১.
ঢাকা যাবার
সুযোগ পাচ্ছি না বলে বইমেলায় যাবারও সুযোগ পাচ্ছি না। তবু বইমেলায় যেতে না
পারার আক্ষেপটা এবার নেই। বন্ধু স্বজনের কল্যাণে বইপত্র পেয়ে যাবো বলে নয়। বইয়ের খিদে মেটাবার
বিকল্প রাস্তা হাতের নাগালে বলেই। চট্টগ্রামে 'বাতিঘর',
'বিশদ বাঙলা'র মত প্রতিষ্ঠান থাকাতে ঢাকা
না গিয়েও অনেক বই পেয়ে যাই। উল্লেখযোগ্য বইগুলো ওখানে আসে। তাছাড়া হাতে এখনো প্রায়
শ খানেক না পড়া বই রয়ে গেছে। এখন আর বই কেনার জন্য বেহুদা ছোটাছুটি
না করলেও চলবে।
মেলায় যাওয়া
মানে নিজের হাতে তরতাজা প্রকাশিত বই কেনা। সেই আনন্দের জন্য ঢাকা যাবার যে
ঝক্কি সেটা পোষাবে না। ঢাকা এখন বহুত দূরের গন্তব্য। সড়কপথ রেলপথ উভয় পথেই। বিমানপথকেও খুব বেশী
দ্রুত বলা যাবে না। যানজট পেরিয়ে বিমানপোতে যাতায়াত সময় এবং বিমানের বিলম্বজনিত সময়ের যোগফলের
পার্থক্য বাস বা ট্রেনের ভ্রমণ সময়ের চেয়ে খুব বেশী নয়। ছোটবোন সেদিন দুপুর
একটায় বেরিয়ে বিমানের চারটার ফ্লাইটে ছটার সময় উঠে সাতটায় ঢাকা পৌঁছে। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে
বাসায় পৌছাতে আরো দুই ঘন্টা। সব মিলিয়ে আট ঘন্টা। যদি বাসে যেতো, দুপুর একটার
বাসে দামপাড়া থেকে উঠে ঢাকার মালিবাগ পৌঁছাতে রাত নটার বেশী লাগার কথা নয়।
মেলায় যাওয়ার
অন্যতম উদ্দেশ্য বই কেনা হলেও আড্ডার লোভটাই সবচেয়ে বেশী মনে হয়। কয়েক ঘন্টা আড্ডা দেবার
জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে একটা দিন অফিস ফাঁকি দেয়া প্রায় নিয়মের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। এই মাসে ইতিমধ্যে দক্ষিণ
যাত্রার কারণে দুদিন খেয়ে ফেলেছি। আবার রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না।
বইমেলায়
না যাওয়ার ব্যাপারে আত্মপক্ষ সমর্থনটা শেষ করলাম এখানেই।
২.
এবার বাকী
কথা। আসলে নিজেকে ঠিকমতো বোঝাতে পারাটাই সবচেয়ে বড় সফলতা। কোন ব্যাপারে নিজেকে
আয়ত্ত করতে না পারলে মগজে ঝামেলা লাগে। হিসেব মেলানো তখন দায় হয়ে পড়ে। আমি এবার বইমেলা যাবো
না সিদ্ধান্ত নিলে কেউ আমাকে তাড়া করবে না। কিন্তু নিজেকে নিজে তাড়া দেবার
একটা ব্যাপার কাজ করে আমার। আমি নিজের ভেতর কয়েকটা সত্ত্বা
লালন করি, এরা অধিকাংশ সময় একমত থাকলেও মাঝে মাঝে ঠোকাঠুকি লাগে। তখন নিজের ভেতরের ঝালটা
বাইরে গিয়েও আঘাত করে।
মানুষ মাত্রেই
স্ববিরোধী। যুক্তিশীল মানুষ হলো সুশীল স্ববিরোধী। এরা নিজের ভুল চোখে
দেখে না। ভুল দেখলেও সেটাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কুযুক্তি হাজির করে। সেদিক থেকে বোকা মানুষেরা
কম স্ববিরোধী, বোকা মানুষেরাই সহজ।
Markus
Zusak এর
The
Book Thief বইটা না থেমে পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে
থামতে হলো। এই বইটা ছত্রে ছত্রে ভাবনার খোরাক যোগায়, না থেমে উপায়
কি। বন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞতা বইটার সন্ধান দেবার জন্য। এই নামে যে সিনেমা হয়েছে
সেটিও পেয়ে গেছি। বইটা পড়ে মুভিটা দেখবো বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু অতদূর ধৈর্য
ধরেনি, বইকে মাঝপথে রেখে মুভিটা দেখে ফেললাম। একটা বই কিভাবে মানুষকের
জীবনকে প্রভাবিত করে সেটা চাক্ষুস করার জন্য এই সিনেমাটা অপরিহার্য। অসাধারণ একটা মুভি। বাইসাইকেল থিফের মতো
আরেকটা কালজয়ী সিনেমা।
৩.
মনে হতে
পারে পড়ার জগতে ফিরে গেছি আবারো। না। একদমই না। এগুলোও অনেকটা ভং। নিজেকে পড়ায় লিপ্ত করা
ভং। আমি ভেবে দেখেছি জগতে নীরব শান্তির এই একটাই দেশ আছে, সেটা বইদেশ। আমি আস্তে আস্তে নিজেকে
বইদেশে নির্বাসিত করার চেষ্টা করছি। ক্যারিয়ার, টাকাপয়সা,
ধন সম্পদ ইত্যাদির পেছনে বেহুদা ছুটতে ছুটতে ঠুশ করে মরে যাবার চাইতে
বই পড়তে পড়তে কাত হয়ে যাওয়া বেশী শান্তির হবে। তবে আপাততঃ ভং ধরলেও
আখেরে এটাই হতে পারে আমার আসল ঘরবাড়ি। এমনকি চাকরিবাকরী ছেড়ে দিয়ে বই
পড়ায় ডুবে থাকার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সংসার কি তা মানবে? মানবে না। কেউ মানবে না। টাকার পেছনে ছোটো, টাকাই আসল,
বইপত্র অবসর বিনোদন মাত্র। আসলেই কি?
ব্লগারদের
বই কেনার একটা তালিকা করে ঢাকায় পাঠাতে হবে। পছন্দের বেশ কজন ব্লগার বই বের
করেছে এবার। প্রতিবারই কিনি। অনেক ব্লগার প্রতিষ্ঠিত লেখকদের
চেয়ে ভালো লেখেন। প্রতিকূলতা এড়িয়ে টিকে থাকতে পারলে এরাই একদিন হবে মূলধারার লেখক। ইতিমধ্যে তিন খানা বই
হাতে চলে এসেছে। তারেক অনুর
'পৃথিবীর পথে পথে', চরম উদাসের 'লাইনে আসুন' এবং মাহবুব আজাদের 'ছায়াগোলাপ'। আরো বই পাইপলাইনে আছে। মেলা শেষ হবার আগে যোগাড়
হয়ে যাবে।
৪.
বইয়ের বিকল্প
আর কিছু আছে কি? বইকে বিনোদন ভাবলে বিকল্প অনেক আছে। কিন্তু বইকে জীবন ভাবলে, আর কোন বিকল্প
থাকে না। জীবনের বিকল্প কিছু নেই। বইকে আমি জীবন ভাবতে পছন্দ করছি। যদি খেটে খাওয়া মানুষ
না হতাম। তাহলে সবটুকু সময় বইকেই দিতাম হয়তো, কে জানে।
No comments:
Post a Comment