খুব কষেই দৌড়টা লাগিয়েছিলাম। দাঁতমুখ খিঁচে, প্রাণটা আক্ষরিক অর্থেই হাতে নিয়ে।
হেঁটেই ফিরছিলাম। কিন্তু পেছনের একটা দলকে ধাওয়া দিল পুলিশ। ভাঙচুর করছিল ওরা। তাড়া খেয়ে আমার পেছন পেছন ছুটে আসছিল। আমার দৌড় দেবার কথা না হলেও দিতে হলো। দৌড় না দিলে ওদের ধাক্কায় শত পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে যাবো। স্রোতের বিপরীতে থামা যায় না। আবার ওরা আমাকে পিষ্ট না করে পেরিয়ে গেলেও বিপদ। পুলিশ আমাকে মুরগী বানাবে। ধরে নেমে আমিও সেই দলের একজন। পুলিশের পিটুনী সহ্য করার মতো বয়স নেই এখন। তার চেয়ে খানিক দৌড়ে এগিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
দোষী না হয়েও ছুট দিলাম তাই। ছুটতে গিয়ে টের পেলাম বয়স হয়েছে। এই পঞ্চাশে হাঁটুতে অত জোর নেই। তারুণ্যের সাথে ছোটার সময় পেরিয়ে গেছে। তবু জনস্রোতটা আসার আগে পেরিয়ে যেতে হবে ওই গেট, তারপর একটা রেল লাইন, রেল লাইন পেরিয়ে কয়েকশো গজ যেতে পারলে মহাসড়ক, তারপর মুক্তি। ছুটছি, হাঁপাচ্ছি, ছুটছি। নিঃশ্বাস বড় হচ্ছে, বুকে ব্যাথা লাগছে, হাঁটুতেও। উপায় নেই। পুলিশাতংক তার চেয়েও গভীর।
বেতন বাড়ানো নিয়ে আন্দোলন। নতুনদের বেতন বেড়েছে ৮০% কিন্তু পুরোনোরা একই জায়গায়। যেমন আমি। দশ বছর চাকরী করে আমার বেতন ৬ হাজার টাকা। তবু নতুন স্কেল নিয়ে নিয়ে কোন অসন্তুষ্টি নেই। অল্পে তুষ্ট মানুষ আমি।
মামুনেরও আপত্তি নেই। ২২ বছর বয়সী মামুন দুই মাস আগে যোগ দিয়েছে আমাদের কারখানায়। তার বেতন সাড়ে ২১০০ থেকে এক লাফে বেড়ে ৩৩০০ হয়েছে বলে সে খুব খুশী।
কিন্তু কালাম ক্ষিপ্ত। ২৮ বছর বয়সী কালাম তিন বছর ধরে কাজ করছে। দক্ষ শ্রমিক হিসেবে খ্যাতি আছে তার। তার বেতন এখন ৩৫০০টাকা। তিন বছর কঠোর পরিশ্রম করে এই বেতনে এসেছে। বেতন বৃদ্ধির কথা শুনে আসছিল বেশ কয়েকমাস থেকে। কার কতো বাড়বে জানা ছিল না। কালাম শুনে এসেছে এবার ৫০-৮০% বেতন বাড়াতে পারে মালিক। সেরকম হলে তার বেতন হয়ে যাবে কমপক্ষে ৫০০০ টাকা। অনেক টাকা! বড়লোক হয়ে যাবে সে।
মালিকের লস হবে বলে ওরা একটু আফসোসই করছিল। আবার অতি বুদ্ধিমান কেউ কেউ বলছিল, মালিকের লস নাই, বড়জোর লাভ কম হবে। মালিকের অনেক টাকা। লাভ কম হলে সমস্যা নাই। তাদেরই দরকার বাড়তি টাকা। এই মাস থেকে দেড় হাজার টাকা অতিরিক্ত গোনার অধীর অপেক্ষায় থাকে কালাম। মামুন তার হেলপার। ছেলেটা ভালো। চটপটে। কথা বললে শোনে। গুরুমান্য করে তাকে।
তিনদিন আগেও মামুন বলছিল, ওস্তাদ, এবার বেতন পাইলে আমারে সিনেমা দেখাইতে নিবেন, কথা দিছেন গতমাসে। কালাম মুচকি হেসে বলে, শুধু সিনেমা না, তোরে বিরানীও খাওয়ামু।
বেতনের দিন টাকাভর্তি খামটা হাতে পাবার পর বুক ধুকপুক ধুকপুক কালামের। খাম খুলে টাকা গুনে। একবার, দুবার, বারবার। ভ্রু কুঁচকে যায় তার। এদিক সেদিক তাকায়। অন্যদের দেখে। তারাও গুনছে। হিসেব মেলে না। কোথাও একটা ভুল হয়েছে। টাকা ভরতে গিয়ে কয়েকটা নোট ভুলে পড়ে গেছে হয়তো। অফিসে কমপ্লেন করে আসতে হবে। কিন্তু খামের উপর ছাপানো অংকটাও কি ভুল? ওখানে জ্বলজ্বল করছে ৩৮০০ টাকা। আশেপাশে কালামের সমকক্ষ যারা, তাদের মুখও শুকনো।
ওদিকে নতুনদের উল্লাস। ঈদের আনন্দে কোলাকুলি করছে। মামুন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কালামকে। ওস্তাদ, চলেন আপনারে আগে আমি সিঙ্গাড়া খাওয়াই। তারপর আপনার সিনেমা।
কিন্তু কালাম তখন অবশ হয়ে আছে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় মামুনের দিকে। মামুন বলে, কি হইছে? কালাম আস্তে করে খামটা দেখায়। মামুনেরও ভ্রু কুচকে যায়। আশে পাশে তাকায়। দেখা গেল নতুনদের উল্লাসটা আস্তে আস্তে কমে গিয়ে কেমন থমথমে হয়ে আছে পরিবেশটা। কোথাও তাদের ফাঁসানো হয়েছে অংকের খেলায়। অফিসে গেল একজন একজন করে। ফিরে এলে জানা গেল, নতুনদের বেতনের ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা থাকলেও পুরোনোদের কি হবে সেরকম স্পষ্ট কোন নির্দেশনা ছিল না। তাই মালিকপক্ষ পুরোনোদের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবু গড়ে তিনশো টাকা করে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে সবার বেতন। কিন্তু প্রণোদনা ভাতা এই মাস থেকে বাতিল করা হয়েছে। মাসিক প্রণোদনা ভাতা ছিল ৩০০ টাকা। প্রত্যেকদিন উপস্থিত থাকলে এই ভাতা দেয়া হতো। তার মানে পুরোনোদের বেতন ৩০০ টাকা বেড়েছে, আবার অন্যদিকে ৩০০ টাকা কমেছে। বেতন বাড়িয়েছে বলে এই তামাশার মানে কি?
কালামরা মেনে নিতে পারে না এই প্রহসন। কাজ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে যায় ওরা। পেছন পেছন বেরিয়ে যায় সহমর্মী মামুনেরাও।
আমি মালিকের বিশ্বাসী কর্মচারী, সবাই বেরিয়ে গেলেও আমি যাইনি। যার নুন খেয়েছি তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে পারবো না। বেতনে না পোষালে চাকরী ছেড়ে দিব। কিন্তু কিছুক্ষণ পর টের পায়, বাইরের অবস্থা খারাপ। বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে গন্ডগোলের খবর আসছে। ভাঙচুর শুরু হয়েছে। মিছিলের পর মিছিল। ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দুরে ধোঁয়া দেখতে পাই। পোলাপানের এসব আন্দোলন ভাঙচুর ভাল্লাগে না আমার। তোদের না পোষাইলে চইলা যা। জোর করে তোরে এই বেতনে চাকরী করতে বলছে কেউ? যত্তসব। বিরক্ত লাগছে আমার।
এগারোটার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে ফ্যাক্টরী ছুটি ঘোষণা করা হয়। এইটা শুনে ভালো লাগে আমার। আইনতঃই বাড়ী যেতে পারবো এবার। বেআইনীভাবে কালামদের সাথে বেরিয়ে গেলে মনটা অপরাধে খচখচ করতো। এখন বাইরের হাজার গন্ডগোলেও মাথাব্যাথা নাই। যার যেদিকে খুশী যাক। আমি বাড়ী যাবো। নগদ বেতন পকেটে। সুপ্রিয়া বলছিল এবার বেতন পেলে ওকে একটা টাঙ্গাইল শাড়ী কিনে দিতে। ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া তন্নী আবদার করছিল 'বাবা আমাকে একটা নতুন সুয়েটার কিনে দিও'। বলেছিলাম দেবো, কিন্তু কেনার সময় পাচ্ছিলাম না। কারখানা ছুটি হতে হতে মার্কেট বন্ধ হয়ে যায়। আজকে একটা ভালো সুযোগ। পকেটে টাকাও আছে, সময়ও যথেষ্ট।
হেলেদুলে চলছিলাম। চারপাশের এত উত্তেজনা আমাকে স্পর্শ করছে না। এসবের সাথে আমার কোন সংযোগ নাই। সুপ্রিয়া আর তন্নীর জন্য আর কি কেনা যায় ভাবতে ভাবতে নিজের জন্যও কি কেনা যায় ভাবছি। অনেকদিন কিছু কেনা হয় না। সুপ্রিয়া বলছিল, আমার হাতে একটা ঘড়ি থাকলে নাকি খুব মানাতো। তার টাকা থাকলে কিনে দিত। ঠিক আছে রিয়াজুদ্দিন বাজারের ফুটপাত থেকে না হয় একটা ঘড়ি কিনেও নেয়া যাবে এক-দেড়শো টাকায়।
ইপিজেডের প্রথম গেটটা আরেকটু সামনেই। তাড়াটা এসেছিল একদম আচমকাই।
এখনো ছুটছি। ভাবছি আর ছুটছি। ছোটার গতির চেয়ে ভাবনার গতি বেশী। হঠাৎ কেমন আতংক ভর করলো। যদি পুলিশের হাতে পড়ি? কিন্তু আতংকটা গতি বাড়াতে পারলো না। হাঁটুতেও জোর দিল না। পা দুটো কেমন অনিচ্ছুক মনে হলো। ছুটতে ছুটতে হাঁপানি বেড়ে গেল। আর পারছি না। দম টাইট হয়ে আছে ভেতরে। চারদিক ঘুরছে কেন। ওই তো রেললাইন। ওটা দিয়ে এখন ট্রেন চলে না। রেল লাইন বেয়ে চলে যাবো? নাকি সোজা যাবো। সোজা গেলে পুলিশের ট্রাকের সামনে পড়বো না? বাম দিকে মোড় নেবো না ডানদিকে?
আর পারছি না। ডান বাম কোথাও যাওয়া হলো না। একটা ইটের কোনায় ঠোক্কর খেয়ে পড়ে গেলাম রেল লাইনের উপরে। ভাগ্য ভালো মাথাটা বাঁচলো। উঠে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু উঠতে পারছি না কেন? দুই হাত অবশ লাগছে। পা দুটোও। ব্যাথা নয়, বেদনা নয়। কেমন অচেনা অবসন্নতা সমস্ত শরীর জুড়ে। বুকের ভেতর শিনশিন করছে।
পেছনের মিছিল পুলিশ আগুন আন্দোলন ভাঙচুর সব ভুলে গিয়ে ছোট্ট তন্নীর অপেক্ষমান মুখটা ভেসে উঠলো। কী অবাক হয়ে যেত আজকে বাবাকে অসময়ে বাড়ী ফিরতে দেখলে। কখনো ফেরেনা বাবা দিনের বেলা। কতো আফসোস সোনাটার। ওকে অবাক করতে এত আনন্দ আমার! এত আনন্দ! কতোদিন ওকে ওরকম অবাক করা হয় না!
মিছিলের ছেলেগুলো আমার আশপাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু অলস আমি শুয়ে আছি রেললাইনে মাথা দিয়ে যেই রেল লাইন দিয়ে গত বিশ বছরেও কোন ট্রেন আসেনি। অবসন্নতা কেটে যাবার বদলে আরো যেন গভীর হয়ে এল। আমার বগলে হাত দিয়ে কে যেন টেনে তোলার চেষ্টা করছে মনে হলো। কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছি না, চোখের পাতাটা ঢাকা। কেবল টের পেলাম মাথার উপর জ্বলতে থাকা সূর্যটা মাঝদুপুরেই নিবে গেল।
[পাদটীকাঃ এটি নেহাতই একটি গল্প। সাম্প্রতিক সিইপিজেড ঘটনায় নিহত স্যাম সুপিরিয়র অ্যাপারেলের নিহত শ্রমিক রূহী দাসের সাথে গল্পের রূহীদাসের কেবল দুটো মিল আছে। দুজনেই শ্রমিক সংঘর্ষের সময় মারা গেছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে এবং দুজনের কেউই পুলিশের গুলি খায়নি]
No comments:
Post a Comment