Thursday, February 13, 2014

ছেঁড়াদ্বীপ : ভ্রমণের এক ভুল গন্তব্য

বিকেলে দ্বীপের অর্ধেক হেঁটে হোটেলে ফিরলাম। রাতে বড় একটা মাছের বারবিকিউ দিয়ে ডিনার সারা হলো খুবই তৃপ্তির সাথে। খাওয়া সেরে হোটেলে ফিরে রাতের আড্ডার শুরু। আড্ডার চানাচুর মুচমুচ করতে করতে বারোটার ঘরে পৌঁছে গেল ঘড়ির কাঁটা। দপ করে নিভে গেল দ্বীপের সমস্ত বাতি। দশ বছর আগের কথা মনে পড়লো। এই সময়ে বাতি নিভে গিয়েছিল প্রাসাদ প্যারাডাইসেও। ওরা হারিকেন দিয়ে গেছিল রুমে রুমে। এই হোটেল দিয়েছে মোমবাতি।

মোম জ্বালিয়ে আড্ডা চলছে। দুয়েকজন ঘুমে  ঢুলুঢুলু, সাড়ে বারোটার মধ্যে প্রায় সবাই ঘুমের পথে। শুধু আমার চোখে ঘুম উধাও। আমি দরোজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কোথাও কেউ নেই। এমনকি সমুদ্রের গর্জনও শোনা যাচ্ছে না। সমস্ত দ্বীপ রাত্রির শান্তি মেনে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখনই হঠাৎ আকাশে চোখ গেল। সামনের নারকেল গাছের অন্ধকার সারির একটু উপরে অদ্ভুত এক ফালি চাঁদ জেগে আছে দ্বীপের এই নিঃসঙ্গতাকে আরো বিষাদময় করে। এরকম সময়ে কবিত্ব জেগে ওঠে মানুষের মধ্যে? আমার ভেতর কবিত্ব জাগেনি। কেমন একটা গা শিরশিরে অনুভুতি। এটা কি ভয় নাকি আনন্দ নাকি বিস্ময় আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আকাশটা একটু বেশীই কাছে এখানে। বড় একটা মই বেয়ে যেন ছুঁয়ে দেয়া যাবে। 

আমি সেই অপার্থিব চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলাম। আমি যা সত্য ভাবি তা কি সত্য? আমি এই জগতের কতটুকু জানি, কতটুকু স্পর্শ করেছি। মহাবিশ্বের লক্ষ কোটি নক্ষত্র নীহারিকার মধ্যে এই চাঁদ এই পৃথিবী এই সৌরজগত ছোট্ট একটা ফুটকি মাত্র। এই সামান্য ফুটকির মধ্যে কত রূপরসগন্ধ। আমি রহস্য থেকে আরো গভীর রহস্যের অন্ধকারে ডুবে যাই। জগতের সবকিছুই অচেনা মনে হয় তখন। আমি কি তখন কিছু ভাবছিলাম? বিশেষ কারো কথা? কে সে? আমার মাথা ঠিকভাবে কাজ করছিল না।

হঠাৎ সামনের ঝোপ থেকে একটা কুকুর লাফ দিয়ে বের হলে আমি চমকে গেলাম। ওই চাঁদ, সেই কুকুর আর আমি। আমাদের কারো সাথে কারো কোন সংযোগ নেই, আমরা কেউ কারো নই। তবু আমরা একই সময়ে একটা প্যারালাল অস্তিত্ব নিয়ে এই জগতে অবস্থান করছি। এরকম সময়ে বিশ বছর আগে এই দ্বীপে একটা গান বাজছিল কাছের অন্ধকার সৈকতে। ছয় তরুণের সেই অভিযান। মান্না দে'র সেই গানটা "গভীর হয়েছে রাত, পৃথিবী ঘুমায়…..."।

ওই পৃথিবী থেকে এই পৃথিবী কতটা আলাদা? আমাদের অনেক কিছুই বদলে গেছে। কিন্তু পৃথিবী কি বদলেছে একটুও? সেই একই আহ্নিক গতি, সেই একই বার্ষিক গতি। মাঝখানে আমরা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে দুষিত করলাম খানিক।

পঞ্চমীর সেই চাঁদ নারিকেল গাছের আড়ালে ডুবে গেলে জগতময় অন্ধকার নেমে আসলো। নিকষ কালো অন্ধকারকে বাইরে রেখে আমি বিছানা ধরলাম এসে।


