Tuesday, February 25, 2014

এক্সিট প্ল্যান

মানুষের জীবনে বারবার এক্সিট প্ল্যান দরকার হয়। কতবারই যে কত জায়গা থেকে এক্সিট করতে হয় এক জীবনে। বারবার এক্সিট প্ল্যান করলেও মানুষ চুড়ান্ত এক্সিট প্ল্যানের ব্যাপারে অসহায় থাকে। ওই প্ল্যানে মানুষের কোন হাত নেই। একেক দেশের একেক সিস্টেম। কোন কোন দেশ আছে যেখানে প্রতিবার ঘর থেকে বের হবার জন্য এক্সিট প্ল্যান দরকার হয়। কারণ সে ফিরে নাও আসতে পারে। একবার বাইরে যাওয়া হয়তো চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যাওয়া। এমনও দেশ আছে। আমাদের দেশটাও আস্তে আস্তে সেরকম দেশে পরিণত হচ্ছে। এখানেও প্রতিদিন এক্সিট প্ল্যান দরকার হয়। প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সময় ভালো করে প্রিয়মুখগুলো দেখে বের হই। মশারির ভেতর ঘুমন্ত দুই সন্তানের কপাল ছুঁয়ে আসি চোখ দিয়ে। হাত দিয়ে ধরলে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন বলবে, বাবা তোমার আজ চাকরীতে যাওয়া লাগবে না। আমার তখন কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।

সুখের অসুখ হয় কখনো কখনো? হয় বোধহয়। জয় গোস্বামী পড়তে পড়তে মাথায় কয়েকটা শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছিল সকাল থেকে। ছিল, নেই। মাত্র দুটি শব্দ না? মাত্র একটা কমার ব্যবধান। কিন্তু বাস্তবে কি এত ছোট্ট পার্থক্য? একজন মানুষের কিংবা একটা অস্তিত্বের থাকা না থাকার ব্যাপার মাত্র দুটি শব্দে বলে দেয়া যায়। যা নেই, তা একসময় হয়তো বলতো আছি আছি থাকবো থাকবো। কিন্তু সে টেরই পায় না কখন সে নেই হয়ে যায়।

কোথায় যেন বলেছিলেন জয় গোস্বামী-

আমার গুরুত্ব ছিল মেঘে
প্রাণচিহ্নময় জনপদে
আমার গুরুত্ব ছিল…
গা ভরা নতুন শস্য নিয়ে
রাস্তার দুপশ থেকে চেয়ে থাকা আদিগন্ত ক্ষেতে আর
মাঠে
আমার গুরুত্ব ছিল…
আজ
আমার গুরুত্ব শুধু রক্তস্নানরত
হাড়িকাঠে!


না শুধু এটা না। আরো আছে। এই যে কোমল রশ্মির অশ্রুপাতের বিকেল, সেই বিকেলের কথাও-

অপূর্ব বিকেল নামছে
রোদ্দুর নরম হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা মাঠে
রোদ্দুর, আমগাছের ফাঁক দিয়ে নেমেছে দাওয়ায়
শোকাহত বাড়িটিতে
শুধু এক কাক এসে বসে
ডাকতে সাহস হয় না তারও|
অনেক কান্নার পর পুত্রহারা মা বুঝি এক্ষুনি
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন
যদি ঘুম ভেঙ্গে যায় তাঁর!


সমুদ্র নদী রোদ বৃষ্টি মেঘ মাখা অনেক কথাই তখন ধুলিচিহ্নিত হয়ে মুছে যাবে। এই তো হবার কথা, নয়? ছিল, কিন্তু নেই। এবার কিন্তু একটা কিন্তু বসে গেছে ঠেসে। কিন্তুকে তখন মোটেও চিন্তিত মনে হয় না। কারণ সে জানে, এ অনিবার্য শমন। বানানটা ভুল করলাম না তো আবার? 


Monday, February 24, 2014

দিনযাপনের অসমতল বর্ননা

তোমার যেখানে সাধ চলে যাও, আমি রয়ে যাবো এই বাংলার পারে। কথাটা আসল না। আসল কথা আমি বাধ্য হয়ে থাকছি। তুমি বাধ্য হয়ে চলে গেছো। আমি ভালো আছি বলে ভাণ করছি যাতে আমি দুঃখ পেলে তোমারও দুঃখী হতে না হয়। আমরা সবাই ভাণ করছি। ভালো থাকার ভাণ। সবকিছু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার ভাণ।

ভাণ করে থাকাটা একটা নীরব মানসিক কষ্ট যা কেবল ভুক্তভোগীই জানে। ভাণ করে থাকা আমার তীব্র অপছন্দ হলেও মাঝে মাঝে পরিস্থিতি বাধ্য করে ভদ্রসমাজে ভাণ করতে। যেমন কোন জ্ঞানী সমাজে মূর্খদের ভাণ করতে হয় আমিও অনেক জানি। আমি তাই জ্ঞানী সমাজ এড়িয়ে থাকি। পারতপক্ষে তাদের সাথে মেলামেশা করি না। যদি কোন জ্ঞানী সমাজে আমাকে যেতেই হয় তখন গোমড়ামুখে চুপ করে বসে থাকি এবং জ্ঞানের আলোচনা শুনে মাথা ধরাই। চুপ করে প্রমাণ করি আমিও জ্ঞানী, কারণ আমি জানি জ্ঞানীলোক মাত্রেই ভরা কলসি, আর ভরা কলসি যে কম বাজবে সে জানা কথাই।

আবার জ্ঞানী সমাজে আমি যতটা নীরব, মূর্খ সমাজে ততটাই সরব। আমি তাই মূর্খদের সাথে আড্ডা দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। মূর্খে মূর্খে মুখাকাকর। আমি সবচেয়ে সতর্ক থাকি বইয়ের দোকানে গেলে। আশি নব্বই দশকে কারেন্ট বুক সেন্টার ছিল চট্টগ্রামে বই কেনার সবচেয়ে ভালো জায়গা। এখানে দুনিয়ার জ্ঞানী আঁতেল লোকজন ভর্তি থাকতো তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে দেখতাম দোকানের টুলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি ভুলেও তাদের কোন আলোচনায়  ঢুকতাম না। চুপচাপ বই দেখতে থাকতাম আলোচনা উপেক্ষা করে।
আমি ওখানে সেবা প্রকাশনীর সস্তা বই কিংবা প্রাক স্বাধীনতা আমলের সস্তা পোকায় খাওয়া বই অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতাম। আমি কখনোই নতুন বইয়ের দিকে তাকাতাম না। ভুলেও না। নতুন কোন বই আসলে সেটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে পয়সা লাগে না। কিন্তু আমার কাছে নতুন বই হাতে নেয়াটাও কেমন অসহ্য লাগতো। সদ্য প্রকাশিত বই না কেনার অভ্যেসটা এখনো রয়ে গেছে আমার। তখন দেখতাম না আর্থিক সমস্যার কারণে, এখন দেখি না দীর্ঘ অনভ্যস্ততার কারণে।


কারেন্ট বুকের মালিকের সাথে খাতির থাকার সুবাদে নতুন বই আসলে খোঁজ খবর পেয়ে যেতাম। সদাহাস্যময় শাহীন ভাইকে খুব পছন্দ করতাম। যখনই যেতাম আড্ডা দিতাম খানিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। এখন ওদিকের পথ ভুলে গেছি তেমন না। কিন্তু অনেকদিন ওদিকে যাওয়া হয় না। মাঝে মাঝে নিউমার্কেটের পাশ দিয়ে যাবার সময় খুঁজি দোকানটা আছে তো? তখন চোখে পড়ে আস্তে আস্তে কারেন্ট বুক সেন্টারকে গ্রাস করছে আশেপাশের জঞ্জাল। ফুটপাতের দোকানগুলো চারপাশ থেকে অন্ধকার করে ফেলে প্রবেশ পথটাকে। দোকানে ঢোকার মতো জায়গা রাখেনি হকারের দল। ভদ্রলোকের চলাচলের অযোগ্য হয়ে আছে দোকানের সামনের জায়গাটা।

আমার কষ্ট হতে থাকে একটা মননশীল বইয়ের দোকান এভাবে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে দেখে। আগে যারা ওখানে ভিড় করতো তারা এখন নতুন জায়গায় চলে গেছে। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বিশৃংখল জায়গায় পরিণত হওয়া জলসা চত্বর আর বইয়ের কেন্দ্র থাকতে পারেনি। আমার কারেন্ট বুক জীবন শেষ হয়ে গেছে ২০০৫ সালের আগেই।


