'সেকালের দারোগা কাহিনী' পড়ছি। দেড়শো বছর আগের বই। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত। উনিশ শতকের এক দারোগার অভিজ্ঞতার বয়ান। লেখক গিরিশচন্দ্র বসু (১৮২৪-১৮৯৮) পুলিশে চাকরী করতেন। চোর ডাকাতের উৎপাত সম্পর্কে তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা। তিনি বইটি জুড়ে বিস্তর বর্ণনা দিয়েছেন। বইয়ের ঘটনাকাল ১৮৫৩ থেকে শুরু হলেও আরো পূর্ববর্তী ঘটনার আলোচনাও এসেছে। তার মধ্যে এক দুর্ধর্ষ চোরকে নিধন করা সংক্রান্ত একটা ঘটনা আছে। আশাশুনী নামের এক চোরের উৎপাতে সমস্ত কালনা, গুপ্তিপুর, শান্তিপুর, রানাঘাট এবং উলা গ্রামের অধিবাসীরা তটস্থ জীবনযাপন করছিল। চোর খুবই চালাক। সিঁদকাঠিতে তার পারদর্শীতা ভুভারতে ছিল না। সে রাতে এমনকি জীবন্ত মানুষকে যাদুবলে ঘুম পাড়িয়ে সিঁদকেটে সর্বস্ব নিয়ে যেতো। একবার জনৈক মুস্তৌফি সাহেবের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে সে ধরা পড়লো বাড়িতে নিয়োজিত পেশাদার ভাড়াটে দেশীয় পাহারাদার দলের হাতে। ধরা পড়ার পর মুস্তৌফি সাহেব তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করার জন্য বলাতে পাহারাদারেরা রাজী হলো না। তারা নিজ হাতে আশাশুনীকে শায়েস্তা করতে চায়। বাকীটা বই থেকে পড়ুন-
''আমরা তা কখনো করতে দিব না। ব্যাটার ভয়ে আমরা রাত্রিতে নিদ্রা যাইতে পারি না এবং সমস্ত দেশের লোক ইহার ভয়ে শংকিত। হাকিমের কাছে পাঠাইলে চারি কি পাঁচ বছর কারারুদ্ধ থাকিয়া আশাশুনী ফিরিয়া আসিবে এবং পুনরায় সকলকে জ্বালাতন করিবে, অতএব তাহাকে আমরা বিশেষ শাস্তি দিব যে সে আর কখনও চুরি না করিতে পারে। আপনারা ঘরে যাউন আমরা যাহা জানি তাহা করিব।"
এই বলিয়া আশাশুনীকে মণ্ডপঘরের সম্মুখস্থিত যূপকাষ্ঠে ফেলিয়া সন্ধিপূজার ছাগলের ন্যায় প্রহরীরা তাহাকে বলি দিয়া সেই রাত্রিতেই তাহার দেহ জ্বালাইয়া ভস্ম করিয়া ফেলিল। এখন অনেকে এই বৃত্তান্ত শুনিয়া শিহরিয়া উঠিতে পারেন। কিন্তু ধীরভাবে তৎসাময়িক দেশের অবস্থা সমালোচনা করিয়া দেখিলে, প্রহরীদিগের এই নৃশংস কার্য্য নিতান্ত অযুক্তিযুক্ত বলিয়া বোধ করিবেন না। প্রহরীরা কেবল তাহাদের নিজ শত্রু দূর করিয়াছিল এমন নহে, সাধারণের শত্রুও বিনাশ করিয়াছিল।
''আমরা তা কখনো করতে দিব না। ব্যাটার ভয়ে আমরা রাত্রিতে নিদ্রা যাইতে পারি না এবং সমস্ত দেশের লোক ইহার ভয়ে শংকিত। হাকিমের কাছে পাঠাইলে চারি কি পাঁচ বছর কারারুদ্ধ থাকিয়া আশাশুনী ফিরিয়া আসিবে এবং পুনরায় সকলকে জ্বালাতন করিবে, অতএব তাহাকে আমরা বিশেষ শাস্তি দিব যে সে আর কখনও চুরি না করিতে পারে। আপনারা ঘরে যাউন আমরা যাহা জানি তাহা করিব।"
এই বলিয়া আশাশুনীকে মণ্ডপঘরের সম্মুখস্থিত যূপকাষ্ঠে ফেলিয়া সন্ধিপূজার ছাগলের ন্যায় প্রহরীরা তাহাকে বলি দিয়া সেই রাত্রিতেই তাহার দেহ জ্বালাইয়া ভস্ম করিয়া ফেলিল। এখন অনেকে এই বৃত্তান্ত শুনিয়া শিহরিয়া উঠিতে পারেন। কিন্তু ধীরভাবে তৎসাময়িক দেশের অবস্থা সমালোচনা করিয়া দেখিলে, প্রহরীদিগের এই নৃশংস কার্য্য নিতান্ত অযুক্তিযুক্ত বলিয়া বোধ করিবেন না। প্রহরীরা কেবল তাহাদের নিজ শত্রু দূর করিয়াছিল এমন নহে, সাধারণের শত্রুও বিনাশ করিয়াছিল।