কোথাও বেড়াতে গেলে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কোন একটা বিশেষ দৃশ্য দেখার একটা ব্যাপার থাকে। সেটা দেশে হোক, বিদেশে হোক। সকালের তাড়াটা থাকবেই। হয় কোন পর্বতে সূর্যের প্রথম আলো, নয়তো সাগরে সূর্যোদয় অথবা জঙ্গলের ভোর। রাতে পরিকল্পনা হবার সময় খুব উৎসাহ থেকে এসব ব্যাপারে। কিন্তু মাঝরাত পেরিয়ে ঘুমাবার পর সকালে আর বিছানার মায়া ছাড়তে পারি না। ছাড়তে পারি না বলে জগতের অনেক সৌন্দর্যময় মুহুর্তকে আমি হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছি। ভোরের বিছানার উষ্ণতার কাছে আমার কাছে স্বর্গও নস্যি।

কিন্তু এবার উঠতেই হলো। গন্তব্য ছেঁড়া দ্বীপ। সবাই যাচ্ছে, সুতরাং আমাকেও যেতে হবে। বাঙালীদের কাছে এরকম কিছু হুজুগ আছে। কক্সবাজার গেলে হিমছড়ি যেতে হবে, সেন্টমার্টিন গেলে ছেঁড়াদ্বীপ যেতে হবে, রাঙ্গামাটি গেলে ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে হবে, বান্দরবান গেলে চিম্বুক উঠতে হবে(অধুনা নীলগিরি)। নিজের পছন্দের কোন জায়গা খোঁজার অবকাশ নেই। অমুক গেছে, তাই যেতে হবে। এখানে আসলে ওখানে যেতেই হয়। রুটিন মেনে। আমি আগের সেন্টমার্টিন ভ্রমণে এই হুজুগ এড়িয়ে থেকেছি। ফলে ছেঁড়াদ্বীপ জেয়ারত করা হয়নি আমার।

হ্যাঁ ব্যাপারটা জেয়ারতের মতোই। যেন তীর্থস্থান দেখতে বেরিয়েছি। এক ঘন্টা নৌকা ভ্রমণ করে একটা জায়গায় এক ঘন্টা অবস্থান করে ফিরে আসাটা তো তীর্থদর্শনের মতোই। সৌন্দর্যে অবগাহনের জন্য একটা দিন না হোক অর্ধদিবস হলেও থাকা দরকার। কিন্তু এখানে সেই সুযোগ নেই। নিয়ম করা হয়েছে এক ঘন্টা থাকবেন তারপর আবার ফিরতি নৌকায় উঠে যাবেন। ব্যাস।


কথা ছিল সাতটায় উঠে নাস্তা সেরে নৌকা ধরতে হবে। বিছানার মায়া ত্যাগ করতে কষ্ট হচ্ছিল বলে সব সেরে ঘাটে পৌছাতে পৌছাতে নটা বেজে গেল। ততক্ষণে সেন্টমার্টিন খালি করে পর্যটকের দল ছেড়াদ্বীপ চলে গেছে। আমরা কজন অযোগ্য পেছনে রয়ে গেছি। যাদের তেমন কোন তাড়া নেই। একটা নৌকা পছন্দ করা হলো। এটা বিদেশী পুরোনো মাল। মাথার উপর ছাদও আছে। টহলবোট ধরনের বস্তু। নতুন থাকতে বেশ জাঁকজমকই ছিল বোঝা যাচ্ছে। বিশ পচিশজনের ঠাঁই হবে। এখানে বিশজন হতেই নৌকা ভটভট করে যাত্রা শুরু করলো।
                                                    
                                      এই দ্বীপরেখাটি সেন্টমার্টিনের দক্ষিনপাড়া হয়ে গলাচিপা পার হয়ে ছেঁড়াদ্বীপ ছুঁয়েছে

সমুদ্র শান্ত। কোন দুলুনি নেই। এখানে পান্নার মতো সবুজ স্বচ্ছ জলের সৌন্দর্য মোহিত করে। কিন্তু সৌন্দর্য উপভোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে ইঞ্জিনের ভটভট শব্দ। আমাদের তিনচার ফুট দূরত্বেই ইঞ্জিনটা ভটভট করছে। দশ মিনিটের মধ্যে মাথা ধরে গেল আমার। বিরক্তির চুড়ান্তে উঠলাম বিশ মিনিটে। আরো বিশ মিনিট লাগবে। সময় যেন কাটছেই না।

অবশেষে কানের মগজের বারোটা বাজিয়ে প্রায় চল্লিশ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম ভ্রমণতীর্থ ছেঁড়াদ্বীপ। মূল দ্বীপ থেকে অবশ্য ছেড়াদ্বীপে হেঁটেও যাওয়া যায়। ঘন্টা তিনেক হাঁটতে হবে । অত সময় নেই কারো। তবে দূরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম কেউ কেউ হেঁটে যাচ্ছে। বেপরোয়া শৌখিন তরুন দল হবে নিশ্চয়ই।


ছেঁড়াদ্বীপে নৌকা ভেড়ার কোন ঘাট নেই। বড় নৌকাকে তাই দ্বীপ থেকে শখানেক গজ দূরে নোঙর ফেলে দাড়াতে হলো। ওখান থেকে ডিঙ্গি নৌকা করে দ্বীপে যেতে হবে। ডিঙ্গি নৌকা এল। একেক  ডিঙ্গিতে আট দশ জন উঠতে পারে। কিন্তু এই নৌকা বদল ব্যাপারটা বিশ্রী লাগলো। এখানে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। মানুষ ওঠার সময় ছোটনৌকাগুলো যেভাবে দুলে, তা উল্টে যেতে এক সেকেণ্ডও লাগবে না। নৌকার মাঝিগুলোও আনাড়ি মনে হলো। বাচ্চা ছেলে কতগুলো।

এখানে কোন প্রশাসন নেই, কারো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন অঘটন ঘটলে সাহায্য পাবার সম্ভাবনা নেই। লাশটা উদ্ধার করা যাবে এটুকুই। আমরা ডানবাম দুলতে দুলতে ছোট নৌকা নিয়ে দ্বীপে পা রাখলাম। দ্বীপে পা রাখা বলতে যত সহজ, কাজটা অত সহজ না। পা রাখতে গিয়েও যে কেউ ফসকে পড়ে যেতে পারে। কারন পা রাখার জায়গা বলতে কিছু নেই। প্রবাল পাথরের অগোছালো স্তুপে পা রেখে নামতে হয় নৌকা থেকে। পাথরগুলোর অনেকটাই ভারসাম্যহীন। লোকজন আছাড় খেতে খেতে অল্পের জন্য রক্ষা পাচ্ছে। ডুবে মরা থেকে বাঁচলেও পাথরে আছাড় খেয়ে পড়া থেকে বাঁচা মুশকিল। প্রত্যেকটা পাথর ধারালো। আছাড় খেলে হাত পা ছড়ে বীভৎস কাণ্ড ঘটতে পারে।


দূরে দাড়ানো বড় নৌকা থেকে ছোট ডিঙিতে এই পাথুরে সৈকতে আসে

এরকম পাথর ছড়ানো দ্বীপের চারপাশে। কয়েকশো ফুট প্রবাল পাথর পেরিয়ে বালির জায়গা আসলে স্বস্তি। এরপর বালি আর বালি, বালি পেরিয়ে বিরাট একটা কেয়াবন। শুধুই কেয়ার জঙ্গল। দ্বীপটায় আর কিছু নেই। মাথা গোঁজার এক ফোঁটা ঠাই নেই। গরম তপ্ত বালি আর পাথরে এক ঘন্টা টেকাই কষ্টকর। তবু লোকজন তীর্থ দর্শনের মতো এখানে আসে, কেউ কেউ এমনকি কোলের শিশু নিয়েও আসে। এমন পূন্যের কাজ এখানে আসা। আমি এই দ্বীপে এরকম ঝক্কি পেরিয়ে আসার কোন মানে খুঁজে পেলাম না। পাঁচ মিনিট এদিক ওদিক তাকিয়ে স্বাদ মিটে গেল।

                                         
                                       ওই দেখা যায় ছেঁড়াদ্বীপ, কেয়াঝোপ ছাড়া যেখানে দ্বিতীয় কোন বৃক্ষ নেই

পাথরের ফাঁকে ফাঁকে যেখানে স্বচ্ছ জল আছে সেখানে মাছেদের খেলা করতে দেখলাম। দেখার মধ্যে এই জিনিসই আছি। কিন্তু লোকজন এদিকে কেউ আসছে না। সবার লক্ষ্য উপরের কেয়াবন। যে কেয়াবনে দেখার কিছু নেই। আমার ইচ্ছে ছিল তখনই ফিরে যাই। খামাকা সময় নষ্ট এখানে। কিন্তু দেড় ঘন্টার পর নৌকা ছাড়বে। বেজার মুখে পাথরের উপর বসে থাকলাম। বাকীরা ফিরলে নৌকা ছাড়বে। একের পর এক নৌকা আসছে, হোচটমোচট খেয়ে লোকজন নৌকা থেকে নামছে। নারী পুরুষ শিশু সবরকম মানুষ একরকমের ভ্রান্তির শিকার হয়ে আসছে এদিকে।

