Sunday, November 27, 2016

মেঘ ডাকছে ডাকুক, আমার কাছেই থাকুক....

তাঁর সম্পর্কে মৃণাল বসু চৌধুরী লিখেছিলেন - বাংলা কবিতার এই অনুপম বাতাবরণে, কখনও হেমন্তের অরণ্যের মধ্যে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে কখনও-বা উড়ন্ত সিংহাসনে বসে জ্বলন্ত রুমাল উড়িয়ে, ছন্দ অন্তর্জাল ছিঁড়তে ছিঁড়তে, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন কবিতামালা নিয়ে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন যে কবি, তাঁর নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নামের সাথে প্রথম যে কবিতার লাইনগুলো চোখে ভাসে তা হলো-

সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয় তখনই
পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্ণিশে কার্ণিশে,
ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার সময়, বাড়ির ভেতরে বাড়ি, পায়ের ভেতরে পা,
বুকের ভেতরে বুক
আর কিছু নয়।


আর আমরা যখন শক্তির কবিতা ছাড়িয়ে আরো কাছাকাছি গিয়ে তাঁকে ছুঁতে চাই, তখন তিনি বলে ওঠেন-
একটু নেমে দাঁড়াও, যদি আমার কাছে দাঁড়াতে হয়
একটু উঠে এসো, যদি আমার কাছে দাঁড়াতে হয়
দুখানি হাত বাড়াতে হয়, বাহিরে টান ছাড়াতে হয়,
একটু উঠে একটু নেমে আমার কাছে দাঁড়াতে হয়।

তারপর আমরা যখন আকাশে ভাসতে ভাসতে আরো উর্ধ্বমুখী হয়ে নিজেদের কোথাও হারিয়ে ফেলতে যাই তখন তিনি পিছুডাক দিয়ে বলেন-
সফলতা সব নয়, সে তো শুধু উলঙ্গের কাছে
প্রকৃত পোশাক পরে দেখা দেওয়া
কিংবা শুধু সমুদ্রের তীরে
পাহাড়ের গল্প বলে তিক্ত করা গল্পের আসর
মানুষের আগুপিছু, মানুষের জানার তো নয়!

তারপর অবলীলায় তিনি আমাদের স্বপ্ন পেরিয়ে নতুন অচেনা জগতের প্রতি আহবান করেন-
যদি কোনদিন যাই মেঘের ওপারে

তোমাকেও নেওয়া যেতে পারে ।
তারপরে, পথ নেই । ফুটে আছে ফুলের প্রদীপ
তুমি কি পোড়াবে কিছু, জ্বালিয়ে নেবে না সন্ধ্যাদীপ ?
আরও কিছুক্ষণ যেতে হবে
পথ বড়ো সঙ্কীর্ণ, কঠোর

তারই মধ্যে হাওয়া এলোমেলো -
বলে, শান্ত, কে এখানে এলো ?


এখানে এসে আমাকে থেমে যেতে হয়। আমি কোথায় যাবো? কোথাও যাবো কী? কে নেবে আমায়? তখন তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন-
মেঘ ডাকছে ডাকুক
আমার কাছেই থাকুক
ভালো থাকবো সুখো থাকবো
এই কামনা রাখুক।

ঠিক তাই। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন সুরেও তিনি আমাদের জানাতে থাকেন-
ছোট্ট হয়েই আছে
আমার, না হয় তোমার, না হয় তাহার বুকের কাছে
দুঃখ নিবিড় একটি ফোঁটায় - দুঃখ চোখের জলে
দুঃখ থাকে ভিখারিনীর একমুঠি সম্বলে ।
ছোট্ট হয়েই আছে
একের, না হয় বহুর, না হয় ভিড়ের বুকের কাছে ।
একটি ঝিনুক তাকে
জন্ম থেকেই, একটু-আধটু, বাইরে ফেলে রাখে ।।


তারপর তাঁর মুখ থেকেই চলে যাবার আশংকা ধ্বনিত হয়- হয়তো নিজেরই অজান্তে-
এই যে আছি, থাকবো না আর
সময় হলে লুকিয়ে যাবার
তখন কি কেউ দেখতে পাবে
আমার সঙ্গে পথ হারাবে ?
কক্ষনো নয়,কক্ষনো না
আমিতো নই সবার চেনা


অতঃপর তিনি থামেননি। তাঁকে হাওয়া মেঘ সরিয়ে উর্ধ্বাকাশ পেরিয়ে উড়ে যেতে হয়। তারপর ধান শালিকের দেশে ঘাসের গন্ধ মেখে তিনি মাটির মমতা জড়ানো কন্ঠে বলেন-
একা লাগে, ভারি একা লাগে
তোমাদের ছেড়ে এসে অমূল বৈরাগে
একা লাগে, ভারি একা লাগে
এখানে লাফায় ঘাসে পোকা
আঙ্গিনায় মানুষের খোকা
এখানে দুরন্ত ঘাসে পোকা ।
এখানে উদ্বেগ নেই মেঘে
দেখার মতন নেই জেগে
কেউ, এক দুঃখে ও আবেগে ...
একা লাগে বড় একা লাগে ।

না, কবি। আপনার একা লাগবে না লাখো পাঠকের হৃদয় ঝংকারে। যে সুর আপনার শব্দ বাক্যের অলংকারে আপনি আমাদের পরিয়ে দিয়েছেন, সেই অক্ষর আমরা এখনো প্রতিনিয়ত ধারণ করে আছি। আপনার সুরেই বলি-
মানুষের অন্ধকার, মানুষের আলোর সাঁতারে
যে কেউ, যে কোন কিছু, ভেসে যেতে পারে?

আপনি ভেসে যাননি। অগণিত মানুষের আলোর সমুদ্রেই জেগে আছেন আপনি, হে প্রিয় কবি!

..................................................................................
[শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনের কবিতানুভূতি]

No comments: