Monday, February 10, 2014

শহর সভ্যতা ছেড়ে পালিয়ে : সেন্টমার্টিন পর্ব

শেষমেষ টিকলো ৫ জন। শেষ মুহুর্তে বাদ গেল ২ জন। ৫ জনই কম কি। এরকম ট্রিপে ৫ জন সংসারী মানুষ সংসার পেছনে রেখে ব্যাচেলর হয়ে সমুদ্রযাত্রা করবে বাঙালীদের কাছে এটাই যেন দুঃসাহসের কাজ। কেননা বাঙালী স্ত্রী ধর্মে স্বামীকে কোথাও একা যেতে দেবার নিয়ম নেই, একা যেতে দিলেও যাবার আগে একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলে যাত্রার আবেশ নস্যাত করে দিতে হবে। স্ত্রী মাত্রেই সেই দায়িত্বটা কানায় কানায় পূর্ণ করার চেষ্টা করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- যেতে নাহি দেবো। তারপর- আমারেও লইয়া চলো। এই পর্যায়ে স্বামীদেবতা রাজনীতির আশ্রয় গ্রহন করে বলে- ইহা অত্যন্ত দুর্গম রাস্তা, বিপদসংকুল অন্ধকার যাত্রা। এই পথ তোমাদের জন্য নহে। তোমাদের জন্য আছে অদূর ভবিষ্যতের উজ্জ্বল যাত্রা। মসৃন সেই পথে আমরা সংসার সহযোগে আনন্দ ভ্রমণ করিব। রাজনীতিতে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করাই নিয়ম, সুতরাং পথের বাধা অপসারিত।
                                                
                                                   সমান্তরাল যাত্রায় টেকনাফ সেন্টমার্টিন রুটে আরেকটি জাহাজ


রাত একটায় বাস ছাড়লো সিনেমা প্যালেস থেকে। বাসটা যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বহুগুন বেশী আরাম দায়ক। নরোম গদিতে ডুবে বসামাত্র ঘুম ঘুম পেয়ে গেল। বাসে ওঠার আগে একটু লাল চা খেয়েছিলাম ফুটপাতের টং দোকান থেকে। সেই সাথে পান তামুক সেরে টিশার্ট গায়ে সিটের আরামে ডুবে চোখ বন্ধ করলাম। মোবাইল ফোনটার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এটা খানিক পর বাজবে কি? প্রত্যেক যাত্রায় বাজে। ভাবনাহীন সুখে চোখ বন্ধ হয়ে এল। স্বাধীনতার মতো সুখ আর কি আছে জগতে।


পথে বাস থামবে না। শুধু টেকনাফ লিংক রোডে গিয়ে পাঁচ মিনিটের প্রকৃতি বিরতি। তখন ভোর চারটা। নীচে নামতেই কনকনে শীত এখানে জানান দিল ইহা মাঘমাস, শহরে যার প্রবেশ নেই। আবার তাড়াতাড়ি বাসে উঠে মোটা জ্যাকেটের তলায় আশ্রয় গ্রহন। নাফ নদীর তীরে যখন পৌঁছুলো বাস তখন ঘড়িতে ছয়টা। কেয়ারী সিন্দবাদের ঘাটের আশ্রয় কেন্দ্রে বোচকাবুচকি রেখে সবাই শিল্প সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কাটিয়ে দিলাম ঘন্টা তিনেক। মাঝখানে ডিমের অমলেট, পরোটা, চা ইত্যাদি সহযোগে প্রকৃতির শোভা অনুভব করতে করতে প্রাতঃরাশ। এদিকে পাহাড়, ওদিকে নদী, অপূর্ব সেই শোভা। কুয়াশার চাদরে মোড়া পাহাড়গুলো যেন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। এই পথে আমার চতুর্থ যাত্রা, তবু মুগ্ধতা প্রায় নতুনের মতো।



পাখীদের পাহারায় নাফ নদী পার

এই জাহাজে প্রথম যাচ্ছি। আগের চেয়ে এটা সুন্দর। আসনগুলো আরামদায়ক। সমুদ্রে চোখ রাখার সুবিধা বেশী। চারপাশে শুধু খোলা রেলিং। জাহাজের পাশে পাশে উড়ছে গাঙচিল। আমাদের মোহনা পর্যন্ত এগিয়ে দিল গাঙচিলের দল। যাত্রীরা আপ্যায়িত করলো চিপসের প্যাকেট খুলে ছুঁড়তে ছুঁড়তে। এই দৃশ্য আগে দেখিনি। বাংলাদেশের চিপসের ভোক্তা এই পাখির দল। উৎসাহের আতিশয্যে বন্ধু দশ প্যাকেট কিনলো। কিন্তু অর্ধেক শেষ হবার আগেই পাখির যাত্রা শেষ। বাকীগুলো মনুষ্য ভোজনে গেল। আরেকজন কফির গেলাস নিয়ে এল। এই জাহাজের ইসপেশাল কফি। ভাতের ফেনের সাথে কফি ফ্লেভার হলেও দামটা বাইরের দ্বিগুন। সম্ভবতঃ একটা মিনিপ্যাক দিয়ে ৪ কাপ বানানো হয়েছে। লাভ আটগুন। ইচ্ছা হলো এখানে কফির দোকান দিয়ে বছর শেষে কোটিপতি বনে যাই।


                                         
                                         সেন্টমার্টিনের কাছের সমুদ্রের এই স্বচ্ছ লোনা জল মুগ্ধকর

পান্না সবুজ জল দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। এই পথের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ক্যামেরা আনিনি। মোবাইলটা বের করে দু চারটা ক্লিক করলাম ছবি আর ভিডিওতে। ভিডিওতে চার্জ খেয়ে ফেলে দ্রুত। দু মিনিটের বেশী করলাম না ভিডিও দৈর্ঘ্য। তিন ঘন্টা পেরিয়ে যাবার পর জাহাজ ঘাটে ভিড়লো। দূর থেকেই বুঝলাম এই সেন্টমার্টিন আর সেই সেন্টমার্টিন নাই। আর দশটি বাজারঘাটের চেহারায় পরিণত হয়েছে মুক্তোর দ্বীপটা। জাহাজ থেকে নেমে জেটি ব্রিজ দিয়ে দ্বীপে পা রাখতেই ঘিঞ্জি দোকান, লোকজনের ভিড়, হৈ হল্লা। যে মুগ্ধতা বিশ বছর আগে ছিল সে তো দূরের কথা, দশ বছর আগের মুগ্ধতাও এখন আর নেই। সারিসারি খাবার হোটেল থেকে ভাজা মাছের ভুরভুরে গন্ধ। শুটকির গন্ধ মৌ মৌ করছে রাস্তাময়। আমি যথারীতি খুঁজলাম আগে দেখা দোকানপাট হোটেল রেস্তোঁরা। কিছুই নেই আগের মতো। আগে যেখানে দুয়েকটা ভ্যান ছিল, এখন সেখানে ছয় সিটের রিকশা ভ্যান। আমাদের গন্তব্যের হোটেল কাছেই। স্বপ্ন বিলাসের বালি দেয়া প্রবেশ পথে ঢুকে গেলাম। হোটেল দেখেও হতাশ। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় না। আগের বার প্রাসাদ প্যারাডাইসের তুলনায় এটি নেহায়েত মেস ঘর। এটাচ বাথ আছে। কিন্তু রুমে তেমন ফার্নিচার নেই। বিরক্তই লাগলো। এত ছোট ঘর। দুটো বিছানাতেই ঘর ভর্তি। তবু উপায় কি না দেখেই হোটেল বুকিং দিয়েছে বন্ধু।

দুপুরে খেলাম পাখি মাছের ফ্রাই, বেগুন ভর্তা আর ডাল। খেয়ে হোটেলের সামনে গাছের ছায়া বিছানো চেয়ারে আয়েশ করে বসতেই চলে এল তরমুজের ফালি। ঠাণ্ডা তরমুজে গলে গেল সমস্ত বিরক্তি গলে গিয়ে ভালো লাগা ভর করতে শুরু করলো। তরমুজ শেষ হতে গেলাস ভর্তি চা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাতাসে সুখের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে মনে হলো এতক্ষণে, জীবনটা নেহায়েত খারাপ নয়। বাকীরাও ক্রমে দার্শনিক হয়ে উঠলো সাময়িক ভাবালুতায়।