                                                  এই পাথরগুলো একসময় রঙিন ছিল, এর ফাঁকে ছিল রঙিন মাছের খেলা

এই দ্বীপের চেয়ে সেন্টমার্টিনের মূল দ্বীপ অনেক বেশী সুন্দর। মূলদ্বীপে দেখার অনেক বেশী কিছু আছে। কিন্তু এদেরকে এই দ্বীপে আনার জন্য প্রলুদ্ধ করলো কারা? এটা তো রীতিমত দিল্লিকা লাড্ডু মনে হলো। আমাদের জাহাজ ছাড়বে বিকেল তিনটায়। সকাল থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত সময় যদি আমরা দ্বীপে ঘুরে বেড়াতাম তাহলে অনেক বেশী আনন্দ হতো। এখানে আসা যাওয়া মিলে চার ঘন্টা একদম বেহাত হয়ে গেল। চরম বিরক্তি নিয়ে ফিরতি যাত্রা করলাম। আবারো নৌকার বিশ্রী ভটভট শব্দ। তেলের ধোঁয়া, গন্ধ। এরকম ভ্রমণের চেয়ে হোটেলে শুয়ে আরো ঘন্টাখানেক ঘুমানো আরামের।


ভ্রমণপিপাসুদের জন্য আমার পরামর্শ-  সেন্টমার্টিন ভ্রমণে গেলে ছেঁড়াদ্বীপ যাবার প্ল্যান না করাই ভালো। ওটা একটা হুজুগ। যে হুজুগে আনন্দের চেয়ে বিপদ বেশী, উপভোগের চেয়ে বিরক্তি বেশী। তার চেয়ে দ্বীপময় সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করুন ঘুরে ঘুরে।

কথা ছিল বেলা এগারোটায় হোটেল ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু আমরা ফিরতে ফিরতে বারোটা বাজলো। ফেরামাত্র গোসল করার সুযোগ নেই, রুম ছাড়তে হবে এখুনি, নতুন কাস্টমার আসছে। বাধ্য হয়ে আমাদের রুম ছেড়ে পাশের রুমে উঠতে হলো। সবাই ওখানে গাদাগাদি করে জিনিসপত্র রাখলাম। তারপর গোসলটোসল সেরে খেতে বেরুলাম।

খাওয়া সেরে টুকটাক কেনাকাটা হলো শুটকি ইত্যাদি(জঘন্য  রকমের অতিরিক্ত লবন দেয়া শুটকি)। আমি কিনলাম এক প্যাকেট বার্মিজ ক্যাণ্ডি বাচ্চাদের জন্য। ব্যস। জাহাজে উঠে গেলাম আড়াইটার মধ্যে। কেয়ারী সিন্দবাদ। যাবার সময় নীচতলায় সিট পেলাম। উঠেই ঘুম পেয়ে গেল আমার। ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে উঠে বের হলাম বিকেলের সমুদ্র দেখতে। রেলিং এ ভর দিয়ে সমুদ্র দেখে বিকেল শেষ করলাম।


                                        
গোধুলি বেলায় নাফ নদীতে ফেরার পথে আবারো গাঙচিলের দেখা
সন্ধ্যার মুখে মুখে নাফ নদীর জেটিতে থামলো জাহাজ। আমরা বাসের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। এখন থেকে পনের মিনিটের মধ্যে বাস আসবে। ছটার পরপর বাস এলো। বাসে উঠে দ্বিতীয় পর্বের আরেক ঘুম। ঘুমাতে ঘুমাতে ঝিমাতে ঝিমাতে রাত বারোটায় বাসার কাছে পৌঁছে গেলাম।
ছেঁড়াদ্বীপ ঘুরতে গিয়ে ভ্রমণের আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল এবার। ওই হুজুগে না মাতলে এই ভ্রমণটা ১৯৯৪ সালের মতো না হোক, কিন্তু বন্ধুদের নিয়ে আরেকটা মজার স্মৃতি হয়ে থাকতো।


ছেড়া দ্বীপের ভিডিওক্লিপ

পাদটীকা: এই লেখাটিও সেন্টমার্টিনে পা না রাখা বন্ধুর জন্য

No comments: