তটা বয়স চলে গেলো, তবু কি আশ্চর্য, আজো কী জানলাম/ চড়ুইয়ের ঠোঁটে কেন এত তৃষ্ণা?/ খড়ের আত্মায় কেন এত অগ্নি, এতটা দহন?/ গোলাপ নিজেই কেন এত কীট, এত মলিনতা নিয়ে তবুও গোলাপ?
এতটা বয়স চলে গেলো, তবু কি আশ্চর্য, আজো কী জানলাম/একটি শিশুর কেন এত নিদ্রা, এত গাঢ় ঘুম আর/তখন আমরা কেন তার মতো ঘুমুতে পারি না?
(আদিজ্ঞান / আবুল হাসান)
জামাল হাবীবের ঠোঁটটা নড়ছে মৃদু। কিন্তু কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। পাশেই অরুনের স্ত্রী পাপিয়া দাঁড়ানো। বলছে, “বাবা তুমি কিছু খাবা? অ্যাই, বাবাকে একটু ডালিমের রস দাওতো। বাবার তেষ্টা পেয়েছে বোধহয়।“
অরুন গিয়ে ডালিমের রস এনে মুখে তুলে দেয়। অল্প মুখের ভেতরে যায়, বাকীটা বাইরে।
২০ বছর আগে চাকরী থেকে অবসর নেবার পর থেকে প্রায় ১৮ বছর সচল ছিলেন। গত দুবছর ধরে নানান জটিল রোগের কারণে হাসপাতালে আসা যাওয়া চলছিল। কাজ হয়নি। গত তিন মাসে শেষ অবস্থায় চলে এসেছে। কথাবার্তা কিংবা লোকজন চেনা বন্ধ হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোন অভিব্যক্তি নেই। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে।
বাসায় রেখে সেবা যত্নে অসুবিধা হয় বলে বাড়ীর পাশে নার্সিং হোমে রাখা হয়েছে। স্বচ্ছল মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষ আশ্রয়।
আত্মীয় স্বজন মানসিকভাবে প্রস্তুত যে কোন মধ্যরাতের একটা টেলিফোনের। দু দুবার মাওলানা ডেকে তাওবা পর্যন্ত পড়ানো হয়েছে। কিন্তু জামাল হাবীবের প্রানবায়ু কি করে যেন এখনো আটকে আছে। ঘনিষ্টতম মানুষেরাও বিরক্তিতে ভুগতে শুরু করেছে।
পুত্রকন্যারা সেবা যত্ন করতে করতে ক্লান্ত। তারাও বিশ্রাম চায়। আট পুত্রকন্যা আর তাদের সন্তানেরা গত তিন মাস পালা করে ডিউটি দেবার পর আজ যখন শুনলো একটু ভালো লাগছে, তখন বাড়ী ফিরে গেল কেউ কেউ। বুঝলো জামাল হাবীব এবারও ঘরেই ফিরবেন।
অরুন বাবার কনিষ্ঠ সন্তান। চাকরীর হাজার ব্যস্ততার পরেও নার্সিং হোমে প্রতিদিন ডিউটি দেয়। একমাত্র অরুনই বাবার অসুস্থতা নিয়ে একটুও বিরক্ত হয়নি। সে সত্যি সত্যি চায় বাবা আবার সুস্থ হয়ে উঠুক।
বাবার ঠোঁট নড়া থামছে না। বাবা কি কিছু বলতে চায়? কাছে গিয়ে বাবার মুখের কাছে কান পেতেছে কয়েকবার। কিন্তু কোন শব্দ নেই। কেবল নড়ছে ঠোঁট দুটো। “পানি খাবে বাবা? নাকি ডাব? বলো বাবা”। ফিসফিস করে অরুন। এটা সেটা মুখে দিয়ে চেষ্টা করে।
কিন্তু বাবা কিছুতেই সন্তুষ্ট হচ্ছে না। বাবার চাওয়াটা বুঝতে অক্ষম হলো বলে অসহায় দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরে অরুন। বাবা কি চায়? এত ঘন ঘন ঠোঁট নাড়ছে কেন বাবা? পানি দেয়া হলো, ডাব দেয়া হলো, ফলের রস দেয়া হলো, কিছুই নিচ্ছে না।
তিনটি মাস বাবা একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। কি খাবে, কেমন লাগছে, কোথায় অসুবিধা হচ্ছে, কিছুই বোঝার উপায় নেই। বাবা কিছু চাইতে ভুলে গেছে। কিন্তু আজ বাবার ঠোট নড়ছে খুব বেশী। চোখটা নাড়াচ্ছে উপর নীচ। কি চায় বাবা?
জামাল হাবীবের কোন অনুভূতি অবশিষ্ট নেই। প্রায় সব ইন্দ্রিয় অকেজো। কেবল একটা বোধ জেগে আছে। সেই বোধটার নাম বোধহয় তৃষ্ণা। জলের তৃষ্ণা নয়। অরুণকে একটি বার ছুঁয়ে দেবার তৃষ্ণা। একটি বার অরুণের হাতটা বুকে চেপে ধরার তৃষ্ণা। একটি বার অরুণের আদর পাবার তৃষ্ণা। যে স্পর্শ দিয়ে অরুণকে তিন দিন বয়সে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছে, সেই স্পর্শের তৃষ্ণা জেগে উঠেছে এতকাল পরে। জীবনে তিনি কখনো কিছুর লোভ করেননি। কিন্তু আজ এই স্পর্শের লোভ পেয়ে বসেছে তাঁকে।
বড় হবার পর অরুণকে আর আদর করা হয়নি তাঁর। এসএসসি দেবার পর অরুণ যেন অনেক বড় হয়ে যায়। গত পঁচিশ বছর অরুণকে আর সেভাবে কাছে পায়নি। আজ খুব ইচ্ছে করছে শেষবার অরুণের ছোঁয়া পেতে বুকের মাঝখানটিতে। অন্ততঃ একবার অরুন তাকে জড়িয়ে ধরে বলুক, বাবা আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কিছুই করা হয় না। কিছুই বলা হয় না। কেউ বোঝে না জামাল হাবীব কি চায়। অরুনও না।
জামাল হাবীবের শরীরটা একটু কেঁপে ওঠে। কাঁপতে থাকে গলার কাছটা। গরগর শব্দ হতে থাকে। সবাই ছুটে যায় বিছানার কাছে। অরুন তার হাতটা বাবার হাতে রাখার সাথে সাথেই বোধহয় শেষ নিঃশ্বাসটা নির্গত হয়ে গেল। সে পাগলের মতো বাবার পালস খোঁজে। নেই।
ডুকরে কেঁদে ওঠার আগে অরুন খেয়াল করে বাবার ডান চোখের কোনে একফোঁটা অক্ষম শিশির।
No comments:
Post a Comment