১.
রাত কতো জানি না। ঘড়ি নেই। সময়ের কোন হিসেব রাখবো না বলে ঘড়ি আনিনি।
ঘরটা ভেঙ্গে পড়বে মনে হলেও ছুটে বেরিয়ে যেতে সাহস হচ্ছে না ঘুটঘুটে অন্ধকারে।
.
কুঁড়ে ঘরের চালের উপর থেকে এবার গরররররররর গররররর জাতীয় অদ্ভুত কিছু বিজাতীয় শব্দ ভেসে আসছে। ভীতু মানুষ না হলেও, এই সময়ের জন্য সাহসটা দমে গেল। এডভেঞ্চারের শুরুতে বেঘোরে মারা পড়াটা কোন কাজের কাজ হবে না। তবে ভয়ের চেয়েও একটা বিচিত্র অভিজ্ঞাতর লোভ অনেক বেশী আবিষ্ট করে রেখেছে বলে ভয়টা দাঁত ফোটাতে পারছে না।
.
অতীত থেকে শিক্ষা পেয়েছি যে দুর্যোগ থেকে বেঁচে গেলে সেই দুর্যোগই পরে মধুর স্মৃতিচারণ হয়ে ওঠে। সেরকম বেশ কয়েকটা অভিজ্ঞতা ঝুলিতে জমা আছে। সেন্টমার্টিনে প্রথমবার যাবার সময় মাঝ দরিয়ায় ছোট্ট নৌকাসহ ডুবে যাচ্ছিলাম দেখেও ভয় পাইনি ঢেউয়ের সেই অপরূপ রুদ্র মূর্তি শ্রীকান্তের চোখে দেখেছিলাম বলে।
.
আন্দাজ করার চেষ্টা করছি কিরকম জন্তু হবে পারে। এই অঞ্চলে কি কি হিংস্র জন্তু আছে তার তালিকা বাংলাপিডিয়ায় পড়েছিলাম অনেক আগে। এখন মনে আসছে না।
.
বাংলাপিডিয়ার কথা মনে পড়লে আমার এখনো লজ্জা হয়। প্রথম যখন ওটা প্রকাশিত হয়, সহজে কিনতে পাওয়া যেত না। হেলায় সুযোগ না হারানোর জন্য কারেন্ট বুক সেন্টারে গিয়ে আগাম অর্ডার দিয়ে রাখলাম। তারপর যখন ঢাকা থেকে জিনিস এলো, ষ্টক ফুরিয়ে যাবার ভয়ে দ্রুততম পথে দশ হাজার টাকায় পুরো সেট কিনে আনি বাসায়। কিন্তু বিজয়ীর হাসিটা ফুরোবার আগে কদিন বাদেই শুনি পুরো বাংলা পিডিয়ার ডিজিটাল ভার্সন মাত্র আশি টাকায়। ওটা ছিল বই কিনে আমার জীবনে অন্যতম ধরা।
.
যাককে, ধান ভানতে শিবের গীত চলে আসছে আবারো। জঙ্গলে ফিরি এখন।
.
২.
উপরে যে জন্তু হানাহানি করছে তা জানার চেয়ে এখানে চুপচাপ বসে থাকি। জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞানতা কখনো কখনো শ্রেয়তর। বাইরে বেরিয়ে টর্চ মেরে দেখতে গেলে ওদের ডিনারের খাদ্য হয়ে যেতে পারি। এখনো নিশ্চিত না ওদের লড়াইটা কি নিয়ে। অসম্ভব কিছু না, হতে পারে আমাকে দখল করা নিয়েই যুদ্ধ। আমার শরীরে যে মাংস আছে তাতে দুটো বাঘের কুলোবে না। তাই হয়তো ফয়সালা চলছে, মানুষ বেটা কার?
.
এটা মাথায় আসার পর গা শির শির করলো। মানুষ খেকো বাঘ নাকি ভয়ংকর জিনিস। আমার কাছে একটা মাল্টিপারপাস পকেট নাইফ বাদে আর কোন অস্ত্র নাই। খালি হাতে আত্মরক্ষা বিদ্যায় কালোফিতার পদক থাকলেও সেটা বাঘভালুকের বিরুদ্ধে কোন কাজে আসছে না। সুযোগ থাকলে ঝেড়ে দৌড় দিতাম, কিন্তু জঙ্গলের যে অবস্থা, দিনের বেলা পায়ে হেঁটেই চলা মুশকিল। রাতে তো পুরা আন্ধা। ঠিক এই সময়ে বিধাতার উপর একটু ক্ষোভ জন্মালো মানুষের প্রতি আনফেয়ার ট্রিটমেন্ট করার জন্য। সকল হিংস্র জীব জন্তুরই বিল্টইন নাইটগ্লাস আছে। কোন যন্ত্র ছাড়াই ওরা রাতের বেলাও ফকফকা দেখে। মানুষের নখ দাঁত কিছুই মজবুত না, তার উপর নাইটগ্লাসও নাই। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একেবারে অচল। এটাকে ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট হিসেবে মেনে নিয়ে কান খাড়া করে শুয়ে থাকলাম।
.
এই ঘরে কোন দরোজা নেই। যে ফোকর দিয়ে আমি ঢুকেছি এত অন্ধকারে সেটার অবস্থানও বুঝতে পারছি না। অন্ধকার এত ঘন হতে পারে এরকম জায়গায় না এলে কেউ বুঝবে না। কোন কোন সাপ(নাকি সব সাপ) নাকি চোখে দেখে না, জিহ্বা দিয়ে শুনে শুনে শিকারকে টার্গেট করে। আমিও কানকে চোখের বিকল্প অবস্থানে দিয়ে তৈরী থাকলাম আক্রান্ত হওয়ার জন্য।
.
এমন সময় দূরে কোথাও তীক্ষ্ণ একটা চীৎকার শোনা গেল। হায়েনা নাকি? তারপর একটা শেয়ালের ডাক। শেয়ালের ডাক থামতে না থামতেই আরো কয়েকটা শেয়াল ডাক ছাড়া শুরু করলো। আবারো সেই হায়েনার মতো তীক্ষ্ণ চিৎকার। আমি হায়েনার ডাক চিনি না। কিন্তু আন্দাজে মনে হলো। ডাকটা কাছে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ মাথার উপর থেকেও সেরকম ডাক শুনতে পেলাম। কান ঝালাপালা করে ফেললো সেই চিক্কন ডাক। ধাপাধাপি থামিয়ে চিৎকার শুরু করলো এবার। আমার কানের পর্দা না ফাটিয়ে ছাড়বে না। আরো কয়েকটাকে আমন্ত্রন করছে নাকি ডিনারে?
.
এই ঘরে আছে এক এক মানুষের ছাও
তোমরা সকলে মিলে তাড়াতাড়ি আও
.
কাহিনী যদি এই হয়, তাহলে আজকেই আমার দিন শেষ। কেউ জানবেও না পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন জঙ্গলে বেঘোরে বন্য জন্তুর পেটে চলে গেছে একটা আস্ত মানুষ। পত্রিকার পাতায় কদিন নিখোঁজ সংবাদ আসবে। তিন মাস পর পরিচিত সাংবাদিক ফলো আপ নিউজ করবে স্থানীয় পত্রিকায়, "আজ তিন মাস হয়ে গেল আবুল হোসেন আমাদের মাঝে নেই। আজ থেকে তিনমাস আগে ২১ ডিসেম্বর শনিবার সকালে কাউকে না বলে উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাকে সর্বশেষ মুরাদপুর বাস স্টেশানে দেখেছে বলে জানিয়েছে তার সহপাঠি জহিরুল। প্রাথমিকভাবে অপহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও তাহার মুক্তিপন ঘোষনা করে কেউ যোগাযোগ করেনি। আবুল হোসেন একজন সৎ নির্বিবাধী সাহসী ও মানবতাবাদী সমাজদরদী মানুষ ছিলেন। তিনি গতবছর তার ছেঁড়া পাঞ্জাবীটা রিকশাচালক নুরুল ইসলামকে দান করেছিলেন।"
.
৩.
হঠাৎ চিক্কুর পাক্কুর সব চুপ। কোথাও কোন শব্দ নেই। পোকা মাকড়গুলো অবিরত চিৎকার করে যাচ্ছে। এই ব্যাটাদের গলা ব্যাথাও হয় না। ঝিঁঝিঁ পোকার গলা কি দিয়ে বানানো খোদা মালুম। সিনথেটিক কোন বস্তু না থাকলে ওটা এত চিৎকারে ফেটে চোঙ্গা হয়ে যেত। মশামাছি বরং খুব ভদ্রজাতের প্রাণী। চিৎকারে অভব্যতা নেই। আমার সাহস ফিরে আসছে। উঠে বসলাম সাবধানে। তবু মচ মচ করে কঁকিয়ে উঠলো। এটা শুনে জন্তু জানোয়ার বিরক্ত হলে সেটা প্রাণঘাতি হবে। কোথাও নড়াচড়া দেখলাম না আর। বুঝলাম চলে গেছে যুদ্ধবাজ জন্তুগুলো। যাবার পর মনে মনে কাহিনীটা সাজিয়ে নিলাম।
.
শহরে ফিরতে পারলে এটা একটা দারুণ গল্প হবে। বীরত্বের রস দিতে হবে কিছুটা। রস ছাড়া বীরত্বের কাহিনী জমে না। ঘটনা সব ঠিক থাকবে, কেবল যোগ করা হবে একটা বর্শা। ওটা এই কটেজেই পাওয়া যাবে। সেই বর্শা হাতে নিয়ে আমি জন্তুটার উপর অন্ধকারেই হুংকার ঝাপিয়ে পড়েছি। বর্শার গুতোয় জঙ্গল ছেড়ে পালিয়েছে সেই কাল্পনিক বাঘটা। বাঘের রং অবশ্যই কালো হবে। যদিও অন্ধকার ছিল। পকেটে টর্চ ছিল ওটা জ্বেলে দেখে নিয়েছি। এরকম চাপাবাজিগুলো খুব কাজের, কেউ যাচাই করতে আসবে না।
.
এসব আউল ফাউল চিন্তা করতে করতে ঘুম জড়িয়ে এল। ঘুম ভেঙ্গে বুঝতে পারলাম না বেলা কত হয়েছে। সূর্যের দেখা নেই কোনদিকে। সকাল আটটাও হতে পারে, দুপুর একটাও হতে পারে। যাই হোক, ঘড়ি এখন একটা সেটা পেটের ভেতর। ওটা বলছে খিদা পাইছে, খানা দাও। রাতের কিছু খিচুড়ী ছিল প্যানে। জমে বরফ হয়ে আছে। এই একটাই পাত্র আছে আমার, ওটাতেই রান্না, ওটাতেই খাওয়া। ভাত চা কফি সব একটাতেই। স্টোভটা জাললাম। খিচুড়ী গরম করতে দিলাম। এই স্টোভ যন্ত্রটা
পূর্ব ঘটনা:
http://neersondhani.blogspot.com/2010/12/blog-post_1944.html
No comments:
Post a Comment