কারেন্ট বুক সেন্টারের যুগ পার হবার পর আসলো বিশদ বাঙলার যুগ। বিশদ বাঙলার যুগে প্রবেশ করি ২০০৬ সালের দিকে। মেহেদীবাগে বই কেনার নতুন একটা স্বস্তিদায়ক জায়গা পেয়ে আমোদিত। নিজের ঘরের লাইব্রেরীর মতো ঘুরে ফিরে বই নির্বাচন করি। ইতিমধ্যে আমরাও বাসা বদলে চলে আসি কাছাকাছি এলাকায়। বাসার কাছে হওয়াতে হেঁটে হেঁটেও চলে যাই বিশদ বাঙলায়। শুধু বই নয় আরো অনেক কিছুই আছে বিশদ বাঙলায়। চট্টগ্রামে প্রথম এই দোকানেই বসে বসে বই পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। কোন তাড়া না থাকলে, হাতে নগদ সময় থাকলে আমি বিশদ বাঙলায় ঢুকে পড়তাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় বইপত্র খুঁজে আরাম ছিল।

কয়েক বছর পর বিশদ বাঙলার জৌলুশও পড়তে শুরু করে। কেন জানি না। আগের মতো বইপত্র পাই না। বই দেখার সময় শীতল পরশ নেই। গরমে ঘামতে ঘামতে বই দেখতে অস্বস্তি হয়। পাশের চা খানায় আগের মতো নাস্তাপানি থাকে না। এটাও একদিন গল্প হয়ে যাবে?  সেটা মেনে নেয়া কষ্টকর হবে আমার জন্য। এই জায়গাটা আমার প্রিয় জায়গা ছিল।

বিশদ বাঙলার পর আমার যাতায়াত শুরু হয় বাতিঘরে। বাতিঘর চট্টগ্রামে বেশ কয়েক বছর ধরেই আছে। চেরাগী পাহাড়ের মোড়ে বাতিঘরকে কেন্দ্র করেই একটা সাহিত্য সাংস্কৃতিক আড্ডা বসে। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আড্ডাখানা বলতে গেলে শিল্পকলা আর চেরাগী পাহাড়কে বোঝায়। কিন্তু সেই চেরাগী পাহাড়ের আড্ডায় আমার থাকা হয়নি কখনো। বয়সে একটু এগিয়ে গিয়েছি অথবা ওখানে ছোট ভাইবোনেরা আড্ডা দেয় ইত্যাদি কারণে হয়তো। তাছাড়া চেরাগীর বাতিঘর খুবই ছোট্ট সাইজের। বই দেখার স্বস্তিদায়ক পরিবেশ ছিল না। তার চেয়ে পাশের নন্দনেই আমার ভালো লাগতো।

একদিন সেই বাতিঘর উঠে এলো প্রেসক্লাবের এক তলায়। বিশাল একতলার পুরোটা জায়গা জুড়ে বাতিঘর। অসাধারণ ডিজাইন আর শিল্পকলায় বাংলাদেশের বই সুপার স্টোর হয়ে গেল বাতিঘর। এখন বাতিঘরই চট্টগ্রামের সবচেয়ে ভালো আর স্বস্তিদায়ক দোকান। এটাকে দোকান না বলে বইয়ের যাদুঘর বললে বরং সঠিক মূল্যায়ন হয়। এখানে আসার পর থেকেই বাতিঘরে যাতায়াত শুরু হয় আমার। এখন আমি বাতিঘরেই নিয়মিত যাই। বই কিনে দেউলিয়া হবার জন্য এত উৎকৃষ্ট জায়গা বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই।
 
কিন্তু এই তিনটা জায়গাতেই আমার সবচেয়ে বড় সফলতা হলো এখানে আমি জ্ঞানীলোকের সঙ্গ আমি সযত্নে এড়িয়ে থাকতে পেরেছি। আমার জ্ঞানের ঝুড়ি আসলে এতটাই ফুটো যে বাকী জীবন পড়াশোনা করেও সেই ফুটো ভর্তি করা যাবে না। আলোচক হবার জন্য যতটা পড়া দরকার আমি তার খুব সামান্য অংশই পড়া হয়েছে আমার। আলোচনা  সভা সমিতি এসবের চেয়ে বই কেনা, বই পড়া অনেক বেশী দরকারী মনে হয়। আপাততঃ আমি সেই দরকারী কাজটিই করে যাচ্ছি।
কিছু ভাণ হোক। তবু ভালো আছি। এই তো আজ ভোরে জেগেও মনে হয়েছিল ভালোই আছি। আছি না? ফাগুনের এই নিদারুন মায়াবী শীতের আড়ারে নকশী কাঁথার ওমে ভালো থাকা নয়? লাভ লেইনের মোড়ে সেদিন দেখলাম পলাশ ফুটে আছে আইল্যাণ্ডে দাড়ানো মস্ত গাছটিতে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। ইঠ পাথরের শহরেও ফোটে সেই ফুল। মনে পড়লো মাত্র কিছুদিন আগেও পলাশ ফুল চিনতাম না। ওই গাছের পাশ দিয়ে এত বছর যাতায়াত করলেও মাত্র এই বছর নজর পড়লো ফুলের দিকে। কত কিছুই অজানা অদেখা রয়ে যায় এমনকি চিরচেনা শহরটিতেও।
গতকাল একদম হুট করে অফিস থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিলাম লালদীঘির পাড়ে। প্রাচীন একটা লাইব্রেরী আছে। বহুবছর আগে গিয়েছিলাম। যে লাইব্রেরীতে ঢুকলে উনিশ শতকের গন্ধ পাই, এটা সেই লাইব্রেরী। এখনো যে বেঁচে আছে সেটা দেখেই আশ্চর্য হলাম। সাড়ে বারোটায় পৌঁছে ভেতরে ঢুকে বাধা পেলাম। বলা হলো, লাইব্রেরী খুলবে দুপুর ১ টায়। বন্ধ হবে বিকেল ছটায়।

বাহ। সিনেমা হল বারো ঘন্টা চলতে পারে কিন্তু লাইব্রেরীর অতদূর চলার সুযোগ নেই? পাঁচ ঘন্টায় যা নেবে নাও। ঢুকতে বারণ করলেও অবাধ্য হয়ে  ঢুকলাম। বললাম একটু দেখে চলে যাবো। মলিন করুন অতি নোংরা কক্ষগুলোয় মৃতপ্রায় বইগুলো কোন মতে আবছা অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে ধুলোর আস্তর বুকে নিয়ে। কত বছর আগের বই? বিশ, পঞ্চাশ, আশি, একশো বছর? হ্যাঁ আশ্চর্য হলেও এই লাইব্রেরীতে শহরের সবচেয়ে প্রাচীন বইয়ের সংগ্রহশালা। বই এবং পত্রিকা সাময়িকীও। যে পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখতেন, যে পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখতেন, যে পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশ লিখতেন, সেই সব পত্রিকার সংগ্রহ ছিল। এখন অনেক কিছুই নেই। নিলাম ডেকে সব বিক্রি করে দেয়া হয়েছে হয়তো। শুধু মলিন নেমপ্লেটগুলো রাখা। সেখানে হাত দিয়ে পেলাম উর্দুভাষী পাকিস্তান আমলের কিছু পত্রিকা। আশ্চর্যজনকভাবে 
বাংলা সাহিত্যের সম্পদগুলো হারিয়ে গেলেও পাকিস্তানী তেলাপোকাগুলো টিকে গেছে, । আর দেখতে রুচি হলো না। বেরিয়ে এলাম লাইব্রেরী থেকে জাতির দুর্ভাগ্যকে গালি দিতে দিতে। 
রাস্তায় বেরিয়ে যেদিকে যাবার নয় সেদিকে হাঁটতে শুরু করলাম। এবারও।

Saturday, February 22, 2014

শিশুদের সাথে আনন্দ গ্রামে(ছবিব্লগ)

শহর থেকে খুব দূরে নয়। গাড়িতে খুব বেশী হলে এক ঘন্টা। কিন্তু যানজটের ভয়ংকর চাপ খেয়ে ফেললো আস্ত তিনটা ঘন্টা। আমরা ত্রিশ নাকি পয়ত্রিশ জন? গুনিনি। এক মিনিবাস আমরা সাথে শিশু পাঁচজন শুধু এটুকু নিশ্চিত।

যাত্রাপথের বিশ্রী যন্ত্রণায় ত্যক্ত বিরক্ত শিশুকূলের দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগছিল। কেউ বমি করছে, কেউ করবে যে কোন সময়। কতদূর আর কতদূর।

অবশেষে গন্তব্যের দেখা মিললো। শান্তি। সবুজ শান্তিময় একটা গ্রাম। ধূ ধূ প্রান্তরে ফসল কাটা হয়ে গেছে  কবেই। মাঝে মাঝে শুধু শীতকালীন সবজি অবশিষ্ট। চমৎকার গ্রামটি দেখে মুহুর্তে পথের বিরক্তি উধাও।

গ্রামে নেমেই বদলে গেল শিশুরাও। ত্যক্ত বিরক্ত ঘর্মাক্ত চেহারায় হাসতে শুরু করলো আলো। কিছু খেয়ে না খেয়েই শুরু হলো গ্রামময় ছোটাছুটি, বন্যতা, মাঠে ঘাটে দাপাদাপি। স্বাধীনতার আনন্দ উচ্ছ্বাস।

অনেক কায়দা করে ক্যামেরা বিমুখ শিশুদের কয়েকটা ফ্রেমে আবদ্ধ করা গেছে। ধুলোবালি মেখে বিকেলের শেষ রোদ গায়ে চড়িয়ে আবারো গাড়িতে চড়া, আবারো শহুরে বন্দীশালায়।



স্থানঃ আনোয়ারা, চট্টগ্রাম
তারিখঃ ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৪

সময়ঃ সারাদিন


                                     আমিই তো বাবাকে বলে তোমাদের আনলাম এখানে


আমি এখানে সব চিনি, সব চিনি, তুমি আসো আমার সাথে

                                ব্যাটা এত চিনলো আমি চিনলাম না কেন? চাপা নাকি?
                                  ঐ শোন, এরপরই কিন্তু আমরা ছুট লাগাবো

                                    ওরা গেছে যাক, আমি এদিকে ছুট লাগাই

তাড়াতাড়ি করো, ছবি তুলে সময় নষ্ট করা যাবে না

                                                 আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি                                 

                                      আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছি ওষুধ না দিয়ে তুমি ছবি তোলো??                   
             

আই নো হাউ টু মেক এ উইশ, কিন্তু বলবো না কি উইশ

আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি





আমি ফারিস। ঢাকার উত্তরায় থাকি। তোমাদের সব্বাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ নিমন্ত্রণ রক্ষা করে আমাদের গ্রামে বেড়াতে আসার জন্য। এরপর তোমরা শহরে চলে যাবে, আমিও দুদিন বাদে ঢাকার জেলখানায়। তবে আবার আসবো আমি। তখন তোমরাও এসো, কেমন?

Wednesday, February 19, 2014

বসন্তের চিঠি: হাইহিল ভালোবাসা.......

প্রিয় হৃদয়হীনা কঠিনশীলা,

ইহা একটি বেদনাদায়ক পত্রবাণ। নিতান্ত বাধ্য হইয়া তোমার নিকট পত্রখানা লিখিতে বসিয়াছি। আমি আগেও হাজার হাজার পত্র লিখিয়াছি তোমার কাছে। কিন্তু কোটি বছর ধরিয়া তোমার ফসিল হৃদয় জীবাস্ম হইয়া আছে বলিয়া আমার প্রেমময় বার্তা তোমার কলিজায় আঘাত হানিতে পারে নাই। আমি যতবারই পত্রবাণ করি তুমি ততবারই উহাকে মহাসমুদ্রে ছুঁড়িয়া ফেলো।

আমার সকল প্রেমপত্র জলে নিমজ্জিত হইবার পর আমি গতকল্য শেষ বারের মতো তোমার জন্য একটি পুষ্পরথ তৈরী করিয়া আকাশ পথে পাঠাইয়া দেই। কিন্তু তুমি তাহা পাইয়া (সম্ভবতঃ রুদ্রমুর্তি ধারণ করিয়া) আমার উদ্দেশ্যে যে এক পাটি নীল জুতা ছুড়িয়া মারিয়াছো তাহা আমার বুকে শেলের মতো বিধিয়াছে। পরনে মোটা জ্যাকেট থাকিবার কারণে জুতার নীচের চোখা হিল অল্পের জন্য আমার কলিজা ভেদ করিয়া যায় নাই। অতএব আমি এই যাত্রা প্রাণে বাঁচিয়া গেলাম। ভাগ্যকে এই ক্ষণে আরো ধন্যবাদ জানাইতে হয় যে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা আর কেহ দেখে নাই। তাহাতে আমার ইজ্জত ও কূল উভয় রক্ষা পাইয়াছে।

তবে তোমার সেই নীল জুতার একটি ব্যাপার আমাকে অতীব ভাবনায় ফেলিয়াছে। এই জুতার উপরিভাগে আছে একটি সাদা রঙের পাথরের ফুল। ফুলের মধ্যিখানে একটি সবুজ রত্নপাথর। ওই রত্নপাথরটি মূল্যবান বলিয়া মনে হইতেছে। শুধু তাহাই নহে, ইহার সবকিছু দেখিয়া শুনিয়া ইহাকে সিণ্ডরেলার জুতা বলিয়া মনে হইতেছে। সিণ্ডরেলার জুতা হইলে ইহার সঙ্গে ভালোবাসার একটা সম্পর্ক থাকিবার সম্ভাবনা উড়াইয়া দেওয়া যায় না।

অতএব আমি আবারো হিলের গুতো খাইবার ঝুঁকি লইয়া এই পত্রবান তৈরী করিয়াছি সেই কথা জানিতে যে তুমি কি ভালোবাসিয়া আমাকে জুতাখানা নিক্ষেপ করিয়াছিলে যাহাতে আমি জুতাখানা তোমার কাছে ফেরত দিবার সুযোগ পাই? সেই সুযোগে তুমি আমার নৈকট্য গ্রহন করিবে? ঘটনা তাহা হইলে জুতাখানাকে আমি প্রেমশর ভাবিয়া বুকের সাথে বাঁধিয়া রাখিব। জুতা ফিরত দিবার কালে তুমি যদি দুর্ঘটনাক্রমে কোন প্রেমময় বাক্য শুনাইয়া দাও, তাহা হইবে আমার জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান সংগ্রহ।

আর যদি বিপরীত ঘটনা হইয়া থাকে, অর্থাৎ আমার এই পত্র খানা দেখিবামাত্র জুতার বাকী পাটিখানাও নির্দয়ভাবে ছুড়িয়া মারো, তাহা হইলে আমি অশ্রু বিসর্জন দিয়া বাকী জুতাখানা কুড়াইয়া বাজারে বিক্রয় করিয়া ভেজাল বিহীন বিষ সংগ্রহ করিব এবং অবশিষ্ট টাকা হাসপাতালের বিল বাবদ জমা রাখিব।  

ভাবিতেছো হাসপাতালের বিল কেন? তুমি তো জানো আমি আরো একবার আহত হইয়া মরিবার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইয়াছি। ভেজাল বটিকার কারণে যমদুতকে মরন দুয়ার হইতে খালি হাতে ফিরিতে হইয়াছে। আমার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নয় মর্মে এক খানা পত্র লিখিয়া বোতল ভর্তি তরল বিষ গলায় ঢালিবার পরক্ষণেই তাহা বদহজম হইল, অতঃপর জলোচ্ছ্বাসের মতো বমনক্রিয়ায় বিছানা ভাসাইয়া আমি অপমানজনক ভাবে মাঝপথে এমনভাবে ঝুলিয়া ছিলাম যাহা হইতে যমদূতের আলিঙ্গন মধুর হইত। যমদুত হাসপাতালে উপস্থিত হইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া আমার কলিজা গুর্দা ধরিয়া টানাটানি করিয়া বিফল মনোরথে ফেরত গিয়াছিল। উপরন্তু আমার মৃত্যু ঘোষণার চিঠিখানা প্রতিবেশীদের বিনোদনের খোরাক হইয়াছিল। বাঁচিয়া থাকা যে কিরকম লজ্জাজনক যন্ত্রণা সেই প্রথমবার টের পাইলাম।

শুধু তাহাই নহে, ঘটনার পরে মড়ার উপর খাড়ার ঘা স্বরূপ হাসপাতালে বিষমুক্তির চিকিৎসার জন্য আমার অফিসের ক্যাশ হইতে যে বিপুল অংকের টাকাকড়ি খরচ হইয়াছিল তাহা আমাকে মাসের বেতন হইতে গুনিয়া পরিশোধ করিতে হইয়াছিল। মুর্খ চিকিৎসকগন বোঝে নাই - বাঁচিতে চাহি নাই আমি সুন্দর ভূবনে। খেয়াল করিয়া  মাত্র দেড়শো টাকার একটি ইনজেকশান চামড়ার নীচে পুশ করিয়া দিলে আমি দেড় লক্ষ টাকার হাসপাতাল বিল হইতে বাঁচিয়া যাইতাম।

যাহা হউক, দুঃখের কথা বাড়াইয়া আর কাজ নাই। কপালে যাহা আছে তাহাই ঘটিবে। তোমার নীল জুতার একপাটি আমি যত্ন সহকারে শোকেসে সাজাইয়া রাখিয়াছি। বাকী পাটির অপেক্ষায় আজিকার পত্রবান এইখানেই সমাপ্তি ঘটাইলাম।


ইতি,
তোমার (মাইরের ডরে)  নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরাণ পাখি.......‍‍‍‍‌‌‌‌ 



Saturday, February 15, 2014

মিঠাপানির জলদস্যু

নোনাসমুদ্রে এতকাল কাটার পর মিঠাপানির প্রথম স্পর্শটা সুখের ছিল তা বলতে পারি না। বরং বলতে পারি স্পর্শটা বড় বিচিত্র ছিল। মুখে নিয়ে কুলি করার মতো করে ফেলে দেবার পর শান্তি।


আবহাওয়া ঠিক আছে। জলের কোলাহলও তেমনি। ঘনত্বে একটু পার্থক্য, আর রঙে। এখানকার রঙটা যেন ফ্যাকাসে। তবু কেউ কেউ বলছিল যে যাই বলুক, যত সুখ শান্তি সব মিষ্টি জলের নদীতে। অগাধ ঝড়ঝঞ্ছাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে অনিশ্চিত জীবনযাপন করার চেয়ে এখানে অনেকটা নিশ্চিন্ত জীবন। চাইলে যখন তখন কূলের কাছাকাছি যাওয়া যায়, গাছ লতাপাতা ফুল পাখিদের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সমুদ্রে কি তা সম্ভব? তবু এতকালের অভ্যেস সমুদ্র। এই নেশা কাটানো মুশকিল। আমি ওদের পিছু পিছু নদীতে আসার পর সেই কথাই ভাবছিলাম।


কিছুদিন গেলে নদীর পরিবেশে অভ্যস্ত হবার পর একদিন একজন জানালো, একটা বিপদ দেখা যাচ্ছে। ওদিকে কিছু জলদস্যু নেমেছে। তাদের হাতে মারা পড়েছে অনেকে।


আমি আগে কখনো জলদস্যু দেখিনি। সমুদ্রের কিছু এলাকা এড়িয়ে চলতে হয় জলদস্যুদের উৎপাতের কারণে। আমি খুব ভালো করে চিনি কোন কোন পথে জলদস্যু হামলা করে। সমুদ্রে আমি তাই কখনো জলদস্যুদের হাতে পড়িনি। কিন্তু নদী সম্পর্কে আমি অনভিজ্ঞ। এখানে পালাবার পথঘাট ঠিক চেনা হয়নি। বন্ধুদের প্ররোচণায় এসে পড়েছিলাম, অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করছিলাম, অনেকটা অভ্যস্ত হয়েও পড়েছিলাম নতুন জীবনে। কিন্তু নৌ দস্যুদের কথা শুনে তো রীতিমত চিন্তায় পড়লাম।


কিছুদিন যাবার পর টের পেলাম আমার চারপাশে চেনাজানা সবাই উধাও হয়ে যাচ্ছে একে একে। আস্তে আস্তে আমি একা হয়ে গেলাম। আমাকে ওরা ফেলে চলে গেছে কোথাও? এরকম কেউ চলে যেতে পারে? এতকালের চেনা জানা কেউ?


মনে হয় না। একাকীত্বের কষ্ট এমনিতেই অসহ্য। কিন্তু কেউ ফেলে চলে গেলে সেটা যেন বেশী কষ্টের। আমার শান্ত্বনা হলো, না শান্ত্বনা নয়, আমি নিশ্চিত ওরা কেউ আমাকে ফেলে যায়নি। নিশ্চয়ই ধরা পড়েছে জলদস্যুদের হাতে। মারা পড়েছে ওদের হাতে। একা হবার পর আমি সাবধানে চলি। গভীর জলের মাছেদের মতো আমি মাঝ নদীতে লুকিয়ে চুরিয়ে ঘুরাফেরা করি।


মাঝনদীটা অনেকটা নিরাপদ। জলদস্যুরা এদিকে সহজে আসে না। আসলেও টিকতে পারে না। আজকাল আমি ভুলেও কিনারের দিকে যাই না। জলদস্যুরা ওদিকে নোঙর ফেলে ঘাঁটি গেড়েছে। আমি একবার ধরা পড়তে পড়তে অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। সেই প্রথম আমার নোঙর চেনা।


আত্মরক্ষার জন্য আমাকে এবার পূর্বপুরুষের শরণাপন্ন হতে হয়। পূর্বপুরুষের কাছ থেকে আমি একটা অদ্ভুত বিদ্যা রপ্ত করেছিলাম। প্রত্যেক বংশে একেক প্রজন্মে মাত্র একজনকে সেই ক্ষমতা দেয়া হয়। আমার প্রজন্মে আমি পেয়েছিলাম সেই ক্ষমতা। শরীরের যে কোন অংশে প্রাণ লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা। সর্বোচ্চ শক্তির মহাপ্রাণ জানিয়েছেন, তুমি যখন এমন কোন বিপদগ্রস্থ যে তুমি ধ্বংস হলে তোমার বংশ লুপ্ত হবে, তখন তুমি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। তার আগে নয়। এই ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তুমি নিজে মৃত্যুবরণ করবে কিন্তু তোমার প্রাণ জেগে থাকবে তোমার কোন একটা অঙ্গে। সেই প্রাণ তুমি শত্রুর উপর প্রতিশোধ হানার জন্য ব্যবহার করবে। এতে তোমার পাপ হবে না কারণ এটা তোমার বংশ রক্ষার মহাজাগতিক অধিকার।


আমার এখন সময় হয়েছে সেই বিদ্যা প্রয়োগের। ধরা পড়লে আর কোন বিকল্প নেই আমার। আমি জলে একটা দীর্ঘ ডুব দিয়ে মন্ত্রপাঠ করে নিজেকে তৈরী করে নিলাম। এবার আর মৃত্যুভয় নেই আমার। মরে গেলেও প্রাণ থাকবে শরীরের কোথাও। আমার হাতে কোন অস্ত্র নেই কিন্তু আমার সমস্ত শরীরই এখন অস্ত্র। চাইলে আমি এখন বিষে বিষাধার করে ফেলতে পারি নিজেকে।  জলদস্যুদের কোন আক্রমন আমাকে আর ভীত করবে না।


এবার আমি মাঝ নদী ছেড়ে তীরের কাছাকাছি খাড়িতে খাড়িতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। আমি এখন একদম একা। অন্য কোন বংশের সাথে আমার মেলামেশা নেই। ভেবে কষ্ট হয় মাঝে মাঝে, আমার বংশের আর কেউ বেঁচে নেই এই অবিচারের দেশে। এখানে জলদস্যুরাই রাজা, জলদস্যুরাই আইন। হাটবাজার গ্রামগঞ্জ সব ওদের। একাকী ঘুরতে ঘুরতে আমার মাথার প্রতিশোধের আগুন বুড়বুড়ি হয়ে বেরুতে থাকে।


সময় যেতে যেতে আকাশে মেঘের আনাগোনা বাড়লো। ঘন কালো অন্ধকার হয়ে গেল দিন। নীলাকাশ হয়ে গেল কুচকুচে ছাই। যেদিন খুব বৃষ্টি নামলো আমার ইচ্ছে হলো মাথা তুলে নাচি। আমি নাচতে শুরু করলাম। নাচতে নাচতে নদীর কিনারে চলে গেলাম। এদিকে বৈঠা বাইছে এক মাঝি। আমাকে দেখে মাঝি কী খুশী। আমিও মাঝিকে দেখে খুশী। এই মানুষকে বিশ্বাস করা যায়।


আমি মাঝির নৌকায় উঠে গেলাম এক লাফে। 'আমারে লইয়া যাও মহুয়ার দেশে'। না, এটা আমি গাইছি না। আমি গানটান জানি না। মাঝি গান গাইছে আমাকে পাবার পর। সে আমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটা বাজারে গেল। আমি খুশীমনে মাঝির সাথে যাচ্ছি। জলদস্যুদের হাতে পড়লে নিশ্চয় আমাকে এত আরামে নিত না। কচুকাটা করে ফেলতো এতক্ষণে।


কিন্তু খুশী হয়ে কি হবে। আমার চুড়ান্ত পরিণতি তো একই। মাঝির হাত দিয়ে গেলে যা, জলদস্যুর হাত দিয়ে গেলেও তা। এটা ভেবে আমি একটু বিমর্ষ হয়ে থাকলাম।


বাজারে গিয়ে মাঝির পাশে চুপ করে বসে বসে আমি মানুষ দেখতে দেখতে ভুলে গেলাম এখানে কেন এসেছি আমি। আশেপাশের দোকানের ভাজাপোড়ার গন্ধ ভেসে আসছে। কত কি খায় এখানকার মানুষ!


নদীতে এত কিছুর ব্যবস্থা নেই। মাঝি আমাকে খাওয়াবে কিনা বুঝতে পারছি না। সে গরীব, চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। বেচারা আমার চেয়েও হতভাগা। খানিকপর একটা লোক এসে আমার দিকে কেমন যেন চোখ পাকিয়ে তাকালো। যেন আমাকে খুঁজছে অনেককাল।


আমি ভয় পেতে গিয়েও থেমে গেলাম। হাসলাম মনে মনে। লোকটা মাঝির সাথে কথা বলছে। বলছে আমাকে চায় সে। কিন্তু মাঝি আমাকে হাতছাড়া করতে চাইছে না। সে এমন সব কথা বলছে লোকটা প্রায় ক্ষেপে গেছে।


কথায় কথায় বুঝলাম এই লোক যে সে নয়। সে এলাকার জলদস্যু সরদার। তাকে কেউ না করতে পারে না। আমাকে তার চাইইইই চাই। দস্যু সর্দার জলদাস আমাকে তার গাড়িতে তুলে নিল। আমি অশ্রুবিহীন বেদনায় মাঝির কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাঝি লোকটা আজব। এত আদর করে এনেছে আমাকে। অথচ আমাকে বিদায় দেবার বদলে তার পকেটে এক তাড়া কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে কেমন লোভী চোখে। এই কাগজগুলো দিয়েছে জলদাস। যাক আমার কি, এরা সব এক জাত। স্বার্থপর গোঁজামিল।


যেতে যেতে জলদাস আমার সাথে গল্প করতে লাগলো। একটু পর আমি ভুল বুঝতে পারলাম। আমার কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু আমার সাথে বলছে না। বলছে তার সাথের আরেক জলদস্যুর সাথে। সেও বলেছে আমার মতো একজনকে নাকি সমুদ্রে দেখেছিল একবার। জলদাস সে কথা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিল। সে বললো আমার মতো আর একজনও নাই এই সমুদ্রে। আমি তুলনাহীন।


আমি তাদের দুজনের তর্ক উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম জলদাসের বাড়ি। বিশাল সেই বাড়ি। আমি কখনো এমন বাড়ি দেখিনি। আমাকে যেখানে নেয়া হলো সেখানে আমাকে গোসল করিয়ে যত্ন করে শুইয়ে রাখা হলো। এরপর আমি আয়েশে ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক দীর্ঘ যাত্রা পথ পেরুতে হয়েছে আজ। গাড়িতে চড়ার অভ্যেস নেই আমার। ভাগ্যিস বমি করে দেইনি। তাহলে বংশের মান মর্যাদা সব চলে যেতো।


আমি যখন জেগে উঠলাম তখন অনেক বদলে গেছে সবকিছু। এভাবে বদলে যাবো কখনো ভাবিনি।


আমার চেহারা পোষাক বিছানা সব বদলে দেয়া হয়েছে। আমি শুভ্র সুন্দর একটা বিছানায় শোয়া। বিছানাটা গোলাকার চকচকে। বিছানার কিনারটা সোনা রঙে মোড়ানো। তার পাশে দুটো রুপোলী দণ্ড সোজাসুজি রাখা। সূর্যের আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে যেন। আমাকে পরানো হয়েছে জমকালো পোষাক। কত বাহারী অলংকার আমার উপরে ছড়ানো।


সুগন্ধে মৌ মৌ করছে সমস্ত ঘর। আমারই সুগন্ধ। আমি আমার নিজের এত দারুন সুগন্ধ আগে কখনো পাইনি। সবাই আমাকে ঘিরে বসেছে। যেন আমাকে পুজা করছে। আমি এমনকি ঘুমাবার আগেও বুঝিনি আমি এতটা খ্যাতিমান কেউ। আমাকে দেবতার সম্মান দিয়ে এখানে রাখা হয়েছে ভাবতেই আমি জলদাসের প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করলাম। এরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে আমি যা তা কেউ নই। এ নিশ্চয়ই আমার স্বর্গারোহনের আয়োজন। আমি আমোদে চোখ বুঝলাম আবারো।


হঠাৎ বুকে খচ করে বিধলো কি যেন। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি জলদাসের হাতে উঠে এসেছে আমার পাশে রাখা রুপোলী দণ্ড দুটো। তার একটি বুকে সেঁদিয়ে দিয়েছে লোভাক্রান্ত জলদাস। তার মুখ থেকে এক ফোটা লালা আমার গায়ে পড়লো। আমি এবার আসল ঘটনা বুঝতে পারলাম।


জলদাস আমার স্বর্গারোহনের আয়োজন করেনি। আমার চারপাশে বসে থাকা লোকগুলো আমার পুজো করছে না। এবার তারা আমাকে টুকরো টুকরো করে তাদের উদরপূর্তি করবে। পূর্বপুরুষের ভবিষ্যতবাণীর কথা মনে পড়লো। এবার আর রক্ষা নেই। আমি ভয় পেতে আচ্ছি না। আমি ভাবছি এখন সময় হয়েছে প্রতিশোধের। মনে পড়লো আমাকে কি করতে হবে উদরের পথে যেতে যেতে। আমার শরীরের একটি বিশেষ কাঁটাকে আমি বিষাক্রান্ত করে রাখলাম। এটাই আমার প্রতিশোধের তীর। জলদাস আমার ওই অংশটাকে কাঁটাচামচে তুলে মুখে পুরে দিল। আমি এখন শুধুই একটি চোখা কাঁটা। আমার সমস্ত শরীর থেকে আমি জীবনের কনাকে এখানেই সন্নিবদ্ধ করেছি। বিষে বিষাক্রান্ত করেছি এই একটি বিন্দু। ওখানেই আমার জীবন কণা।


আমি জলদাসের উদরের পথে যেতে যেতে গোলাপী রঙের সরু গলিপথে পৌঁছামাত্রই আমার বাঁকানো কাঁটাকে আচ্ছা করে বিঁধিয়ে দিলাম সমস্ত শক্তি দিয়ে।

জলদাস তীব্র চিৎকার দিয়ে খাওয়া থামিয়ে দিল। সবাই অবাক। এমন কি ঘটলো। মুখে কোন কিছু বলছে না। কেবল ব্যথায় তীব্র চিৎকার করছে। সবাই ছুটে আসলো চারপাশ থেকে। কী হলো কী হলো? কাঁটা বিধেছে। কাটা কোথায়। গলায় হাত দিয়ে কেউ দেখলো না। জলদাস কথা বলতে পারছে না।

আমার সমস্ত বিষ জলদাসের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। জলদাসের শরীর
ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকলো।

আমার কাজ শেষ। এবার আমিও তৃপ্তিতে শান্তিতে চিরঘুমের দেশে চলে যেতে থাকলাম অবশ হয়ে। বংশের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে আমি গর্বিত।

Friday, February 14, 2014

ফাল্গুনের প্রিয় দুটো দিন

১.
আমাদের অনেকের জীবনেই একেকটা কফি হাউজের আড্ডার গল্প আছে। পরিণত বয়সে আড্ডার বন্ধুগুলো আর একসাথে থাকে না। আমারো অনেক বন্ধু হারিয়ে গেছে। তবু এখনো কয়েকজনের সাথে যোগাযোগে আছি। একই এলাকায় না হোক, একই শহরে। একই শহরে না হোক একই দেশে। এমনকি একই দেশে না হোক একই গ্রহে।

কিন্তু কিছু বন্ধু একেবারেই ছিটকে গেছে যোগাযোগের পথ থেকে। তাদের কিছুই আমরা জানি না। হেরে যাওয়া মানুষের সংবাদ কেউ রাখে না। আজ সেরকম একজন বন্ধু হঠাৎ ফোন করলো। ওর কথা শুনতে শুনতে ভীষণ কষ্ট হলো অপরাধবোধ হলো। সুদূর আমেরিকায় বসবাস করা বন্ধুর খবর আমি এক ক্লিকে নিয়ে ফেলি অথচ একই শহরে বাস করা এই বন্ধুর ঠিকানাও জানি না। কষ্ট চেপে বন্ধুকে বললাম আয় আজ দুপুরে একসাথে ডালভাত খাই। বন্ধু রাজী হলে আমার মনে হলো এটাই তো ভ্যালেন্টাইন আনন্দ।

মাঝে মাঝে কি আমরা এই হেরে যাওয়া বন্ধুদের নিয়ে ভ্যালেন্টাইন পালন করতে পারি না? বছরে দুয়েকবার? অবশ্যই পারি।

[১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৪]

২.
গত কয়েক বছর পহেলা ফাল্গুনে বিকেল থেকে সন্ধ্যের সময়টা ডিসি হিলে যাই পরিবার নিয়ে। ওশিন যখন ৩ বছরের কম তখন থেকেই আসতে শুরু করি। এই অনুষ্ঠান ওরও ভীষণ প্রিয়। ওর স্কুলের ঠিক সামনেই। এ বছর অফিস ফাঁকি দিতে পারিনি বলে সন্ধ্যের পর যেতে হলো। তখনো আলোয় ছায়ায় সুরের মায়ায় পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে থাকা শতাধিক বর্ষ প্রাচীন শিরীষ গাছের পাখায় পাখায় বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস বসে থাকা সারি সারি মানুষের কানে কানে বলছিল- 'এই তো আমি এসে পড়েছি, এবার নতুনের গান শোনো'। আমরা বেঞ্চিতে বসে মাথা দুলিয়ে পায়ে তাল দিতে দিতে গান উৎসব উপভোগ করি।

সত্যি বলতে কি পহেলা বৈশাখের চেয়েও এই দিনটা প্রিয় আমার। আরামদায়ক আবহাওয়া। মার্জিত পরিবেশ। রুচিশীল মানুষের সমাবেশ। পহেলা বৈশাখের লক্ষ মানুষের বিশ্রী রকমের ধাক্কাধাক্কি হুড়োহুড়ি সমৃদ্ধ বিরক্তিকর গরম উৎসবের চেয়ে এই সীমিত মানুষের বসন্ত উৎসব ঢের ঢের সুন্দর আর উপভোগ্য। পারলে নববর্ষই বদলে নিয়ে আসতাম আজকের দিনে।

[পহেলা ফাল্গুন ১৪২০]

৩.
সবগুলো ইচ্ছেপুরণের অন্যরকম একটা দিন আজ। এই সময়ের সবচেয়ে সুন্দর ২৪টি ঘন্টা।

Thursday, February 13, 2014

ছেঁড়াদ্বীপ : ভ্রমণের এক ভুল গন্তব্য

বিকেলে দ্বীপের অর্ধেক হেঁটে হোটেলে ফিরলাম। রাতে বড় একটা মাছের বারবিকিউ দিয়ে ডিনার সারা হলো খুবই তৃপ্তির সাথে। খাওয়া সেরে হোটেলে ফিরে রাতের আড্ডার শুরু। আড্ডার চানাচুর মুচমুচ করতে করতে বারোটার ঘরে পৌঁছে গেল ঘড়ির কাঁটা। দপ করে নিভে গেল দ্বীপের সমস্ত বাতি। দশ বছর আগের কথা মনে পড়লো। এই সময়ে বাতি নিভে গিয়েছিল প্রাসাদ প্যারাডাইসেও। ওরা হারিকেন দিয়ে গেছিল রুমে রুমে। এই হোটেল দিয়েছে মোমবাতি।

মোম জ্বালিয়ে আড্ডা চলছে। দুয়েকজন ঘুমে  ঢুলুঢুলু, সাড়ে বারোটার মধ্যে প্রায় সবাই ঘুমের পথে। শুধু আমার চোখে ঘুম উধাও। আমি দরোজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কোথাও কেউ নেই। এমনকি সমুদ্রের গর্জনও শোনা যাচ্ছে না। সমস্ত দ্বীপ রাত্রির শান্তি মেনে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখনই হঠাৎ আকাশে চোখ গেল। সামনের নারকেল গাছের অন্ধকার সারির একটু উপরে অদ্ভুত এক ফালি চাঁদ জেগে আছে দ্বীপের এই নিঃসঙ্গতাকে আরো বিষাদময় করে। এরকম সময়ে কবিত্ব জেগে ওঠে মানুষের মধ্যে? আমার ভেতর কবিত্ব জাগেনি। কেমন একটা গা শিরশিরে অনুভুতি। এটা কি ভয় নাকি আনন্দ নাকি বিস্ময় আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আকাশটা একটু বেশীই কাছে এখানে। বড় একটা মই বেয়ে যেন ছুঁয়ে দেয়া যাবে। 

আমি সেই অপার্থিব চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলাম। আমি যা সত্য ভাবি তা কি সত্য? আমি এই জগতের কতটুকু জানি, কতটুকু স্পর্শ করেছি। মহাবিশ্বের লক্ষ কোটি নক্ষত্র নীহারিকার মধ্যে এই চাঁদ এই পৃথিবী এই সৌরজগত ছোট্ট একটা ফুটকি মাত্র। এই সামান্য ফুটকির মধ্যে কত রূপরসগন্ধ। আমি রহস্য থেকে আরো গভীর রহস্যের অন্ধকারে ডুবে যাই। জগতের সবকিছুই অচেনা মনে হয় তখন। আমি কি তখন কিছু ভাবছিলাম? বিশেষ কারো কথা? কে সে? আমার মাথা ঠিকভাবে কাজ করছিল না।

হঠাৎ সামনের ঝোপ থেকে একটা কুকুর লাফ দিয়ে বের হলে আমি চমকে গেলাম। ওই চাঁদ, সেই কুকুর আর আমি। আমাদের কারো সাথে কারো কোন সংযোগ নেই, আমরা কেউ কারো নই। তবু আমরা একই সময়ে একটা প্যারালাল অস্তিত্ব নিয়ে এই জগতে অবস্থান করছি। এরকম সময়ে বিশ বছর আগে এই দ্বীপে একটা গান বাজছিল কাছের অন্ধকার সৈকতে। ছয় তরুণের সেই অভিযান। মান্না দে'র সেই গানটা "গভীর হয়েছে রাত, পৃথিবী ঘুমায়…..."।

ওই পৃথিবী থেকে এই পৃথিবী কতটা আলাদা? আমাদের অনেক কিছুই বদলে গেছে। কিন্তু পৃথিবী কি বদলেছে একটুও? সেই একই আহ্নিক গতি, সেই একই বার্ষিক গতি। মাঝখানে আমরা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে দুষিত করলাম খানিক।

পঞ্চমীর সেই চাঁদ নারিকেল গাছের আড়ালে ডুবে গেলে জগতময় অন্ধকার নেমে আসলো। নিকষ কালো অন্ধকারকে বাইরে রেখে আমি বিছানা ধরলাম এসে।


কোথাও বেড়াতে গেলে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কোন একটা বিশেষ দৃশ্য দেখার একটা ব্যাপার থাকে। সেটা দেশে হোক, বিদেশে হোক। সকালের তাড়াটা থাকবেই। হয় কোন পর্বতে সূর্যের প্রথম আলো, নয়তো সাগরে সূর্যোদয় অথবা জঙ্গলের ভোর। রাতে পরিকল্পনা হবার সময় খুব উৎসাহ থেকে এসব ব্যাপারে। কিন্তু মাঝরাত পেরিয়ে ঘুমাবার পর সকালে আর বিছানার মায়া ছাড়তে পারি না। ছাড়তে পারি না বলে জগতের অনেক সৌন্দর্যময় মুহুর্তকে আমি হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছি। ভোরের বিছানার উষ্ণতার কাছে আমার কাছে স্বর্গও নস্যি।

কিন্তু এবার উঠতেই হলো। গন্তব্য ছেঁড়া দ্বীপ। সবাই যাচ্ছে, সুতরাং আমাকেও যেতে হবে। বাঙালীদের কাছে এরকম কিছু হুজুগ আছে। কক্সবাজার গেলে হিমছড়ি যেতে হবে, সেন্টমার্টিন গেলে ছেঁড়াদ্বীপ যেতে হবে, রাঙ্গামাটি গেলে ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে হবে, বান্দরবান গেলে চিম্বুক উঠতে হবে(অধুনা নীলগিরি)। নিজের পছন্দের কোন জায়গা খোঁজার অবকাশ নেই। অমুক গেছে, তাই যেতে হবে। এখানে আসলে ওখানে যেতেই হয়। রুটিন মেনে। আমি আগের সেন্টমার্টিন ভ্রমণে এই হুজুগ এড়িয়ে থেকেছি। ফলে ছেঁড়াদ্বীপ জেয়ারত করা হয়নি আমার।

হ্যাঁ ব্যাপারটা জেয়ারতের মতোই। যেন তীর্থস্থান দেখতে বেরিয়েছি। এক ঘন্টা নৌকা ভ্রমণ করে একটা জায়গায় এক ঘন্টা অবস্থান করে ফিরে আসাটা তো তীর্থদর্শনের মতোই। সৌন্দর্যে অবগাহনের জন্য একটা দিন না হোক অর্ধদিবস হলেও থাকা দরকার। কিন্তু এখানে সেই সুযোগ নেই। নিয়ম করা হয়েছে এক ঘন্টা থাকবেন তারপর আবার ফিরতি নৌকায় উঠে যাবেন। ব্যাস।


কথা ছিল সাতটায় উঠে নাস্তা সেরে নৌকা ধরতে হবে। বিছানার মায়া ত্যাগ করতে কষ্ট হচ্ছিল বলে সব সেরে ঘাটে পৌছাতে পৌছাতে নটা বেজে গেল। ততক্ষণে সেন্টমার্টিন খালি করে পর্যটকের দল ছেড়াদ্বীপ চলে গেছে। আমরা কজন অযোগ্য পেছনে রয়ে গেছি। যাদের তেমন কোন তাড়া নেই। একটা নৌকা পছন্দ করা হলো। এটা বিদেশী পুরোনো মাল। মাথার উপর ছাদও আছে। টহলবোট ধরনের বস্তু। নতুন থাকতে বেশ জাঁকজমকই ছিল বোঝা যাচ্ছে। বিশ পচিশজনের ঠাঁই হবে। এখানে বিশজন হতেই নৌকা ভটভট করে যাত্রা শুরু করলো।
                                                    
                                      এই দ্বীপরেখাটি সেন্টমার্টিনের দক্ষিনপাড়া হয়ে গলাচিপা পার হয়ে ছেঁড়াদ্বীপ ছুঁয়েছে

সমুদ্র শান্ত। কোন দুলুনি নেই। এখানে পান্নার মতো সবুজ স্বচ্ছ জলের সৌন্দর্য মোহিত করে। কিন্তু সৌন্দর্য উপভোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ। আমাদের তিনচার ফুট দূরত্বেই ইঞ্জিনটা ভটভট করছে। দশ মিনিটের মধ্যে মাথা ধরে গেল আমার। বিরক্তির চুড়ান্তে উঠলাম বিশ মিনিটে। আরো বিশ মিনিট লাগবে। সময় যেন কাটছেই না।

অবশেষে কানের মগজের বারোটা বাজিয়ে প্রায় চল্লিশ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম ভ্রমণতীর্থ ছেঁড়াদ্বীপ। মূল দ্বীপ থেকে অবশ্য ছেড়াদ্বীপে হেঁটেও যাওয়া যায়। ঘন্টা তিনেক হাঁটতে হবে । অত সময় নেই কারো। তবে দূরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম কেউ কেউ হেঁটে যাচ্ছে। বেপরোয়া শৌখিন তরুন দল হবে নিশ্চয়ই।


ছেঁড়াদ্বীপে নৌকা ভেড়ার কোন ঘাট নেই। বড় নৌকাকে তাই দ্বীপ থেকে শখানেক গজ দূরে নোঙর ফেলে দাড়াতে হলো। ওখান থেকে ডিঙ্গি নৌকা করে দ্বীপে যেতে হবে। ডিঙ্গি নৌকা এল। একেক  ডিঙ্গিতে আট দশ জন উঠতে পারে। কিন্তু এই নৌকা বদল ব্যাপারটা বিশ্রী লাগলো। এখানে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। মানুষ ওঠার সময় ছোটনৌকাগুলো যেভাবে দুলে, তা উল্টে যেতে এক সেকেণ্ডও লাগবে না। নৌকার মাঝিগুলোও আনাড়ি মনে হলো। বাচ্চা ছেলে কতগুলো।

এখানে কোন প্রশাসন নেই, কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন অঘটন ঘটলে সাহায্য পাবার সম্ভাবনা নেই। লাশটা উদ্ধার করা যাবে এটুকুই। আমরা ডানবাম দুলতে দুলতে ছোট নৌকা নিয়ে দ্বীপে পা রাখলাম। দ্বীপে পা রাখা বলতে যত সহজ, কাজটা অত সহজ না। পা রাখতে গিয়েও যে কেউ ফসকে পড়ে যেতে পারে। কারন পা রাখার জায়গা বলতে কিছু নেই। প্রবাল পাথরের অগোছালো স্তুপে পা রেখে নামতে হয় নৌকা থেকে। পাথরগুলোর অনেকটাই ভারসাম্যহীন। লোকজন আছাড় খেতে খেতে অল্পের জন্য রক্ষা পাচ্ছে। ডুবে মরা থেকে বাঁচলেও পাথরে আছাড় খেয়ে পড়া থেকে বাঁচা মুশকিল। প্রত্যেকটা পাথর ধারালো। আছাড় খেলে হাত পা ছড়ে বীভৎস কাণ্ড ঘটতে পারে।


দূরে দাড়ানো বড় নৌকা থেকে ছোট ডিঙিতে এই পাথুরে সৈকতে আসে

এরকম পাথর ছড়ানো দ্বীপের চারপাশে। কয়েকশো ফুট প্রবাল পাথর পেরিয়ে বালির জায়গা আসলে স্বস্তি। এরপর বালি আর বালি, বালি পেরিয়ে বিরাট একটা কেয়াবন। শুধুই কেয়ার জঙ্গল। দ্বীপটায় আর কিছু নেই। মাথা গোঁজার এক ফোঁটা ঠাই নেই। গরম তপ্ত বালি আর পাথরে এক ঘন্টা টেকাই কষ্টকর। তবু লোকজন তীর্থ দর্শনের মতো এখানে আসে, কেউ কেউ এমনকি কোলের শিশু নিয়েও আসে। এমন পূন্যের কাজ এখানে আসা। আমি এই দ্বীপে এরকম ঝক্কি পেরিয়ে আসার কোন মানে খুঁজে পেলাম না। পাঁচ মিনিট এদিক ওদিক তাকিয়ে স্বাদ মিটে গেল।

                                         
                                       ওই দেখা যায় ছেঁড়াদ্বীপ, কেয়াঝোপ ছাড়া যেখানে দ্বিতীয় কোন বৃক্ষ নেই

পাথরের ফাঁকে ফাঁকে যেখানে স্বচ্ছ জল আছে সেখানে মাছেদের খেলা করতে দেখলাম। দেখার মধ্যে এই জিনিসই আছি। কিন্তু লোকজন এদিকে কেউ আসছে না। সবার লক্ষ্য উপরের কেয়াবন। যে কেয়াবনে দেখার কিছু নেই। আমার ইচ্ছে ছিল তখনই ফিরে যাই। খামাকা সময় নষ্ট এখানে। কিন্তু দেড় ঘন্টার পর নৌকা ছাড়বে। বেজার মুখে পাথরের উপর বসে থাকলাম। বাকীরা ফিরলে নৌকা ছাড়বে। একের পর এক নৌকা আসছে, হোচটমোচট খেয়ে লোকজন নৌকা থেকে নামছে। নারী পুরুষ শিশু সবরকম মানুষ একরকমের ভ্রান্তির শিকার হয়ে আসছে এদিকে।

                                                  এই পাথরগুলো একসময় রঙিন ছিল, এর ফাঁকে ছিল রঙিন মাছের খেলা

এই দ্বীপের চেয়ে সেন্টমার্টিনের মূল দ্বীপ অনেক বেশী সুন্দর। মূলদ্বীপে দেখার অনেক বেশী কিছু আছে। কিন্তু এদেরকে এই দ্বীপে আনার জন্য প্রলুদ্ধ করলো কারা? এটা তো রীতিমত দিল্লিকা লাড্ডু মনে হলো। আমাদের জাহাজ ছাড়বে বিকেল তিনটায়। সকাল থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত সময় যদি আমরা দ্বীপে ঘুরে বেড়াতাম তাহলে অনেক বেশী আনন্দ হতো। এখানে আসা যাওয়া মিলে চার ঘন্টা একদম বেহাত হয়ে গেল। চরম বিরক্তি নিয়ে ফিরতি যাত্রা করলাম। আবারো নৌকার বিশ্রী ভটভট শব্দ। তেলের ধোঁয়া, গন্ধ। এরকম ভ্রমণের চেয়ে হোটেলে শুয়ে আরো ঘন্টাখানেক ঘুমানো আরামের।


ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আমার পরামর্শ-  সেন্টমার্টিন ভ্রমণে গেলে ছেঁড়াদ্বীপ যাবার প্ল্যান না করাই ভালো। ওটা একটা হুজুগ। যে হুজুগে আনন্দের চেয়ে বিপদ বেশী, উপভোগের চেয়ে বিরক্তি বেশী। তার চেয়ে দ্বীপময় সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করুন ঘুরে ঘুরে।

কথা ছিল বেলা এগারোটায় হোটেল ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু আমরা ফিরতে ফিরতে বারোটা বাজলো। ফেরামাত্র গোসল করার সুযোগ নেই, রুম ছাড়তে হবে এখুনি, নতুন কাস্টমার আসছে। বাধ্য হয়ে আমাদের রুম ছেড়ে পাশের রুমে উঠতে হলো। সবাই ওখানে গাদাগাদি করে জিনিসপত্র রাখলাম। তারপর গোসলটোসল সেরে খেতে বেরুলাম।

খাওয়া সেরে টুকটাক কেনাকাটা হলো শুটকি ইত্যাদি(জঘন্য  রকমের অতিরিক্ত লবন দেয়া শুটকি)। আমি কিনলাম এক প্যাকেট বার্মিজ ক্যাণ্ডি বাচ্চাদের জন্য। ব্যস। জাহাজে উঠে গেলাম আড়াইটার মধ্যে। কেয়ারী সিন্দবাদ। যাবার সময় নীচতলায় সিট পেলাম। উঠেই ঘুম পেয়ে গেল আমার। ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে উঠে বের হলাম বিকেলের সমুদ্র দেখতে। রেলিং এ ভর দিয়ে সমুদ্র দেখে বিকেল শেষ করলাম।


                                        
গোধুলি বেলায় নাফ নদীতে ফেরার পথে আবারো গাঙচিলের দেখা
সন্ধ্যার মুখে মুখে নাফ নদীর জেটিতে থামলো জাহাজ। আমরা বাসের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। এখন থেকে পনের মিনিটের মধ্যে বাস আসবে। ছটার পরপর বাস এলো। বাসে উঠে দ্বিতীয় পর্বের আরেক ঘুম। ঘুমাতে ঘুমাতে ঝিমাতে ঝিমাতে রাত বারোটায় বাসার কাছে পৌঁছে গেলাম।
ছেঁড়াদ্বীপ ঘুরতে গিয়ে ভ্রমণের আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল এবার। ওই হুজুগে না মাতলে এই ভ্রমণটা ১৯৯৪ সালের মতো না হোক, কিন্তু বন্ধুদের নিয়ে আরেকটা মজার স্মৃতি হয়ে থাকতো।


ছেড়া দ্বীপের ভিডিওক্লিপ

পাদটীকা: এই লেখাটিও সেন্টমার্টিনে পা না রাখা বন্ধুর জন্য

Tuesday, February 11, 2014

বই নোট ২০১৪

.
ঢাকা যাবার সুযোগ পাচ্ছি না বলে বইমেলায় যাবারও সুযোগ পাচ্ছি না তবু বইমেলায় যেতে না পারার আক্ষেপটা এবার নেই বন্ধু স্বজনের কল্যাণে বইপত্র পেয়ে যাবো বলে নয় বইয়ের খিদে মেটাবার বিকল্প রাস্তা হাতের নাগালে বলেই চট্টগ্রামে 'বাতিঘর', 'বিশদ বাঙলা'র মত প্রতিষ্ঠান থাকাতে ঢাকা না গিয়েও অনেক বই পেয়ে যাই উল্লেখযোগ্য বইগুলো ওখানে আসে তাছাড়া হাতে এখনো প্রায় শ খানেক না পড়া বই রয়ে গেছে এখন আর বই কেনার জন্য বেহুদা ছোটাছুটি না করলেও চলবে

মেলায় যাওয়া মানে নিজের হাতে তরতাজা প্রকাশিত বই কেনা সেই আনন্দের জন্য ঢাকা যাবার যে ঝক্কি সেটা পোষাবে না ঢাকা এখন বহুত দূরের গন্তব্য সড়কপথ রেলপথ উভয় পথেই বিমানপথকেও খুব বেশী দ্রুত বলা যাবে না যানজট পেরিয়ে বিমানপোতে যাতায়াত সময় এবং বিমানের বিলম্বজনিত সময়ের যোগফলের পার্থক্য বাস বা ট্রেনের ভ্রমণ সময়ের চেয়ে খুব বেশী নয় ছোটবোন সেদিন দুপুর একটায় বেরিয়ে বিমানের চারটার ফ্লাইটে ছটার সময় উঠে সাতটায় ঢাকা পৌঁছে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বাসায় পৌছাতে আরো দুই ঘন্টা সব মিলিয়ে আট ঘন্টা যদি বাসে যেতো, দুপুর একটার বাসে দামপাড়া থেকে উঠে ঢাকার মালিবাগ পৌঁছাতে রাত নটার বেশী লাগার কথা নয়

মেলায় যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য বই কেনা হলেও আড্ডার লোভটাই সবচেয়ে বেশী মনে হয় কয়েক ঘন্টা আড্ডা দেবার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে একটা দিন অফিস ফাঁকি দেয়া প্রায় নিয়মের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল এই মাসে ইতিমধ্যে দক্ষিণ যাত্রার কারণে দুদিন খেয়ে ফেলেছি আবার রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না

বইমেলায় না যাওয়ার ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থনটা শেষ করলাম এখানেই

.
এবার বাকী কথা আসলে নিজেকে ঠিকমতো বোঝাতে পারাটাই সবচেয়ে বড় সফলতা কোন ব্যাপারে নিজেকে আয়ত্ত করতে না পারলে মগজে ঝামেলা লাগে হিসেব মেলানো তখন দায় হয়ে পড়ে আমি এবার বইমেলা যাবো না সিদ্ধান্ত নিলে কেউ আমাকে তাড়া করবে না কিন্তু নিজেকে নিজে তাড়া দেবার একটা ব্যাপার কাজ করে আমার আমি নিজের ভেতর কয়েকটা সত্ত্বা লালন করি, এরা অধিকাংশ সময় একমত থাকলেও মাঝে মাঝে ঠোকাঠুকি লাগে তখন নিজের ভেতরের ঝালটা বাইরে গিয়েও আঘাত করে
মানুষ মাত্রেই স্ববিরোধী যুক্তিশীল মানুষ হলো সুশীল স্ববিরোধী এরা নিজের ভুল চোখে দেখে না ভুল দেখলেও সেটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কুযুক্তি হাজির করে সেদিক থেকে বোকা মানুষেরা কম স্ববিরোধী, বোকা মানুষেরাই সহজ

Markus Zusak এর The Book Thief বইটা না থেমে পড়তে চেয়েছিলাম কিন্তু কিছুদূর গিয়ে থামতে হলো এই বইটা ছত্রে ছত্রে ভাবনার খোরাক যোগায়, না থেমে উপায় কি বন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞতা বইটার সন্ধান দেবার জন্য এই নামে যে সিনেমা হয়েছে সেটিও পেয়ে গেছি বইটা পড়ে মুভিটা দেখবো বলে ঠিক করেছিলাম কিন্তু অতদূর ধৈর্য ধরেনি, বইকে মাঝপথে রেখে মুভিটা দেখে ফেললাম একটা বই কিভাবে মানুষকের জীবনকে প্রভাবিত করে সেটা চাক্ষুস করার জন্য এই সিনেমাটা অপরিহার্য অসাধারণ একটা মুভি বাইসাইকেল থিফের মতো আরেকটা কালজয়ী সিনেমা

.
মনে হতে পারে পড়ার জগতে ফিরে গেছি আবারো না একদমই না এগুলোও অনেকটা ভং নিজেকে পড়ায় লিপ্ত করা ভং আমি ভেবে দেখেছি জগতে নীরব শান্তির এই একটাই দেশ আছে, সেটা বইদেশ আমি আস্তে আস্তে নিজেকে বইদেশে নির্বাসিত করার চেষ্টা করছি ক্যারিয়ার, টাকাপয়সা, ধন সম্পদ ইত্যাদির পেছনে বেহুদা ছুটতে ছুটতে ঠুশ করে মরে যাবার চাইতে বই পড়তে পড়তে কাত হয়ে যাওয়া বেশী শান্তির হবে তবে আপাততঃ ভং ধরলেও আখেরে এটাই হতে পারে আমার আসল ঘরবাড়ি এমনকি চাকরিবাকরী ছেড়ে দিয়ে বই পড়ায় ডুবে থাকার ইচ্ছে আছে কিন্তু সংসার কি তা মানবে? মানবে না কেউ মানবে না টাকার পেছনে ছোটো, টাকাই আসল, বইপত্র অবসর বিনোদন মাত্র আসলেই কি?
ব্লগারদের বই কেনার একটা তালিকা করে ঢাকায় পাঠাতে হবে পছন্দের বেশ কজন ব্লগার বই বের করেছে এবার প্রতিবারই কিনি অনেক ব্লগার প্রতিষ্ঠিত লেখকদের চেয়ে ভালো লেখেন প্রতিকূলতা এড়িয়ে টিকে থাকতে পারলে এরাই একদিন হবে মূলধারার লেখক ইতিমধ্যে তিন খানা বই হাতে চলে এসেছে তারেক অনুর 'পৃথিবীর পথে পথে', চরম উদাসের 'লাইনে আসুন' এবং মাহবুব আজাদের 'ছায়াগোলাপ' আরো বই পাইপলাইনে আছে মেলা শেষ হবার আগে যোগাড় হয়ে যাবে

.
বইয়ের বিকল্প আর কিছু আছে কি? বইকে বিনোদন ভাবলে বিকল্প অনেক আছে কিন্তু বইকে জীবন ভাবলে, আর কোন বিকল্প থাকে না জীবনের বিকল্প কিছু নেই বইকে আমি জীবন ভাবতে পছন্দ করছি যদি খেটে খাওয়া মানুষ না হতাম তাহলে সবটুকু সময় বইকেই দিতাম হয়তো, কে জানে