আমি একজন অসাধারণ মানুষ। আমার কোন তুলনা হয় না। আমার কোন প্রতিপক্ষ নাই। আমি নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ। নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আমি নিজেকে তীব্ররকমের অপছন্দ করি।
.
প্রথম অপছন্দ...... আমার নামটা। আমার গভীর বিশ্বাস জন্মকালে আমার নামকরনের ব্যাপারটা একটা ষড়যন্ত্র কিংবা অবহেলার ফসল।
.
প্রত্যেক পরিবারে সন্তানের নাম রাখে পিতামাতা। কিন্তু আমার নাম রেখেছিল আমার মেজফুপা। মেজফুপার সাথে বাবার সাপ নেউলের মতো একটা ভালোবাসা ছিল বলে এই নামকরনের ব্যাপারটা আমাকে সন্দিহান করে তোলে। আমি বিশ্বাস করি, শত্রুতা করেই আমার নাম রাখা হয়েছে আমিন বকশী। দরিদ্র পিতামাতা ধনী ফুপার প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে পারেনি বলেই নিমরাজী হয়েছিল বলে মনে করি। ত্রিশের দশকে জন্ম হলে না হয় মেনে নিতাম নামটা। কিন্তু সত্তর দশকের শেষভাগে জন্মেও এরকম একটা নাম বহন করার ভার যে কতো কঠিন সেটা একজন ভুক্তভোগীই জানবে।
.
নাম মানুষকে বড় করে না, মানুষই নামকে জাগিয়ে তোলে। কথা সত্য। কিন্তু এই নামের কারণে আমাকে কতো জায়গায় ভুগতে হয়েছে!! বাল্যকাল থেকে আমাকে শোনানো হয়েছে আদিমযুগে আমার নামে একজন পূণ্যবান ব্যক্তি ছিল এই এলাকায়। তার নামে নামটা রাখা হয়েছিল আমার। আমি বিশ্বাস করি ওটা ডাহা মিছা কথা।
.
আমার নামের দুইটা অংশ। দুই অংশেই আমি কোন ভালো জিনিস পাইনি। এই নামের যত লোক দেখেছি তাদের সব ছাপোষা কেরানী নয়তো পিয়ন দারোয়ান চৌকিদার। তাই ছেলেবেলা থেকেই নাম নিয়ে একটা হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে বড় হয়েছি। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে চুপ থাকতে পছন্দ করতাম। ইচ্ছে হতো নামটা বদলে অন্য কিছু রাখি। আমার এক কাজিন মেট্রিক পাশ করার পর নাম বদলে ফেলে। তার নাম ছিল আবদুল কুদ্দুস, বয়স ষোলতে পৌঁছে সে হয়ে যায় 'আকাশ আবেদ'। নিজেই নিজের নাম পাল্টে দিয়েছে। সে কারণ দেখায়, কবিদের সুন্দর নাম থাকতে হয় এবং আকিকা ছাড়াই নাম বদলে রাখার সুযোগ আছে কবিতার স্বার্থে। জগতে কেউ সেটার বিরোধিতা করে না।
.
কিন্তু আমি কবিতা লিখতাম না। ফলে আমার নাম বদলানোর সুযোগও ছিল না। জন্মমাত্র ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে। ছাত্রজীবনে কোন মেয়ে প্রেম করতে আসেনি এই নামের কারনেই। এমনকি মেয়ে ক্লাসমেটরাও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো নামটাকে। ফলে অনেকটা গুটিশুটি মেরে ভার্সিটি পার করি। পাশ করার পর যা হবার ছিল তাই হয়েছে। একটা সদাগরী অফিসের কেরানীর চাকরীই জুটলো যদিও রেজাল্ট একেবারে খারাপ ছিল না। কিন্তু বকশী নামের কারনেই বোধহয় ভালো কোন কোম্পানী নিল না আমাকে।
.
আমার দ্বিতীয় অপছন্দ........আমার হাসিটা। আয়নায় আমি নিজের হাসি দেখলে চমকে উঠি। বিধাতা এ কি হাসি দিয়ে পাঠিয়েছে আমাকে? দেখতে তো আমি নেহাত খারাপ না। চেহারাটা ফর্সা গোলগালই। মাথায় ঘনকালো চুল। নিয়মিত প্যারাসুট নারিকেল তেল দেই। কিন্তু যেই আমার হাসি পায়, আমার দুই ঠোট এবং দাঁতের মধ্যেকার দুরত্বটা কেমন যেন বেফাঁস বেড়ে গিয়ে দাঁতের পাটি, মাড়ি আর দুই ঠোঁটের একটা বহুমাত্রিক বিষমভুজ তৈরী হয় যা প্রায় অবিশ্বাস্য একটা বিভৎসতা তৈরী করে মুখমন্ডলে।
.
একবার একটা মেয়ে মুখ ফুটে বলেই দিয়েছিল, "আপনি হাসবেন না বকশী ভাই, হাসলে আপনাকে হনুমানের চেয়েও জঘন্য লাগে। তবে গম্ভীর মুখে আপনি শাহরুখ খানও হতে পারেন।"
.
বুকে পাথর চেপে মেনে নিয়েছি এবং দ্বিতীয় বাক্যটা শান্ত্বনা বলেই ধরে নিয়েছি। সেই থেকে আমি হাসি ঠাট্টার আসর এড়িয়ে চলি এবং রুমাল বহন করি পকেটে।
.
আমার তৃতীয় অপছন্দ......আমার হাঁটা। আমি যখন হাঁটি আমার সাথে সাথে যেন পৃথিবীটা দুলে। এটা আমার কথা না, ছেলেবেলায় এক বন্ধু বলেছিল। সে আমার ঠ্যাং দুটো পরীক্ষা করে বলেছে, ওগুলোর হাড্ডি নাকি ঈষৎ গোলাকারে বাঁকানো। ফলে আমি দুধার কাঁপিয়ে হাঁটি, সাথে সাথে দুনিয়াও নাকি এপাশ ওপাশ করে। ব্যাপারটাকে আমি সম্মানিত ভেবে অনেকদিন কাটিয়েছি। ফুটপাতে লোকজন আমাকে দেখলে সসম্মানে রাস্তায় নেমে যেত। ধরে নিতাম ওরা আমাকে কেউকেটা ভাবছে। মার্কেটের আয়নায় নিজের হাঁটা গম্ভীর ভাবে পরখ করতাম গোপনে। বাহ, দুই হাতের সাথে দুই পায়ের ছন্দে একটা মিল। খান্দানী লাগে বুঝি। নিজের গোপন প্রশংসায় আপ্লুত।
.
একদিন সেই খান্দান ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল যখন ভার্সিটিতে সহপাঠি তানভীর বললো, "তোর হাঁটাটা বদলানো দরকার দোস্ত, তোরে একদম নাদানের মতো লাগে। দুই হাত ওরকম দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটিস কেন?"
.
আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো। তাকে বারবার জিজ্ঞেস করা হলো ঠাট্টা করছিস, নাকি সত্যি বলছিস? সে একই উত্তর দিল। তারপর রাকিবকে স্বাক্ষী করে, আরো পাঁচজনের আড্ডায় স্বীকার করা হলো আমার হাঁটাটা নিতান্ত হাদারামের হাঁটা। কোন ভদ্র শিক্ষিত ছেলে এভাবে দুহাত দুলিয়ে হাঁটেনা। এটা বদলানো উচিত।
.
সেদিন থেকে হাঁটাহাঁটি চরম অপছন্দ হয়ে গেল আমার। পারতপক্ষে হাঁটিনা। মাইলের পর মাইল হাঁটা মানুষ এখন রিকশায় উঠে যায় একশো হাত যাবার জন্যও। নিউমার্কেটে আয়নাওয়ালা দোকান আছে প্রচুর। আয়না দেখে দেখে আলগোছে চেষ্টা করেছি নিজেকে শুদ্ধ করতে। কিন্তু আমিন বকশীর হাত পা মাথা নোয়াবার নয়। তার হাত দুটো হাঁটার ছন্দে দুলতেই থাকে। পা দুটো নাচতেই থাকে। চুপি চুপি ভাবতে থাকি, অন্যরা হাঁটার সময় তাদের হাত দুটো কোথায় রাখে? ঝুলিয়ে হাঁটে নাকি সুতলিতে বেঁধে রাখে? আর পা দুটো?
.
নিজেরে নিয়ে এই তিন অপছন্দের ভেতরে বিব্রত জীবন যাপন করি। আর ভাবি, এখনকার কোন কবি কেন বলে না, আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতেও কেউ কেউ এই ধরনীতে আসিয়াছে।
No comments:
Post a Comment