চলো, একদিন দূরে কোথাও বেড়াতে যাবো।
.
না। ট্যুর, ট্রিপ, পিকনিক..... এসব না। এই সব প্রতিবছরই কোন না কোনভাবে হয়। কিন্তু তৃপ্তি হয় না। যেখানেই যাই মনে হয় বিয়ে বাড়ীতে নিমন্ত্রন খাচ্ছি। সেই একই ভ্রমন, একই পথে একই যাত্রা, চেনা রেস্তোঁরায় চেনা খাওয়া, চেনা হোটেলের চেনা বিছানায় ঘুমানো, চেনা সমুদ্রের চেনা ঢেউ গোনা, চেনা পাহাড়ের চেনা কুয়াশার ঘ্রান নেয়া।
.
এইসব ছেড়ে একদম আনকোড়া নতুন কোন জায়গায় বেড়াতে যেতে চাই। আগে কখনো দেখিনি এমন দৃশ্য দেখতে চাই, আগে খাইনি তেমন খাবার খেতে, আগে শুইনি তেমন বিছানায় ঘুমাতে, আগে দেখিনি তেমন পাহাড়ী ঝরনা দেখতে, আগে শুনিনি তেমন পাখির গান শুনতে চাই। যেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পৌছেনা, টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের যন্ত্রনা কানে বাজে না, যেখানে টিপ টপ লোকজন সেজেগুজে বেড়াতে যায় না। দেশে হোক দেশের বাইরে হোক এই গ্রহের যে কোন একটা অচেনা অজানা জায়গায় গিয়ে মোটে সাতটি দিন চুপচাপ কাটিয়ে আসতে চাই।
.
দিবাস্বপ্ন হয়ে যায়?
.
তাও না। চাইলেই যাওয়া যায়। একটু সাহস সঞ্চয় করে সুশীলতা থেকে বেরুতে হবে। কোথাও কোথাও চেনা পথের আশেপাশেই তেমন অচেনা জায়গা আছে। বেরিয়ে পড়লেই খোঁজ মেলে। একসময় এরকম হুটহাট বেরিয়ে পড়া হতো। আমার সেই বাউন্ডুলে সঙ্গীগুলোকে মিস করি খুব। সব দূর থেকে দূরে চলে গেছে এখন।
.
কর্ণফুলী নদীর অনেক লেজ শাখা প্রশাখা এদিক সেদিক চলে গেছে খালের শেকড় বেয়ে বেয়ে। সেই দলটা কোন কোন দিন হুট করে ঘাটে গিয়ে একটা সাম্পান ঠিক করে মাঝিকে বলতাম তোমার যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাও। মাঝি তার ইচ্ছে মতো সাম্পান তাড়িয়ে অচেনা গ্রাম গঞ্জে নিয়ে হাজির হতো, বিচিত্র মানুষের সাথে দেখা হতো। একই দেশে কতোরকম জীবন যাত্রা।
.
একবার সুনসান নীরব একটা ঘাটে এসে সাম্পান ঠেকলো। একটা খালের বাঁক। পরিত্যক্ত একটা বাজারমতো। নামধাম চিনলাম না। জীবনেও এই গ্রামের নাম শুনিনি। সেই মধ্য দুপুরে নিথর একটা পথের পাশে ভাঙা বেড়ার একটা দোকান। পানি খাবো বলে ঢুকে পড়লাম আমরা। দুটো টুল সামনের দিকে, পেছনে একটা চুলোয় তরকারী হচ্ছে। মাছে সালুনের খিদা জাগানিয়া ঘ্রান। এক বুড়ো জুবুথুবু হয়ে রান্না করছে। শিম দিয়ে মাছের তরকারী।
.
বললাম, খাওয়া যাবে?
বললো, যাবে, আপনারা বসেন।
.
বুঝলাম এটা একটা ভাতের হোটেলও। হোটেলের চারদিকে প্রায় খোলা। পাঁচ ফুট বাই আট ফুট দোকানের সাইজ। ওই টুকুতেই বসা খাওয়া রান্নার জায়গা। একটা চুলো আর তিনটা ডেকচি বসিয়ে রান্নাবান্না। টিনের বাসনে গরম ভাত দেয়া হলো। তরকারী ডেকচী থেকেই বেড়ে দেয়া হচ্ছে। বাটি ফাটির বালাই নাই। সেই সামান্য মাছের তরকারীর স্বাদ এত অপূর্ব ছিল যে এখনো ভুলতে পারি না। তৃপ্তির সাথে ভরপেট খেয়ে মূল্য পরিশোধ করতে হলো নামমাত্র। অদ্ভুত তৃপ্তি মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এসেছিলাম সেদিন।
.
আমার এক বাউন্ডুলে বন্ধু জামান। বন্ধুজগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। যাকে ঘিরে আমরা গ্রহ উপগ্রহরা দিনের পর দিন আনন্দে কাটিয়েছি। সেই খেয়ালী বন্ধুটা আজ কোথাও হারিয়ে গেছে। সে এইসব চেনা জগতের দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে অচেনা গন্তব্যে হাঁটতে পেরেছিল। আমাদের সাহস ছিল না বলে তার সঙ্গী হইনি। এখন আমরা নিতান্ত সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে কোন একটা চাকরী করি, বিয়ে করে সংসার পাতি, বাজার করি, বউয়ের সাথে ঝগড়া করি, বছরে দুয়েকবার চেনা জায়গায় গিয়ে হৈ হৈ করে আসি নাম যার পিকনিক।
.
কিন্তু জামানের ওসবে পোষাতো না। সে যেন এক একাকী শেরপা তার খেয়ালের ঘোড়াকে কখনো ছুটিয়ে দিয়েছে জেলে নৌকায় করে টেকনাফ থেকে বঙ্গোপসারের গহীনে, কখনো ছুটিয়ে দিয়েছে সুদূর সোয়াজিল্যান্ডের অরণ্যে, কখনো বা দুর্গম দক্ষিনের কোন লবন চাষের পল্লীতে। যখন যেখানে গিয়েছে কাটিয়েছে মাসের পর মাস, মিশে গেছে এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে। পূর্ব পুরুষের ধন সম্পদকে পেছনে ফেলে বেছে নিয়েছিল বস্তি জীবন। স্বেচ্ছা নির্বাসন। এইসব করেছে বলে আমাদের নিয়মিত সুশীল সমাজ তাকে অচ্ছ্যুত বলে গণ্য করা হয়। ভদ্রসমাজে স্থান হয়নি তার।
.
এত বছর পর এসে আমি জামানের সেই ভিন্নজগতের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ করি। অসময়ে এডভেঞ্চার ডাক দেয়। ইচ্ছে করে তাকে খুঁজে বের করে বলি, আয় দোস একটা জেলে নৌকা নিয়ে সাত দশ দিন ঘুরে আসি দূরের অচেনা সমুদ্রের কালাপানিতে। আবিষ্কার করি নতুন জেগে ওঠা কোন চর, নির্জন বালুচরে পা ডুবিয়ে বসে ঢেউয়ের শব্দ শুনি কান পেতে সারাদিন। কয়েকটা নির্জন দিন চাই, কয়েকটা নিথর রজনী।
.
হয় না। হবে না। জামান হারিয়ে গেছে, সময় হারিয়ে গেছে, পেছনে রেখে গেছে না হওয়া অনেকগুলো ভ্রমণের আকাংখা।
.
1 comment:
icche kore emon kore jodi amio harate partam
Post a Comment