Monday, November 1, 2010

সম্পর্কের ফসিল

সময়কে ধরে রাখার সাধ্য কারো নেই। আমরা কেবল সময় অতিক্রম করতে পারি। সময়কে স্মৃতিতে যতটুকু ধারন করতে পারি, ওইটুকুই পাওনা। বাকী সব হারিয়ে যায়। একসময় ঘোরতর রোমান্টিক স্মৃতিও ফিকে হয়ে আসে সময়ের ধুলোয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে টের পাই সময়ের ধুলোর আস্তরণ। অতীতে সময়কে ধরে রাখার একমাত্র কায়দা ছিল ডায়েরী। মানুষ শব্দে শব্দে সময়কে ধারণ করে রাখতো। যতটুকু সম্ভব ততটুকু মমতায় ধরে রাখতো। একসময় সেই মমতা মন থেকে মুছে গেলেও শব্দগুলোই তার স্মৃতিকে ধারণ করে রাখতো। প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ফলে সেই ডায়েরী কাগজের পাতা ছেড়ে আশ্রয় নিল ডিজিটাল অক্ষরে। ব্যক্তিগত ব্লগে সময়কে ধরে রাখার চেষ্টা চলে। পত্রমিতালীর শখ ছিল একসময়। বহুদুর দেশ থেকে বার্তা নিয়ে অচেনা বন্ধুর কাছ থেকে চিঠি নিয়ে ডাক পিয়নের কড়া নাড়া, দারুণ রোমাঞ্চিত করতো। সেই ডাকপিয়নও আজ কড়া নাড়ে না খুব বেশী বাড়ীতে। কখনো পত্রমিতালী করা হয়নি। সাহস কিংবা উদ্যোগের অভাবে। মাঈনুদ্দিন নামের এক বন্ধু ছিল তার পত্রমিতালীর ভাগ্য ছিল। সে যখন গল্প করতো, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মাঈনুদ্দিনের সাথে দেখা হয়না বহুবছর। দেড় যুগের কাছাকাছি হবে। সেদিন হঠাৎ করে সচলায়তনের একজন বললো তার কথা, আমি অবাক হলাম। জানতে চাইলাম কোথায় আছে সে। সরকারী চাকরী ছেড়ে নাকি কানাডা প্রবাসী হয়েছে বহুবছর আগে।

বলা হয়নি বোধহয় কখনো। আমার একজন পত্রবন্ধু ছিল। তুহীন। প্রাইমারী স্কুলের বন্ধু। সে কুমিল্লার স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। সেখান থেকে চিঠি লিখতো। খুব অভিমানী ছিল ছেলেটা। আমি চিঠির জবাব দিতে দেরী করলে খুব মর্মাহত হতো। আমি বরাবর চিঠি খেলাপী ছিলাম। তুহীন আমাকে খুব আকড়ে ধরে রাখতে চাইতো। যদি কখনো চাটগা বেড়াতে আসতো, সারাদিন আমাকে নিয়ে ঘুরতো। আঠার মতো লেগে থাকতো আমার সাথেই। আমি মনে মনে বিরক্ত হতাম। আরো বন্ধুবান্ধব ছিল আমাদের দুজনেরই। কিন্তু তুহীন চাইতো কেবল আমারই সঙ্গ। এটা যদি বিপরীত লিঙ্গের কেউ করতো, তাহলে হয়তো বিরক্ত লাগতো না, কিন্তু আমি ওর আদিখ্যেতায় বিব্রত হতাম প্রায়ই। সেকারণেই কিনা জানি না, তুহীন আমার ঘনিষ্ট বন্ধু হলেও এক নাম্বার প্রিয় বন্ধু ছিল জামান কিংবা মামুন।