এইটুকু পড়ে মনে হলো ক্রসফায়ারের সূচনা সেই বৃটিশ যুগেই হয়েছিল এবং এটা চালু করেছিল সাধারণ মানুষ। ক্রসফায়ার বা বিনা বিচারে হত্যা কতটা অমানবিক সেই আলোচনা অনেক তর্ক সাপেক্ষ। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকারের গুষ্টি কিলিয়ে ক্রসফায়ার করা দরকার হয়। বিশেষতঃ যেসব সন্ত্রাসী জামিনে মুক্তি পেয়ে আরো বেশী অপরাধ করে, জেলখানায় থেকেও অপরাধ ছড়ায়, তাদের জন্য ক্রসফায়ার ছাড়া আর কোন ভালো বিকল্প নেই। সম্প্রতি ক্রসফায়ারের বদলে চালু হয়েছে বন্দুক যুদ্ধ। সন্ত্রাসী ধরে তাদের অস্ত্রের ভাণ্ডার খুঁজতে যাবার পথে তার সহযোগীরা তাকে ছিনিয়ে নেবার জন্য চেষ্টা করে। দুপক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলিতে সে নিহত হবে। দুয়েকজন পুলিশ সদস্য সামান্য আহত হতে পারে।
আমাদের এলাকায় তাইজ্জা নামের এক সন্ত্রাসী ছিল। নামী সন্ত্রাসী না। তাকে বলা হতো পেতি মাস্তান বা বিলের মাস্তান। পেতি হলেও সে ছিল এলাকার মূর্তিমান আতংক। আতংক সৃষ্টির একটা জীবন্ত আর্ট তার চেহারা সুরত আচার আচরণ। আমাদের এলাকাটা তখন বিশাল বিল। টুকরো টুকরো বাড়ি উঠছে একেকটা দ্বীপের মতো। নতুন কেউ বাড়ি করতে আসলে তাইজ্জা এসে হাজির হবে। সে প্রচলিত কায়দায় চাঁদাবাজী করতো না। ধরা যাক বাড়ি করার জন্য কেউ ইট বালি ইত্যাদি এনে রাখলো। সে সন্ধ্যার সময় সহযোগীদের নিয়ে হাজির হবে, হাজির হয়ে প্রথমে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে জায়গার মালিকের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে। তার অনুমতি ছাড়া কোন সাহসে এই রাস্তা দিয়ে ট্রাক ঢুকলো, কোন সাহসে ইট নামালো সে জিজ্ঞাসার করবে গালিগালাজের সাথে সাথে। তখন ওই জায়গায় পাহারাদার কেয়ারটেকার বেরিয়ে আসবে ভীত চেহারায়। তার কলার ধরে দুটো চড় থাপড় দেয়া হবে। পাশাপাশি অন্য সহযোগীরা ইট বালি এসব ছুড়ে ফেলবে এদিক সেদিক। কেয়ারটেকারের ঘর থাকলে সেটার উপরও হামলা করা হবে।
তারপর বলবে এইখানে বাড়ি করতে হলে তাদের সাথে লাইনে আসতে হবে। নইলে কাজ বন্ধ। যদি মিস্ত্রী ওখানে কাজ করতে থাকে, তাদেরকে ধাওয়া দিয়ে এলাকা পার করে দেয়া হবে। দুতিনদিন কাজ বন্ধ থাকবে। নিরীহ ভূমির মালিক দুদিন ঘুরে কাউকে দিয়ে মধ্যস্ততা করাবে। মধ্যস্ততা হলো, এই নির্মানকাজের সমস্ত ইট বালির সাপ্লাই ওকে দিতে হবে। সাথে পাহারাদারের দায়িত্বটাও। চোরের হাতে পাহারাদারের দায়িত্ব দেবার কাজটা না করে কারো উপায় ছিল না। যে কোন নতুন বাড়ি তুলতে গেলে একই দৃশ্য দেখতাম আমরা। এই বিরান ভূমিতে একাকী কোন মালিকের সাহস নেই তার সাথে লড়ার।
দুয়েকজন বীরত্ব দেখাতে পুলিশের কাছে নালিশ করেছিল। পুলিশ ওদের হাতে আগেই সাইজ হয়ে আছে নির্দিষ্ট লেনদেনে। তবু কেউ পুলিশকে টাকা দিয়ে আসলে পুলিশ এসে ঘুরে যেত এক বেলা। পুলিশ চলে যাবার পর ওই মালিকের উপর শুরু হয় দ্বিগুন অত্যাচার। হয়তো তৈরী করা একটা দেয়াল রাতে এসে শাবল মেরে গুড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। আরেকদিন রডের বাণ্ডিল তুলে নিয়ে গেল। এরকম নানান উৎপাত শুরু হয়ে যাবে। অতএব বাড়ির মালিকরা কেউ ঝামেলায় না গিয়ে চোরের হাতে বাড়ি পাহারার দায়িত্ব দিয়ে তারা সরে থাকতো।
ওসব নির্মানাধীন খালি বাড়িতে রাতের বেলা বসতো মদ মেয়েমানুষের আসর। কিন্তু কেউ টুঁ শব্দ করার সাহস পেতো না। আমার তখন খুব ইচ্ছে হতো যদি ক্রসফায়ারের মতো কোন ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে তাইজ্জাকে সেই নরকে পাঠাতাম আমি।
জীবনে অনেক জঘন্য মানুষের মুখ দর্শন করেছি, কিন্তু তাইজ্জার মতো কুৎসিত আর একটিও দেখি নাই। চেহারা, কথা, ভাষা, আচার আচরণ সবকিছুর মধ্যে চরম অথবা চরমতম অশ্লীলতা। আমি এখন জানিনা তাইজ্জার শেষ পরিণতি, অথবা এখন কেমন আছে। ওই এলাকা ছেড়ে এসেছি অনেকদিন আগে। তবু আজো মনে হয় তাইজ্জার মতো এই জঘন্য কীটগুলোকে ক্রসফায়ারে দেয়া ছাড়া আর কি করার আছে? তারপরও কি এসবের জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো কাঁদবে?
তারপর বলবে এইখানে বাড়ি করতে হলে তাদের সাথে লাইনে আসতে হবে। নইলে কাজ বন্ধ। যদি মিস্ত্রী ওখানে কাজ করতে থাকে, তাদেরকে ধাওয়া দিয়ে এলাকা পার করে দেয়া হবে। দুতিনদিন কাজ বন্ধ থাকবে। নিরীহ ভূমির মালিক দুদিন ঘুরে কাউকে দিয়ে মধ্যস্ততা করাবে। মধ্যস্ততা হলো, এই নির্মানকাজের সমস্ত ইট বালির সাপ্লাই ওকে দিতে হবে। সাথে পাহারাদারের দায়িত্বটাও। চোরের হাতে পাহারাদারের দায়িত্ব দেবার কাজটা না করে কারো উপায় ছিল না। যে কোন নতুন বাড়ি তুলতে গেলে একই দৃশ্য দেখতাম আমরা। এই বিরান ভূমিতে একাকী কোন মালিকের সাহস নেই তার সাথে লড়ার।
দুয়েকজন বীরত্ব দেখাতে পুলিশের কাছে নালিশ করেছিল। পুলিশ ওদের হাতে আগেই সাইজ হয়ে আছে নির্দিষ্ট লেনদেনে। তবু কেউ পুলিশকে টাকা দিয়ে আসলে পুলিশ এসে ঘুরে যেত এক বেলা। পুলিশ চলে যাবার পর ওই মালিকের উপর শুরু হয় দ্বিগুন অত্যাচার। হয়তো তৈরী করা একটা দেয়াল রাতে এসে শাবল মেরে গুড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। আরেকদিন রডের বাণ্ডিল তুলে নিয়ে গেল। এরকম নানান উৎপাত শুরু হয়ে যাবে। অতএব বাড়ির মালিকরা কেউ ঝামেলায় না গিয়ে চোরের হাতে বাড়ি পাহারার দায়িত্ব দিয়ে তারা সরে থাকতো।
ওসব নির্মানাধীন খালি বাড়িতে রাতের বেলা বসতো মদ মেয়েমানুষের আসর। কিন্তু কেউ টুঁ শব্দ করার সাহস পেতো না। আমার তখন খুব ইচ্ছে হতো যদি ক্রসফায়ারের মতো কোন ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে তাইজ্জাকে সেই নরকে পাঠাতাম আমি।
জীবনে অনেক জঘন্য মানুষের মুখ দর্শন করেছি, কিন্তু তাইজ্জার মতো কুৎসিত আর একটিও দেখি নাই। চেহারা, কথা, ভাষা, আচার আচরণ সবকিছুর মধ্যে চরম অথবা চরমতম অশ্লীলতা। আমি এখন জানিনা তাইজ্জার শেষ পরিণতি, অথবা এখন কেমন আছে। ওই এলাকা ছেড়ে এসেছি অনেকদিন আগে। তবু আজো মনে হয় তাইজ্জার মতো এই জঘন্য কীটগুলোকে ক্রসফায়ারে দেয়া ছাড়া আর কি করার আছে? তারপরও কি এসবের জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো কাঁদবে?
No comments:
Post a Comment