে। বড়শির ছিপের ফাৎনার মতো মনে হলো জিনিসটা। এতগুলো দেশের তালিকা দেখেই প্রথমে ভড়কে যায় বাঙালী। মনে হবে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী। মাল্টিন্যাশনাল মানে বিশ্বাসী, টাকা পয়সার বটগাছ ওরা। সবগুলো লিংক কাজ করছে না দুবাই এবং চীন এরর দেখায়।

বাকীগুলো বাদ দিয়ে, খালি বাংলাদেশের অংশে মন দিলাম। প্রথম পাতার নীচের দিকে দেখি দুটো সার্টিফিকেটের রঙিন স্ক্যানকপি দেয়া আছে। সম্ভবতঃ বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর স্বার্থে। বাঙালী আবার সার্টিফিকেট জাতীয় বস্তুর খুব ভক্ত।

একটা সার্টিফিকেট জয়েন্ট স্টক কোম্পানীর ইনকরপোরেটেড সার্টিফিকেট, আরেকটা হলো আমদানী সার্টিফিকেট(IRC) যাতে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আমদানী সীমা দেয়া আছে।

এই কোম্পানী ১৫ লক্ষ টাকার কী আমদানী করার সার্টিফিকেট নিল? বছরে শতকোটি টাকার আমদানী সার্টিফিকেট হলে না হয় বুঝতাম স্বর্ন আমদানীর লাইসেন্স পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের FOREIGN EXCHANGE REGULATION ACT, 1947 ACT NO. VII অনুযায়ী সরকার কাউকে স্বর্ন আমদানীর লাইসেন্স দেয় না। তাছাড়া দেশে যে কোন ধরনের আর্থিক ব্যবসা করার জন্য লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেরকম কোন অনুমতিপত্র দেয়নি ওরা সাইটে। থাকলে নিশ্চয়ই একটা খেলো আমদানী সার্টিফিকেট দিয়ে পাবলিকের চোখে চশমা পরাতো না। তাহলে ব্যাপারটা কি?

তারপর একটু টেকি বিষয়ে খোঁজ খবর নিলাম। ওয়েবসাইটের হোষ্ট ও আইপি বিষয়ক তথ্যগুলোতেও বেনামী থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করলাম, যেটা সন্দেহকে আরো গাঢ় করে তুললো। আইপি বিষয়ক তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আছে বলে এখানে প্রকাশ করলাম না। কিন্তু যে কেউ http://www.ip-adress.com/whois অথবা http://www.dnsstuff.com এ গিয়ে সার্চ দিয়ে তথ্যগুলো দেখে নিতে পারবেন।

সব মিলিয়ে মনে হয় বড় ধরনের ঘাপলা আছে কোথাও। কি সেই ঘাপলা? যারা ফাঁদে পা দিয়েছে সবাই তো অশিক্ষিত না। সরকারের চোখের সামনেই তো ঘটছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার কি অপেক্ষা করছে কখন মানুষ রাস্তায় নেমে 'সব নিয়ে গেল রে' বলে বুক চাপড়ে কাঁদবে? মধ্যবিত্তের সামান্য সঞ্চয়কে ছেঁকে নেবার ফাঁদ পাতার সুযোগ আর কতকাল দিয়ে যাবো আমরা?

নাম তার রূহী দাস, পরিচয় পোষাক কর্মী, এখন সে হিমঘরে!

খুব কষেই দৌড়টা লাগিয়েছিলাম। দাঁতমুখ খিঁচে, প্রাণটা আক্ষরিক অর্থেই হাতে নিয়ে।

হেঁটেই ফিরছিলাম। কিন্তু পেছনের একটা দলকে ধাওয়া দিল পুলিশ। ভাঙচুর করছিল ওরা। তাড়া খেয়ে আমার পেছন পেছন ছুটে আসছিল। আমার দৌড় দেবার কথা না হলেও দিতে হলো। দৌড় না দিলে ওদের ধাক্কায় শত পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে যাবো। স্রোতের বিপরীতে থামা যায় না। আবার ওরা আমাকে পিষ্ট না করে পেরিয়ে গেলেও বিপদ। পুলিশ আমাকে মুরগী বানাবে। ধরে নেমে আমিও সেই দলের একজন। পুলিশের পিটুনী সহ্য করার মতো বয়স নেই এখন। তার চেয়ে খানিক দৌড়ে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

দোষী না হয়েও ছুট দিলাম তাই। ছুটতে গিয়ে টের পেলাম বয়স হয়েছে। এই পঞ্চাশে হাঁটুতে অত জোর নেই। তারুণ্যের সাথে ছোটার সময় পেরিয়ে গেছে। তবু জনস্রোতটা আসার আগে পেরিয়ে যেতে হবে ওই গেট, তারপর একটা রেল লাইন, রেল লাইন পেরিয়ে কয়েকশো গজ যেতে পারলে মহাসড়ক, তারপর মুক্তি। ছুটছি, হাঁপাচ্ছি, ছুটছি। নিঃশ্বাস বড় হচ্ছে, বুকে ব্যাথা লাগছে, হাঁটুতেও। উপায় নেই। পুলিশাতংক তার চেয়েও গভীর।

বেতন বাড়ানো নিয়ে আন্দোলন। নতুনদের বেতন বেড়েছে ৮০% কিন্তু পুরোনোরা একই জায়গায়। যেমন আমি। দশ বছর চাকরী করে আমার বেতন ৬ হাজার টাকা। তবু নতুন স্কেল নিয়ে নিয়ে কোন অসন্তুষ্টি নেই। অল্পে তুষ্ট মানুষ আমি।

মামুনেরও আপত্তি নেই। ২২ বছর বয়সী মামুন দুই মাস আগে যোগ দিয়েছে আমাদের কারখানায়। তার বেতন সাড়ে ২১০০ থেকে এক লাফে বেড়ে ৩৩০০ হয়েছে বলে সে খুব খুশী।

কিন্তু কালাম ক্ষিপ্ত। ২৮ বছর বয়সী কালাম তিন বছর ধরে কাজ করছে। দক্ষ শ্রমিক হিসেবে খ্যাতি আছে তার। তার বেতন এখন ৩৫০০টাকা। তিন বছর কঠোর পরিশ্রম করে এই বেতনে এসেছে। বেতন বৃদ্ধির কথা শুনে আসছিল বেশ কয়েকমাস থেকে। কার কতো বাড়বে জানা ছিল না। কালাম শুনে এসেছে এবার ৫০-৮০% বেতন বাড়াতে পারে মালিক। সেরকম হলে তার বেতন হয়ে যাবে কমপক্ষে ৫০০০ টাকা। অনেক টাকা! বড়লোক হয়ে যাবে সে।

মালিকের লস হবে বলে ওরা একটু আফসোসই করছিল। আবার অতি বুদ্ধিমান কেউ কেউ বলছিল, মালিকের লস নাই, বড়জোর লাভ কম হবে। মালিকের অনেক টাকা। লাভ কম হলে সমস্যা নাই। তাদেরই দরকার বাড়তি টাকা। এই মাস থেকে দেড় হাজার টাকা অতিরিক্ত গোনার অধীর অপেক্ষায় থাকে কালাম। মামুন তার হেলপার। ছেলেটা ভালো। চটপটে। কথা বললে শোনে। গুরুমান্য করে তাকে।

তিনদিন আগেও মামুন বলছিল, ওস্তাদ, এবার বেতন পাইলে আমারে সিনেমা দেখাইতে নিবেন, কথা দিছেন গতমাসে। কালাম মুচকি হেসে বলে, শুধু সিনেমা না, তোরে বিরানীও খাওয়ামু।

বেতনের দিন টাকাভর্তি খামটা হাতে পাবার পর বুক ধুকপুক ধুকপুক কালামের। খাম খুলে টাকা গুনে। একবার, দুবার, বারবার। ভ্রু কুঁচকে যায় তার। এদিক সেদিক তাকায়। অন্যদের দেখে। তারাও গুনছে। হিসেব মেলে না। কোথাও একটা ভুল হয়েছে। টাকা ভরতে গিয়ে কয়েকটা নোট ভুলে পড়ে গেছে হয়তো। অফিসে কমপ্লেন করে আসতে হবে। কিন্তু খামের উপর ছাপানো অংকটাও কি ভুল? ওখানে জ্বলজ্বল করছে ৩৮০০ টাকা। আশেপাশে কালামের সমকক্ষ যারা, তাদের মুখও শুকনো।

ওদিকে নতুনদের উল্লাস। ঈদের আনন্দে কোলাকুলি করছে। মামুন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কালামকে। ওস্তাদ, চলেন আপনারে আগে আমি সিঙ্গাড়া খাওয়াই। তারপর আপনার সিনেমা।

কিন্তু কালাম তখন অবশ হয়ে আছে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় মামুনের দিকে। মামুন বলে, কি হইছে? কালাম আস্তে করে খামটা দেখায়। মামুনেরও ভ্রু কুচকে যায়। আশে পাশে তাকায়। দেখা গেল নতুনদের উল্লাসটা আস্তে আস্তে কমে গিয়ে কেমন থমথমে হয়ে আছে পরিবেশটা। কোথাও তাদের ফাঁসানো হয়েছে অংকের খেলায়। অফিসে গেল একজন একজন করে। ফিরে এলে জানা গেল, নতুনদের বেতনের ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা থাকলেও পুরোনোদের কি হবে সেরকম স্পষ্ট কোন নির্দেশনা ছিল না। তাই মালিকপক্ষ পুরোনোদের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবু গড়ে তিনশো টাকা করে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে সবার বেতন। কিন্তু প্রণোদনা ভাতা এই মাস থেকে বাতিল করা হয়েছে। মাসিক প্রণোদনা ভাতা ছিল ৩০০ টাকা। প্রত্যেকদিন উপস্থিত থাকলে এই ভাতা দেয়া হতো। তার মানে পুরোনোদের বেতন ৩০০ টাকা বেড়েছে, আবার অন্যদিকে ৩০০ টাকা কমেছে। বেতন বাড়িয়েছে বলে এই তামাশার মানে কি?

কালামরা মেনে নিতে পারে না এই প্রহসন। কাজ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে যায় ওরা। পেছন পেছন বেরিয়ে যায় সহমর্মী মামুনেরাও।

আমি মালিকের বিশ্বাসী কর্মচারী, সবাই বেরিয়ে গেলেও আমি যাইনি। যার নুন খেয়েছি তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে পারবো না। বেতনে না পোষালে চাকরী ছেড়ে দিব। কিন্তু কিছুক্ষণ পর টের পায়, বাইরের অবস্থা খারাপ। বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে গন্ডগোলের খবর আসছে। ভাঙচুর শুরু হয়েছে। মিছিলের পর মিছিল। ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দুরে ধোঁয়া দেখতে পাই। পোলাপানের এসব আন্দোলন ভাঙচুর ভাল্লাগে না আমার। তোদের না পোষাইলে চইলা যা। জোর করে তোরে এই বেতনে চাকরী করতে বলছে কেউ? যত্তসব। বিরক্ত লাগছে আমার।

এগারোটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে ফ্যাক্টরী ছুটি ঘোষণা করা হয়। এইটা শুনে ভালো লাগে আমার। আইনতঃই বাড়ী যেতে পারবো এবার। বেআইনীভাবে কালামদের সাথে বেরিয়ে গেলে মনটা অপরাধে খচখচ করতো। এখন বাইরের হাজার গন্ডগোলেও মাথাব্যাথা নাই। যার যেদিকে খুশী যাক। আমি বাড়ী যাবো। নগদ বেতন পকেটে। সুপ্রিয়া বলছিল এবার বেতন পেলে ওকে একটা টাঙ্গাইল শাড়ী কিনে দিতে। ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া তন্নী আবদার করছিল 'বাবা আমাকে একটা নতুন সুয়েটার কিনে দিও'। বলেছিলাম দেবো, কিন্তু কেনার সময় পাচ্ছিলাম না। কারখানা ছুটি হতে হতে মার্কেট বন্ধ হয়ে যায়। আজকে একটা ভালো সুযোগ। পকেটে টাকাও আছে, সময়ও যথেষ্ট।

হেলেদুলে চলছিলাম। চারপাশের এত উত্তেজনা আমাকে স্পর্শ করছে না। এসবের সাথে আমার কোন সংযোগ নাই। সুপ্রিয়া আর তন্নীর জন্য আর কি কেনা যায় ভাবতে ভাবতে নিজের জন্যও কি কেনা যায় ভাবছি। অনেকদিন কিছু কেনা হয় না। সুপ্রিয়া বলছিল, আমার হাতে একটা ঘড়ি থাকলে নাকি খুব মানাতো। তার টাকা থাকলে কিনে দিত। ঠিক আছে রিয়াজুদ্দিন বাজারের ফুটপাত থেকে না হয় একটা ঘড়ি কিনেও নেয়া যাবে এক-দেড়শো টাকায়।

ইপিজেডের প্রথম গেটটা আরেকটু সামনেই। তাড়াটা এসেছিল একদম আচমকাই।

এখনো ছুটছি। ভাবছি আর ছুটছি। ছোটার গতির চেয়ে ভাবনার গতি বেশী। হঠাৎ কেমন আতংক ভর করলো। যদি পুলিশের হাতে পড়ি? কিন্তু আতংকটা গতি বাড়াতে পারলো না। হাঁটুতেও জোর দিল না। পা দুটো কেমন অনিচ্ছুক মনে হলো। ছুটতে ছুটতে হাঁপানি বেড়ে গেল। আর পারছি না। দম টাইট হয়ে আছে ভেতরে। চারদিক ঘুরছে কেন। ওই তো রেললাইন। ওটা দিয়ে এখন ট্রেন চলে না। রেল লাইন বেয়ে চলে যাবো? নাকি সোজা যাবো। সোজা গেলে পুলিশের ট্রাকের সামনে পড়বো না? বাম দিকে মোড় নেবো না ডানদিকে?

আর পারছি না। ডান বাম কোথাও যাওয়া হলো না। একটা ইটের কোনায় ঠোক্কর খেয়ে পড়ে গেলাম রেল লাইনের উপরে। ভাগ্য ভালো মাথাটা বাঁচলো। উঠে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু উঠতে পারছি না কেন? দুই হাত অবশ লাগছে। পা দুটোও। ব্যাথা নয়, বেদনা নয়। কেমন অচেনা অবসন্নতা সমস্ত শরীর জুড়ে। বুকের ভেতর শিনশিন করছে।

পেছনের মিছিল পুলিশ আগুন আন্দোলন ভাঙচুর সব ভুলে গিয়ে ছোট্ট তন্নীর অপেক্ষমান মুখটা ভেসে উঠলো। কী অবাক হয়ে যেত আজকে বাবাকে অসময়ে বাড়ী ফিরতে দেখলে। কখনো ফেরেনা বাবা দিনের বেলা। কতো আফসোস সোনাটার। ওকে অবাক করতে এত আনন্দ আমার! এত আনন্দ! কতোদিন ওকে ওরকম অবাক করা হয় না!

মিছিলের ছেলেগুলো আমার আশপাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু অলস আমি শুয়ে আছি রেললাইনে মাথা দিয়ে যেই রেল লাইন দিয়ে গত বিশ বছরেও কোন ট্রেন আসেনি। অবসন্নতা কেটে যাবার বদলে আরো যেন গভীর হয়ে এল। আমার বগলে হাত দিয়ে কে যেন টেনে তোলার চেষ্টা করছে মনে হলো। কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছি না, চোখের পাতাটা ঢাকা। কেবল টের পেলাম মাথার উপর জ্বলতে থাকা সূর্যটা মাঝদুপুরেই নিবে গেল।

[পাদটীকাঃ এটি নেহাতই একটি গল্প। সাম্প্রতিক সিইপিজেড ঘটনায় নিহত স্যাম সুপিরিয়র অ্যাপারেলের নিহত শ্রমিক রূহী দাসের সাথে গল্পের রূহীদাসের কেবল দুটো মিল আছে। দুজনেই শ্রমিক সংঘর্ষের সময় মারা গেছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এবং দুজনের কেউই পুলিশের গুলি খায়নি]

আমিন বকশীর তিন অপছন্দ

আমি একজন অসাধারণ মানুষ। আমার কোন তুলনা হয় না। আমার কোন প্রতিপক্ষ নাই। আমি নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ। নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আমি নিজেকে তীব্ররকমের অপছন্দ করি।
.
প্রথম অপছন্দ...... আমার নামটা। আমার গভীর বিশ্বাস জন্মকালে আমার নামকরনের ব্যাপারটা একটা ষড়যন্ত্র কিংবা অবহেলার ফসল।
.
প্রত্যেক পরিবারে সন্তানের নাম রাখে পিতামাতা। কিন্তু আমার নাম রেখেছিল আমার মেজফুপা। মেজফুপার সাথে বাবার সাপ নেউলের মতো একটা ভালোবাসা ছিল বলে এই নামকরনের ব্যাপারটা আমাকে সন্দিহান করে তোলে। আমি বিশ্বাস করি, শত্রুতা করেই আমার নাম রাখা হয়েছে আমিন বকশী। দরিদ্র পিতামাতা ধনী ফুপার প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে পারেনি বলেই নিমরাজী হয়েছিল বলে মনে করি। ত্রিশের দশকে জন্ম হলে না হয় মেনে নিতাম নামটা। কিন্তু সত্তর দশকের শেষভাগে জন্মেও এরকম একটা নাম বহন করার ভার যে কতো কঠিন সেটা একজন ভুক্তভোগীই জানবে।
.
নাম মানুষকে বড় করে না, মানুষই নামকে জাগিয়ে তোলে। কথা সত্য। কিন্তু এই নামের কারণে আমাকে কতো জায়গায় ভুগতে হয়েছে!! বাল্যকাল থেকে আমাকে শোনানো হয়েছে আদিমযুগে আমার নামে একজন পূণ্যবান ব্যক্তি ছিল এই এলাকায়। তার নামে নামটা রাখা হয়েছিল আমার। আমি বিশ্বাস করি ওটা ডাহা মিছা কথা।
.
আমার নামের দুইটা অংশ। দুই অংশেই আমি কোন ভালো জিনিস পাইনি। এই নামের যত লোক দেখেছি তাদের সব ছাপোষা কেরানী নয়তো পিয়ন দারোয়ান চৌকিদার। তাই ছেলেবেলা থেকেই নাম নিয়ে একটা হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে বড় হয়েছি। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে চুপ থাকতে পছন্দ করতাম। ইচ্ছে হতো নামটা বদলে অন্য কিছু রাখি। আমার এক কাজিন মেট্রিক পাশ করার পর নাম বদলে ফেলে। তার নাম ছিল আবদুল কুদ্দুস, বয়স ষোলতে পৌঁছে সে হয়ে যায় 'আকাশ আবেদ'। নিজেই নিজের নাম পাল্টে দিয়েছে। সে কারণ দেখায়, কবিদের সুন্দর নাম থাকতে হয় এবং আকিকা ছাড়াই নাম বদলে রাখার সুযোগ আছে কবিতার স্বার্থে। জগতে কেউ সেটার বিরোধিতা করে না।
.
কিন্তু আমি কবিতা লিখতাম না। ফলে আমার নাম বদলানোর সুযোগও ছিল না। জন্মমাত্র ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে। ছাত্রজীবনে কোন মেয়ে প্রেম করতে আসেনি এই নামের কারনেই। এমনকি মেয়ে ক্লাসমেটরাও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো নামটাকে। ফলে অনেকটা গুটিশুটি মেরে ভার্সিটি পার করি। পাশ করার পর যা হবার ছিল তাই হয়েছে। একটা সদাগরী অফিসের কেরানীর চাকরীই জুটলো যদিও রেজাল্ট একেবারে খারাপ ছিল না। কিন্তু বকশী নামের কারনেই বোধহয় ভালো কোন কোম্পানী নিল না আমাকে।
.
আমার দ্বিতীয় অপছন্দ........আমার হাসিটা। আয়নায় আমি নিজের হাসি দেখলে চমকে উঠি। বিধাতা এ কি হাসি দিয়ে পাঠিয়েছে আমাকে? দেখতে তো আমি নেহাত খারাপ না। চেহারাটা ফর্সা গোলগালই। মাথায় ঘনকালো চুল। নিয়মিত প্যারাসুট নারিকেল তেল দেই। কিন্তু যেই আমার হাসি পায়, আমার দুই ঠোট এবং দাঁতের মধ্যেকার দুরত্বটা কেমন যেন বেফাঁস বেড়ে গিয়ে দাঁতের পাটি, মাড়ি আর দুই ঠোঁটের একটা বহুমাত্রিক বিষমভুজ তৈরী হয় যা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা বিভৎসতা তৈরী করে মুখমন্ডলে।
.
একবার একটা মেয়ে মুখ ফুটে বলেই দিয়েছিল, "আপনি হাসবেন না বকশী ভাই, হাসলে আপনাকে হনুমানের চেয়েও জঘন্য লাগে। তবে গম্ভীর মুখে আপনি শাহরুখ খানও হতে পারেন।"
.
বুকে পাথর চেপে মেনে নিয়েছি এবং দ্বিতীয় বাক্যটা শান্ত্বনা বলেই ধরে নিয়েছি। সেই থেকে আমি হাসি ঠাট্টার আসর এড়িয়ে চলি এবং রুমাল বহন করি পকেটে।
.
আমার তৃতীয় অপছন্দ......আমার হাঁটা। আমি যখন হাঁটি আমার সাথে সাথে যেন পৃথিবীটা দুলে। এটা আমার কথা না, ছেলেবেলায় এক বন্ধু বলেছিল। সে আমার ঠ্যাং দুটো পরীক্ষা করে বলেছে, ওগুলোর হাড্ডি নাকি ঈষৎ গোলাকারে বাঁকানো। ফলে আমি দুধার কাঁপিয়ে হাঁটি, সাথে সাথে দুনিয়াও নাকি এপাশ ওপাশ করে। ব্যাপারটাকে আমি সম্মানিত ভেবে অনেকদিন কাটিয়েছি। ফুটপাতে লোকজন আমাকে দেখলে সসম্মানে রাস্তায় নেমে যেত। ধরে নিতাম ওরা আমাকে কেউকেটা ভাবছে। মার্কেটের আয়নায় নিজের হাঁটা গম্ভীর ভাবে পরখ করতাম গোপনে। বাহ, দুই হাতের সাথে দুই পায়ের ছন্দে একটা মিল। খান্দানী লাগে বুঝি। নিজের গোপন প্রশংসায় আপ্লুত।
.
একদিন সেই খান্দান ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল যখন ভার্সিটিতে সহপাঠি তানভীর বললো, "তোর হাঁটাটা বদলানো দরকার দোস্ত, তোরে একদম নাদানের মতো লাগে। দুই হাত ওরকম দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটিস কেন?"
.
আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো। তাকে বারবার জিজ্ঞেস করা হলো ঠাট্টা করছিস, নাকি সত্যি বলছিস? সে একই উত্তর দিল। তারপর রাকিবকে স্বাক্ষী করে, আরো পাঁচজনের আড্ডায় স্বীকার করা হলো আমার হাঁটাটা নিতান্ত হাদারামের হাঁটা। কোন ভদ্র শিক্ষিত ছেলে এভাবে দুহাত দুলিয়ে হাঁটেনা। এটা বদলানো উচিত।
.
সেদিন থেকে হাঁটাহাঁটি চরম অপছন্দ হয়ে গেল আমার। পারতপক্ষে হাঁটিনা। মাইলের পর মাইল হাঁটা মানুষ এখন রিকশায় উঠে যায় একশো হাত যাবার জন্যও। নিউমার্কেটে আয়নাওয়ালা দোকান আছে প্রচুর। আয়না দেখে দেখে আলগোছে চেষ্টা করেছি নিজেকে শুদ্ধ করতে। কিন্তু আমিন বকশীর হাত পা মাথা নোয়াবার নয়। তার হাত দুটো হাঁটার ছন্দে দুলতেই থাকে। পা দুটো নাচতেই থাকে। চুপি চুপি ভাবতে থাকি, অন্যরা হাঁটার সময় তাদের হাত দুটো কোথায় রাখে? ঝুলিয়ে হাঁটে নাকি সুতলিতে বেঁধে রাখে? আর পা দুটো?
.
নিজেরে নিয়ে এই তিন অপছন্দের ভেতরে বিব্রত জীবন যাপন করি। আর ভাবি, এখনকার কোন কবি কেন বলে না, আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতেও কেউ কেউ এই ধরনীতে আসিয়াছে।

তৃষ্ণা

তটা বয়স চলে গেলো, তবু কি আশ্চর্য, আজো কী জানলাম/ চড়ুইয়ের ঠোঁটে কেন এত তৃষ্ণা?/ খড়ের আত্মায় কেন এত অগ্নি, এতটা দহন?/ গোলাপ নিজেই কেন এত কীট, এত মলিনতা নিয়ে তবুও গোলাপ?

এতটা বয়স চলে গেলো, তবু কি আশ্চর্য, আজো কী জানলাম/একটি শিশুর কেন এত নিদ্রা, এত গাঢ় ঘুম আর/তখন আমরা কেন তার মতো ঘুমুতে পারি না?
(আদিজ্ঞান / আবুল হাসান)


জামাল হাবীবের ঠোঁটটা নড়ছে মৃদু। কিন্তু কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। পাশেই অরুনের স্ত্রী পাপিয়া দাঁড়ানো। বলছে, “বাবা তুমি কিছু খাবা? অ্যাই, বাবাকে একটু ডালিমের রস দাওতো। বাবার তেষ্টা পেয়েছে বোধহয়।“


অরুন গিয়ে ডালিমের রস এনে মুখে তুলে দেয়। অল্প মুখের ভেতরে যায়, বাকীটা বাইরে।


২০ বছর আগে চাকরী থেকে অবসর নেবার পর থেকে প্রায় ১৮ বছর সচল ছিলেন। গত দুবছর ধরে নানান জটিল রোগের কারণে হাসপাতালে আসা যাওয়া চলছিল। কাজ হয়নি। গত তিন মাসে শেষ অবস্থায় চলে এসেছে। কথাবার্তা কিংবা লোকজন চেনা বন্ধ হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোন অভিব্যক্তি নেই। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে।


বাসায় রেখে সেবা যত্নে অসুবিধা হয় বলে বাড়ীর পাশে নার্সিং হোমে রাখা হয়েছে। স্বচ্ছল মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষ আশ্রয়।


আত্মীয় স্বজন মানসিকভাবে প্রস্তুত যে কোন মধ্যরাতের একটা টেলিফোনের। দু দুবার মাওলানা ডেকে তাওবা পর্যন্ত পড়ানো হয়েছে। কিন্তু জামাল হাবীবের প্রানবায়ু কি করে যেন এখনো আটকে আছে। ঘনিষ্টতম মানুষেরাও বিরক্তিতে ভুগতে শুরু করেছে।


পুত্রকন্যারা সেবা যত্ন করতে করতে ক্লান্ত। তারাও বিশ্রাম চায়। আট পুত্রকন্যা আর তাদের সন্তানেরা গত তিন মাস পালা করে ডিউটি দেবার পর আজ যখন শুনলো একটু ভালো লাগছে, তখন বাড়ী ফিরে গেল কেউ কেউ। বুঝলো জামাল হাবীব এবারও ঘরেই ফিরবেন।


অরুন বাবার কনিষ্ঠ সন্তান। চাকরীর হাজার ব্যস্ততার পরেও নার্সিং হোমে প্রতিদিন ডিউটি দেয়। একমাত্র অরুনই বাবার অসুস্থতা নিয়ে একটুও বিরক্ত হয়নি। সে সত্যি সত্যি চায় বাবা আবার সুস্থ হয়ে উঠুক।


বাবার ঠোঁট নড়া থামছে না। বাবা কি কিছু বলতে চায়? কাছে গিয়ে বাবার মুখের কাছে কান পেতেছে কয়েকবার। কিন্তু কোন শব্দ নেই। কেবল নড়ছে ঠোঁট দুটো। “পানি খাবে বাবা? নাকি ডাব? বলো বাবা”। ফিসফিস করে অরুন। এটা সেটা মুখে দিয়ে চেষ্টা করে।


কিন্তু বাবা কিছুতেই সন্তুষ্ট হচ্ছে না। বাবার চাওয়াটা বুঝতে অক্ষম হলো বলে অসহায় দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরে অরুন। বাবা কি চায়? এত ঘন ঘন ঠোঁট নাড়ছে কেন বাবা? পানি দেয়া হলো, ডাব দেয়া হলো, ফলের রস দেয়া হলো, কিছুই নিচ্ছে না।


তিনটি মাস বাবা একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। কি খাবে, কেমন লাগছে, কোথায় অসুবিধা হচ্ছে, কিছুই বোঝার উপায় নেই। বাবা কিছু চাইতে ভুলে গেছে। কিন্তু আজ বাবার ঠোট নড়ছে খুব বেশী। চোখটা নাড়াচ্ছে উপর নীচ। কি চায় বাবা?


জামাল হাবীবের কোন অনুভূতি অবশিষ্ট নেই। প্রায় সব ইন্দ্রিয় অকেজো। কেবল একটা বোধ জেগে আছে। সেই বোধটার নাম বোধহয় তৃষ্ণা। জলের তৃষ্ণা নয়। অরুণকে একটি বার ছুঁয়ে দেবার তৃষ্ণা। একটি বার অরুণের হাতটা বুকে চেপে ধরার তৃষ্ণা। একটি বার অরুণের আদর পাবার তৃষ্ণা। যে স্পর্শ দিয়ে অরুণকে তিন দিন বয়সে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছে, সেই স্পর্শের তৃষ্ণা জেগে উঠেছে এতকাল পরে। জীবনে তিনি কখনো কিছুর লোভ করেননি। কিন্তু আজ এই স্পর্শের লোভ পেয়ে বসেছে তাঁকে।


বড় হবার পর অরুণকে আর আদর করা হয়নি তাঁর। এসএসসি দেবার পর অরুণ যেন অনেক বড় হয়ে যায়। গত পঁচিশ বছর অরুণকে আর সেভাবে কাছে পায়নি। আজ খুব ইচ্ছে করছে শেষবার অরুণের ছোঁয়া পেতে বুকের মাঝখানটিতে। অন্ততঃ একবার অরুন তাকে জড়িয়ে ধরে বলুক, বাবা আমি তোমাকে ভালোবাসি।


কিছুই করা হয় না। কিছুই বলা হয় না। কেউ বোঝে না জামাল হাবীব কি চায়। অরুনও না।


জামাল হাবীবের শরীরটা একটু কেঁপে ওঠে। কাঁপতে থাকে গলার কাছটা। গরগর শব্দ হতে থাকে। সবাই ছুটে যায় বিছানার কাছে। অরুন তার হাতটা বাবার হাতে রাখার সাথে সাথেই বোধহয় শেষ নিঃশ্বাসটা নির্গত হয়ে গেল। সে পাগলের মতো বাবার পালস খোঁজে। নেই।


ডুকরে কেঁদে ওঠার আগে অরুন খেয়াল করে বাবার ডান চোখের কোনে একফোঁটা অক্ষম শিশির।

ধরা

আহাদুলের ভুলটা তুচ্ছ হলেও ধরাটা হলো কঠিন। ঘটনাটা এরকম।

পাশাপাশি দুটি দোতলা বাড়ী। নির্জন আবাসিক এলাকা। কাছাকাছি আর কোন প্রতিবেশী নেই। দুটো বাড়ীতেই মালিক দোতলায়, ভাড়াটিয়া একতলায়। ফারজানারা এলাকায় নতুন। আহাদুলরা মোটামুটি পুরোনো।

ফারজানার সাথে চোখাচোখিটা হয়ে গেল বাড়ীতে ওঠার দিনই। আহাদুলের নজর প্রথমে ফারজানা কেড়েছে নাকি ফারজানার নজর আহাদুল কেড়েছে আমরা জানি না। আমরা কেবল জানি ফারজানা নিকটস্থ বালিকা বিদ্যালয়ে দশম শ্রেনীতে পড়ে। আর আহাদুল ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির জন্য অপেক্ষমান। পরিবেশ পরিস্থিতি অনূকুলে থাকায় ব্যাপারটা এগিয়ে গেল।

এগিয়ে গেলেও ব্যাপারটা ঠিক পাখা মেলতে পারছিল না ফারজানার বাবার হিটলারী মেজাজ এবং তাঁর কঠিন অন্তঃপুর নিয়ন্ত্রণের কারণে। যোগাযোগ প্রতিবন্ধকতা দুরীকরনে ওরা বেছে নেয় রাতের ছাদ। ছাদ দুটো সমানে সমান দশ ফুটেরও কম দুরে। সপ্তাহে অন্ততঃ তিনদিন, সমস্ত পাড়া যখন ঘুমিয়ে, ওরা তখন ছাদে। পদ্ধতিটা অভিনব । চিঠি লিখে কাগজটা পাথরে মুড়ে ছুঁড়ে দেয় একজন। লুফে নেয় অন্যছাদের আরেকজন। নিরুপদ্রপই ছিল মাঝরাতের ইনিংস।

ঝামেলা হলো সেদিনই প্রথম।

রূপালী জ্যোৎস্নার রাত। সেই আলোতে নীরবে ভাষা বিনিময় করছে দুটি হৃদয়। কিন্তু কি করে যেন আহাদুলের চিঠির ঢিলটা হাত ফসকে ছাদের কার্নিশে ঠোক্কর খেয়ে নীচে পড়ে গেলো। ঠিক সেই সময় নীচের গ্যারেজের সামনে এক চোর ফারজানাদের নির্মানকাজের পরিত্যক্ত রডগুলো দড়ি বেধে দেয়াল টপকানোর জন্য দাড়িয়ে ছিল। পাথরটা পড়বি তো পড় চোরের মাথায়। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে ব্যাথা পেয়েও চোর ব্যাটা নিশ্চুপ!

সেই চোরটা ছিল পাড়ার মুখচেনা ছিঁচকে দলের একজন। যারা দিনের বেলায় অন্য কাজে থাকে, রাতের বেলা পার্টটাইম চুরি করে বেড়ায়। আহাদুল ছাদের কিনারে গিয়ে ঢিলটা কোথায় পড়েছে উঁকি দিতেই সেই চেনা চোরের সাথে চোখাচোখি। সড়ক বাতির হালকা আলোয় আহাদুল ও চোর দুজন দুজনকে দেখে চিনলো।

তবু সমস্যা হতো না যদি চোর ব্যাটা অন্য ছাদের কিনারে দাঁড়ানো ফারজানাকে না দেখতো। ফারজানাকে দেখে মনে মনে হিসেবটা মিলিয়ে পাথরটা কুড়িয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে গেল সে।

পরদিন সকালে সেই চোর ফারজানাদের গেটের সামনের গোবেচারা কামলা। আগাছা সাফ করছে বসে বসে। ফারজানার বাবা অফিসে বেরুবার মুখে ছুটে গিয়ে আহাদুলের চিঠিটা হাতে দিয়ে বললো, “চাচা বাড়ীর সামনে কাজ করতে গিয়ে পেলাম। দরকারী কাগজ বোধহয়।”

ফারজানার বাবা ভাঁজ খুলে চিঠি পড়ে হুংকার দিয়ে আহাদুলের বাসায় গিয়ে হাজির। আহাদুলের বাবা ঘটনা শুনে অপমানে লাল হয়ে গেল। ক্ষেপে গিয়ে ঘুমন্ত আহাদুলকে কান ধরে হিড় হিড় টেনে আনে বসার ঘরে। “অই হারামজাদা, এইটা তর চিঠি? তর লেখা? বল!!”

ভয়ে পাথর আহাদুল জানালা দিয়ে বাইরে দাঁড়ানো রাতের চোরটাকে দেখে বুঝলো ওই বদমাশটা কাল রাতে চুরি করতে না পারার প্রতিশোধ এভাবেই নিল।

তবে বিড়বিড় করেও যে কথা তার মুখ দিয়ে বেরুলো না ভয়ে তা হলো “আংকেল, কাল রাতে ওই ব্যাটা আপনাদের বাসায় চুরি করতে এসেছিল, আমিই ঢিল মেরে তাকে তাড়িয়েছি।”

বলতে পারেনি কারন সেই ঢিলকে জড়িয়ে ধরে ছিল কড়কড়ে প্রেমের পত্রটি।

ইনডোর স্টেডিয়াম

সিটি গেট থেকে বাসটা ছাড়ার পরপরই টাকমাথা গোলগাল চেহারাটা ঘুরলো আমার দিকে।

চেহারা দেখে চমকে উঠি। এই তো সেই মুখ। একেই তো খুঁজছি এতদিন। লোকটা চেনে না আমাকে। তবু তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড, চোখে চোখ নয় কপালের ইঞ্চিখানেক উপরের চকচকে জায়গাটার দিকে। স্বগোত্রীয় বলে কথা।

তার লক্ষ্য আমার চকচকে টাক হলেও আমার লক্ষ্য তার গোলাকার খোমা। মাথার উপর আমার এই সমৃদ্ধ চকচকে বিরান ভূমির জন্য জন্য দায়ী এই খোমার মালিক। বহুবছর ধরে খুঁজছি তাকে।

"হেয়ার এন্ড কেয়ার" কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের স্টিকারে এই খোমা মালিকের পাশাপাশি দুটো ছবি ছাপানো থাকতো। 'তিনমাস আগে' ছবিতে চকচকে টেকো মাথা, 'তিনমাস পরে' ছবিতে সুন্দর সিঁথি দেয়া ঝকমকে চুলো মাথা। বিজ্ঞাপনে মুগ্ধ হয়ে হেয়ার এন্ড কেয়ার কোম্পানীর অফিসে গিয়ে নগদ ২৫০০ টাকা দিয়ে তিনমাসের বটিকা নিয়ে আসি। বিয়ে ঠিক হয়েছিল এক কেশবতী কন্যার সাথে, তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম এক কেশবান যুবক স্বামীর।

বিয়ে করলাম। কিন্তু ছমাস যাবার পর সর্বনাশের চেহারা দেখা গেল। গ্যালারীতে যে কিছু চুল অবশিষ্ট ছিল তাও উড়ে গেল অব্যর্থ বটিকার গুনে। ছিলাম গ্যালারী স্টেডিয়াম, হয়ে গেলাম পরিপূর্ণ ইনডোর স্টেডিয়াম। মারমুখী হয়ে ছুটলাম হেয়ার এন্ড কেয়ার কোম্পানীতে। কিন্তু পাখি উড়ে গেছে। কাউকে পাওয়া গেল না ওই ঠিকানায়।

সেই থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি ওই কোম্পানী কিংবা এই মাথার মালিককে। হতে পারে সে মডেল বা মালিক, তার মুন্ডু চেটে ওই কোম্পানীর ঠিকানা বের করবো। আমার আড়াই হাজার টাকা!!!