"সেন্টমার্টিন হলো একটা জেলে গ্রাম, যেটাকে জোর করে লোকজন টুরিষ্ট স্পট বানিয়ে ফেলেছে।"


"এত মানুষের ভিড়ে দ্বীপটা সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে"


"দ্বীপের প্রবেশপথে এতটা ঘিঞ্জি থাকা উচিত হয়নি"


"এখানে দোতলা বাড়ি তৈরী নিষিদ্ধ এখন। আগে যা হয়েছে হয়েছে। নতুন কিছু করা নিষেধ। আমি এই হোটেল দোতলা করার পর পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন এসে ভেঙ্গে দিয়েছে। কুড়াল মেরে আমার দরোজাগুলো ভেঙ্গে ফেলেছে। একেকটা ইটের পেছনে ষোল টাকা খরচ। নানান জায়গায় ম্যানেজ করে আনতে হয়েছে। পোষাচ্ছে না হোটেল বানিয়ে।"


"ইটের কিছু সরকারী দালান আছে। তাদের কি হবে? ইটের দালান না থাকলে ঝড়ের সময় মানুষ কোথায় আশ্রয় নেবে?"


"পুরো দ্বীপে টুরিষ্টদের জন্য কাঠের বাড়ি থাকাই ভালো হবে। তবে এরকম ঘিঞ্জি না। গোছানো। পরিকল্পিত।"


"দ্বীপের দূরবর্তী অংশে নির্জন কিছু কটেজ আছে সমুদ্রের পাড়ে। ওখানে থাকলে সবচেয়ে ভালো হতো। আগামীবার ওরকম কোন কটেজে উঠবো।"


"ওরকম কটেজ তোমার জন্য নয়। ওরকম কটেজ হলো কাপলদের জন্য, প্রেমিক প্রেমিকা যুগলের জন্য, নিরিবিলি হাত ধরে বসে থাকবে সমুদ্রের দিকে চেয়ে। তোমাদের মতো বুড়োদের জন্য এসব ভেতরের কটেজই যথেষ্ট ভালো যেখানে খানাপিনা হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। যুগলদের জন্য খাওয়াদাওয়া না হলেই চলে। ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে দুয়েকবেলা না খেয়ে কাটাতে পারবে।"


"আমি যদি আগামী জন্মে প্রেম করার সুযোগ পাই তাহলে প্রেমিকাকে পটিয়ে বিয়ের আগে এখানে নিয়ে আসবো। এই দৃশ্য বিয়ের আগে উপভোগ করতে হয়। বিয়ে পর সবকিছু ধেন্দা মেরে যায়।"


"তোমার বউ এই কথা জানে? আমি কি ফোন করে জানান দেবো ধেন্দা মেরে যাবার কথাটা?"


"আরে না না, ওকে বলছি নাকি। অন্য লোকের বউকে বলেছি। আমার বউ এখনো রোমান্টিক। এখনো যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করে আমাকে।"


"এখানে আসলে সব কটা ব্যর্থ প্রেমিক। তুই ফেল মারলি কলেজে, মারারই কথা, অত ছোট বয়সে কেউ বিয়ের কথা ভাবে। তুই বললি প্রেমের কথা, মেয়েটা বললো, বিয়ের কথা। পালিয়ে চলে আসলি।"


"আসলে এভাবে অনেক হৃদয় খানখান হয়ে যায় প্রেমের অভাবে। এই দেখ না, আমার যখন বয়স ছিল তখন কোন মেয়ে পাত্তা দেয়নি। আর বিয়ে করার পর থেকে মেয়েরা বুঝতে পেরেছে আমার হৃদয় বলে কিছু একটা আছে। কিন্তু উপায় কি।"


"কি রে ভালোই তো শিল্পের সেবা করে আসলি। এত মানুষ থাকতে ছবি তোলার জন্য তোকে বেছে নিল মেয়েটা। তোর মাথার হ্যাট দেখে মনে হয় বুঝতে পারছিল এই লোকটা হৃদয়বান।"

"সে তো বুঝতে পারলোই। কিন্তু জেনারেশান গ্যাপটা টের পেলাম যখন মেয়েটা কাছে এসে বললো, আংকেল আমার একটা ছবি তুলে দেবেন?"


কোন বাক্য কে বলেছে মনে নেই। আসলে বলেছে নাকি স্মৃতি থেকে বানিয়ে লিখেছি। তবে শেষ বাক্যটা একদম হুবহু মনে আছে।  এখানে হোটেলের মালিক থেকে শুরু করে বন্ধুদের সবার বক্তব্য এসেছে।

আরো কিছুক্ষণ বসে আড্ডা হলো। রোদ নেমে যাচ্ছে নারকেল গাছের পাতা বেয়ে। আমাদের বসে থাকার উপায় নেই। উঠতে হবে উঠতে হবে এবার।


                                            বিকেলের সৈকতে ডাবের পসরা নিয়ে বসে আছে

বিকেলে বেরুলাম সমুদ্র দেখতে। পড়ন্ত বেলার সমুদ্র খুবই মনোরম। সমুদ্রের তীরে রাশি রাশি নারিকেল গাছ। প্রথমে ডাবের পানি খাওয়া হলো। সৈকতে ডাব নিয়ে বসেছে এক দুটো ছেলে। সৈকতে যে কোন দোকান আমার অপছন্দ। সৈকতকে দুষিত করে। তবু বলতে পারলাম না  ডাব খাবো না। বরং বন্ধুদের ডাকে সাড়া দিয়ে  ডাব খেলাম তারিয়ে তারিয়ে, এমনকি ভেতরে ডাবের নরোম শাসও। মানুষ মাত্রেই স্ববিরোধী না?




                                                        সৈকতের নারকেল গাছের সারি

হাঁটতে হাঁটতে গল্প চলছে। চলছে ভাবনাও। অন্ধকার হবার পথে ভাবনার জোর বাড়ে। কোন কোন ভাবনা একেবারে অর্থহীন। কোন কোন ভাবনার হয়তো দিকরেখা আছে। দিকভ্রান্ত ভাবনাগুলো নিয়েই বেশী সময় কাটে। অমীমাংসিত ভাবনাগুলোর অধিকাংশ জুড়েই থাকে মানুষ। এই পৃথিবীর মানুষেরা সহজ জটিল সকল অবয়বে তৈরী। একই মানুষের ভেতর মানবিকতা অমানবিকতা পশুতা সব রূপই আছে। মানুষ ইচ্ছে করলে ভালো হতে পারে, মন্দ হতে পারে।




                                                      পশ্চিম সৈকতে উল্টানো নৌকা

মানুষের সবচেয়ে বড় প্রভাবক অন্য আরেক মানুষ। অনেক সময় মানুষ নিজস্ব বলয় ছেড়ে অন্য মানুষের পথে হাঁটতে শুরু করে। যে পথে তার হাঁটার কথা ছিল না সেই পথে হাঁটে। যা করার ছিল না তাই করে বসে। যেখানে যাবার কথা ছিল না সেখানে চলে যায়। আবার এই মানুষও কখনো কখনো একাকীত্বের সন্ধান করে। আমরা সভ্যতা ছেড়ে দূরে থাকতে চাই মাঝে মাঝে। সেও এই একাকীত্বের লোভে। একাকীত্বের মতো কষ্ট আর কি আছে তবু কিছু কিছু সময় মানুষ একা থাকতে চায়। ভিড় যখন তাকে যন্ত্রণা দেয়, সংসার যখন তাকে পিষ্ট করে, সম্পর্ক যখন পোড়ায়, তখন সে কোলাহল ছেড়ে একা হয়ে যেতে চায়। এই দ্বীপের সাথে এসব ভাবনার কোন সম্পর্কই নেই। তবু ভাবনার জগতের কোন নিয়মনীতি নেই। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনিয়ে আসলো যখন সূর্য পাটে বসলো। 



সকালের দুটি দৃশ্য খালি চোখে বারবার দেখতে ইচ্ছে করছিল বলে ছোট্ট করে ভিডিও ক্যাপচার করা হলো মোবাইল টিপে। 

গাঙচিল 

জলের রেখা




[প্রথম বিকেল সমাপ্ত]


পাদটীকা: যে বন্ধুটি কখনো এই দ্বীপে পা রাখেনি তার জন্যই পোষ্টটি লেখা





No comments: