Wednesday, November 30, 2016

তিব্বত, দালাইলামা এবং একজন বাঙালী অতীশ দীপঙ্কর

১.
তিব্বত একটি দুর্গম এলাকা। এশিয়ার অন্যতম বিচ্ছিন্ন এলাকা। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রায় বিশ হাজার ফুট উঁচু দু্ই হাজার মাইল দীর্ঘ হিমালয় পর্বতমালা দ্বারা আলাদা করা। এতসব দুর্গম পর্বত, দুঃসহ আবহাওয়া, ক্ষেত খামারের জায়গা নেই, খনিজ সম্পদেরও কোন প্রাচুর্য নেই, তবু ঔপনিবেশিক কাল থেকে তিব্বতের প্রতি বড় বড় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহের কারণ কী? একের পর এক মিশন পাঠিয়ে তিব্বতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার এই চেষ্টা কেন? ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকা তিব্বতি লামাদের জোর করে দুনিয়ার ঝামেলার দিকে টানার কী দরকার ছিল?

তিব্বত নিয়ে পড়তে পড়তে ভাবনাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে।

তিব্বত তখনো একটি প্রচলিত রাষ্ট্র ছিল না। তিব্বতের শাসনকাজ চলে ধর্মগুরুর হাতে। তিব্বত হাজার বছর ধরে নিজের পথে চলছে। তিব্বত কখনো স্বাধীন ছিল না, আবার পরাধীনও নয়। তিব্বত বরাবরই চীনের হাতে। সেই তিনশো বছর আগের ইতিহাসেও তাই দেখি। কিন্তু আবার সেই চীন তিব্বতকে গিলেও স্বস্তিতে থাকেনি কখনো। তিব্বত তার পেটের মধ্যে আছে ঠিকই, কিন্তু সে কখনো সুখে ভাবতে পারছে না তিব্বত তার। দখল করলেই তাকে পাওয়া যায় না, তিব্বত তার অন্যতম একটা উদাহরণ।

দখল করেও না পাওয়ার অতৃপ্তির কারণেই তিব্বতের উপর চিরকাল নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে চীন সরকার। আসলে তিব্বত নিজেই নিজেকে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে রেখেছে হাজার বছর ধরে। সেই নিষেধের বেড়া তুলতে না পেরে মহাশক্তিমান চীন সেই বেড়ার উপর একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়ে বলেছে - আম্মো নিষেধ কইলাম!

২.
তিব্বতের প্রতি আমার কোন মোহ ছিল না। কিন্তু সমস্যা করেছে দুজন বাঙালী। বাঙালী কোথাও কিছু করেছে সেটা জানার পর আরেকজন বাঙালের কৌতুহল আকাশচুম্বী হয়। জাতপ্রেমের কারণে তিব্বত নিয়ে পড়ার আগ্রহ হলো। দুই বাঙালীর একজন শরতচন্দ্র দাশ, আরেকজন অতীশ দীপঙ্কর। শরতচন্দ্র দাশ নিয়ে লিখেছি কিছু, এবার অতীশ দীপঙ্করের কথা বলি।

যে তিব্বত আজ নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে নিজেদের আটকে রেখেছে শত শত বছর ধরে, সেই নিষেধাজ্ঞার জনক তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা বাহিনী। বর্তমান দালাই লামা ১৪তম। ১ম দালাই লামার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৩৯১ সালে। মনে হচ্ছে বহুকাল আগের কথা? হতেই পারে। চোদ্দশতক তো আজকের কথা নয়। কিন্তু তারও চারশো বছর আগে অতীশ দীপঙ্কর নামে এক বাঙালী বৌদ্ধ তিব্বতে গিয়েছিলেন। হয়তো গিয়েছিলেন তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের মশালকে আরেকটু উঁচুতে তুলে ধরতে। ধরেও ছিলেন। শুনে অবাক হতে পারেন সেই মশালই হাজার বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে তিব্বতের লামারা। যে দালাই লামারা চোদ্দ শতকে যাত্রা শুরু করে বৌদ্ধ ধর্মের একচ্ছত্র নেতা হয়েছেন, তাদের মাথার উপর ছাতা হয়ে এখনো রয়েছে একজন বাঙালী অতীশ দীপঙ্কর।

দালাই লামার যাত্রা শুরু সম্পর্কে উইকিতে লেখা আছে
The Book of Kadam, the main text of the Kadampa school, to which the First Dalai Lama, Gendun Drup, first belonged

যে বই এবং যে স্কুলের শিক্ষা দিয়ে দালাই লামার যাত্রা শুরু সেই দুটোই অতীশ দীপঙ্করের সৃষ্টি।

এমন বিখ্যাত একজন মানুষ সম্পর্কে আমাদের জানার পরিমান খুবই কম। তিনি তিব্বত গিয়েছিলেন এটা জানতাম কিন্তু তিব্বতে তিনি কী রোপন করে এসেছেন তা জানতাম না।

অতীশ দীপঙ্করের জন্ম ৯৮২ সালে বাংলাদেশে। ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাসস্থান এখনও 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে পরিচিত। এটা খুব আশ্চর্য যে তাঁর মতো এত বড় ধর্মগুরুকে নাস্তিক উপাধি পেতে হয়েছিল। কেন তা হয়েছিল তার প্রেক্ষাপট জানাও সম্ভব নয় এত শত বছর পর।

১২ বছর বয়সে ৫ম শতকে বিহার অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন এবং তখন থেকে তাঁর নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
This distinctive portrait of Atiśa originated from a Kadam monastery in Tibet and was gifted to the Metropolitan Museum of Art, New York in 1933 by The Kronos Collections. In this graphic depiction, Atiśa holds a long, thin palm-leaf manuscript with his left hand, which probably symbolizes one of the many important texts he wrote, and he makes the gesture of teaching with his right hand



তাঁর তিব্বত যাত্রা নিয়ে ছোট একটা অংশ পড়া যাক আনন্দবাজারের গৌতম চক্রবর্তীর বরাতে-

"১০৪০ খ্রিস্টাব্দের এক সকালে নাগসো, ভূমিসিংহ, ক্ষিতিগর্ভ প্রমুখ ১৯ জন শিষ্যকে নিয়ে বিক্রমশীল মহাবিহার রওনা থেকে রওনা হলেন মহাপণ্ডিত। সঙ্গে রয়েছেন আর এক শিষ্য বীর্যচন্দ্র। তিনি দীপঙ্করেরই ছোট ভাই। সংসারাশ্রমে তাঁর নাম ছিল শ্রীগর্ভ। আর দীপঙ্করের নাম ছিল চন্দ্রগর্ভ। মহাবিহার থেকে বেরিয়ে দীপঙ্কর ও তাঁর সঙ্গীরা গেলেন বুদ্ধগয়া। বোধিবৃক্ষের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে রওনা হলেন তাঁরা। সেখান থেকে আজকের চম্পারণ, রক্সৌল হয়ে নেপালের দিকে। নেপাল সীমান্তের কাছে ছোট্ট মিত্রবিহার। সেখানে কয়েক জন বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকেন। মিত্রবিহার থেকে ক্রমশ এগিয়ে চলা। মাঝপথে স্বয়ম্ভূনাথের রাজা তাঁর সেনাধ্যক্ষকে পাঠালেন এই দলটিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।

স্বয়ম্ভূনাথ থেকে পালপা। জ্বরে দীপঙ্করের সঙ্গী বীর্যসিংহর গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ রাজ্যে অদ্ভুত নিয়ম। পথে বীর্যসিংহের মৃত্যু হলে তাঁর সম্পত্তি যাবে সরাইখানার মালিকের হাতে। বীর্যসিংহ মারা গেলেন এক নদীর ধারে। রাতের অন্ধকারে তাঁকে দাহ করে, তাঁর ডুলিতে পোশাকআশাক সাজিয়ে চলল দলটি। দেখলে মনে হবে, বীর্যসিংহ বসে আছেন। পালপাতে সাদর আতিথ্য জানালেন রাজা অনন্তকীর্তি। নিজের 'দৃষ্ট ওষধি' নামের হাতিটি তাঁকে দান করলেন দীপঙ্কর। ওই হাতির পিঠে চেপেই বোধগয়ার বজ্রাসনীয় মহাবিহার থেকে তিনি এসেছেন এ রাজ্যে। অনন্তকীর্তিকে দিয়ে শুধু শপথ করিয়ে নিলেন, এ হাতিটিকে কখনও যুদ্ধের কাজে লাগানো যাবে না। অনন্তকীর্তি গুরুপদে বরণ করে নিলেন মহাপণ্ডিতকে। দীপঙ্করের নির্দেশেই 'থাম' অঞ্চলে তৈরি করালেন এক বৌদ্ধবিহার।

সেই 'থাম'ই আজকের থামেল। ডিস্কোথেক, ঝাঁ-চকচকে হোটেলে সজ্জিত কাঠমাণ্ডুর রঙিন এলাকা। পালপা জায়গাটা পোখরার অনতিদূরে তানসেন অঞ্চলে।

কিন্তু পালপায় এখনও শেষ হয়নি তাঁর কাজ। আর কয়েক দিন বাদে গৌড়বঙ্গের সিংহাসনে অভিষিক্ত হবেন তাঁর স্নেহধন্য ন্যায়পাল। এখান থেকেই পালবংশের নতুন রাজাকে চিঠি লিখলেন দীপঙ্কর, "রাজসিংহাসনে বসেও নম্র এবং বিনীত হবে।"

পালপা ছেড়ে এক দিন বেরিয়ে এলেন ভিক্ষু। এ বার আরও উত্তরে মুক্তিনাথের রাস্তা। সেই রাস্তা বেয়ে মানস সরোবর। সাত রাত সেখানে থাকলেন দীপঙ্কর। মানস সরোবরের পাশ দিয়ে নারি রাজ্যে যাওয়ার পথ। ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন বৃদ্ধ ভিক্ষু, কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে 'অতি ভাল। অতি মঙ্গল।' নারি আজ আর নেই। কিন্তু মানস সরোবরের পাশ দিয়ে যদি চিনের উইগুর অঞ্চলের কিছু আগে আসা যায়, 'গু জে' ধ্বংসাবশেষ। ওখানেই ছিল নারি রাজ্য। আজও সেখানে আছে থোলিং মহাবিহার। তিব্বতে প্রথম তিন বছর দীপঙ্কর সেখানেই ছিলেন।
"


৩.
শরতচন্দ্র দাশের খনন এখনো শেষ হয়নি আমার। তিব্বত অভিযানের ঔপনিবেশিক কুটনীতির সাথে মহাদেশীয় ভূরাজনৈতিক তত্ত্ব বোঝার চেষ্টাও অব্যাহত। মাঝপথে একটু অতীশ দীপঙ্কর ভ্রমণ হয়ে গেল। পড়তে পড়তে লাইনচ্যুত হয়ে পড়া পুরোনো অভ্যেস। বদভ্যাস হলেও তাতে নতুন কিছু আবিষ্কারের আনন্দ আছে। সেই কারণে হাওয়া বদলকে নিরুৎসাহিত করা হয়  না।

Monday, November 28, 2016

বাংলাদেশ কেন হজম হয়ে যায়নি

যোগ্য এবং শক্তিশালী নেতৃত্বের অভাবে আস্ত একটা দেশ, জাতি, রাষ্ট্র, তার অস্তিত্ব হারিয়ে আরেকটা দেশের পেটের মধ্যে হজম হয়ে যেতে পারে। বড় মাছ যেভাবে ছোট মাছকে গিলে ফেলে, একটা দেশ তেমনি আরেকটা দেশকে গিলে খেতে পারে। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী উদাহরণ আরাকান বার্মার পেটে, সিকিম ভারতের পেটে, তিব্বত চীনের পেটে হজম হয়ে গেছে।

বাংলাদেশও কারো না কারো পেটে হজম হয়ে যেতো যদি শেখ মুজিবের জন্ম না হতো। যারা মনে করেন যে 'কেউ একজন' থাকলেই দেশ এগিয়ে যায়, তাদের বুঝতে হবে 'যে কেউ একজন' জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে না। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্যারিশমা, সেই ব্যক্তিত্ব, সেই বিচক্ষণতা- গাছেও ধরে না, বাজারেও কিনতে পাওয়া যায় না।

বর্তমানে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে তাকিয়ে পুরোনো উপলব্ধিটা নতুন করে অনুভব করলাম। একসময় আরাকানও একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। এতটাই শক্তিশালী ছিল যে মহামতি মোগল সম্রাটদের একশো বছরের বেশী লেগেছে আরাকানকে সরিয়ে চট্টগ্রাম দখল করতে। সেই শক্তিশালী রাষ্ট্র আরাকান এখন মধ্যযুগের ইতিহাসের একটি অংশ মাত্র। সুতরাং 'নিজে যুদ্ধ না করে' স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া শেখ মুজিবের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েই থাকতে হবে আমাদের।

[হজম হয়ে যাওয়া প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির ইতিহাস পড়তে পড়তে চেনা উপলব্ধি নাড়া দিচ্ছে আবারো]

ইতিহাস আঁকা আছে যে ছবিতে

ইতিহাস যেখানে নুয়ে আছে
পাথরের দেয়ালে, অবসন্ন  মৃত্তিকার
চিত্রলেখায়, ধুয়ে যাওয়া সরোবরে
বিস্ময় অবকাশে ছায়া ভাসে কার?


