তোমার যেখানে সাধ চলে যাও, আমি রয়ে যাবো এই বাংলার পারে। কথাটা আসল না। আসল কথা আমি বাধ্য হয়ে থাকছি। তুমি বাধ্য হয়ে চলে গেছো। আমি ভালো আছি বলে ভাণ করছি যাতে আমি দুঃখ পেলে তোমারও দুঃখী হতে না হয়। আমরা সবাই ভাণ করছি। ভালো থাকার ভাণ। সবকিছু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার ভাণ।
ভাণ করে থাকাটা একটা নীরব মানসিক কষ্ট যা কেবল ভুক্তভোগীই জানে। ভাণ করে থাকা আমার তীব্র অপছন্দ হলেও মাঝে মাঝে পরিস্থিতি বাধ্য করে ভদ্রসমাজে ভাণ করতে। যেমন কোন জ্ঞানী সমাজে মূর্খদের ভাণ করতে হয় আমিও অনেক জানি। আমি তাই জ্ঞানী সমাজ এড়িয়ে থাকি। পারতপক্ষে তাদের সাথে মেলামেশা করি না। যদি কোন জ্ঞানী সমাজে আমাকে যেতেই হয় তখন গোমড়ামুখে চুপ করে বসে থাকি এবং জ্ঞানের আলোচনা শুনে মাথা ধরাই। চুপ করে প্রমাণ করি আমিও জ্ঞানী, কারণ আমি জানি জ্ঞানীলোক মাত্রেই ভরা কলসি, আর ভরা কলসি যে কম বাজবে সে জানা কথাই।
আবার জ্ঞানী সমাজে আমি যতটা নীরব, মূর্খ সমাজে ততটাই সরব। আমি তাই মূর্খদের সাথে আড্ডা দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। মূর্খে মূর্খে মুখাকাকর। আমি সবচেয়ে সতর্ক থাকি বইয়ের দোকানে গেলে। আশি নব্বই দশকে কারেন্ট বুক সেন্টার ছিল চট্টগ্রামে বই কেনার সবচেয়ে ভালো জায়গা। এখানে দুনিয়ার জ্ঞানী আঁতেল লোকজন ভর্তি থাকতো তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে দেখতাম দোকানের টুলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি ভুলেও তাদের কোন আলোচনায় ঢুকতাম না। চুপচাপ বই দেখতে থাকতাম আলোচনা উপেক্ষা করে।
আমি ওখানে সেবা প্রকাশনীর সস্তা বই কিংবা প্রাক স্বাধীনতা আমলের সস্তা পোকায় খাওয়া বই অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকতাম। আমি কখনোই নতুন বইয়ের দিকে তাকাতাম না। ভুলেও না। নতুন কোন বই আসলে সেটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে পয়সা লাগে না। কিন্তু আমার কাছে নতুন বই হাতে নেয়াটাও কেমন অসহ্য লাগতো। সদ্য প্রকাশিত বই না কেনার অভ্যেসটা এখনো রয়ে গেছে আমার। তখন দেখতাম না আর্থিক সমস্যার কারণে, এখন দেখি না দীর্ঘ অনভ্যস্ততার কারণে।
কারেন্ট বুকের মালিকের সাথে খাতির থাকার সুবাদে নতুন বই আসলে খোঁজ খবর পেয়ে যেতাম। সদাহাস্যময় শাহীন ভাইকে খুব পছন্দ করতাম। যখনই যেতাম আড্ডা দিতাম খানিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই। এখন ওদিকের পথ ভুলে গেছি তেমন না। কিন্তু অনেকদিন ওদিকে যাওয়া হয় না। মাঝে মাঝে নিউমার্কেটের পাশ দিয়ে যাবার সময় খুঁজি দোকানটা আছে তো? তখন চোখে পড়ে আস্তে আস্তে কারেন্ট বুক সেন্টারকে গ্রাস করছে আশেপাশের জঞ্জাল। ফুটপাতের দোকানগুলো চারপাশ থেকে অন্ধকার করে ফেলে প্রবেশ পথটাকে। দোকানে ঢোকার মতো জায়গা রাখেনি হকারের দল। ভদ্রলোকের চলাচলের অযোগ্য হয়ে আছে দোকানের সামনের জায়গাটা।
আমার কষ্ট হতে থাকে একটা মননশীল বইয়ের দোকান এভাবে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে দেখে। আগে যারা ওখানে ভিড় করতো তারা এখন নতুন জায়গায় চলে গেছে। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বিশৃংখল জায়গায় পরিণত হওয়া জলসা চত্বর আর বইয়ের কেন্দ্র থাকতে পারেনি। আমার কারেন্ট বুক জীবন শেষ হয়ে গেছে ২০০৫ সালের আগেই।
কারেন্ট বুক সেন্টারের যুগ পার হবার পর আসলো বিশদ বাঙলার যুগ। বিশদ বাঙলার যুগে প্রবেশ করি ২০০৬ সালের দিকে। মেহেদীবাগে বই কেনার নতুন একটা স্বস্তিদায়ক জায়গা পেয়ে আমোদিত। নিজের ঘরের লাইব্রেরীর মতো ঘুরে ফিরে বই নির্বাচন করি। ইতিমধ্যে আমরাও বাসা বদলে চলে আসি কাছাকাছি এলাকায়। বাসার কাছে হওয়াতে হেঁটে হেঁটেও চলে যাই বিশদ বাঙলায়। শুধু বই নয় আরো অনেক কিছুই আছে বিশদ বাঙলায়। চট্টগ্রামে প্রথম এই দোকানেই বসে বসে বই পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। কোন তাড়া না থাকলে, হাতে নগদ সময় থাকলে আমি বিশদ বাঙলায় ঢুকে পড়তাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় বইপত্র খুঁজে আরাম ছিল।
কয়েক বছর পর বিশদ বাঙলার জৌলুশও পড়তে শুরু করে। কেন জানি না। আগের মতো বইপত্র পাই না। বই দেখার সময় শীতল পরশ নেই। গরমে ঘামতে ঘামতে বই দেখতে অস্বস্তি হয়। পাশের চা খানায় আগের মতো নাস্তাপানি থাকে না। এটাও একদিন গল্প হয়ে যাবে? সেটা মেনে নেয়া কষ্টকর হবে আমার জন্য। এই জায়গাটা আমার প্রিয় জায়গা ছিল।
বিশদ বাঙলার পর আমার যাতায়াত শুরু হয় বাতিঘরে। বাতিঘর চট্টগ্রামে বেশ কয়েক বছর ধরেই আছে। চেরাগী পাহাড়ের মোড়ে বাতিঘরকে কেন্দ্র করেই একটা সাহিত্য সাংস্কৃতিক আড্ডা বসে। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক আড্ডাখানা বলতে গেলে শিল্পকলা আর চেরাগী পাহাড়কে বোঝায়। কিন্তু সেই চেরাগী পাহাড়ের আড্ডায় আমার থাকা হয়নি কখনো। বয়সে একটু এগিয়ে গিয়েছি অথবা ওখানে ছোট ভাইবোনেরা আড্ডা দেয় ইত্যাদি কারণে হয়তো। তাছাড়া চেরাগীর বাতিঘর খুবই ছোট্ট সাইজের। বই দেখার স্বস্তিদায়ক পরিবেশ ছিল না। তার চেয়ে পাশের নন্দনেই আমার ভালো লাগতো।
একদিন সেই বাতিঘর উঠে এলো প্রেসক্লাবের এক তলায়। বিশাল একতলার পুরোটা জায়গা জুড়ে বাতিঘর। অসাধারণ ডিজাইন আর শিল্পকলায় বাংলাদেশের বই সুপার স্টোর হয়ে গেল বাতিঘর। এখন বাতিঘরই চট্টগ্রামের সবচেয়ে ভালো আর স্বস্তিদায়ক দোকান। এটাকে দোকান না বলে বইয়ের যাদুঘর বললে বরং সঠিক মূল্যায়ন হয়। এখানে আসার পর থেকেই বাতিঘরে যাতায়াত শুরু হয় আমার। এখন আমি বাতিঘরেই নিয়মিত যাই। বই কিনে দেউলিয়া হবার জন্য এত উৎকৃষ্ট জায়গা বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই।
বাহ। সিনেমা হল বারো ঘন্টা চলতে পারে কিন্তু লাইব্রেরীর অতদূর চলার সুযোগ নেই? পাঁচ ঘন্টায় যা নেবে নাও। ঢুকতে বারণ করলেও অবাধ্য হয়ে ঢুকলাম। বললাম একটু দেখে চলে যাবো। মলিন করুন অতি নোংরা কক্ষগুলোয় মৃতপ্রায় বইগুলো কোন মতে আবছা অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে ধুলোর আস্তর বুকে নিয়ে। কত বছর আগের বই? বিশ, পঞ্চাশ, আশি, একশো বছর? হ্যাঁ আশ্চর্য হলেও এই লাইব্রেরীতে শহরের সবচেয়ে প্রাচীন বইয়ের সংগ্রহশালা। বই এবং পত্রিকা সাময়িকীও। যে পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখতেন, যে পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু লিখতেন, যে পত্রিকায় জীবনানন্দ দাশ লিখতেন, সেই সব পত্রিকার সংগ্রহ ছিল। এখন অনেক কিছুই নেই। নিলাম ডেকে সব বিক্রি করে দেয়া হয়েছে হয়তো। শুধু মলিন নেমপ্লেটগুলো রাখা। সেখানে হাত দিয়ে পেলাম উর্দুভাষী পাকিস্তান আমলের কিছু পত্রিকা। আশ্চর্যজনকভাবে বাংলা সাহিত্যের সম্পদগুলো হারিয়ে গেলেও পাকিস্তানী তেলাপোকাগুলো টিকে গেছে, । আর দেখতে রুচি হলো না। বেরিয়ে এলাম লাইব্রেরী থেকে জাতির দুর্ভাগ্যকে গালি দিতে দিতে।
No comments:
Post a Comment