বাস চলছে আর মনে মনে তার মুন্ডু চটকাচ্ছি। ভীড় বাড়তে থাকলো নয়া বাজার ফেলে আসার পর। এই বাস নিউমার্কেট পর্যন্ত যাবে। ভীড়ের ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখছি কোথায় নামে লোকটা। ঝিমুনি আসছে এত গরমেও। চোখ খোলা রাখা দায় হয়ে পড়েছে।

কিছুক্ষণ পর ভীড়ের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, লোকটাও ঝিমোচ্ছে। কি কি বলতে হবে মনে মনে ডায়লগগুলি কল্পনা করছি।
-ভাই কেমন আছেন
-আপনাকে চিনলাম না
-আপনার এই টাক আমি চিনি
-জী, আমি মডেল ছিলাম একসময়
-জী দেখেছি আমি। তা এইটা আপনার তিনমাস আগের মাথা, তিনমাস পরের মাথাটা গেল কই?
-হে হে, আর বলবেন না ভাই, আগে পরে সব সমান। পরচুলা।
-সব সমান না, আপনার পরচুলার জন্যই আমার মুন্ডুর আজকের এই দশা
-মানে?
-দাঁড়াও ব্যাটা মানে বোঝাচ্ছি তোমাকে, তোমার বাবার কোম্পানীর ঠিকানা দাও............

কলারটা চেপে ধরার মুহূর্তেই কল্পনাটা আছাড় খেল যখন বাসটা একটা রাইডারের পাছায় মাঝারি ধাক্কা দিয়ে থেমে গেল। রাইডারের হেলপার দৌড়ে নেমে এসে বাস ড্রাইভারের কলার ধরে ঝুলে পড়েছে। শুরু হলো হৈ হৈ। বাসে রাইডারে মারামারি কাড়াকাড়ি। বাস আর যাবে না। যাত্রীরা দুদ্দাড় নেমে যাচ্ছে।

যার যেখানে খুশী যাক, আমি ছাড়ছি না টেকোকে। কিন্তু কই? লোকটা গেল কই। ওই তো সামনেই...... দরোজা দিয়ে একটা চকচকে মাথা নামছে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাই দরোজার দিকে।

এ্যাঁ......একী? এ তো সেই লোক নয়। অথচ এই মাথার দিকেই তো তাকিয়ে ছিলাম গত আধঘন্টা! কিন্তু খোমা আর শার্ট তো মেলে না। এই টেকোর শার্ট বাদামী, ওটার ছিল সাদা। ভীড়ের মধ্যে টাকটাই নজরে ছিল, শার্টটা ছিল না।

সাদা শার্ট মাঝপথে নেমে গেছে, আর সাথে করে নিয়ে গেছে আমার ২৫০০ টাকা উদ্ধারের আশা।

অমূলক

বিকেলটা হাসছিল। চাহিবামাত্র রিকশা পেয়ে যাওয়ায় নীতুও। রোদ কমে গেছে। হেমন্তের সূর্যে তাপ নেই।

রিকশাটা গলিতে ঢুকতেই চেইনটা পড়ে গেল। রাস্তার একপাশে থেমে গেল। পেছনে গিয়ে চেইন টানাটানি করছে রিকশাওয়ালা। জায়গাটা নির্জন। এঁদো গলি। কোন বাসাবাড়ি নেই এদিকে। দুপাশে আধভাঙ্গা দেয়াল।

নীতু বুঝে ফেলেছে কেন চেইনটা পড়ে গেল হঠাৎ। যে কোন সময় একটা সিএনজি টেক্সী এসে দাঁড়াবে পাশে। পিস্তল/চাপাতি/ ক্ষুর হাতে তিন-চার যুবক নেমে দাঁড়াবে দুপাশে। হাতব্যাগ আর গলার কানের চেইন-দুল টানাটানি করবে।

এরকমই হবার কথা। রাস্তায় কোন লোকজন থাকে না এরকম সময়ে। থাকলেও কেউ ফিরে তাকায় না।

রিকশাওয়ালা তখনো চেইন টানাটানি করছে। নীতু জানে এসব অহেতুক সময়ক্ষেপণ। ঠিক সময়ে ওরা এসে হাজির হবে। হাতের ব্যাগটা আগেভাগেই আলগা করে ধরে রাখে যাতে বিনা আয়াসেই নিয়ে যেতে পারে। কেবল ওড়নাটা ঠিক করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে জড়োসড়ো। শীত লাগছে অথচ ঘাম দিচ্ছে।

নন্দনকাননের দিক থেকে সবুজ সিএনজিটা এগিয়ে আসতে দেখলো। ভেতরে তিনজন তরুন। কাছাকাছি এসে থেমে গেল সিএনজি। ঠিক যেরকম হবার কথা। মাথা নীচু করে বসে আছে ব্যাগের উপর হাতটা আলগা করে। ব্যাগ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত সে, তবু ধমকে দেবে ওরা, 'চুপ্! কথা বললে লাশ ফেলে দেবো।'

সিএনজি থেকে গলা বের করে একজন বললো, 'অ্যাই!'

ওদিকে তাকাতে ভরসা পাচ্ছে না সে।

সেই গলা আবারো হাঁক দিল, ''অ্যাই রিক্সা, কি হইছে?'

রিকশাওয়ালা বলে, 'চেইন পইড়া গেছে, লাগাইতে পারতেছি না।'

ওই গলাটা আবারো বলে, 'চেন লাগবে না, হাতে টেনে চলে যা, এই জায়গা ভালো না।'
বলেই সিএনজিটা সাঁই টান দিয়ে চলে গেল।

রিকশাওয়ালা চেইন ছেড়ে হ্যান্ডেল ধরে টেনে চালাতে থাকে দ্রুত। গলি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে এখুনি।

এতক্ষন চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ফেললো নীতু।

আজীব মুক্তিযোদ্ধা!!

সেই ছাত্রত্ব কালের কথা। এক সন্ধ্যায় পাড়ার ঝুপড়ি চা দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিছিলাম বন্ধুকে নিয়ে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পাশের টেবিলের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল বারবার। আধ ময়লা শার্ট পরা মাঝ বয়েসী একজন শ্রমজীবি মানুষ ওই টেবিলে বসা। কপালে ঘাম চিকচিক করছে তাঁর। লোকটা খুব মনযোগের সাথে যে কাজটা করছিন সেটাই দৃষ্টিকে টেনে নিচ্ছিল ওদিকে।

তাঁর হাতে একটা সিগারেট জ্বলছে। খানিক পরপর সেই সিগারেটের ছাইগুলো ঝাড়ছেন সামনে রাখা চায়ের কাপে। খালি কাপ না। চা ভর্তি কাপ। আবার সেই চায়ের কাপে চুমুকও দিচ্ছেন সুড়ুত সুড়ুত করে। সিগারেটের ছাই দিয়ে কাউকে চা খেতে দেখা সেই প্রথম। কৌতুহল দমন করতে না পেরে আমরা ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কি?

আমাদের কৌতুহল দেখে একটু আমোদই পেলেন যেন। হাসলেন। বললেন, অনেক দিনের অভ্যেস। এখন নেশা হয়ে গেছে। কতো বছর হবে? জানতে চাইলাম। বললেন, মুক্তিযুদ্ধের পরপর। 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটার উচ্চারণের দৃঢ়তার কারণেই বোধহয়, কৌতুহল আরো বেড়ে গেল। এই শ্রেনীর মানুষ মুক্তিযু্দ্ধ শব্দটা ঠিক এভাবে উচ্চারণ করে না। আরো এগিয়ে গিয়ে জানতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কোথায় ছিলেন?

আমার প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুচকে গেল তাঁর। একটু অবাক সুরে বললেন - কোথায় আবার, যুদ্ধে ছিলাম।

“যুদ্ধে ছিলাম” শব্দ দুটো আমার ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। কারণ নাটক সিনেমার বাইরে আমি কখনো কোন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা দেখিনি। এই প্রথম একজন মুক্তিযোদ্ধা দেখছি। এই সুযোগ হারাতে চাইলাম না। ধরে বসলাম যুদ্ধের গল্প শুনবো। একটু দোনোমোনো করেও শেষমেষ রাজী হলেন তিনি। বলছেন তিনি। শ্রোতা আমি আর বন্ধু।

যুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে ঘন্টা পেরিয়ে গেল। মগ্ন হয়ে শুনছি ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতার কথা। পাকি শিবির এমবুশ করার পর কচুরিপানার জঙ্গলে তিন দিন অনাহারে লুকিয়ে থাকার কথা। সঙ্গীদলকে পালাতে সুযোগ করে দিতে গ্রেনেড আর এলএমজি দিয়ে শত্রুর চোখে বিভ্রম তৈরী করা ইত্যাদি নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। তারপর সর্বশেষ অপারেশানে পিঠে গুলি খেয়েও শত্রুর কাছ থেকে বেঁচে ফিরে আসার কথা। বুকটা গর্বে ফুলে উঠলো আমার যখন পিঠের জামা উল্টিয়ে দেখালেন যেখানে গৌরবের ক্ষতটা জ্বলজ্বল করছে কুচকানো চামড়ার মধ্যে।

গল্প শেষ হলে জানতে চাইলাম – যুদ্ধের পর থেকে কি করছেন?

বললেন, আগে চাষবাস করতাম, এখন ঠেলাগাড়ী চালাই।

শুনে অবাক না হলেও দুঃখিত হলাম। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যিনি এলএমজি হাতে নিজের প্রাণটাকে তুচ্ছ করে যুদ্ধ করে লাল সবুজের পতাকাটা আমাদের জন্য উপহার দিয়েছেন, সেই মানুষটা পিঠে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে ঠেলাগাড়ী চালিয়ে জীবন কাটাবে এটাই নিয়তি?

ক্ষোভের সাথে বললাম - "আপনি দেশের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ করলেন, অথচ দেশ আপনাকে কিছুই দিল না? আপনার আফসোস হয় না?"

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা রমিজ হোসেনের জবাব আমার বিস্মিত হবার ক্ষমতাকেও হার মানালো।

“দেশ আমাকে কিছু দেবে কেন? শেখ সাহেবের ডাকে যুদ্ধে গেছি। দেশের জন্য যুদ্ধ করছি। যুদ্ধ শেষ, দেশ স্বাধীন হইছে। আমার কাজ শেষ। আমি দেশের কাছ থেকে আর কিছু চাই না। আমার কাজ আমি করি। যা আছে তাতেই খুশী”

আমি আর কথা বাড়াবার সাহস পেলাম না। ঘাড়টা আপনা আপনি নীচু হয়ে গেল আমার। দেশে এত আজীব মুক্তিযোদ্ধাও আছে!

×××××× ××××××× ××××××

গতকালের পত্রিকায় দেখলাম ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে কিছু লোক সরকারী চাকরীর সুবিধা নিয়েছে জালিয়াতি করে। খবরটা শোনার পর থেকে একজন সাধারণ ঠেলাওয়ালা রমিজ হোসেনের সেই কথাগুলো দেড়যুগ পাড়ি দিয়ে এসে মগজের ভেতর খট খট করছে।

ডিজিটাল আহম্মকি!!!

মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল সকালবেলা।

হাতে কাজ কম ছিল আজ। ভাবলাম কিছু ওয়েবসাইটে ঘুরাঘুরি করি। বহুদিন সরকারের ওয়েবসাইটের প্রতি নজর দেই না। এই সরকার আসার পর একবারও সরকারের প্রধান ওয়েবসাইটে যাই নি। কেবল একবার উঁকি দিয়েছিলাম টিয়া রঙের পতাকাটা এখনো আছে কিনা দেখতে। লজ্জাই লাগতো খোদ সরকারের ওয়েবসাইটে পতাকার কটকটে ভুল রং দেখে।

আজকে প্রথমে ঢুকে একটু আনন্দিতই হলাম, যাক ভুল পতাকাটা গেছে। ওয়েবসাইটের উন্নতি ঘটছে। নতুন পোর্টাল। অনেক নতুন ফিচার দেখা যাচ্ছে। একটা একটা ক্লিক করতে সময় লাগবে বলে প্রথম পাতাটাই আগাগোড়া নজরে আনলাম। সরকারের প্রতি খুব বেশী প্রত্যাশা নেই। তাই কেবল সাদা চোখে দেখবো। ক্রিটিকাল না হবার জন্য মনে মনে এই পণ করেছিলাম। কিন্তু নীচের দিকে গিয়ে একটা লিংকে ক্লিক করে ফট করে মেজাজ ফরটি নাইন হয়ে গেল।

প্রথম পাতার নীচের দিকে দুটো কলাম আছে। বামদিকে দেখা যাবে Know Bangladesh. যারা ক্লাস এইটের গ্রামার বইতে বাংলাদেশ বিষয়ক ইংরেজী রচনা মুখস্ত করেছিলেন, তাদের হয়তো খুশী লাগতে পারে মিল পাবেন বলে। কিন্তু আমি ইংরেজীতে খুব কাঁচা, রচনা মনে নাই, তবে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল অস্টাদশ শতকীয় ইংরেজীর ব্যবহার দেখে। তাও মাফ করে দিলাম, যে লিখছে তার বাপে হয়তো পিঠের উপর ঝাড়ু ভেঙ্গে সেই ইংরেজী শিখিয়েছিল যা আজো ভুলতে পারছে না।

বটম লাইন হলো, পর্যটক আকৃষ্ট করার মতো ন্যূনতম সহজ ভদ্র ভাষা আল্লাহ মাবুদ বাংলাদেশ সরকারের উপর নাজেল করে নাই। পর্যটনের ওয়েবসাইট নিয়ে আগে একবার লিখেছিলাম। তাই আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না।

অন্যদিকে যাই। ডান দিকে Video নামে এটা ট্যাব আছে। ওখানে তাকিয়ে দেখি এক বালিকা মোবাইল হাতে সবজী ক্ষেতে দাড়িয়ে আছে। সরল মনে ভাবলাম এটা Know Bangladesh এর ভিডিও ভার্সন। কিন্তু ক্লিক করতে শুরুতে যে টাইটেল ভেসে উঠে তাতে লেখা আছে e-Governece Service at doorstep

প্রথম দৃশ্যে দেখা যাবে একটা লাউ মাচার নীচে সবুজ শাড়ী পরা এক মহিলা কালো একটা গরুকে খড় বা খাবার যোগান দিচ্ছে। কাজ সেরে মহিলা পাশের একটা টং দোকানে গিয়ে মোবাইল কল দিয়ে কথা বললো স্বামীর সাথে। স্বামী কথা শেষ করে সাইকেল চালিয়ে জনমানবশূণ্য জরাজীর্ণ একটা গাছতলার হাটে এল। সেখানে গাছের সঙ্গে ব্ল্যাকবোর্ড টাঙিয়ে আলু পটলের দাম লিখে রেখেছে আরেক হাটুরে। তার পাশেই টিনের ছাপড়ায় হতদরিদ্র একটা টুল সর্বস্ব দোকানে ব্যানারে লেখা, ইমেইল ই-সেবা, ই-তথ্য, কম্পিউটার,ইন্টারনেট এইসব কথা।

বাঁশের মাচার সেই ঝুপড়িতে কম্পিউটার নিয়ে টুলে বসে আছে এক লোক। তার পাশে এক প্রৌঢ় কাগু বসা.......এইসব নিয়ে ৬ মিনিটের একটা VOB ডিভিডি ফরমেটের ভিডিও যার ডাউনলোড সাইজ ৪০০ মেগার মতো ( আমি ডাউনলোড করতে গিয়ে আবার বাতিল করলাম দানবীয় সাইজ দেখে। AVI কিংবা MPEG ফরমেটে যা ৩০ মেগার বেশী হতো না। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতাদের মধ্যে কত জ্ঞানী লোকের বিচরন এই ভিডিও তার একটা প্রমান)

টেকি বিষয় বাদ। কেবল ভাবতে থাকি, এই ওয়েবসাইট কাদের জন্য তৈরী করেছে সরকার? Know Bangladesh লেখা দেখে বোঝা যায় এই ভিডিওর টার্গেট বিদেশী ভিজিটর। তো, এই ভিডিও দেখে যদি বিদেশী কেউ বাংলাদেশকে জানে, তাহলে আমাদের সম্পর্কে কি ধারণা জন্মাবে তার? ভিডিও চিত্র যে দৃশ্যটা প্রকাশ করে তা হলো -

"এই দেশের প্রধানতম দৃশ্য হলো হত দরিদ্র রিক্ত নিঃস্ব গন্ডগ্রাম, পাহাড় সমুদ্র সব পোষ্টারেই আছে। এবং যেখানে কাঁচা মাটির রাস্তা দিয়ে সাইকেলে যাতায়াত করতে হয়, গরু বাদে আকর্ষণীয় কোন প্রাণী নেই। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য যে এত অভাবেও লোকের হাতে মোবাইল সুবিধা আছে। দরিদ্র মানুষের মোবাইল ব্যবহার দেখার জন্য বাংলাদেশে আসুন।"

অথচ বামদিকের Know Bangladesh ট্যাবে লেখা Bangladesh offers many tourist attractions, including archaeological sites, historical mosques and monuments, longest natural beach in the world, picturesque landscape, hill forests and wildlife, rolling tea gardens and tribes.

এই বর্ণনার একটা ফোঁটাও যদি ভিডিওতে থাকতো, তাহলেও কিছু বলতাম না। কিন্তু পুরো ভিডিওতে যা প্রকাশ পেয়েছে তাকে এক কথায় বলা যায় ডিজিটাল আহম্মকি।

সময় থাকলে ঘুরে আসুন
http://www.bangladesh.gov.bd

আহম্মকির এমন নজীর আর কতো বছর দেখতে হবে আমাদের?