তুহীন হারিয়ে গিয়েছিল এসএসসি পরীক্ষার পর। হারিয়ে গিয়েছিল মানে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আমি যোগাযোগে দুর্বল হওয়াতে, ওকে চিঠি লিখতাম না। আর আমার বাসা বদলে যাওয়াতে আমার ঠিকানাও হারিয়ে যায়। ওর বাসা ছিল আমাদের কাছেই। কিন্তু বাবা রিটায়ার্ড করে দেশের বাড়ীতে চলে যাবার পর আমি আর কোন ঠিকানা পাইনি। আসলে খুঁজিওনি। নতুন বন্ধুদের নিয়েই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। তুহীন হারিয়ে যাবার আরো বাইশ বছর পর একদিন পুরোনো কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ ওর একটা চিঠি হাতে পড়লো। এসএসসির পরপর দিয়েছিল। বরাবরের মতো অভিমানী চিঠি। এতদিনে পদ্মা মেঘনা যমুনা কর্ণফুলী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যাবার পথে। তবু চিঠির পেছনের পৃষ্টায় ওর গ্রামের বাড়ীর ঠিকানা দেখে মন কেমন করলো। ভাবলাম আমাকে এত ভালোবাসতো, আর আমি স্বার্থপরের মতো ওকে হারিয়ে যেতে দিলাম। উত্তর পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, তবু একটা চিঠি লিখলাম গ্রামের ঠিকানায়। ওদের কেউ গ্রামে থাকে না। সবাই শহরবাসী। তবু দেখা যাক।

মাস দুয়েক পর মোবাইলে একটা কল এলো। পরিচয় শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। তুহীন। দুইমাস পর চিঠিটা হাতে পেয়েই ফোন। এখন কতো সহজ যোগাযোগ, এক ক্লিকেই হাজার মাইল পাড়ি দেয়া যায়। বললাম, দোস্ত কি খবর তোর। কতদিন দেখা হয়নি। সেই এক মারাত্মক রোমাঞ্চকর অনুভুতি। তুহীনকে বাসার ঠিকানা দিলাম। তুহীন এলো একদিন। অবাক হয়ে দেখলাম খুব বেশী বদলায়নি। ঢাকায় আছে আইসিডিডিআরবিতে রিসার্চ অফিসার। বিয়ে করেছে, ছেলেমেয়েগুলো ক্লাস সেভেন এইটে পড়ে। আর আমি তখনো বিয়েই করিনি বোধহয়। অবাক হয়ে গেলাম।

সেই যোগাযোগের পর থেকে আমিও ঢাকা গেলাম। ওর বাসায় খেলাম। পরিবারের সাথে কথা বললাম। আনন্দে সময় কাটালাম। এবার আর ছাড়াছাড়ি হবে না ঠিক করলাম। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর, দেখা গেল, সুর তাল লয় সব কেটে গেছে। ওর রাস্তা আলাদা হয়ে গেছে আমাদের কাছ থেকে। আমি একবার ঢাকা গেলাম এরপর, বিয়ের পর। দেখা করতে চাইলাম ওর সাথে। কিন্তু ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে গেল মনে হলো। কিংবা সত্যিই ব্যস্ত ছিল। এরপর আমি কয়েকবার ফোন করে যোগাযোগ করেছি। একসময় আমিও ক্লান্তিবোধ করতে শুরু করি। বুঝে নেই, সময়! আমাদের বদলে দেয় সময়। ইচ্ছাকৃত স্বার্থপরতা হয়তো না। ওর রাস্তা আর আমার রাস্তা সত্যি আলাদা হয়ে গেছে। একসময় আমি ওর নাম্বার হারিয়ে ফেলি, সেও আমার নাম্বার হারিয়ে ফেলে। আমরা আর কেউ কারো নাম্বার খুঁজি না। জীবনটা কি এরকমই? মানচিত্র বদলে যায় সময়ের সাথে সাথে? বুঝি না। সম্পর্কগুলো সত্যি সত্যি পাথর হয়ে যায় এক সময়। বন্ধুত্বগুলো ডায়েরীর পাতায় টিকে থাকে সম্পর্কের ফসিল হয়ে।

1 comment:

Anonymous said...

সবকিছু একদিন গল্প হয়ে যায়..........