The Sixth Panchen Lama Receives George Bogle at Tashilhunpo, oil painting by Tilly Kettle, c. 1775

ক্যাপশানেই ছবির তথ্য দেয়া আছে। তবে পেছনের ঘটনাগুলো একটু দীর্ঘ। দীর্ঘ গল্পটিকে সংক্ষেপে বলছি।

ছবিটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার নিদর্শন। ঘটনাটি ১৭৭৪ সালের। তিব্বতের শিগাৎসে শহরের (Shigatse বর্তমানে Xigazê নামে পরিচিত) তাশি লানপো মন্দিরে একটি সাদা রেশমি রুমাল বাড়িয়ে ধরে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, সেই ভদ্রলোকের নাম George Bogle. তিনি জাতিতে স্কটিশ, এসেছেন বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এর প্রতিনিধি হয়ে। আর যিনি আসনে বসে শ্রদ্ধা গ্রহন করছেন তিনি তিব্বতের ষষ্ঠ 'পানচেন লামা'। পানচেন লামা একটি পদবী, যেমন দালাই লামা। তিব্বতের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মগুরুর পদবী 'পানচেন লামা'। তিব্বতের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শিগাৎসের প্রধান মন্দির তাশিলানপো । 'পানচেন লামা' সেই মন্দিরের প্রধান। রাজধানী লাসার পোতালা প্রাসাদের প্রধান ধর্মগুরু দালাই লামার পরেই পানচেন লামার স্থান।

আরেকটু পেছনে যাই। সিরাজদৌলাকে হটিয়ে ইংরেজরা তখন বাংলার মসনদে বসেছে। তখনো পুরো ভারতবর্ষ তাদের কব্জায় আসেনি। ১৭৭৩ সাল। ওয়ারেন হেস্টিংস এর কাছে কুচবিহারের রাজা ভুটানের এক সেনাপতির কাছ থেকে আক্রমনের বিরুদ্ধে সাহায্যের আবেদন করলে হেস্টিংস শর্তের বিনিময়ে সাহায্য করতে সম্মত হলেন। ইংরেজ সাহায্য পেয়ে কুচবিহারের রাজা সেই সেনাপতিকে পরাজিত করেন। পরে ভুটানের পরাজিত সেনাপতি নিজেদের গৃহযুদ্ধেও হেরে গিয়ে তিব্বতে পলায়ন করলে তাশিলানপোর পানচেন লামা তাকে আটক করে জেলে পুরেন।

অতঃপর পানচেন লামা  হেস্টিংস এর কাছে বন্ধুতাপূর্ণ এক পত্র মারফত জানান ভুটানে এখন মিত্রশক্তি ক্ষমতায় বসেছে সুতরাং এই অঞ্চলে আর যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। হেস্টিংস এই সন্ধিপ্রস্তাবকে তিব্বতের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার একটু সুযোগ হিসেবে গ্রহন করার জন্য জর্জ বোগলকে পানচেন লামার দরবারে পাঠিয়েছিলেন যথাযথ উপঢৌকন সহকারে। তিব্বতের সাথে ইউরোপীয়দের বন্ধুতার সেই সুত্রটি একুশ শতকে এসেও উদাহরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

সেই অভিযানে জর্জ বোগলের লেখা বইটি (Narratives of the mission of George Bogle to Tibet, and of the journey of Thomas Manning to Lhasa" (1876) by Sir Clements Markham) থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আরো একশো বছর পরে শরতচন্দ্র দাশ তিব্বত অভিযানে গিয়েছিলেন ১৮৭৯ সালে। যখন ৭ম পানচেন লামা ক্ষমতায়, তাঁর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতেও সাহায্য করেছিল জর্জ বোগলের গড়ে দেয়া শতবর্ষ পূর্বের মিত্রতা।

ঐতিহাসিক ঘটনার এই পেইন্টিংটি বর্তমানে বৃটিশ রাজ পরিবারের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়(Royal Collection) রক্ষিত আছে।


Sunday, November 27, 2016

মেঘ ডাকছে ডাকুক, আমার কাছেই থাকুক....

তাঁর সম্পর্কে মৃণাল বসু চৌধুরী লিখেছিলেন - বাংলা কবিতার এই অনুপম বাতাবরণে, কখনও হেমন্তের অরণ্যের মধ্যে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে কখনও-বা উড়ন্ত সিংহাসনে বসে জ্বলন্ত রুমাল উড়িয়ে, ছন্দ অন্তর্জাল ছিঁড়তে ছিঁড়তে, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন কবিতামালা নিয়ে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন যে কবি, তাঁর নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নামের সাথে প্রথম যে কবিতার লাইনগুলো চোখে ভাসে তা হলো-

সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয় তখনই
পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্ণিশে কার্ণিশে,
ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার সময়, বাড়ির ভেতরে বাড়ি, পায়ের ভেতরে পা,
বুকের ভেতরে বুক
আর কিছু নয়।


আর আমরা যখন শক্তির কবিতা ছাড়িয়ে আরো কাছাকাছি গিয়ে তাঁকে ছুঁতে চাই, তখন তিনি বলে ওঠেন-
একটু নেমে দাঁড়াও, যদি আমার কাছে দাঁড়াতে হয়
একটু উঠে এসো, যদি আমার কাছে দাঁড়াতে হয়
দুখানি হাত বাড়াতে হয়, বাহিরে টান ছাড়াতে হয়,
একটু উঠে একটু নেমে আমার কাছে দাঁড়াতে হয়।

তারপর আমরা যখন আকাশে ভাসতে ভাসতে আরো উর্ধ্বমুখী হয়ে নিজেদের কোথাও হারিয়ে ফেলতে যাই তখন তিনি পিছুডাক দিয়ে বলেন-
সফলতা সব নয়, সে তো শুধু উলঙ্গের কাছে
প্রকৃত পোশাক পরে দেখা দেওয়া
কিংবা শুধু সমুদ্রের তীরে
পাহাড়ের গল্প বলে তিক্ত করা গল্পের আসর
মানুষের আগুপিছু, মানুষের জানার তো নয়!

তারপর অবলীলায় তিনি আমাদের স্বপ্ন পেরিয়ে নতুন অচেনা জগতের প্রতি আহবান করেন-
যদি কোনদিন যাই মেঘের ওপারে

তোমাকেও নেওয়া যেতে পারে ।
তারপরে, পথ নেই । ফুটে আছে ফুলের প্রদীপ
তুমি কি পোড়াবে কিছু, জ্বালিয়ে নেবে না সন্ধ্যাদীপ ?
আরও কিছুক্ষণ যেতে হবে
পথ বড়ো সঙ্কীর্ণ, কঠোর

তারই মধ্যে হাওয়া এলোমেলো -
বলে, শান্ত, কে এখানে এলো ?


এখানে এসে আমাকে থেমে যেতে হয়। আমি কোথায় যাবো? কোথাও যাবো কী? কে নেবে আমায়? তখন তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন-
মেঘ ডাকছে ডাকুক
আমার কাছেই থাকুক
ভালো থাকবো সুখো থাকবো
এই কামনা রাখুক।

ঠিক তাই। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সুরেও তিনি আমাদের জানাতে থাকেন-
ছোট্ট হয়েই আছে
আমার, না হয় তোমার, না হয় তাহার বুকের কাছে
দুঃখ নিবিড় একটি ফোঁটায় - দুঃখ চোখের জলে
দুঃখ থাকে ভিখারিনীর একমুঠি সম্বলে ।
ছোট্ট হয়েই আছে
একের, না হয় বহুর, না হয় ভিড়ের বুকের কাছে ।
একটি ঝিনুক তাকে
জন্ম থেকেই, একটু-আধটু, বাইরে ফেলে রাখে ।।


তারপর তাঁর মুখ থেকেই চলে যাবার আশংকা ধ্বনিত হয়- হয়তো নিজেরই অজান্তে-
এই যে আছি, থাকবো না আর
সময় হলে লুকিয়ে যাবার
তখন কি কেউ দেখতে পাবে
আমার সঙ্গে পথ হারাবে ?
কক্ষনো নয়,কক্ষনো না
আমিতো নই সবার চেনা


অতঃপর তিনি থামেননি। তাঁকে হাওয়া মেঘ সরিয়ে উর্ধ্বাকাশ পেরিয়ে উড়ে যেতে হয়। তারপর ধান শালিকের দেশে ঘাসের গন্ধ মেখে তিনি মাটির মমতা জড়ানো কন্ঠে বলেন-
একা লাগে, ভারি একা লাগে
তোমাদের ছেড়ে এসে অমূল বৈরাগে
একা লাগে, ভারি একা লাগে
এখানে লাফায় ঘাসে পোকা
আঙ্গিনায় মানুষের খোকা
এখানে দুরন্ত ঘাসে পোকা ।
এখানে উদ্বেগ নেই মেঘে
দেখার মতন নেই জেগে
কেউ, এক দুঃখে ও আবেগে ...
একা লাগে বড় একা লাগে ।

না, কবি। আপনার একা লাগবে না লাখো পাঠকের হৃদয় ঝংকারে। যে সুর আপনার শব্দ বাক্যের অলংকারে আপনি আমাদের পরিয়ে দিয়েছেন, সেই অক্ষর আমরা এখনো প্রতিনিয়ত ধারণ করে আছি। আপনার সুরেই বলি-
মানুষের অন্ধকার, মানুষের আলোর সাঁতারে
যে কেউ, যে কোন কিছু, ভেসে যেতে পারে?

আপনি ভেসে যাননি। অগণিত মানুষের আলোর সমুদ্রেই জেগে আছেন আপনি, হে প্রিয় কবি!

..................................................................................
[শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনের কবিতানুভূতি]

Saturday, November 26, 2016

পাঁচ পয়সার গল্প

পাঁচ পয়সা দিয়ে বললাম, আজ আর নাই। এটা দিয়ে একটা আমসত্ত পাবে অথবা বৈয়ামে রাখা রঙিন চিনির লজেন্স।

মিষ্টি হেসে বললো, আমার তাতেই চলবে। বেশী চাওয়া নেই। তুমি দিতে চাও সে আমি খুব জানি। তোমার নেই বলে দিতে পারো না।

কত ছোট্ট একটা কথা অথচ কেমন চমৎকার বোধ। তুমি দিতে চাও, কিন্তু নেই বলে দিতে পারছো না। এতেই কী নিদারুণ সন্তুষ্টি। দিতে চাওয়াটাই তো আসল। ইচ্ছেটা সবচেয়ে মূল্যবান। আমার ইচ্ছেটা যদি তুমি বোঝো তাহলে কোথাও কোন সমস্যা নেই।

এখন আমার নেই বলে আমি দিতে পারছি না। যখন ছিল তখন চার আনা, আট আনা, এমনকি একটাকাও দিয়েছি। থাকলে দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু এখন আমার যে নেই, সেটা ও বুঝেছে। বুঝেছে বলেই পাঁচ পয়সা পেয়েও সন্তুষ্ট। বেশী চেয়ে বিরক্ত করছে না।

জীবনে এই বোঝাবুঝিটাই সবচেয়ে জরুরী। আমরা কেউ কেউ অবোধ থেকে যাই নিজের অজান্তেই। নিজেরা নিজেকেই বুঝি না, অন্যকে বোঝা দূর বাত। একটা শিশু যতটুকু বুঝদার, অনেক বয়স্ক তার ধারে কাছেও নেই।

বিশ শতকে বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়ে যাবার পর মানুষের মনুষ্যত্বকে শুষ্ক করে ফেলছে। বিদ্যুত কিংবা তেজষ্ক্রিয়তার কারণে চিরকালীন সহজ মানুষ, রুক্ষ মানুষে পরিণত হচ্ছে। যন্ত্র দেখত দেখতে যন্ত্রের মতো আচরণ করছে।

রবিঠাকুর যখন প্রথম আকাশে উড়লেন সেটা তাঁকে নতুন এক অনুভূতির দ্বার পরিগ্রহ করালো। দূরত্বের মরুশুষ্ক দৃষ্টিবিভ্রম তাঁকেও ভাবিয়েছে।  আকাশযান কিংবা ব্যোমতরী ভ্রমণে তাঁর প্রথম অভিব্যক্তি-

ব্যোমতরী বাংলাদেশের উপর দিয়ে যতক্ষণ চলল ততক্ষণ ছিল মাটির কতকটা কাছাকাছি। পানাপুকুরের চারি ধারে সংসক্ত গ্রামগুলি ধূসর বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো দ্বীপের মতো খণ্ড খণ্ড চোখে পড়ে। উপর থেকে তাদের ছায়াঘনিষ্ঠ শ্যামল মূর্তি দেখা যায় ছাড়া-ছাড়া, কিন্তু বেশ বুঝতে পারি আসন্ন গ্রীষ্মে সমস্ত তৃষাসন্তপ্ত দেশের রসনা আজ শুষ্ক। নির্মল নিরাময় জলগণ্ডুষের জন্য ইন্দ্রদেবের খেয়ালের উপর ছাড়া আর-কারো 'পরে এই বহু কোটি লোকের যথোচিত ভরসা নেই।

মানুষ পশু পাখি কিছু যে পৃথিবীতে আছে সে আর লক্ষ্য হয় না। শব্দ নেই, গতি নেই, প্রাণ নেই; যেন জীববিধাতার পরিত্যক্ত পৃথিবী তালি-দেওয়া চাদরে ঢাকা। যত উপরে উঠছে ততই পৃথিবীর রূপবৈচিত্র্য কতকগুলি আঁচড়ে এসে ঠেকল। বিস্মৃতনামা প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতিলিপি যেন অজ্ঞাত অক্ষরে কোনো মৃতদেশের প্রান্তর জুড়ে খোদিত হয়ে পড়ে আছে; তার রেখা দেখা যায়, অর্থ বোঝা যায় না।

রবিঠাকুর কয়েক বছর হলো বিগত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রতিটি বাণীর অন্তর্নিহিত সত্য আমাদের প্রতিদিন আলোড়িত করে।

পারমিতার সাথে আমার আজকাল কোন দূরত্ব নেই। মানসিকবোধটা আমাদের এত গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে যে এখানে ভৌগলিক দূরত্ব আর কোন দ্বিধার দেয়াল তুলতে পারে না।

আজ দুপুরে ডাক হরকরা যখন ঝুলি থেকে চিঠিটা বের করছিল তখন আমি জানতাম ওটা পারমিতা। চিঠি খুলে অবাক হয়ে দেখলাম, সেও আমার মতো একই কথা ভেবেছে। দুজনের চিন্তার এতখানি মিল এত যুগেও কমেনি।

১৯৩০ সালের পর ওর মুখখানি আর একবারও দেখিনি। এখন আর দেখতেও চাই না। যে চিত্রটি আমার ভেতরে মুদ্রিত হয়ে আছে সেই ছবিটাই থাকুক।

ইচ্ছেটা আছে। দুজনেই জানি দুজনের ইচ্ছে। এই জানাটাই সত্য সুন্দর চিরন্তন।

এই সত্যটি পাঁচ পয়সার আকুতি হলেও আমাদের শেষদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকবে।

[পরাগল রায়]

Friday, November 25, 2016

সিকিমের শেষ সূর্য: যেখানে ঘর বেঁধেছিল একটি রূপকথা

১৯৫৯ সাল। দার্জিলিং এর হোটেল উইণ্ডামেয়ারের আলো ঝলমল সান্ধ্য আসরে হাস্যোজ্জ্বল হিমালয় দেখতে আসা উনিশ বছর বয়সী আমেরিকান তরুণী হোপ কুক বান্ধবীকে নিয়ে পান ভোজনে উচ্ছ্বসিত। কাঞ্চনজংঘা দেখার বহুদিনের এক লালিত স্বপ্ন পূর্ণ হতে যাচ্ছে আগামী দিন ভোরে। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখার আয়োজন হয়েছে।

লবির অন্য পাশে বিষন্ন এক রাজকুমার কাঁচের গেলাসে রঙিন সুধাপানে মগ্ন। সদ্য বিপত্নীক এই রাজকুমারের নাম পালডেন থনডুপ নামগিয়াল। রাজ্যের নাম সিকিম। গ্যাংটকের রাজপ্রাসাদে বসবাস। দেরাদুন থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া চৌকস তরুণ সিকিমের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। বয়স ৩৫ হলেও এখনো তারুণ্যে উজ্জ্বল।

আমেরিকান তরুণীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো রাজকুমার। একবার নয়, বারবার। এতবার দেখেও তৃষ্ণা মিটছে না। অসাধারণ ধারালো চোখের অধিকারিনী এই নারী কে? কোথা থেকে এসেছে সে?

আমেরিকান তরুণীও ফিরতি চাহনিতে মুগ্ধতা প্রকাশ করলো। চোখে চোখে কী কথা হলো কেউ জানে না। তারপর দুজন দুজনের ঘরে গিয়ে দরোজা দিয়ে একজন কবিতার বই খুলে বসলো, অন্যজন রেকর্ড প্লেয়ারে পুরোনো দিনের গান শুনতে বসলো।

এর কয়েকদিন পর হোটেল উইণ্ডামেয়ারের বাসিন্দা এবং দার্জিলিং এর পাহাড় জেনে গেল পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই বাসিন্দা একটি জগতের সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে।
রাজা নামগিয়াল ও রানী হোপ কুক

কুকের কাছে অবিলম্বে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো রাজকুমার। তখনি আমাদের মনে পড়ে যাবে মোনাকোর রাজকুমার এবং হলিউডের গ্রেস কেলীর রূপকথার বিয়ের কথা। তাদেরও কী মনে পড়েছিল? মাত্র তিন বছর আগে ১৯৫৬ সালে সারা পৃথিবীতে সাড়া জাগানো মোনাকোর রূপকথার ঘটনাটি ঘটেছিল।

মোনাকোর মত এত সহজে ঘটতে পারলো না সিকিমে। এখানে বাধ সাধলো পশ্চিমের প্রতি রক্ষণশীল সিকিমের ভুটিয়া সমাজের চিরকালীন অবিশ্বাস। তাছাড়া আমেরিকান নাগরিকত্ব নিয়ে সিকিমের রাণী হওয়া অসম্ভব। কিন্তু প্রেমের কাছে কোন বাধাই বড় নয়। কুক আমেরিকা ফিরে নাগরিকত্ব ত্যাগ করে আবারো সিকিম ফিরে এলো ১৯৬১ সালে। তারপর কোন বাধা ছাড়াই আরেকটি রূপকথার প্রেমের মধুরতম পরিণতি পেলো হিমালয়ের কোলে, গ্যাংটকের পাহাড়ে।

১৯৬৫ সালে সিকিমের রাজার মৃত্যু হলে পালডেন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন আর রাণীর আসনে হোপ কুক। হিমালয় পর্বতের নিরিবিলি রাজ্যটি ঐতিহাসিকভাবে সবসময় বিপদমুক্ত ছিল না। বিদেশী শক্তি বারবার লোভের থাবা বাড়িয়েছে। নিজের দেশকে নিজের মতো করে কখনোই শাসন করতে পারেনি এই রাজ্যের রাজা মহারাজারা। প্রতিবেশী রাজ্যের আক্রমণ থেকে বারবার আত্মরক্ষায় ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। সর্বশেষ ছিল বৃটিশ শক্তি, যাদের কাছে দার্জিলিং আপোষে দিয়ে দিতে হয়েছিল ১৮৩৫ সালে। এরপর গ্যাংটকেও তাদের আসন গাড়া ছিল। তবু খবরদারিত্ব ছিল না বলে স্বস্তিতেই কাটছিল।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সিকিমকে স্বতন্ত্র একটি রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হলেও ভারতের নেপালের কুনজর পড়ে বৌদ্ধ অধ্যুষিত দেশটির দিকে। নেপাল থেকে প্রচুর লোকের অনুপ্রবেশ ঘটছিল একশো বছর ধরে। সিকিমের দুর্বল শাসনব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদির কারণে অসম্ভব ছিল অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা। সত্তর দশকে এসে দেখা গেল বৌদ্ধ শাসিত অঞ্চলটির হিন্দু জনসংখ্যা শতকরা আশি ভাগের কাছাকাছি। ভারতের চাপে গনভোট অনুষ্ঠিত হলে দেখা গেল অধিকাংশ জনগণ ভারতের সাথে মিশে যেতে চায়।

কিন্তু গ্যাংটকের রাজপ্রাসাদ ও ভুটিয়া জনগোষ্ঠি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে বেঁচে চাইলেও ভারতের হুমকিতে তা সম্ভব ছিল না। গণভোটের দিন দুই লাখ জনগোষ্ঠির দেশটির চারপাশে ভারত এক লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। ১৪এপ্রিল ১৯৭৫ রাজাকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে গৃহবন্দী করা হয়। তারপর ১৫ মে ১৯৭৫ সালে এক নীরব অভ্যূত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলো তিনশো বছরের পুরোনো শাসক  এবং শাসনব্যবস্থা। সিকিম ভারতের অধীনস্থ একটি রাজ্যে পরিণত হলো। এর আগেই নিরাপত্তার জন্য হোপ কুক তাদের দুই সন্তান Prince Palden Gyurmed Namgyal এবং Princess Hope Leezum Namgyal Tobden কে নিয়ে আমেরিকায় চলে যায়। জুন মাসে সিনেটে বিশেষ বিল পাশের মাধ্যমে তাঁর নাগরিকত্ব পূনর্বহাল করা হয়।

ক্ষমতাচ্যুত হবার পর কুক আর পালডেনের বিচ্ছিন্ন হওয়া পরিবার সংসার ইত্যাদি নিয়ে তৈরী হতে থাকে দূরত্ব। অবশেষে ১৯৮০ সালে তাদের ১৮ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে।

আর বছর দুই পরে ১৯৮২ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রাজা পালডেন নামগিয়েলও নিউইয়র্কের  Memorial Sloan Kettering Cancer Center হাসপাতালে মারা যান।

শাসক হিসেবে নামগিয়েল কতোটা সফল ছিলেন? উত্তরে একটা তথ্য দেই কেবল তাতেই কিছুটা বোঝা যাবে হয়তো। তিনি একটি আধুনিক এশিয়ান রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। তাঁর আমলে সিকিমের শিক্ষার হার ও মাথাপিছু আয় প্রতিবেশী দেশগুলোর দ্বিগুন হয়ে গিয়েছিল।

জীবনের এইসব বৈচিত্র্যময় ঘটনাবলী নিয়ে ১৯৮১ সালে হোপ কুক তাঁর আত্মজীবনী লিখেছিলেন TIME CHANGE An Autobiography নামে। বইটি প্রকাশিত হবার পর তাঁদের জীবন এবং বইটির রিভিউ হিসেবে নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল। আগ্রহীদের জন্য তার কপি দেয়া গেল নীচে-


THE FAIRY TALE THAT TURNED NIGHTMARE
By FRANCINE DU PLESSIX GRAY (March 8, 1981)

WHEN New York socialite Hope Cooke married Crown Prince Palden Thondup Namgyal of Sikkim in 1963, the American press was enraptured. Although Sikkim's snowcapped Himalayas were less lucrative than Monaco's baccarat tables, the setting was much more the stuff of fairy tales. Former debutante Hope Cooke was about to become the queen of Asia's smallest kingdom, a mountain paradise with emerald green hills, pandas and snow lions, 500 varieties of wild orchids and the world's largest crop of cardamon.

For years Queen Hope, dressed in the traditional ankle-length Sikkimese kho looked out at us from many a magazine page, her freckled, fine-boned face smiling wistfully. Vogue asked her what kind of skin moisturizer she used to preserve her prettiness in the 20,000-foot altitude of her capital, Gangtok. The New Yorker followed the royal couple as they made one of their yearly trips to America. Queen Hope's throaty whispers, her nearly inaudible repetitions, were widely quoted. ''The second time we met ... he proposed to me ... I said 'yes yes yes' ... I just fell in love with his sad sad eyes.''

The disparity between public dream and private reality is beautifully recorded in Hope Cooke's autobiography. And it is told not in a whisper, but in an intense, assertive monologue that instantly lets us know we are in the presence of a writer of intelligence and natural talent.

Hope Cooke begins with an account of her orphaned, wealthy childhood in New York City, and I've seldom read a more sensory rendering of a child's early years. Hope's Irish father was a ne'erdo-well flight instructor who had left his wife shortly after his daughter's birth in 1940. Hope's mother was killed shortly afterward when she took off in her Piper Cub with a nearly empty gas tank and crashed: ''I didn't and don't know whether they found any parts of her body or, if so, where she is buried. When I was a child this lack of information prevented me from feeling the finality of her death as strongly as I felt her permanent suspension away from the earth and myself.''

Hope Cooke's earliest memories are of the days she spends in the company of her half-sister Harriet and a succession of governesses in a New York apartment bought by her maternal grandparents, who live across the hall. The grandparents are well-meaning but aloof and starchy people who spend their evenings reading or doing crossword puzzles after punctually imbibing two oldfashioneds. During the day, ''My grandfather does his writing in the library at a desk covered with red leather. Around the room are shelves full of red and browny-gold leather volumes. They are very important. They are classics, he tells me. It is a long time before I realize the things on the shelves are books.''
A succession of sadistic nannies drifts in and out.

One beats Hope with a coat hanger when she doesn't remember the Lord's Prayer; another ties her hands to the bedposts at night to keep her from masturbating. Her grandparents refuse to talk to her about her mother; they disapproved of her marriage and felt her death was irresponsible, perhaps intentional. Hope will suffer forever from the emotional dislocation of a child who is not told the details of a parent's life and death.

Seldom has a WASP girlhood in the 1940's been rendered with such immediacy. She describes the starched smocks and bloomers and kneehigh woolen socks of the Chapin School uniform: ''Only nouveaux riches and Jews,'' one nanny tells Hope, wear the white ankle socks she craves. Grandfather, after his nightly drinks, badgers his 5-year-old ward to memorize Churchill's ''We Shall fight Them on the Beaches'' speech. Hope's Chapin class is shocked when two students vote for Truman in their school mock election of 1948. There are ceremonious expeditions in July to the grandparents' summer home in Seal Harbor, Maine, with Granny holding stacks of lavender Bergdorf-Goodman hatboxes and caged canaries on her lap. Hope suffers the torment of dancing classes at the Colony Club, where she yearns ''for the floor to swallow me up'' and all the parents want their daughters to dance with Arthur MacArthur, the general's son: ''He has black pomaded hair, slicked back, and a large turquoise ring.... I don't want to dance with Arthur MacArthur. I could go to the bathroom and sit there, pulling the chain.''

These first chapters, a remarkably vivid and candid portrait of a young girl, lend credibility to the much weaker, latter portions of the book. The child Hope Cooke describes has the spiritual fervor, born of feeling isolated and outcast, that will lead her to crave submersion in the mysticism of India. By age 10, she is already something of a mystic. Her favorite time of day in Maine is the moment when she and her governess (a rare kindly one) walk to the church to water flowers from china pitchers: ''In the dark piney evening, watching the water wash channels around the geraniums, I feel virtuous, which I confuse with feeling holy. In the church, whose door is open, I sit in the piney pews looking out the windows at the forest, wanting a revelation.''

Hope's loneliness and confusion grow over the years, and so does her spiritual quest. Grandfather dies when she's 12, Granny dies three years later. She goes to live with her aunt and uncle, Mary and Selden Chapin, then the ambassador to Iran, and finishes high school there. One summer in her late teens she travels to India: ''I've never been so happy ... India! My heart explodes ... The East is my home ... I must stay near India somehow ...''

Hope Cooke is majoring in Asian studies at Sarah Lawrence when she meets the recently widowed Crown Prince of Sikkim in Darjeeling (where, with typical eccentricity, she is taking a course in typing). Two years later they are engaged. The writer immediately hints at the complex pragmatism of this alliance: Her impulse toward him may be inspired by her fascination with Indian spirituality and her desire for some kind of rootedness; his impulse toward her is in part prompted by his need to find a mother for his children. Both are also driven toward each other by the similar isolation of their childhoods. ''Even more than me,'' Hope muses about the Prince's ''Chaplinesque loneliness,'' ''when he was small he had a rather sad life.''

Hope Cooke is an exceptionally chaste adventuress who seeks the tamer shores of security rather than the wilder shores of love. She's perhaps more infatuated with the prospect of nesting in her little Oriental palace than she is with the moody king. ''I want a family so much. I want to fill this nest, make it a real home.'' One of the most touching aspects of this story is her delight in recapturing childhood through her affection for her three stepchildren, whom she seems to love quite as much as she will later love her own son and daughter. She exults when her modest (five-bedroom) palace explodes with offspring and the family consumes 12 dozen eggs a week. She has made a fierce resolution to reverse the karma that had saddened her childhood and her husband's.''These children will be happy. The wheel of unhappiness that both my husband and I grew up on will not go to this generation.'' 

But the monsters lurking in Hope's fairy tale appear soon after her marriage. The Crown Prince may well have been one of the Far East's most enlightened rulers, as both the author and the historical record confirm: He shaped a model Asian state whose literacy rate and per capita income were twice as high as the neighboring countries of Nepal, Bhutan and India; he retained a measure of independence for a tiny country threatened on two sides, by an India intent on annexation and an equally aggressive Communist-dominated Tibet. Yet, as Hope Cooke describes him, he was also a heavy-drinking philanderer with an odious streak of macho sexism. Notwithstanding his strained finances, the Crown Prince managed to maintain a love affair with a married woman in Belgium before and during his marriage to Hope; he even flew to visit her a few weeks before Hope's first child was born. The lover wrote letters to the Prince on ''crisp rustling paper'' that Hope could hear crinkling in her husband's bathrobe when he hugged her at night. If a letter dropped to the floor, she read it while he went to the altar to perform his Buddhist prayers.

When Sikkim's independence was endangered by the death of Nehru, who had carefully preserved Sikkim's autonomy under the terms of a protectorate, the Crown Prince began to drink more and throw temper tantrums. During one such tantrum, he tosses Hope's record player, her ''lifeline to the West,'' out the window. Fairy tale turns to nightmare as Indira Gandhi conspires to deprive Sikkim of the little independence it has. While Hope entertains visiting reporters interested in ''My Thirty Ways of Preparing Yak,'' she is secretly tippling beer in the morning, living on whisky, Valium and cigarettes from noon on. She begins to realize that the manic fervor with which she'd developed Sikkim's cottage industries and helped her husband fight Indian domination is a substitute for a love that barely exists, if it ever existed. On one of her yearly trips to New York, she has an affair with a man who had been a friend during her lonely adolescence, and the memory of this affair haunts her for the rest of her stay in the Far East. She lies in bed more dazed than ever by whisky and Valium, listening to Joan Baez sing freedom songs.

When India finally closes in on Sikkim, Hope packs up to return to the United States, where she brings the four youngest royal offspring to spare them the house arrest about to be imposed on their father. There is little emotion in the final parting of the royal couple: ''I embrace Chogyal a final time and the children touch their foreheads to his.''

A few days later she is back in the United States, putting on a short dress for the first time in 11 years. Her children are embarrassed. They have never seen her legs before. She has been the formal, impeccable spouse of an Asian potentate. While trying to make a new nest for her brood in New York, she sits in the back of buses dressed in dowdy clothes, chewing gum in ''a vulgar, slack-jawed manner'' to avoid being recognized.

Out of fidelity to the beleaguered husband she has left behind, she cuts short the affair she'd started with her American lover. Her acute need for him (''I want this man so badly I have to go out running to keep from going crazy'') makes one admire her self-denial. Despite her celebrity she seems like many people in middle age, groping for identity as painfully as they did as adolescents, picking up the pieces after leaving a marriage that was the product of personal delusions, buried miseries, childhood pains.

There are two distinct flaws to this often wonderful book: the concentration on Sikkimese politics at the expense of Sikkimese culture, and the decision to leave a sometimes gushing, girlish style in its natural state. The author's mini-history of Sikkim , which could be gleaned with greater clarity from back issues of Newsweek, is rendered in a breathless tone that can unwittingly verge on the comic. One misses a deeper view of rituals that are merely mentioned. There are several references to the white scarf ceremony in Sikkimese Buddhism, for instance, but the symbolism is never disclosed. (I had to go to an encyclopedia to find that the white scarf is a symbol of ''pure thoughts.'')

As for Hope Cooke's often impetuous style, it works splendidly in the childhood chapters, where it is appropriate to the material. But it can be disastrous for expressing adult sentiments. A passage such as ''My leaving is too painful to bear. I lie, my guts molten in a cast ... My brain and heart burning in this prison'' is not worthy of Hope Cooke's talent. Such infelicities recur much too often for this reader's comfort, and the strength of the author's personality seems all the more remarkable for emerging despite these flaws. Her autobiography is in most parts engrossing and engaging; the test of quality in this kind of book is an unstinting candor about the self; and Hope Cooke has enough of that for twelve authors - or princesses.
সিকিমের প্রাচীন রাজপ্রাসাদ

রাজপুত্র এবং রানী


রাজকন্যা এবং রানী


এবং সত্যজিত রায় নির্মিত 'সিকিম'

সবশেষে বলি, সত্যজিত রায়ের 'সিকিম' যারা দেখেছেন, তারা যদি এই লেখা পড়ে আবারো দেখেন, তাহলে অবশ্যই নতুন করে সিকিমের শেষ রাজ পরিবারকে আবিষ্কারের আনন্দ পাবেন, সেই সাথে স্বাধীনতা হারানো একটি রাজ্যের জন্য বেদনার্ত হবেন। সত্যজিত রায় 'সিকিম' তৈরী করেছিলেন ১৯৭১ সালে। সেই সিনেমাটি তৈরীর পেছনে সর্বোতভাবে সহযোগিতা ও পৃষ্টপোষকতা করেছিলেন রাজা পালডেন নামগিয়াল এবং রাণী হোপ কুক। তাদের দুর্লভ ভিডিও ফুটেজগুলো ধরে রেখেছে এই সিনেমাটি। সত্যজিত রায় নিজের কন্ঠে পুরো সিনেমাটির ধারাবিবরণী বলে গেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিনেমাটি ভারতে কখনোই সত্যিকার অর্থে কখনোই মুক্তি পায়নি বারবার নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে। ২০১০ সালে কোলকাতায় ্ একদিন প্রদর্শিত হবার পর আবারো নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছিল। সত্যজিত রায় সিকিমের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার অবস্থান নিয়ে ডকুমেন্টারিটি তৈরী করেছিলেন। কিন্তু তার পাঁচ বছর পরেই সিকিমের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে গিয়েছিল।

সত্যজিত নির্মিত 'সিকিম' এর ইউটিউব লিংকটা যুক্ত করে দেয়া হলো-
https://www.youtube.com/watch?v=-AEhw3zcJzM

_______________________________________________________________

তথ্যসুত্র:
১. "Sikkim: A Requiem For Himalayan Kingdom" - by Andrew Duff
২. "Time Change"- by Hope Cooke
৩. "Where There's Hope", TIME, March 29, 1963
৪. "The Fairy Tale That Turned Nightmare?". New York Times. March 8, 1981
৫. Photo: Family Album -Princess Hope Leezum Namgyal Tobden 
৬. সত্যজিতের সিকিম : ইউটিউব




স্বপ্নে পাওয়া শব্দ - ছোলেষ

নিজে সেইসব অপকর্ম সমূহ করেও সাধু থাকতে চায় অথচ অন্যদের সেই কর্মে এক বিন্দুও সহ্য করে না, এমন মানুষকে ডাকার মতো উপযুক্ত শব্দ বাংলা ভাষায় আছে কি? আমি খুঁজে পাইনি।

কিন্তু অদ্ভুত কোন কারণে স্বপ্নে পাওয়া ওষুধের মতো মাথার ভেতরে তাদেরকে ডাকার মতো একটি শব্দ কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে-  'ছোলেষ', 'ছোলেষ', 'ছোলেষ'........

দেশের মাথা, সমাজের নেতা, উপদেশ বন্টনকারী, স্বচ্ছল সমৃদ্ধ সুশিক্ষিত প্রচুর 'ছোলেষ' আজকাল নৈতিকতার ঝাণ্ডাধারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও তাদের দখলে।

Wednesday, November 23, 2016

অনুবাদ পড়তে কেন ভয় পাই?

আমি বহুভাষাবিদ নই। বাংলা আর ইংরেজি বাদে অন্য কোন ভাষায় দখল নেই। ফলে ভিন্ন ভাষার সাহিত্যের স্বাদ নেবার জন্য অনুবাদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু অনুবাদ বিষয়ে আমার কিছু বিবমিষা তৈরী হয়েছে নানান সময়ে, যেটা আমাকে অনুবাদ পাঠ থেকে বিরত রেখেছে দীর্ঘকাল। সংগ্রহে থাকা প্রচুর অনুবাদ সাহিত্য অপঠিত রয়ে গেছে।

অনুবাদ পড়তে কেন ভয় পাই -সেই প্রশ্নের উত্তরে একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার অবস্থানটি যথাসম্ভব ছোট পরিসরে ব্যাখ্যা করলাম। জানতে ইচ্ছে করে এমন অভিজ্ঞতা আরো মানুষের আছে কিনা।

++কেমন অনুবাদ চাই++
অনুবাদ মানে শব্দার্থ নয়। যথার্থ অনুবাদ বিষয়টি প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। প্রতিটি ভাষার নিজস্ব একটি ব্যাকরণ আছে, স্বতন্ত্র একটি চেতনা আছে, ভাব প্রকাশের শৈলী আছে। আরো আছে নানান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য যা একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। একটি অনুবাদ তখনই সফল হয় যখন এই বিভিন্ন মাত্রার শিল্প সুষমাকেও রূপান্তরিত করে ভিন্ন ভাষায় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। সবগুলো মাত্রাকে শুধুমাত্র আক্ষরিক অনুবাদ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। যে অনুবাদ এই শর্তগুলো যত বেশী পরিমানে পূর্ণ করতে পারে সেই অনুবাদ ততখানি সফল।

একাডেমিক বই অনুবাদ যতটা সহজ, সাহিত্যের বিষয়াদি অনুবাদ তার চেয়ে বহুগুন কঠিন। তথ্যভিত্তিক বইগুলো শুধু তথ্যের অনুবাদ ঠিক থাকলেই চলে। কিন্তু একটা সাহিত্য যে ভাষায় রচিত হয় সেই ভাষাগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক চেতনাও ধারণ করে। একজন অনুবাদক যদি মূল ভাষার সেই সাংস্কৃতিক চেতনার সাথে যথেষ্ট পরিমানে পরিচিত না থাকেন তাঁর পক্ষে যথার্থ অনুবাদের পথে হাঁটা অসম্ভব।

বাংলা ভাষায় যথার্থ অনুবাদের উদাহরণ খুব বেশী নেই। ব্যক্তিগত পাঠাভিজ্ঞতার আলোকে দেখেছি প্রচুর অনুবাদ মূল সুর থেকে অনেকটা দূর দিয়ে হেঁটেছে। অর্থ ঠিক থাকলেও অনুবাদকের ভুল শব্দচয়নের কারণে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে পাঠককে। বাংলা আমার মাতৃভাষা, ইংরেজি শুধুমাত্র পাঠ্য ভাষা। বাংলার চেয়ে ইংরেজি জ্ঞান অনেকটা কম হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি বইয়ের বাংলা অনুবাদের চেয়ে মূল ইংরেজির সাহিত্য পাঠ অনেক বেশী বোধগম্য হয় আমার কাছে। আক্ষরিক অনুবাদ ব্যাপারটা তো রীতিমত ভয়াবহ। আমাদের অধিকাংশ অনুবাদক সরাসরি আক্ষরিক অনুবাদের পথ ধরেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি শব্দের আভিধানিক অর্থ শুদ্ধ হলেও বাক্যটি তার সঠিক অর্থ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।

++একটি উদাহরন++
জেরোম কে জেরোমের 'থ্রি ম্যান ইন আ বোট' বইটি ছাত্রজীবন থেকেই আমার খুব পছন্দের একটি বই। এই বইয়ের তিনটি বঙ্গানুবাদ পাঠের সুযোগ হয়েছে। সেবা প্রকাশনী, বাংলা একাডেমি এবং পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রকাশনীর। এখানে একমাত্র সেবা প্রকাশনীর অনুবাদটিই(অনুবাদক এ.টি.এম. শামশুজ্জামান) মূল বইয়ের কাছাকাছি যেতে পেরেছে। সেবার অধিকাংশ অনুবাদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো তা পাঠককে বুঝতে দেয় না এটি একটি অনুবাদ। সীমাবদ্ধ পড়াশোনার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- নিজের ভাষার আদলে একটি বিদেশী সাহিত্যকে উপস্থাপন করার নজির বাংলাদেশে সেবা প্রকাশনী ছাড়া আর কোন প্রকাশনীতে চোখে পড়েনি আমার।

++একটি অভিজ্ঞতা++
সম্প্রতি কাহলিল জিবরানের 'দ্য ব্রোকেন উইংস' বইটির একটি অনুবাদ(অনুবাদক: মোস্তফা মীর, অনিন্দ্য প্রকাশনী) পড়তে গিয়ে হোঁচট নয় রীতিমত হুমড়ি খেয়ে পড়ার যোগাড় হয়েছিল। অথচ ইংরেজি বইটি এই অনুবাদের চেয়ে বহুগুন সহজবোধ্য। কেবল দুটি বাক্যের উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে-

"নারীর চোখ থেকে নিক্ষেপ করা একটি দৃষ্টি তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত করবে।"
One look from a woman's eye makes you the happiest man in the world.

"সেই রাতে সেলমা যে কথা উচ্চারণ করেছিল তা আমার অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝখানে আমাকে গ্রেফতার করে রেখেছিল, যেন মধ্যসমুদ্রে নোঙর করা একটা নৌকা"
That word which Selma uttered that night arrested me between my past and future, as a boat which is anchored in the midst of the ocean.

এই দুটি বাক্যবন্ধের মধ্যে 'নারীর চোখ থেকে নিক্ষেপ করা একটি দৃষ্টি' এবং 'অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝখানে আমাকে গ্রেফতার করে রাখা' পাঠক হিসেবে আমাকে খুব মর্মাহত করেছিল। যদি অনুবাদক গল্পটির মূল সুর ধরতে অক্ষম হন কিংবা বেখেয়াল হন পাঠকের যে দুর্বিসহ অবস্থা উপস্থিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের অনুবাদ জগতে এমন উদাহরণ শত শত, হাজার হাজার।

আবার জি.এইচ. হাবীব অনূদিত হাণ্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুড বইটির অনুবাদ 'নিঃসঙ্গতার একশো বছর' পড়ে বেশ ভালো লেগেছিল। গোটা বইটি না থেমে এক নাগাড়ে পড়ে শেষ করতে তেমন কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি। মূলের সাথে অনুবাদের দূরত্ব যেটুকু ছিল তাকে সহনীয় বলা চলে। এক্ষেত্রে অনুবাদক উপরে উল্লেখিত শর্তাবলী মোটামুটিভাবে পালন করতে পেরেছেন। পাঠক হিসেবে তা আমাকে তৃপ্ত করেছিল।

++শেষ কথাটি++
আমি জানি অনুবাদ খুব পরিশ্রমসাধ্য একটি কাজ। ছোটখাট কিছু অনুবাদ কর্ম করে তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। আস্ত একটি বই কিংবা সমস্ত কোন রচনাবলী অনুবাদ খুবই দুঃসাধ্যের একটি কাজ। এত পরিশ্রমসাধ্য কাজটি যদি পাঠকের মননে প্রবেশযোগ্য না হয় তাহলে সেই অনুবাদের কোন অর্থ হয় না। সেই কাজটাকে পণ্ডশ্রম বলেই ধরে নেয়া যায়। অনুবাদ করার জন্য সেই ভাষা ও সংস্কৃতির উপর যথেষ্ট দখল এবং নিজের ভাষায় বৈচিত্র্যময় শব্দচয়নের দক্ষতা না থাকলে সেই পথে না হাঁটাই উচিত।

এইসব কারণে আমি অনুবাদ পড়তে ভয় পাই, সেই সাথে অনুবাদ করতেও। একই কারনে হাতে থাকা অসমাপ্ত অনুবাদকর্মগুলো অগ্রসর হতে সাহস পাচ্ছে না।

গনি মিয়া

গনি মিয়া পরের জমিতে নিজের গরু দিয়ে চাষ করার সময় আল ভেঙ্গে পাশের সরিষা ক্ষেত নষ্ট করে জরিমানার শিকার হয়ে দুইদিন উপোষ থাকার পর বউয়ের গঞ্জনায় হাটে গিয়ে নির্বোধ পশুটিকে বিক্রি করে ফিরে আসার কালে ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে মাঝ সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে গলায় দড়ি দিল।

Monday, November 21, 2016

রূপকথার ঘোরে




রূপকথার রাজকন্যা -তুমি কোথায় থাকো, কোন সে সুদূর অন্তহীনের ওইপারে?
তোমাদের চির সবুজের রাজ্যটিতে কখনো শীতকাল আসেনা সুপর্না?




তোমাদের সবুজ দেশে কি শুধুই গান, শুধুই আনন্দ? কানাকানি, হানাহানি, রাজনীতি, কুটনীতি নেই, বিষাদ মলিনতার দুষণ নেই? কী নাম তোমার দেশের?


------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব –
প্রতি সন্ধ্যায় কে যেন
ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে –
আমি চুপ করে বসে থাকি –
অন্ধকারে নীল ফানুস উড়িয়ে দেয় কারা,
সারারাত বাজি পোড়ায়
হৈ-হল্লা – তারপর হঠাত্
সব মোমবাতি ভোজবাজির
মতো নিবে যায় একসঙ্গে –
উত্সবের দিন হাওয়ার
মতো অন্যদিকে ছুটে যায়,
বাঁশির শব্দ আর কানে আসে না –
তখন জল দেখলেই লাফ
দিতে ইচ্ছে করে আমার
মনে হয় – জলের ভেতর – শরীর ডুবিয়ে
মুখ উঁচু করে নিশ্বাস নিই সারাক্ষণ–





ভালো লাগে না সুপর্ণা,
আমি মানুষের মতো না, আলো না, স্বপ্ন না –
পায়ের পাতা আমার
চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশ –
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে, তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি,
ঘড়ির কাঁটা আঙ্গুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন –
আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব!

একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মেঘ
ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম জানলার
কাছে –
চারিদিকে অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যচ্ছিল
না সেদিন –
সেইদিন তোমার কথা মনে পড়তেই
আমি কেঁদে ফেলেছিলাম –
চুলে দেশলাই জ্বালিয়ে চুল পোড়ার
গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম
আবার -এখন আমি মানুষের মতো না –
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাত্ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার
– ভালোবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নিচু
করে বসে থাকতে ভালো লাগে না –
আমি মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই
তড়বড়ে নিশ্বাস ফেলি এখন – যে-দিক
দিয়ে আসি, সে-দিকেই দৌড় দিই
কেন এই দৌড়ে যাওয়া?
আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা,
আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব ।।






____________________________________________________________________
বেহালার সুর: টেলর ডেভিস 
কবিতা: ভাস্কর চক্রবর্তী - শীতকাল কবে আসবে সুপর্না


Sunday, November 20, 2016

নিজের দর্পনে কবি অলোক সরকার

কবি অলোক সরকার চলে গেলেন। তাঁর সাথে আমার পরিচিতি ছিল না তেমন। কিন্তু তাঁর একটি লেখা পড়ে বেশ ভালো লেগেছিল। নিজের কবিতা বিষয়ক লেখাটিতে একটি মৌলিক দর্শনের কথা প্রকাশ করেছিলেন যেটি অনেক জীবনযাপনের গল্পের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ -

যা আছে তা থাকার সঙ্গে আছে, স্মৃতির সঙ্গে থাকা, স্বপ্নের সঙ্গে থাকা। থাকা অর্থাৎ নির্বাচিত থাকা, যে নির্বাচন জীবনের, জীবনযাপনের প্রশ্নে সদর্থক, অভীপ্সা, স্বতঃস্ফূর্ত, তার দিকেই আমার সমর্থন, আমার পক্ষপাত--- জীবনযাপন অর্থাৎ নানাবিধ অভিজ্ঞতা, তার এক অংশ বিরুদ্ধ শক্তি। তার দিকে আমার আগ্রহ অক্রিয় হয়, আমার টান তার দিকেই যা আমার জীবনকে রচনা করেছে, লালন করেছে। তা এমন একটা অনতিক্রম যাকে অতিক্রম করলেই আমার ভ্রমণ লক্ষ্যহীন অনাশ্রয়, ধুলোর সঙ্গে ধুলো, সাদার সঙ্গে সাদা। আমার চরাচর আমার থাকার অনিবার্যতার আনুকূল্যে নিশ্চিত হয়, ভাষা রচনা করে, ভাষা অর্থাৎ শব্দ-সঞ্চয়ন, ভাষা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ব্যক্তির সর্বস্ব, একটা শব্দের পাশে আর একটা শব্দের সচেতন সংস্থাপন--- সঙ্গে সঙ্গে ধুলো অবারিত হলো, নদী নৃত্যবিহ্বল। কালবৈশাখী, পূর্ণিমা নিশি। যা আছে তাকে অতিক্রম করে, সেই অস্পর্শ, অবধারিত এখন, এখন আরো বিশুদ্ধ, সেই মাতৃভূমি যা দিন রচনা করেছে, লালন করেছে।

আমার বরাবরের বিশ্বাস প্রায় প্রতিটি কবির সাথে একজন নিমগ্ন দার্শনিকও বাস করেন। জীবনানন্দ স্পর্শ করা এই কবির ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য বলে মনে হয়।


**[নিজের দর্পনে নিজের কবিতা- অলোক সরকার, বাক- ব্লগজিন, মার্চ ২০১৫]

কথায় কথায় রাত হয়ে যায়.......

কথায় কথায় অনেক কিছু হয়। কথায় কথায় কিছু হয় না। দুটোই সত্যি। আবার সব কথা প্রকাশ হয় না। কিছু কথা লুকিয়ে থাকে শব্দের আড়ালে আবডালে, বাক্য বিন্যাসের ঝোপেঝাড়ে। কথায় কথায় রাজনীতি, কথায় কথায় কুটনীতি। কথার মারপ্যাচে হেরে যায় রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা বিরোধী নেত্রী। কথারা আঘাত দেয়। শব্দেরা হয় বুলেট। কিছু শব্দের আঘাতে জ্ঞান হারায় মানুষ, কিছু কথায় খুন হয়। খুন খারাবির কথা থাক। কথারা কোথায় আনন্দ পায় সে কথা চলুক।

কথার উপর যদি কোন জীবন বেঁচে থাকে, বাঁচার উপর বাঁচে, সে কথার চেয়ে মহৎ আর কী আছে? 'বাঁচার উপর বাঁচা' মানে কী? বাঁচা হলো দৈনিক বুকভরা অক্সিজেন, পেট ভরে ভাত খেয়ে দেহধারণ করা। আর সেই বাঁচার উপর আরো কিছু বাড়তি উপযোগ বেঁচে থাকাকে অর্থপূর্ণ করে। হতে পারে সেটা কোন বিনোদন কিংবা পাঠতৃষ্ণা অথবা বন্ধুসঙ্গ। কোন কোন জীবনে কথা এবং শব্দের উপর নির্ভরতা থাকে। তখন কথা দিয়েই সে বাঁচার উপর বেঁচে থাকে।

কথারা কখনো যুদ্ধকেও দমন করে। দুই বিবাদমান প্রতিবেশী রাষ্ট্রপ্রধান যদি নিজেদের অবস্থান থেকে একটু নমনীয় হয়ে সংলাপে বসে তখন যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব।

দুজন পরস্পর মঙ্গলকামী মানুষও ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে পারে কথার মাধ্যমে। আসল কথাটি শেষ দৃশ্যের জন্য রেখে না দিয়ে মধ্যবর্তী সময়ে যদি প্রকাশ করা যায় তাহলে বাংলা সিনেমার তিন ঘন্টার ভুলবোঝাবুঝি সংঘর্ষের কোন প্রয়োজন হতো না। 'কেন তোমাকে ভুল বুঝিলাম' টাইপের সংলাপ আপোষমিত্রতার জন্য অপরিহার্য।

অপ্রিয় সত্য কথা বলা বিপদজনক। সর্বক্ষেত্রে বীরত্বটা না দেখানোই ভালো। তবে অপ্রিয় সত্যটা প্রকৃত বন্ধুকেই বলা যায়। সেই অপ্রিয় কথাটি যদি বন্ধুকে নিয়ে হয় তাও। প্রকৃত বন্ধু সেই যে অপ্রিয় সত্য জানার পরও বন্ধুতা খারিজ করে দেবে না।

ধরা যাক, বন্ধু আমার উপর রাগ করেছে। আমি বন্ধুর উপর। কেউ কারো সাথে কথা বলছি না ঠিক সুরে। দুজন দুই কারণে রেগে আছি। বন্ধু আমার উপর রাগ করেছে আমি বন্ধুর সমস্যাটি বুঝিনি বলে। আমি রাগ করেছি বন্ধু সমস্যাটি আমাকে বলেনি বলে। এখন বন্ধু যদি সমস্যাটি না বলে রাগ অভিমান নিয়ে দূরেই সরে থাকে তাহলে দূরত্বটা বাড়তেই থাকবে। আবার বন্ধু যদি রাগ প্রকাশ করেও যদি অপ্রিয় সত্যটি আমার কাছে বলে দেয়, তাহলে আমি ভুলটি শোধরাবার চেষ্টা করবো। না হলে বলবো, মাফ করে দে পারবো না।

এই বিষয়ে সচলের রন'দা চমৎকার একটি কবিতা লিখেছেন গতকাল ফেসবুকে। সেখান থেকে কপি করে দিচ্ছি-

...
তোমার নিস্পৃহ জিহ্বা ও চোখের চেয়ে
ঢের ভালো অবিশ্রাম বিষবাক্যে ছুঁড়ে দেয়া
ঘৃণার আঘাত ! প্রায়শ্চিত্তের নীল জলে
থাকে কি রক্তের দাগ ! ভেবো না কলঙ্কী হবো,
তোমার শুভ্রতায় পড়বে না আঁচড় কোনো--
এটুকু বলেই যেন বেমালুম গায়েব সে !
যাকে বলে নিরুদ্দেশ !

নিজেকে হারালে কেউ তাকে কি এতিম বলে!
প্রিয় মুখ প্রিয় চোখ কিভাবে হারায় লোকে?
কিংবা হারানো কান্নার চিহ্ন কেউ কি জমিয়ে রাখে?
পাই না উদ্দেশ কোনো ভেবে ভেবে দিনরাত!
তন্ন তন্ন খুঁজে অবশেষে
যেখানে আচমকা এসে সসঙ্কোচে থমকে দাঁড়াই !
কোথাও কোন অন্তরালে এইখানে আছে কি সে?
কিভাবে ঢুকতে হয়-- বুকের গভীরে খুব !
জানি পদচিহ্ন মুছে যায়, মুছে না পায়ের ঘা...
একটুকু নাড়াতেই যদি
অলক্ষ্যে লুকোনো সব গন্ধ ছড়ায় !!

(১৯-১১-২০১৬)
[অন্ধপ্রলাপ- রণদীপম বসু]


তুহীন আমার বহুবছরের ঘনিষ্ট বন্ধু। আমাদের ঘনিষ্টতা এতই গভীর ছিল যে সে আমার সাথে আর কারো বন্ধুতা সহ্য করতো না। অথচ একদিন আমরা দুজনই হারিয়ে গেলাম নিজস্ব ব্যস্ততার জগতে এবং বহু বছর আমরা নিখোঁজ হয়ে ছিলাম দুজনের কাছে। দেখা হবার কোন সুযোগই ছিল না, ঠিকানা, ফোন সব বদলে গেছে। তবু নিয়তি নামক ব্যাপারটার কারণে আবার দেখা ঢাকাতেই। রমনা পার্কের বিকেলটি তখন আমাদের দুজনকে জড়িয়ে নিল। কোন অভিযোগ নেই। ভুল বোঝা নেই। শুধু ফিরে পাবার আনন্দ। লেনদেনহীন সম্পর্কগুলো বোধহয় এমন নিটোল থাকে। বহুবছর পরও মরিচা ধরে না।

গেল বছরেও তেমন কয়েকটি ফিরে পাবার ঘটনা ঘটেছিল। যারা হারিয়ে গিয়েছে বলে জেনেছিলাম, তারা যখন হারায়নি বলে জানা যায়, তখন তাকে পাওয়ার ঘটনা বলা চলে। আমার খুব প্রিয় কিছু মুখ আবারো ফিরে পেয়েছিলাম। প্রবল আন্তরিকতাপূর্ণ হাসিমুখগুলো দুই দশকের দূরত্ব এক নিমেষে ঘুচিয়ে দিয়েছিল।

হারিয়ে ফেলার হাহাকার মানুষের জীবনে নতুন কিছু নয়। আমার একটু বেশীই। একটি বড় হারানোর ঘটনার কারণেই....। কিন্তু না পাওয়াকে পেয়ে যাওয়ার আনন্দটিও কি কম? সবচেয়ে বড় পাওয়া সেইটিই। পাওয়া হয়ে গেলে 'আর কিছু লাগে না আমার' ধরণের গর্বও চলে আসে। সেই পাওয়াটা কী? সেই পাওয়াও কিছু কথা মাত্র। কিছু শব্দ, কিছু অক্ষর, কিছু খুব প্রিয় বাক্য। দুঃসময়ের সম্বল হতে পারে সেই কথাগুলো। 'বাঁচার উপর বেঁচে' থাকি প্রিয় সংলাপের স্মৃতি নিয়ে। প্রিয় চিঠির মায়াবী গদ্যসম্ভারে।


---------------------------------------------------------------------
শিরোনাম - শ্রীকান্তের গানের লাইনগীতিকার - পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরকার - সুধীন দাশগুপ্ত


Tuesday, November 15, 2016

অনুল্লেখ্য বিভ্রম

চায়ের কাপটি যে টেবিল টপের উপর রাখা সেই টেবিলের উপর একটি চিত্র আছে। এই টেবিলের বয়স দুই বছরের বেশী এবং এটার উপর কাপ পিরিচ রেখে কতশত বার চা নাস্তা করেছি অথচ এই ছবিটা কিসের তা বুঝতে পেরেছি মাত্র আজ সকাল নটার পরে।

দেরীতে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে চা খাওয়ার আগে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলাম তখন পাশে টেবিলের উপর চোখ পড়াতে খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

ছবিটা একগুচ্ছ রঙিন পেন্সিলের বৃত্তাকারে সাজানো একটি দৃশ্যের। সামান্য দৃশ্যটি বুঝতে এতখানি সময় কেন লাগলো সেটা খুব অবাক করেছে। কার বইতে যেন পড়েছিলাম শিল্পী সুলতানের কিছু ছবি কাছ থেকে বোঝা যেতো না একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে গেলেই ছবির আসল সৌন্দর্য বোঝা যেতো।

এক্ষেত্রে আমি টেবিল থেকে দূরেও যাইনি। একই দূরত্বে থেকে যে দৃশ্য আগে চোখে পড়েনি তা আজ পড়লো। যে চিত্রটা এতকাল ছিল কেবলই কিছু সমান্তরাল রঙের অর্থহীন রেখামাত্র, আজ সেই দৃশ্যটি পরিপূর্ণ অর্থ নিয়ে চোখের সামনে হাজির। একপাল রং পেন্সিলের উপর চায়ের কাপটা কেমন চুপচাপ বসে আছে। অতি তুচ্ছ এই দৃশ্যটি আমার কাছে অপটিক্যাল ইল্যুশনের যথার্থ একটা উদাহরণ হইল!

'মানুষ' কেন পৃথিবী শাসন করছে?

প্রশ্নটিও সহজ, আর উত্তরও তো জানা........তবু আবার একটু চোখ বুলাই।

যদি বলি আপনার সহস্র নাম্বার পূর্বপুরুষটি সত্তর হাজার বছর আগে আফ্রিকার কোন জঙ্গলাকীর্ণ পর্বতের ঢালুতে বসে একটা আধপাকা কলা ভক্ষণ শেষে কলা ছিলকার উপর হাতের আঙুলগুলো রেখে অবাক হয়ে দেখছে –আরে এই ছিলকায়ও দেখি আমার হাতের আঙুলের সমান টুকরা! হাউ ফানি! অংক আবিষ্কারের এই ভুজুংভাজুং কেচ্ছা কি বিশ্বাস করবেন? না করলেও সমস্যা নাই। কিন্তু কল্পনাটি অসম্ভব কিছু না। প্রাগৈতিহাসিক কালের কোন আদম হয়তো ওই ভাবেই প্রথম গুনতে শিখেছিল যার অসংখ্য বিবর্তনের ফসল হিসেবে ৭০ হাজার বছর পরে আপনি কম্পিউটারে খুটখাট করার দুর্লভ সুযোগ সুলভে ভোগ করছেন।

আপনি নিশ্চয়ই জানেন প্রায় ৭০ হাজার বছর আগে আপনি গরু ছাগল কুকুর বেড়াল বা শিম্পাঞ্জির চেয়ে খান্দানী কোন প্রাণী ছিলেন না। প্রাগৈতিহাসিক যুগে দুনিয়ার বুকে আপনার ভূমিকাটা একটা জেলিফিশ, কাঠঠোকরা এমনকি একটা মৌমাছির চেয়েও নগণ্য ছিল।

অথচ আজকে আপনি প্রযুক্তির পাখায় ভর করে গোটা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, আকাশে উড়ছেন, পাতালে নামছেন, আধমরাকে বাঁচিয়ে তুলছেন ইনজেকশানের খোঁচায়, আবার জীবিতকে কবরজাত করছেন ক্লাস্টার/নাপাম বোমা দিয়ে, হাতের তালুর সাইজের মোবাইল টিপে জগতের সব খোঁজ খবর নিতে পারছেন, বুর্জ-আল-আরবে বসে দুনিয়াতেই বেহেশতী সুখ উপভোগ করছেন। আপনার এই সাফল্যের গোপন চাবিকাঠি কোথায়? কোন যাদুতে আফ্রিকার অখ্যাত জঙ্গলের এক কোণায় কলা ছিলে খাওয়া এক নগণ্য আদিম জানোয়ার থেকে মাত্র পঞ্চাশ হাজার বছরে পরিবর্তিত হয়ে গেলেন পৃথিবীর শাসক প্রাণীতে।

প্রচলিত বিশ্বাসে আপনি হয়তো ভাবেন আপনারা অর্থাৎ মানুষের দল আশরাফুল মখলুকাত। অন্য সকল প্রাণীদের চেয়ে আপনাদের আলাদা করে বানানো হয়েছে। আপনি বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন আপনার শরীরে কিংবা মগজে এমন কোন বিশেষ কোন মাল মশল্লা আছে যা আপনাকে একটা বাঘ, সিংহ, হাতি কিংবা গণ্ডারের চেয়ে বেশী যোগ্যতা দিয়েছে। কিন্তু বিব্রতকর ব্যাপার হলো মগজের হিসেবে আপনি বড়জোর একটা শিম্পাঞ্জির সমতূল্য। তাতেও আবার কিন্তু আছে। শিম্পাঞ্জি খালু আর আপনাকে যদি একটা নির্জন দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়, তাহলে আমি বাজি ধরতে পারি আপনি খালুর কাছে হেরে যাবেন।এমন হতে পারে আপনি ভাতের ক্ষুধায় কাতর হয়ে হাবিজাবি খেয়ে পেট খারাপ করে পটল তুলবেন, ওদিকে শিম্পাঞ্জি খালু লতাপাতা খেয়ে দিব্যি মোটাতাজা হয়ে বলবে, শালার মনুষ্যি একটা অপদার্থ জানোয়ার! অথবা শিম্পাঞ্জি খালু আপনাকে খাবারের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে টুটি চেপে পরপারে চালান করে দেবে।

শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে টানাটানি করছি বলে চিন্তায় পড়ে গেলেন? চিন্তার কিছু নাই। খুলে বলছি।

আসলে অন্য প্রাণীদের সাথে মানুষের আসল পার্থক্য হলো দলগত অবস্থানে। মানুষের এত ক্ষমতার সুত্র হলো একজন মানুষ অনেক মানুষের সাথে দলগতভাবে সহাবস্থান করতে পারে বিভিন্ন বিচিত্র পরিস্থিতিতে। পিঁপড়া বা মৌমাছিও দলগত অবস্থানে বেশ মজবুত, কিন্তু তাদের মধ্যে নিয়ম শৃংখলার নমনীয়তা নেই। হাজার হাজার বছর ধরে যে ফরমেটে ওরা কাজ করে তার বাইরে যেতে পারে না। একটা মৌচাক যদি আক্রান্ত হয় তখন সেই সমস্যা মোকাবেলার জন্য রাতারাতি নতুন কোন নিয়ম চালু করতে পারে না ওরা। তারা রাণীকে বিতাড়িত করে নতুন রাষ্ট্র গড়ার কথা ভাবতেও পারে না।
নেকড়ে আর শিম্পাঞ্জিরা যদিও পিপড়াদের তুলনায় অধিক নমনীয় কিন্তু সেটা শুধুমাত্র অল্প কটা নেকড়ে বা শিম্পাঞ্জি হলেই সম্ভব। কোন একটা শিকার ধরার জন্য আক্রমনের দলগত পরিকল্পনা করা সম্ভব তাদের পক্ষে। তবে এটাকে ঠিক সামাজিক সহযোগিতা হিসেবে দেখানো যায় না।

ধরা যাক আপনি একজন শিম্পাঞ্জি এবং আমিও একজন। এখন আপনি যদি কোন কাজে আমাকে লাগাতে চান, সেটার জন্য আগে আমাকে চিনতে হবে, আমার স্বভাব চরিত্র বুঝতে হবে, আমার মধ্যে কোন শয়তানি আছে কিনা সেটা বোঝার শক্তি থাকতে হবে। আপনি যদি আমাকে ভালোভাবে না চেনেন তাইলে কোন কাজে আমাকে নিতে ভরসা পাবেন না। হোমো স্যাপিয়েন্স বা মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা অসংখ্য অচেনা মানুষের সাথেও জোটবদ্ধভাবে পারস্পরিক বোঝাপরার মাধ্যমে যে কোন মিশন সম্পন্ন করতে পারে।

একটা শিম্পাঞ্জির সাথে একটা মানুষের হাতাহাতি লাগলে শিম্পাঞ্জিটা জিতবে, এমনকি দশটা শিম্পাঞ্জীও দশটা মানুষকে হারাতে পারবে। কিন্তু ১০০০ শিম্পাঞ্জিকে ১০০০ মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিলে মানুষই জিতবে কেননা ১০০০ মানুষের মধ্যে ঐকতান সৃষ্টির যে ক্ষমতা মানুষের আছে যেটা শিম্পাঞ্জির নেই। মীরপুর স্টেডিয়ামে এক লাখ শিম্পাঞ্জিকে এনে বসিয়ে দিলে কী ভয়ানক ক্যাচালের সৃষ্টি হবে চিন্তা করতে পারেন? অথচ লাখ লাখ মানুষ স্টেডিয়ামে বসে হরদম আনন্দের সাথে খেলা দেখে শৃংখলা মেনে। এখানেই মানুষের জিত।

তবে মানুষের এই জোটবদ্ধ অবস্থান সবসময় সুখের হয় না এটাও ঠিক। এই মানুষই দলবদ্ধভাবে ভয়ানক সব কর্মকাণ্ড করেছে সমগ্র ইতিহাস জুড়ে। জেলখানা, কনসেনট্রেশান ক্যাম্প, গণহত্যা এসবই যুথবদ্ধ কর্মকাণ্ড।

অন্যদিকে অপরাধ বা অপকর্মের দিক থেকে দেখলে আবার শিম্পাঞ্জিদের জেলখানাও নেই, কনসেনট্রেশান ক্যাম্পও নেই, রাজাকার আলবদরও নেই। সেদিক দিয়ে ওরা মানুষের চেয়ে সেরা।

কিন্তু মানুষের এই দলবদ্ধভাবে সুপরিকল্পিত উপায়ে কাজ করার রহস্যটা কী? হোক সেটা খেলাধুলা কিংবা ব্যবসা বাণিজ্য অথবা খুন খারাবি।

উত্তর হলো – মানুষের অপরিসীম কল্পনাশক্তি।

হ্যাঁ, একমাত্র মানুষের কল্পনার জোরেই অনেক অচেনা মানুষের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে পারে, মানুষ বানিয়ে গল্প কাহিনী লিখতে পারে, সেটা দুনিয়াময় ছড়িয়ে দিতে পারে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাতে বিশ্বাস করাতে পারে, এই সবকিছুর মূলে মানুষের কল্পনাশক্তি। এটার জোরেই আমরা সবাই একটা ধারণায় সম্মিলিতভাবে বিশ্বাস করতে পারি, একই আইনে নিজেদের শৃংখলিত রাখতে পারি, পরস্পরকে সহযোগিতা করতে পারি।

সমগ্র প্রাণীজগতের কিছু ব্যাপার একমাত্র মানুষকে দিয়েই সম্ভব। যেমন আপনি কোন একটা শিম্পাঞ্জিকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে সে যদি আপনাকে একটা কলা খেতে দেয় দেয়, পরকালে এই পূন্যের জোরে সে লক্ষ লক্ষ কলার মালিক হবে। কিন্তু একজন মানুষকে আপনি এটা বিশ্বাস করাতে পারবেন। এই ক্ষমতার জোরেই আমরা সারা পৃথিবী শাসন করি, আর শিম্পাঞ্জিরা বনজঙ্গল, চিড়িয়াখানা কিংবা গবেষণাগারের জেলখানায় আটক থাকে।

পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মের পেছনে কিছু না কিছু গল্প কাহিনীর প্রভাব আছে। সেসব গল্পের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে মানুষ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকে কিংবা ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ করে। কেননা তারা ঈশ্বর ও স্বর্গের কাহিনীতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে।

শুধু ধর্ম না, আইনকানুন বিষয়েও একই কথা প্রযোজ্য। সভ্য যুগে সকল আইন কানুনের অন্যতম ভিত্তি হলো ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার। কিন্তু বাস্তবে মানবাধিকার ব্যাপারটিও একটি রূপকথা যার বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই। বস্তুতপক্ষে মানবের কোন অধিকার নাই, যেমন নেই শিম্পাঞ্জি বা নেকড়ের। পুরো মানবাধিকার ব্যাপারটি একটি গালগল্প যা আমি নিজেরা বানিয়ে অন্যদেরকে বিশ্বাস করতে বলি। এটা খুব আকর্ষণীয় গল্প কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু এ শুধুই গল্প, বাস্তব কিছু না।

রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। যেমন একটা পর্বত হলো সত্যিকারের অস্তিত্ব। আপনি তাকে ছুঁতে পারেন, বেয়ে উঠতে পারেন, পর্বতের মাটি পাথরের ঘ্রাণ নিতে পারেন। কিন্তু আমেরিকা বা ইসরায়েল বা জাপান কোন বাস্তব ব্যাপার না। আপনি আমেরিকা- ইসরায়েল - জাপান নামের কোন অস্তিত্বকে ছুঁয়ে দেখতে পারবেন না। রাষ্ট্র নামক বিষয়টি পুরোপুরি একটা কল্পনা। এটি মানুষের তৈরী এবং মানুষ তাতে প্রবলভাবে বিশ্বাস করে যেমন বিশ্বাস করে ঈশ্বর বা স্বর্গের উপস্থিতি।

কল্পনার এই ঘটনা টাকাপয়সার ক্ষেত্রেও। ধরুন আপনার কাছে ১০০ টাকার একটা নোট আছে। এটা আপনি চিবিয়ে খেয়ে কোন মজা পাবেন না, পানিতে চুবিয়ে সরবত বানানো যাবে না, অলংকার বানিয়ে পরলেও সুবিধার হবে না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছে এটার মূল্য দুই কেজি চিনির সমান। আপনি অচেনা কোন এক দোকানে গিয়ে নোটটি দিয়ে দোকানীকে বললেন দুই কেজি চিনি দিতে। সেই দোকানী লোকটা আপনাকে জিন্দেগীতে কখনো না চিনলেও বিনাবাক্য ব্যয়ে  দুই কেজি চিনি দিয়ে দেবে ১০০ টাকা নামক কাগজের টুকরোর বিনিময়ে।

কেন দিয়েছে? দিয়েছে কেননা সেও আপনার মতো গভর্নরের গল্পটা বিশ্বাস করেছে যে এই টুকরো কাগজটির মূল্য দুই কেজি চিনির সমান। কিন্তু একটা শিম্পাঞ্জিকে কাগজের টুকরোটা দিলে কেমন হবে নিশ্চয়ই বোঝার বাকী নেই।

সম্ভবতঃ টাকা হচ্ছে মানব আবিষ্কৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ফিকশন। পৃথিবীর সব মানুষ সমভাবে ঈশ্বর, মানবাধিকার কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের উপর আস্থাশীল নয়, কিন্তু ডলারের উপর আস্থা আছে সবার, এমনকি ওসামা বিন লাদেনেরও। লাদেন আমেরিকার ধর্ম রাজনীতি সংস্কৃতি সবকিছুকে ঘৃণা করলেও আমেরিকান ডলারের উপর তার প্রেমে কোন খাদ ছিল না।ওই ফিকশনে তার কোন আপত্তি ছিল না।

সুতরাং যেখানে অন্য সকল প্রাণী নদী বৃক্ষ কিংবা বনের পশু যে কোন একটির উপর নির্ভর করে জীবনধারণ করে কিন্তু আমরা মানুষেরা সেখানে দ্বৈত জীবনে অভ্যস্ত। আমাদের জীবনধারণের প্রাথমিক উদ্দেশ্যের সাথে আমরা আরেকটি বিশ্বাসের স্তর নিয়ে বাস করি যা পুরোপুরি কাল্পনিক অস্তিত্ব নিয়ে আছে যেমন জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ঈশ্বর, ডলার, মানবাধিকার ইত্যাদি। সময়ের সাথে সাথে এসব কাল্পনিক অস্তিত্বগুলো অনেক বেশী শক্তিশালী হয়েছে এবং আজকের পৃথিবীতে সেইসব কাল্পনিক বস্তুর প্রভাবই সবচেয়ে বেশী। বলা চলে তারাই আজ পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি। তাদের উপর নির্ভর করছে সমস্ত পৃথিবীর সব মানুষের জীবনধারণ চলন বলন নদী সমুদ্র বন কিংবা পশুপাখির অস্তিত্ব।

এবং এই দ্বিতীয় কাল্পনিক জগতের জন্যই মানুষ আজ পৃথিবী শাসন করছে, অন্য প্রাণীরা তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে বনে জঙ্গলে বাস করছে।


---------------------------------------------------------------------------------------------------------
[Professor Yuval Noah Harari লিখিত WHY HUMANS RUN THE WORLD অনুসরণে লিখিত]

Sunday, November 13, 2016

শূন্যের জয়

শূন্যেরও জয় আছে, শূন্যেরও আছে উৎসব। শূন্য দিয়ে পূর্ণ হয় কোন কোন বিরূপ সময়। যখন মোহ কেটে গিয়ে উধাও চাঁদ ঘোর কেটে বেরিয়ে আসে নতুন উপত্যকা ঘেঁষে।

................................................................................................
চাঁদ সে দণ্ডিত আলো মাথা দিয়ে ঠেলে মূহ্যমান
মেঘে না বেরোয় যবে সমস্ত অপ্রকাশিত গ্রহ
গ্রহানু পেরিয়ে গিয়ে মেঘে ঢাকা আমার শরীর
প্রকাশ না করে তবে এক চন্দ্রসংস্করণের
আগে পরে অশরীর আরও লক্ষ লক্ষ চন্দ্র নিয়ে আসে
নীলিমা স্থাপন করে আমাতে এ ৯ ০ ৯
০ ৯ ০ ৯ ০ সাল কাল জন্মমাসে
বাতাসকে বয়ে চলি সমস্ত অপ্রকাশিত জয়
মেঘের তলায় জয় হয়েছিল, মেঘে উঠে চাঁদ
জয়যুক্ত হল, এই বায়ু যুক্ত জয় যুক্ত আলো
সমান সমগ্র গোল : ফেটে যে-নিঃশ্বাস বায়ু বয়
সে পড়ে তারার অঙ্কে শুয়ে, শুয়ে তারা অঙ্ক পড়ে
জয়যুক্ত জয়যুক্ত জয়, শূন্য, জয়শূন্য নয়
[জয় গোস্বামী]
=====================================



০ ৯ ০ ৯ ০ ৯
*
*
*
০১৬ ০১৬ ০১৬
*
*
*
চাঁদ ডুবে গেলে পর পৃথিবীর অর্ধেক আঁধার এসে আমার ডান হাতে অস্তমিত হয়



শ্বেত রক্ত

পাতাটির শিরা উপশিরায় বহমান স্বচ্ছ শ্বেত রক্ত কণিকায় খাদ্য অনুসন্ধানী পিঁপড়া।

যদি এটি পাতা না হয়ে একটি মানচিত্র হতো তাহলে দৃশ্যমান শিরা উপশিরাগুলো হতো একেকটি নদী নালা খাল। আর মাঝখানের সবুজ টুকরোগুলো একেক খণ্ড জমি।

এ যদি এক স্যাটেলাইট ছবি হতো সবুজ টুকরোগুলো নিশ্চিতভাবে সতেজ ঘাসের মাঠ হতো। আর পিঁপড়াটি কী হতো তখন?

আমার ভূখণ্ড গ্রাস করতে আসা এক অপশক্তি।

পৃথিবীর শিরা উপশিরা দিয়েও নানাবর্ণের রক্ত প্রবহমান। মাটির কান্না চোখে দেখা যায় না।

Saturday, November 12, 2016

বাড়ানো পাত



অলীক, তোমার স্বপ্ন থেকে শান্ত হাতের
একটি দুটি রৌদ্রেপোড়া
সাহস
আমায় ঋণ দিয়ে যাও, দোলের দিনে
আবির খেলতে ঋণ দিয়ে যাও অলীক তোমার
সকল তামস কলুষ হরণ
গানের অমন ঝর্নাতলায় হাসতে পারি খেলতে পারি
এমন একটি দিন দিয়ে যাও যখন তোমার সোনার বরণ 
গ্রীষ্ম লেগে কাতর তখন হাতের কাছে হাতপাখা নাও, রৌ্দ্রেপোড়া
হাতপাখা নাও....
............
অলীক তোমার স্বপ্ন থেকে ্ আর একটিবার
শান্ত হাতে আদর করার একটি দুটি
ছল খুঁজে দাও রৌদ্রেপোড়া.......
[ঋণ-জয় গোস্বামী]




****** ****** *******

সদ্য চোখ মেলা পাতাটিকেও হাত পেতে বলতে হয় আলো দাও, বেঁচে থাকি। রক্তিম কাণ্ড ছেড়ে নিজস্ব সবুজে রূপান্তরিত হবার প্রাক্কালে সূর্যের সাথে তার নিজস্ব বোঝাপড়া।

Friday, November 11, 2016

সালোক সংশ্লেষণ



উদ্ভিদের হৃদয় নেই, শুধু শিরা উপশিরায় বহমান প্রাণ। প্রতিটি উদ্ভিদের শিরা উপশিরার বৈশিষ্ঠ্য আলাদা, আকার, চেহারা, বর্ণ সব আলাদা। এটা আমরা সবাই জানি। ভূমি থেকে ৭০ ফুট উপরে কংক্রিট বান্ধব পরিবেশেও এই দুটো লতানো উদ্ভিদ তাদের পাতাগুলো হেমন্তের রোদে মেলে দিয়েছে, যেমন দিত খোলা হাওয়ায় মেতে থাকা শ্যামল মাটির উঠোন জুড়ে। হৃদয়হীন উদ্ভিদ কখনো সৌন্দর্য বিলাতে, আনন্দ ছড়াতে কার্পন্য করে না। যে কোন পরিবেশে এরা নিজেদের চরিত্র অক্ষুন্ন রাখে। বিরূপ অবস্থাতেও এরা অক্সিজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইডের ভারসাম্য ঠিক রাখে। এদের হাতে বৈশ্বিক সকল সৌন্দর্য নিরাপদ, নিষ্কলুষ। এরাই তথাকথিত প্রকৃতি, এদের নিয়েই আমাদের পরিবেশ। এই এক গুচ্ছ সজীব পাতাতেও খুঁজে পাওয়া যায় নির্মল আনন্দ। অদ্য প্রভাতে চক্ষু মেলিয়া দেখা হয়ে গেল টুকরো সৌন্দর্যের প্রতিফলিত আলোটি।

তবে বিষয়টি আমার পক্ষে সৌন্দর্য উপভোগের হলেও উদ্ভিদের পক্ষে বেঁচে থাকার অতি জরুরী সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া, যা দিয়ে উদ্ভিদ সূর্যের আলোর সাহায্যে বেঁচে থাকার মতো খাবার তৈরী করে।

Thursday, November 10, 2016

এ ভাঙা সুখের মাঝে নয়ন জলে.....

অনেক বছর আগে কোথাও পড়েছিলাম Happiness is a journey, not a destination. কথাটা আমার খুব প্রিয়। আমার স্বাচ্ছন্দ্যময় অবসরে এই সুখ ভ্রমণের স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করি। যখন বর্তমান নিয়ে অতিষ্ট থাকি, তিক্ততার আগুন এসে পুড়িয়ে মারে, তখন ওইসব ভ্রমণের কথা সুশীতল দখিনা হাওয়ার কাজ করে। এই জীবনে আর কিছু পাওয়া না হলেও ওই প্রাপ্তিগুলো চিরকালীন সম্পদ হয়ে থাকবে। মানুষ বুড়ো হলেও যৌবনের সোনালী স্মৃতিগুলো মিথ্যে বা অর্থহীন হয়ে যায়  না, তেমনি থাকবে ওই অর্জনগুলো। অক্ষর-শব্দ-বাক্যবিন্যাসে তৈরী হতে পারে বায়বীয় এক সুখ স্বর্গোদ্যান।

কোর্সেরার সৌজন্যে A Life of Happiness and Fulfillment কোর্সটি শুরুর পর একটি ব্যক্তিগত মূল্যায়ন পর্বে অংশগ্রহন করতে হলো। সুখ বিষয়ে নিজের মতো করে লিখতে বলা হলো। ফলাফল পর্বে দেখা গেল সুখ সংক্রান্ত মূল্যায়ন পর্বের একটিতে আমার রেটিং আশাতীত ভালো হলো। বলা হলো এই পর্বে আমি সর্বোচ্চ ২% এর দলে ঠাঁই পেয়েছি। এই কোর্সের গবেষণাকর্মের মধ্যে অন্যতম একটি পর্যবেক্ষণ হলো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ অন্য বৈষয়িক বা বস্তুগত লাভের জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দেয়। এই অবস্থানের বিপরীতে আছে নাকি মাত্র ৬% মানুষ। সুতরাং আমার ২% দলে যুক্ত হতে পারাটা নিঃসন্দেহে সুখের বিষয়। তার মানে এই নয় যে আমি সর্ববিষয়ে সুখী। সাত পর্বের মাত্র একটিতে আমার রেটিং ভালো। বাকীগুলোতে আমার আরো অনেক উন্নতি করতে হবে।

তবে যে কারণে এই একটিতে ভালো রেটিং পাওয়া হলো তার মূল কারণটি আমার সাবেক ক্যারিয়ারের সমাপনীর সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত। যে কারণে আমার  দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ার জীবনের সমাপনী টানতে হয়েছে তার সাথে সুখী হবার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান যুক্ত আছে। পুরো লেখাটি নীচে বঙ্গানুবাদ করে দেয়া হলো।

শুরু থেকে বলি। আমি যেখানে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম সেটি সহজ কোন জায়গা ছিল না। খুব কঠিন অবস্থা থেকে, কঠোর পরিশ্রম এবং শ্রম ব্যয় করে আমি একটি মোটামুটি উচ্চ ধাপে পৌঁছে গিয়েছিলাম অল্পদিনের মধ্যেই। আমার একাডেমিক রেজাল্ট খুব বেশী সন্তোষজনক ছিল না বলে আমি ক্যারিয়ার বদলের দিকে যাইনি। তবে অন্যন্য বন্ধু কলিগ অনেকবার চাকরী বদল করলেও আমি না করার কারণটি যতটা না অক্ষমতা তার চেয়ে বেশী ছিল বিদ্যমান ক্যারিয়ারের অগ্রযাত্রা।

যে চেয়ারে বসে প্রথমদিন থেকে যাত্রা শুরু করি, সেই চেয়ারটি আমাকে কখনো বিপদে ফেলে দেয়নি। বরং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছিল। চাকরী শুরুর মাত্র দেড় বছরের মাথাতেই বড় ধরণের প্রমোশন পেয়ে যাই, যা বর্তমানে দশ বছর চাকরী করেও পায়নি অন্য কলিগরা। সেই প্রমোশনের পেছনে কাজ করেছিল আমার শ্রম এবং নিষ্ঠা। আমি আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম কর্মক্ষেত্রে।

পাঁচ বছর পর আমি নিজেকে এমন জায়গায় আবিষ্কার করি যেখানে আমি প্রতিষ্ঠানের অপরিহার্য একটি অঙ্গ হয়ে পড়ি। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, আমি আরো উপরের দিকে যেতে থাকি। দশ বছরের মাথায় আমি আমার জন্য বরাদ্দ অবস্থানের সর্বোচ্চ চুড়ায় পৌঁছে যাই। যেখানে আমাকে আর কাজ করতে হয় না, শুধু সিদ্ধান্ত দিলেই হয়। আমি আমার টিমকে এমনভাবে গড়ে নিয়েছিলাম যেখানে সবাই নিজ নিজ কাজ করলে লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যায়। অন্য সব টিম যেখানে ক্রমাগত বিশৃংখল অবস্থায় চিৎকার চেঁচামেচি করে কাজ করতো সেখানে আমার টিমটা ছিল সুসংহত, সংগঠিত অথচ শান্তিপূর্ণ। আমি এই শান্তিপূর্ণ অবস্থানের সুযোগে নিজের মতো কিছু কাজ ও পড়াশোনা করতে পারতাম।

আমি ছিলাম অফিসের সবচেয়ে সুখী মানুষ। এমনকি স্বচ্ছলতর আত্মীয় বন্ধুদের মধ্যেও আমার অবস্থান ছিল সবচেয়ে নিরুপদ্রপ এবং সন্তোষজনক। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই অবস্থানে থেকে বাকী সময় পার করার। এই পর্যন্ত ঠিকঠাক চলছিল সবকিছু।

তারপর কোন এক সকালবেলার বিশেষ সভায় সর্বোচ্চ কতৃপক্ষ থেকে আমাকে নতুন একটি কাজের দায়িত্ব নেবার জন্য অনুরোধ করা হলো। আমি জানতাম ওই দায়িত্ব নিলে আমি আর্থিকভাবে অনেক লাভবান হবো এবং আমার ভবিষ্যত আরো আরো উজ্জ্বলতর হবে। সুযোগের দরোজা আমার জন্য উন্মুক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কোন প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল না- হাত বাড়ালেই আকাশ। কিন্তু সমস্যা শুধু একটি।

এই কাজটি নিলে আমার বর্তমান নিরুপদ্রপ সুখী জীবনটা থাকবে না। নতুন দায়িত্বটি এমন একটা জায়গায় যেখানে সবসময় অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে যে অস্থিতিশীলতা ওই দায়িত্বের একটি চরিত্রবিশেষ। এখন আমি সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে পরিবারকে সময় দেই। তখন আমি রাত দশটায়ও ফিরতে পারবো না। শুধু তাই না, আমাকে দিনরাত এমনকি ছুটির দিনেও অস্থির থাকতে হবে। শুধু ক্যারিয়ার বা টাকার জন্য ওটা সহ্য করতে গেলে আমার সুখী জীবনকে বিসর্জন দিতে হবে। আমি সেটা করতে প্রস্তুত ছিলাম না। আমি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম নতুন দায়িত্বটি। সমস্ত ক্যারিয়ারে এই প্রথম কোন কাজকে 'না' বললাম।

খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার এতদিনকার উন্নতির সিঁড়িটা বন্ধ হতে শুরু করলো। এতকালের সুনজরের সার্চলাইটটি আমার উপর থেকে সরে গেলেও আমি গা করিনি। কেননা আমি নিজের কাজটি সুষ্ঠুভাবে করে যাচ্ছিলাম তৃপ্তির সাথে। আমার টিম আমার কাছে বিশ্বস্ত, ওরা আমার সকল নির্দেশ জান দিয়ে পালন করে। আমার কাজের কোন খুঁত বের করতে পারে না কেউ। তা না পারলেও অন্য একটি কাজ করে বসলো একদিন।

আমার মাথার উপর অযোগ্য লোক এনে বসিয়ে দিল। যার কাজ হলো বিনা কারণে আমার কাজে হস্তক্ষেপ করা এবং আমাকে মানসিকভাবে চাপে রাখা। যদি যোগ্য লোক হতো, আমার চেয়ে বেশী কাজ জানতো, আমার চেয়ে বেশী বুঝতো, তবু হয়তো কিছুটা মানতে পারতাম। কিন্তু এটা মানা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। তবু মাস গেলে মোটামুটি ভালো আকারের বেতন জমা হয় অ্যাকাউন্টে, সে কারণে খবরদারী সহ্য করে কিছুকাল চালাতে পেরেছি। কিছুদিন এমন চলার পরও আমাকে যখন কাবু করা গেল না, তখন নতুন পথ ধরলো। আমার চেয়ে অযোগ্য লোকদের প্রমোশন ও অন্যন্য সুবিধা দেয়া শুরু করলো। একবার, দুবার, কয়েকবার ঘটলো ব্যাপারটা। যে আমার এসিসট্যান্ট হবারও যোগ্যতা রাখে না সেরকম একজনকে অন্য একটা বিভাগের প্রধান করে দেয়া হলো। এটা পরোক্ষ অপমান প্রচেষ্টা। টাকার ব্যাপারে আমার কোন রা না থাকলেও সম্মানের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল বরাবরই। বলা চলে ওটাই আমার মূল পুঁজি। এবারসহ্য করা গেল না।

আর বিলম্ব হলো না সিদ্ধান্ত নিতে। উপযুক্ত সময়ে পদত্যাগপত্র দাখিল করে নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম। সুখের জন্য আমি ক্যারিয়ারের উন্নতি ও সমৃদ্ধিকে বিসর্জন দিলাম।

এই কোর্সের একটি উদাহরণ ছিল এরকম।

একটি রেস্তোঁরার বুফেতে সালাদ ও  চিকেন রাখা আছে। সালাদ পছন্দ করে কিন্তু চিকেন অপছন্দ করে তেমন মানুষদের ওখানে পাঠানো হলে দেখা গেল অধিকাংশ মানুষের প্লেটে সালাদের চেয়ে চিকেনের পরিমাণ বেশী এবং খাওয়া শেষে দেখা গেল অধিকাংশ প্লেটে চিকেন উচ্ছিষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এর মানে হলো সালাদ-পছন্দ মানুষও টাকার হিসেবটা মাথায় রেখে প্লেট ভর্তি করেছিল, কেননা চিকেনের দাম সালাদের চেয়ে বেশী। জরিপে দেখা গেছে টাকার জন্য সুখ বিসর্জন দেয়া মানুষের অংশ প্রায় ৯৪%।

নিজেকে প্রশ্ন করি - অধিকাংশ মানুষের বিপরীত এবং অনিশ্চিত পথে হেঁটে আমি কী সুখী?

হ্যাঁ, এখনো পর্যন্ত সুখীই। ত..বু....... প্রা..ণ.... কেন কাঁদে রে?
উত্তর তেমন কঠিন নয়। দুঃখ জাগানিয়া বাঁশীর সুরও সুখী মানুষের বিনোদন!

[ঈষৎ সংক্ষেপিত]
----------------------------------------------------

**শিরোনাম কৃতজ্ঞতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সময় বিরূপতা এবং কবিতা মলম

স্বল্পায়ু জীবনে মানবসৃষ্ট দুর্যোগে কতখানি ক্ষত বয়ে বেড়াই, কতগুলো অমূল্য দিনকে হারিয়ে ফেলি অন্ধকারে, তার হিসেব না রেখে ভুলে যেতে পারলেই সবচেয়ে মঙ্গলময় হতো। কিন্তু সমস্যাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিতে চাইলেও লাল প্ল্যাকার্ড নিয়ে যখন চোখের সামনে দাঁড়ায় বিরূপ সময়, তখন উটপাখির মতো বালিতে মুখ গোঁজার সুযোগ না পেয়ে মানসিক আশ্রয়ের সন্ধানে কবিতায় মুখ গোঁজা যায়। কবিরা কঠিন কথাকে শব্দে সহনীয় করে যে নিঃশব্দ সুর তৈরী করে, সেই শব্দসুর এসে অযাচিত ক্ষতের প্রলম্বিত বেদনাগুলো অনায়াসে হালকা করে দেয়..........



কোমল বাতাস এলে ভাবি, কাছেই সমুদ্র! তুই তোর জরার হাতে কঠিন বাঁধন দিস। অর্থ হয়, আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে সমুদ্র স'রে যাবে শীতল স'রে যাবে মৃত্যু স'রে যাবে। তবে হয়তো মৃত্যু প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে। অন্ধকার আছি, অন্ধকার থাকবো, বা অন্ধকার হবো।

আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে।
[জরাসন্ধ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়]

নির্বোধের আলস্যে কেবল ম্লান হাস্যে জানিয়েছি
মনোরম অস্তরাগে শুধু আমার গোধূলি-ভাষ্য
মূল্যবোধের আর যা কিছু সত্য তাই হতাশার
পরম, বিশ্বস্ত অনুগামী, প্ররোচক বুঝি স্বেচ্ছামরণের,

এইমতো জীবনের সাথে চলে কানামাছি খেলা
এবং আমাকে নিষ্কপর্দক, নিষ্ক্রিয়, নঞর্থক
ক'রে রাখে; পৃথিবীতে নিঃশব্দে ঘনায় কালবেলা!
আর আমি শুধু আঁধারে নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটে রক্তাক্ত জবার মতো
বিপদ-সংকেত জ্বেলে একজোড়া মূল্যহীন চোখে
পড়ে আছি মাঝরাতে কম্পমান কম্পাসের মতো
                                    অনিদ্রায়।

[উত্তরাধিকার, শহীদ কাদরী]


অধঃপতনের ধুম সবদিকে , সভ্যতার সেয়ানা গুন্ডার মতো
মতবাদ; রাজনীতি, শিল্পকলা শ্বাস ফেলছে এদিকে ওদিকে,
শহরের সবদিকে সাজানো রয়েছে শুধু শাণিত  দুর্দিন,
বন্যা অবরোধ, আহত বাতাস !

আমি আর কার কাছে যাবো? কোনদিকে যাবো?
কোন শহরের দিকে যাবো আমি ? যৌবনের জ্বলন্ত শিরায় আজ
এই যে জ্বলছে চাঁদ জ্যোৎস্না, চাঁদ জ্যোৎস্না আর জ্যোৎস্নাফুল,
হৃদয়ের ভিতরে ব্যাকুল,
জ্বলছে এই যে স্বপ্ন, স্মৃতি, শব্দ অলঙ্কার
অভাবের মরীচিকা, এ শহর কার?

[দূরযাত্রা - আবুল হাসান]


Sunday, November 6, 2016

এসো নিজে পড়ি

হঠাৎ করে হাতে অঢেল সময় চলে আসলো। রীতিমত বড়লোক। এত সময় ধুয়ে পানি খাবো? কর্মসময় কমে যাবার প্রাক্কালে অলস সময়ের কানে কানে বলে গেল, বসে থাকিস না, কাজে লাগা, হাত পা মুখ চোখ কান, মাথা মগজ সব অচল হয়ে যাবে। জ্ঞান, আনন্দ আর বন্ধুতায় বয়সটয়স কোন ব্যাপার না।

তিন বছর পর সাহস করে edX এ ঢুকলাম। বেছে টেছে MIT এর একটা কোর্স পছন্দ করলাম। Supply Chain Analytics যেটা আমার অনলাইন কাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এই লাইনে অামার আত্মবিশ্বাস অনেক বেশী। চাইলে পিএইডি থিসিসও করে ফেলতে পারি অথবা কেউ পিএইডি করলে তার এডভাইজারও হতে পারি। এত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও প্রথম সপ্তাহের কোর্স ম্যাটেরিয়াল দেখে আক্কেল গুড়ুম। এখানকার অধিকাংশ পড়াশোনা হলো অংকের উপর ভর দেয়া। আমার SCM এর বাস্তব অভিজ্ঞতা আর থিউরির মধ্যে পার্থক্যের প্রধান অংশ হলো অংক। এই অংক, এই ফরমূলা আমার বহুল চেনা হলেও এই বয়সে আর এসব ধরতে ইচ্ছে করে না। তবু ওষুধের তেতো গেলার মতো গিলতে শুরু করেছি। কিন্তু সারাক্ষণ তেতোর উপর থাকলে মাথা নষ্ট হবার সম্ভাবনা।

তাই আবার একটু চোখ ঘুরিয়ে হালকার উপর সমাজবিজ্ঞানের একট কোর্স পছন্দ করলাম
Wellesley College এর। Global Inequality নামের এই কোর্সটা ইন্টারেস্টিং মনে হলো প্রথম লেকচারটা শুনেই। দুনিয়াজোড়া প্রচুর অনিয়ম, অবিচার জারি আছে কোন সন্দেহ নেই, তাই এই কোর্সটা দুনিয়ার হালচালের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বিশেষ করে এখানে গার্মেন্টস সেক্টরের অনিয়ম অবিচারগুলো নিয়ে বেশ কিছু পর্ব আছে এবং দুটো ডকুমেন্টারী মুভি নিয়ে বেশ ভালো আলোচনা আছে কোর্সে China Blue এবং Made in LA নামে। এই দুটোই চীন এবং ল্যাটিন দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবনযাপনের উপর। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের। তিন দিক মিলিয়ে এই কোর্সটা ভালো লাগতে শুরু করেছে। এটাও edX কোর্স।

সময় শূন্যতা মোটামুটি পূর্ণ করার পর ইচ্ছে হলো coursera থেকে একটু ঘুরে যাই। ওখানে আজকাল প্রায় সব কোর্সে পয়সা। আগের মতো অবস্থা নাই। দেখতে গিয়ে চোখ আটকে গেল অন্যরকম একটা কোর্সের দিকে। A Life of Happiness and Fulfillment. এই কোর্সটা Indian School of Business এর। বিজনেস স্কুল কেন  এমন কোর্স রেখেছে সেই কৌতুহল থেকে এনরোল করালাম একটু দেখে সটকে পড়বো ভেবে। কিন্তু এটার শুরুটা এমন চমকপ্রদ, ঢুকেই আটকে গেলাম চৌম্বকীয় লেকচারের টানে। এই কোর্সটার পরতে পরতে আনন্দের সম্ভার। অনেক ব্যস্ত নই বলে এটাকেও রেখে দিলাম। সবচেয়ে মজার কথা হলো এটা সবচেয়ে কম প্রায়োরিটি পাবার কথা থাকলেও, আমাকে বেশী টানতে শুরু করছে এই কোর্সটাই।

অলস সময় এবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসতে বাধ্য হলো। আগামী বছরের প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরী করার জন্য এখনই সঠিক প্রস্তুতিকাল।