একটি গ্রামীণফোন অভিজ্ঞতায় পাওয়া ডিজিটাল 'তেনারা'

অফিসেই ৯০% ইন্টারনেট ব্যবহার করি। ফাইবার অপটিকসের হাই ব্যান্ডউইথে পংখীরাজের মতো উড়ে উড়ে কাজ করা যায়। বাসায় ধীরগতির ইন্টারনেটে বিরক্তি লাগে বলে খুব জরুরী না হলে বাসা থেকে ইন্টারনেটে ঢুকি না। ওয়েব মেইল চেক করা, অফিসের কিছু টুকটাক অনলাইনের কাজ সারা, ব্লগ ফেসবুকে খানিক উঁকিঝুকি দেয়া বাদে আর কিছু করা হয় না। এই পরিমান ব্যবহারের জন্য মাসে ১ গিগাবাইট যথেষ্ট। সেই হিসেবে গ্রামীন ফোনের ১ গিগা লিমিটের ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম সাড়ে তিনশো টাকা দিয়ে। সুখেই ছিলাম।

একদিন ভুতে কিলালো।

অফিসের এক কলিগ পট্টি দিয়ে বললো, বস আপনার মতো লোকের মাসে ১ গিগা লিমিট, কেমন কেমন লাগে। আপনি আনলিমিটেডে চলে যান। আমিও আনলিমিটেড ব্যবহার করি। মাত্র পাঁচ ছয়শো টাকা বেশী যাবে। কিন্তু সারাটি মাস দুশ্চিন্তা মুক্ত। বিষুদবার রাতে টরেন্টে মুভি ডাউনলোড দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন, শুক্রবার জেগে উঠে নাস্তা সেরে দিনভর আরামসে মুভি দেখবেন।

ভদ্রলোকের মতো গ্রামীণ অফিসে গিয়ে বিধি মোতাবেক ফটো আইডি জমা দিয়ে নতুন সিম রেজিষ্ট্রেশান করালাম। পোষ্টপেইড আনলিমিটেড। বিল মাসে ৯৭৭ টাকা। তবে বিল পেতে কখনো দেরী হলে ফট করে যাতে লাইন কেটে না দেয়, সেজন্য বাড়তি এক হাজার টাকার ডিপোজিট রেখে দিলাম। স্মার্ট এক্সিকিউটিভ আশ্বাস দিল, বিল না দিলেও আপনার লাইন কাটার কোন ঝুঁকি নেই স্যার।

খুশী মনে বাড়ী ফিরলাম। কিন্তু মাস যায়, আমার টরেন্টে যাবার সময় হয় না। অফিসের মেইল, ব্লগ, ফেসবুক, জিমেইল এই তিনের বাইরে আর কোথাও যাবার সময় পাই না। ইচ্ছেও করে না। মাস গেলে বিল দেখি ৯৭৭ টাকা। কিন্তু আমার ইউসেজ ডাটা দেখি ৮০০মেগারও কম। মানে আমি এখনো ৩৫০ টাকার ভেতরেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছি। পরের মাসে মনে হলো খামাকা অপচয় করছি মাসে তিনগুন টাকা। ফিরে যাই ১ গিগা লিমিটে। ৩৫০ টাকার লাইনই যথেষ্ট আমার।

গেলাম গ্রামীণ অফিসে। স্মার্ট কাস্টমার সার্ভিস এক্সিকিউটিভ আমাকে ১ গিগা লিমিটের প্যাকেজে বদলে দিল। লাইন পোষ্টপেইড থাকবে। কেবল লিমিট বদল হলো। ভিন্ন প্যাকেজে। বিল আসবে, কিন্তু লাইন কাটবে না, কারন এক হাজার টাকার ডিপোজিট। ধন্যবাদ দিয়ে ফিরে এলাম।

প্রথম মাসে বিল এলো ৩১২ টাকা ইউসেজ ডাটা ১১২৯মেগাবাইট। বিল দিলাম। এই বিলটা ঠিক এসেছে।

কিন্তু দ্বিতীয় মাসের ১৫ দিন যাবার আগেই একদিন লাইনটা কাটা গেল। কাহিনীর শুরু এখানে। পরদিনই ছুটলাম গ্রামীণ অফিসে। বিলের প্রিন্ট নিলাম। তাজ্জব হয়ে দেখলাম পনের দিনের বিল দেখাচ্ছে ১৫৪৬ টাকা, ইউসেজ ডাটা ৮৪২ মেগাবাইট। বললাম, আমার তো তিনশো টাকার ১ গিগা লিমিট, এত টাকা কেমনে আসে? তাছাড়া আমার ডাটা ইউসেজ তো ১ গিগার কম দেড় হাজার টাকা কেমনে আসে? স্মার্ট এক্সিকিউটিভ জানালো কোথাও টেকনিক্যাল প্রবলেম হয়েছে, তাই এতটাকা বিল। ভয় নেই স্যার, আশ্বাস দিলেন তিনি। আমার কাছ থেকে ৫৪০ টাকা নিয়ে খুটখাট টাইপ করে লাইন চালু করে দিলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, আমার ১০০০ টাকা ডিপোজিট ঠিক আছে তো, তিনি বললেন, ঠিক হ্যায়। ৩৫০ টাকার জায়গায় ৫৪০ টাকা জমা দিয়ে তেতো মুখে বাসায় ফিরে এলাম।

তৃতীয় মাসে ১২ দিন যাবার আগেই একটা ওয়ার্নিং এলো। বলা হলো, আপনি সীমা অতিক্রম করবেন শীঘ্রই। বাঁচতে চাইলে টাকা জমা দিন। অতরাতে আমি কই টাকা জমা দেই।

ঘন্টা খানেক পরেই দুম করে লাইনটা কাটা গেল। আমি বোবা হয়ে গেলাম। মেজাজ চরমে উঠলো এবার। জরুরী একটা কাজের মাঝখানে লাইনটা অসভ্যের মতো কেটে গেল। রাত তখন সাড়ে দশটা। আমি দৌড়ে বাইরে গিয়ে রাস্তার পাশের দোকান থেকে আরেকটা সিম যোগাড় করে প্রিপেইডে চলে গেলাম। জরুরী কাজটা সারলাম।

কদিন পরে আগের বিল আসলো। দেখলাম ১৯৭০ টাকা!! মাত্র ১২ দিনের বিল। ইন্টারনেট ব্যবহার ১১৫২মেগা। বলা হলো পুরো টাকাটাই দিতে হবে, আমার ডিপোজিট হাপিস। ডাটার হিসেবে আমি ৩০০ টাকার সমপরিমান ১ গিগা ব্যবহার করেছি। কিন্তু বিল এসেছে ৬০০% বেশী।

এবার আর গ্রামীণ অফিসে লাইন দিতে মন চাইলো না। স্মার্ট এক্সিকিউটিভ এবারো নিশ্চয়ই 'টেকনিক্যাল এরর, ঠিক হয়ে যাবে' বলে পিঠে হাত বুলিয়ে ১৯৭০ টাকা আদায় করে বিদায় করে দেবে। তার চেয়ে বরং বিল খেলাপী হই। কতো মানুষ কতো কোটি কোটি টাকা হাপিস করে দেয় ব্যাংক থেকে নিয়ে। আমি না হয় একটি রাক্ষস বিল মেশিনের বিরুদ্ধে গিয়ে ১৯৭০ টাকার খেলাপী হলাম। বিল দিলাম না, গ্রামীন অফিসে গেলাম না।

এখন কদিন পর পর চিঠি আসে গ্রামীণ থেকে। আপনি কিন্তু সীমা লংঘন করেছেন বলে আপনার লাইন কেটে দিয়েছিলাম। অতি সত্ত্বর গ্রামীন অফিসে এসে পাওনা মিটিয়ে আপনার লাইন পুনরুদ্ধার করুন। আমি মনে মনে বলি, ধুত্তোরি, তোর লাইনের গুষ্টি মারি। সীমা লংঘন আমি করি নাই, তোমরাই ৩০০টাকার সীমানায় ফাটল ধরিয়ে ১৯৭০ টাকা ঢুকিয়ে দিয়েছো।

আপনারাই বলেন, আমার কি এখন ভদ্রলোক হওয়া সাজে?

ইদানীং সচলে তেনাদের গল্প আসছে খুব। ধরে নেয়া যেতে পারে এটাও গ্রামীণের তেনাদের কাজ। তেনারা আজকাল ডিজিটাল বিট বাইটেও হানা দিচ্ছেন। কোন পত্রিকা তেনাদের গল্প ছাপায় না বলে ব্লগই একমাত্র ভরসা। তেনাদের গল্প পত্রিকায় না ছাপানোর পেছনে কতোটা কর্পোরেট বন্ধুত্ব, কতোটা বিজ্ঞাপন বানিজ্য সেটাও একমাত্র তেনারাই বলতে পারবেন।

আগে বলা হতো, কাক কাকের মাংস খায় না। এখন সেটাকে বাড়িয়ে বলা যায়, কর্পোরেট কর্পোরেটের মাংস খায় না। তাই পত্রিকায় সব সংবাদ আসে না।

Saturday, December 11, 2010

বোকা কর্নার

চালাক মানুষের সংখ্যা কত বাংলাদেশে? এরকম কোন পরিসংখ্যান হয় না দেশে। চালাক বনাম বোকা মানুষের পরিসংখ্যান হলে চালাকেরা আওয়ামীলীগের চেয়েও বেশী সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাবে নিশ্চিত। কারণ আমি চারপাশে কোন বোকা মানুষ দেখি না। সবাই চালাক। কে কত চালাক এটা নিয়ে মানুষের প্রচ্ছন্ন গর্বও আছে।

তবে অতি চালাক লোককে জিজ্ঞেস করা হলে জবাব পাওয়া যাবে উল্টো।

সেরকম এক স্বঘোষিত বোকা (!) সহকর্মী প্রায়ই বলতেন, "আমার চেয়ে সরল আর বেকুব আল্লাহ আরেকটা বানাইছে, যারে আমি বিয়া করছি।" বউ ভক্ত এই বোকা(!) মানুষটা মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকা বেতনে দশ বছর চাকরী করে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ গড়েছিলেন। একসময় কোম্পানী তার বোকামি(!) টের পেয়ে খোদা হাফেজ জানিয়ে দিয়েছিল এবং আমার কানটা নিস্তার পেয়েছিল তার অবিরাম বোকামি আর সরলতার গল্প থেকে।

চালাক মানুষদের আমি ভয় পাই। কারণ জানি না। তবে অস্বস্তি হয় তাদের সাথে কথা বলতে। আমি তাই কোন অনুষ্ঠানে গেলে বোকা কর্নার খুঁজি। এমন একটা যুতসই জায়গা যেখানে চালাক মানুষেরা আড্ডা দিচ্ছে না। প্রায়ই খুব মুশকিল হয়ে যায় বোকা কর্নার পাওয়া। এদেশে চালাকের সংখ্যা অসহ্য রকমের বেশী। সব আড্ডায় চালাকির গল্প। কে কত চালাকি করে কোটিপতি হয়ে গেল, কে কত চালাকি করে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে কোটি টাকার গাড়ী অর্ধকোটিতে কিনলো, কে পাঁচ বছর আগে ভিখিরি ছিল, এখন শতকোটি টাকার মালিক, ইত্যাদির গল্প। সম্পদ প্রাচুর্যের গালগল্প আমার পোষায় না, কারন আমার ওসব কিছুই নাই, কখনো হবার সম্ভাবনাও নাই। আগ্রহও নাই। চাকরী ক্যারিয়ার নিয়ে আলাপও অপছন্দ করি কারণ তাতেও আমার উন্নতি নাই। কাজ করা দরকার করি, ব্যাস। তাই বরাবর যেখানে যাই আমি বোকা কর্নার খুঁজি।

সেদিন এক বিয়েতে গিয়ে চুপচাপ এক কোনায় বসে আছি। পরিচিত মুখ নেই তেমন। হঠাৎ পাশে এসে বসলো একজন। চালাকের কেউ কিনা শংকিত চোখে তাকিয়েও আস্বস্ত হলাম। নাহ, ইনি মোকারম ভাই। নিরেট বোকা। খুশীতে মোটামুটি জোরেসোরে হাত চাপাচাপি করলাম দুজনে। মুখ দেখে বুঝলাম তিনিও বোকা কর্নারের সন্ধানে ছিলেন।

কিন্তু আলাপ খানিকক্ষণ গড়ানোর পর মোকারম ভাই বললেন, "আমার জন্য একটা চাকরী দেখো। এটাতে পোষাচ্ছে না। সারাদিন বসে মাছি মারি। একটা কাজের চাকরী দরকার। আরো প্রেস্টিজিয়াজ। বেতন লাখের খানিক উপরে হলেই চলবে।"

আশ্চর্য! এই মোকারম ভাই না বাসায় চোর ঢুকেছে শুনে খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন? এতটাকা বেতনের চাকরী করেন, এত সুখের ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। আরো চাই আপনার? আপনিও চালাকের সারিতে যেতে চান? আমি জবাব না দিয়ে হতাশ ও বিরক্ত হয়ে হয়ে উঠে গেলাম। একটা বিড়ি খেতে হবে কোনার অন্ধকার বারান্দায় দাড়িয়ে। পেছন পেছন মোকারম ভাইও এলেন। বললেন "কি ব্যাপার কিছু বললা না?"

"দেখেন মোকারম ভাই, আমি খুব চালাক না হলেও মোটামুটি চরে খাই। তবু চাকরী বদলের স্বপ্ন দেখিনাই এখনো। আপনি তো এখনো চরতেও শেখেননি। আপনি কেমনে চাকরী বদলাবেন?"
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম।

কারণ মোকারম ভাই তখন কোটের ভেতর পকেট থেকে ছোট্ট একটা চ্যাপটা বিদেশী বোতল বের করে হাতের আড়ালে নিয়ে মুখে ঢালছেন। এই মানুষকে জীবনে সিগারেটে একটা টানও দেয়াতে পারিনি। আসলে বোকা কর্ণার থেকে অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

ভ্রমণ অভ্রমণের গল্প

চলো, একদিন দূরে কোথাও বেড়াতে যাবো।
.
না। ট্যুর, ট্রিপ, পিকনিক..... এসব না। এই সব প্রতিবছরই কোন না কোনভাবে হয়। কিন্তু তৃপ্তি হয় না। যেখানেই যাই মনে হয় বিয়ে বাড়ীতে নিমন্ত্রন খাচ্ছি। সেই একই ভ্রমন, একই পথে একই যাত্রা, চেনা রেস্তোঁরায় চেনা খাওয়া, চেনা হোটেলের চেনা বিছানায় ঘুমানো, চেনা সমুদ্রের চেনা ঢেউ গোনা, চেনা পাহাড়ের চেনা কুয়াশার ঘ্রান নেয়া।
.
এইসব ছেড়ে একদম আনকোড়া নতুন কোন জায়গায় বেড়াতে যেতে চাই। আগে কখনো দেখিনি এমন দৃশ্য দেখতে চাই, আগে খাইনি তেমন খাবার খেতে, আগে শুইনি তেমন বিছানায় ঘুমাতে, আগে দেখিনি তেমন পাহাড়ী ঝরনা দেখতে, আগে শুনিনি তেমন পাখির গান শুনতে চাই। যেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পৌছেনা, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের যন্ত্রনা কানে বাজে না, যেখানে টিপ টপ লোকজন সেজেগুজে বেড়াতে যায় না। দেশে হোক দেশের বাইরে হোক এই গ্রহের যে কোন একটা অচেনা অজানা জায়গায় গিয়ে মোটে সাতটি দিন চুপচাপ কাটিয়ে আসতে চাই।
.
দিবাস্বপ্ন হয়ে যায়?
.
তাও না। চাইলেই যাওয়া যায়। একটু সাহস সঞ্চয় করে সুশীলতা থেকে বেরুতে হবে। কোথাও কোথাও চেনা পথের আশেপাশেই তেমন অচেনা জায়গা আছে। বেরিয়ে পড়লেই খোঁজ মেলে। একসময় এরকম হুটহাট বেরিয়ে পড়া হতো। আমার সেই বাউন্ডুলে সঙ্গীগুলোকে মিস করি খুব। সব দূর থেকে দূরে চলে গেছে এখন।
.
কর্ণফুলী নদীর অনেক লেজ শাখা প্রশাখা এদিক সেদিক চলে গেছে খালের শেকড় বেয়ে বেয়ে। সেই দলটা কোন কোন দিন হুট করে ঘাটে গিয়ে একটা সাম্পান ঠিক করে মাঝিকে বলতাম তোমার যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাও। মাঝি তার ইচ্ছে মতো সাম্পান তাড়িয়ে অচেনা গ্রাম গঞ্জে নিয়ে হাজির হতো, বিচিত্র মানুষের সাথে দেখা হতো। একই দেশে কতোরকম জীবন যাত্রা।
.
একবার সুনসান নীরব একটা ঘাটে এসে সাম্পান ঠেকলো। একটা খালের বাঁক। পরিত্যক্ত একটা বাজারমতো। নামধাম চিনলাম না। জীবনেও এই গ্রামের নাম শুনিনি। সেই মধ্য দুপুরে নিথর একটা পথের পাশে ভাঙা বেড়ার একটা দোকান। পানি খাবো বলে ঢুকে পড়লাম আমরা। দুটো টুল সামনের দিকে, পেছনে একটা চুলোয় তরকারী হচ্ছে। মাছে সালুনের খিদা জাগানিয়া ঘ্রান। এক বুড়ো জুবুথুবু হয়ে রান্না করছে। শিম দিয়ে মাছের তরকারী।
.
বললাম, খাওয়া যাবে?
বললো, যাবে, আপনারা বসেন।
.
বুঝলাম এটা একটা ভাতের হোটেলও। হোটেলের চারদিকে প্রায় খোলা। পাঁচ ফুট বাই আট ফুট দোকানের সাইজ। ওই টুকুতেই বসা খাওয়া রান্নার জায়গা। একটা চুলো আর তিনটা ডেকচি বসিয়ে রান্নাবান্না। টিনের বাসনে গরম ভাত দেয়া হলো। তরকারী ডেকচী থেকেই বেড়ে দেয়া হচ্ছে। বাটি ফাটির বালাই নাই। সেই সামান্য মাছের তরকারীর স্বাদ এত অপূর্ব ছিল যে এখনো ভুলতে পারি না। তৃপ্তির সাথে ভরপেট খেয়ে মূল্য পরিশোধ করতে হলো নামমাত্র। অদ্ভুত তৃপ্তি মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এসেছিলাম সেদিন।
.
আমার এক বাউন্ডুলে বন্ধু জামান। বন্ধুজগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। যাকে ঘিরে আমরা গ্রহ উপগ্রহরা দিনের পর দিন আনন্দে কাটিয়েছি। সেই খেয়ালী বন্ধুটা আজ কোথাও হারিয়ে গেছে। সে এইসব চেনা জগতের দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে অচেনা গন্তব্যে হাঁটতে পেরেছিল। আমাদের সাহস ছিল না বলে তার সঙ্গী হইনি। এখন আমরা নিতান্ত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে কোন একটা চাকরী করি, বিয়ে করে সংসার পাতি, বাজার করি, বউয়ের সাথে ঝগড়া করি, বছরে দুয়েকবার চেনা জায়গায় গিয়ে হৈ হৈ করে আসি নাম যার পিকনিক।
.
কিন্তু জামানের ওসবে পোষাতো না। সে যেন এক একাকী শেরপা তার খেয়ালের ঘোড়াকে কখনো ছুটিয়ে দিয়েছে জেলে নৌকায় করে টেকনাফ থেকে বঙ্গোপসারের গহীনে, কখনো ছুটিয়ে দিয়েছে সুদূর সোয়াজিল্যান্ডের অরণ্যে, কখনো বা দুর্গম দক্ষিনের কোন লবন চাষের পল্লীতে। যখন যেখানে গিয়েছে কাটিয়েছে মাসের পর মাস, মিশে গেছে এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে। পূর্ব পুরুষের ধন সম্পদকে পেছনে ফেলে বেছে নিয়েছিল বস্তি জীবন। স্বেচ্ছা নির্বাসন। এইসব করেছে বলে আমাদের নিয়মিত সুশীল সমাজ তাকে অচ্ছ্যুত বলে গণ্য করা হয়। ভদ্রসমাজে স্থান হয়নি তার।
.
এত বছর পর এসে আমি জামানের সেই ভিন্নজগতের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ করি। অসময়ে এডভেঞ্চার ডাক দেয়। ইচ্ছে করে তাকে খুঁজে বের করে বলি, আয় দোস একটা জেলে নৌকা নিয়ে সাত দশ দিন ঘুরে আসি দূরের অচেনা সমুদ্রের কালাপানিতে। আবিষ্কার করি নতুন জেগে ওঠা কোন চর, নির্জন বালুচরে পা ডুবিয়ে বসে ঢেউয়ের শব্দ শুনি কান পেতে সারাদিন। কয়েকটা নির্জন দিন চাই, কয়েকটা নিথর রজনী।
.
হয় না। হবে না। জামান হারিয়ে গেছে, সময় হারিয়ে গেছে, পেছনে রেখে গেছে না হওয়া অনেকগুলো ভ্রমণের আকাংখা।
.

Monday, November 1, 2010

সম্পর্কের ফসিল

সময়কে ধরে রাখার সাধ্য কারো নেই। আমরা কেবল সময় অতিক্রম করতে পারি। সময়কে স্মৃতিতে যতটুকু ধারন করতে পারি, ওইটুকুই পাওনা। বাকী সব হারিয়ে যায়। একসময় ঘোরতর রোমান্টিক স্মৃতিও ফিকে হয়ে আসে সময়ের ধুলোয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে টের পাই সময়ের ধুলোর আস্তরণ। অতীতে সময়কে ধরে রাখার একমাত্র কায়দা ছিল ডায়েরী। মানুষ শব্দে শব্দে সময়কে ধারণ করে রাখতো। যতটুকু সম্ভব ততটুকু মমতায় ধরে রাখতো। একসময় সেই মমতা মন থেকে মুছে গেলেও শব্দগুলোই তার স্মৃতিকে ধারণ করে রাখতো। প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে সেই ডায়েরী কাগজের পাতা ছেড়ে আশ্রয় নিল ডিজিটাল অক্ষরে। ব্যক্তিগত ব্লগে সময়কে ধরে রাখার চেষ্টা চলে। পত্রমিতালীর শখ ছিল একসময়। বহুদুর দেশ থেকে বার্তা নিয়ে অচেনা বন্ধুর কাছ থেকে চিঠি নিয়ে ডাক পিয়নের কড়া নাড়া, দারুণ রোমাঞ্চিত করতো। সেই ডাকপিয়নও আজ কড়া নাড়ে না খুব বেশী বাড়ীতে। কখনো পত্রমিতালী করা হয়নি। সাহস কিংবা উদ্যোগের অভাবে। মাঈনুদ্দিন নামের এক বন্ধু ছিল তার পত্রমিতালীর ভাগ্য ছিল। সে যখন গল্প করতো, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মাঈনুদ্দিনের সাথে দেখা হয়না বহুবছর। দেড় যুগের কাছাকাছি হবে। সেদিন হঠাৎ করে সচলায়তনের একজন বললো তার কথা, আমি অবাক হলাম। জানতে চাইলাম কোথায় আছে সে। সরকারী চাকরী ছেড়ে নাকি কানাডা প্রবাসী হয়েছে বহুবছর আগে।

বলা হয়নি বোধহয় কখনো। আমার একজন পত্রবন্ধু ছিল। তুহীন। প্রাইমারী স্কুলের বন্ধু। সে কুমিল্লার স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকে চিঠি লিখতো। খুব অভিমানী ছিল ছেলেটা। আমি চিঠির জবাব দিতে দেরী করলে খুব মর্মাহত হতো। আমি বরাবর চিঠি খেলাপী ছিলাম। তুহীন আমাকে খুব আকড়ে ধরে রাখতে চাইতো। যদি কখনো চাটগা বেড়াতে আসতো, সারাদিন আমাকে নিয়ে ঘুরতো। আঠার মতো লেগে থাকতো আমার সাথেই। আমি মনে মনে বিরক্ত হতাম। আরো বন্ধুবান্ধব ছিল আমাদের দুজনেরই। কিন্তু তুহীন চাইতো কেবল আমারই সঙ্গ। এটা যদি বিপরীত লিঙ্গের কেউ করতো, তাহলে হয়তো বিরক্ত লাগতো না, কিন্তু আমি ওর আদিখ্যেতায় বিব্রত হতাম প্রায়ই। সেকারণেই কিনা জানি না, তুহীন আমার ঘনিষ্ট বন্ধু হলেও এক নাম্বার প্রিয় বন্ধু ছিল জামান কিংবা মামুন।

তুহীন হারিয়ে গিয়েছিল এসএসসি পরীক্ষার পর। হারিয়ে গিয়েছিল মানে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমি যোগাযোগে দুর্বল হওয়াতে, ওকে চিঠি লিখতাম না। আর আমার বাসা বদলে যাওয়াতে আমার ঠিকানাও হারিয়ে যায়। ওর বাসা ছিল আমাদের কাছেই। কিন্তু বাবা রিটায়ার্ড করে দেশের বাড়ীতে চলে যাবার পর আমি আর কোন ঠিকানা পাইনি। আসলে খুঁজিওনি। নতুন বন্ধুদের নিয়েই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। তুহীন হারিয়ে যাবার আরো বাইশ বছর পর একদিন পুরোনো কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ ওর একটা চিঠি হাতে পড়লো। এসএসসির পরপর দিয়েছিল। বরাবরের মতো অভিমানী চিঠি। এতদিনে পদ্মা মেঘনা যমুনা কর্ণফুলী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাবার পথে। তবু চিঠির পেছনের পৃষ্টায় ওর গ্রামের বাড়ীর ঠিকানা দেখে মন কেমন করলো। ভাবলাম আমাকে এত ভালোবাসতো, আর আমি স্বার্থপরের মতো ওকে হারিয়ে যেতে দিলাম। উত্তর পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, তবু একটা চিঠি লিখলাম গ্রামের ঠিকানায়। ওদের কেউ গ্রামে থাকে না। সবাই শহরবাসী। তবু দেখা যাক।

মাস দুয়েক পর মোবাইলে একটা কল এলো। পরিচয় শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। তুহীন। দুইমাস পর চিঠিটা হাতে পেয়েই ফোন। এখন কতো সহজ যোগাযোগ, এক ক্লিকেই হাজার মাইল পাড়ি দেয়া যায়। বললাম, দোস্ত কি খবর তোর। কতদিন দেখা হয়নি। সেই এক মারাত্মক রোমাঞ্চকর অনুভুতি। তুহীনকে বাসার ঠিকানা দিলাম। তুহীন এলো একদিন। অবাক হয়ে দেখলাম খুব বেশী বদলায়নি। ঢাকায় আছে আইসিডিডিআরবিতে রিসার্চ অফিসার। বিয়ে করেছে, ছেলেমেয়েগুলো ক্লাস সেভেন এইটে পড়ে। আর আমি তখনো বিয়েই করিনি বোধহয়। অবাক হয়ে গেলাম।

সেই যোগাযোগের পর থেকে আমিও ঢাকা গেলাম। ওর বাসায় খেলাম। পরিবারের সাথে কথা বললাম। আনন্দে সময় কাটালাম। এবার আর ছাড়াছাড়ি হবে না ঠিক করলাম। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর, দেখা গেল, সুর তাল লয় সব কেটে গেছে। ওর রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে আমাদের কাছ থেকে। আমি একবার ঢাকা গেলাম এরপর, বিয়ের পর। দেখা করতে চাইলাম ওর সাথে। কিন্তু ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে গেল মনে হলো। কিংবা সত্যিই ব্যস্ত ছিল। এরপর আমি কয়েকবার ফোন করে যোগাযোগ করেছি। একসময় আমিও ক্লান্তিবোধ করতে শুরু করি। বুঝে নেই, সময়! আমাদের বদলে দেয় সময়। ইচ্ছাকৃত স্বার্থপরতা হয়তো না। ওর রাস্তা আর আমার রাস্তা সত্যি আলাদা হয়ে গেছে। একসময় আমি ওর নাম্বার হারিয়ে ফেলি, সেও আমার নাম্বার হারিয়ে ফেলে। আমরা আর কেউ কারো নাম্বার খুঁজি না। জীবনটা কি এরকমই? মানচিত্র বদলে যায় সময়ের সাথে সাথে? বুঝি না। সম্পর্কগুলো সত্যি সত্যি পাথর হয়ে যায় এক সময়। বন্ধুত্বগুলো ডায়েরীর পাতায় টিকে থাকে সম্পর্কের ফসিল হয়ে।

Saturday, October 30, 2010

প্রিয় কন্যা এবং পুত্রঃ তোমাদের জন্য লেখা

আমার প্রিয় কন্যা ও পুত্র(ওশিন ও শিহান)

শ এর প্রতি আমার দুর্বলতা বেশী নাকি ন এর প্রতি আমার দুর্বলতা আমি জানি না। কিন্তু সচেতনভাবে আমি তোমাদের নাম রাখতে গিয়ে এই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছি। ওশিনের নাম রেখেছি আধঘন্টার এক সিদ্ধান্তে। যদিও নামের বই থেকে শত শত নাম দেখা হয়েছে। ইন্টারনেটেও খোঁজা হয়েছে অনেক। তবু শেষমেষ তারুণ্যের শুরুতে মুগ্ধ করা একটা জাপানী কাহিনীর চরিত্র ওশিনকে বেছে নিলাম তোমার জন্য। ওশিন আমার স্বপ্ন। যার জন্মের আগে থেকেই ভালোবেসেছিলাম প্রবলভাবে। তার একটা নাম রেখেছিলাম আয়নাপরী। আমি যেন জানতাম আমি একটা পরীর বাবা হতে যাচ্ছি। তোমার জন্মের সাথে সাথে আমাকে হাসপাতালের অপারেশান থিয়েটারে ডাকা হলো তোমাকে দেখার জন্য। আমি দেখলাম অবিশ্বাস্য সুন্দর একটা পরী দুই গালে টোল ফেলে হাসছে আমার দিকে চেয়ে। এইটুকুন বাচ্চার গালে টোল! আমার নিজেরই অবিশ্বাস লেগেছিল। তবে এই ফুটফুটে শিশুটি মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়েছে ইয়া মোটা একটা নাড়ী নিয়ে। ওটা অপারেশান ছাড়া নাভির ছিদ্র বন্ধ হবে না। কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার সমস্ত আনন্দ উবে গিয়ে বিষাদের কান্না ভর করলো। কি অপরাধে আমার এই শাস্তি? রাত দশটার মধ্যে অপারেশান সমাপ্ত হলেও তোমার জ্ঞান ফেরেনি বলে আমরা তোমাকে রুমে আনতে পারলাম না। অনেক রাতে তোমাকে রুমে দেয়া হলো। মাথায় ব্যন্ডেজ দিয়ে আটকানো স্যালাইন। তুমি কাঁদার শক্তিও হারালে। তারপর তোমার যখন জ্ঞান ফিরলো শুরু হলো ব্যাথার কান্না। সেই অবিরাম কান্না বহুরাত আমাদের নির্ঘুম রেখেছিল বাসায় ফেরার পরেও। তবু একদিন তুমি সেরে উঠলে। আমাদের মুক্ত করলে সকল দুশ্চিন্তা থেকে।

কান্নার ছবির একটা চিত্র ভিডিওতে তুলে রেখেছি ইন্টারনেটে।



ওশিনের একটা ওয়েবসাইটও তৈরী করা হলো জন্মের সাথে পরপর।
http://sites.google.com/site/oshinmahiyat/


আমরা তখন বেপারী পাড়ার বাসায়। একতলা টিনশেড বাড়ী। তোমার দাদার বানানো ঘর। আমাদের আশ্রয় দিয়ে রেখেছিল ২২টি বছর। সেই ঘরটি তখন জরাজীর্ণ। বর্ষায় পানি পড়ে টিনের চাল দিয়ে। করিডোরে পানি জমে যায়। ইট দিয়ে পারাপার বাথরুমে। তবু নিরুপায় বসবাস। তুমি যে ঘরটিতে থাকতে সেটি অবশ্য ছাদের নিরাপদ আশ্রয় ছিল। পুরো বাড়ীতে এই একটি ঘর ছিল পাকা ছাদের। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের ঝড়ে পুরো চাল উড়ে যাবার পর পুননির্মান করতে গিয়ে এটাকে সবার ঘূর্নিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে বানানো। আমি সেই ঘরটিতে বসবাস করতে শুরু করি ৯১ থেকেই। তোমার জন্মের পর আমরা তিনজন ওই ঘরে ডাবল খাটে। মোটামুটি সুখী জীবন তোমাকে পেয়ে আরো সুখী। কিন্তু কিছু কিছু রাতের দুঃসহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারি না। রাতে যখন বিদ্যুতের হাহাকার অন্ধকার গরমে আমি আর খুকী তখন দিশেহারা তোমাকে নিয়ে। তুমি একটুও গরম সহ্য করতে পারো না। হাতপাখার বাতাস দিয়ে নির্ঘুম রাত পার করেছি কখনো কখনো। তারপর একদিন খোঁজ পেয়ে চার্জ ফ্যান কিনে আনি মার্কেট থেকে। সেই চার্জ ফ্যান আসার পর অনেকটা শান্তি। যদিও দুঘন্টা পর চার্জ ফ্যানেও কাজ হতো না আর। সেই ছোট্ট ফ্যানের অল্প বাতাস তোমার ছোট্ট শরীর ছুয়ে আমাদেরও কিছু বাড়তি শীতল ছোঁয়া দিত। তুমি যখন বসতে শিখলে, খামচি দিতে শিখলে আমি তোমার খামচি খেয়ে অফিসে যেতাম, কেউ জিজ্ঞেস করলে গর্ব করে বলতাম, আমার কন্যার ভালোবাসার চিহ্ন।

তোমার প্রথম জন্মদিন ছিল অনাড়ম্বর যদিও তবু অনেক আনন্দ ছিল। কেক কেটে ছবি তুলে তুমুল আনন্দ করেছি আমরা।

কিন্তু জন্মদিনের আগেই একটা বন্যার ভয়াবহ আক্রমন আমাদের ভেঙে দেয় মানসিকভাবে। খুব বৃষ্টির এক সকালে (১১ই জুন ২০০৭ সম্ভবত) অফিসে গেলাম আধভেজা হয়ে। অফিসে পৌছানোর কিছুক্ষণ পর খুকী ফোন করলো উদ্বিগ্ন কন্ঠে। বারান্দায় পানি উঠে গেছে আমাদের। অবাক হলেও ভয় পাইনি। খানিক পরেই নেমে যাবে পানি। আমাদের কখনো বন্যা হয়নি। আশ্বাস দিয়ে ফোন কাটি। দশ মিনিট পরেই আবার ফোন। পানি বাড়ছে দ্রুত। বাসায় উঠে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। এখন কি হবে। এবার সত্যি চিন্তায় পড়লাম। বললাম, আসছি। অফিস থেকে দৌড়ে নেমে গাড়ী নিলাম। ড্রাইভারকে বললাম দ্রুত যেতে। কিন্তু বাসার কাছাকাছি আসতেই দেখি আমাদের সামনের এক্সেস রোড পানিতে থৈথৈ। কোমর পানি প্রায়। গাড়ীটা আটকে গেল। আমি নেমে গেলাম। পাগলের মতো দ্রুত পা চালালাম বাসার দিকে। এত এত পানি চারদিকে। জীবনেও দেখিনি। ১৯৯১ সালেও না। ভয়াবহ একটা দৃশ্য। আমি বাসায় ঢুকে দেখি বাসায় হাটু পানি। সোফাগুলো ডুবে গেছে। দ্রুত বাড়ছে পানি। তোমার নানা আর মামা এসেছে মোতাহারাকে নিয়ে তোমাদের নিয়ে যাবে। আমি রুমে ঢুকে দেখি তুমি প্রায় ডুবন্ত খাটে বসে আছো চুপ করে। আমি তোমাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। মাথায় একটা প্লাস্টিক দিলাম তোমার। বৃষ্টি ঝরছে। কোমর পানিতে নেমে রিকশা খুঁজছি পালাবার জন্য। এই এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে এক্ষুনি। কিন্তু কোন রিকশা নিল না আমাদের। আমি ব্যর্থ হয়ে পূর্বদিকের আবদুল্লাহ স্টোরের ভেতর ঢুকে গেলাম। ওখানে এখনো পানি ওঠেনি। ওখানে ঢুকে পেছনের দরোজা দিয়ে চলে গেলাম দোতলার বাড়ীওয়ালার বাসায়। খোদেজা বেগমের বাড়ী ওটা। আমাদের প্রতিবেশী। আমাদের কাছ থেকে জায়গা কিনে বাড়ী করেছিলেন। এই প্রথম আসা বিপদের দিনে ওনাদের বাসায়। তারপর একে একে সবাইকে নিয়ে আসি ওই বাসায়। দুদিন বাসায় যেতে পারিনি, ওখানেই ছিলাম। পানি নামতে দেরী করেছে। অপূর্ব আতিথেয়তা দিয়ে আমাদের রেখেছিলেন ওনারা। ওনাদের সম্পর্কে আমাদের সমস্ত পূর্ব ধারনা মুছে গেল। মহান মানুষ দেখলাম আরেকবার।

সেই বছর আরো দুবার বন্যায় ভুগলাম আমরা। তবে প্রস্তুতি থাকায় পরের দুটোতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। আমরা ভাবছিলাম এআর প্রোপার্টিজের ফ্ল্যাটে উঠে যাবো কদিন পরেই। কটা দিন কষ্ট করি আর। কিন্তু দিন কাটে না আর। কষ্ট বাড়তেই থাকে বসবাসের। হারুন সালাম মারা গেলেন। এআর প্রোপার্টিজের সাথে চুক্তি বাতিল হলো। ফেরদৌস ভাই বললেন ওখানে আর হবে না। আমরা নতুন উপায় খুজতে লাগলাম বাড়ীটা ছাড়ার। কিন্তু কোন উপায় হচ্ছিল না। একজনের সাথে কথা হয় হয় এমন সময় এলো আরেকটা ভয়ংকর দিন। সেইদিনটা না এলে আমাদের ওই বাড়ী হয়তো এখনো ছেড়ে আসা হতো না। একদিকে সেই ঘটনাকে আমি আশীর্বাদ মনে করি।

২৯শে জানুয়ারী ২০০৮ সকালে অচেনা একটা জায়গা থেকে টেলিফোন এলো। বিশাল অংকের টাকা পরিশোধ না করলে সপরিবারে হত্যার হুমকি এলো। আমি প্রথমেই তোমার কথা ভাবলাম। বাসায় তোমরা একটা। তুমি তোমার মা দাদী ফুপু। ওরা বললো বাসা ঘিরে রেখেছে। ভয়ে আমি আধমরা। আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে কোন উপায়ে আজকেই বাসাটা বদলাতে হবে। আত্মীয়বন্ধুদের সহায়তায় আমার চাচাদের বাসায় চলে গেলাম কসমোপলিটন আবাসিক এলাকায়। বাড়ীটা বুঝিয়ে দিলাম কোরাল রীফকে। ওরা বললো টাকা পরিশোধ করবে সময়মতো। সেই আশ্বাসে বিশ্বাস করে ভুল করলেও আমার উপায় ছিল না। আমি তোমাদের বাঁচাতেই বাকী সব হারানোর ঝুঁকি নিলাম। চাচার বাসায় থাকতেই ভাড়া নিলাম খুব চমৎকার একটা ফ্ল্যাট কাজীর দেউড়ীর এসএইচ টাওয়ারে। ওখানে গিয়েই যেন পেলাম আমি আমার কাংখিত জীবন। আস্বস্ত হলাম। অন্ততঃ কিছুদিন নিরুপদ্রপ থাকতে পারবো। এই বাসায় পানি বিদ্যুত সবকিছুর ব্যবস্থা চমৎকার। খরচটা যদিও বেশী তবু আমি এখানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম যতদিন সামর্থ্যে কুলোয়।

একদিন ওখানেই খবর এলো শিহান আসছে। প্রথমে দ্বিধা ছিল। কিন্তু সব কাটিয়ে আমরা আবারো আশীর্বাদ প্রাপ্ত হলাম সেই সৌভাগ্যের। সেই একই হাসপাতালে, প্রায় একই দিনে, সেই একই ভিআইপি রুমে শিহানের জন্ম হলো। এটা আমাকে অবাক করে। ২০০৬সালে যেই রুমটাতে ওশিনের জন্ম হয়েছিল। ঠিক সেই রুমটাই যেন আবার পেয়ে গেলাম শিহানের জন্য। জুলাই মাসের পনের তারিখ তুমি এলে। তোমাকে বাসায় ফিরিয়ে নেবার পর আমাকে গতবারের মতো টেনশান করতে হয়নি গরমে কষ্ট পাবে কিনা। আমি আর কিছু পারি বা না পারি একটা সুন্দর ফ্ল্যাটে আমার পুত্রকে নিয়ে আসতে পেরেছি। আমি সেই আনন্দে, তোমাদের নিরাপত্তার আনন্দে বাকী সব কষ্ট ভুলে গেলাম। আমরা এখনো আছি সেই বাসায়। ওশিন এখন চার বছর পেরিয়েছে। তুমি কদিন পরে দেড় বছরে পড়বে। তোমাদের নিয়ে আমি দারুন সুখী। কিন্তু এই সুখী বলতে আমি ভয় পাই। আমি চারপাশের অস্থিরতা অসুস্থতা দেখে দেখে আতংকিত হই। তোমাদেরকে সুস্থভাবে বড় করে তুলতে পারবো আমি? কিংবা আমি কি বেঁচে থাকতে পারবো তোমরা বড় হয়ে নিজের পায়ে দাড়াতে পারার আগ পর্যন্ত? মানুষের সব স্বপ্ন সফল হয় না। আমার এই স্বপ্নটাও হবে না। আমি তোমাদের বড় হওয়া পুরোপুরি দেখে যেতে পারবো না হয়তো। কোন একদিন আমিও ঢলে পড়বো নিঃশব্দে কিংবা পতন হবে ভিন্ন কোন দুর্যোগে। আমি ঠিক জানি না কি হবে। কেবল আস্বস্ত হতে ভয় পাই।




আমি তোমাদের ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভয় পাই তাই। সবাই যখন তোমাদের ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে উত্তমরূপে মানুষ করার পরামর্শ দেয় আমি তখন বলি, আমি কেবল আমার সুস্থ দুই সন্তানের স্বাভাবিক বড় হওয়া দেখতে চাই। আমি খুব ভালো স্কুল চাই না, খুব ভালো রেজাল্ট চাই না। আমার সন্তানকে আমি কেবল সাধারণ মানুষ হয়ে উঠতে দেখতে চাই। আজকের বিশাল ফ্ল্যাট ছেড়ে আমাকে যদি কেবল দুই ঘরের ঘুপচি বাসায় চলে যেতেও হয় তবু আমি খুশী আমার সন্তানদের সুস্থতা দেখে। তাদের সাথে কাটাবার জন্য যে দিন মাস বছরগুলো বাকী আছে আমি তাকে পরিপূর্ণ সুখে কাটাতে চাই। আমি এক নিখাদ ভালোবাসার কান্নায় ভাসতে চাই।






[আমি জানি না এই লেখাটা পড়ার মতো বয়স হতে হতে এই ওয়েবসাইট জীবিত থাকবে কিনা। কিংবা টেকনোলজি বদলে গিয়ে লেখাগুলো হারিয়ে যাবে কিনা। আমি এই সব কিছুই জানি না এই সময়ে। তবু লিখে রেখে যাচ্ছি আমার প্রবল ভালোবাসার সামান্য একটা চিহ্ন। যদি কখনো পড়ো বাবার লেখাটি]

শনিবার, ৪.০৯মি
৩০ অক্টোবর ২০১০

Monday, October 4, 2010

ফিওনা

১.
পাহাড়ের ঢালটা যেখানে কাত হয়ে নদীর দিকে নেমে গেছে ওদিকটায় কেবল বুনো জঙ্গল। হাঁটতে হাঁটতে ফিওনা ওদিকে চলে গেছে। ৭ বছরের ফুটফুটে মেয়েটি। হঠাৎ তার উল্লসিত চীৎকার - বাবা বাবা দেখে যাও, কি সুন্দর একটা ফুল এখানে!

আরিল মুখ ফিরিয়ে মেয়ের আঙুলকে অনুসরন করে কাছে গিয়ে দেখলো সত্যি চমৎকার একটা ফুল। তার এত বছরের ফুলের ব্যবসা কিন্তু কখনোই এত সুন্দর ফুল দেখেনি। ফুলটা লাল বেগুনী হলুদ এই তিনটা রঙের অপূর্ব সমন্বয়। এই বেগুনীটা ঠিক বেগুনীও নয়। কেমন অদ্ভুত উজ্জ্বল। অন্য রংগুলো ছাড়িয়ে বেগুনীটার উপর একটু বেশী আলো পড়েছে। যেন মুগ্ধতা ছড়ানোর জন্যই ফুলটির জন্ম! কাছে গিয়ে আলতো করে ফুলটিকে স্পর্শ করলো আরিল। দারুন একটা সুগন্ধী আবেশ নাকের ঠিক সামনে এসে মৌ মৌ করতে থাকে। আরিল অবাক বিস্ময়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করছে কোথায় দেখেছে আগে। নাহ্ এই গাছ আগে কোথাও দেখেনি। কোন দেশী ফুল এটা? এত সুন্দর ফুল এখানে কি করে এলো? গতকালও তো ওদিকে কোন ফুল দেখেনি।

জাত ব্যবসায়ী আরিল। ফুলটা ছুঁয়েই বুঝে গেল এই ফুলকে যত্ন করে চাষ করতে পারলে একচেটিয়া ব্যবসা হবে। ফুলের পাপড়িগুলো অর্কিডের মতো দৃঢ়। তার মানে এই ফুল দীর্ঘক্ষন তাজা থাকবে এবং সংরক্ষনের উপযোগী। ফুল ব্যবসার অন্যতম প্রধান সুযোগ হলো এই জাতীয় শক্ত ফুলগুলি। বাড়তি পাওনা এর সুগন্ধ। আরিল ভাবলো এই ফুলের চাষ করা শুরু করতে হবে। আলতো করে ফুলের চারাটা নিয়ে একটা টবের মধ্যে স্থাপন করলো। বাড়ী ফেরার পথে নিয়ে এলো টাবটাকে।

বিকেলে কফির কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে অবাক হলো আরিল। ফুলটার রং শুধুই বেগুনী এখন। আশ্চর্য। রং বদলায় এই ফুল? দিনে কয়বার বদলায় দেখতে হবে। টবটাকে বারান্দায় তুলে আনলো। রাতের বেলা আরো অবাক হয়ে দেখলো ফুলটা গাঢ় খয়েরী হয়ে গেছে। পরদিন ভোরে উঠে দেখলো ফুলটা লাল। রোদ বাড়তেই রঙ বাড়ছে। দশটার দিকে হলুদ আর লাল। দুপুরের আগে আগে লাল, হলুদ আর বেগুনীর চমৎকার একটা মিশ্রন দেখা গেল। আবার বিকেল হলে পুরোটা বেগুনী। কয়েকদিন রেখে দেখলো এক সপ্তাহেও ফুলটি পচছে না। কেবল শুকিয়ে যায়।

আরিল ভীষন আশাবাদি হলো এবার। এই ফুলের চাষ করতে পারলে সে একাই ফুল সম্রাট হয়ে যাবে দুনিয়ায়।

পাপুয়া নিউগিনির পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত মরোবি প্রদেশের প্রধানতম শহর -লেই। মাত্র লাখ দেড়েক লোকের বসবাস এই শহরে। শহরের উত্তরের উপত্যকার উল্টোদিকের ঢালে কয়েক একর জায়গা নিয়ে একটা ফুলের খামার আছে। তারপর একটা আদিম জঙ্গল। হাজারো গাছপালা ওখানে। এই উপত্যকাটার ঢালটা আরিল লীজ দিয়েছে ৯৯ বছরের জন্য। খামারের মাইল খানেক সামনে দিয়ে বয়ে গেছে একটা নদীর ধারা। দুই পাহাড়ের মাঝে বয়ে যাওয়া নদীটার মধ্যে চর জেগে আছে। ওখানে পাখির ঝাঁক নামে কোন কোন বিকেলে। দুপাশের পাহাড় চিরে বেরিয়ে সাগরে পড়েছে ধারাটা। এখানে একটা পুরোনো কাঠের বাড়ী আছে।

খামারের এই বাড়ীতেই আরিলের সপ্তাহের পাঁচদিন কাটে। স্ত্রী সুসি আর কন্যা ফিওনা থাকে নিকটস্থ শহরে। মাঝে মাঝে আরিলের কাছে এসে থাকে যখন ফিওনার স্কুল বন্ধ থাকে। বর্তমানে এই দেশের নাগরিক হলেও আদতে সে অষ্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা। পূর্বপুরুষের ভিটে অষ্ট্রেলিয়ার পার্থে। কিন্তু লেই শহরের প্রেমে পড়ে এখানেই স্থায়ী বসতি করেছে। শহরটি অপূর্ব সুন্দর। শহর ছাড়িয়ে উত্তরে গেলে যে সবুজ পর্বতমালা চোখে পড়বে তার উল্টোদিকে আরিলের খামারবাড়ী।

প্রাকৃতিকভাবেই মোরোবি প্রদেশটি বৈচিত্রময় একটা জায়গা। সবুজ পাহাড় জঙ্গলের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরের এত সুন্দর সমন্বয় এই অঞ্চলে খুব কমই আছে। কেবল এই প্রদেশেই ৭০০-১০০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে এবং ১২০০০-১৫০০০ জাতের উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। অঞ্চলটা প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের স্বর্গ বিশেষ। এত বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক উপাদানের সমাহার পৃথিবীর আর কোন এলাকায় নেই। এরকম অদ্ভুত প্রাকৃতিক বৈচিত্রের মেলায় বুনোফুলের আবিষ্কার তেমন বিস্ময়ের কিছু না হলেও আরিলকে হতবাক করলো ফুলের রঙ পরিবর্তনের ব্যাপারটা।

==================================
২.
আরিল সে রাতেই সুসিকে খুলে বললো ব্যাপারটা। সুসি ব্যবসা বোঝে না। সে স্কুলে চাকরী করে। তবু মতামত দিল এই ফুলের আবিষ্কারের কথাটা আপাততঃ গোপন রাখতে। চাষাবাদ করে রপ্তানীযোগ্য পরিমান উৎপাদন করার পরই জানান দেয়া হোক। এই ফুলের একচেটিয়া অধিকার তাদের।

ফুলটির নাম কি দেয়া যায়?

আরিল বললো, ফিওনার নামে দিলে কেমন হয়? সুসি রাজী। ঠিক হলো, ফুলটাকে 'ফিওনা' বলেই ডাকবে।

আরো এক বছর কেটে গেছে।

ফিওনার চাষ করা খুব সহজ। মাটিতে পুঁতে দিলেই হয় কোন একটা ডাল। সপ্তাহান্তেই ফুল। পুরো উপত্যকা ভরিয়ে ফেললো এই ফুল দিয়ে। সুগন্ধে মৌ মৌ সমস্ত উপত্যকা। আরিল ইতিমধ্যে তার আবিষ্কারের ঘোষনা দিয়ে এই ফুলের মালিকানা নিয়ে নিয়েছে পেটেন্ট করে। সমস্ত লেই শহরে ফিওনার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লো। এই জনপ্রিয়তা পোর্ট মোর্সবি ছাড়িয়ে অষ্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডেও ছড়িয়ে গেল। সারা দুনিয়া লেই শহরকে ফিওনা সিটি ডাকতে শুরু করেছে।

লেই শহর ১৯৩৭ সালের পর আর কখনো বিশ্বমিডিয়ায় এতটা খ্যাতি পায়নি। ১৯৩৭ সালে বিশ্বখ্যাত পাইলট এমেলিয়া ইয়ারহার্টের রহস্যময় নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছিল লেই এয়ারপোর্ট থেকে ওড়ার পরেই। আমেরিকান নাগরিক এমেলিয়া মহিলা পাইলটদের কিংবদন্তী। যিনি বিমানের সেই আদিম যুগে বিশ্বভ্রমন করতে চেয়েছিলেন লকহীড কোম্পানীর তৈরী ছোট্ট একটা বিমান নিয়ে। এমেলিয়া প্রথম মহিলা বৈমানিক যিনি একা আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিল আকাশপথে। সেই এমেলিয়া ছিল আরিলের নানীর প্রিয় বান্ধবী। লেই শহরে বসতি স্থাপন করার পেছনে আরিলের মায়ের মুখে শোনা এমেলিয়ার গল্পটাও কাজ করেছিল। এমেলিয়া নিখোঁজ রহস্য নিয়ে সে বেশ কিছুদিন গবেষনাও করেছিল। জাপানিদের কোন হাত ছিল কিনা সেটা খুঁজতে খুঁজতে করতে গিয়ে এই খামারের জায়গাটা আবিষ্কার করে, সাথে কাঠের এই বাড়ীটাও। পছন্দ হলো, আর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো এখানে বপন করবে ছোট্ট একটা স্বপ্নের বীজ। এমেলিয়া রহস্য উদঘাটন করা হলো না তার।

কিন্তু সেই স্বপ্নটা যে এত বড় মহীরূহ হয়ে যাবে সেটা কল্পনাও করেনি। সবগুলো দুই বছরে আরিলের আয় দুই কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেল। বাগানে আর কোন ফুল নেই। কয়েকশো একর জায়গা জুড়ে কেবল ফুল আর ফুল। ফিওনার রাজত্ব উপত্যকা জুড়ে। যেন কেউ এক চিলতে স্বর্গের চাদরে ঢেকে দিয়েছে এলাকাটা। ফুল রপ্তানী করলেও ভুলেও সেই ফুলের চারা বা ডালপালা বেচে না কারো কাছে ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে।

দুবছর নির্বিঘ্নে যাবার পর তৃতীয় বছর ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটলো। এক রাতে আরিল খামারবাড়ীর অন্ধকার বারান্দায় বসে দুরে বয়ে যাওয়া নদীর দিকে তাকিয়ে আনমনে পাইপ টানছিল। হঠাৎ খেয়াল করলো বাগান থেকে ক্ষুদে একটা আলোকরশ্মি সুতোর মতো আকাশের সাথে সেতু রচনা করেছে। বেগুনী রঙটা ঠিক যেন তার বাগানের ফুলের রঙ। এরকম অদ্ভুত ঘটনা আগে দেখেনি। আলোর উৎস খোঁজার জন্য বাগানে নামলো আরিল। ঢাল বেয়ে কাছাকাছি যেতেই আলোটা অদৃশ্য হয়ে গেল। যেখান থেকে আলোটা উৎসরিত হচ্ছিল সেই জায়গাটা চিহ্নিত করে রাখলো।

পরদিন সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে আরিল বাগানে গেল। ওই জায়গায় গিয়ে কোন সুত্র পাওয়া যায় কিনা দেখলো। কিচ্ছু নেই। ফুলগুলি রক্তলাল হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আরিল ভাবলো রাতে ভুল দেখলো কিনা।

কয়েকদিন পর একই দৃশ্য আবারো। এইবার উত্তরপূর্ব কোনে। এবার একটি নয়, তিন চারটি আলোর সুতো আকাশ ছুঁয়েছে। আরিলের মাথায় ঢুকছে না, কি ওই আলোর উৎস। ভুতপ্রেতে বিশ্বাসী নয় সে। এবারো কাছে যেতেই নিভে গেল সুতোগুলি। কাউকে বললো না ঘটনাটি। চেপে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু চিহ্নিত করে রাখলো জায়গাটা।

মাসখানেক পর এক রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার ফিসফিস শব্দে। ঝড়ো বাতাসের মতো হিসহসানি। বাইরে কি ঝড় হচ্ছে নাকি? জানালা খুললো আরিল। না সেরকম কিছু নেই। তাহলে শব্দের উৎস কী? হঠাৎ ডানদিকের জঙ্গলে চোখ যেতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো তার। ওখানে বিশাল ঘন এক জঙ্গল ছিল প্রাচীন সব বৃক্ষের মেলা। ওই বিশাল বিশাল গাছগুলো প্রচন্ডবেগে দুলছে। দুলতে দুলতে প্রায় মাটির সাথে শুয়ে পড়ছে। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। অত মোটা গাছ কি করে নুইয়ে যায় এরকম। এবার সত্যি সত্যি ভয় পেল আরিল। সুসি আর ফিওনা শহরে। ফোন করে জাগালো সুসিকে। বললো ভয়ানক কিছু ঘটছে এখানে। দৃশ্যটার বর্ননা দিয়ে ফোন কেটে দিল।

সুসি ফোনটা নামিয়ে রেখে চিন্তিত হয়ে ভাবছে কার কাছে বলা যায় ব্যাপারটা। ঘুমন্ত ফিওনার দিকে তাকালো। তারপর তাকালো ঘরের কোনে রাখা ফিওনা ফুলের টবের দিকে। আশ্চর্য! ফুলটা লাল হয়ে আছে কেন? এইসময় তো ওর কালচে খয়েরী থাকার কথা। ফিওনা টেলিফোন নিয়ে পরিচিত সিটি কাউন্সিলর ফোন ডায়াল করলো। আশ্চর্য ফোন যাচ্ছে না। মোবাইল ফোনে ধরলো। মোবাইলে দেখালো নেটওয়ার্ক বিজি। আসলে আরিল তখন ফোন রাখার আগেই লাইনটা কেটে গিয়েছিল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ লাইনটা জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। ওরা দুজনেই বোঝেনি জ্যাম হলো কেন।

ঘুমন্ত লেই শহরের কেউ জানলো না উপত্যকা থেকে লক্ষ কোটি আলোর সুতো মহাকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সবরকম যোগাযোগ বন্ধ ছিল কয়েক মিনিট। না মোবাইল, না টেলিভিশন, না রেডিও।

আরিল ঘরে ঢুকে আবারো ফোন করার চেষ্টা করলো অন্য বন্ধুবান্ধবকে। কিন্তু কিছুতেই গেল না ফোনটা। নেটওয়ার্কের এরকম সমস্যা আর কখনো হয়নি।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। ভোরে পাখপাখালির ডাকে ঘুম ভাঙলো। দৌড়ে জানালার কাছে গেল। এই দৃশ্যের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে।

সম্মুখের উপত্যকা জুড়ে ফিওনা ফুলের বাগান ছিল গতরাত পর্যন্তও। আজ একটা ফিওনা ফুলের অস্তিত্বও নেই। সমস্ত উপত্যকা ধবধবে সাদা। যেন তুষারে ঢেকে দিয়েছে কেউ। ভীত হয়ে আরিল ফোন করলো সুসিকে। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না।

ধরবে কি করে? রাত ভোর হবার আগে সুসির ঘুম ভাঙলে সুসি দেখতে পায় ফিওনার টবটা যেখানে রাখা ছিল, সেখান থেকে বেগুনী সুতোর আলোক রশ্মি জানালা দিয়ে দুর আকাশে ছুটে যাচ্ছে। ওটা দেখেই সুসি যে জ্ঞান হারালো, এখনো ফেরেনি।

পাশের ঘরে ফিওনার ঘুম ভেঙ্গে গেল ফোনের শব্দে। গুটিগুটি পায়ে মার কাছে এসে ডাকলো, "মা ওঠো, বাবা ফোন করেছে"। মার ঘুম ভাঙছে না দেখে ফিওনা নিজেই মোবাইল হাতে নিয়ে বাবার সাথে কথা বললো।

"ফিওনা, তোমার মায়ের ঘরের কোনে যে ফুলের টবটা আছে ওটা ঠিক আছে কিনা দেখো তো?"
"বাবা, ফুলতো নাই, ওখানে সাদা পাউডার পড়ে আছে।"

আরিলের হাত থেকে ফোনটা পড়ে যাবার দশা হলো। বললো, "তোমার মাকে ডেকে তোলো তাড়াতাড়ি। ওই টবটা বাইরে ফেলে দিতে বলো এক্ষুনি।"

নার্ভাস আরিল মোবাইল ফোনটা রাখতে না রাখতে ঘরের কোনে রাখা ল্যান্ডফোনটা বাজতে শুরু করে। ভীত চোখে ফোনের দিকে তাকালো। সারা দুনিয়া থেকে আরিলের কাছে ফোন আসবে এখন। সবগুলো বিক্রিত ফুলই নিশ্চয়ই পাউডার হয়ে গেছে। যেখানে যেখানে এই ফুল রপ্তানী করা হয়েছে অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা, প্যারিস, লন্ডন........সবগুলো নিশ্চয়ই এখন সাদা পাউডার।

ক্রেতারা টাকা ফেরত চাইতে আসবে, দেউলিয়া মামলা হবে, আরিল সর্বশান্ত হয়ে যাবে.....কল্পনা এগোলো না আর। বেলা বাড়তে বাড়তে এসব ঘটনার সুত্রপাত হবে। তার আগেই পালাতে হবে। ছোট একটা ব্যাগে মূল্যবান সবকিছু ভরে নিয়ে বাইরে দাঁড়ানো জীপটাতে উঠে ষ্টার্ট দিয়ে শেষবারের মতো বাগানটার দিকে তাকালো।

গাড়ী চালাতে চালাতে সুসিকে ফোন দিল আবার। জ্ঞান ফিরেছে সুসির। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে কি যেন বলতে চাইলে থামিয়ে দিয়ে সংক্ষেপে পুরো ব্যাপারটা বোঝালো। সবশেষে বললো, "কান্নাকাটি করার সময় অনেক পাবে। এখন ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ো। ডোমেষ্টিক ফ্লাইটে চলে যাও পোর্ট মোর্সবি, তারপর ওখান থেকে পরদিন পার্থের ফ্লাইট ধরবে। কেউ খোঁজ শুরু করার আগেই। কাউকে কিচ্ছু বলবে না। আমি কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করো না। কয়েকমাস দেখা হবে না আমাদের। পার্থে তোমার ভালো থাকবে।

মাথা ঠান্ডা করে সুসি পরিস্থিতি আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। ওদের এত আদরের চাষ করা ফুল পাউডার হয়ে গেছে, ফুল থেকে বেগুনী রশ্মি বেরিয়ে আকাশের দিকে ছুটে গেছে ওই রহস্য উদঘাটন পরে হলেও চলবে। আগে পাওনাদারের আক্রমন থেকে বাঁচতে হবে।

পিএনজি এয়ারলাইন্সের নাম্বারে ফোন করে দুটো টিকেটের বুকিং দিল লেই থেকে পোর্ট মোর্সবি পর্যন্ত। দুপুরের পর একটা ফ্লাইট আছে। প্রিয় ঘরটা আর ফিরে পাবে কিনা ভেবে কষ্ট লাগলেও চেপে রাখলো। ফিওনা আরো বেশী কষ্ট পাবে। এই শহরের সবকিছু প্রিয় তার। গাড়ী ছুটছে নাজ্জাব এয়ারপোর্টের দিকে।

আরিল গাড়ীটা একটা নিকটস্থ আশ্রয়ে রেখে তার নিজস্ব বোটটি নিয়ে মারকাম নদীর উজানের দিকে রওনা দিল। ওখান থেকে ইউফিন নদী ধরে পুবদিকে দশ মাইল মতো গেলে পর্বতের মধ্যে তার একটা নিরাপদ হাইডআউট আছে। নির্জনে বসে পাখীর গান শোনার জন্য বানিয়েছিল ঘরটি অনেকদিন আগে। ওখানে কেউ খুঁজে পাবে না তাকে। সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন একটা জায়গা। মরোবি প্রদেশের সবচে ঘন জঙ্গলাকীর্ণ স্থান। এরকম দুর্দিনে কাজে লাগবে ভাবেনি।


=================================

৩.
বহু দুরবর্তী গ্যালাক্সির 'নিউক' গ্রহের আদি বাসিন্দা 'সেল' সমাজের নমুনা সভা বসেছে। মহাবিশ্বের কোথায় কোথায় সেলদের বসতি আছে তা আবিষ্কার করতে গিয়ে ওদের একটি নবীন গবেষক সেল সম্পূর্ণ নতুন জাতের এক আজব জীবের সন্ধান পেয়েছে। তার গবেষণা রিপোর্টের সৌজন্যেই আজকের সভা।

ওদের নিজেদের গ্যালাক্সির মধ্যে দুশো পঁচিশটা 'সেল-বাস-যোগ্য' গ্রহ আছে। তার মধ্যে নিউক হলো সবচেয়ে বড় এবং আদিম। 'সেল' উদ্ভিদ প্রজাতির জীব হলেও জীব-জড় উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তার মধ্যে। তাদের নিউক্লিয়াসে ইলেক্ট্রনের মতো এক উপাদান আছে যা থেকে শক্তিশালী রশ্মি উৎপন্ন হয়। এটাই সেলদের সকল শক্তির আধার। এদের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো দুর্দান্ত অভিযোজন ক্ষমতা, আলোর চেয়েও দ্রুত ছুটবার যোগ্যতা এবং যে কোন ধরনের জীবের সাথে যোগাযোগ করার দক্ষতা।

গ্যালাক্সি ব্যাপী ছোটাছুটি করার জন্য পুরো শরীর নিয়ে ভ্রমণ করতে হয় না তাদের। শরীরের যে কোন একটা সেলকে সেই রশ্মি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে ছুঁড়ে দেয়া হয়। গন্তব্যে পৌঁছেই অতি ক্ষুদ্রতম সেলটি দ্রুততম সময়ে পূর্নাঙ্গ শরীর নিয়ে বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে যেতে পারে সেখানে। এই ক্ষমতা অর্জন করেছে কোটি বছরের বিবর্তনের ফসল হিসেবে। ধারনা করা হয় এদের পূর্বপুরুষ একসময় সাধারন বৃক্ষই ছিল।

বক্তা সেলটি শুরু করলোঃ

"উপস্থিত সেল সমাজ, দীর্ঘ দুই লগ (পৃথিবীর হিসেবে দুই বছর) ধরে খুঁজতে খুঁজতে নতুন যে গ্রহটি আবিষ্কার করেছি সেখানে লুকিয়ে আছে এক অপার বিস্ময়। এতদিন আমরা জানতাম মহাবিশ্বের মধ্যে সেল বাদে অন্য কোন জাতের জীব নেই। কিন্তু সেল প্রজাতির পাশাপাশি সেই গ্রহে পাওয়া গেছে নতুন এক প্রজাতি। প্রাণী বলে পরিচিত সেই আজব জীবদের বৈশিষ্ট আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। বহু জাতের প্রাণী থাকলেও আজ আমাদের সভার মূল বিষয় সেই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। এরা আকারে তেমন বড় না হলেও প্রযুক্তি জ্ঞানের কারণে ওই গ্রহের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে।

" নতুন প্রজাতির জীবের সবচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার হলো ওদের খাদ্য গ্রহন এবং বর্জ্য ত্যাগ। অদ্ভুত সব কাজ কারবার তাদের। ওরা আহার করে শরীরের একটা গর্ত দিয়ে, আবার অন্য একটা গর্ত দিয়ে খাবারগুলো পঁচিয়ে বের করে দেয়। এরকম আজিব কান্ডের পেছনে কি যুক্তি থাকতে পারে আমি বুঝিনি।

"সেখানে অনেক জাতের প্রাণী থাকলেও যে দলটা মানুষ নামে যারা পরিচিত, তাদের হাতেই ওই গ্রহের নিয়ন্ত্রণ। তারা পুরো গ্রহে সবচেয়ে শক্তিমান ও বুদ্ধিমান প্রাণী। তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। কিন্তু গবেষণা করতে গিয়ে ওই গ্রহের উদ্ভিদ সেল সমাজের অবস্থা সম্পর্কে যা জানলাম তা খুবই দুঃখজনক। মানুষের দল সভ্যতার নামে, প্রযুক্তির নামে, শিল্পায়নের নামে, আরো নানা বাহানায় সেল সমাজের উপর আঘাত হেনে চলেছে বহু যুগ ধরে। বায়ুমন্ডলে কালো কালো ধোঁয়া ছেড়ে সেল সমাজের আহারের মধ্যে ধ্বংসাত্মক উপাদান ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সেলরা যেখানে বসতি করতো সেখানকার মাটিকে সেল শূন্য করে তাদের ভিটেয় ঘুঘু চরাচ্ছে।

"আপনারা জানেন সেল সমাজই মহাবিশ্বের মালিক, কিন্তু মানুষ নামের ওই নোংরা জীব ছোট্ট ওই গ্রহে সেল সমাজের উপর যে অত্যাচার করছে তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না।
মানুষের সমাজ একদিকে আমাদের স্বজাতির কিছু সেলকে বন্দী করে ব্যবহার করছে দাসের মতো, যথেচ্ছ কাজে লাগাচ্ছে তাদের খাদ্য বাসস্থান ইত্যাদির জন্য, আবার তাদের হাতেই ধ্বংস হচ্ছে অন্যান্য সেল প্রজাতি। সংখ্যায় সেল গণ অনেক বেশী হলেও সেলদের কোন কতৃত্ব নেই ওই গ্রহে।

"মানুষ নামের নোংরা প্রাণীদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতে না পারার মূল কারণ তাদের প্রযুক্তিজ্ঞানহীনতা। এই উত্তরাধূনিক যুগেও ওখানকার উদ্ভিদ সেলগুলো আমাদের কোটি বছর আগের পূর্বপুরুষের মতো নির্বোধ রয়ে গেছে। তাদের প্রযুক্তিজ্ঞান একেবারে শূণ্যের কোটায়। একটা উদ্ভিদ সেলকে কেটেকুটে জ্বালিয়ে দিলেও বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়তে পারে না।

"এই জগতে আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো যোগাযোগ রশ্মি। যা দিয়ে আমরা নিমেষেই বিশ্বের যে কোন জায়গায় যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি। আমাদের সে কোন সেলকে যে কোন দুরত্বে নিয়ে স্থাপন করতে পারি। এই সুবিধাটা ওদের কারো নেই। ওরা জানেই না এরকম কোন ব্যবস্থা থাকতে পারে। যা কিছু প্রযুক্তি আছে তা মানব সমাজের দখলে। তবে মানুষেরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে যোগাযোগ করে ওদের সভ্যতার শীর্ষে উঠেছে বলে দাবী করে তা দিয়ে আমাদের কাছে হাস্যকর। তারা উদ্ভিদ সেলদের মতো স্থির নয়। ক্রমাগত নড়াচড়া করতে হয় তাদের। ভ্রমন করার জন্য ওরা নিজেদের আস্ত শরীরকে তো নেয়ই, সাথে আরো বিশাল যন্ত্র বহন করে। যাকে ওরা জাহাজ, গাড়ী, বিমান এরকম বিদঘুটে নামে ডাকে।

"ওদের সর্বোচ্চ গতির যন্ত্রের(রকেট) গতি দেখলে আপনি হাসতে হাসতে খুন হবেন। তাছাড়া ওই বিশাল যন্ত্রগুলোকে ভুমি থেকে আকাশে ভাসাতে এমন ভীষন ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করতে হয়, এত আগুন পোড়াতে হয় যে তাতে কয়েক কোটি সেল পুড়ে যাবে। ওরকম হাস্যকর জিনিস নিয়ে ওরা নাকি গ্রহে গ্রহে বিচরন করবে। মজার ব্যাপার হলো নিকটস্থ নক্ষত্রে পৌঁছাতেও তাদের কয়েক লক্ষ বছর লেগে যাবে। অথচ ওদের গড় আয়ু মাত্র ৭০ লগ(বছর)। তাদের নক্ষত্র ভ্রমণ অনেক দূরের অসম্ভব স্বপ্ন। আমাদের জগত নিয়ে কল্পকাহিনী লেখার মগজও নেই ওদের।

"যাক সেকথা, ওখানকার সেল সমাজের কথায় ফিরে আসি। এত অনাচার সত্ত্বেও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা একটা উদ্ভিদ সেল অন্যটাকে সাহায্য করতে পারে না। বহু বছর ধরেই চলছে এমন দশা। ওরা দেখতে পায় নিজেদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া, কিন্তু প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠার কোন ভাষা জানা নেই। আমার দুই বছরের গবেষণায় আমি চেষ্টা করছি তাদেরকে কোন একটা রাস্তা খুঁজে দিতে যাতে তারা নিজেদের ধ্বংস ঠেকিয়ে দুষ্ট প্রাণীদের হাত থেকে গ্রহটাকে রক্ষা করতে পারে। এটা আমাদের আন্তঃনীহারিকা সেল সমিতির অঙ্গীকারও বটে।

"আমি যোগাযোগ রশ্মির মাধ্যমে আমার একটা সেল ওদের ভুমিতে পুঁতে দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য আরো বিস্তারিত জ্ঞানলাভ করা ওই গ্রহের বিভিন্ন বিষয়ে। যেখানে আমি পুঁতেছিলাম, সেই প্রাণীটা সেল চাষ করে। রঙিন সেলদের বন্দি করে কুপিয়ে হাত পা কেটে নানান জায়গায় চালান করে। ওরকম অদ্ভুত খেয়াল কেন প্রথমে বুঝতে পারিনি আমি। পরে জেনেছি ওই প্রক্রিয়াটাকে ওরা বলে বানিজ্য। সেই প্রাণীটা আমার সেলকেও বন্দি করে। আমি চাইলে তখুনি চলে আসতে পারতাম। কিন্তু আসিনি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। সেলগণ নিজেদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করতে পারে। আমরা চাইলে আমাদের বৃদ্ধিকে নিজেরাই নিয়ন্ত্রন করতে পারি। আমাকে বন্দী করার পর মানুষটা আমার কাছ থেকে আরো সেল আশা করে। আমি আরো সেল বাড়ালাম। সেলগুলো খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেলে তাকে বাণিজ্যে উৎসাহ দিল।

"মানুষটা আমার বর্ধিত সেলগুলোর হাত পা মুন্ডু কেটে বস্তাবন্দী করে নানা জায়গায় পাঠালো। ব্যাপারটা আমার জন্য ভালো হয়েছে। আমার সুযোগ হলো সমস্ত গ্রহের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ার। আমি জানলাম পুরো গ্রহের প্রাণী জগতের বিচিত্র সব তথ্য। মোটামুটি দুই বছর পর্যবেক্ষণের পর আমি সেল ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলাম। নিউকের কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশ নিয়ে যাবার জন্য এক রাতে আমার সবগুলো সেলকে উপড়ে নিয়ে চলে এলাম।

"ইতিমধ্যে যা জেনেছি তাতে মনে হয়েছে মানুষ নামক প্রাণীটা সেল সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পুরো গ্রহের সেল সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এই মানুষের দল। তাই নিউকের অনুমতি নিয়ে আমি আবার মাঠে নামতে চাই সেল সমাজকে রক্ষা করার জন্য। আমি এখানকার সমাজকল্যাণ সেল প্রধানকে অনুরোধ করবো আমার জন্য কয়েক লক্ষ শক্তিমান সেল বরাদ্দ করা হোক পৃথিবীকে লক্ষ্য করে নতুন প্রজাতি নিক্ষেপ করার জন্য। প্রতিটি ভূখন্ডে সেলগুলো ছড়িয়ে দেয়া হবে যারা এক বছরের মধ্যেই সারা পৃথিবীর সমস্ত সেলগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবে এবং অনিষ্টকর প্রাণীদের বিরুদ্ধে একশানে যাবে।

"অশুভদের হাত থেকে, নষ্টদের হাত থেকে বিশ্বকে মুক্ত রাখার অঙ্গীকার করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।"



=============================================

৪.
যে বক্তা তার বক্তব্য শেষ করলো তার একটি নাম সেল-ফিওনা। বক্তব্য শেষ হতে না হতেই উপস্থিত সেলদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। ভিন্ন জগতের সেল সমাজের অপমানে ক্ষেপে উঠে কেউ কেউ তক্ষুনি যুদ্ধযাত্রা করতে চাইল। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় শহীদ হবার বাসনা প্রকাশ করলো। সভাপতি নিউক লাল রশ্মি জ্বালিয়ে চুপ থাকার সিগন্যাল দিল। সবাই চুপ করলো। মহামান্য নিউক তার বক্তব্যে বললোঃ

"আমাদের ক্ষুদে সেল-ফিওনা যে আবিষ্কার করেছে সেটা তার জন্য বিরল সম্মানস্বরূপ সে নিজের জন্য একটা নাম অর্জন করলো। এর আগে এই গ্যালাক্সীতে মাত্র ২২৫ জন এই সম্মান পেয়েছে। সেল সমাজের জন্য উপকারী একটা কাজ করেছে তার গবেষনা ও প্রতিকারের উপায় বলে। কিন্তু আমাদের কয়েকটা জিনিস মনে রাখতে হবে। এখুনি আমরা এমন কিছু করতে পারি না যাতে ওই গ্রহের শাসক প্রানীদের ক্ষেপিয়ে দেয়। আমাদের কোন পরিকল্পনা টের পেলে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে ওই প্রাণীরা। তাতে করে নিরস্ত্র সেল ভায়েরা বেঘোরে মারা পড়বে। তাই ভয় ভীতিজনিত কোন কাজ করা যাবে না। বরং আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।

"ফিওনার রিপোর্ট দেখে ওই জীবদের সম্পর্কে অনেককিছু জানা গেলেও একটা ব্যাপার বোঝা যায়নি। ওরা আহার করে আবার সেই আহারকে পচিয়ে পরিত্যাগ করে কেন। এতে তাদের কি উপকার হয়। আমরা সেল সমাজ যে খাবার গ্রহন করি তার পুরোটাই শরীর গঠনে ব্যয় করি। কিন্তু কিম্ভুতাকার প্রাণী সমাজ তা করে না। সেল সমাজের জন্য ওটা অস্বাভাবিক নোংরা একটা ব্যাপার। তবে ওই প্রক্রিয়ার পুরো চক্রটা জানতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি করে ওই জীবগুলোকে ধ্বংস করা যাবে। তাছাড়া আরো জানা গেছে কেবলমাত্র এক জাতের প্রাণীর উৎপাতেই অতিষ্ট পুরো সেল সমাজ। মানুষ নামের ওই প্রজাতিকে ধ্বংস করতে পারলেই চলবে আমাদের। বাকী প্রাণীদের হাতে ক্ষতিকর কোন প্রযুক্তি দেখা যায়নি। আমি ফিওনাকে আরো এক লগ সময় দিলাম মানুষের বিস্তারিত জীবন চক্র জেনে নেয়ার জন্য।"

ফিওনা সানন্দে রাজী হলো। "মাননীয় নিউক। আপনার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। যথাসময়ে রিপোর্ট দেয়া হবে।"

পরের এক লগ ফিওনা ব্যস্ত রইল পৃথিবীর প্রাণীজগতের জীবন চক্র পর্যবেক্ষন ও পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে।

*******************************************************

ফিওনার মন খারাপ। আজ কয়েক মাস বাবাকে ছেড়ে পার্থে দাদার বাড়ীতে উঠেছে মাকে নিয়ে। এখানে সবকিছু আছে, তবু তার শূন্যতা কোথাও।

তার দশম জন্মবার্ষিকী পালন করা হলো কোন আয়োজন ছাড়াই। বাবা থাকলে কতো মজা হতো! বাবা এখন কোথায়? ফিওনা ফুলগুলো কোথায় উধাও হয়ে গেল। প্রথম দেখার পর থেকে ফুলটা সাথে কেমন এক বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। বাগানে গিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলতো ফুলগুলোর সাথে। ওরাও দুলে দুলে জবাব দিত। গান শোনালে গানের ফিরতি জবাব দিত। কিন্তু কেউ শুনতো না।

ফিওনার মনে হতো সে আজগুবি চিন্তা করছে।
ফুলেরা কি কথা বলতে পারে?

কিন্তু তাহলে ফুলগুলো তাকে ডাকছে মনে হতো কেন মাঝে মাঝে। লুকিয়ে কাঁদে ফিওনা সেই হারানো ফুলের জন্য।

মা বলেন ওগুলো অশুভ ফুল, ওদের জন্য কাঁদতে নেই।

*****************************************************

৫.

গবেষণা শেষে সেল-ফিওনা বিস্ময়কর কিছু তথ্য পেল। আবার নতুন রিপোর্ট দিল।

"পৃথিবীর প্রাণীকূল শরীরের বৃদ্ধি ও জীবন ধারনের জন্য নির্ভর করে যেসব খাদ্যের উপর তার পুরোটাই সেল সমাজের অবদান। কয়েক লক্ষ জীবের মধ্যে মাত্র একটা জীব পুরো গ্রহের অধিকাংশ খাদ্য ভক্ষন করে। বাকী প্রাণীকে ওই মানুষের আহার্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে হয়। শাসক জীবেরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে দাবী করলেও তাদের কর্মান্ডগুলো সেল সমাজ তো বটেই অন্যন্য প্রাণীদের জন্যও ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয়েছে। আমি আরো কয়েক জাতের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করেছি, জানতে পেরেছি মানব সমাজের ধ্বংসের ব্যাপারে ওদের সানন্দ সম্মতি আছে।

মানুষেরা খাদ্যের জন্য ধান গম ভুট্টা ইত্যাদি নানান জাতের সেলের চাষ করে। ওইসব উদ্ভিদের নিজেদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য নাই। যাকে যে খোয়াড়ে চাষ করা হয় তাকে সেই খোয়াড়ে থাকতে হয়। মানুষ সেল সমাজের উপর যেরকম অত্যাচার করে, তেমনি অন্যান্য কিছু প্রাণীকেও সেরকম অত্যাচার করে তাদেরকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। কেবল খাদ্য নয়, ওদের পোষাক নামক একরকম বস্তু শরীরের উপর পেঁচিয়ে পরতে হয়। নইলে নাকি ইজ্জত থাকে না। ওই পোষাক বস্তুও উৎপাদিত হয় সেল ও প্রাণী সমাজের একাংশ থেকে। শাসক জীবগন সেল সমাজের উপর এত নির্ভর করার পরও কৃতজ্ঞতা বলে কিছু দেখায় তো না, বরং তারা সেলদের উপর স্বেচ্ছাচারী কায়দায় অত্যাচার করে। কাজ শেষ হলে ওই এলাকার সেল সমাজকে নির্বংশ করে দেয় নির্বিচারে জ্বালিয়ে কিংবা মাড়িয়ে।

"আগেই বলা হয়েছে সেল সমাজের প্রধান দুর্বলতা ওদের যোগাযোগ অক্ষমতা ও প্রযুক্তি বিস্তার। কয়েক লক্ষ লগ পূর্বে এখানে সেল সমাজ যেরকম অক্ষম ও দুর্বল ছিল, বর্তমানে পৃথিবীর সেল সমাজ সেই আদিম দুর্বলতার ভেতর রয়ে গেছে। এই দুর্বলতা কাটিয়ে প্রযুক্তির বিবর্তনে সামিল হতে পৃথিবীর সেল সমাজেরও কয়েক লক্ষ বছর টিকে থাকতে হবে। কিন্তু মানুষ নামের নোংরা প্রাণীদের অত্যাচারে সেল সমাজ বিলুপ্ত হয়ে যাবে কয়েক হাজার লগের মধ্যে। সুতরাং যা করার এখুনি করতে চাই।"

ফিওনা তার বক্তব্যের প্রথমাংশ শেষ করলো।

চিন্তিত কন্ঠে নিউক জানালো, "হুমমম....এখুনি করতে হবে? কি করত চাও তুমি?"।

ফিওনা বললো, "উপায় আমার আছে। আমি তিনটা বিকল্প রাস্তার কথা ভেবেছি। আপনি অনুমতি দিলেই বলতে পারি।"

নিউক বললো, "তোমার প্রস্তাব বলো।"

ফিওনা আবার শুরু করলো।

"১. পৃথিবীতে সেল সমাজকে প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে সর্বপ্রথমে। মানুষের কুটচালে প্রচুর প্রজাতির সেল মানব প্রদত্ত খাদ্যের উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে। কৃত্রিম খাদ্য সেল সমাজের জীবনক্রিয়াকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ করলেও তারা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিচ্ছে। নয়তো তাদের মৃত্যু অনিবার্য। দুঃখজনকভাবে কিছু কিছু সেল নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ ও অন্যন্য জীব নিসৃত ঘৃণিত বর্জ্যের উপর। সেই নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে বিকল্প খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। বিকল্প খাদ্যের প্রতি মনোযোগী করার জন্য সেল সমাজে আমাদের জেনেটিক কোড প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। ওই গ্রহের বায়ুমন্ডলে পরিবর্তন আনা ছাড়া খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা যাবে না। প্রযুক্তির আওতায় আনলে মানুষের উপর নিজেরাই আঘাত হানতে পারবে।

"২. ওদের বায়ুমন্ডলে ২১% অক্সিজেনকে বাড়িয়ে ২৩% করে দিতে হবে। তাহলে ওই আবহাওয়ায় মানুষ বা অন্য কোন প্রাণী বেঁচে থাকতে পারবে না। বেঁচে থাকবে কেবল আমাদের সেল সমাজ। সেল সমাজকে পরিবর্তিত বায়ুমন্ডলে টিকে থাকার মতো সেল দিয়ে অভিযোজিত করে রাখা হবে। কাজটা সুক্ষ্ণ এবং সময়সাপেক্ষ। পৃথিবীতে যতটা সেল জীবিত আছে তার নির্ভুল তালিকা করে, তাদের নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করে প্রত্যেকের জন্য একেকটি পূর্নাঙ্গ সেল বরাদ্দ করতে হবে। ওখানকার একেকটি বৃক্ষের মধ্যে লক্ষকোটি সেল আছে। তার মধ্যে যে কোন একটা সেলকে বদলে দিতে হবে আমাদের নতুন প্রতিরক্ষা সেল দিয়ে। নতুন সেলগুলোকে প্রোগ্রাম করে দিতে হবে যাতে ওই বৃক্ষকে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে।

"৩. মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করবে আত্মনিবেদিত সেল সমাজ। ওদের সকল খাদ্যের ভেতর সুক্ষ্ণ ধ্বংসাত্মক সেলকে প্রতিস্থাপন করা হবে। পৃথিবীর সবগুলো উদ্ভিদ যেদিন আমাদের সেলের আওতায় আসবে সেদিন আমরা বিজয়ের পথে হাঁটবো। হয়তো কোটি কোটি সেলের বিনাশ ঘটবে। কিন্তু তার বিনিময়ে গ্রহটি হবে সবুজ সুন্দর এবং গ্রহটি হবে আমাদের।"

ফিওনা তার বক্তব্য শেষ করলো। নিউক দুটি নীল রশ্মি জ্বালালো আকাশের দিকে। তার মানে তার ভাবতে হবে আরো।

বেশ অনেকক্ষন ভাবার পর প্রথম দুটো প্রস্তাবকে নাকচ করে দিল। প্রথম প্রস্তাবে ওই সেল সমাজের ভেতর আমাদের জেনেটিক কোড প্রবেশ করিয়ে বুদ্ধিমান করে তুললে তাদের সাথে আমাদের সেলের সংঘাত লেগে যেতে পারে গ্রহের দখল নিয়ে। জেনেটিক কোড বদলানো বহুত ঝক্কির কাজ।

দ্বিতীয় প্রস্তাবও অনেক ব্যয়বহুল। এত কোটি সেল বরাদ্দ করা সম্ভব নয়। কারন পুরোটাই অপচয় হবে। তাছাড়া তাতে করে অন্য নিরীহ প্রাণীগুলো মারা পড়বে। আমরা তো কেবল একটা প্রজাতি ধ্বংস করতে চাই।

সব হিসেব করে দেখলে তৃতীয় প্রস্তাবটিই গ্রহনযোগ্য মনে হয়। কারন ওতে খুব বেশী সেল খরচ হবে না। মাত্র কয়েকটা শস্যের সেল বদলে দিলেই হবে। দ্রুত বাড়িয়ে দেয়া যাবে উৎপাদন। এটা গ্রহন করা যেতে পারে। বেগুনী রশ্মি দিয়ে সম্মতি জানালো নিউক।

নিউকের সম্মতি পাবার পর ফিওনা বললো. "তবে একটা কথা আছে আমার।"
"কি কথা?" নিউক জিজ্ঞেস করলো।
"ওই গ্রহের সব মানুষ ধ্বংস হয়ে গেলেও আমি একটা পরিবারকে বাঁচাতে চাই।"
"কাকে?" নিউক অবাক একটু।
"ফিওনার পরিবারকে।"
"ফিওনা?"
"সেই একমাত্র প্রাণী যাকে প্রথম নেমেই মুগ্ধ হয়ে দেখেছি, সেও আমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে। সেই প্রথম মুগ্ধতার ভালোবাসার স্মৃতিকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে চাই। ওদেরকে আমি বিশেষ সেল দিয়ে বদলে দেব যাতে বিকল্প খাদ্যের জন্য অভিযোজিত হতে পারে।"
"তুমি সত্যি চাও একটা বিপদজনক প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখতে?" নিউক চিন্তিত সুরে বললো।
"আমি চাই। কারন ফিওনাকে আমি পছন্দ করেছি।"

নিউক এবারো দুটো বেগুনি রশ্মি জ্বালিয়ে সম্মতি দিল।

*******************************
কয়েক বছর পরের কথা।

ইতিমধ্যে পৃথিবীতে নতুন জাতের কিছু শস্য আবিষ্কৃত হলো। নতুন জাতের ধান, গম, ভুট্টা, ডাল। নতুন জাতের ফল। নতুন জাতের সবজী। অতি সুস্বাদু, ভিটামিনে ভরপুর। প্রোটিন শর্করা সব ওই শস্যসমূহে পাওয়া গেল। প্রানীজ চর্বির উপর নির্ভরতা কমে গেল। পৃথিবীতে খাদ্যসমস্যার আপাত সমাধান হয়ে গেল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যে দুজন বিজ্ঞানী এই জাতের আবিষ্কার করলো, তারা পরপর দুবছর নোবেল পেল। কিন্তু ঘুনাক্ষরেও তারা কাউকে জানালো না কোন ফরমুলায় তারা ওই জাত তৈরী করতে পেরেছে। যেন স্বপ্নে পাওয়া ঔষধ। পৃথিবীটা সবুজে সবুজ হয়ে যেতে থাকে। মানুষেরা আনন্দে দিন কাটাতে থাকে। পরিবেশে প্রচুর অক্সিজেন। আকাশে বাতাসে অক্সিজেন।

চতুর্থ বছরে এসে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বায়ুমন্ডলের একটা অদ্ভুত সমস্যা দেখতে পেল। বায়ুমন্ডলের ভারসাম্যে কোথাও গন্ডগোল হয়েছে। এখানে ওখানে প্রচুর মানুষ অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যেতে শুরু করেছে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে অনেক মানুষ। হাসপাতাল ডাক্তারে কুলোচ্ছে না। কোন রোগ নেই। কেবল রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। কেন শুকিয়ে যাচ্ছে তার কোন কারন খুজে পেল না। উন্নত দেশে বেশী ঘটতে লাগলো। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশে কম এখনো। যেখানে খাদ্যের প্রাচুর্য সেখানে বেশী মৃত্যু। সবচে কম মারা গেছে আফ্রিকাতে।

গত কবছরে বিশ্বের সর্বত্র জঙ্গল বেড়ে গেছে। পুরো পৃথিবীটা আমাজন হয়ে যাচ্ছে। যেখান ছোট চারা লাগানো হোক, দুমাসে তা লকলক করে বেড়ে দাড়িয়ে যায়। নিউইয়র্কের মতো শহরের আনাচে কানাচে সবুজ জঙ্গল। দেখতে ভীষন সুন্দর। পৃথিবীটা হঠাৎ করে যেন স্বর্গের রূপ লাভ করেছে। কিন্তু স্বর্গের সুধা পান করার মতো মানুষের সংখ্যা কমতে লাগলো।

পঞ্চম বছরে গিয়ে অবস্থা এত খারাপ হলো যে হাসপাতালে নেয়াই গেল না। কেউ কাউকে দেখার রইল না। বাসার বেডরুমেই শুকিয়ে মারা গেল প্রচুর লোক।

পৃথিবীর সবগুলো বড় বড় দেশ সভা করলো। ধনীদেশগুলো বিশেষ ব্যবস্থা নিতে চাইল নিজেদের রক্ষায়। রক্ত কিনে কিনে টাংকি ভর্তি করে ফেলছে লোকজন। গাড়ী বাড়ী জমি জমা সব বিক্রি করে রক্ত কিনছে মানুষ। মানুষের রক্ত শেষ। এরপর পশুপাখির রক্ত সংগ্রহ শুরু হলো। গরু ছাগল শুয়োর কাক চড়ুই পাখীও বাদ গেল না। বাঁচতে হলে রক্ত লাগবে। তবু শেষ রক্ষা হলো না। মরতে শুরু করেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকায়, এশিয়ায়................।

ওই গোলোযোগে আরিলের দেউলিয়া মামলার কথা ভুলে গেল সবাই। আরিল সুসি আর ফিওনাকে নিয়ে এসেছিল পার্থ থেকে ওর গোপন আস্তানায়। অবশ্য তার আগেই ওদের শরীরে এক রাতে তিনটা রশ্মি প্রবেশ করেছিল তা ওরা কেউ জানে না। আরিল ভাবলো এই জায়গা মানব সমাজ থেকে দুরে, তাই মহামারী থেকে এই অঞ্চলে নিরাপদে থাকতে পারবে। খাদ্যের মজুদও আছে প্রচুর। কিন্তু জীবিত মানুষের সংখ্যা একেবারে নেই বললেই চলে। জীবিত মানুষকে আরিল ভয় পায় এখনো। তাই আপাততঃ সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জনেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল আরিল।

জনবিচ্ছিন্ন ওই জায়গায় থেকে আরিল জানতেও পারলো না পৃথিবীতে তারা তিনজনই জীবিত মানব। বাকী সাড়ে ছয়শো কোটি মানুষ শুকিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। যখন জানবে তখন খুব দেরী হয়ে গেছে। পৃথিবীতে মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে বৃক্ষদের রাজত্ব শুরু হয়েছে। গাছে গাছে পাখি ডাকে নির্ভয়ে। অরন্যে বাঘ হরিনের অবাধ ছুটোছুটি শিকার। দুবছর পর শহরের দিকে গিয়ে দেখে চমকে উঠে। এসব কি দেখছে? মানুষজন সব কোথায়। এত নির্জনতা কেন এখানে?

বড় বড় দালানের উপর উঠে গেছে বৃক্ষলতা। বাড়ি গাড়ি সব জঙ্গলের ভেতর হারিয়ে গেছে। পথঘাট সব কংক্রিট হারিয়ে ঘাসের জঙ্গলে রূপ নিয়েছে। কোথাও একটা আগ্রাসন ঘটে গেছে আরিল আন্দাজ করলো। কাদের আগ্রাসন? মাত্র দু বছর আড়ালে ছিল শহর থেকে দুরে, এতেই একটা শহরের মানুষ সবগুলো হারিয়ে গেল? এটা কি সেই রোগের প্রভাব? জীবানু আক্রমন ঘটেছে? জীবানুরা সব মানুষ মেরে ফেললো শহরের? অথচ গাছেদের কিছু হয়নি। গাছেরা আরো সবুজ হয়েছে, পল্লবিত হয়েছে, পুষ্ট হয়েছে।

নাহ এই দেশে থাকবে না আর। জনশূন্য শহরে বসবাস করার কোন মানে হয় না। অস্ট্রেলিয়া নয়তো ইউরোপ চলে যাবে। জিপ গাড়ীটা চালিয়ে বিষন্ন মনে বাড়ী ফিরছে আরিল। বাড়ীর কাছাকাছি যেতেই ফিওনার চিৎকার -"বাবা বাবা দেখো, সেই ফুলটা আবারো ফুটেছে আমাদের বাগানে।"

সেই অভিশপ্ত ফুলটা আবারো ফিরে এসেছে কেন? ভয়ে ভয়ে ফুলটার দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ করে হু হু করে কাঁদতে কাঁদতে ফুলটার পাশে ভাঙ্গা চোরা মানুষ হয়ে বসে পড়লো আরিল।

[সমাপ্ত]