Thursday, November 10, 2016

এ ভাঙা সুখের মাঝে নয়ন জলে.....

অনেক বছর আগে কোথাও পড়েছিলাম Happiness is a journey, not a destination. কথাটা আমার খুব প্রিয়। আমার স্বাচ্ছন্দ্যময় অবসরে এই সুখ ভ্রমণের স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করি। যখন বর্তমান নিয়ে অতিষ্ট থাকি, তিক্ততার আগুন এসে পুড়িয়ে মারে, তখন ওইসব ভ্রমণের কথা সুশীতল দখিনা হাওয়ার কাজ করে। এই জীবনে আর কিছু পাওয়া না হলেও ওই প্রাপ্তিগুলো চিরকালীন সম্পদ হয়ে থাকবে। মানুষ বুড়ো হলেও যৌবনের সোনালী স্মৃতিগুলো মিথ্যে বা অর্থহীন হয়ে যায়  না, তেমনি থাকবে ওই অর্জনগুলো। অক্ষর-শব্দ-বাক্যবিন্যাসে তৈরী হতে পারে বায়বীয় এক সুখ স্বর্গোদ্যান।

কোর্সেরার সৌজন্যে A Life of Happiness and Fulfillment কোর্সটি শুরুর পর একটি ব্যক্তিগত মূল্যায়ন পর্বে অংশগ্রহন করতে হলো। সুখ বিষয়ে নিজের মতো করে লিখতে বলা হলো। ফলাফল পর্বে দেখা গেল সুখ সংক্রান্ত মূল্যায়ন পর্বের একটিতে আমার রেটিং আশাতীত ভালো হলো। বলা হলো এই পর্বে আমি সর্বোচ্চ ২% এর দলে ঠাঁই পেয়েছি। এই কোর্সের গবেষণাকর্মের মধ্যে অন্যতম একটি পর্যবেক্ষণ হলো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ অন্য বৈষয়িক বা বস্তুগত লাভের জন্য নিজের সুখকে বিসর্জন দেয়। এই অবস্থানের বিপরীতে আছে নাকি মাত্র ৬% মানুষ। সুতরাং আমার ২% দলে যুক্ত হতে পারাটা নিঃসন্দেহে সুখের বিষয়। তার মানে এই নয় যে আমি সর্ববিষয়ে সুখী। সাত পর্বের মাত্র একটিতে আমার রেটিং ভালো। বাকীগুলোতে আমার আরো অনেক উন্নতি করতে হবে।

তবে যে কারণে এই একটিতে ভালো রেটিং পাওয়া হলো তার মূল কারণটি আমার সাবেক ক্যারিয়ারের সমাপনীর সাথে গভীর সম্পর্কযুক্ত। যে কারণে আমার  দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ার জীবনের সমাপনী টানতে হয়েছে তার সাথে সুখী হবার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান যুক্ত আছে। পুরো লেখাটি নীচে বঙ্গানুবাদ করে দেয়া হলো।

শুরু থেকে বলি। আমি যেখানে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম সেটি সহজ কোন জায়গা ছিল না। খুব কঠিন অবস্থা থেকে, কঠোর পরিশ্রম এবং শ্রম ব্যয় করে আমি একটি মোটামুটি উচ্চ ধাপে পৌঁছে গিয়েছিলাম অল্পদিনের মধ্যেই। আমার একাডেমিক রেজাল্ট খুব বেশী সন্তোষজনক ছিল না বলে আমি ক্যারিয়ার বদলের দিকে যাইনি। তবে অন্যন্য বন্ধু কলিগ অনেকবার চাকরী বদল করলেও আমি না করার কারণটি যতটা না অক্ষমতা তার চেয়ে বেশী ছিল বিদ্যমান ক্যারিয়ারের অগ্রযাত্রা।

যে চেয়ারে বসে প্রথমদিন থেকে যাত্রা শুরু করি, সেই চেয়ারটি আমাকে কখনো বিপদে ফেলে দেয়নি। বরং সামনের দিকে এগিয়ে নিয়েছিল। চাকরী শুরুর মাত্র দেড় বছরের মাথাতেই বড় ধরণের প্রমোশন পেয়ে যাই, যা বর্তমানে দশ বছর চাকরী করেও পায়নি অন্য কলিগরা। সেই প্রমোশনের পেছনে কাজ করেছিল আমার শ্রম এবং নিষ্ঠা। আমি আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম কর্মক্ষেত্রে।

পাঁচ বছর পর আমি নিজেকে এমন জায়গায় আবিষ্কার করি যেখানে আমি প্রতিষ্ঠানের অপরিহার্য একটি অঙ্গ হয়ে পড়ি। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, আমি আরো উপরের দিকে যেতে থাকি। দশ বছরের মাথায় আমি আমার জন্য বরাদ্দ অবস্থানের সর্বোচ্চ চুড়ায় পৌঁছে যাই। যেখানে আমাকে আর কাজ করতে হয় না, শুধু সিদ্ধান্ত দিলেই হয়। আমি আমার টিমকে এমনভাবে গড়ে নিয়েছিলাম যেখানে সবাই নিজ নিজ কাজ করলে লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যায়। অন্য সব টিম যেখানে ক্রমাগত বিশৃংখল অবস্থায় চিৎকার চেঁচামেচি করে কাজ করতো সেখানে আমার টিমটা ছিল সুসংহত, সংগঠিত অথচ শান্তিপূর্ণ। আমি এই শান্তিপূর্ণ অবস্থানের সুযোগে নিজের মতো কিছু কাজ ও পড়াশোনা করতে পারতাম।

আমি ছিলাম অফিসের সবচেয়ে সুখী মানুষ। এমনকি স্বচ্ছলতর আত্মীয় বন্ধুদের মধ্যেও আমার অবস্থান ছিল সবচেয়ে নিরুপদ্রপ এবং সন্তোষজনক। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই অবস্থানে থেকে বাকী সময় পার করার। এই পর্যন্ত ঠিকঠাক চলছিল সবকিছু।

তারপর কোন এক সকালবেলার বিশেষ সভায় সর্বোচ্চ কতৃপক্ষ থেকে আমাকে নতুন একটি কাজের দায়িত্ব নেবার জন্য অনুরোধ করা হলো। আমি জানতাম ওই দায়িত্ব নিলে আমি আর্থিকভাবে অনেক লাভবান হবো এবং আমার ভবিষ্যত আরো আরো উজ্জ্বলতর হবে। সুযোগের দরোজা আমার জন্য উন্মুক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কোন প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল না- হাত বাড়ালেই আকাশ। কিন্তু সমস্যা শুধু একটি।

এই কাজটি নিলে আমার বর্তমান নিরুপদ্রপ সুখী জীবনটা থাকবে না। নতুন দায়িত্বটি এমন একটা জায়গায় যেখানে সবসময় অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে যে অস্থিতিশীলতা ওই দায়িত্বের একটি চরিত্রবিশেষ। এখন আমি সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে পরিবারকে সময় দেই। তখন আমি রাত দশটায়ও ফিরতে পারবো না। শুধু তাই না, আমাকে দিনরাত এমনকি ছুটির দিনেও অস্থির থাকতে হবে। শুধু ক্যারিয়ার বা টাকার জন্য ওটা সহ্য করতে গেলে আমার সুখী জীবনকে বিসর্জন দিতে হবে। আমি সেটা করতে প্রস্তুত ছিলাম না। আমি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম নতুন দায়িত্বটি। সমস্ত ক্যারিয়ারে এই প্রথম কোন কাজকে 'না' বললাম।

খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার এতদিনকার উন্নতির সিঁড়িটা বন্ধ হতে শুরু করলো। এতকালের সুনজরের সার্চলাইটটি আমার উপর থেকে সরে গেলেও আমি গা করিনি। কেননা আমি নিজের কাজটি সুষ্ঠুভাবে করে যাচ্ছিলাম তৃপ্তির সাথে। আমার টিম আমার কাছে বিশ্বস্ত, ওরা আমার সকল নির্দেশ জান দিয়ে পালন করে। আমার কাজের কোন খুঁত বের করতে পারে না কেউ। তা না পারলেও অন্য একটি কাজ করে বসলো একদিন।

আমার মাথার উপর অযোগ্য লোক এনে বসিয়ে দিল। যার কাজ হলো বিনা কারণে আমার কাজে হস্তক্ষেপ করা এবং আমাকে মানসিকভাবে চাপে রাখা। যদি যোগ্য লোক হতো, আমার চেয়ে বেশী কাজ জানতো, আমার চেয়ে বেশী বুঝতো, তবু হয়তো কিছুটা মানতে পারতাম। কিন্তু এটা মানা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। তবু মাস গেলে মোটামুটি ভালো আকারের বেতন জমা হয় অ্যাকাউন্টে, সে কারণে খবরদারী সহ্য করে কিছুকাল চালাতে পেরেছি। কিছুদিন এমন চলার পরও আমাকে যখন কাবু করা গেল না, তখন নতুন পথ ধরলো। আমার চেয়ে অযোগ্য লোকদের প্রমোশন ও অন্যন্য সুবিধা দেয়া শুরু করলো। একবার, দুবার, কয়েকবার ঘটলো ব্যাপারটা। যে আমার এসিসট্যান্ট হবারও যোগ্যতা রাখে না সেরকম একজনকে অন্য একটা বিভাগের প্রধান করে দেয়া হলো। এটা পরোক্ষ অপমান প্রচেষ্টা। টাকার ব্যাপারে আমার কোন রা না থাকলেও সম্মানের ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল বরাবরই। বলা চলে ওটাই আমার মূল পুঁজি। এবারসহ্য করা গেল না।

আর বিলম্ব হলো না সিদ্ধান্ত নিতে। উপযুক্ত সময়ে পদত্যাগপত্র দাখিল করে নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম। সুখের জন্য আমি ক্যারিয়ারের উন্নতি ও সমৃদ্ধিকে বিসর্জন দিলাম।

এই কোর্সের একটি উদাহরণ ছিল এরকম।

একটি রেস্তোঁরার বুফেতে সালাদ ও  চিকেন রাখা আছে। সালাদ পছন্দ করে কিন্তু চিকেন অপছন্দ করে তেমন মানুষদের ওখানে পাঠানো হলে দেখা গেল অধিকাংশ মানুষের প্লেটে সালাদের চেয়ে চিকেনের পরিমাণ বেশী এবং খাওয়া শেষে দেখা গেল অধিকাংশ প্লেটে চিকেন উচ্ছিষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এর মানে হলো সালাদ-পছন্দ মানুষও টাকার হিসেবটা মাথায় রেখে প্লেট ভর্তি করেছিল, কেননা চিকেনের দাম সালাদের চেয়ে বেশী। জরিপে দেখা গেছে টাকার জন্য সুখ বিসর্জন দেয়া মানুষের অংশ প্রায় ৯৪%।

নিজেকে প্রশ্ন করি - অধিকাংশ মানুষের বিপরীত এবং অনিশ্চিত পথে হেঁটে আমি কী সুখী?

হ্যাঁ, এখনো পর্যন্ত সুখীই। ত..বু....... প্রা..ণ.... কেন কাঁদে রে?
উত্তর তেমন কঠিন নয়। দুঃখ জাগানিয়া বাঁশীর সুরও সুখী মানুষের বিনোদন!

[ঈষৎ সংক্ষেপিত]
----------------------------------------------------

**শিরোনাম কৃতজ্ঞতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

No comments: