কর্মময় জীবন আর ভালো লাগিতেছে না। আসলে যে কাজ করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেছি সেই কাজের প্রতি এক প্রকার অনীহা তৈরী হইয়াছে। 'কাজ' আমাকে পছন্দ করিতেছে না আমি 'কাজ'কে পছন্দ করিতেছি না। আমাদের অবনিবনার ফসল একরকমের বিবমিষা।
আমি দিনের পর দিন একই চেয়ারে বসিয়া কীবোর্ড পেষার কাজ করি। আমার কীবোর্ড পেষাপেষিতে দেশ জাত কুল কাহারো কোন উপকার হয় না। তবে মাস শেষের মাহিনা যখন ব্যাংকের খাতায় জমা হয় তখন এক প্রকার স্বস্তিবোধ হয়। শুধুমাত্র একটি মাসিক স্বস্তির জন্য আমি বাকী ত্রিশটা দিন কাজের সহিত ঘষাঘষি করিয়া মরিব ইহা আর মানিতে পারিতেছি না। আমি মুক্তি লাভ করিতে চাই।
আসলে আমি একাই মুক্তি চাহি না। কাজও আমা হতে মুক্তি চায়। আমার মতো অপদার্থ অকর্মণ্য কর্মী সে ইতিপূর্বে কখনো দেখে নাই। শুনিয়া আপনারা ভাবিতেছেন আমি নতুন কোথাও যাইবার ধান্ধা করিতেছি কিনা। আসলে তাহা নহে। আমি ১৮ বছর পর উপলব্ধি করিলাম যে কর্মময় জীবন আমার জন্য নহে। আমার দরকার ছিল একটা নির্বিবাদী জমিদারী। যাহাতে আমি গদিতে শুইয়া শুইয়া হুকুম করিব আর প্রজাবৃন্দ আমার পদতলে সকল প্রকার সেবা প্রদান করিবে। কিন্তু তাহাও তো হইবার উপায় নাই। আমি তাই ভিন্ন রকমের এক জমিদারির কথা বলি। তাহার নাম আলস্যের জমিদারি।
আলস্যের মতো আনন্দদায়ক ব্যাপার আর কিছু নাই। আলস্যের মর্যাদা দিতে যাহারা ব্যর্থ হইয়াছেন তাহারা জীবনের অনাবিস্কৃত আনন্দসম্ভার থেকে বঞ্চিত হইয়াছেন।
জীবনের প্রকৃত আনন্দের অন্যতম উপায় হইল বেলা দশটা বাজিবার পর চক্ষু মেলিয়া উঠিয়া বসা। আস্তে ধীরে প্রাতঃকৃত্য সারিয়া বেলা এগারোটায় চায়ের কাপ হাতে খবরে কাগজ খুলিয়া হেডলাইনে চোখ বুলাইবামাত্র কাগজখানা খাটের তলায় ছুড়িয়া মারা। তারপর বোকা বাক্সের দূরবর্তী নিয়ন্ত্রক(রিমোট)খানা হাতে লইয়া চ্যানেল ঘুরাইতে ঘুরাইতে আগাপাশতলা চষিয়া 'বন্ধ কর' বোতামে টিপ দিয়া তাহাও সোফার এক কোনায় ছুড়িয়া মারা। কিসসু ভালো লাগিতেছে না ভাবিয়া বইয়ের তাক হইতে খুঁজিয়া খুঁজিয়া যে কোন একটা যুতসই বই নামাইয়া সাড়ে তেরো পাতা পড়ার পর আবিষ্কার করা যে এই বইখানা ইতিমধ্যে আরো একবার পঠিত হইয়াছে।
অতঃপর উহাও যথাস্থানে রাখিয়া ড্রয়ার খুলিয়া খাতা কলম বাহির করিয়া আধখানা খসড়া গদ্য রচনা করিয়া তৃপ্তির সহিত ভাবিতে বসা, আহ কী অপূর্ব সাহিত্য রচনা করিলাম, রবীন্দ্রনাথের অমিত চ্যাটার্জি দেখিলেও চমকিয়া উঠিতেন আর লাবন্য দেখিলে বলিতো ……...থাক লাবন্যের কথাটা বলা এখন নিরাপদ নহে। রান্নাঘরে তাওয়ায় রুটি গরম করিতেছে গিন্নী, হাতে তাহার গরম ছেনি।
এই করিতে করিতে বেলা দুপুর পার হইয়া গেলে গোসল সারিয়া তিন পদের ভর্তার সাথে দুই পদের ছোটমাছের ঝোল দিয়া ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত মাখিয়া পেট ভর্তি করিয়া খাইয়া ফের বিছানায় শুইয়া দেয়াল টিভির বড় পর্দায় একখানা লাতিন আমেরিকান মুভি ছাড়িয়া দিয়া ঘুমাইয়া পড়া। আরেক ঘুমে বৈকাল সাড়ে পাঁচ ঘটিকা পর্যন্ত কাটাইয়া দেওয়া। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচ ঘটিকায় আসা মানে আপিস ছুটি। আজিকার কর্মসময় সমাপ্ত।
কর্মসময় পার করিবার পর বিছানা হইতে নামিয়া গায়ে ফতুয়া চড়াইয়া হাওয়া খাইবার জন্য পল্টন ময়দানের উদ্দেশ্যে বাহির হইয়া যাওয়া। অফিস টাইমের পরে বৈকালিক ভ্রমণের মতো আনন্দ আর কিছুতে নাই।
কি ব্যাপার? অত বড় হা করিয়া কি দেখিতেছেন? এখনো বুঝেন নাই? না বুঝারই কথা। কারণ উপরোল্লিখিত কর্মময় জগত বাস্তবে আপনারা দেখেন নাই। আমিও দেখি নাই। ইহা কেবলই একটা ইউটোপিয়া মাত্র।
দুঃখজনক সত্য হইল, বাস্তব জগতে এরকম সুখময়তার কোন স্থান আজাবধি কেউ দেখে নাই। বাস্তব জগত একটি 'খাইট্যা খা' ধরনের বস্তু। উহাতে আমি বা আর কেহ স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। তবু তাহা মানাইয়া লইয়া বাঁচিয়া থাকে। সাম্প্রতিককালে আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করি 'কাজ' কখন নিজ হইতে আমাকে খেদাইয়া দিবে। হয়তো কাজও আমার জন্য প্রতীক্ষা করে, কখন আমি আপোষে ভাগিয়া যাইবো। কিন্তু কোনটিই ঘটিতেছে না। ফলে আমাকে এই রচনা প্রস্তুত করিয়া উভয়ের মধ্যে মিলন ঘটাইবার বন্দোবস্ত করিতে হইলো। এইবার কোন এক শুভক্ষণে উহারা পরস্পরকে বিদায় জানাইতে পারে।
অতঃপর আমি নিশ্চিন্তে আলস্যের জমিদারির কুসুমাস্তীর্ণ পথে নিরুদ্বিগ্ন পদযুগল সঞ্চালন করিতে পারিব। আলস্যের এই মহান চেতনা আমি জগত ব্যাপিয়া ছড়াইয়া দিতে চাহি।
No comments:
Post a Comment